সুমনের দুজন জুনিয়ার খরিদ্দার সেজে আসবে। সেই ফাঁকে সুমন এবং রাজশ্বী তাদের সব কথাগুলো রেকর্ড এবং ছবি তুলে নিবে। ছক পাতা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু মূল চরিত্রের আগমণ বাকি। ক্যামেরা হাতে অপেক্ষা করছে রাজশ্বী। হঠাৎ চার পাঁচ জন লোক ঘরে ঢুকলো। জানালার শিক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাদের মাঝে একজনকে দেখে রাজশ্বীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ধীর স্বরে বেড়িয়ে এলো,
" দীপঙ্কর দা, এদের মূলে"
সুমন ফিসফিসিয়ে বলে,
"তুমি চেনো এদের কাউকে?"
"হ্যা, চিনি। মাঝের আসমানী রঙ্গের পাঞ্জাবী পড়া লোকটির নাম দীপঙ্কর রায়। আমার জামাইবাবুর কাকাতো ভাই। কিন্তু দীপঙ্কর দাদা এখানে কেনো?"
"কেনো আবার, এই শয়তানগুলোর নেতা। সে এখানে না থাকলে হবে?"
সুমনের কথা শুনে ক্ষোভে ঘৃণায় মুখ খিঁচিয়ে আসলো রাজশ্বীর। ভাবতেও তার খারাপ লাগছে, এই লোক কি না রুদ্রের ভাই। এতোটা লোভীও মানুষ হয়! সে হাতে থাকা ক্যামেরাটি দিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো। তারপর ঘাপটি মেরে বসে রইলো তাদের কথা শোনার জন্য। একেবারে জানালার কাছে বিধায় তাদের কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। দীপঙ্করের সাথের লোকগুলোর মাঝে একজন খরিদ্দরকে বললো,
"আপনারাই জমি কিনতে চান?"
"আজ্ঞে, আমরাই কিনবো।"
"কতটুকু কিনবেন?"
"বিঘা দশেক"
"এতো জমি কি একাই কিনবেন?"
"জ্বী না, আমরা মোট দশ বন্ধু। আমরা দশজন মিলেই এই জমি কিনতে চাই। একটা বড় মিল করবো এখানে। তা কত করে বিঘা?"
দীপঙ্কর আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
"বুঝলেন ভাই, জমি তো জমি না। এখন সব সোনা এক একটা। এই জমি কিছুদিনের মধ্যে আগুনের দামে হবে। এখন মন্দা চলে ঠিক কিন্তু এই পাশে যখন বিদ্যুৎকেন্দ্র করবে, জেলখানা হবে তখন জমির দাম বেড়ে যাবে। তখন কাঠা এই দামে পান কি না সন্দেহ! বেশি না সাত লক্ষ টাকা করে বিঘা।"
"একটু বেশি হলো না? এই জায়গাগুলো ডোবা! এখন জায়গার সরকারী দর তো এতো না ভাই। শতক হবে আট দশ হাজার টাকা করে। এখানে সাতলাখ অনেক বেশি। আমরা তো দশ বিঘার মতো খরিদ করবো। একটু কমিয়ে দিন।"
"দেখুন আমরা মাছের বাজারে তো নই এখন। জমি জমায় কি এভাবে দর কষাকষি চলে? যা দাম সেটাই ফিক্স। আমাদের খদ্দরের অভাব নেই। এটা ভবিষ্যতে আবাসিক হবে। বড় মার্কেট তুলতে পারবেন মশাই। ভেবে দেখুন।"
খরিদদারেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বললো,
"আচ্ছা কাগজ ঠিক আছে তো? পেপারে লেখালিখি চলছে। এ জমি নাকি বেয়াইনি দখলে। কিনবো কি করে?"
"এসব আইন ফাইন পকেটে রাখি বুঝলেন? কোনো হালার পুতের সাহস নেই আমার সামনে জবান খোলার৷ দখল বুঝিয়ে দিবো, কাগজ বুঝিয়ে দিবো আর কি চাই?"
"কেস হলে?"
"আদালতে যাবে কেউ আপনার মনে হয়। ও সব কেস তো ঝুলতেই থাকে ঝুলতেই থাকে। এসব হলো সব কিছু টাকার খেলা। আর ওদের টাকা দিয়ে আমরা কিনেছি। সই, টিপ, আঙুলের ছাপ সব আছে। এই যে, দেখুন খতিয়ান।"
রাজশ্বীর গা জ্বলছে। ইচ্ছে করছে লোকগুলোর গলা টিপে ধরতে৷ কতটা অমানুষ হলে এতোটা চড়াও হয়ে নিজের অপকীর্তির বড়াই করতে পারে! সব কথা শেষ হবার পর সুমন আস্তে করে সুতোয় বাঁধা কলমটি বের করে নেয়। তারা সেখান থেকে সরতেই যাবে, তখনই সুমনের চটি শুকনো পাতায় শব্দ করে উঠে। বাইরে সিগারেট খাওয়া, দীপঙ্করের ছেলেপেলের নজর পড়ে ঝোপের দিকে। বাজখাই স্বরে বলে উঠে,
"কে রে? কে ওখানে?"
তাদের কন্ঠ শুনেই সুমন এবং রাজশ্বীর ভেতরটা কামড় দিয়ে উঠে। রাজশ্বী সুমনকে বলে,
"সুমন দা পালাতে হবে। দৌড় দিতে পারবেন তো? চলুন দৌড় দেই। ধরা পড়লে মেরে ফেলবে কিন্তু"
দীপঙ্করের লোকেরা টর্চের আলো ফেলতেই আলো সুমনের ভয়ার্ত মুখে গিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠে,
"দাঁড়া ওখানে, এই কে কোথায় আছিস। ধর ধর, লুকিয়ে কথা শুনছিলো বোধ হয়"
মূহুর্তেই শান্ত নিবিড় পরিবেশটি গমগমে হয়ে গেলো। সবার শোরগোল বাড়তে লাগলো। ছেলেপেলের শোরগোলে দীপঙ্কর বাহিরে আসে। তাদের জিজ্ঞেস করে,
"কি রে চিৎকার করছিস কেনো?"
"দাদা, দুজন ক্যামেরা হাতে লুকিয়ে জানালার পাশে ছিলো। হয়তো ছবি তুলছিলো। কি করবো দাদা?"
"অকর্মন্য, গবেট কোথাকার। তোদের টাকা দিয়ে কি গন্ডমূর্খের মতো দাঁড়িয়ে থাকার পয়সা দেই। যা না দেখ কোথায় গেছে। এগুলোকে ধরতে না পারলে আমাদের সব ফাঁস হয়ে যাবে। যা"
রাজশ্বী এবং সুমন প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে থাকে। ক্যামেরার রিলটা এবং কলম টি অতি সাবধানে নিজের কাছে রাখে। তাদের জুনিয়রদের কাছেও রেকর্ডিং কলম আছে সেকারণে প্রমাণের অভাব হবে না। শুধু তারা ধরা না পড়লেই হয়। এদিকে দীপঙ্করের লোকজন পেছনে ছুটতে থাকে। হাতে তাদের ছড়ি, দা। না জানি কত অস্ত্র। উদ্দেশ্য রাজশ্বী এবং সুমনকে এই গ্রাম থেকে বের না হতে দেওয়া। ছুটছুটতে পায়ে ব্যাথা করে উঠে রাজশ্বীর। আকা বাকা পথ যেনো শেষ হবার নাম নেই। অবশেষে একটি পানের বরজের কাছে চলে আসে তারা। উপায়ন্তর না পেয়ে রাজশ্বী এবং সুমন সেই পানের বরজের ভেতরে লুকিয়ে পড়ে তারা। আমাবস্যার রাত, চাঁদও যেনো ঘাপটি মেরে রয়েছে তাদের বাঁচাতে। টর্চ দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুজতে থাকে তারা। সুমন আয়াতুল কুরসী পড়তে থাকে। তার হৃদস্পন্দন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মৃত্যির ভয়ে তার হাটু কাঁপাচ্ছে। এদিক রাজশ্বীর পা টা যেনো হিম ধরে গিয়েছে। অবশ হয়ে আসছে। পানের বরজের ভেতরে হাটু গেড়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকাটা খুব সহজ কার্য নয়। তার কপালে ঘাম জমছে, ফাগুনের শীতল রাতেও ঘামছে সে। গলাটা শুকিয়ে আসছে ছুটার কারনে। এক এক জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুজতে খুজতে এক পর্যায়ে একটি ছেলের চোখে পানের বরজে যায়। সে সিদ্ধান্ত নেয় পানের বরজে একবার দেখবে, সে টর্চ হাতে ঢুকে পড়ে বরজে.........
—————
পানের বরজের ভেতরে হাটু গেড়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকাটা খুব সহজ কার্য নয়। তার কপালে ঘাম জমছে, ফাগুনের শীতল রাতেও ঘামছে সে। গলাটা শুকিয়ে আসছে ছুটার কারনে। এক এক জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুজতে খুজতে এক পর্যায়ে একটি ছেলের চোখে পানের বরজে যায়। সে সিদ্ধান্ত নেয় পানের বরজে একবার দেখবে, সে টর্চ হাতে ঢুকে পড়ে বরজে। সমস্যাটি হয় আকারে, লোকটির স্বাস্থ্য অনুযায়ী পানের বরজটির আকার বেশ ছোট। যেকারণে শেষ পর্যন্ত যাওয়াটা মুশকিল হয়ে উঠে। লোকটির হাটুর ঘর্ষণ সন্নিকটে চলে এলো। ফলে রাজশ্বী এবং সুমনের হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে। মৃত্যু ভয়ে তাদের গলা শুকিয়ে যায়। পরমূহুর্তে কি ঘটতে চলেছে তার কোনো আন্দাজ নেই, ভয় হচ্ছে এই বুঝি যমের দর্শন হবে। রাজশ্বীর চোখে উমার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো, অন্তরাত্না গ্লানিতে ভরে উঠলো। দিদির কাছে ক্ষমাটুকু চাওয়া হলো না তার। উমার কথা মনে পড়তেই হৃদয়ে শক্ত হয়ে উঠলো। নিজেই নিজেকে বুঝালো, এখন তার যমের দেখা পাবার সময় হয় নি, তার উপর হাজারো দায়িত্ব। শাশ্বত তাকে বিশ্বাস করে এতো বড় দায়িত্ব সপে দিয়েছে। সেই বিশ্বাসটুকুর মর্যাদা সে রাখবে। ভয় পেলে মস্তিষ্ক ধীর হয়ে যায়, ভয়ের মেঘ কাটলে উদ্দীপনার প্রভাত ফুটবে। রাজশ্বী কিছুক্ষণ চিন্তা করলো কিভাবে এই লোকদের ধ্যান অন্য দিকে নেওয়া যায়। তারপর মাটির খুচে কিছু নুড়ি, খোয়া কুড়িয়ে নিলো। তারপর ছুড়ে দিলো অনেক দূরে, গ্রামের মেয়ের নিশানা চুকলো না। শব্দ আসতেই সবার নজর গেলো দূরে। বাইরে থাকা ছেলেগুলো বললো,
“এই বের হো, ওদিকে গেছে হয়তো”
সময় নষ্ট না করে লোকটি বেড়িয়ে পড়লো পানের বরজ থেকে। হাফ ছাড়লো সুমন এবং রাজশ্বী। ভয়ে শ্বাসরোধ হয়ে আসছিলো তাদের। সুমন ধীর স্বরে বললো,
“তোমার তো সেই বুদ্ধি, কি সুন্দর করে ওদের দৃষ্টি সরিয়ে নিলে। কিন্তু আমরা এখান থেকে বের হবো কি করে?”
সুমনের প্রশ্নের উত্তর নিজের জানা নেই রাজশ্বীর। এভাবে কেটে যায় বহু সময়, রাতের গভীরতা বাড়তে থাকে। রাজশ্বীর হাটুতে টান লাগছে, একটু নড়ে বসলে হয়ত ভালো হতো। তাই একটু নড়ে আসন গেড়ে বসে সে। পানের ফাঁকে আকাশের দিকে চায়, এখান থেকে বের হবার কি আদৌ ও কোনো উপায় আছে। নিঝুম রাতে ঝিঝিদের মনোরম ধ্বনি কানে আসছে, সেই সাথে এক থমথমে গরম হাওয়া বইছে। বিপদের গুমোট বাণী যেনো ধেয়ে আসছে। সকালের সূর্য না উঠলে হয়তো এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। তীব্র প্রতিকূল পরিবেশে মস্তিষ্কের স্নায়ু শ্লথ গতিতে কাজ করে, সামনে উপায় থাকা সত্ত্বেও নজরে পড়ে না। এর মাঝে সুমন নিজের মোবাইলখানা বের করে। নেটওয়ার্কের একটি ডান্ডা মাথা উঁচিয়ে আছে। এই এক মাত্রা নিয়েই সে শাশ্বতকে ফোন দেবার চেষ্টা চালায়। যদি শাশ্বত কোনো উপায় বের করে। কিন্তু কোনো ভাবেই তার ফোনটিতে সংযোগ পায় না। সেই সময়ে রাজশ্বীর স্মরণ হয়, রুদ্রের কথাটি। বিপদের এই নিকষকৃষ্ণ আধারে আশার এক কুসুমপ্রভা দেখতে পায় রাজশ্বী। কাঁপা হস্তে ফোন লাগায় রুদ্রকে। বেশ কবার বাজার পর রুদ্র ফোনটি তুলে, ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
“নমস্কার কে বলছেন?”
“জামাইবাবু, আমি রাজশ্বী”
রাজশ্বীর ভীত কন্ঠ কর্ণপাত হতেই রুদ্র নড়ে চড়ে উঠে,
“কি হয়েছে রাজশ্বী? তোমার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো?”
“জামাইবাবু, মহাবিপদে পড়েছি। খুব ভয়ঙ্কর কিছু লোক আমাদের পিছনে লেগেছে। কোনো মতে একটা পানের বরজে লুকিয়ে রয়েছি। উপায়ন্তর না পেয়ে ফোন করেছি। দয়া করে আমাদের বাঁচান”
“শাশ্বত কোথায়?”
“স্যার, এখানে নেই। অনেক কথা জামাইবাবু। এতো কথা বলার সময় নেই। দয়া করে আমাদের বাঁচান”
“কোথায় আছো এখন?”
“শিবপুরের এখানে। মন্দিরের কাছাকাছি একটা জায়গায়”
“ওখানেই লুকিয়ে থাকো। আমি আসছি”
বলেই রুদ্র ফোন রেখে দিলো। নিজের গাড়ির চাবিটা নিয়ে গুদাম থেকে বের হতে নিলে রক্তিমের সাথে দেখা হয়। রক্তিম এতো রাতে রুদ্রকে বেড়িয়ে যেতে দেখে প্রশ্ন করে উঠে,
“বাড়ি যাচ্ছিস নাকি রুদ্র?”
“শাবীব কোথায় রে?”
“ও তো বাড়ি গিয়েছে, আসবে রাতে। তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
“আমার সাথে চল, যেতে যেতে বলছি”
রক্তিম আর প্রশ্ন করলো না। সাথে সাথেই বেড়িয়ে গেলো। গাড়ির বেগ বাড়ালো রুদ্র। আধারের পথ চিরে গাড়ি ছুটলো শিবপুরের দিকে__________
★
রাত গভীর হয়েছে, মিনু এবং ফুলির মা খেয়ে শুয়ে পড়েছে। উমা গোপালের ঘরের বাতি বন্ধ করে দিলো। সে বই বুকে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেটার একটা সমস্যা পড়ার সময় ঘুম আসে। আজও তাই হলো। বাংলা ব্যাকরণের বই বুকে নিয়েই ঘুমোচ্ছে সে। উমা কাঁথা টেনে দিলো তাকে। তারপর সে চলে গেলো রুদ্রের কাজের ঘরে। একে একে সব ফাইল কাগজ বের করতে লাগলো সে। শ্রাবণের কাছে আজ যা যা শুনেছে তার পর কাধ ঝেড়ে হাতে হাত রেখে বসে থাকাটা সম্ভব নয় উমার পক্ষে, সত্যটা বের করতেই হবে। রুদ্রের টেবিলের ডেস্কের মোট দু খানা চাবি, যার একটি সর্বদা তার কাছেই থাকে, আরেকটি থাকে কার্পেটের নিচে। খুব কষ্টে নিচু হয় উমা। ভারী পেট ছেপে চাবিটা বের করে। তারপর রুদ্রের ডেস্ক খুলে সে। এক এক করে রুদ্রের সকল কাগজ বের করে সে। বেশ কিছু দালানের নকশা পায় উমা। প্রতিটি দালানের নিচেই কোনো না কোনো সুরঙ্গ রয়েছে। চেয়ারম্যান বাড়ির পাতালঘরের মতই এই সুরঙ্গগুলো। বেশ কিছু বের করে উমা। প্রতিটি দলিলের ক্রয়কারী রুদ্র সিংহ রায় এবং উমা রায়। বেশ কিছু নকশা করা, স্কুল, কলেজ, কারখানার। উমার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। যদি রুদ্র জমি দখল করে নেয় তবে কেনো তার নাম এবং উমার নাম ক্রয়কারীর স্থানে। এর মাঝেই তিনটি খাদি খাম হাতে পড়ে উমার। খামগুলো খুলতেই বেশ কিছু ব্যাক্তির ছবি সহ তথ্য বেড়য়ে যায়। তার মাঝে বেশ কিছু লোকের মুখে ক্রস চিহ্ণ দেওয়া, বেশ কিছু লোকের মুখে গোল চিহ্ন দেওয়া। পাতা সরা্তে সরাতে ডাক্তার রকিবের ছবিও ভেসে উঠে। তার মুখে ক্রস দেওয়া। বহু সময় ধরে খোঁজার পর অর্গান স্মাগলিং এর কিছুই পায় নি। তখন ঘরের বেল বেজে উঠে। উমার মনে হয় রুদ্র বুঝি এসেছে। তাড়াতাড়ি খামগুলো ব্যাতীত সব কিছু গুছিয়ে নিলো উমা। তারপর দরজাটি খুলে সে। দরজা খুলতে শাবীবকে দেখে ভ্রু কুচকে আসে উমার। অবাক কন্ঠে সে প্রশ্ন করে,
“শাবীব দা, আপনি এত রাতে?”
“রুদ্র বাড়িতে এসেছে?”
“না, আপনার বন্ধু তো বাড়িতে নেই।“
“ওহ, না আসলে ও গুদামেও নেই। ফোনটাও ধরছে না। তাই ভাবলাম ও বাড়িতে এসেছে কিনা। উমা তোমার কিছু কথা বলতাম?”
উমা দরজা আকড়েই দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখে হিংস্র দৃষ্টি। শাবীব দৃষ্টির কারণটা বুঝতে পেরে বললো,
“ভয় পেও না, আমি কিছু করবো না। শুধু রুদ্রের ব্যাপারে কিছু কথা বলতাম।“
উমা কিছু ভেবে বললো,
“বেশ আসুন, আমার ও আপনার সাথে কথা রয়েছে। বসুন”
শাবীব বসতেই খাম গুলো তার সামনে রাখে উমা। কঠিন জড়তাহীন কন্ঠে বলে উঠে,
“এসব কি শাবীব দা? উনি কেনো এমন পশুর মতো কাজগুলো করেন? উনি কি কোনো সংস্থার সাথে জড়িত? আমার উত্তর চাই। সে তো আমাকে উত্তর দিবে না কখনো, আপনি দিন। নয়তো এই সব নিয়ে আমি পুলিশের কাছে যাবো। অন্যায়ের সাথে আপোশ আমি করি নি, করবোও না। যদি সে অন্যায় করে থাকে সেই শাস্তি সে পাবে।“
“তোমার পুলিশেরা কিছুই করবে না। আইন শুধু ক্ষমতার কাছেই নত হয়। তাই সেই ক্ষমতা অর্জনের প্রতিযোগীতায় নেমেছে রুদ্র। যাদের ছবি দেখছো, তারা সবাই সেই ক্ষমতাশীল মানুষের কজন, যাদের টাকা এবং ক্ষমতার জোড়ে তাদের টিকিটিও ধরতে পারে না পুলিশ। হ্যা, এই রুদ্র অন্যায় করে। কিন্তু সেই অন্যায়কে কি আদৌ অন্যায়ের কাতারে ফেলা যায় উমা? আমার বোনের এপেনডিসাইটের ব্যাথা হয়েছিলো। আমি তাকে ওই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার অপারেশনের কথা বলে। আমরা রাজীও হই, বেশ কিছু বন্ডে সাইন ও করি। বোনের অবস্থার কারণে আমরা এতোকিছু ভাবিও নি। কিন্তু ওই জানোয়ার অপারেশন করে আমার বোনের একটি কিডনী খুলে নিয়ে যায়। যখন বোনের স্বাস্থের কোনো উন্নতি হয় নি তখন রুদ্র ভালো একটি ডাক্তার দেখায় তাকে। সেই ডাক্তার জানায় আমার বোনের একটি কিডনী নেই। পুলিশের কাছে গেলে ডাক্তার আমাদের বন্ড দেখায়। আমরা নাকি স্বেচ্ছায় আমার বোনের কিডনীর ডোনেশনের জন্য সাইন করেছি। এবার বলো, তাকে কিভাবে শাস্তি দেওয়া উচিত? হ্যা রুদ্র কখনো সোজা পথে চলে না। নিজের পরিবারকে বাঁচাতে তাকে অসুর হতে হলেও সে হতে ভয় পায় না। নিজের বাবাকেও সে ছাড়ে নি। অভিনব সিংহ আজ জেলের ভেতর একমাত্র রুদ্রের জন্য। আর ওই শিবপুরের জমি, সেটা ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে তোমার নামে জমিগুলো নিয়েছে রুদ্র। তোমাদের সন্তানের কথা ভেবে এই কাজগুলো করেছে সে। তোমার হাতে সেই চাষের জমি সে বিতরণ করার কথা চিন্তা করেছিলো। হ্যা, রুদ্র ভালো নয়। তোমাদের মহাভারতেও তো অর্জুন নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলো। সে কি খুনী ছিলো উমা? এটা রাজনীতি উমা, হয় তুমি তাকে হারাবে, নয়তো অপর মানুষ তোমাকে পায়ে তলিয়ে দিবে। রুদ্রের শত্রুর অভাব নেই, তোমাদের বাঁচাতেই সে এমন। আশাকরি উত্তর টা পেয়েছো”
উমা চুপ করে আছে, তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। অনুভব করলো তার গালটা ভিজে এসেছে। ঠিক সেই সময় রুদ্র এবং রাজশ্বী দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে। উমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তাদের দিকে, রুদ্র এবং রাজশ্বীর অবস্থা দেখে কৌতুহলী হয়ে উঠে উমা। এগিয়ে যায় তাদের কাছে। রাজশ্বীর সালোয়ার কাঁদায় ভরে গিয়েছে। ময়লা জামাটা নিচের দিকে হালকা ছিড়ে গেছে। রুদ্রের গায়ে রক্তের ছিটা স্পষ্ট। বা হাত থেকে তরতর করে রজত পড়ছে। উমা তখন……………
—————
উমা চুপ করে আছে, তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। অনুভব করলো তার গালটা ভিজে এসেছে। ঠিক সেই সময় রুদ্র এবং রাজশ্বী দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে। উমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তাদের দিকে, রুদ্র এবং রাজশ্বীর অবস্থা দেখে কৌতুহলী হয়ে উঠে উমা। এগিয়ে যায় তাদের কাছে। রাজশ্বীর সালোয়ার কাঁদায় ভরে গিয়েছে। ময়লা জামাটা নিচের দিকে হালকা ছিড়ে গেছে। রুদ্রের গায়ে রক্তের ছিটা স্পষ্ট। বা হাত থেকে তরতর করে রজত পড়ছে। উমা তখন এগিয়ে আসে দ্রুত পায়ে। উমাকে দেখে রুদ্রের মাথা নত হয়ে আসে। সে চোখ সরিয়ে নেয়। রাজশ্বীর বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে সে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“এমন অবস্থা কি করে হলো রাজী? তুই তো তোর বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছিলি?”
রাজশ্বী চুপ করে থাকে, উমার অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। রুদ্র তখন বলে,
“ওকে কিছু বলো না, ও ভয় পেয়ে আছে। কম ঝড় তো যায় নি”
উমা তখন রাজশ্বীর দিকে তাকায়। রাজশ্বী সোফায় বসে। আঁটসাঁট করে বসে সে। উমা উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। শাবীবকে দেখে রুদ্র এক কোনায় নিয়ে যায়। সেখানের ঘটনা সবকিছু খুলে বলে। রুদ্র যখন সেখানে পৌছায় তখন রাজশ্বী পানের বরজেই লুকিয়ে ছিলো। রুদ্রের গাড়ি পৌছালে দীপঙ্করের ছেলেদের সাথে এক ছোট হাতাহাতি হয় রুদ্র এবং রক্তিমের। এক পর্যায়ে রুদ্রের হাতে চোট ও লাগে। রুদ্র থেমে থাকার পাত্রটি নয়, এলোপাথাড়ি বেল্ট খুলে পিটায় তাদের। রক্তিম তার লাইসেন্স করা বন্দুকের গুলি ছাড়ে, এক পর্যায়ে ছেলেগুলো পালিয়ে যায়। তারপর সুমন এবং রাজশ্বীকে সেখান থেকে বাঁচিয়ে আনে রুদ্র। রক্তিম সুমনকে বাড়ি পৌছে দেয়। আর রাজশ্বীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে রুদ্র। শাবীবকে রুদ্র বলে,
“দীপঙ্করের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।“
“আন্দাজ কিভাবে করছিস? তুই থাকতে দীপঙ্কর এমন কিছু করবে?”
”জানি না মনে হচ্ছে, তাই বললাম। তুই এখন বাড়ি যা।“
“নিজের দিকে খেয়াল রাখিস, দীপঙ্করের টার্গেট এখন তুই”
“ঠিক আছে”
শাবীব চলে যায়। রুদ্র দরজা লাগিয়ে দেয়। রাজশ্বী তখন উমাকে সব খুলে বলে। উমা রাজশ্বীকে জড়িয়ে ধরে, শক্ত কন্ঠে বলে,
“তুই আমাকে একবার বলতি, কখনো একা যেতে দিতাম না। যদি কিছু হয়ে যেত?”
“জামাইবাবু বাচিয়ে দিলো রে”
উমার নজর তখন রুদ্রের দিকে যায়। রুদ্র তখনো অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে। উমা রাজশ্বীকে নিজ ঘরে যেতে বলে। রাজশ্বী নিজ ঘরে চলে গেলে উমা রুদ্রকে বলে,
“দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে যান, আমি ঔষধের বাক্স নিয়ে আসছি।“
উমা যেতে ধরলে রুদ্র পিছু ডাকে,
“উমা”
“কিছু বলবেন?”
রুদ্রের অনেক কিছু বলার আছে কিন্তু কিছুই যেনো গলা দিয়ে বের হলো না। মুখে কুলুপ এটেই দাঁড়িয়ে রইলো। উমা অপেক্ষা করল না, সে ড্রয়ার খুলে ঔষধের বাক্সটা নিয়ে এলো। রুদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শান্ত স্বরে বললো,
“মলম লাগাতে হবে তো, নয়তো ঘা হয়ে যাবে।“
রুদ্র বাধ্য ছেলের ন্যায় উমার পিছু পিছু ঘরে গেলো।
রুদ্র গিয়ে বিছানায় বসলো, ময়লা শার্ট টি খুলে উমার দিকে হাতটি বাড়িয়ে দিলো। উমা আস্তে আস্তে ফু দিয়ে মলম লাগাতে লাগলো, আর রুদ্র ব্যাস্ত হয়ে পড়লো তার ষোড়শীকে দেখতে। মুখখানা শুকনো লাগছে তার। চোখজোড়া ভিজে আছে। কাজল লেপ্টে আছে চোখের নিচে। গাল চিকচিক করছে। রুদ্র বুঝলো শাবীব তাকে সবটা বলে দিয়েছে। উমা বললো,
“ভাত আর আলু পোস্তের ঝোল আছে, খাবেন কি?”
“হু, খাবো। কিন্তু ডান হাতটা ব্যাথা করছে। খেতে কষ্ট হবে”
“ওহ”
উমার শীতল কন্ঠ রুদ্রকে আহত করছে। উমার এই শীতল ব্যাবহার যেনো অশ্য হয়ে উঠছে, তীব্র যন্ত্রণায় বুকটা জ্বলছে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই উমা বলে উঠে,
“লোকগুলোকে ছেড়ে দিন, পুলিশের কাছে দেবার ব্যাবস্থা করুন। শ্রাবণ তাদের সত্যটা জানে, তাদের কঠিন শাস্তি হবে”
“আমি ছেড়ে দিয়েছি ওদের।“
“ভালো”
“তুমি কি আমায় ঘৃণা করো উমা?”
“উত্তরটা কঠিন, ঘৃণা শব্দটি চাইলেও কথা যায় না। যে মানুষটির মাঝে নিজেকে বিলীন করেছি তাকে ঘৃণা করা অসম্ভব। কিন্তু সেই হিংস্রতাকে ভুলতে পারছি না। আপনার সাথে মেলাতে পারছি না। আপনি ভুল নন, কিন্তু মস্তিষ্ক মানতে চাচ্ছে না। আমাকে সময় দিন। হয়তো নিজেকে মানিয়ে নিবো। তবে একটা প্রতীক্ষা চাই”
“কি?”
“আমার থেকে লুকাবেন না কিছু, এই লুকোচুরিটা আমাকে আরোও কষ্ট দেয়।“
উমার কথা শেষ না হতেই রুদ্র তাকে জড়িয়ে ধরে। শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে উমাকে। উমা তার বুকে নিজেকে আবিষ্কার করে নিজেকে সামলাতে পারে না। হু হু করে কেঁদে উঠে সে। যন্ত্রণাগুলো যেনো উবে যায় উষ্ণ আবেশে। মানুষটিকে ছাড়া যে সে অসম্পূর্ন, তার শক্তি যে এই মানুষটি__________
২৭!!
শিবপুর থানায় বসে রয়েছে দীপঙ্কর। থানার অসি কুমারেশ সিগারেট এগিয়ে দিলোন তার দিকে। দীপঙ্করের সিগারেটটা নিলো। সকাল সকাল পুলিশের ফোনে এখানে ছুটে আসা তার। রাজশ্বী তার বিরুদ্ধে পুলিশে রিপোর্ট লিখিয়েছে। শাশ্বত এবং রুদ্রের প্রেসারে পুলিশ বাধ্য হয়েছে রিপোর্ট লিখতে। শাশ্বত তার চাকরি নিয়ে টানাটানির হুমকি দিয়েছে। অসি প্রতিমাসে দীপঙ্করের টাকা খায় তাই তাড়াতাড়ি ফোন করে তাকে। অসি অনুগত স্বরে বললো,
“স্যার, রাজশ্বী মেয়েটা একেবারে ধারালো বিষ ছুরি। কি সাহস! আপনার বিরুদ্ধে কেস করে, অবশ্য রুদ্র স্যার তার পেছনে আছে। আপনা রিপোর্ট লিখেছি। কিন্তু স্যার মেয়েটির কাছে প্রমাণ আছে।“
দীপঙ্করের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। কাল রাতে যখন ছেলেরা বলে ছিলো রুদ্রের কথা সে আমলে নেয় নি। কিন্তু এখন চুপ করে বসে থাকা মানে নিজের পায়ে নিজেই কোড়াল দেওয়া। দীপঙ্কর কুমারেশকে বলে,
“তুমি টাকা পেয়ে যাবে, চিন্তা করো না”
“ধন্যবাদ স্যার।“
দিপঙ্কর থানা থেকে বেড়িয়ে সোজা চলে যায় অভিনব সিংহএর সাথে দেখা করতে। অভিনব সিংহ সেলের এক কোনায় বসে রুটি খাচ্ছিলেন। তখন কন্সটেবল এসে বলে,
“আসেন, কেউ দেখা করবে”
অর্ধখাওয়া রুটিতা সেভাবে রেখেই উঠে দাঁড়ায় অভিনব। বেড়িয়ে দেখে দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে আছে। শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠে বলে,
“এতো সকালে কি মনে করে?”
“সর্বনাশ হয়েছে জ্যেঠু”
“কি?”
“আপনার ছেলে আমাদের জমির ব্যাবসার লাল বাতি জ্বালিয়ে দিলো।“
“মানে?”
অবাক হয় অভিনব বাবু। তার কপালে ভাঁজ পড়ে। দীপঙ্কর বলে,
“রুদ্র দা, উমা এবং উমার বোন রাজশ্বী মিলে আমাদের বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতার মামলা করেছে। তাদের কাছে নাকি প্রমাণ ও আছে। জ্যেঠু, বলেছিলাম আপনাকে আপনার ছেলে আপনার লংকায় আগুন লাগাতে উদ্ধত হয়েছে। আমি এদিকে আপনাকে বাঁচানোর পথ খুজি আর সে আপনাকে ফাঁসানোর। জমিদস্যুতার কেস করেছে সে আমাদের উপর। আমি তো কিছু বলবোনা, আপনার নুন খেয়েছি। কিন্তু অন্যরা তো নিজেকে বাঁচাতে আপনাকে ফাঁসিয়ে দিবে। কি হবে তখন জ্যেঠু? আর সাক্ষী দিবে আপনার ছেলে। ওই উমা, সব ছোটলোকগুলোকে সাক্ষী দেবার জন্য প্রস্তুত করছে। শাশ্বত এই খবর পেপারে ছাঁপাবে। জ্যেঠু এখনো কিছু বলবেন না আপনি? আজ আপনার এই পরিণতি আপনার ছেলের জন্য। শাশ্বতকে আপনার বিরুদ্ধে সে ব্যাবহার করছে জ্যেঠূ”
অভিনব সিংহের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। হারাবার তার কিছুই নেই, কিন্তু রুদ্রের কাছে সে হারবে না। অভিনব সিংহ শক্ত কন্ঠে বললো,
“কি করতে চাও তুমি?”
“শত্রুকেই শেকড় থেকে মেরে ফেললে কেমন হয়?”
“পারবে?”
“আপনি বললেই পারবো”
“বেশ, তবে হয়ে যাক সাম দাম দন্ড ভেদ”
দীপঙ্করের মুখে পৈশাচিক হাসি। সে ছক কষতে লাগলো। অভিনব সিংহের হৃদয় কাঁপছে। নিজ পুত্রের বধ করতে আদেশ দিয়েছে সে। কিন্তু শত্রুকে সমূলে নিধন করার আনন্দ কাজ করছে। বাঁচার এই শেষ উপায়। রুদ্রকে কিস্তিমাত দেবার এই একটাই সুযোগ, মৃত্যু। সকল বোঝ থেকে মুক্তি দিবে সে তার ছেলেকে। পাপ মস্তিষ্ককে গ্রাস করে। আজ অভিনব সিংহ এর একই দশা। মরতে তো হবেই তাকে, তবে শত্রুকে নিয়েই কেননা। আগাম জন্মে হয়তো ছেলেকে নিজের বশে রাখতে পারবে সে__________________
সন্ধে ৭টা,
আজ দক্ষিণে মেঘ করেছে বিকেলে। বাতাস বইছে থমথমে, সাগরের ঢেউ উঠেছে প্রবল বেগে। উমার মনে হলো ঝড় আসবে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও নেমেছে। ঠিক তখন শ্বাশ্ত আসে তাদের বাড়িতে। গতরাতে তার ফোনটা বন্ধ ছিলো। সকালে অফিসে যায় নি। বিকেলে অফিস গেলে সুমন তাকে সব খুলে বলে। তাই এই মূহুর্ত দেরি না করে সে ছুটে আছে রাজীকে দেখতে। রাজশ্বীর কথা ভাবতেই তার বুক কেঁপে উঠে। এতোটা ভয়ংকর হবে বুঝে উঠে নি শাশ্বত। শাশ্বতকে দেখেই রাজশ্বী হতবাক। অবাক কন্ঠে বলে,
“স্যার আপনি এখানে?”
“তুমি ঠিক আছো তো?”
“জ্বী স্যার আমি ঠিক আছি। কিন্তু আপনি এখানে?”
“তোমাকে দেখতে এলাম।
শাশ্বতের স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে যায় রাজশ্বী। শাশ্বতকে দেখে নিজের রাগ সংবরণ করতে পারে না রুদ্র। সে হিনহিনে স্বরে বলে,
“একটা বাচ্চা মেয়েকে এতো বড় ঝুকিতে ঠেলে দিয়ে এখন ন্যাকামি করতে এসেছিস?”
“আমি আমার কলিগকে দেখতে এসেছি। সাংবাদিকতা কখনোই ঝুকি ব্যাতীত হয় না রুদ্র। আমি তো কম ঝুকি নেই না”
“তাই বুঝি? তোর অর্ধেক কাজ তো খাম ই করে দেয়। সব ক্লু সহ তোকে সাহায্য করে। তোর আমার ঝুঁকি”
রুদ্রের কথায় শাশ্বতের চোখ কুঁচকে আসে। ধীর স্বরে বলে,
“খামের ব্যাপারে তুই কি করে জানিস?”
“মায়ের কাছে মাসির খবর দিলে তো হবে না শাশ্বত”
বলেই বাঁকা হাসি হাসে রুদ্র। শাশ্বতের বুঝতে বাকি রইলো না এতকাল খামগুলো কে পাঠায়! আন্দাজ করলেও এখন বুঝতে বাকি রইলো না এই কাজগুলো রুদ্র ই করে। শাশ্বতকে দেখে উমা ধীর স্বরে বলে,
“শাশ্বত বাবু বসুন, ফুলির মা মুড়ি মেখেছে। খেয়ে যাবেন”
“বসার সময় নেই উমা, আমি রাজশ্বীকে দেখতে এসেছি। যতই হোক দোষ আমার, দায়ভার আমার উপর ই বর্তায়। নয়তো তোমার বর আমাকে কথা বলতে তো ছাড়ে না”
রুদ্র তখন হেসে বলে,
“কাজটাই এমন করিস যে আমাকে কথা বলতেই হয়।“
“বলে নে, যেদিন তোর পেছনে লাগবো তখন আর খামের প্রয়োজনীয়তা পড়বে”
রুদ্র কিছু বলতে যাবে তখন ই ফোনটি বেজে উঠে শাশ্বতের। ফোন ধরতেই সুমনের ভয়ার্ত কন্ঠ শোনা যায়,
“স্যার, আমার বাড়িতে আসতে পারবেন?”
“কেনো সুমন, কি হয়েছে?”
“স্যার একটা দম্পতি লুকিয়ে আমার বাড়ি এসেছে। আপনি একটু আসুন। উনি সাক্ষী দিবেন”
“ঠিক আছে, আসছি”
শাশ্বত ফোন রাখার পর ই রুদ্র বলে উঠে,
“কি হয়েছে?”
“সুমনের কাছে একটা দম্পতি গিয়েছে, অবশেষে কেউ সাক্ষী দিতে রাজী হয়েছে দীপঙ্করের বিরুদ্ধে।“
“এক কাজ কর, আমিও সাথে যাচ্ছি। শ্রাবণকে ও নিয়ে যাব সেখানে নিয়ে যাবো। ওদের সুরক্ষার জন্য রক্তিম এবং শাবীবকে আসতে বলছি।“
“এটাই ভালো হবে”
রুদ্র শাবীব এবং রক্তিমকে ফোন দিলো। তারা এলে রুদ্ররা বেড়িয়ে পড়ে।
রাত বাড়ছে, আবহাওয়া প্রতিকূল হচ্ছে।রুদ্র এখনো ফিরে নি। রক্তিম এবং শাবীব সিগারেট টানতে বাড়ির পেছনে যায়। এর মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠে উমার বাড়ির। ফুলির মা উমাকে বসতে বলে,
“বউ বসো, আমি দেখি কে আইছে”
দরজা খুলতে পাঁচ ছ জন লোক সহ দীপঙ্কর ঢুকে পড়ে। ফুলির মাকে ধাক্কা দিতেই সে পড়ে যায় মাটিতে। বৃদ্ধ শরীরে চোট লাগে। এর মাঝে হট্টগোলের আওয়াজে উমা এবং রাজশ্বী নেমে আসে। দীপঙ্কর এতো তাড়াতাড়ি হামলায় দিশেহারা হয়ে যায় উমা। ঘরের জিনিস ভাঙ্গচুর করতে থাকে তারা। তন্ন তন্ন করে ক্যামেরার রিল খুজতে থাকে। উমা, রাজশ্বী, মিনু এবং গোপালকে জিম্মি করে নেয় তারা। উমা দীপঙ্করের এমন অবনতি দেখতে থাকে। তার চোখজোড়া রক্তিম হয়ে উঠে। উমা স্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন করে উঠে,
“কি চাই তোমার?”
“তোর বোনের সাহস বাড়ছে আমার নামে কেস করে, আজ কেস করা শিখাবো আমি। আমার এতো দিনের প্রাচীর ভাঙ্গা কি এত সহজ। আর তোদের কে বাঁচাবে? ঐ রুদ্র? এতোক্ষণে আমার লোক ওকেও মেরে দিছে।“
“বেশি বার বেড়ো না দীপঙ্কর দা”
“কি করবি? সামান্য নারী তোরা। ঘরে পুরুষ বলতেও তোর এই ভাই। ও বাঁচাবে?”
তারপর রাজশ্বীর চুল ধরে বলে,
“ছবি গুলো কোথায়? মরবি এমনিতেও ওমনিতেও বল ছবি কোথায়?”
রাজশ্বী ব্যাথায় কুকিয়ে উঠে। তখন উমা হিংস্র কন্ঠে বলে উঠে,
“দীপঙ্কর দা, ভালোই ভালোই বলছি রাজশ্বীকে ছেড়ে দাও। মহিলারা বলে আমাদের দূর্বল ভেবো না। মা দূর্গাও অস্ত্র তুলে অসুর বধ করেছিলেন। ওকে ছাড়ো দীপঙ্কর দা।”
উমার হুমকিতে দীপঙ্করের মুখ শক্ত হয়ে উঠে। সে রাজশ্বীকে ছেড়ে উমার কাছে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। সজোরে থাপ্পড় মারে তাকে। উমার ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসে। তারপর উমার চুল ধরে টেনে ধরে বলে,
“তেজ দেখাচ্ছিস? তেজ? তোর এই তেজের অন্ত আজ আমি করবো। ওই রতির মতো তোর গলা কেটে রেখে দিবো। আফসোস রুদ্র সেতা দেখতে পারবে না।”
“সাহস থাকলে করো”
দীপঙ্কর এবার আরও শক্ত করে ধরে উমার চুল। রাজশ্বী দীপঙ্করের হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে কিন্তু দীপঙ্করের লোকেরা তাকে ধরে ফেলে। উমাকে আবার প্রহার করতে লাগে দীপঙ্কর। কিন্তু উমার চোখে ভয়ের এক বিন্দুও দেখে না। এক পর্যায়ে উমার পেটে লাথি মারতে উদ্ধত হয় দীপঙ্কর। উমা পেটে আকড়ে থাকে। ঠিক সেই সময়ে ফুলির মা আঘাত করে উঠে দীপঙ্করকে। একটা ঝাড়ু নিয়ে এলোপাথাড়ি প্রহার করে সে। দীপঙ্করের লোকেরা ফুলির মাকে ধরে ফেলে। দীপঙ্কর রাগের চোটে ফুলির মাকে লাথি মারে। তার মাথায় চোট লাগে। এদিকে শাবীব এবং রক্তিম সিগারেট টেনে ফিরে আসে। কিন্তু ঘর নিস্তদ্ধ দেখে তারা দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়ে। তারপর দীপঙ্করের লোকেদের সাথে তাদের বেশ ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। দীপঙ্কর সেই সুযোগে রাজশ্বীর হামলা করতে গেলে উমা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। ডাইনিং টেবিলের ছুড়িটি দিয়ে পেছন থেকেই আক্রমন করে উঠে সে। রক্তছিটকে পড়ে উমার মুখে। শাড়িটি রক্তে লাল হয়ে উঠে। দীপঙ্কর হাটু গেড়ে বসে। তখনও শান্ত হয় না উমা। ছুরিটি নিয়ে তার গলায় আরেকবার আঘাত করে। দীপঙ্করের মাথাটি ধর থেকে আলাদা হয়ে যায়। উমা হাফাচ্ছে। তখন ই ঘরে প্রবেশ করে রুদ্র, শ্রাবণ এবং শাশ্বত। উমা রক্ত চক্ষুতে তাকায় তাদের দিকে। উমাকে এমন পরিস্থিতিতে দেখে স্তব্দ হয়ে যায় রুদ্র______________
২৮!!
সাল ২০২২,
জানালার গ্রিল ঘেষে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উমা। বৃষ্টি থেমেছে বহুক্ষণ হয়েছে। ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়া বহমান, আবহাওয়া ঠান্ডা পরশ বুলাচ্ছে উমার মুখশ্রীতে। কাঁচাপাকা চুলগুলো উড়ছে, মাঝে মাঝে মুখমন্ডলে লেপ্টে যাচ্ছে। সোনালী ফ্রেমের নিচের বৃদ্ধ চোখজোড়া তাকিয়ে আছে ডুবন্ত সূর্যের পানে। নীল আকাশ কমলা রঙে রাঙিয়ে উঠেছে, পশ্চিমে রক্তিম সূর্যটি পাড়ি দিচ্ছে অন্য পথে। ব্যাস্ত দিনটি ঢলে পড়বে নিকষ কৃষ্ণ আধারে। যেমনটা উমার যৌবন ঢলে পড়েছে, চামড়াটা কুচকে এসেছে। শরীরে বেঁধে দু একটা রোগ। নজর দূর্বল হয়ে গিয়েছে খানিকটা। চৌদ্দটা বছর কেটে গেছে। কিভাবে এই চৌদ্দটি বছর কেটেছে হিসেবটা আজও অজানা। পুরোনো সেই কালীগঞ্জের বাড়ির দেয়ালে লেগেছে নতুন রঙ। উমা জানালার পাশের আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিলো। তার চোখ ভেজা, আজ একাকীত্ব তার সঙী। উমা হাতে নিলো ছবির এলব্যামটি। জীবনের রঙিন সময়গুলো এই ছবির এলব্যামে লুকায়িত। নির্জীব ছবিতে না জানি কতো অকথ্যে কথা রয়েছে। উমা পাতা উলটালো, হুট করে এলব্যামের মাঝে রাখা একটা কাগজ পরে গেলো। কাগজটি নিচু হয়ে উঠালো। কাগজটি পুরোনো হয়ে গিয়েছে। লেখায় ময়লা জমেছে। কালীটা বেরঙ হয়ে উঠেছে। লেখাটি রুদ্রের, গোটা গোটা হাতের লেখায় কিছু শব্দ। উমা চোখ বুলালো সেই কাগজে,
“ওহে ষোড়শী,
সর্বগ্রাসী অগ্নির ন্যায় তুমি
যতবার ছুয়ে যাও
ততবার পুড়ি
ছারখার হই
তবুও খেই হারা পথিকের ন্যায় বারে বারে তোমার কাছে আসি
চরম অবহেলায় বুজে আসা আখির নেত্রে শুধু তোমাকেই রাখি
ভঙ্গুর হৃদয়ের শুধু একটাই বুলি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি”
উমার মনে হলো রুদ্র তার গা ঘেষে কবিতাটি আবৃত্তি করলো, তার উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুয়ে গেলো উমার কান। কেঁপে উঠলো তার হৃদয়। উমা চুমু খেলো কাগজে। চোখে জল বিন্দু বিন্দু পড়লো কাগজে, আজ যে তার প্রিয়তমের মৃত্যবার্ষিকী। গতবছরের করোনা নামক মরনব্যাধিতে উমার হাতেই শেষ নিশ্বাস ছেড়েছিলো তার প্রিয়তম, রুদ্র। বাঁচানোর কম চেষ্টাটি করা হয় নি যদিও। কিন্তু ঈশ্বরের মর্জির কাছে কার জোর আছে? মানুষটি নেই ঠিক ই, কিন্তু তার নীল ভালোবাসার চাঁদর আজও আচ্ছাদিত করে রয়েছে উমাকে, তার এই উষ্ণ ভালোবাসা মনের কোনে আজ ও জীবন্ত। মানুষটি না থাকলে হয়তো সেদিনের সেই স্মৃতিটা কালোরাতে পরিণত হতো উমার জন্য। রক্তিম হাতজোড়া দেখে নিজের প্রতি ঘৃণা আসছিলো উমার। সে যে খুন করেছিলো। যে রক্তকে এতকাল ভয় পেতো, সেই রক্তই সারা অঙ্গে ধারণ করে রেখেছিলো সে। রুদ্র না থাকলে হয়তো সেই স্মৃতি ভোলা অসম্ভব হতো।
চৌদ্দ বছর পূর্বে,
রুদ্র, শাশ্বত এবং শ্রাবণ যত সময়ে বাড়িতে পৌছালো ততসময়ে যা হবার হয়ে গিয়েছিলো। উমা স্তদ্ধ রক্তাক্ত শাড়িতে বসে রয়েছে। মুখে লেগে আছে দীপঙ্করের কালচে রক্ত, তার চাহনী স্থির। অসুর বধের পর কি সবার এমন ই হয়? অনুভূতি শূণ্য লাগছিলো নিজেকে তার। হাতের জমাট বাধা কালচে রক্ত দু চারবার মোছার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু রক্তটা মুছছে না। জমাট বেঁধে আছে। রাজশ্বী মিনু এবং গোপালকে জড়িয়ে বসে রয়েছে। ফুলির মা, শাবীব, রক্তিম জখমী হালে রয়েছে। দীপঙ্করের সাথে থাকা কিছু ছেলে পালিয়ে গেছে। কিন্তু মার খেয়ে অবচেতন। উমা দীপঙ্করের দ্বিখন্ডিত লাশের পাশে বসে রয়েছে। রুদ্র দ্রুত পায়ে হেটে উমার সামনে বসলো। উমা নিস্তেজ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। শান্ত শীতল কন্ঠে বললো,
“আমি মেরে দিয়েছি তাকে। অবশেষে আমার হাতও রক্তে লাল হয়ে গেলো, দেখুন। উঠছেই না। কখন থেকে চেষ্টা করছি।“
রুদ্র জড়িয়ে ধরলো উমাকে। উমা কাঁদছে না। তার অনুভূতিগুলো যেনো জমাট বেঁধে গেছে। সে রুদ্র থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। শ্রাবণের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“খুনটা আমি করেছি”
শ্রাবণ একবার রুদ্রের দিকে চাইলো, পুনরায় চাইলো নিস্তদ্ধ উমার দিকে। সেও জানে খুনটি কেনো হয়েছে। রুদ্র এগিয়ে এসে বললো,
“কোনো ভাবে কি ওকে বাঁচানো সম্ভব নয়?”
“চিন্তা করবেন না রুদ্র, নিজেকে বাঁচাতে উনি এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। সাক্ষী আমি নিজে দিবো। আপনি চিন্তা করবেন না। উনার শাস্তি হলেও বেশি হবে না চিন্তা করবেন না”
পুলিশ উমাকে হাতকড়া পড়ায়। দীপঙ্করের লাশটি নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করা হয়। দীপঙ্করের সব সাঙ্গপাঙ্গদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। উমা নিঃশব্দে পুলিশের সাথে চলে যায়। দীপঙ্করের মৃত্যুর পর মৌমিতা ভেঙ্গে পড়ে। অভিনব সিংহের কানে খবরটি যেতেই তার বুঝতে বাকি নেই এই দাবার চালের শেষ গুটিটিও হারিয়েছেন তিনি। শ্রাবণ এবং বাকিদের সাক্ষীর ফলে কোর্টে প্রমাণিত হয় উমা আত্নরক্ষা করতে এবং দীপঙ্করের হামলা থেকে রাজশ্বী এবং নিজের অনাগত সন্তানকে বাঁচাতে তার উপর আক্রমণ করে। সেজন্য তাকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। উমা এবং রুদ্রের সন্তান সেখানেই জন্মায়। উমার মতোই মুখের আদলের একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। রুদ্র তার নাম রাখে দিত্যা। বাচ্চাটি জেল থেকেই রুদ্রের কাছে দেওয়া হয়। দিত্যাকে রাজশ্বী বড় করে। উমা জেল থেকে বের হলে শাশ্বত এবং রাজশ্বীর বিয়েটা হয়। অপরদিকে, উমা এবং রাজশ্বীকে আক্রমণ এবং রুদ্রকে হত্যার প্রচেষ্টায় অভিনব সিংহকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কোর্ট প্রমাণ এবং সাক্ষী মেনে অভিনব সিংহকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। তার দু বছরের মাঝেই জেলে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তার সাথে রুদ্র দেখা করে। তিনি শ্লেষ্মা জড়িত কন্ঠে বলে,
“অবশেষে জিতেই গেলে?”
“অন্যায় শক্তিশালী হলেও ন্যায় কাছে হারতে বাধ্য বাবা।“
অভিনব সিংহ কথা বলেন নি বেশী। তার বাধ্যর্ক জীবনে এমন পরিণতিটা মেনে নেওয়াটা সহজ ছিলো না। যে অভিনব সিংহ কে সকলে ভয় পেতো সেই অভিনব সিংহকেই থাকতে হয়েছে খুনী পিশাচদের মাঝে। কয়েকবার তো অহেতুক কয়েদিদের হাতে মার ও নসিবে জুটেছে তার। মৃত্যুকালীন সময়ে স্ত্রীর দেখা মিলে নি তার। রুদ্র সেবারে সকল বাঁধা কাটিয়ে পৌরমেয়র হয়েছিলো। উমা জেল থেকে বের হবার দিন ছিলো রুদ্রের কাছে সবচেয়ে আনন্দের দিন। সফেদ একখানা পাঞ্জাবী পড়ে একরাশি গোলাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। উমাকে একখানা লালপাড়ের শাড়ি দিয়েছিলো সে। শাড়িটি পড়েই জেলের গেট থেকে বের হয় উমা। বহু মানুষ উমার বের হবার অপেক্ষায় ছিলো। তার সংগঠনের অনুপ্রাণিত নারীরা এসে সংবধনা দিয়ে বরন করে উমাকে; যেভাবে মা দূর্গাকে বরণ করা হয়।সকলে অভ্যর্থনায় বিচলিত হয় উমা। তখন সকলের আড়ালে কানের ফাঁকে রুদ্র গুজে দিয়েছিলো একটি গোলাপের কলি। বলেছিলো,
“ভয় পেও না, ষোড়শী। তুমি খুনী নও, তুমি প্রেরণা। এই নারীদের বিশ্বাস। তুমি ভয় পেলে যে এদের বিশ্বাস ভেঙ্গে যাবে। যুদ্ধে তো অস্ত্র ধারণ করতেই হয়, দেখার পালা সেই অস্ত্রটা কিসের জন্য? ভয় পেও না”
রুদ্রের সেই কথাটা এখনো মনে আছে উমার। এরই মাঝে মিনুর কন্ঠ কর্ণপাত হতেই পেছনে ফিরে তাকায় উমা। মিনু তাকে বলে,
“দিদি, পার্টির লোকেরা নিচে বসে রইছে। আপনি যাবেন না?”
“তাদের চা দাও আমি আসছি, দিত্যা কি চলে এসেছে?”
“হ, মাত্র আসলো। জামা কাপড় ছেড়ে পড়তে বসলো”
“আচ্ছা যাও”
মিনু চলে গেলো। উমা উঠে দাঁড়ালো। নিচে পার্টির লোকেরা এসেছে। জেল থেকে বের হবার পর উমার হাতে খড়ি হয় এই নোংরা রাজনীতিতে। রুদ্রের সাথে তাল মিলিয়ে সে এগিয়ে চলে প্রতিনিয়ত। তার ধরণী কল্যান সংগঠন শুধু সাতক্ষীরাতে সীমাবদ্ধ নয়। তা সারা দেশে বিস্তার পেয়েছে। লাখ লাখ নারী সদস্য তাদের। শিউলী এই সংগঠন দেখে। উমা এখন কোনো সাধারণ নারী নয়, সাতক্ষীরা ৪ নং আসনের সদস্য সে। উমা নিচে যেতেই সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে, উমা হাত জড়ো করে বলে,
“নমস্কার, বসুন। প্রচারণার কাজ কতদূর?”
আবারো ভোটের সময় হয়ে এসেছে, আবারো বাতাসে উড়ছে হাজারো পেমপ্লেট। কালীগঞ্জের বাংলোর বাহিরে মানুষের ঢল, মানুষের মিছিলের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে,
“উমা দেবী জিন্দাবাদ, উমা দেবী জিন্দাবাদ”
***(সমাপ্ত)***