অচেনা অতিথি - পর্ব ০৩ - সিজন ২ - নাফিসা মুনতাহা পরী - ধারাবাহিক গল্প


বাতাসি বিবি মাগরিবের নামায পড়ে ডাইনিংরুমে বসে চায়ের ভিতর বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছে আর টিভিতে "রুপবান" মুভিটা দেখছে। এই ছবি নিয়ে তার অনেক ইতিহাস রয়েছে। জিবনের প্রথম এই ছবি দেখাতে ইমতিয়াজ চেয়ারম্যান বাতাসি বিবিকে হলে নিয়ে গিয়েছিলেন। আহ্ কি সেই স্মৃতিময় সময়। সেই স্মৃতিময় সময়টা মনে পড়তেই বাতাসি বিবি তার আঁচল খানা দিয়ে চোখটা মুছতেই সাবিনা চিক্কুর দিয়ে কইলো-

~" অ আম্মা দেইখা যান, দাদী রুপবান ছবি দেইখ্যা কান্দাইয়া বুক ভাসাইতেছে। অ্যার বিশ্বাস, দাদা মরনের সময়ও দাদী এত্ত কান্দেনাই। এতো দেকছি বিনুদন বিনুদন...!"

সাবিনার কথা শুনে বাতাসি বিবি অত্যান্ত লজ্জা পেয়ে বসা থেকে উঠেই সাবিনার মুখ চেপে ধরলো। তারপর রাগে চোখমুখ আগুন করে বলল-

~"ঐ ছুড়ি তোর চোপা ভাঙ্গমু কিন্তু। তুই অ্যার সম্মান লইয়া টানা-হিচড়া করোস? তোর সাহসতো কম লয়!"

এমন সময় লাবীবা বেগমের আগমন। আম্মা সাবিনার মুখ চেপে ধরেছেন কেন! কি বলেছে ও???

লাবীবাকে দেখে বাতাসি সাবিনাকে ছেড়ে দিয়ে ঝাঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো- 

~" আইজ থ্যাইকা সাবিনার লগে অ্যার কোন সমন্ধ নাই। ওরে সেক্রেটারির খাতা থেকে নাম ক্যাইটা দিলাম। ছুড়ি বেশি কতা কয়।"

আই কথা কইলেই দোস! আন্নে যে রূপবান ছবি দেইকা কাইন্দা বুক ভাসাইছেন হেইডার বেলায়! সব অ্যার দোষ তাই না! কথাগুলো বলে ভরা বাজারে বাতাসির ঢোল পিটালো সাবিনা।

আম্মা আপনি কেঁদেছেন! লাবীবা চোখ বড় বড় করে তার শাশুড়ীর দিকে চাইলো। রুপালীও চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মায়ের কাছে এসে দেখলো, মায়ের চোখে সত্যিই পানি। এবার রুপালী আর চুপ করে থাকতে পারলোনা। সে চট করে বলেই ফেলল-

~" আম্মা, আপনি কাঁদতেও জানেন! কি অবাস্তব কথা?"

বাতাসির এবার মুখ দেখানো যেন দায় হয়ে পড়লো। কি দুক্কু, নিজের পরাণ খুলে কানতেও পারুমনা। রাগে ফুসতে ফুসতে যখন রুমের দিকে যাচ্ছিল বাতাসি তখন হঠাৎ নিসা এসে বলল-

~" সাবিনা, কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার নতুন করে কফি দে তো!"

বাতাসি নিসাকে দু'চোক্ষে দেখতে পারেনা। সমস্ত রাগ যেন নিসার উপর পড়লো। বাতাসি চিক্কুর দিয়ে কইল-

~" প্যালে লোচা লোচা, না প্যালে কুত্তার ভোচা। এত কি নবাবের বেটি আইচে তার জন্য বার বার ক্যাইলা চা দেওন লাগবো তারে! চা তো লয় যেন ক্যাইলা বিদেশী কুত্তার মুত খায়। আমাগো গোলাবের মুতও এর থ্যাইকা ঢের ফকফকা।"

ব্যস হয়ে গেল! এ যেন সাপ নেউলের লড়াই। সাবিনাতো হাতে জোড়ে জোড়ে দু'খান তালি বাজিয়ে বসে পড়লো সোফাতে। পিকচার অাভি বাঁকি হে ......! বাতাসি বনাম নিসা।

নিসা ফুসতে ফুসতে বাতাসির সামনে এসে বলল-

~" দেখেন দাদী! ভাষা ঠিক করেন বলে দিলাম। অসংগত ভাষায় আমার সাথে একদম বলবেননা। আমাকে তিতির পাননি যে, যা বলবেন তা মেনে নিব। ফার্দার যদি এমন কথা বলেছেন তাহলে বাবার কাছে নালিশ দিব।"

ভাবী! সাহেবরে নালিশ দিয়া কোন কাম নাই। দাদী তো হেরই মান সোলেমান রাখেনা। আপনি এক কাম করতে পারেন! মাহাদ ভাইজানের কাছে নালিশ দেন। হেই দাদীরে সোজা করবো। আর সাহেবরে তো দাদী মগা কয় মগা....! 
বুইড়া বয়সে যে মায়ের হাতে লাডির বারি খায় হেই আবার আন্নের কি বিচার করবো!
সাবিনা কথাগুলো বলেই জ্বিভে কামড় দেয়। এদিক ওদিক তাকাতেই লাবীবার দিকে চোখ পড়তেই সাবিনা ভয় পেয়ে যায়। স্বামীকে নিয়ে সে কোন কথা শুনতে চায়না।

লাবীবার এমন চাহোনী দেখে সাবিনা চট করে বসা থেকে উঠেই বাতাসি বিবির পিছনে গিয়ে দাড়ালো। তারপর বাতাসিকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল-

~" দাদী, জব্বর কথা কইছেন নিসা ভাবীরে। তার কত্ত বড় সাহস, আন্নের মুখের উপর তর্ক করে।"

সাবিনার কথা শুনে বাতাসি বিবি ভ্রু কুচকে বললো-

~" খাট্টাস্ মার্কা ছুড়ি। দু'মোখা মাইয়া কোন্টেকার! ফাজলামি শুরু করছোস! অ্যারে বোকা ভাবছোস? তোরে অ্যার দল থাইকা বাইর কইরা দিছি। অ্যার ঝগড়া আই একাই করতে পারুম!"

সাবিনাও সাথে সাথে মুখে ভ্যাংচি কেটে বললো-

~" পরে একবার ডাকেন শুধু! অ্যার আমু না।"

এদিকে নিসা ফুয়াদ কে কল দিয়ে ফেলেছে। ফুয়াদ কল রিসিভ করতেই নিসা কিছুটা জোড়েই বলল-

~" তোমার দাদীর অত্যাচারে আমি মনে হয় এই বাসায় বেশিদিন টিকতে পারবোনা। আমি মারা গেলেই বুঝি সে বেশি খুশি হবে।"

বেটি তুই মরবি! তোর মত খচ্চরের কাছে মরন আইতেও দু'বার ভাববো। অার তুই বাড়ীতে টিকবি না কি! টিইকাই তো বইয়া আছোস ছ্যাচড়া মাইয়া!

বাতাসি আর নিসার ভিতর এবার ঝগড়া বেঁধে গেল। না লাবীবা থামাতে পারে না রুপালী থামাতে পারে। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। বাতাসিও নিসাকে সাবান-সোডা বিহীন একেবারে ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়। বাতাসির সাথে লাগা! যদি নিসাকে নাই ধুয়ে দিতে পারে তাহলে বাতাসি এ জিবনে শিখলোটা কি! একটা মান-সম্মানের ব্যাপার আছেনা?


ডাক্তারগন গোলাবের চিকিৎসা করছে। প্রায় দু'ঘন্টা যাবত ভিজা শরীরেই মাহাদ দাড়িয়ে আছে পশু হসপিটালের ভিতরে। চুল দিয়ে টপটপ করে কয়েকফোটা জলও ঝড়ে পড়লো ওর ঘাড়ে। চাপা উত্তেজনায় মাহাদ অস্থির হয়ে পায়াচারী করছে আর আল্লাহ্ সুবহানাতালার কাছে বারবার প্রার্থনা করছে। আল্লাহ্ এবারের মত ওকে ঠিক করে দাও। আমি ওর দায়িত্ব আর কাউকে দিবোনা। আমি নিজেই ওর দেখাশোনা করবো। 
 
এমন সময় একজন রুম থেকে বের হয়ে এসে হাসি মুখে বললেন-

~" স্যার, আপনার কুকুরটাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। যা ধকল গেলোনা কুকুরের উপর দিয়ে? সে তো মারাই যাচ্ছিলো। হায়াত আছে বলে বেঁচে গেছে শেষ মুহুত্বেও।"

লোকটার কথা শুনে মাহাদ কিছুক্ষন স্থির চোখে চেয়ে রইলো  ওনার দিকে। তারপর বললো,
গোলাব আমার ছেলের মত তাই ওকে আমি পশু হিসাবে কখনোই বিবেচনা করিনা। আর আপনি যেই নাম উচ্চারন করেছেন সেটা আমি তার ক্ষেত্রে কোনদিনই ব্যবহার করিনি। যাইহোক, তাকে কি আমি নিয়ে যেতে পারবো? মাহাদ কথাগুলো শেষ করেই রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা না করে রুমের ভিতর যেতেই গোলাব কান দুটি খাড়া করেই মাহাদের দিকে তাকালো। তারপর ছোট কুকুর ছানাদের মত অদ্ভুদ শব্দ করতেই মাহাদ আরও কাছে গিয়ে ওর গায়ে হাত দিতেই সামনে থাকা দুটি ছেলে গোলাব কে ছেড়ে দিল। গোলাব ছাড়া পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে গা ঝাড়া দিয়েই মাহাদের বুকে দু'পা ঠেসে দাড়িয়ে মনে হয় কিছু বলার চেষ্টা করলো।

মাহাদ ওর কপালটা গোলাবের কপালের সাথে ঘেষিয়ে বলল-

~"  সমস্ত বিপদে-আপদে আল্লাহ্ তোকে আমার পাশে থাকার সৌভাগ্য দান করেছে। যতবার সমস্যায় পড়ি আগে তুই এগিয়ে আসিস। আর সেই তুই আমার কাছ থেকে চলে গেলে আমি থাকবো কেমন করে বাবা! চল আমরা বাড়ি যাবো।"

কথাগুলো বলে বুকের সাথে গোলাবকে আকড়ে ধরে ডক্টরকে বলল-

~" আমার  টাকাগুলো ভিজে গেছে। আপনাদের অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিন আমি টাকা পাঠিয়ে দিব।"

হসপিটালের ঝামেলা শেষ করে রাত ৯টার দিকে গোলাবকে নিয়ে বাসার পথে রওনা দিল মাহাদ। মাহাদ এখনো জানেনা সাদের কি অবস্থা? দুঃশ্চিন্তায় যেন সব ভুলতে বসেছে মাহাদ। তাই গাড়ীর গিয়ারটা বাড়িয়ে দিয়েই দ্রুত বাসার পথে সে চলে গেল।


কোন একটা কাজে মাহাদের সাথে দেখা করতে বাসায় ফুয়াদ এসেছিল।  এসেই সাদকে এমন পরিস্থিতে দেখতে পাবে সে কখনো কল্পনা করেনি। সাদের পেট থেকে পানি বের করা হয়েছে। খানিকটা সুস্থ সে। অক্সিজেনের মাস্ক লাগালো হয়েছে। ডাক্তারদের সাথে ফুয়াদ সাদের পাশে চিয়ার নিয়ে বসে আছে। কেমন শান্ত ভাবে সাদ সুয়ে আছে যেটা দেখতে ফুয়াদের মোটেও ভালো লাগছেনা। চোখে পানি চলে আসাতে রুম থেকে বের হতেই টপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়ে গেল। 
তিতিরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেনা ফুয়াদ। ওকে খুজতে গিয়েই দেখে ও জায়নামাযে বসে নামায পড়ছে। ফুয়াদ রুম থেকে বের হতেই দেখলো, মাহাদ গোলাবকে নিয়ে দ্রুত ডাইনিং রুমে ঢুকলো। নিজের বড় ভাইকে দেখে ও যেন চমকে উঠলো।  সাদ ঠিক আছেতো বলেই গোলাবকে ছেড়ে দিয়ে উপরে উঠতেই  ফুয়াদ ওর হাতটা ধরে ওকে শান্ত করে বলল-

~" মাহাদ এত বিচলিত কেন হচ্ছিস! সাদ ঠিক আছে।"

যতই সবাই বলুকনা কেন, সাদ ঠিক আছে। কিন্তু বাবার মন সে কি আর চুপ থাকতে পারে! দ্রুত রুমে ঢুকতেই দেখলো ডাক্তার সাদের মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলছে। সাদের জ্ঞান ফিরেছে। গোলাবই আগে সাদের কাছে চলে গেল। গোলাবকে দেখে সাদ শোয়া থেকে উঠে বসেই আদুরে স্বরে বলল-

~" ভাইয়া, আপনি কেমন আছেন?"

সাদের ভাষা যেন গোলাব এক মুহুত্বেই বুঝে নেয়। লাফ দিয়ে বেডে উঠেই সাদের গা ঘেষে বসে পড়েল। তারপর সাদের গায়ের সাথে নিজের মাথাটা হেলান দিয়ে ঘষতে লাগলো। 

মাহাদ আর ভিজা শরীর নিয়ে সাদের শরীরে হাত না দিয়ে রুম থেকে বের হতেই ফুয়াদ যেন একটু ভয় পেল। সাদ আর গোলাবের সাথে যা ঘটেছে সেটা সে এখানে এসে পুরোটাই শুনেছে। মাহাদের যা রাগ, তিতিরকে যদি কিছু বলে! মাহাদ শোন বলেই ফুয়াদ এগিয়ে গেল মাহাদের দিকে।

মাহাদ দাড়িয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই ফুয়াদ বলল-

~" মাহাদ, আমি বাসায় চলে যাব! একটা কাজে আসছিলাম কিন্তু সেটা থাক। পরে ফোনে তোকে সব জানাবো।"

কি বল! আমি এখন আসলাম আর তুমি বলছো চলে যাবে! আজকে থাকো! তুমি থাকলে আমাদের সবার ভাল লাগবে। তুমি থাকো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি বলে মাহাদ পা বাড়াতেই ফুয়াদ ওকে আবার আটকালো। 
ছোট মেয়েটা আমার জন্য অপেক্ষায় আছে। আমি না যাওয়া অবদি ঘুমাবেনা। অন্যদিন আসবো বলে মাহাদকে টেনে আবার সাদের কাছে নিয়ে যেতেই সাদ ফুয়াদকে সালাম দিতেই ফুয়াদ সালামের জবাব দিয়ে সাদকে কোলে নিয়ে বলল-

~" বাবা, আমিতো চলে যাচ্ছি! আপনি আমাদের বাসায় কবে যাবেন বলেন তো!"

সাদ ওর বাবার দিকে চেয়েই ফুয়াদের গালে একটা চুমা খেয়ে ফুয়াদের গলা দু'হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মন খারাপ করে  বলল-

~" বড় বাবা, আপনি এখুনি যাবেন? আমাদের সাথে থাকবেন না!"

হ্যাঁ বাবা, অন্য একদিন আসবো। তোমার জন্য চকলেট এনেছি  বলেই সাদকে খাটে বসিয়ে দিয়ে ওর হাত ভর্তি চকলেট দিল ফুয়াদ। 
তুমি ভালো থেক বাবা। আর দ্রুত সুস্থ হও। এবার আসার সময় তোমার আপুদের নিয়ে আসবো বলে সাদকে কয়েকটা কিস করে রুম থেকে বের হয়ে এল ফুয়াদ। সাথে ডক্টরও বের হয়ে মাহাদের সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে চলে গেল।

ফুয়াদকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল মাহাদ। যাওয়ার আগে ফুয়াদ মাহাদের হাত ধরে অনুরোধের স্বরে বলল,

~" তিতিরকে যেন কিছু বলিসনা। দেখ সবারই ভুল হয়। ও হয়ত ভুল করে ফেলেছে। তাছাড়া বিপদ কখন আসবে তা আমরা জানিনা। মাথা একটু ঠান্ডা রাখিস।"

মাহাদ কিছু বললোনা, শুধু নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে থেকে
ফুয়াদের চলে যাওয়া দেখলো।  ফুয়াদ চলে যেতেই মাহাদ ভিতরে চলে আসলো। এসে দেখলো তিতির সাদকে কোলে নিয়ে চুপ করে আছে। মাহাদ আর কিছু না বলে ওর রুমে চলে গেল। 


বাবা তুমি থাকো আমি একটু পর এসেই তোমাকে খাবার দিচ্ছি বলেই তিতির দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেল। তারপর নিজেদের রুমে এসে দেখলো, মাহাদ ওর ভেজা শার্টটা খুলছে। কিছুতো একটা ঘটবে সেটার সুযোগ করে দিয়ে তিতির দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর চুপ করে মাহাদের সামনে এসে দাড়িয়ে রইলো। মাহাদ তিতিরের দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ কাজ করছে।

এভাবে চুপ থাকলে সব কিছুর সমাধান হয়না তাই তিতির মাহাদ বলে ডাকতেই মাহাদ সামনের চেয়ারে এত জোড়ে একটা লাথি দিল যে, সেটা ছিটকে গিয়ে দুরে পড়ে গেল। ভয়ে তিতিরের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। মা..হা...দ বলে নিচু গলায় শব্দ করেই মাথা নিচে নামালো তিতির।

ওয়্যারড্রপের উপর কিছু সোপিজ ছিল। সেগুলো এক ঝটকায়ে নিচে ফেলে দিল মাহাদ। তারপর দ্রুত তিতিরের কাছে এসে ওর দু'বাহু শক্ত করে চেপে ধরে কঠিন স্বরে বলে উঠলো-

~" এতটা কেয়ারলেস তুমি হও কিভাবে? তোমাকে আমি কতবার বলেছি, সাদকে যেন বাহিরে যেতে না দেওয়া হয়। তাছাড়া ওকে একবার বললেই ও কখনো বাহিরে যেতনা। আর তুমি কি করেছ! ওকে নিষেধই করোনি। তুমি নিজের সন্তানকে সামলাতে পারোনা তাহলে তোমাকে দ্বারা কোন কাজটা হবে!"

মাহাদের চিৎকারময় কন্ঠে তিতির ভয়ে একদম চুপসে গেল। মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের করতে পারলোনা। কারন তিতির ভালো করেই জানে, একজন চিৎকার করলে অপর জনকে সম্পূর্ন চুপ থাকতে হয়। তাছাড়া, মাঝে মাঝে নিরবতা ঝগড়ার চেয়ে বেশি সমাধান বয়ে আনতে পারে।

তিতিরের এমন চুপ থাকা মাহাদকে আরও রাগান্বিত করে ফেলে। মাহাদ হিতাাহিত বোধটুকু হারিয়ে ফেলে তিতিরকে দেয়ালের সাথে ধরে গলাটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল-

~" এই তুই চুপ করে আছিস কেন! কথা বল আমার সাথে। অন্য সময় হলেতো কথার ঝড় তুলিস আর আমি কথা বললেই আমার সামনে চুপ করে থাকিস!
এতবড় ভুল তুই করিস কিভাবে!  তোর এই অপরাধের কোন অনুশোচনা নেই! কি মনে করিস নিজেকে! আমার কথার কি কোন দাম নেই তোর কাছে?"

তবুও তিতিরের মুখে কোন কথা নেই। কোন কথা বলার মুখও নেই ওর। ওর বুকের ভিতর যে কষ্ট হচ্ছে সেটা শুধু ও আর আল্লাহ্ সুবহানাতালা ভালো জানেন।

এত কথা বলার পরও যখন তিতির কিছু বললোনা তখন মাহাদ ওকে আরও শক্ত করে ধরেই বলল-

~" তোর ভাগ্য ভালো, আমার সন্তানরা সুস্থ আছে। সামান্য কোন ক্ষতি হলে তোকে আজই মাটিতে পুতে ফেলতাম।"

এমন সময় মা,মা বলে সাদ দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলো তিতিরকে। সাদের আওয়াজ শুনে মাহাদ একদম চুপ হয়ে গেল। সন্তানের সামনে ও কখনো তিতিরের সাথে আজ অবদি উচু গলায় কথা বলেনি। কারন সে কখনো চায়না তার সন্তান কোনদিনও শিখুক যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্য খারাপ সম্পর্ক বলেও কিছু সময় থাকে।

তিতির ঝটপট চোখের পানি মুছে দম নিয়ে নিজেকে সংযত করে বলে উঠলো-

~" বাবা, তুমি গোলাব ভাইয়াকে নিয়ে খাবার টেবিলে যাও। তোমার বাবা এখুনি ফ্রেস হয়ে তোমার কাছে যাচ্ছে। "

ঠিক আছে মা বলেই সাদ মনে হয় চলে গেল।

 মাহাদ আর কিছু না বলে তিতিরকে ছেড়ে দিয়ে রাগে গেঞ্জিটা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে মেরে ওয়াশরুমে চলে গেল।এবং খুব জোড়েই ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে  দিল। 

তিতির নিজেকে ঠিক করে মাহাদের শার্ট আর গেঞ্জি তুলে ভাঙ্গা কাচের টুকরোগুলো দ্রুত পরিষ্কার করল। তারপর পুরো রুম ঠিক করে সেখান থেকে বের হয়ে গেল। নিচে এসে দেখলো সাদ চিয়ারে বসে আছে। বেচারা টেবিলটাও হাতা পাচ্ছেনা। তিতির আর দেরী না করে জলদি সবার জন্য খাবার বেড়ে দিতেই মাহাদ দ্রুত নেমে আসে নিচে। মাহাদকে দেখেই গোলাব ওর খাবার খেতে লাগলো। মাহাদ সাদের দিকে চেয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসেই বলল-

~"  আমার বাবাটা এখন কেমন আছে?"

সাদ কিছু না বলে বাবার বুকের ভিতর ঢুকে চুপ করে রইলো। মাহাদ আর কথা না বাড়িয়ে ছেলেকে খাবার মুখে তুলে দিয়েই পিছন থেকে সাদের গালে একটা চুমা খেল। সাদ নিঃশ্চুপে খাওয়া শেষ করতেই তিতির ওকে নিয়ে উপরে চলে গেল।

ওরা চলে যেতেই মাহাদ আর না খেয়ে উঠতেই টিয়া বলল-

~" ভাইজান খাবেন না!"

~" নাহ্, তুই খেয়ে সব তুলে ফেল।"

~" আপাও খাবেনা?"

মাহাদ এবার রেগে গিয়ে টিয়ার দিকে তাকাতেই টিয়া ভয় পেয়ে গেল। আর মুখ দিয়ে একটা কথাও বের করতে পারলোনা। ভয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো। মাহাদ আর এক মুহুত্বও দেরী না করে রুমে চলে গেল।


দীর্ঘ সময় হয়ে যায় কিন্তু তিতির রুমে আর আসেনা। অতিথী দোলনায় সুয়ে আছে। মেয়েকে অনেক চেষ্টা করে ঘুমিয়ে দেয় মাহাদ। কিন্তু এখনো তিতির আসেনা। মাহাদ যেন অস্থির হয়ে যায়। এখনো কি সাদ ঘুমাইনি? 

সাদ আর গোলাব আলাদা রুমে ঘুমায়। ওরা ঘুমিয়ে পড়লে তিতির নিজের রুমে চলে আসে। কিন্তু আজ অনেক আগেই সাদ ঘুমিয়ে পড়েছে তিতিরের কোলে কিন্তু তিতির তবুও মাহাদের কাছে যাচ্ছেনা। তিতিরের কোমড় ঘেষেঁ গোলাবও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘড়িতে প্রায় রাত ১টা বাজা বাজা অবস্থা। মাহাদ এতক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে না পড়েনি! এসব ভাবতে ভাবতেই সাদকে  বিছানায় সুয়ে দিয়ে আলতো করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে দেখলো, ডাইনিংরুমে ড্রিম লাইট জ্বলছে। তারমানে টিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। মাহাদ যে রাতে খায়নি সেটা তিতির ভাল করেই জানে। বাসায় থাকা অবস্থায় মাহাদ তিতিরকে ছাড়া কখনোই খাবার মুখে তুলবেনা। একরাশ খারাপ লাগা এসে মনে ভিড় জমাতে লাগলো তিতিরের। 

তিতির ধীর পায়ে আস্তে করে দরজা খুলে রুমে এসে দেখলো, মাহাদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমন্ত মাহাদের মুখটা দেখেই তিতির মনে মনে বলল-

~♥ মহান আল্লাহ্ সুবহানাতালা  স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নেতা হিসাবে নির্বাচন করেছেন স্বামীকে।
তাই আমার সবসময় মনে রাখা উচিত, স্বামীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সবচেয়ে সুন্দর উপায় হলো তাকে সম্মান করা। 
আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য, ঝগড়া-বিবাদ কটু কথা হতেই পারে। তবে দিন শেষে প্রাপ্য সম্মানটা যে শুধু তারই.......♥"

তিতির লাইটা অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে মাহাদের কাছে গেল। আবছা আলোতে অনেকক্ষণ মাহাদের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আর কিছু না বলে একটু দুরুত্ব রেখে মাহাদের পাশে সুয়ে পড়লো। 

তিতির সুয়ে পড়তেই মাহাদ চোখ খুললো। মাহাদ এখনো ঘুমাইনি। তিতির রুমে ঢুকতেই স্বাভাবিক ভাবে ও চোখ বন্ধ করে রাখে। যাতে তিতির ভাবে ও ঘুমিয়ে পড়েছে। এভাবে আরও ঘন্টা দুয়েক কেটে যায়। 

রাত যখন ৩টা ছুই ছুই তখন তিতির পাশ ফিরে দেখলো মাহাদ ওপাশ হয়ে সুয়ে আছে।  তিতির আরও একটু এগিয়ে গেল মাহাদের দিকে। তারপর ওর হাতটা আস্তে আস্তে মাহাদের শরীরে ছোয়াতেই মাহাদ সামান্যই নড়ে উঠলো। সাথে সাথে তিতির ওভাবেই চুপ করে রইল এবং চোখটা বন্ধ করলো। তিতির এমন ভ্যান করলো যেন মনে হয় ও ঘুমের ভিতর মাহাদের গায়ে হাত তুলে দিয়েছে। তারপর আরো কিছুক্ষন চুপ করে রইল তিতির। আবার ও চোখ খুলে পিছন দিক থেকে ধীরে ধীরে  ওর হাতের ভিতর মাহাদের হাত নিতেই চট করে মাহাদ চোখ খুলল......। তিতির জানতেই পারলোনা মাহাদ এখনো জেগে আছে। তাই তিতির আরো কাছে যেতেই মাহাদ শক্ত করে ওর হাতটা চেপে ধরলো। এমন অচমকা কান্ডে তিতিরের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। মাহাদ সাথে সাথে ঐ অবস্থায় পাশ ফিরে তিতিরের দিকে কঠিন চোখে চাইতেই তিতির স্থির হয়ে যায়। এ যেন শিকার  শিকারীর কাছে স্ব-ইচ্ছায় ছোবল খাওয়ার মত অবস্থা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন