০১!!
বাইরে বিশাল কমলা রঙা সূর্যটা ডুবিডুবি করছে। আর সেই সাথেই গোধূলির আবছা আলো আধাঁরির খেলা ধীরে ধীরে বাড়ছে। একটু পরেই কমলা রঙের সূর্যটা ডুব দেবে নিকষ কালো অন্ধকারে। বাইরের এই আলো আধাঁরির সাথে মিল রেখেই নরম একটা আলো জ্বলছে রুমটাতে। চারপাশে বিশাল বিশাল বিল্ডিংয়ের ফাঁকে গোধূলির আলো আধাঁরিটা রুম পর্যন্ত এসে পৌঁছাচ্ছে না। তাই নিয়ন বাতির আলোতে ঘরটা জ্বলজ্বল করলেও কৃত্রিমতাটা যেন থেকেই যাচ্ছে। এই কৃত্রিমতায় চোখ ধাঁধানো আলো থাকলেও কোথাও একটা ঘুটঘুটে আঁধার আজীবনের জন্যই যেন রয়ে গেছে।
এই নিয়ন বাতিরই ঝলমলে আলোতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে চোখে মোটা করে কাজল আঁকছে মাইশা। বড্ড বেশি বেখাপ্পা লাগছে নিজেকে ওর এই মূহুর্তে। সেদিনের সেই নীল রঙা শাড়ি পড়েছে আজও। চোখে সেদিনের সেই কালো কাজল। তবে সেদিনের মতো বোধহয় এতো যত্ন করে পড়া হয় নি কাজলটা আজ। তাই হয়তো কোথাও মোটা কোথাও একটু সরু হয়ে গেছে কাজলটা। সেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না ও আজকে। সেদিনের মতো হাত ভর্তি লাল চুড়িও পড়েছে। সাথে লাল রঙা টিপ, লাল পাথরের ঝুল কানের দুল, গলায় লাল রঙা পাথর ঝুলানো একটা চেইন। আজকে শুধু চুলটা সেদিনের মতো ছেড়ে দেয়নি মাইশা। একটু আগে মা যত্ন করে বেঁধে দিয়েছে। লম্বা চুলগুলোকে সমানের দিকে পাফ করে ফুলিয়ে খোপা করে। লম্বা খোলা চুলের দিকে মাদকতার ঘোর লাগা চোখে চেয়ে থাকা সেই মানুষটার জন্য তো সাজে নি আজ। তাই মাকে বারণও করেনি সেদিনের মতো।
চুলের স্টাইলটার সাথে আজ যে দেখার মানুষটাও বদলে গেছে। আজ কার জন্য সাজছে মাইশা নিজেই জানে না। হবে হয়তো কেউ একজন। তাদের পছন্দ হলে সারাজীবন হয়তো এই নতুন একজনের পছন্দ মতো সাজতে হবে ওকে। হয়তো চুলটা আর খোলা এলোমেলো করে রাখতে পারবে না। হয়তো নীল রঙা শাড়ি পড়ার অধিকারটাও আর থাকবে না৷ হয়তো হাতে লাল কাঁচের রেশমি চুড়ি আর গলায়-কানে প্রিয় অর্নামেন্টের বদলে ঠাঁই হবে ভারি কোন গহনার। হয়তো--------। এতো হয়তো নিয়ে ভাবতে বসে কি আর হবে এখন? যাক গে সেসব কথা।
সেই কবে সূর্যটা ডুবেছে। বোধ হয় আজ পূর্ণিমা। গোল থালার মতো চাঁদটা ঝলমলে আলো ছড়াচ্ছে বাইরে। রুমের নিয়ন বাতিটা বন্ধ করে দিলো মাইশা। সেদিনের মতো করে যত্ন করে সাজেনি আজ সে। তাই বারবার সাজ ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য বাতি জ্বেলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি হবে? কি হবে ঢিপঢিপে বুকে কারো অপেক্ষা করে? কি হবে কাউকে নিয়ে বেখেয়ালি স্বপ্ন বুনে?শাড়িটাও আজ ঠিক করে পড়া হয়নি বোধ হয়। বারবার পেঁচিয়ে যাচ্ছে৷ মনে হচ্ছে এই বুঝি হোঁচট খাবে মাইশা। তবে মাইশা হোঁচট খায় না। মাইশাদের হোঁচট খেতে নেই। তাদের সামলে চলতে হয়, সামলে বলতে হয়, প্রিয়জনগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও মাইশাদের হাসি মুখে দাঁড়াতে হয় ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে।
ইন্টারভিউ বোর্ডই তো! কি পারেন, কি করেন, কি খান, কি পড়েন, কোথায় যান, কেন যান, কত্তো কত্তো প্রশ্ন! একবার ফেল তো- ফেল!!
মাইশার খুব ইচ্ছে করছে চাঁদের সাথে গল্প করার। চাঁদটা আজ ভিষণ খুশি। তাকে আজ মাইশার মন খারাপের কথা বললেও সে মন খারাপ করবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু বলা যাবে না। সময় নেই। যেকোন মূহুর্তে ডাক পড়বে। ইন্টারভিউের জন্য।।
নিয়নের বাতিটা জ্বলে উঠেছে রুমের। এবার যেতে হবে। ডাক পড়েছে। বারান্দা থেকে রুমে এসে ঢুকে মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো ও। মা তীক্ষ্ণ চোখে মাইশার দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝার চেষ্টা করলেন। মাইশা মাথা নেড়ে জানালো কিছু হয়নি। চিন্তা না করতে।।
-চল মাইশু? তোর বাবা ডাকছে---।
-চলো, মা।
-তুই ঠিক আছিস মাইশা মা?
-হ্যাঁ মা। একদম ঠিক আছি---। চলো??
মায়ের সাথে ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হতে চললো মাইশা। চা-নাস্তা সব দেয়া হয়ে গেছে। মাইশাকে কিছু করতে হবে না। শুধু যাবে। সবাইকে একটা সালাম করবে। তারপর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তার জবাব দিবে। নয়তো চুপ করে বসে থাকবে। এই হলো কাজ।। জাস্ট এইটুকুই। রুম থেকে ড্রয়িং রুমে যেতে সেদিন মনে হয়েছিল সময়টা কাটছেই না। আর আজ মনে হচ্ছে সময়টা এখানেই থেমে যায় না কেন!?
সবাইকে লম্বা করে একটা সালাম দিলো মাইশা। সবাই বলতে চারজন মানুষ এসেছেন তারা। আর মাইশার বাবা বসা তাদের সাথে। ১৬/১৭ বছরের মেয়েটা সরে বসে মাইশাকে জায়গা করে দিলো বসার। মিষ্টি চেহারা মেয়েটার। ওর সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে মাইশার৷ এখন ব্যাপারটা সম্ভব না।কখনোই সম্ভব কিনা কে জানে!?
-মা কি নাম তোমার?
- জি মাইশা তাসনুভা।
-মাশাল্লাহ সুন্দর নাম। কিসে পড়ো মা?
-অনার্স ফাইনাল ইয়ারে।
-পরীক্ষা কবে মা তোমার?
-জি! জুলাই মাসে।
-সেকি! ৩ মাস পরেই তো পরীক্ষা। পড়াশোনা কেমন চলছে মা?
-জি ভালো।।
-এই যে আমার মেয়ে মেহের, ইন্টারে উঠেছে এই বছরই। আর এই যে আমার ছেলে ধ্রুব। এইচ আর পি নামে মাল্টিন্যাশনাল একটা কোম্পানিতে জব করে। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আর এই দেখছো তোমার আন্টি আর আমি বুড়ো বুড়ি--৷ হা হা হা। এই চারজনের ছোট্ট সংসার। ----। তা ভাই সাহেব এরা একটু কথা বলে নিক। কি বলেন?
বাবা হাসিহাসি মুখ করে মাকে বললেন মাইশার রুমে বসতে দিতে। মেহেরও চললো ওদের সাথে। মেয়েটা খুব মিষ্টি।সেই কখন থেকে মাইশার হাত ধরে বসে ছিল। এখন টুকটুক করে ওর সাথে সাথে চলছে। মাইশাও ওর সাথে একটা দুটো কথা বলছে। আর ভাবছেঃ-
এটা কি হলো? রান্না পারো কিনা, কি রাধঁতে পারো, হেঁটে দেখাও, গেয়ে শুনাও, এসব প্রশ্ন কি সত্যিই শুনে নি ও? নাকি কেবলই তার কল্পনা এসব? বাস্তবে কি এসব আসলেই ঘটছে? নাকি সে স্বপ্ন দেখছে!
০২!!
তালঘোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব মাইশার। আচ্ছা? একটা চিমটি কেটে দেখলে কেমন হয়? নিজেকে চিমটি কাটলে যদি ব্যথা পায় তাহলে বুঝবে জেগেই আছে। আর যদি ঘুমিয়ে থাকে? এখনই ঘুমটা ভেঙে যাবে। হয়তো আর কিছুই থাকবে না। এই মিষ্টি মেয়েটাও থাকবে না। গুটিগুটি পায়ে মাইশার সাথে বকবক করতে করতে যাবে না আর। হয়তো এই মানুষটা থাকবে না যাকে এখনো দেখাই হলো না। একটা মানুষ সামনে থাকলেও কিভাবে যে তাকে না দেখে থাকা যায় সেটার ব্যাপারে ও নিশ্চয়ই কোন একদিন ছোটখাটো একটা বই লিখতে পারবে। এসব ভাবতে ভাবতেই হাঁটছে মাইশা। কিছু একটাতে পা জড়িয়ে গিয়ে হোঁচট খেল হঠাৎ। তাড়াতাড়ি সামলেও নিতে পারলো নিজেকে৷ কেউ একজন হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেছিল বলে। নইলে কি যে বিশ্রি একটা ঘটনা ঘটতো! উফ--!
তবে এটা কি হলো? বারান্দায় কখন আসলো ও? আর হাতটা এখন আর কেউ ধরে নেই কেন? আসলেই কি স্বপ্ন দেখেছে সে এতোক্ষণ? কেউ কি আসে নি তাহলে? মুখটা তুলে সামনে তাকাতে ধাক্কা মতোন খেল মাইশা। অসম্ভব সুন্দর একজন মানুষ সামনে দাঁড়ানো। সুন্দর বললে কম বলা হবে৷ শুধু যে ফর্সা গোল গাল মুখ- তেমনটা নয়। তবে তার চেহারায় কিছু একটা আছে। কোন এক মায়ায় ভরা মুখটা। কিছু একটার নেশা লাগানো দৃষ্টি চোখ দুটোয়। কি আছে এই মুখটাতে!! সেটা বুঝতে না পেরে মাইশা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মানুষটার মুখের দিকে! চিনতেও পারলো না মানুষটা কে।।
-আপনি?
-আমি ধ্রুব---। তা ভাবা শেষ হলো আপনার? নাকি আরো কিছু ভাবা বাকি আছে?
-জি?
-কিছু না--। তো এতো মগ্ন হয়ে কি এতো ভাবছিলেন?
- আপনি কি সত্যি আছেন? নাকি আমি---? না মানে---।
-হা হা হা। কি বলেন? আছি মানে জ্বলজ্যান্ত আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি--। বিশ্বাস হয় না?
-তো মেহের?
-মেহের তো আপনার আম্মুর সাথে ড্রইং রুমে চলে গেলো সেই কখন---।
-ও----।
-বিশ্বাস না হলে ছুঁয়ে দেখুন---।
-হুম?
-হুম। সত্যি--। তাতে যদি আপনার মনে হয় এটা স্বপ্ন না। বাস্তব---।
লোকটা অনেক সুন্দর করে কথা বলে কি করে! চোখ দুটোয় কিছু একটা কাছে তার। মায়ামায়া চেহারা, টানাটানা চোখ, ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। তবে চোখেমুখে ছল চাতুরীর টাইপের কোন কিছু চোখে পড়ছে না মাইশার। লোকে নাকি মুখোশ পড়তে পারে ভালোমানুষির। এ ও কি সেই রকম! তবে মুখটা দেখে কেন জানি শান্তি শান্তি লাগছে। অন্যরকম একটা প্রশান্তি ফুটে উঠেছে মানুষটার চেহারায়। সেখানে ছলনার কোন ছিটেফোঁটাও নেই।।
-এভাবে কি দেখছেন? এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না???
-হচ্ছে।
-আপনি কি সারাদিনই এভাবে বসে বসে ভাবতেই থাকেন? না মানে মনে হচ্ছে ভাবনা ব্যাপারটা নিয়ে আপনি মিনি পি.এইচ.ডি করে ফেলেছেন এতোদিনে-।
-কি!
-ফুল আপনার খুব পছন্দ তাই না?
-হুম--। কি করে বুঝলেন?
-এই যে আপনার বারান্দায় অনেক রকমের ফুলের গাছ। বেশ অনেক ফুলই ফুটেছে। সবচেয়ে সুন্দর ফুল কোনটা জানেন এখানে?
-কোনটা?
-ওই যে নীল অপরাজিতা ফুলটা। নীলকণ্ঠ ও বলে অবশ্য ফুলটাকে। আমার সবচেয়ে পছন্দের একটা ফুল। কিন্তু আমার বাগানে কিছুতেই হয় না---।
-ওহ আচ্ছা---।
-অবশ্য এর চাইতেও সুন্দর কিছু এখানে আছে---।
-কি!
-বললে হয় রাগ করবেন নয়তো লজ্জা পাবেন----।
কথাটা বলতে বলতেই ধ্রুবের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো। ধ্রুব ফুলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল। আর মাইশা ধ্রুবের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।কথাটা শোনামাত্রই কেন জানি লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে তাকালো মাইশা। লোকটা বড্ড বেশি ফাজিল তো! মনে হচ্ছে না আজই তাদের প্রথম আলাপ।বহুদিনের পরিচিত মানুষের মতো কথা বলছে। দুষ্টুমি করছে। মানুষটার সাথে কথা বলে এই কয়দিনের মন খারাপ করা সমস্ত ঘটনা যেন নিমিষেই ভুলে গেল মাইশা।
মাইশার মা দুজনকে একবার ডেকে চলে গেলেন। ধ্রুব যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে কি মনে করে আবার পিছনে ফিরে মাইশার কাছে আসলো।
-আপনার চোখে আঁকাবাঁকা করা কাজলটাও বেশ মানিয়েছে--। একটা কথা জানেন? এখন মনে হচ্ছে আমার প্রিয় ফুলটা আমার বাগানে না ফুটে বেশ ভালোই হয়েছে---। ফুলটা ফোটানোর দায়িত্ব হয়তো কেউ একজন নিতে পারবে----।
কথাটা বলে লোকটা আর দাঁড়ালো না। মাইশা হা করে তার চলে যাওয়া দেখলো। কি বলে গেলো লোকটা! চিন্তাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে মাইশার। এরা সবাই এতো ভালো! নাকি ভালোমানুষির নাটক করছে? পাঁচটা বছর একটা মানুষকে ভালোবেসেও তাকে চিনতে পারে নি মাইশা। আজ হুট করে আসা এই মানুষগুলোকে কি করে চিনবে?