৪৭!!
বৌভাতের ফাংশনটা শেষ করে মায়রা এখন আভা আর সামির সাথে নাইয়রে যাচ্ছে। সামির আনা গাড়িতে বসা ওরা পাঁচজন। ড্রাইভিং সিটে সামি, তার পাশেই আভা। আর পিছনের সিটে আয়ান, তার পাশে মায়রা আর মায়রার পাশে জানলা দখল করে বসা বাঁধন। বৌভাতের পর মামা মামির সাথে যেতে হবে শুনেই কেন জানি বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠেছিল মায়রার। কিসের একটা ভয় খেলা করছে বুকের পা পাশটায়। ভয়টা কিসের জানা নেই মায়রার। চব্বিশ ঘণ্টাও পার হয়নি এই বাড়িতে এসেছে ও। অথচ কেমন যেন ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাড়িটা আর বাড়িগুলো মিশে গেছে ওর। শ্বশুরবাড়ির সাথে একটা মেয়ের সম্পর্ক বুঝি এমনই হয়! তবে প্রতিটা মেয়ের সেই চির আকাঙ্ক্ষিত নাইয়র যেতে বুকটা কেঁপে উঠছে কেন ওর? এ কিসের ইঙ্গিত কে জানে?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে জানলা দিয়ে বিকেলের কড়া রোদের শহরটাকে দেখছিল মায়রা। ঠিক দেখছিল বললেও হয়তো ভুল বলা হবে। ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে ওদের গাড়িকে যে শত শত গাড়ি শা শা করে ক্রস করে যাচ্ছে সেটা একদমই টের পাচ্ছে না মায়রা। ওর দৃষ্টি দূরে, বহুদূরে। হাবিজাবি সব ভাবতে ভাবতে মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে মায়রার৷ ঠিক এমন সময় কোমড়ে এক হাতের পরম স্নেহের স্পর্শ অনুভব করলো মায়রা। হাতটা কোমল পরশে মায়রাকে স্পর্শ করতেই মায়রা একটু কেঁপে উঠলো। নিজেকে একটু শান্ত রেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে দৃষ্টি জানালা থেকে সরিয়ে আয়ানের দিকে ফিরলো মায়রা। মায়রা তাকাতেই আয়ানও চোখের ইশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে। মায়রা ঠোঁটের কোণে আগের হাসিটা ধরে রেখেই মাথা নাড়িয়ে কিছু হয়নি সেটা জানালো।
আয়ানের চোখে চোখ রেখে 'কিছু হয়নি' নামক ছোট্ট মিথ্যেটা বলতে মায়রার সত্যি ভিষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু আয়ানের শান্ত আর ওমন হৃদয়ভেদী দৃষ্টি যে চোখের, সেই চোখ থেকে নিজের নজর ফিরিয়ে নিবে এমন সাধ্য কি মায়রার কোন কালে ছিল? না আজ আছে? অথচ নিজের এমন অযাচিত ভয়টাও তো বলা যায় না তাকে। কি বলবে? আধো বলার কি আছে? সে কি বুঝবে কিসের ভয় এসে ঘর বেঁধেছে মায়রার বুকের ভিতরে? সদ্য পাওয়া সংসার হারানোর ভয়টা যে মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয়ংকর মনে হচ্ছে মায়রার কাছে, সেটা কি বুঝবে আয়ান? আয়ান নাহয়, অন্য কেউও কি বুঝবে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আয়ান আরেকটু গভীরভাবে মায়রাকে স্পর্শ করে নিজের একটু কাছে টেনে নিলো। মায়রা একটু কেঁপে উঠলো আবারও৷ আয়ানের ঠোঁটের কোণেও মিষ্টি করে একটা হাসি ফুটে উঠেছে।
-এইযে ম্যাডাম ভাবনাবিদ, এতো টেনশন কেন করছেন? সব ঠিক আছে তো। এতো টেনশন করলে তো নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে। সেটা কি খুব একটা ভালো হবে ম্যাডাম?
মায়রা মুখ নিচু করে একটু হাসলো। এই লোকটা কি করে ওর মনের কথাটা পড়ে ফেলে? আজকাল নিজের মনে কিছু ভাবলেও সেটা টের পেয়ে যায় মানুষটা। কি করে? আয়ান এবারে মায়রার কোমড় থেকে হাত সরিয়ে মায়রার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে আঙুলের ভাঁজে মায়রার আঙুলগুলো চেপে ধরলো। মায়রার দিকে এক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইলো।
-ভালোবাসি তাই বুঝতে পারি। তুমিও আগের মতো সব ভয় কাটিয়ে ভালোবাসার চেষ্টা করো। তুমিও চুপিচুপি আমার মনের কথাগুলো টের পেয়ে যাবে।
মায়রা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। আসলেই কি ও আগের মতো নেই? বদলে গেছে? বদলে গেছে ওই মানুষটার জন্য ভালোবাসাও? কথাগুলো মায়রার ভিতরে কেমন একটা ঝড় তুলছে। কোথা থেকে ওর জীবনে কি হচ্ছে তার কিছুই যেন মায়রার আয়ত্তের মধ্যে নেই। এতো সাধ্য সাধনার পরে নিজের প্রিয় মানুষটার উপরে একটা অধিকার পেয়েছে, তবুও কেন মাঝের অদৃশ্য দেয়ালটা ও ভাঙতে পারছে না? কিসের বাধা ওর এই দূরত্বটা ঘোচাতে? বাধা? নাকি ভয়?
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। আয়ান মায়রা দুজনে এখন সামিদের বাসায়। বাঁধনও এতোক্ষণ মায়রার রুমেই ছিল। আভা একটু আগে ওদেরকে রেস্ট করতে বলে বাঁধনকে প্রায় জোর করে নিয়ে গেছে। মায়রা এতোক্ষণ যা ও বাঁধনের সাথে কথা বলছিল, এবারে একদম চুপ হয়ে গেল। আয়ানও মায়রার চিন্তিত মুখটা দেখে কিছু বললো না। আস্তে করে মায়রার কোলে মাথা রেখে কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে নাক ঘষতে শুরু করলো। মায়রা চমকে উঠে আয়ানের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর আয়ানের স্পর্শে কেঁপে উঠছে একটু পর পর। সেদিকে যেন আয়ানের নজরই নেই। সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মায়রার ঘ্রাণ নিলো। তারপর আলতো করে চুমোয় ভরিয়ে দিতে লাগলো মায়রার পেটে। আয়ানের চুলে মায়রার হাত দুটো যেন জমে গেল নিমিষেই। আয়ানের ঠোঁটের কোণে হাসিটাও আরো বিস্তৃত হলো। আবার চুমো খেল মায়রার পেটে।
-তুই কবে আসবি বল তো? আমি যে অধীর হয়ে তোর আসার অপেক্ষায় বসে আছি। ইশ! তোকে লাল টুকটুকে ফ্রকটায় কি যে কিউট লাগছিলো! চোখের সামনে সেই দৃশ্যটা যেন ঝুলে আছে। ওইরকম একটা টকটকে লাল জামা তোকে এনে দিবো। চলে আয় না বাবাইয়ের কাছে মামনি?
মায়রা আয়ানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। লোকটা কি পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি! কি সব বলছে? মায়রা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আয়ানের চুলে হাত বুলিয়ে দিল আবার।
-এই? আয়ান? তুমি এসব কি বলছ? আর কাকেই বা বলছ?
-আমার ছোট্ট মামনিটাকে।
কথাটা বলেই আয়ান আরেকবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো মায়রার পেটে। তারপর মায়রার কোমড় ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে মায়রার মুখের দিকে তাকালো।
-কার কথা বলছো?
-এই বলো তো মায়রা আমাদের বাবুটার কি নাম রাখবো? মেয়ে বেবি চাই আমার আগেই বলে দিচ্ছি।
-কি?
-উমমমম। আমায়া নামটা সুন্দর না মায়ু? হুম। আমার আমায়া বেবি। বাবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
-তুমি সত্যি পাগল হয়ে গেছ। মেয়ের খবর নেই, সে নাম নিয়ে পড়েছে। হুহ।
-হলে হয়েছি। কিন্তু এই পাগলের সাথেই আজীবন থাকতে হবে। কিচ্ছু করার নেই ম্যাডাম। আর তুমি চাইলেই তো আমার মেয়েটা আমার কাছে চলে আসতো। তুমিই তো দিচ্ছো না। ধ্যাত।
-তোমাকে আমি------।
-স্বপ্নটা ভিষণ সুন্দর ছিল জানো? তুমি আমি আর আমাদের ছোট্ট লালপরী আমায়া। আমার আমায়া। বিশ্বাস করো স্বপ্নেও এতোটা জীবন্ত লাগছিলো। পরীটা তোমার কোলে, আর তুমি আমার---। কি সুন্দর করে 'বাবা' বলে ডাকছিল! আহ! মনে পড়তেই হৃদয় জুড়িয়ে যায়।
মায়রার মুখটা আবার লজ্জায় লাল হয়ে গেছে দেখে আয়ান দুহাতে মায়রার মুখটা তুলে ধরলো।
-এই মায়রা? পরীটাকে আমার চাই তো? দিবে না প্লিজ?
মায়রা চোখ বন্ধ করে আয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো। আয়ানও হেসে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটা সুন্দর স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে এসে মায়রা রুমে এসেছে। পড়নের শাড়িটা বদলে হালকা একটা থ্রি পিস পড়ে সবে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে এমন সময় আয়ান মায়রাকে টেনে নিয়ে বিছানার উপরে বসিয়ে দিয়ে নিজে মায়রার পায়ের কাছে বসে পড়লো। তারপর আলতো করে মায়রার পায়ের কাছ থেকে পায়জামাটা একটু সরিয়ে দিলো। মায়রা থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি আয়ানের হাতটা ধরে ফেললো।
-এই এই? কি করছ তুমি?
আয়ান মায়রার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। সে নিজের কাজে ব্যস্ত। পায়ের পাতায় ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে মায়রা চমকে তাকালো আবার। আয়ান একমনে মায়রার পায়ে আলতা পড়াতে ব্যস্ত। প্রথমে মায়রার পায়ের পাতার মাঝখানে বড় করে একটা বৃত্ত এঁকে দিয়েছে। তারপর তার চারপাশে আরো পাঁচটা ছোট বৃত্ত। আর পায়ের পাতার পাশ ঘেষে মোটা করে আলতা দিয়ে ঢেউ তোলা রেখা। দুপায়েই আলতা রাঙানো শেষ হলে আয়ান আলতার বোতলটা খাটের নিচে এককোণে রেখে দিয়ে মায়রার পায়ে এক জোড়া নূপুর পড়িয়ে দিয়ে উঠে মায়রার পাশে বসলো। মায়রা অবাক হয়ে একবার আয়ানকে দেখছে আর একবার নিজের আলতা রাঙা পা। আয়ানের ঠোঁটের কোণে হাসিটাই বলে দিচ্ছে কাজটা করে সে কতোটা খুশি। মায়রা কিছু বলার আগেই আয়ান মায়রার হাত দুটো টেনে নিয়ে মায়রার মেহেদী রাঙা হাত দেখায় মন দিলো। মায়রা হাত টেনে নেয়ার চেষ্টা করতেই আয়ান মায়রার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
-মায়রা? এতো নড়াচড়া করো কেন? তোমার এতো লাফালাফিতে আমার আঁকা আলতার ডিজাইনের যদি কিছু হয়--। তাহলে কিন্তু খবর আছে বলে দিলাম।
-আরে!
-চুপ করে বসে থাকো। এতো ছটফট করো না তো। তোমার হাত তো আমি খেয়ে ফেলছি না। নাম খুঁজছি। সো ডোন্ট ডিস্টার্ব মি৷
মায়রা কিছু না বলে চুপ করে গেল। এই মানুষটাকে কিছু বললেও সে শুনবে না। নামটা খুঁজে পেলে কি হবে সেটাই ভাবার চেষ্টা করলো মায়রা৷ হঠাৎ হাতের তালুতে আয়ানের ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়ে সামনের দিকে তাকালো মায়রা। আয়ানের ঠোঁটের কোণে বাঁকা দুষ্টু হাসিটা দেখে ঢোক গিললো মায়রা। আয়ান ভ্রু নাচিয়ে মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
-নাম তো পেয়ে গেছি। এবার কি করবে?
-কোথায় পেলে! হয়নি-----।
-এই যে দেখো? এখানে? আর হয়নি বলে তো লাভ নেই। ম্যাডাম। আমি জিতেছি। এখন আমার কথা মানতে হবে-----।
-কি মানতে হবে?
মায়রার ভীত হরিণীর মতো মুখটা দেখে আয়ান হাসলো। কিছু না বলে মায়রার ঘাড়ে হাত রেখে মুখটা নিজের মুখের একদম কাছে নিয়ে এলো।
-রাতে ঘুমানোর আগে তোমার মিষ্টি ঠোঁটের আদর চাই।
-হুম? কি?
-তাড়াতাড়ি করো তো? ঘুম পাচ্ছে ভিষণ। কয়দিন ঘুমাই নি খেয়াল আছে? তবু এতো রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রেখেছ! এটা কোন কথা?
-তুমি ঘুমাও না?
-কাল সকালেই তোমাকে কানের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে মনে হচ্ছে।
-কি! কেন?
-এই যে কানে শুনছ না যে।
-শুনছি তো?
-তো তাহলে? তাড়াতাড়ি করো?
মায়রা কোনমতে আয়ানের দিকে এগিয়ে আসতেই আয়ান মায়রাকে বুকে টেনে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মায়রাকে নিজের বুকের উপরে তুলে নিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো।
-দাও। এবার করো? দেখা যাবে তোমার চুমোর আশায় বসে থাকতে থাকতেই আমি ঘুমিয়ে পড়বো।
মায়রা চোখ বন্ধ করে আয়ানের ঠোঁটে আলতো করে একবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়েই আয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো। আয়ান হেসে ফেললো মায়রার এমন কাজে।
-বাপরে! একটা চুমো দিবে তাতেই কি অবস্থা! আমার যে কি হবে! হায় আল্লাহ! হাহ। ঘুমাও ঘুমাও।
মায়রা আয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে হাসলো। কিছু বললো না। আয়ানও মায়রাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। সমস্ত ভয়, দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে মায়রার চোখেও নামলো শান্তির ঘুম।
৪৮!!
দুটো দিন মামা মামীর বাসায় বেশ আনন্দেই কেটেছে আয়ান মায়রার। সারাদিন ওরা সবাই মিলে বন্ধুর মতো আড্ডা দিয়েছে, একসাথে ঝাঁপাঝাপি করে রান্না করেছে, একে অন্যের ছোট ছোট বোকামিগুলো নিয়ে হাসাহাসি করেছে, কেউ লজ্জা পেয়েছে আর কেউ সেই লজ্জামাখা মুখটা উপভোগ করেছে। ওদের সাথে আরো দুজন মানুষ এসে দলে ভিড়িছে। তাথৈ আর রিহান। দুটো দিন সমস্ত চিন্তা ভুলে অসাধারণ সময় কাটিয়েছে সবাই। কাল সকালে মায়রা শ্বশুর বাড়িতে ফিরবে। তাই বেশ অনেকটা রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছে সবাই মিলে। হাসি তামাশা করতে করতে কখন যে গভীর রাত হয়ে গেছে সেদিকে কারো খেয়ালই ছিল না। দেয়াল ঘড়িটায় দুটো বাজার ঘন্টা শুনে সবাই হেসে ফেললো। তারপর একে অন্যকে বিদায় জানিয়ে ঘুমাতে গেল।
আয়ান ফ্রেশ হয়ে এসে মায়রাকে রুমে না পেয়ে বারান্দায় উঁকি দিলো। মায়রাকে অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়ান পিছন থেকে মায়রাকে জড়িয়ে ধরলো। মায়রা কেঁপে উঠলো। কিন্তু কিছু বললো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকার দেখতে লাগলো। আয়ান মায়রার কাঁধে নাক ঘষে দিয়ে ঘাড়ে মুখ ডুবালো।
-মায়ু? ঘুমাবা না আজকে?
-ঘুম আসছে না আমার৷
-কি ভাবছো এতো? সব ঠিক আছে তো পরী। এতো কেন টেনশন করছ?
-আমার ভয় করছে আয়ান।
-কেন? কি হয়েছে?
-জানি না আয়ান। খুব ভয় করছে৷ মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হবে--।
-শশশ। পাগলিটা। এতো টেনশন করতে হয়? আর এতো নেগেটিভ ভাবার কি হলো? বি পজিটিভ বউসোনা৷ কিচ্ছু হবে না। আর হলেও আমি তো আছি নাকি? সব সামলে নিবে তোমার বরটা৷ এখন চলো লক্ষী মেয়ের মতো ঘুমাবা। কত রাত হলো খেয়াল আছে?
-হুম---। চলো?
-আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই চলো? তাড়াতাড়ি ঘুম আসবে তাহলে----।
-উঁহু। তোমার বুকে ঘুমাবো।
-আচ্ছা বাবা। ঠিক আছে। যেমন বউয়ের মর্জি--। এখন আসো তো আসো?
আয়ান মায়রাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে আলতো করে চুলে হাত বুলিয়ে দিলো অনেকক্ষণ। ক্লান্তিতে এক সময় ঘুমিয়েও গেল দুজনেই৷ ঘুমের মধ্যেও থেকে থেকে ভয়ংকর কিছু স্বপ্ন দেখে কেঁপে উঠেছে মায়রা। ভয়ে একদম গুটিশুটি হয়ে আয়ানের বুকের মধ্যে লুকানোর চেষ্টাও করেছে। আয়ানও ঘুমের মধ্যেও মায়রাকে নিজের বুকের মধ্যে শক্ত করে প্রচন্ড ভালোবাসায় আগলে রাখলো। যেন সমস্ত ভয়, বিপদ, আশংকা সব থেকে সবসময় আগলে রাখবে এমন করে।
সকালবেলা মায়রার ভয়টা আরো বেড়ে গেল। বুকের ভিতরে কেউ যেন সজোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। কোন এক অজানা ভয়ে ঢিপঢিপ করছে বুকের ভিতরে। একসময় সেই ভয়টা এতোটা বাড়লো যে বেচারি নাস্তাটুকুও করতে পারলো না। আয়ান বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। তাই আর দেরি করলো না। মামা, মামি, তাথৈ, রিহান, বাঁধন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মায়রাকে নিয়ে বাড়িতে রওনা হলো। সামি নিজেদের গাড়ি আর ড্রাইভার দিয়ে দিয়েছে। মায়রা সারাটা রাস্তা চুপ করে আয়ানের পাশে বসে রইলো। একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। বেচারির এমন গম্ভীর মুখটা দেখে আয়ানেরও খানিকটা চিন্তা হতে শুরু করেছে৷ সবার কাছে মায়রার ব্যাপারটা লুকিয়ে কি সে আসলেই ভুল করেছে? মায়রাকে আলতো হাতে বুকে টেনে নিলো আয়ান। আর একটা সিদ্ধান্ত নিলো। আজ বাড়ি গিয়েই মা বাবাকে মায়রার ব্যাপারে সবটা বলে দিবে। তাতে আর কিছু হোক না হোক মেয়েটা সারাক্ষণ এই ভয়টার হাত থেকে তো অন্তত মুক্তি পাবে!
বাড়ির গেইটের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই মায়রা তাড়াহুড়ো করে নামলো। আয়ান মায়রার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।
-তুমি যাও। আমি লাগেজটা নিয়ে আসছি।
-হুম---।
মায়রা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজায় কলিংবেল বাজাতেই কেউ একজন দরজাটা খুলে দিলো। মায়রা মুখ তুলে তাকে চিনতে পারলো। মেয়েটা আর কেউ নয় সায়না। মায়রাকে দেখেই সায়নার ঠোঁটের কোণে কেমন একটা কটাক্ষের হাসি ফুটে উঠলো। মায়রা বুঝতে পারলো না এই সকালে সায়না এই বাড়িতে কি করছে। আর হাসছেই বা কেন! মায়রার এসব ভাবনার মাঝেই সায়না আবার একবার কুটিল হাসি দিয়ে মায়রার জন্য দরজা ছেড়ে দিলো। মায়রা তখনো ভ্রু কুঁচকে সায়নার দিকে ছিল। এবার সায়না সরে দাঁড়াতেই বাসায় ঢোকার জন্য পা বাড়ালো মায়রা।
-খালামনি? তোমার আদরের ছেলের বউ চলে এসেছে। তাকে সম্মানের সাথে বরণ করে নেবে না?
সায়নার কথাটা শুনে অজান্তেই মায়রার পা থমকে গিয়েছিল। কি জানি কি এমন ছিল সায়নার কথায় যে মায়রা আবার অবাক হয়ে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। এই মেয়েটার এতো হেয়ালি মায়রার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। মায়রা আবার পা বাড়ালো। কিন্তু একটা কণ্ঠে আবারও মায়রার পা থমকে গেল।
-খবরদার বলছি মেয়ে--। ওখানেই দাঁড়িয়ে যাও। এক পা ও বাড়াবে না আমার বাড়ির চৌকাঠের দিকে।
-মা? কি বলছেন?
-খবরদার মেয়ে--। আমাকে মা বলে ডাকবে বা একদমই--। সেই অধিকার তোমার নেই। এতো ভোলাভালা চেহারা করে এতো বড় মিথ্যে বলে আমাদেরকে ঠকিয়েছ? কি করে পারলে? আমাকে, আমার ছেলেটাকে ঠকিয়ে কি পেলে বলো তো? কি পেলে?
-মা? আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কাউকে ঠকাই নি মা---আপনি একবার বিশ্বাস করুন?
-বিশ্বাস? তাও আবার তোমাকে? তোমাকে বিশ্বাস করে আবার ঠকবো?
-মা একবার আমার কথাটা শুনুন?
-খবরদার মেয়ে---। একবার বলেছি বাড়িতে ঢোকার চেষ্টাও করবে না। তোমার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে। এখন আর এমন ন্যাকাকান্না করে কোনো লাভ হবে না---।
মায়রা আবার কিছু বলার আগে আয়ান এসে দাঁড়ালো পাশে। হাতে লাগেজটা টেনে টেনে আনছিলো। তাই কি হচ্ছে খেয়াল করে নি সে। মায়রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মায়রাকে এক হাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। মায়রাও কাঁধে স্পর্শ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আয়ানকে দেখেই কেঁদে ফেললো বাচ্চাদের মতো।
-কি হয়েছে মায়রা? দাঁড়িয়ে আছো কেন?---এই মায়রা? কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন এভাবে?
মায়রা কান্নার দাপটে একটা কথা ও বলতে পারলো। আয়ান লাগেজ রেখেই মায়রাকে নিজের দিকে ফিরালো।
-আরে বাবা? আবার কি হলো? এসো তো? বসো আগে? পানি খাও। তারপর বলো কি হয়েছে? এসো এসো?
-এই মেয়েটা যেন এই বাড়িতে না ঢোকে আয়ান---। এই বাড়িতে ওর মতো মেয়ের কোন জায়গাই নেই--।
মায়ের কথাটা কানে যেতেই আয়ান অবাক চোখে সামনে তাকিয়ে মাকে দেখতে পেল। কথাটা মা বলেছে এটা আয়ানের বিন্দুমাত্র বিশ্বাস হচ্ছে না। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে আয়ানের কিছুটা সময় লাগলো। আয়ান মায়রাকে না ছেড়েই আরেকটু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
-মা? কি বলছো তুমি এসব? মায়রা কি করেছে?
-কি করেছে এই মেয়েটাকেই জিজ্ঞেস কর৷ ও আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছে। তোকেও ঠকিয়েছে। ওর আগেও একটা বিয়ে হয়েছে। এক বছরও হয়নি সেই বিয়ে ভেঙে গেছে, আর এই মেয়ে নিজের সবকিছু গোপন রেখে তোকে বিয়ে করেছে। আর জানিস? ওর বাবা মাও আছে--। এই মেয়ে এতো খারাপ যে তারা নিজের মেয়েকে ত্যাগ করেছেন রীতিমতো----। কি জোচ্চর মামা মামির দুটো----।
-মায়রা কাউকে ঠকায় নি মা। আর না ওর মামা মামি কোন ভুল করেছে বা ধোঁকা দিয়েছে--। উনারা শুধু নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করা মেয়েটাকে একটা ভালো, সুস্থ জীবন দিতে চেয়েছে-----।
-তুই বিশ্বাস করছিস না তো? আমিও বিশ্বাস করি নি প্রথমে। এতো মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে--তার মাথায় এতো কুট বুদ্ধি----।
-মা প্লিজ? এসবে মায়রার কোন দোষ নেই। ওকে এভাবে বলো না।
-ওর দোষ নেই তবে দোষটা কার? ওরা কেন জেনেশুনে সবটা গোপন করলো আমাদের কাছ থেকে? কেন?
-কেউ কিচ্ছু গোপন করে নি মা। মায়রা চেয়েছিল তোমাদের সবটা বলতে--। আমিই বারণ করেছিলাম। অতীতে কি ঘটেছে সেটা নিয়ে কেনই বা মাথা ঘামাতে যাবো আমরা বলো তো?
-তারমানে তুই! তুই সবটা জানতি আয়ান? পুরো নাটকটায় তোরও হাত ছিল? কেন করলি এমন? কেন? কেন? কেন? একবারও নিজের বাবা মায়ের কথাটা মনে পড়লো না তোর?
-মা? তুমি যতটা কম্পলিকেট করে ভাবছ ব্যাপারটা তেমন না--। আমার কথাটা একবার শোনো? তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে---।
-এই মেয়ের জন্য তুই আমাদের এভাবে ঠকালি আয়ান? পারলি নিজের বাবা মাকে এতোটা পর করে দিতে? শুধু এই মেয়েটার জন্য?
-মা? আমার কথাটা------।
আয়ানের মা আর এক মূহুর্তও দাঁড়ালেন না সেখানে৷ প্রায় ছুটে ড্রইংরুমের সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। আর উনার পিছনে সায়নাও ছুটতে শুরু করেছে। আয়ান আর মায়রা হতভম্ব হয়ে দরজার বাইরেই থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। মায়রার চোখ বেয়ে আবার অশ্রুর বন্যা শুরু হয়েছে। আর আয়ান? সে মায়রাকে এখনো এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নিজের সাথে। আর ভাবার চেষ্টা করছে। জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন? আয়ান তো সব ঠিক করতেই চেয়েছিল! তাহলে হুট করে কেন সব এলোমেলো হয়ে গেল? কেন ওর দেখা শেষ আশার বিন্দুটাও আজ অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে? সবার কাছে সত্যটা লুকিয়ে আসলেই কি সে ভুল করেছিল? যদি ভুলে করেও থাকে তবে সেই ভুলের মাশুলটা কতোটা কঠিন আর ভয়াবহ হতে পারে?