!!৬৫!!
বইগুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কান্নার দমকে শরীর কাঁপছে সূচনার। নুসরাত পানি নিয়ে এসে পাশে দাঁড়ায়। আদিল পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে সূচনাকে পানি খাওয়ায়। কয়েক ঢোক পানি গিলে কিছুটা ধাতস্থ হয় সূচনা। হঠাৎ করে আদিলের সামনে এতটা ইমোশোনাল হয়ে পড়ায় নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। এখনও তার চোখের কার্ণিশে নোনা জল থৈ থৈ করছে। নুসরাত ফ্লোর থেকে বইগুলো তুলে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখে। সূচনাকে নিয়ে বসায় সোফায়। নিজেও গা ঘেঁষে বসে আদুরেস্বরে জিজ্ঞেস করে,'কী হয়েছে সূচনা? কোনো সমস্যা?'
সূচনা ইশারায় খাতা আর কলম চায়। নুসরাত উঠে যায় নিজের রুমে। এদিকে এক পলকে আদিল চেয়ে আছে সূচনার দিকে। নতজানু হয়ে বসে থাকা সূচনাকে দেখে তার বুকের ভেতর থেকে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অমন সুন্দর মুখখানায় হাসির বদলে চোখের জল কেন? ঘোরতর কোনো সমস্যা হয়েছে কি? সঠিকভাবে কোনো কিছু না জানা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না সে। নুসরাত খাতা এবং কলম নিয়ে ফিরে এসেছে। সূচনা বাম হাতে চোখের পানি মুছে খাতায় লিখে,'আমার মাকে একটু ফোন দিয়ে বলো ঢাকায় আসতে। যদি জিজ্ঞেস করে কেন, তাহলে বলবে আমি আসতে বলেছি। খুব জরুরী কথা আছে। কালকেই যেন বাবাকে নিয়ে চলে আসে।'
লেখাটুকু পড়ে নুসরাত পালটা আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না। সূচনার ফোন থেকে মাকে ফোন করে লিখে দেওয়া কথাগুলোই বলল। হঠাৎ জরুরী তলব পাওয়ায় মায়ের মাঝে উৎকণ্ঠা, ভয় কাজ করছিল। নুসরাত এখানে বুদ্ধিমতীর মতো পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে; যদিও সে জানে না আসল কাহিনিটা কী! সে মাকে আশ্বস্ত করে বলেছে,'কিছুই হয়নি। অনেক দিন দেখা হয় না তাই মন কেমন করছে।'
ফোন রাখার পর নুসরাত জিজ্ঞেস করে,'কী হয়েছে বলো তো এবার? আঙ্কেল-আন্টিকে আসতে বলেছ কেন?'
সূচনা খাতায় লিখল,'পরে বলব। আর একটা উপকার করতে পারবে?'
নুসরাত জিজ্ঞেস করল,'কী?'
অনেকক্ষণ ইতস্তত করে সূচনা লিখল,'আব্বু-আম্মুকে দুইটা দিন তোমাদের বাসায় থাকতে দেবে? শুধু মা আসলে হোস্টেলেই রাখতে পারতাম। কিন্তু গ্রামে বাবাকে একা রেখে আসবে কীভাবে? কেউ তো নেই যে বাবাকে দেখবে। আর জানোই তো, বাবা কথা বলতে পারে না। চাচার বাসায়ও একটু সমস্যা। নয়তো ওরা ঢাকায় এসে চাচার বাসাতেই উঠতে পারত।'
লেখাটুকু পড়ে সাথে সাথে নুসরাত বলল,'আরে কোনো সমস্যাই নেই। নিশ্চিন্তে তারা এখানে থাকতে পারবে। তুমি চিন্তা করো না।'
সূচনার লেখা আদিল পড়েনি। তবে নুসরাতের উত্তর শুনেই সারসংক্ষেপ যা বোঝার বুঝতে পেরেছে। এখানে সে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। বড্ড বেশি মায়া হচ্ছিল সূচনার জন্য। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছাও বারংবার মনের ভেতর ডাল-পালা মেলে জাগ্রত হয়ে উঠছিল। ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরতে। এমন কী কষ্ট তার? কেন সে কাঁদবে এভাবে?
নুসরাত সূচনাকে বলল,'বসো। আমি আসতেছি।'
সে কিচেনে যায় হালকা কিছু খাবার আনতে। আদিলের সামনে বসে থাকতে সূচনার অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল খুব। তাই সে একদম গাঁট হয়ে বসে থাকে। কোনো দিকেই তাকায় না। তবুও সে ঢের বুঝতে পারছে আদিল যে পলকহীনভাবে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। সে এই অস্বস্তি নিয়ে আর বসে থাকতে পারছিল না। ওদিকে ভূমি হোস্টেলে রয়েছে। তার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। চট করে সে পূণরায় সেন্টার টেবিল থেকে খাতা আর কলম তুলে নিল। লিখল,'নুসরাতকে বলবেন আমি চলে আচ্ছি। আপু হোস্টেলে একা আছে। দেরি করা চলবে না। আর কালকে আমি কলেজেও যাচ্ছি না।'
লেখাটা শেষ করে সে খাতাটি আদিলের সামনে রাখে। সেন্টার টেবিল থেকে নিজের বইগুলো নিয়ে দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। এক পলকে ভাবনাবিহীন তাকিয়ে থাকার ফলে আদিল তৎক্ষণাৎ কিছুই বুঝতে উঠতে পারল না। আহম্মকের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খাতার লেখাটুকু পড়ল। এরপর দৌঁড়ে সে বাইরে এলো। ততক্ষণে সূচনা রিকশায় উঠে বসেছে। তাকে আর আটকানো গেল না। মেয়েটা চলেই গেল! 'তবে এ যাওয়াই শেষ যাওয়া নয়। আপনাকে তো একেবারের জন্যই আমার কাছে নিয়ে আসব।' মনে মনে স্বগতোক্তি করল সে।
!!৬৬!!
এক হাত ডেস্কের ওপর রেখে, হাতের তালুতে মাথা ভর দিয়ে চেয়ারে বসে আছে রাসেল। তার অন্য হাতে কলম। ভাবলেশহীনভাবে সে কলমটি দু'আঙুলের সাহায্যে ঘোরাচ্ছে। ডেস্কের ওপর বেশকিছু ফাইল। ফাইলে চোখ বুলালেও তার চিন্তা-চেতনা সব এখন দুজন রমণীকে ঘিরে। এক সুমি; যাকে সে ভালোবাসি বলে দাবী করে। দুই ভূমি; যে কাগজে-কলমে, আইন মোতাবেক তার স্ত্রী। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল যে কোনো কিছু স্থিরভাবে বোঝার সময়ই পেল না। নাকি পেয়েছিল? হতে পারে সে-ই সময়কে কাজে লাগায়নি।
কলম ডেস্কের ওপর রেখে, ওপরে দু'হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙে। চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে ভাবতে থাকে বেশ কিছু বিষয়। ভূমি কি এতক্ষণে দেশে ফিরে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে? তাহলে এখনও কেউ কেন তার সাথে কোনো যোগাযোগ করল না? সে জানে ভূমির বাবা ছাপোষা মানুষ। রাসেলের বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা তার নেই। তবে ভূমি শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে যদি চাইলেও অনেক কিছুই করতে পারে তবে সে করবে না। রাসেল এটা ভালোমতো জানে বলেই ভূমিকে নিয়ে তার আশঙ্কা শুরু থেকেই কম ছিল। তার কিঞ্চিৎ ভয় শুধু ভূমির বড়ো চাচাকে নিয়ে। লোকটার টাকা-পয়সা, নামধাম, ক্ষমতা সবই আছে। তার ছেলে জারিফ সেও বেশ রগচটা স্বভাবের। এ দুজন বিষয়টা এত সহজভাবে কি মেনে নেবে? এমনটা তো মনে হয় না। যাক, এসব চিন্তা-ভাবনা পরে। ভূমি যখন চলে গেছে, তখন সেও রাসেলের সাথে থাকতে চায় না এটাই তো স্পষ্ট। অতএব দুজনই যখন দুজনের সাথে আর থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন সেখানে অন্য কেউ ঝামেলা পাকানোর কে?
তার মাথায় আরও একটা দুশ্চিন্তা জোড়ালোভাবে চেপে বসে। আর এই ভয়টাই তার সবচেয়ে বেশি। ভয়টা হচ্ছে সুমিকে নিয়ে। সুমিকে হারানোর ভয়। মেয়েটা তো জানে না, রাসেল বিবাহিত। সম্পর্কের শুরুটাই ছিল মিথ্যা দিয়ে। মিথ্যের আড়ালে যেই সত্যিটা লুকিয়ে আছে সেটা জানার পর যদি সুমি তাকে ছেড়ে দেয়? সত্য আজ নয় কাল ঠিকই সামনে চলে আসবে এ কথা অস্বীকার করার জো নেই কোনো মানুষের। অন্তত রাসেল তো এটা বিশ্বাস করে। সুমিকে হারালে তো সে নিঃস্ব হয়ে যাবে। আচ্ছা এমনটা হলে কেমন হয়? রাসেল যদি নিজে থেকেই সব সত্যিটা জানিয়ে দেয়? সুমি নিশ্চয়ই বুঝবে। সেও তো সুমির চোখে তার জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছে। ভালোবাসার টানে হলেও সুমি তাকে বুঝবে। নিশ্চয়ই বুঝবে। তবে তার আগে, ভূমির সাথে অফিশিয়ালি ডিভোর্সটা হতে হবে। তারপর ঠান্ডা মাথায় সুমিকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে সে। এরপর আর বেশি দেরি করবে না। সারা জীবনের জন্য সুমিকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। নিজের বউ বানিয়ে।
!!৬৭!!
নুসরাতদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে সেই যে ভূমির পাশে বসেছে আর ওঠেনি সূচনা। বোনের চুলে আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কোনো দুশ্চিন্তার ছাঁপ নেই। সব কার্যসিদ্ধি ঘুমের ওষুধের। সন্ধ্যের দিকে ভূমিকার ঘুম ভাঙে। নিভু নিভু দৃষ্টিতে সে তাকায়। ধীরে-সুস্থে শোয়া থেকে উঠে বসে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে ঘুমের রেশ কাটানোর চেষ্টা করে। আচমকা মনে পড়ে যায় রাসেলের কথা। বুকের চিনচিনে ব্যথাটা আবারও শুরু হয়েছে। আবারও তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কী যে এক ভয়াবহ যন্ত্রণার মাঝে সে জীবন্ত লাশ হয়ে ধরণীর বুকে আছে, সেটি সে ব্যতীত আর কেউ জানে না।
সূচনা আলতো করে ভূমির পিঠে হাত বুলায়। এতক্ষণে ভূমির হুঁশ আসে, সে আর আমেরিকায় নয়ং; বরং বাংলাদেশে। ভারী নিঃশ্বাসে তার বুক ওঠানামা করছে। সে সূচনার কোলে মাথা পেতে শুয়ে পড়ে। বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে প্রথমে। পরক্ষণেই হাউমাউ করে কান্না করে। সূচনার জামার অংশ খাঁমচে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,'আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে রে সূচনা! ঐ মানুষটাকে ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারছি না। তার ঐ আঘাতের কথাও আমি ভুলতে পারছি না। বুকের ভেতরটায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে রে বোন। আমি বোধ হয় আর বাঁচব না রে সোনা আর বাঁচব না! তুই আব্বু-আম্মুকে আসতে বল। আমি শেষবার ওদেরকে একবার দেখতে চাই।' কেঁদে কেঁদে সে আরও অনেক কথা বলে, যেগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে আসছিল। সূচনা বোনের মাথার ওপর গাল ঢেকিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে। সেও কাঁদতে থাকে নিরবে। সে মনে মনে আল্লাহ্'র কাছে দু'আ করে আল্লাহ্ যেন তার বোনের সকল কষ্ট তাকে দিয়ে দেয়, তবুও যেন তার বোনটা ভালো থাকে।
এভাবে কতকক্ষণ কেটে যায়। সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিট, মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টা। ফাতেমা অফিস থেকে এসে ওদের দু'বোনকে এভাবে কাঁদতে দেখে চমকে যায়। ভূমিকাকে এখানে দেখে বেশ অবাকও হয়েছে। সূচনা তো ওর আসার কথা কিছু বলেনি আগে থেকে। অজানা পরিস্থিতিতে তার কী বলা উচিত অথবা কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। সে নিশ্চুপ পায়ে হেঁটে গিয়ে নিজের বিছানার ওপর ভ্যানিটিব্যাগ রাখল। তার উপস্থিতি পেয়ে দু'বোন-ই যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। ভূমিকা মাঝে মাঝেই ফুঁপিয়ে উঠছিল। সে ওয়াশরুমে চলে যায়। তখন ফাতেমা সূচনাকে জিজ্ঞেস করে,'তোর বোন আজই এসেছে?'
সূচনা মাথা ঝাঁকায়। ফাতেমা পূণরায় জিজ্ঞেস করে,'তোরা কাঁদছিলি কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?'
সূচনা নিরবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। তখনই ভূমিকা ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসায় এই ব্যাপারে কথোপকথন আর এগোলো না। ভূমিকা নিজেই ফাতেমাকে বলল,'আপনি নিশ্চয়ই ফাতেমা খালামনি?'
ফাতেমার ওষ্ঠে হাসি ফুঁটে ওঠে। সে বলে,'হ্যাঁ। কেমন আছো তুমি?'
'আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি কেমন আছেন?'
'আমি তো ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ্। কিন্তু তোমায় দেখে তো মনে হচ্ছে না তুমি ভালো আছো।'
এ কথার পিঠে ভূমিকা আর কিছু বলল না। ফাতেমাও প্রসঙ্গটা আপাতত বন্ধ রেখে ব্যাগ থেকে খাবার বের করে। আসার সময়ে সে দু'প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে এসেছিল।
'আমি জানতাম না তুমি এসেছ, তাহলে তিন প্যাকেটই আনতাম।' বিরিয়ানিগুলো একটা প্লেটে ঢালতে ঢালতে বলল ফাতেমা। পূণরায় সে নিজেই বলল,'সূচনাকে কিন্তু মাঝে মাঝে আমি খাইয়েও দেই। আবার এক প্লেটেও খাই অনেক সময়। আমার সাথে এক প্লেটে খেতে সমস্যা হবে না তো তোমার?'
ভূমিকা তড়িঘড়ি করে বলল,'ছি, ছি খালামনি এসব কী বলছেন? আপনি সূচনার খালামনি মানে তো আমারও খালামনি। আর খালারা কিন্তু মায়েরই অংশ।'
ফাতেমার ঠোঁটে এবার প্রশান্তিকর তৃপ্তির হাসি ফুঁটে ওঠে। সে আবদার করে বলে,'আমি আজ তোমাদের দু'বোনকে খাইয়ে দেই?'
ভূমিকা এ আবদার উপেক্ষা করতে পারল না। সম্পূর্ণ ঘটনা ফাতেমা না জানলেও এটুকু আঁচ করতে পেরেছে যে, এ দু'বোন সহজে খাবার খাইতে চাইবে না এখন। চোখমুখ এবং মনের যা অবস্থা, এই অবস্থায় খাইয়ে দেওয়াই ভালো হবে। আগে সে ভূমিকার মুখে খাবার তুলে দিলো। খাবার মুখে নিয়ে ভূমিকা চিবুচ্ছে। কিন্তু গিলতে গিয়েই বাঁধল সমস্যা। খাবার তো কিছুতেই নামছে না গলা দিয়ে। সে কোনো রকম মুখের খাবারটুকু গিলে পানি খেয়ে বলে,'আর খাব না খালামনি।'
পানি পান করতে করতেই সে আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সূচনার চক্ষুযুগল ফেঁটেও পানি নির্গত হতে শুরু হয়। ফাতেমা আঁৎকে ওঠে। হলো কী দু'বোনের? সে খাবারের প্লেট রেখে ভূমিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,'এই কী হলো কী তোমাদের? এভাবে কাঁদলে হবে? আমায় বলো কী হয়েছে।'
আশ্রয়স্থল পেয়ে ভূমিকার কান্নার দমক আরও বেড়ে যায়। এবার সে শব্দ করে কান্না করতে শুরু করে। ফাতেমার বুকের ভেতরটাও কেমন হু হু করে ওঠে। সে অন্য হাতে সূচনাকেও নিজের কাছে নিয়ে আসে। ভূমিকা আহাজারি করতে করতে বলে,'ভালোবাসায় কেন এত কষ্ট খালামনি? ঐ লোকটা তো দিব্যি ভালো আছে। তাহলে আমি কেন পারছি না ভালো থাকতে?'
ফাতেমা কিছু বুঝতে পারছে না, ভূমিকা কার কথা বলছে। তবে ভালোবাসার কথা যখন এসেছে তখন মানুষটাও নিশ্চয়ই রাসেল? তাহলে ওদের মধ্যে এমন কী ঝামেলা হলো যার জন্য সুদূর আমেরিকা থেকে হঠাৎ করেই ভূমি বাংলাদেশে চলে এলো? মিনিট পাঁচেক পরে ভূমির কান্নার বেগ ধীর হয়। সে স্থির হতে শুরু করে। দু'বোনকে বিছানায় বসিয়ে ফাতেমা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভূমিকে বলে,'এবার বলো আমায়। কী হয়েছে?'
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুরু থেকে সবটা সে বিবৃতি করতে থাকে ভূমি। কথাগুলো বলার মাঝে মাঝে কখনো কখনো ফুঁপিয়ে আবার উচ্চ শব্দেও কেঁদে ওঠে। নিখুঁত অভিনেতার অভিনয়ের কথা সব জানতে পেরে ফাতেমার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ক্রোধে।
সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,'তুমি বাংলাদেশে ফিরলে কেন? আমেরিকাতেই থাকতে। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ঐ পশুটাকে দেখিয়ে দিতে। এজন্য চাইলে তুমি মিসেস চৌধুরীর সাহায্যও নিতে পারতে।'
ভূমি স্মিত হেসে বলে,'আসলেই কি সবটা এত সহজ? খালামনি, আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা রাসেল। বাবার পরে আমার প্রথম বিশ্বাস এবং ভরসার স্থান ছিল ঐ মানুষটির কাছে। আমি তার কাছে থেকেছি, তাকে ভালোবেসেছি। যাকে আমি কখনো অন্য কারো সাথে কল্পনাই করতে পারতাম না, তাকে আমি অন্য কারো সাথে চোখের সামনে কী করে সহ্য করব? আমেরিকায় আমি সম্পূর্ণই একা। একমাত্র প্রিয় মানুষ বলতে শুধু রাসেলই ছিল। ঐ ভিনদেশে আমার আর কেউ নেই। সেখানে আমার একা থাকা, চলা এত বেশি সহজ ছিল না। আমি বাইরে থেকে নিজেকে যতটা স্ট্রং দেখাই ভেতরে আমি ঠিক ততটাই ভাঙা একজন মানুষ। আমার দুঃখগুলো শেয়ার করার মতো কেউ নেই। রাসেলের এসব কর্মকাণ্ড জানার পর যে ক'টা দিন আমি সেখানে ছিলাম, জীবন্ত লাশ হয়ে ছিলাম। ডিপ্রেশনের শেষ পর্যায়ে চলে গিয়ে সুইসাইড পর্যন্ত করতে চেয়েছিলাম। ঠিক সে সময়ে বাবা-মায়ের অসহায় মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে একমাত্র আদরের বোনটির মুখ। এছাড়া আমি সুইসাইড করলে এর সব দায়ভার রাসেলের ওপর বর্তাত। যে মানুষটিকে আমি ভালোবেসেছি, তাকে কীভাবে ফাসিয়ে দেই? ওকে শাস্তি দিলে আল্লাহ্-ই দেবে।
আমেরিকাতে একা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, শক্ত মনোবল ধরা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আপনারা সবাই ভাবেন, সে ঠকিয়েছে তাতে কী হয়েছে? কিছু করে দেখাও, তার চোখের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেখিয়ে দাও। খালামনিরে! এই ঘটনাটা যদি আজ আপনার সাথে ঘটত তাহলে আপনি বুঝতে পারতেন, কোন স্টেজে আমি দাঁড়িয়ে আছি। সত্যি বলতে কি, আমার কষ্টটা আমি ব্যতীত অন্য কেউ আমার মতো করে অনুভব করতে পারবে না। কথায় আছে, কায়া দেখলে মায়া বাড়ে। আমেরিকাতে থাকলে কোনো না কোনোভাবে রাসেলের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। আমি তখন কী করে নিজেকে আটকাবো? কী করে ওকে অন্য মেয়ের সঙ্গে সহ্য করব? অন্য কারও সাথে ওকে সহ্য তো করব দূরের কথা, সেখানে তো আমি ঠিকমতো নিঃশ্বাসই নিতে পারব না।
বাকি রইল কারো সাহায্য নেওয়ার কথা? যেখানে নিজের স্বামীকে বিশ্বাস করেই ঠকে গেছি, সেখানে অন্য কাউকে আর কী করে বিশ্বাস করি? আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। আমি আদি-অন্ত একটা ভাঙা মানুষ। এজন্যই সকল মায়া, পিছুটান ত্যাগ করে দেশে ফিরে এসেছি। এখন আর কষ্ট লাগলে দম আটকে মরতে হবে না। বাবা-মায়ের কাছে ছুটে যেতে পারব। ওদেরকে জড়িয়ে ধরতে পারব। দুঃখগুলো ভাগ করতে পারব। একাকিত্ব আমাকে আর ছুঁতে পারবে না। একদম স্পষ্ট ভাষায় যদি বলি তাহলে বলব, আমি মরতে চাইনি বলেই দেশে ফিরে এসেছি। ভালো থাকার জন্য দূরে সরে এসেছি।'
.
.
.
চলবে............................