অনুভবে - পর্ব ০৫ - নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা - ধারাবাহিক গল্প


সভ্য তার সাথে নয়নবন্ধন করে রেখেই বলে, "আমি চাকরি থেকে বের করা ছাড়াও আরও অনেককিছু করতে পারি। আমি নিশ্চিত তুমি তার অভিজ্ঞতা নিতে চাইবে না যার জন্য ভবিষ্যতে তোমার আফসোস করতে হয়।" 

সভ্য ভাবে এতটুকুতেই ইনারা ভয় পেয়ে যাবে। আর কোন কথা বলবে না। অথচ ইনারা তার চোখে চোখ রেখেই দিল গলায় বলল, "আমিও দেখতে চাই আপনি এমন কি করেন যার কারণে আমার আফসোস করতে হবে।"
সভ্য তার নির্ভীকতা দেখে হতদম্ব হয়ে যায়। তোর চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে আসে। কিন্তু তা সে মুখে বলে না। সোজা বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে। 

ইনারাও নোটবুক নিয়ে দৌড়ে গেল সভ্যের পিছনে। সে গেল রান্নাঘরে। ওপেন এরিয়া থাকায় ইনারা ডাইনিং টেবিলে বসে নোটবুক চেক করতে থাকে। যেন এটা তার নিজেরই ঘর। এতগুলো কাজ দেখে সে থতমত খেয়ে যায়, "আমি বুঝেছিলাম আপনাদের কেবল রেকর্ডিং এবং স্যুট থাকে। কিন্তু এখানে দেখি আজকের দিনের কাজই এক পৃষ্ঠা ভর্তি।"
"সবে কনসার্ট শেষ হবার কারণে আমরা ফ্রী আছি। সাধারণত আরও বেশি হয়। বাই দ্যা ওয়ে, নাস্তা করেছ তো?"
"আপনি যে এত তাড়াতাড়ি ডাকলেন৷ করব কীভাবে?"
"টোস্ট অমলেট খাও?"
"আপনি বানাবেন?" ভ্রু কপালে তুলে বলে ইনারা। 
"অন্য কিছু খেলেও বলতে পারো।"
"না ডিম ভাঁজি আর পাউরুটি ভাঁজাই চলবে।"
"ওটাকে টোস্ট বলে।"
"তো পাউরুটি ভাঁজে ই তো তাই না?"
"তোমার সাথে তর্ক করাটাই বৃথা।" 

সভ্য নিজের কাজ শুরু করলো এবং ইনারা নোট ভালো মতো দেখতে থাকে। মাঝে একবার সে চোখ তুলে তাকায়। সভ্যের রান্নার কৌশল দেখে থমকে যায়। প্রফেশনাল সেফদের মতো রান্না করছিলো সে। অন্তত তার কাছে মনে হলো। দ্রুত এবং কৌশলগত ভাবে। চোখের পলকে এক কাজ শেষে অন্য কাজ শুরু করেছে। আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ইনারা। উঠে কুড়কুড় করে যেয়ে সভ্যের পাশে দাঁড়ায়। ভালো করে দেখতে থাকে সভ্যের রান্না করা। ইতিমধ্যে সে অবশ্য সভ্য যাচাই করল। তাকে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিলো। একটু বেশিই। এমন রাক্ষসকে তার কিভাবে আকর্ষণীয় লাগতে পারে? বুঝে উঠতে পারছে না সে। 

সভ্য অমলেট করার মাঝখানে টোস্ট করার জন্য পাউরুটি আনার জন্য পিছনে ঘুরতেই ইনারার সাথে ধাক্কা লাগে। পরে যেতে নেয় ইনারা। সঠিক সময়েই সভ্য তাকে ধরে নেয় কোমর জড়িয়ে। ইনারা চোখ চেপে ধরে রেখেছে। সাথে সভ্যের গেঞ্জিও মুঠোয় বন্দী করেছে৷ যেন ভয় পেয়েছে সে৷ তার মাথায় হুডির ক্যাপ নিচে পরে তার স্বর্ণোজ্জ্বল কেশ খুলে যায়। সভ্য তীক্ষ্ণ হেসে বল, "যাক তাহলে তুমিও ভয় পাও।"
ইনারা প্রথমে এক চোখ খুলে নিশ্চিত হয় সে এখনো মেঝেতে পড়ে নি। তারপর মুখ ফুলিয়ে বলে, "কে বলল আমি ভয় পেয়েছি? আমি একদম ভয় পাই নি।"
"তাহলে আমাকে এভাবে ধরে রেখেছ কেন?"
ইনারা খেয়াল করে সে সভ্যের গেঞ্জি আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সে তা ছেড়ে দিয়েই বলে, "আপনি আমাকে ধরেছেন বলে। আপনি আমাকে ধরেছেন কেন?"
"আচ্ছা যাও ছেড়ে দিলাম।"
বলেই সভ্য ইনারাকে ছেড়ে দেয়। সে মেঝেতে পড়তেই চিৎকার করে উঠে আর বলে, "হায় আমার কোমর ভেঙে গেল।" 

সভ্য হাসি চাপা দিয়েই তার পাশ কাটিয়ে পাউরুটি নিয়ে টোস্টারে দিলো। ইনারা তা দেখে যেমন অবাক হয় তেমন রাগান্বিতও, "আপনি আসলেই অসভ্য। এভাবে আমাকে ছেড়ে দিতে আপনার একটুও মায়া লাগলো না?"
"না।"
"আই হেইট ইউ।"
"আর তোমার হেইটে আমার কী আসে যায়? কে বলেছিলো আমার পিছনে ভূতের মতো এসে দাঁড়িয়ে থাকতে?"
সে কান্নার ঢঙ করে উঠে দাঁড়ায়। একপাশে যেয়ে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সভ্য কোনো কথা বলে না। কেবল নিজের কাজ করতে থাকে। ইনারার আবার কথা বলার রোগ আছে। কথা না বলতে পারলে তার ভালো লাগে না। তাই সে রাগ ভুকে নিজেই বলল, "আপনি এতকিছু একা খাবেন?"
"না, পাশের ফ্লাটে ইরফান এবং সামি থাকে। ওদের জন্য। সামির জন্য এভাকাডো টোস্ট এবং ইরফানের জন্য রুটি, ডিম।"
"বলেন কি?"
"আগে সবাই একসাথে থাকতাম। কিন্তু ওরা ঘর এলোমেলো করে রাখতো। আর আমার এলোমেলো কিছু পছন্দ না। ভুলেও আমার ঘরের এক জায়গায় রাখা জিনিস অন্য জায়গায় রাখবে না।"
ইনারা জোরপূর্বক হাসে। বিড়বিড় করে বলে, "আমার দ্বারা এটা অসম্ভব।"
মুখে আবারও জিজ্ঞেস করে, "আপনি এত ভালো রান্না কোথা থেকে শিখলেন?"
"সবাই-ই এসব পারে। বিশেষ কিছু না।"
"আমি তো চুলাও জ্বালাতে পারি না।"
কথাটায় সভ্যের কপাল কুঁচকে যায়। সে ইনারার দিকে তাকিয়ে বলল, "তাহলে সব রান্না কে করে?"
"খালাজান। সে আমাকে ছোট বেলা থেকে পেলে বড় করেছে।"
"আপন খালা?"
"না, আপন খালা না। কিন্তু এর থেকে বেশি। আগে আমার মা'য়ের জন্য কাজ করতো। এরপর আমাকে বড় করেছে।"
"সাইদ বলল তুমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তোমাদের অনেক অভাব তাই চাকরির জন্য এসেছ। তাহলে তোমার পরিবার তোমাকে অন্যকাওকে দিয়ে লালন-পালন করা কীভাবে এফোর্ড করতে পারলো?"
প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ইনারা। সাইদ যেহেতু আইজাকে ভালো করে চিনে সেহেতু সে তার পরিবারের ব্যাপারে জানে। আইজার কথা আজ পর্যন্ত সে-ও কাওকে সত্যিটা বলে নি। সাইদ যে সবাইকে এমন গল্প শোনাবে তা তাকে প্রথমেই বলা হয়েছিলো। কথা বলার মাঝে সভ্য এত ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়েও মাথা ঘামাবে সে ভাবে নি। এ কোন বিপদে পড়ে গেল সে? 

ইনারা আমতা-আমতা করে বলে, "অবস্থা আগে এত খারাপ ছিলো না আরকি। আর খালাজান আমাদের পরিবারের মতোই।"
"আচ্ছা এখন তুমি টেবিলে যেয়ে বসো, আর বকবকানি কমাও। তোমার কথা শুনে শুনে আমাদের মাথা ব্যাথা হয়ে গেছে।"
ইনারা ভেংচি কাটে, "আর আপনার সাথে কথা বলার জন্য আমি তো মরে যাচ্ছি।" বলে সে চলে গেল।
"নাটকবাজ একটা।" 

সভ্য সকালের নাস্তা দেবার পর ইনারা খুব মজা করেই খায়। খাবার ভীষণ ভালো লাগে তার কাছে। কিন্তু সভ্যের প্রশংসায় সে নারাজ। সে জিজ্ঞেস করে, "আচ্ছা জোহানের সাথে আপনার বন্ধুত্ব ব্যাপার ছাড়া তাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন করা যাবে?"
উত্তর দেয় না সভ্য। কিন্তু ইনারা ঠিকই প্রশ্ন করে, "জোহানের সাথে যে অভিনেত্রী দীপার সম্পর্ক আছে তা কী সত্যি?"
"সত্যি না হলে কি তোমার মনে হয় তোমার চান্স আছে?"
"থাকতেই পারে।"
"তুমি ওর টাইপের না।"
"আপনি যেন খুব জানেন।"
"জানি দেখেই বলছি।"
কথাটা শুনে খুব বিরক্ত হয় ইনারা, "আপনি চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে পারেন না? টিভিতেও দেখি আপনার কথাগুলো এমন। নির্বিকারে বলা এসব কথাগুলো সে অন্যকে আঘাত করতে পারে তা বুঝেন না?"
"প্রশ্ন করেছ, সত্যি উওর দিলাম। তা কটু শোনা গেলে আমি কি করতে পারি? আমি মাধুরি মিশিয়ে কথা বলতে পারি না।"
ইনারা বিড়বিড় করে কতগুলো বকা দিলো সভ্যকে। তা ঠিকই শুনতে পায় সভ্য, "এমন ইঁদুরের মতো মিনমিনে কথা না বলে চুপচাপ খাও। মানুষ এত কথা কীভাবে বলতে পারে বুঝি না।"
"আপনি তো মানুষ না, রোবট।"
সভ্য এইবার আসলেই বিরক্ত হয়ে তাকায় ইনারার দিকে। চোখ রাঙিয়ে বলে, "তোমার কী আসলেই এই চাকরিটার প্রয়োজন আছে না-কি বলো তো।"
এই প্রশ্নটা শুনে ইনারা কথা বলা তো দূরের কথা সভ্যের দিকে আর তাকায়ও নি। চুপচাপ খেতে থাকে কেবল। 

খাবার শেষে সভ্য রুমে যায় কোম্পানিতে রওনা দেবার উদ্দেশ্যে তৈরি হতে। তৈরি হয়ে এসে দেখে ইনারা সোফাতেই ঘুমিয়ে পরেছে। সভ্য ভালো করে দেখে ইনারাকে। কী শান্ত এবং নিসাড়! অথচ জেগে থাকলে কথা বলতে বলতে মাথা এলোমেলো করে দেয়। এখন কেমন গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে সে। সভ্য তার রুম থেকে একটি পাতলা কম্বল এনে ইনারার উপর দিলো। এই প্রক্রিয়ায় খুব কম সময়ের জন্য হলেও সে ইনারাকে খুব কাছের থেকে দেখতে পায়। তার ফর্সা গাল গোলাপি রঙের আভা ছড়িয়ে আছে। ঠোঁটজোড়া মিষ্টি গোলাপি রঙের। তার কেশবাহারে সোনালী রঙের এক আভা আছে। যা তার ফর্সা ত্বকের সাথে মিশে আরও সুন্দর দেখায়। তাকে মায়াবী দেখায়, কিন্তু তার মুখে আকর্ষণীয় ভাবটা কম। হয়তো গোলগাল মুখের কারণে তার মাঝে এখনো বাচ্চামো ভাবটা আছে এ-কারণেই। সভ্য হেসে বলে, "এখন কত নীরবে ঘুমুচ্ছে, জাগ্রত অবস্থায় শান্তি দেয় না। তবে আমিও কম নই। তোমার পাওয়া শাস্তি না পূরণ করে যেতে দিব না।"
সভ্য উঠে যেতে নিলেও আরেকটিবার তাকাল ইনারার দিকে। সোফার একটি বালিশ তার মাথার নিচে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। 

ইনারা নড়ে-চড়ে উঠে। এক মিষ্টি ধ্বনি বাজে তার কানে। ধীরে ধীরে পলক খুলে তাকায় সে। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে তার চোখ লেগে আসলো সে বুঝতে পারে নি। এক কন্ঠ শুনে সে নিদ্রার দেশ থেকে বেরিয়ে আসে। আশেপাশে তাকায় সে। সে মুগ্ধময় কন্ঠের খোঁজে উঠে। সভ্যের কক্ষ থেকেই শব্দটা ভেসে আসছে। স্বাভাবিক। তার বাসায় অন্য কে এমন গান গাইবে? তবে তার গানের স্বর টিভি, রেডিও অথবা ইউটিউবের মতো লাগছে না। অন্যরকম লাগছে। আরও মধুর। আরও মুগ্ধতায় ভরা। সে হাওয়ায় মিশানো গীতের মাধুরি অনুসরণ করেছে সভ্যের কক্ষে। কক্ষের ওপারে এক বিশাল ব্যালকনি। পর্দা লাগানো থাকায় তা সকালে দেখে নি ইনারা। এত উপরে আশেপাশে আকাশ ছাড়া নেই। নীল আকাশে দোল খাওয়া মেঘ এই পরিবেশের মুগ্ধতা বাড়ায়। এত উপর থেকে এত সুন্দর দৃশ্য আগে দেখে নি ইনারা। সে মুগ্ধ হয়। এই মুগ্ধময় দৃশ্যের শোভা বাড়াচ্ছে সভ্যের গান,
"মেঘ সায়রে ভাসবো আবার তুমি আমি মিলে
স্বপ্ন তোমার রূপকথার 
আমার স্বপ্ন তুমি 
ও প্রিয়তমা, ও প্রিয়তমা তোমার স্বপ্নে বাঁচি আমি,
আমার হৃদমাঝারে কেবল তুমি..." 
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন