পরের দিন তিতির ক্লাস শেষে রবিনদের বাসায় গেল। রবিন ততক্ষনে তাদের সব বেডিং পত্র বেঁধে ফেলেছে। শুধু তিতিরের অপেক্ষায় ছিল তারা। তিতির দরজার সামনে দাড়িয়ে গেল ওর বাবাকে দেখে। এতদিনে তিতির অনেকটা কঠোর হয়ে গেছে। তাই আর দাড়িয়ে না থেকে সোজা রুমে গিয়ে সবার উদ্দেশ্য সালাম দিল।
এরশাদ মীর দাড়ী রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে মোওলানা হয়ে গেছে। আল্লাহর ভয়ে হয়ত হেদায়াত হয়েছে। তাই তিতিরের কথা স্মরন হয়েছে। এরশাদ মীর তিতিরকে বলল," তুই একা! জামাই আসলোনা?"
মাহাদের কথা বলতেই তিতির চুপ হয়ে গেল। কারন মাহাদ একদম পছন্দ করেনা তিতিরের বাবাকে। মাহাদকে না জানিয়েই তাই এখানে আসতে হয়েছে।
ও কাজে একটু ব্যস্ত তাই আসতে পারেনি। বাসার সবাই ভালো আছে?
"সবাই ভালো আছে, শুধু ইভাটা একটু অসুস্থ।"
ইভা অসুস্থ! ইভার ছোট্ট চেহারাটা তিতিরের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এই দুই হাতে ইভাকে কত কোলে নিছে। আর আজ সে অসুস্থ। বাবা, ঢাকায় নিয়ে আসো ওকে। এখানে ভাল ডাক্তার দেখালে ও ঠিক হয়ে যাবে।
এরশাদ মীর বিড় বিড় করে বলল," আর ভাল ডাক্তার, ওকে তিনবার এর মধ্য মাদ্রাজ থেকে দেখিয়ে আনলাম তবুও কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। মেয়েটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সবই পাপের ফল। পিতামাতার কর্মফল মনে হয় মেয়েটার উপর পড়ল।"
তিতির কথাগুলো বুঝতে পারলোনা। রবিনের বাবা এরশাদরে চুপ করতে বলে তিতিরকে বলল," খুব সুখেই আছিস তাহলে!"
" আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। "
"আমাদের বাসায় যাইতে মন চায়না তোর?"
" তিতির শুধু হতাশার একটা মুচকি হেঁসে মাথা নিচু করে রইল। কারন এই কথার কোন জবাব নেই তার কাছে।"
অনেক কথা হল তাদের মাঝে। এত কথার ভিতরও এরশাদের সাহস হলনা তিতিরকে একবার নিজের বাসায় যাওয়ার কথা। তিতিরের সব সয়ে গেছে। এখন তিতিরের মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। নিজেকে শুধু পরজীবীই মনে হচ্ছে। মাহাদ চায় কিন্তু তার পরিবার তিতিরকে চায়না। এই জন্য না জানি ফুয়াদ ভাইয়ার মত মাহাদকেও তার পরিবার ছাড়তে হয়। জানিনা আমার কি করা উচিত। আল্লাহ্ সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তৌফিক দান করুন আমায়। আমার আর মাহাদের জন্য যা ভালো হয় তাই করুন।
আমীন
♦♦♦♦
মাহাদ বাসায় ওর মাকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করাল। লাবীবাকে বলল," জান্নাতুল তাজরীমের বাসায় যাচ্ছি। হিনুর ওখানে কিছু কাজ আছে।"
লাবীবা আর কিছু বললনা। সে আজ কালের ভিতরই মেয়েটার পরিবারের সাথে কথা বলতে চায় তাই আর বারন করলনা। বরং ভালো উপহার নিয়ে যেতে বলল।
মাহাদ আজ সত্যিই অনেক বাজার করেছে। যেই ছেলে নিজে কোনদিন বাজারে যায়নি আর সে আজ নিজের হাতে দোকানিদের বড়লোক করে দিয়ে তিতিরের জন্য বাজার করেছে। সব কাজ করে সে বাসায় এসেছে দেড়টার দিকে।
আসমা দরজা খুলে দিয়ে মাহাদকে দেখে অবাক হয়ে বলল," ভাইজান আপনি! ভালো আছেন আপনি?"
"আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি, তুমি ভাল আছ? তিতির কই আসমা!"
আপাতো বাসায় ফিরেনি ভাইজান। এতক্ষনে আসার কথা কিন্তু এখনো আসলনা। ফোন দিলাম কিন্তু রিসিভ করলোনা।
তুমি এগুলো সব ফ্রীজে রাখো বলে মাহাদ রুমে এসে ফ্রেস হয়ে তিতিরকে কল দিল কিন্তু বরাবর ওর নাম্বারটা এবার বন্ধ দেখাল। কয়েকবার কল দিল তবুও বন্ধই দেখাচ্ছে। শেষে মাহাদ চিন্তায় পড়ে গেল। আজ তিতিরকে নিয়ে কত প্লান ছিল কিন্তু এখন তিতিরেই কোন খোঁজ নেই। মাহাদ হিনুদের বাসায় গিয়ে হিনুকে জিঙ্গাসা করলো ওকে কিছু বলে গেছে কিনা?
হিনু বলল," ওর তো চলে আসার কথা এতক্ষনে। "
আচ্ছা থাক বলে মাহাদ গাড়ী নিয়ে বের হয়ে গেল তিতিরের ভার্সিটিতে। ভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আসে-পাশে যতদুর যায় মাহাদ সব খুঁজে দেখলো।এর মধ্য কয়েকবার আসমাকে কল দিল তিতির ফিরেছে কিনা! নাহ্ তিতির তখনো ফিরেনি। মাহাদ আসমাকে কিছু কাজ করতে বলে কল কেটে দিল।
♦♦♦♦
তিতির সন্ধ্যার একটু পর ফিরল। মাহাদ তখনো বাহিরে আছে। তিতির রুমের ভিতর চলে গেল। আসমা শুধু বলল," আপা কই ছিলেন?"
" একটু কাজ ছিল আসমা, সব শেষ করে আসতে দেরি হয়ে গেল।"
আসমা আর কিছু না বলে ওর রুমে গিয়ে মাহাদকে কল দিয়ে বলল," ভাইজান, আপা বাসায় আসছে।"
" ওকে আসমা, তিতিরকে কিছু বলোনা। আমি এখুনি বাসায় আসছি।"
কেউ কিছু না বললেও হিনু এসে তিতিরকে বাঁশ দিল। তিতির তুমি বাহিরে গেছ ঠিক আছে কিন্তু একটা ফোন দিয়ে জানাবা তো! মাহাদ সেই কখন থেকে তোমায় খুঁজছে। এখন অবদি বাসায় ফিরেনি। তোমার থেকে এমন ব্যবহার আশা করা যায়না তিতির। পরের বার এগুলো ভুল শুধরে নিও বলে হিনু চলে গেল।
মাহাদ এসেছে! তিতিরের বুকটা দুরদুর করতে লাগলো। এখন সে মাহাদকে কি বলবে! বাবার সাথে দেখা করেছি সেটা বললে হয়ত ও অনেক কষ্ট পাবে। কারন ওকে না বলে আমি গিয়েছি।
মাহাদ ঘন্টা খানেক পর বাসায় এল। মাহাদ যখন রুমে আসল তিতির তখন কিছুটা ভয়ে নার্ভাস হয়ে গেল। শেষে এতটাই নার্ভাস হয়ে গেল যে ভয়ে মাহাদের সাথে কথা অবদি বলতে পারল না।
মাহাদ সেটা লক্ষ্য করল। তাই তিতিরকে কিছু না বলে ফ্রেস হয়ে এসে একটা ফতুয়া আর লুঙ্গি পড়ল। মাহাদের খুব সখ ছিল একদিন অন্তত সংসারী মানুষের মত চলাফিরা করা। তাই সে আজ নিজ হাতে বাজার করেছে। কখনো লুঙ্গি পড়া হয়নি। তাই লুঙ্গির গিটটা ভাল করে গুজতে পারছেনা।
তিতির......!
"মাহাদের ডাকে অন্যমনস্ক তিতির চমকে উঠে মাহাদের দিকে চাইল।"
"তিতির এখানে এসে লুঙ্গির গিটটা ভালো করে বেঁধে দাওতো!"
তিতির ধীরে ধীরে মাহাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে লুঙ্গির গিটটা ভালো করে গুজে দিল। কিন্তু কিছু বলল না। তিতির মাহাদের কাছ থেকে চলে যেতেই মাহাদ তিতিরের হাত ধরে বলল," তোমার এমন ব্যবহার আমার জন্য খুব কষ্টদায়ক তিতির! এমন ব্যবহার কখনো আমার সাথে করোনা।"
তিতির হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আলমারি থেকে একটা ছোট বক্স এনে বলল," এটা আমাকে পড়িয়ে দিবেন?"
এবার মাহাদ খুঁশি হয়ে গেল। মাহাদ আরো দুটো বক্স ওর অফিস ব্যাগ থেকে বের করে বেডে গিয়ে বসে তিতিরকে ইশারা করে কাছে ডেকে বসাল।
তিতিরও সাথে সাথে বসে দু'হাত বাড়িয়ে দিল মাহাদের দিকে। মাহাদ খুব সাবধানে তিতিরের হাতে বালা, নাকে নাকফুল আর শিক্ষাবৃত্তির টাকায় কিনা একটা চেন, যার ভিতর MT লেখা একটা লকেট ছিল। সব পড়িয়ে দিয়ে তিতিরের দিকে তাকিয়ে বলল," একদম পারফেক্ট।"
তিতির জানতোনা মাহাদ তাকে এতকিছু গিফট্ করবে। তিতির দরজাটা বন্ধ করে এসে একটা বাসন্তী শাড়ী পড়ে আয়নার সামনে দাড়ালো। এবার তিতির নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ হল। তিতিরের মুখে এবার হাঁসি ফুটলো। তিতির চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলল," মাহাদ দেখেন তো! এবার আমাকে মাহাদের বৌ বৌ লাগছে তো?"
মাহাদ চুপ করে তিতিরকে দেখছে। ভেজা চুলে নারী সত্যই অপ্সরী। আর এ যেন শুধু মাহাদের অপ্সরী।
"মাহাদ একটা জিনিস চাইবো দিবেন!"
মাহাদ অন্যমনস্ক হয়ে বলল," হুম বলো।"
"আমার ঠোটে আপনার প্রেমের ছোয়া দিয়ে দিবেন? বেশি নিব না একটু দিলেই হবে।"
মাহাদ সাথে সাথে বেড থেকে উঠে গেল তিতিরের কাছে। আজ তিতির আরো কিছু চাইলেও হয়ত দিত মাহাদ। মাহাদ তিতিরের ওষ্ট দু'টির ভালোবাসা নিজের ওষ্ট দু'টি দিয়ে শুষে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভালোবাসা গভীর থেকে আরো গভীরে চলে যেতে লাগল এমন সময় দরজায় কলিংবেল বেজে উঠলো। সাথে সাথে মাহাদ তিতিরকে ছেড়ে দিল। কিন্তু তিতির মাহাদকে ছাড়তে রাজি নয়। তিতির আজ ওর বাবার থেকে শেষ পর্যায়ে অনেক আঘাত পেয়েছে। সেই আঘাত ভুলার জন্য মাহাদের উপর চড়াও হয়েছে ভালোবাসা আদায়ের জন্য। এই একটা মানুষ তাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে গেছে সবসময়। তার কাছেই তিতিরের সমস্ত ভালবাসার আকাংখা। তিতির পিছন দিক থেকে মাহাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল," প্লিজ এখন আমাকে ছেড়ে যাবেন না।"
" তিতির পাগলামো করোনা, আন্টি আর হিনু আসছে বাসায়। ওনাদের রাতে আমাদের বাসায় দাওয়াত আছে।"
তিতির ঝট করে মাহাদকে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সাথে সাথে পরিপাটি করে বলল," আপনি আমাকে আগে জানান নি কেন? এখন আমি ওনাদের কি খেতে দেই। কিছুই রেডী করা হয়নি।"
"সারপ্রাইজ মিসেস মাহাদ, আপনি গিয়ে দরজা খোলেন বাঁকিটা এই মাহাদ করে নিবে।"
তিতির দরজা খুলে বাহির হয়ে ডাইনিংরুমের দরজাটা খুলে দিতেই হিনু বলল," কি তিতির! এতক্ষন লাগে দরজা খুলতে?"
দুঃক্ষিত আপু, আমি বুঝতে পারিনি। ভিতরে আসুন বলে দরজার সামনে থেকে তিতির সরে দাড়ালো।
এই তিতির তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ওয়েট, আমি তোমার দাদী শাগুড়ীর ভাষায় বলি, "শোন তিতির, অ্যাই যদি ব্যাটাছাওয়াল হইতাম তাইলে মাহাদকে ডিঙ্গিয়ে অ্যাই তোরেই শাদী করতাম।
"আপু আপনার আরো ট্রেনিং দিতে হবে। কারন দাদী আরও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।"
একদিন শুনেই অনেক বলেছি। আরো শুনলে হবুহু বলতে পারবো। সবাই ডাইনিং টেবিলে বসতেই তিতির অবাক হয়ে গেল। এত আয়োজন আসমা একা হাতে করল! আর আমি অর্কমার ঢেঁকি হয়ে শুধু খেয়েই যাবো?
হিনুর মা, হিনু, আসমা, তিতির, মাহাদ এবং গোলাব সবাই খেতে বসেছে। গোলাব অবশ্যই অন্য খাবার খাচ্ছে একটু দুরে বসে।
মাহাদ তোমারে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরে খুব ভালো লাগছে বলতেই হিনু ওর মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে বলল," আজ যদি আমি তিতিরের মত এমন কাজ করতাম তাহলে আমার বর ঘাড়ে হাত দিয়ে বের করে দিয়ে বলত, যেখানে ছিলি সেখানেই থাক। বাসায় আর আসতে হবেনা। কিন্তু তুই দেখছি পুরোই আলাদা। তিতির তোমার ভাগ্য বলতে হয়। এমন জিবনসঙ্গী পাওয়া চরম ভাগ্যর দরকার।
মাহাদ মুচকি হেঁসে বলল," মাথা না ঠান্ডা রাখলে তো তোর সংসার করার যোগ্যতাই নেই। ভালোবাসা না দিলে ভালোবাসা পাবি ক্যামনে? ভালোবাসা পেতে চাইলে আগে নির্ভেজাল ভালোবাসতে শিখতে হয়। তবেইনা তুই ভালোবাসা পাবি।"
"রাখ তোর যুক্তি। উপরওয়ালা সবাইকে এত ধর্য্য দেয়নারে। সবার গুন যদি এক হত তাহলে পৃথিবীটা বেহেস্ত হত।"
এই জন্যই তো বিচার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে। বাদ দে তো! খাবার ইনজয় কর...
♦♦♦♦
মাহাদ তিতিরকে নিয়ে সুয়ে আছে। তিতির কথাগুলো বলতে চাচ্ছে মাহাদকে কিন্তু বলতে পারছেনা। শুধু নখ খুটরে যাচ্ছে। শেষে মাহাদ বিরক্ত হয়ে বলল," তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?"
" না মানে, আজ রবিনদের বাসায় গিয়েছিলাম।"
" জানি তো?"
"আপনি জানেন!"
"হুম, পরে বুঝতে পারছি। কারন ওখানে ছাড়া তোমার যাওয়ার মত কোন জায়গা নেই।"
তিতির মাথা নিচু করে বলল," সেখানে বাবা আসছিল, তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।"
এবার মাহাদ চুপ করে গেল। হয়তবা কষ্ট পেয়েছে মাহাদ। কিন্তু তিতিরকে কিছু বললনা। এমন সময় মাহাদের ফোনে কল আসল। মাহাদ ট্রী টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে দেখল ওর মা কল দিয়েছে।
কলটা রিসিভ করে বলল, " হ্যাঁ মা, বল।"
" কিরে কখন আসছিস?"
" এইতো মা একটু পর যাচ্ছি বলে কলটা কেটে দিয়ে মাহাদ বেড থেকে উঠে পড়লো। দ্রুত চেঞ্জ করে বের হয়ে গেল। তিতিরের সাথে আর কথা বললনা। শুধু আসমাকে দরজাটা লাগিয়ে দিতে বলল।"
মাহাদ চলে যেতেই তিতির এক দৌড়ে ব্যালকুনিতে গিয়ে দাড়াল। মাহাদ গাড়ী নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। যতক্ষন না মাহাদের গাড়ী আড়াল না হল ততক্ষন পর্যন্ত তিতির ব্যালকুনিতে দাড়িয়ে রইল। অজান্তেই চোখ দিয়ে টপটপ করে করে পানি পড়তে লাগল। রুমে এসে তিতির নিজের শাড়ীটা খুলে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে কাঁদতে লাগল। মাহাদের শাস্তিগুলো এরকমই হয়ে থাকে। না কাটে না ছিড়ে কিন্তু চামড়ার ভিতর চিনচিনে ব্যাথা করে।
♦♦♦♦
কিছুদিন হল মাহাদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই তিতিরের। রাত ১২ টা পার হয়ে গেছে তবুও বইয়ের পাতায় মুখ গুজে আছে তিতির। এমন সময় ফোনে কল আসল। তিতির ফোনের স্কীনে না তাকিয়েই রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে মাহাদ বলে উঠলো ব্যালকুনিতে আসো।
তিতির ফোন বইয়ের উপর ছুড়ে ফেলে এক দৌড়ে ব্যালকুনিতে গিয়ে দেখলো মাহাদ বাইক নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আর দাড়োয়ানের সাথে গল্প করছে।
এবার মাহাদ ওকে ইশারা করলো নিচে নামতে। তিতির রুমে এসে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে দরজাটা খুলে বের হয়ে এল। মাহাদের এমন সারপ্রাইজ তিতিরের প্রচন্ড ভালো লাগে।
গেটের কাছে যেতেই দাড়োয়ান চাচা বলল," এই বয়সে আর কত কি দেখব। যাও মা যাও। স্বামীর কথা শুনতে হয়।"
তিতির কথাটা শুনে প্রচন্ড লজ্জা পেল। আগে যদি জানতাম এমন কথা শুনতে হবে তাহলে দেয়াল টপকাতাম। তিতির রাস্তায় চলে এসে মাহাদের বাইকের পিছনে বসতেই দাড়োয়ান বলল," এই তোমরা কই যাও।"
" কাজ আছে চাচা। আপনার কাজ আপনি করেন। বোঝেনই তো তাহলে আবার জিগান ক্যান?"
দাড়োয়ান মুচকি হেসে বলল," বাবা সবই বুঝি। আমি আরো বিশ বছর আগে ঐ সময় পার করে এসেছি। যাও তোমরা.......
মাহাদ হেঁসে বাইক স্টার্ট দিল। আজ তিতিরকে নিয়ে সে লং ড্রাইভে বের হয়েছে। শুধু গাড়ীর বদলে বাইক। মাহাদ কিছু দুরে এসে বাইক থেমে তিতিরকে বলল," তিতির আমার মত হয়ে বস।"
"ছেলেদের মত?"
হুম বলে একটা সাদা গ্লাসের চশমা দিয়ে বলল," এটা পড়ে নাও। তাছাড়া চোখে ধুলা যাবে।"
তিতির চশমাটা পড়ে বলল," তা মশাই, উফ্ স্যরি....
তা তিতিরের বর মশাই, আপনার রাগ এত দ্রুত ভেঙ্গে গেল! আমিতো ভাবলাম এ জন্মে আর হয়ত আপনার রাগ ভাঙ্গবেনা।"
"রাগতো ক্ষনস্থায়ী আর ভালোবাসা চিরস্থায়ী। তাহলে কার দাম বেশি বল?"
" ভালোবাসার।"
"আশা করি বুঝে গেছ আমি কি বলতে চাচ্ছি।"
তিতির মাহাদের কানের পিঠে একটা কিস করে বলল," হুম বুঝেছি তো।"
এর মধ্য অনেক দুরে চলে এসেছে তারা। মাহাদ ওর গন্তব্য স্থলে পৌছে গেছে। এখানে এসে ও বাইক স্ট্যান্ড করে। মাহাদ বাইক থেকে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে তিতিরের হাত ধরে হোটেলের ভিতর চলে গেল। একটা রুমে এসে ব্যাগটা তিতিরের হাতে দিয়ে বললো," চেঞ্জ করে নাও।"
তিতির ভেবে পেলনা মাহাদ এসব কি করছে। শপিং ব্যাগ খুলে দেখল, কালোর রঙ্গের উপর সাদা পাথর দিয়ে কাজ করা একটা সুন্দর গ্রাউন। সাথে হিজাব এবং ওড়না। মাহাদ এগুলো কেন?
কথা কম, ঝটপট রেডী হয়ে নাও। মাহাদও চেঞ্জ করে নিল। দু'জনেই মাচিং করা পোষাক। রাজযোটক জুড়ি যাকে বলে।
সব কমপ্লিট হলে মাহাদ তিতিরকে নিয়ে একটা রুমে চলে এল। পুরো রুমটা অন্ধকার ছিল। মাহাদ ওকে নিয়ে একটু উচু একজায়গায় দাড়াতেই চারদিকে লাইট জ্বলে উঠল। ও মাই গড এত মানুষ কই থেকে আসলো! সব মাহাদের ব্যাচমেন্ট। তিতির সবথেকে অবাক হল হিনুকে দেখে। এখানে হিনু আপুও এসেছে। মাহাদের সব ফ্রেন্ডরা এসেছে শুধু নিসা ছাড়া। মাহাদ নিসাকে ইনভাইটই করে নাই।
তিতির স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। এটা একটা রিসেপশনের হলরুম। তিতির আর মাহাদ স্টেজে দাড়িয়ে আছে। মাহাদ একটার পর একটা সারপ্রাইজ দিয়েই চলেছে তিতিরকে।
হ্যালো এভরিবড়ি, সী ইজ মাই কুইন তিতির। আজ বিয়ে বা আমাদের দু'জনার জন্মদিন উপলক্ষ্য পার্টি না। আজ যেটার জন্য পার্টি সেটা হল, এই দিনে আমি আমার তিতির নামক রানীর দেখা পেয়েছিলাম। তাই আজ আমাদের প্রেমের জন্মদিন। আমাদের একে অপরের কাছে আসার প্রথম ধাপের জন্মদিন। তোদের সবাইকে কথা দিয়েছিলাম ও আমার কাছে আসলে এই দিনের জন্য একটা পার্টি দিব। আল্লাহ্ সুবহানাতালা সেই ওয়াদা রাখার মত সামর্থ্য দিছেন। আজ সেই দিন চলেই আসলো।
আমার অনেক ফ্রেন্ড আছে যারা আমার রানীকে এখনো দেখেনি তাদেরও আমার রানীর সাথে পরিচয় করার জন্য এই মিলনমেলা।
মাহাদ মাইক্রোফোন বামহাতে নিয়ে ডান হাতে তিতিরের হাত ধরে বলল, " তিতির তুমি হয়তো জানোনা, তুমি আমার কাছে আসার আগে থেকে আমার এই প্রিয় এমন কোন ফ্রেন্ড ছিলনা যারা আমাদের রিলেশনের ব্যাপারে জানতোনা। তারা তোমার এই ♥অচেনা অতিথী♥ টার সমস্ত কাজের সাক্ষী ছিল।"
আমরা আজ বিবাহিত ক্যাপল। সবার কাছে দোয়া চাই সারা জিবন যেন একে অপরের অনূভুতি, কষ্ট গুলো বুঝতে পারি। সব খারাপ সময়গুলো পার করে এক সাথে চলতে পারি।
তিতির মাহাদকে আবার নতুন করে যেন চিনছে। চোখে পানি টলমল করছে। হিনু এগিয়ে এসে টিসু বের করে তিতিরের হাতে দিয়ে বলল," এই পাগলি কাঁদছো কেন? সময়টা উপভোগ করো। এর প্রতিটা মুহুত্ব মনের ভিতর গেথে নাও। এটা তোমার জন্য সব থেকে বেষ্ট মুহুত্ব।"
" জ্বী আপু।"
যারা শুধু তিতিরের নাম শুনেছে তারাও আজ তিতিরকে দেখলো এবং পরিচিত হল। পুরো পার্টি জমে উঠেছে। তিতির আজ খুব খুঁশি। একটা মানুষ কিভাবে এতটা ভালো হয়। মানুষের ভাগ্য কতটা ভালো হলে এমন একটা জিবনসঙ্গী পায় সে জিবনে। আল্লাহ্ কতটা খুঁশি হলে বলতেই একটা মেয়ে এসে মাহাদকে বলল," কিরে বাচ্চা কবে নিচ্ছিস?"
মাহাদ হেঁসে বলল," আল্লাহ্ সুবহানাতালা যেদিন রহম করবে, মনে কর সেদিনই পৃথিবী আলোকিত করে আমাদের সন্তানের আগমন ঘটবে।"
বাহ্ কি ভালবাসা! তা বাচ্চা হওয়ার পর তোর এই ভালোবাসা থাকবে তো?
" কেন থাকবেনা! তখন আরো হাজারগুন ভালোবাসা বেড়ে যাবে। কারন তার মাধ্যমে আমি আমার জিবনের শ্রেষ্ট নিয়ামত পাব। ভালবাসার কমতি, সেটা তো প্রশ্নই ওঠেনা।"
রাখ তোর বড় বড় কথা। তোদের পুরুষদের আমার ভালোকরে চেনা আছে। মেয়েরা বেবি জন্ম দেওয়ার পর তাদের ফিগার ফিটনেস খারাপ হয়ে যায়। তখন এই ভালোবাসার প্রেমিকগনও দুরে সরে যায়। আমিও রিলেশন করে বিয়ে করেছি কিন্তু তার বিনিময়ে ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই পেলামনা। ১বছর, ২বছর, ৩বছর বা তার থেকে কিছুসময় এই ভালোবাসা থাকবে। তারপর..... সেটা না হয় নাই বলি বলে রেখা চেখের পানি মুছলো। ৬ মাস বাবার বাসায় আছি। মেয়ে বা আমার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সে।
মাহাদ রেখার কোল থেকে ওর ২ বছরের ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে কয়েকটা কিস করেই বলল," আমার এমন একটা বাচ্চা থাকলে পৃথিবীতে আর কিছুই চাইতামনা। সন্তান জিবনের একটা শ্রেষ্ট দামী নিয়ামত। এর থেকে মূল্যবান সম্পদ জিবনে আর কিছু হতেই পারেনা।"
মাহাদের বলা প্রতিটা কথাগুলো তিতিরের অন্তরে গেঁথে গেল।