বন্ধন - পর্ব ১৬ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩১!! 

মায়রার রুম থেকে হাসির শব্দ শুনে তিথি উঁকি দিয়ে তিয়াশ আর মায়রাকে দেখলো। নিজেও হেসে ফেললো ওদের মিষ্টি হাসিমুখ দুটো দেখে। মায়রা বা তিয়াশ দুজনের কেউই তিথিকে খেয়াল করে নি। তাই তিথিই আগ বাড়িয়ে ওদের পাগলামিতে বাগড়া দিলো।

-এই এই? তোমরা একলা একলা খাচ্ছো? আমাকে বাদ দিয়ে! এ্যাঁ! আমি মানি না----।

-আরে! তিথি?

মায়রা উঠে আসার আগেই তিথি মায়রার পাশে গিয়ে বসে পড়লো। তিয়াশ ভ্রু কুঁচকে তিথিকে দেখছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় না এতোটা পিচ্চি সে। কিন্তু কাজকর্মে সবসময় বাচ্চামি ভাবটা ঠিকই থেকেই যায় পাগলিটার। 

-আপনি বাসা থেকে না খেয়েই চলে এসেছেন বেয়ান সাহেবা?

-হুহ--। না-। কিন্তু খেয়ে আসলে আবার খাওয়া যাবে না নাকি?

-আচ্ছা--। খান---। 

-উহু--। ভাবিকে কেউ যেভাবে একটু আগে খাইয়ে দিয়েছে, সেভাবে আমাকেও খাইয়ে দিতে হবে--। 

-হোয়াট!

তিয়াশ চোখ বড় বড় করে তিথির দিকে একবার আর একবার মায়রার দিকে তাকাতে লাগলো। এই পিচ্চিটার মুখে কি আসলেই কিছু আটকায় না? কার সামনে কি বলে আধো হুঁশ থাকে না!

-তা এতো তাড়াতাড়ি এলেন কি করে? ১১ঃ৩০ টা বাজে!

-হুহ--। দেরি হয়ে গেছে বলে খোঁটা দিচ্ছেন? রাতে ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছিল আমার---।

-ওহ আচ্ছা---।

-এখন যান তো--। এই ভাবি--। তুমি শাওয়ার নিয়ে আসো---। পার্লার থেকে দুটো আপু এসেছে আর আমি, আমরা তিনজন তোমাকে সাজাবো শাওয়ারের পর--।

-হুম--। 

-দাঁড়াও--। ভাইয়া সব পাঠিয়ে দিয়েছে--। এই যে বেয়াই সাহেব-। একটু ব্যাগটা নিয়ে আসুন না। আমি তো ছোট মানুষ ব্যাগটা আলগাতে পারি নি---। হি হি---।

-হায় রে! নিজের বোনের বিয়েতে আমারেই কুলি বানায়া দিলেন! বসেন--। নিয়া আসি---।

তিয়াশ নিচে তিথিদের গাড়ি থেকে ব্যাগ এনে তিথি মায়রার সামনে রেখে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তিথি ব্যাগ থেকে নরমাল একটা জামদানি বের করে দিয়ে গোসল করে আসতে বললো। মায়রাও শাওয়ার নিতে গেল। একটু পর তিয়াশ রুমে উঁকি মেরে দেখলো মায়রা আছে কিনা। মায়রা নেই দেখেই তিয়াশ একটা প্লেট হাতে করে তিথির সামনে এসে বসলো। তিথি তিয়াশকে দেখে হা হয়ে গেল। তিয়াশ সত্যি সত্যিই তিথির জন্য পাউরুটি টোস্ট করে এনেছে, সাথে ডিম পোঁচ আর জুস। ইশারায় তিথিকে চুপ থাকতে বলে তিথির মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলো। তিথি খাচ্ছে না দেখে তিয়াশ ভ্রু নাচালো।

-কি হলো? হা করো?

-আমার খিদে নেই একদম-। খেয়ে এসেছি তো। এমনি দুষ্টুমি করে বলেছিলাম তো তখন---।

-শশশশশ-। কথা কম বলো তো। আর খাও চুপচাপ--। 

তিথি হেসে তিয়াশকে দেখছে আর খাচ্ছে। তিয়াশও পিচ্চিটাকে খাইয়ে দিয়ে মজা পাচ্ছে। মেয়েটাকে দারুণ লাগছে দেখতে৷ টকটকে লাল রঙের ফ্লোরটাচ গাউন পড়েছে তিথি। সাথে ভারি মেকাপ আর হালকা অর্নামেন্ট। চুলগুলো ফ্রেঞ্চ বান করা, দু পাশ থেকে কিছু চুল ঝুলিয়ে বের করা। আর তিথির ঠোঁটের টকটকে লাল রঙটা তো তিয়াশের হুঁশ উড়ানোর জন্য সবসময়ই রেডি। তিথিকে খাওয়ানো শেষ হলে তিয়াশ আলতো করে তিথির কপালে চুমো খেয়ে বেরিয়ে গেল। কখন কে চলে আসে বলা যায় না। তিয়াশ চায় না দুটো পরিবার জানার আগেই ওদের সম্পর্কটা নিয়ে কোন ধরনের আজেবাজে কথা হোক৷ 

মায়রা গোসল শেষ করে বের হলে তিথি মায়রার চুল শুকানোয় মন দিলো। চুল শুকিয়ে গেলে মায়রার হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো। মায়রা শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলো। বিয়ের বেনারসি! গোল্ডেন সুতায় পান পাতা ছাপানো টকটকে লাল বেনারসি। লাল ভারি কাতানের ব্লাউজ। ব্লাড রেড কালারের কনের ওড়না। ওড়নাটার চারপাশে মোটা করে গোল্ডেন লেইসের কাজ। মায়রা শাড়িটা গায়ের উপর টেনে আয়নায় নিজেকে দেখলো। তিথি মায়রাকে অবাক চোখে দেখছে। মায়রা লাজুক হেসে বেনারসিটা নিজেই পড়ে নিল।। বেনারসিটা পড়ে আসার পর মায়রাকে কোন সাজ ছাড়াই লাল পরী লাল পরী লাগছে। পার্লারের মেয়ে দুটোও ততক্ষণে রুমে চলে এসেছে। মায়রাকে দেখে ওরাও জাস্ট হা হয়ে গেল। বিয়ের সাজের আগেই মেয়েটাকে এতোটা সুন্দর লাগছে, না জানি সাজানোর পর কতটা গর্জিয়াস লাগবে দেখতে! বর তো আজ নতুন বউয়ের দিক থেকে চোখই ফিরাতে পারবে না। পার্লারের মেয়ে দুটো এসব বলাবলি করছিলো। আর মায়রা লজ্জায় লাল হয়ে তিথির পিছনে এসে মুখ লুকালো। এভাবে কেউ বলে!!

টুকটুকে লাল বেনারসির সাথে তিথি মায়রাকে হাতে বালা, পাঞ্জা, হাতপদ্ম, মান্তাসা পড়িয়ে দিয়েছে। আঙুলে আংটি। গলায় সীতাহার, পাতিহার। কোমড়ে বিছা হার। নাকে নথ। কানে ঝুল ঝুমকো। পাফ করে আধো ফুলানো চুলে গোল্ডের টিকলি আর টায়রা।

পার্লারের মেয়ে দুটোও খুব যত্ন করে মায়রাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পাফ করে চুলগুলোকে হালকা ফুলিয়ে খোঁপা করছে একজন। আরেকজন মোটা করে আইলাইনার আর কাজল দিয়ে মায়রার চোখ সাজাতে ব্যস্ত। ঠোঁটে টকটকে লাল ম্যাট লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁটের কাজটা ভালো করে ফুটিয়ে ট্যাডিশনাল একটা লুক দিল ওরা। সাজ শেষ হলে মায়রা আয়নায় নিজেকে দেখলো। কপালে কুমকুম টিপের ফোঁটাগুলোও আজ অসম্ভব ভালো লাগছে ওর। কুমকুম টিপের ফোঁটার মাঝে টকটকে লাল টিপ। সেটাতেও বহু কারিগরি করে নকশা করেছে মেয়েরা। নিজেকে চিনতেই যেন হিমশিম খাচ্ছে মায়রা। সাজতে তো বরাবরই খুব একটা পছন্দ করে না মায়রা। তবে আজকের এই ভারি মেকাপ, এতো এতো ফাউন্ডেশন, পাউডার, কাজল, কুমকুম, সবই বেশ লাগছে ওর কাছে। মেহেদী রাঙা হাতের সদা স্বচ্ছ নখে আজ টকটকে লাল নেইলপালিশটাও বেশ লাগছে ওর এখন। বিয়ে বিয়ে একটা অনুভূতিটা আসছে ওর। খানিকটা লজ্জা, খানিক ভয়, খানিক সংকোচ আর ঢের খানিকটা আবেগ, সব মিলিয়ে অন্য কোন দুনিয়ায় আছে মায়রা৷ 

মায়রার খোঁপা বাঁধা চুলে খোঁপার জালি পড়িয়ে বকুল ফুলের গাজরা পড়ালো তিথি। তারপর কনের ওড়নাটা মাথার উপরে দিয়ে সাজটা কমপ্লিট করলো মেয়েগুলো। মায়রার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে পার্লারের মেয়েগুলো বিদায় নিলো। ওদের সাথে কিছু একটা কাজে বাইরে বের হলো তিথিও। সাজ হতে বেশ অনেকটাই সময় লেগেছে। এখন কেবল মায়রার অপেক্ষার পালা। কারো আসার অপেক্ষা। আর সেই মানুষটার ওকে দেখে কি রিএ্যাকশন দেবে সেটা দেখার জন্য বুকের মধ্যে ছটফটানি। 

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ শুনে মায়রা মুখ তুলে তাকালো। সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে চমকে উঠলো মায়রা। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে মায়রার। ও ঠিক দেখছে তো! নাকি ভ্রম হচ্ছে! এক পা দু পা করে মানুষটি এগিয়ে এসে মায়রার পাশে বসে মায়রার হাত ধরে কিছু একটা পড়াতে লাগলো। মায়রা হঠাৎ করেই যেন কথা বলতেই ভুলে গেছে। কি বলবে! সেটাই তো ওর জানা নেই। এতো অদ্ভুত অবস্থায় তো ও জীবনেও পড়েনি কখনো! 

-তোকে তো কখনো কিছু দিতে পারি নি--। আজ বিদায়ের দিনে এগুলো রাখ। এগুলো আমি একটু একটু করে গড়িয়েছিলাম তোর জন্য--৷ সবার সামনে পড়িয়ে দিব সে সাহস তো আর আমার নেই-। তাই সবার আড়ালেই পড়ালাম--। শ্বশুড়বাড়িতে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলিস তোর বাপ মা একেবারে খালি হাতেও পাঠায় নি---। আজকের পর আর এই বাড়িতে আসবি কিনা জানি না--। তবে শ্বশুরঘরে সবার মন জুগিয়ে চলিস--। কাউকে কখনো কষ্ট দিস না--। আর ভুলেও, যত যাই হোক না কেন ও বাড়ি থেকে আসার কথা কল্পনাতেও আনিস না। আজ থেকে ওটাই তোর শেষ ঠিকানা---। 

মানুষটা মায়রার হাতে মোটা এক জোড়া বালা পড়িয়ে দিয়ে আরেকটা গয়নার বক্স মায়রার কোলে রেখে মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মায়রা গয়নার বক্সটা খুলে দেখলো বেশ ভারি একটা নেকলেস, কানের দুলের একটা ফুল সেট। অসম্ভব সুন্দর ডিজাইন। মায়রা সেটার ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করলো একটু আগে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা আধো সত্যি নাকি ওর কল্পনা!

আয়ান বরযাত্রী নিয়ে আসার পর তিথি আর মায়রার কাজিনরা সবাই মিলে মায়রাকেও স্টেজে এনে বসালো। মায়রা বেশ বুঝতে পারছে মানুষটা ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় বেচারি আর মুখ তুলে আয়ানের দিকে তাকাতেই পারলো না। কাজী সাহেব এসে বিয়ের আচার শুরু করলেন। তিনবার কবুল শব্দটা বলতে মায়রার বুকের ভিতরে তুমুল ঝড় বয়ে গেল। আর আয়ানের দৃঢ় কণ্ঠের  তিনবার 'কবুল' শুনে আনন্দের ঝিলিক দেখা দিলো মায়রার চোখে মুখে। রেজিস্ট্রিতে সাইন করতে গিয়েও আবার একই অবস্থা হলো মায়রার। আয়ান সম্ভবত খুশির চোটে এক নিঃশ্বাসে সাইন করে ফেললো। সেটা বুঝতে পেরে মায়রার একে লজ্জা লাগছে, আবার হাসিও পাচ্ছে।

বিয়ের নিয়ম কানুন শেষ হওয়ার পর খাওয়া দাওয়া পর্ব শুরু হলো। আয়ানের একপাশে মায়রা, অন্য পাশে তিথি। তিথির পাশে তিয়াশ আর তিথি আর মায়রার আর সব কাজিনরা বসেছে। খাওয়া পর্ব শেষ হতে বিকেল ঘনিয়ে গেল৷ মায়রা আর আয়ানকে আবার স্টেজে এনে বসানো হয়েছে। ছোট্ট একটা কম্পিটিশন মতো একটা অনুষ্ঠান হবে একটু পর। সবাই সেটার সেটআপ করাতেই লেগেছে। আয়ানও ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে মায়রার হাতে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার। মায়রা বেচারি লজ্জা পেয়ে তাকাতেই পারছে না আয়ানের দিকে। লোকটা যে কি করে সবসময়ই!
 

-এই যে নতুন বউ? তোমার বরের সব রকমের দোষ জানতে হলে আমাকে জিজ্ঞাসা করবা বুঝসো? ওকে আমার চাইতে বেশি কেউ জানে না। 

একটা মিষ্টি কণ্ঠে কথাটা শুনেই মায়রা চমকে উঠে সামনের দিকে তাকালো৷ ক্রিম কালারের জর্জেটের শাড়ি পড়া একেবারে পরীর মতো একটা মেয়ে মায়রার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে দেখে থতমত খেয়ে গেল মায়রা। মেয়েটা মানুষ নাকি সত্যি সত্যি পরী সেটাই বুঝতে পারছে না মায়রা৷ কিন্তু সেটা চিন্তা করা বাদ দিয়ে মায়রা মেয়েটার বলা কথাটা ভাবার চেষ্টা করলো। এটা কি বলেছে উনি! সবার চেয়ে বেশি চিনে উনি আয়ানকে! কে ই বা উনি! আর আয়ানের সাথেই বা কিসের সম্পর্ক উনার!

৩২!! 

মায়রা থতমত খেয়ে একবার আয়ানকে দেখছে আর একবার ওর সামনে দাঁড়ানো পরীর মতো মেয়েটাকে। কি বলবে, কি রিএ্যাক্ট করবে বেচারি বুঝতে পারছে না। তবে হুট করেই এই পরীটাকে এখন খুবই বিরক্ত লাগছে মায়রার৷ কারণটা বুঝতে পারছে না। হয়তো মেয়েটা এমন উদ্ভট একটা কথা বলেছে বলে। অথবা মেয়েটা আয়ানের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে বলে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এই পরীর মতো সুন্দর মেয়েটাকে অসহ্য লাগতে শুরু করেছে মায়রার। ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে আয়ানের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে। এর আগে কখনো এমনটা হয় নি। আজ হঠাৎ কি হলো!

মায়রা এসব ভাবতে ভাবতেই তিথি কোথা থেকে এসে মেয়েটাকে "আরুআপ্পু" বলে জড়িয়ে ধরেছে। 

-আরিশা--- মায়রাকে তোর কথা বলি নি বলে বদলা নিচ্ছিস এখন এসব বলে? ও কি ভাবছে?

-আরে! ইয়ার! বদলা নিবো কেন? আমি তো জাস্ট পরীক্ষা করে দেখছিলাম, আমার কথা শুনে তোর বউ কি রিএ্যাক্ট দেয়!

-কিসের পরীক্ষা?

-ভালোবাসার পরীক্ষা-। নতুন বউটা আমার এই গাধা বন্ধুটাকে কতটা ভালোবাসে সেটার পরীক্ষা।

-নিজে ভালোবাসার আগামাথা বুঝে না, আসছে আমার বউয়ের পরীক্ষা নিতে---।

-এই কি বললি তুই আয়ান?

-কই! কিছু না তো।

আয়ান বিড়বিড় করে কথাটা বলায় আরিশা ঠিক মতো শুনতে পায় নি কথাটা। কিন্তু মায়রা ঠিকই শুনেছে। মায়রা কিছু না বলেই চুপ করে বসে রইলো। কেন জানি কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না ওর। তিথি ততক্ষণে আরিশাকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছে স্টেজের সামনের সারির একটা সোফায়। এক্ষুণি অনুষ্ঠান শুরু হবে ওদের। অনুষ্ঠানের শুরুতে আয়ান আর মায়রার কাজিনদের একটা দলীয় নাচ হলো। তারপর তিয়াশ আর তিথি একটা ডুয়েট গান ধরলো।

-"বন্ধু তুমি থাকো যদি পাশে,
বসে রব নিরালায়....
মন যে কখন দিয়ে দেব,
তোমার ঐ চোখের ইশারায়....
এই মন জানেনা যে,
কতটা ভালোবাসে....
রাতের আধার হলে,
খুঁজে আশেপাশে....
বন্ধু তুমি জানোনা...
জানোনা...
কত ভালোবাসি তোমাকে....।।
কত ভালোবাসি তোমাকে....।।
তোমায় আমি খুঁজি,
খুঁজি আপন মনে....
তুমি স্বপ্নে আছো মিশে
আছো আমার জাগরণে....
বন্ধু তুমি জানোনা...
জানোনা...
কত ভালোবাসি তোমাকে....।।
কত ভালোবাসি তোমাকে....।।"

তিথি তিয়াশের গান শেষ হতেই তিথি লজ্জায় লাল হয়ে আরিশার পিছনে গিয়ে লুকালো। মায়রার কাজিনরা এবার আয়ানকে গান গাওয়ার জন্য জোরাজোরি শুরু করে দিলো। আয়ান হেসে মায়রার দিকে তাকিয়ে গান ধরলো।

-"এই মন তোমাকে দিলাম
এই প্রেম তোমাকে দিলাম।
তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কিবা দূরে রও
মনে রেখো আমিও ছিলাম।।
বকুলের মালা শুকাবে
রেখে দেব তার সুরভী
দিন গিয়ে রাতে লুকাবে
মুছো নাকো আমারই ছবি।
আমি মিনতি করে গেলাম।।
ভালোবেসে আমি বার বার
তোমারি ও মনে হারাবো
এই জীবনে আমি যে তোমার
মরণেও তোমারই হব।
তুমি ভুলো না আমারও নাম।।"

এভাবে অনুষ্ঠানটা সন্ধ্যা পর্যন্ত চললো। মায়রা বেচারি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। আয়ান একটু পরে পরে তাকাচ্ছে ওর দিকে। সবাই সেটা নিয়ে হাসাহাসিও করছে। কিন্তু লোকটার যদি একটুও লজ্জা বলে কিছু থাকে আর কি! কখনো মায়রাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে, আলতো করে হাতে হাত রাখছে, কিছু লাগবে কি না জানতে চাইছে একটু পর পর। আর বেচারির রাঙা লাল মুখের দিকে তাকিয়ে শয়তানি মার্কা হাসি দিচ্ছে। এমন কেন লোকটা!

আটটার দিকে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আয়ান মায়রাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। মায়রার বুক ফেটে কান্না আসছে। এতোদিনের সমস্ত অত্যাচার, অপমান, অপবাদ থেকে তো সত্যিকারের মুক্তি পেয়ে অন্য এক জগতে চলে যাচ্ছে ও। তবুও কেন মায়রার এতো কষ্ট হচ্ছে এই মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে! হয়তো এটাকে রক্তের টান বলে! নিজের সত্তাকে ছেড়ে যাচ্ছে এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে মায়রার। আরো বেশি কষ্ট লাগলো যখন মায়রার বাবা মা আয়ানের হাত ধরে বললেন, "আমাদের মেয়েটাকে দেখে রেখো বাবা"।  কথাগুলো ফর্মালিটির জন্য বলা নাকি তাদের মন থেকে বলা সেটাই বুঝতে পারছে না মায়রা। মায়রাকে দেখে রাখা না রাখায় তাদের কি আসলে কিছু যায় আসে!

গাড়িতে উঠে বসে মায়রা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। কান্নায় চোখ মুখ ঝাপসা হয়ে আসছে ওর। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি মতো উঠছে। ঠোঁট কামড়ে ধরেও কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছে না বেচারি। একটু সময় পার হতেই হাতে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকালো মায়রা। আয়ান একটু হাসার চেষ্টা করলো। মানুষটার চোখেমুখেও কিসের একটা ব্যথা ফুটে উঠেছে। মায়রা অবাক চোখে তাকাতেই আয়ান আলতো করে মায়রাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আলগা করে জড়িয়ে ধরলো। মায়রা থতমত খেয়ে আয়ানের দিকে তাকালো।

-কি করছেন? সামনের সিটে তিথি বসা।

-সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি ম্যাডাম--। আপনি চুপ করে এভাবে থাকুন। এতো কান্নাকাটি করে হয়রান হয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। একটু পানি খাবেন?

-হুম? নাহ---।

-তাহলে এখন চুপ করে বসে থাকো---। আশ মিটিয়েই কাঁদো, তবে আমার বুকে থেকে---।

বাসায় ফিরে বেশ অনেকক্ষণ সবাই আড্ডা দিলো। তারপর খাওয়া দাওয়া করার পরও আয়ান মায়রাকে কেউ ছাড়ছেই না। আয়ানের মা সবাইকে ধমক লাগিয়ে মায়রাকে নিয়ে চলে গেলেন। মেয়েটার উপর সারাদিন কত ধকল গেছে। তার দিকে কারো হুঁশ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি বলে মায়রাকে নিয়ে এলেন উনি। তিথিও মায়ের সাথে চলে এসেছে। মায়রাকে একটা রুমে এনে বসালো তিথি। ফুল দিয়ে সাজানো ঘরটা। মায়রা অবাক চোখে রুমের ডেকোরেশন দেখছে আর তিথি দেখছে মায়রাকে।

-ইশ! ভাবি! তোমাকে এতো কিউট লাগছে! আজকে কত মজা হইসে! আমার নিজেরই বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখে।

তিথির কথা শুনে মায়রা হেসে ফেললো। তিথি মায়রাকে ব্যাগ এগিয়ে এনে দিলো।

-ধরো ভাবি--। তোমার ব্যাগ। তুমি মেকাপ তুলে শাওয়ার নিবা চলো? এতো ভারি মেকাপ থাকলে স্কিনের ক্ষতি হবে--। 

-আমি একাই পারবো তিথি--।

-সিউর? নাকি ভাগানোর জন্য বলতেসো?

-না না--। সত্যিই পারবো---।

-ওকে-। আমি তাইলে টা টা৷ তুমি শাওয়ার নাও। আমি ভাইয়ার থেকে বকশিস নিতে গেলাম।

-আচ্ছা---।

তিথি লাফাতে লাফাতে বাইরে গিয়ে রুমটা বাইরে থেকে লক করে দাঁড়িয়ে রইলো। আর মায়রাও মেকাপ তুলে শাওয়ার নিয়ে নতুন পাড় ভাঙা শাড়ি পড়লো। 

তিথিকে বেশ অনেকগুলো টাকা বকশিস দিয়ে রুমে আসতে পেরেছে আয়ান। রুমে ঢুকেই একেবারে হা হয়ে গেল বেচারা। বেলি, কাঠ বেলি আর গোলাপ দিয়ে সাজানো খাটের মাঝখানে বসে আছে মায়রা। ক্রিম কালারের সুতোর কাজ করা রয়েল ব্লু জামদানিটা পড়নে মায়রার। সাজ বলতে কপালে ছোট্ট একটা টিপ আর চোখে কালো মোটা কাজল। মায়রা খাট থেকে নামতেই আয়ান মায়রাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বারান্দার দিকে হাঁটা ধরলো। মায়রা তাল সামলাতে না পেরে আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরেছিল। মানুষটার মতিগতি কিছুই বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলো আয়ানের মুখের দিকে। 

আয়ান মায়রাকে কোলে করেই বারান্দায় রকিং চেয়ারটায় বসে পড়লো। চেয়ারটা পিছনের দিকে বেশ অনেকটাই হেলে যাওয়ায় মায়রা ভয় পেয়ে আয়ানের পাঞ্জাবির কোণা আঁকড়ে ধরে চোখ বুজে ফেলেছিলো। আয়ান হেসে এক হাতে মায়রার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে অন্য হাতে চুলের ভেতর দিয়ে মুখটা তুলে ধরে তাকালো। মায়রার ভিজে চুলগুলো বেয়ে আয়ানের গায়েও পানি পড়ছে। সেটাও ভালো লাগছে আয়ানের। আর মেয়েটার চোখ বুজে থাকা দেখে মুখটা আরেকটু কাছে টেনে নিলো আয়ান। 

-মায়রা? একটু চোখ খোলো না লাজুক পরী?

-হুম?

মায়রা চোখ খুলতেই আয়ানের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল৷ আয়ান মায়রার কোমড় থেকে হাত সরিয়ে দু হাতে মায়রার মুখটা তুলে ধরলো। 

-তোমাকে ওই ইলেকট্রিক বাতির আলোয় যতটা মোহনীয় লাগছিল তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি মায়াবী লাগছে এই আবছা চাঁদের আলোয়--। 

-আপনাকেও ভিষণ সুন্দর লাগছে--। 

-ওহ আচ্ছা? তাই? তবে আপনার সাজে যে একটু ঘাটতি রয়ে গেছে আজ--।

-কি?

-ঠোঁট--। ঠোঁট জোড়া লাল হলে মানাতো না? তুমি তো আবার লিপস্টিক খুব একটা পছন্দ করো না---। কথা ছিল আমি অন্যভাবে রাঙিয়ে দিব তোমার ঠোঁট---। এখন দেই পরী?

-হুম? হুম----।

আয়ান মায়রাকে একেবারে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। বেশ অনেকটা সময় পর মুখ তুলে মায়রার দিকে তাকালো। 

-ইশ! ঠোঁট রেঙেছে ঠিকই--। মুখটাও লজ্জায় রঙে লাল হয়ে গেছে--। এটা কোনো কথা? এতো লজ্জারাঙা মুখ দেখে তো অন্য কিছু মাথায় ঘুরছে গো লাজুক পরী।

-হুম?

-দুটো প্রশ্ন ছিলো মায়রা--। করি?

-জি করুন---।

-আমাকে মন থেকে মেনে নিতে পেরেছ তোমার স্বামী হিসেবে?

------জি---। 

-ওয়াও! তো এতো আপনি আপনি করছো কেন? নিজের বরকে বুঝি কেউ আপনি করে বলে?

- না মানে----।

-ওরে লাজুক পরী---। তোমাকে নিজের করে পেয়েছি---। আজ তোমায় আরো নিজের করে পেতে চাই। একেবারে অধিকার নিয়ে কাছে টানতে চাই। তোমার কি কোনো আপত্তি আছে?

-----উহু---।

-সত্যি?

-হুম----।

মায়রা লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছিলো দুহাতে। আয়ান আলতো করে মায়রার মুখ ঢাকা হাতে, গালে চুমো খেয়ে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। বিছানায় আলতো করে শুইয়ে দিতেই মায়রার শাড়িটা পেটের কাছ থেকে একটু সরে গেল। শাড়িটা সরামাত্রই মায়রার নাভির বাম পাশের কুচকুচে কালো তিলটায় চোখ পড়লো আয়ানের। আর সাথে সাথেই ঘোর লেগে গেল আয়ানের। আয়ান ঝুঁকে মায়রার তিলটায় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে আঁচলে হাত রাখলো। আয়ানের স্পর্শে মায়রা কেঁপে উঠছিলো। শাড়ির আঁচলে হাত দিতেই মায়রা আয়ানের হাতটা ধরে ফেললো। আয়ান ঘোর লাগা নেশা নিয়ে মায়রার দিকে তাকালো।

-কি হলো মায়রু? এনি প্রবলেম?

-লা-লাইট-লাইটটা অফ করে নিন না প্লিজ?

-নাহ--। আমি আজ আমার লাজুক পরীর শরীরের তিল আবিষ্কার করবো--। আর এই তিলে এতো নেশা ধরানো ঘোর কেন সেই রহস্য ভেদ করবো--। আরো আলো চাই আজ আমার।

-এই? না প্লিজ? আমি মরে যাবো--। লাইট অফ করে নিন প্লিজ?

-কিন্তু আমি তো তাহলে কিছুই দেখতে পাবো না? এই নেশা ধরা তিলগুলোর রহস্য কি করে---।

-অন্য সময় দেখিয়েন--। প্লিজ?

-উমমমমম-। আচ্ছা ঠিক আছে লাজুক পরী। আজ আদর করি। পরে রহস্যের সমাধান করবো। সেদিন বাধা দিলেও শুনবো না আমি---।

আয়ান উঠে লাইট অফ করে দিয়ে মায়রাকে আরো গভীরভাবে কাছে টেনে নিলো। আবারো উষ্ণ স্পর্শে মায়রাকে মাতাল করে তুললো আয়ান। তারপর দুজনে পাড়ি জমালো সুখের সমুদ্রে, কোনো এক অজানা সুখের দেশে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন