উমা - পর্ব ১৪ - মুশফিকা রহমান মৈথি - ধারাবাহিক গল্প


রুদ্র উমার হাত শক্ত করে ধরলো। কঠিন সত্যের জন্য সে প্রস্তুত কিন্তু তার ষোড়শী নয়। বেঁচারি নিজ পিতার এমন শেষ মূহুর্তটি ঠিক নিতে পারবে কি জানা নেই। ওয়ার্ড বয় এলো, বুকে বেশ কিছুবার আঘাত করলো। প্রায় আধা ঘনটা যমে কোস্তাকোস্তি করলো, অবশেষে যমের বিজয় হলো। দুজন ওয়ার্ড বয় এবং একজন নার্স মিলেও বাঁচাতে পারলো না নিখিলকে, যমের কাছে হার মানতেই হলো। যে দেহ কে তিনজন ও সামলাতে পারছিলো সেই দেহ ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেলো। মুখটা হা করে চোখ উলটে পরে রইলো পঞ্চান্ন বছরের নিখিল কুমার। ডিউটি ডাক্তার এতোক্ষনে এলো। সে নাড়ি পরীক্ষা করে জানালো,
“নিখিল বাবু আর নেই।“

শাশ্বত এতোক্ষন চুপ করে ছিলো। কিন্তু এখন আর দমে থাকতে পারলো না। তীব্র কন্ঠে বলে উঠলো,
“এতোক্ষন কোথায় ছিলেন? আপনার না রাতে ডিউটি? তাহলে কোথায় ছিলেন? আপনার রুমে পর্যন্ত আমি গিয়েছি। বড় ডাক্তারকে ফোন দেওয়ার পর ও তিনি কেন আসেন নি?”
“দেখুন আমিও মানুষ, আমি একটু রেস্ট এ গিয়েছিলাম। এই আধা ঘন্টায় এত কিছু হয়ে যাবে আমি কিভাবে বলবো বলুন।“
“আপনি কি মশকরা করছেন আমার সাথে? একজন সংকটপুর্ণ রোগীর ক্ষেত্রে একমিনিট ও অনেক কিছু। আপনাদের গুরুত্ব ই নেই। এই যে নার্স মহোদয়া এসেই না বুঝে একটি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিলেন। তারপর অবস্থা আরোও খারাপ হতে লাগলো।“
“দেখুন, উনি উনার কাজ করেছেন। আমরা মানুষ, ঈশ্বর নই। আমাদের হাতে যা ছিলো আমরা করেছি। জীবন বাঁচানো আমাদের ধর্ম, কিন্তু মৃত্যু আমাদের হাতে নেই।“

শাশ্বত শান্ত হলো না। তার মেজাজ অত্যধিক খারাপ। মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না সে। বারংবার মনের নাড়া দিচ্ছে অবহেলার জন্যই আজ নিখিল বাবুকে বাঁচানো গেলো না। তীব্র এবং শক্ত কন্ঠে বললো,
“হাসপাতালের ডাক্তারদের চাকরি যদি আমি না খাই আমি সাংবাদিক শাশ্বত চ্যাটার্জি নয়, এই বলে রাখলুম।“

শাশ্বতের হুমকিতে পাংশুটে বর্ন হয়ে গেলো ডিউটি ডাক্তরের মুখশ্রী। বেশ ভয় পেয়েছে সে। সরকারী কর্মকর্তাদের এই এক পেশার মানুষের ই ভয় থাকে, তা হলো সাংবাদিক। আমাদের দেশের সকল সাংবাদিকদের হয়তো অট্টলিকা নেই, সবার জন্য গাড়ি নেই, নন আনতে পানতা ফুরায়। কিন্তু তাদের কলমের যে জোর আছে তা হয়ত দেশের কোটিপতিদের ও নেই। 

নিখিলের মুখে চাদর টেনে দেওয়া হলো। মৃত্যু সনদ বানাতে চলে গেলেন নার্স। উমা এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিছুক্ষন বাদে বাদে তাকে দেখছে। রুদ্র খেয়াল করলো উমা নড়ছে না কিন্তু তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। মুখ রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছে। ঘটনার আকস্মিকতায় ষোড়শী যেন স্তব্ধ পাথর মূর্তি হয়ে গিয়েছে। রুদ্রের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর সাক্ষী হওয়াটা খুব কঠোর কাজ, পৃথিবীর সবথেকে পীড়াদায়ক মূহুর্তটুকু চোখের সম্মুখে দেখাটা খুবই নিষ্ঠুর। রুদ্রের আজ আড়াই মাস পর মদ খেতে ইচ্ছে করছে। কথাটা হাস্যকর শোনাচ্ছে, কেউ কেউ সমালোচনা করে হয়তো মন্তব্য করবে,
“কি পাষণ্ড অমানুষ”

কিন্তু রুদ্রের তাতে কিছুই যায় আসে না, তার মস্তিষ্ক থেকে কিছুক্ষন পুর্বের স্মৃতিটুকু সরাতে ইচ্ছে করছে। এমন নয় যে রুদ্র নিজে যতবার মারাত্মক কাজ করে সেই স্মৃতি তাকে তাড়া করে না। করে, প্রচন্ড ভাবে করে। তখন মদ তার গিলতেই হয়। হয়তো এতোটা প্রকোট আকর্ষণ থাকে না৷ তবে ক্ষীন প্রভাবটা থাকেই৷ আজ ও ব্যাতিক্রম নয়, রুদ্রের মতে মৃত্যু পৃথিবীর সবথেকে কঠিনতম সত্য। কোনো স্বাভাবিক মানু্ষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে এই মৃত্যুকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই রুদ্রের ভেতরটা আজ অশান্ত হয়ে রয়েছে। কিন্তু সে সরতে পারছে না শুধুমাত্র উমার কথা ভেবে। উমার জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব। নিখিলের সংবাদ কথা শোনার পর থেকে সে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। এক বিন্দু অশ্রু ও গড়ায় নি চোখ থেকে। চোখগুলো যেন সাহারা মরুভূমি হয়ে গেছে। শুধু শান্ত দৃষ্টিতে নিখিলের মৃত লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন পর পর ঈষৎ কেঁপে উঠছে। অল্প শোকে কাতর অতি শোকে পাথর। উমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যেনো জ্বলন্ত সত্য। শুধু একটাই কথা সারা মস্তিষ্ক জুড়ে ঘোরপাক করছে তা হলো, সে আজ থেকে অনাথ। মা বাবা কেউ নেই তার। আপন মানুষের সংখ্যাটা ক্রমশ কমেই যাচ্ছে, বিধাতার এমন নিষ্ঠুরতাকে নীরব চিত্তে মেনে নিতে হচ্ছে উমাকে। আর করবেই বা কি? বিধাতার সাথে লড়ার ক্ষমতা সামান্য মানবীর নেই। 

লাশ নিয়ে ফিরলো গ্রামে ফিরা হলো ভোরের দিকে। লাশবাহী এম্বুলেন্স গ্রামে ঢুকতেই সবার নজর সেটার দিকেই আকটে গেলো। চাপা রাস্তায় আর নিতে না পেরে এম্বুলেন্স থেমে যায়। এবার ধরাধরি করে লাশ নিতে হবে। রতী কেবল পুজো সেরে উঠেছিলো তখন ই লোক লোস্কর প্রবেশ করে নিখিলের আঙ্গিনায়। লোকের সমাগম দেখেই বুকটা কামড় পড়ে রতীর। আচলখান টেনেই আঙ্গিনায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। উমা যন্ত্রচালিত পুতুলের ন্যায় সবার আগে প্রবেশ করে। উমার দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো তার মুখখানা রক্তশুন্য লাগছে। বুঝতে বাকি রইলো না নিখিল আর নেই। ঘরের কাঠখানা ধরেই ধপ করে বসে পড়ে রতী। আর্তনাদ করে উঠে,
"উগো, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে"

রাজশ্বী মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তার বুকখানা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। ছুটে যায় সে দিদির নিকট। দিদিকে ঝাকিয়ে বলে,
"দিদি, বাবা কি আর নেই?"
"না"

উমার স্বাভাবিক শান্ত কন্ঠের উত্তরে ধপ করে বসে পড়ে রাজশ্বী। সেই মূহুর্তেই নিখিলের লাশখানা ধরাধরি করে আনা হয়। রাখা হয় চৌকিতে। চোখ বুঝে শান্ত ঘুমন্ত নিখিলের মুখখানা দেখে থমকে যায় রাজশ্বী। পিতার নিথর দেহটি থেকে চিৎকার করে উঠে সে। রতীর আর্তনাদ, রাজশ্বীর চিৎকার সবই কানে যাচ্ছে উমার। কিন্তু সে নীরব, নিশ্চুপ। চোখ গুলো পানিশূন্য, ফ্যালফ্যালিয়ে মা বোনের দিকে চেয়ে আছে। একটা সময় রতী এসে তাকে ঝাকিয়ে বললো,
"বলেছিলি না বাবার কিছু হবে না। হলো তো? আমি জানতুম তিনি ফিরবেন না"

উমা উত্তর দিলো না। তার মুখ থেকে আর কোনো শব্দ কেউ শুনলো না। 

রুদ্র জামাই হিসেবে সকল কার্য সম্পাদন করলো। সকালের সূর্য উঠতে শ্বশানে নিয়ে যাওয়া হলো নিখিলকে। নিখিলের আত্নীয়রা সমাবেশ করেছে, রতীকে শান্তনা দিচ্ছে। কেউ রাজশ্বীকে থামাচ্ছে। উমা তখন ও নিথর। কেউ বলছে,
"মেয়েটা বাপের শোকে পাতগর হয়ে গেছে, পাগল হয় কিনা কে জানে?"

গোপালের হাত ধরে মুখাগ্নি করে রুদ্র। লোকটির কাছে ক্ষমাটি চাওয়া হয় নি। বড্ড অনুতাপ হচ্ছে। সেদিন খুব খারাপ ব্যাবহারটি করেছিলো সে। এখন আক্ষেপ হচ্ছে, না করলেই হয়তো ভালো হতো। খুব অস্থির হয়ে রয়েছে রুদ্র। বাদল পাশে দাঁড়াতে শান্ত স্বরে বললো,
"দোস্ত আমার আর শরীর চলছে না।"
"সব বীরত্ব কি ফুরিয়ে গেলো?"
"তুই তো জানিস, ওইটা বাদে আমার মন বড্ড কাপুরুষ। মাল থাকলে দিস।"
"শ্বশুরের মুখাগ্নি করেই খাবি? লোকে শুনলে কি বলবে? আর বউ মনি? তাকে কথা দিয়েছিস?"
"আমি আর পারছি না বাদল। আমার মাথাটা ঘুরছে। ঘুমের প্রয়োজন "

বাদল কিছুসময় চুপ থেকে বললো,
"দোকানের কোনায় আছে, আবারো বলছি। কেলেঙ্কারি হবে"
"হোক। মৃত্যু চেয়ে বড় কেলেঙ্কারি আর কি আছে? আমার সামনে পুরোনো স্মৃতি গুলো ঘুরছে"

বাদল আর কিছু বললো না। সে জানে রুদ্র কি বলতে চাইছে। রুদ্র ভেতর কোনো ঘূর্ণিজাল মাটি চাপা আছে তা কেবল এই ছেলেটি ই জানে। ছোট বেলার জিগড়ি কি না। তাই সে চুপ করে বন্ধুর পাগলামি দেখলো৷ অপরদিকে শাশ্বত সব কিছুই চুপ করে দেখছে। কষ্ট থেকেও একটা ব্যাপার তাকে ভাবাচ্ছে, তা হলো মরার আগে নিখিল কি কিছু বলতে চাচ্ছিলো?

১৫!! 

নিখিলের মৃত্যুর সপ্তাহ গড়িয়েছে, উমা এক হাতে সকল কার্য করেছে। মেয়েটি একটিবার ও কাঁদলো না। রুদ্র মদ খেয়ে সন্ধ্য অবধি ঘুমিয়েছিলো। উঠে ভেবেছিলো উমা হয়তো এবার কাঁদবে। কিন্তু ভুল উমা অত্যন্ত স্বাভাবিক আচারন করছিলো। রুদ্র তাকে কাঁদাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পাভ হয় না। বরং তাকে অবাক করে উমা বলে,
"বাবার মৃত্যুতে আমার তো করার কিছু ছিলো না। তবে আমার মতো অন্য কোনো মেয়ে যেনো তার পিতাকে না হারায় সেই কাজ আমি করবো।"

ষোড়শী মেয়েটি এক রাতেই বড় হয়ে গিয়েছে। রুদ্র তাকে মদ খাওয়ার কথা চেপে গিয়েছিলো। ভেবেছিল মেয়ে বুঝবে না। কিন্তু উমা তাকে আরোও অবাক করে বলে,
"মদ খেলেই কি স্মৃতি ভোলা যায়? যতসব উছিলা মাত্র। স্মৃতি মোছা এতো সহজ নয়।"

রুদ্রবুমার মাঝে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারলো না। ভাবলো গ্রাম থেকে দূরে থাকলে হয়তো মেয়েটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই আজ কালীগঞ্জ যাবার কথা বলবে সে। উমা তখন কাপড় গুছাচ্ছিলো। 
"আমাদের ও বাড়ি যেতে হবে। কাল উপজেলার দিকে যাবো যে। অনেক গোছানো বাকি"
"বেশ, আমি রাজশ্বী আর মাকেও গোছাতে বলে দেই।"

উমার স্বাভাবিক বক্তব্যে অবাক হয় রুদ্র। চোখ কুচিয়ে বলে,
"উনারা কি গোছাবেন?"
"ওহ, আপনাকে বলা হয় নি মা রা এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে......

—————

রুদ্র উমার মাঝে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারলো না। ভাবলো গ্রাম থেকে দূরে থাকলে হয়তো মেয়েটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই আজ কালীগঞ্জ যাবার কথা বলবে সে। উমা তখন কাপড় গুছাচ্ছিলো। 
"আমাদের ও বাড়ি যেতে হবে। কাল উপজেলার দিকে যাবো যে। অনেক গোছানো বাকি"
"বেশ, আমি রাজশ্বী আর মাকেও গোছাতে বলে দেই।"

উমার স্বাভাবিক বক্তব্যে অবাক হয় রুদ্র। চোখ কুচিয়ে বলে,
"উনারা কি গোছাবেন?"
"ওহ, আপনাকে বলা হয় নি মা রা এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে“
“তোমার সাথে থাকবে মানে? একটু খোলসা করে বলবে?”
“অবশ্যই, আমি মায়েরা আমার সাথে কালীগঞ্জে যাবেন। আমি তাদের একা ফেলে কালীগঞ্জে যাবো না। রাজশ্বী, গোপালের ভবিষ্যতটাও দেখতে হবে। মা একা তাদের কিভাবে পালবে? তাই এই সিদ্ধান্ত”

নির্লিপ্ত চিত্তে কথা গুলো বললো উমা। রুদ্র উমার এরুপ আচারণে শুধু অবাক ই হলো না, খানিকটা বিরক্ত ও হলো। উমার নিজের মা হলে হয়তো রাজীও হয়ে যেত সে, কিন্তু রতী উমার সৎ মা, শুধু তাই নয় রতীর চেয়ে স্বার্থপর খুজে পাওয়া ভার। সেই লোভী নির্দয় নারীকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে হলো না। রুদ্র ঈষৎ বিরক্তি মাখা গলায় বললো,
“যদি পালতে সমস্যা হয়, আমি না হয় মাসে মাসে তাদের কিছু টাকা দিয়ে দিবো। রাজশ্বী এবং গোপালের পড়াশোনা, রাজশ্বীর বিয়ের সব খরচ না হয় আমি ই দিবো। কিন্তু তাদের আমাদের সাথে কালীগঞ্জে নেবার কোনো মানেই হয় না। মা-বাবাকে কি উত্তর দিবো? একেই তোমার পড়াশোনার জন্য কম যুদ্ধ তো আমাকে করতে হচ্ছে না। তাদের মতের বিরুদ্ধে আমরা কালীগঞ্জ যাচ্ছি। সেখানে এই উটকো ঝামেলার কোনো মানে নেই। আর লোকে কি বলবে? কখনো দেখেছো মেয়ের বাবা-মাকে শ্বশুর বাড়ি থাকতে? অহেতুক মানুষ কথা রটাবে। সাহায্য অন্য ভাবেও করা যায়”

রুদ্র এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো, উমা হাতের কাজ থামিয়ে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। কিছুক্ষন চুপ থেকে বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, এই লোক কি বলবে বা ভাববে কথাটা না বললে কি নয়? শ্বশুরের মৃত্যুতে মাল খেয়ে যখন টাল হয়ে পড়ে ছিলেন তখন কি পরোয়া করেছিলেন? তবে এখন কেনো? আর মেয়েদের জন্য আলাদা নিয়ম কেনো? কেনো ছেলেরা তার মা-বাবার পাশে না থাকলে সমাজ বলে কি পাষন্ড ছেলেটি, বৃদ্ধ বিধবা মা এবং ভাই বোনকে ছেড়ে আলাদা থাকে। আর মেয়ে যদি সন্তানের দায়িত্ব ও পালন করতে চায় তখন বলে উঠে লোকে কি ভাববে? টাকা দিয়ে দিলেও তো হয়। বিয়ের পর বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব পালন করলে লোকে কি ভাববে! কন্যা সম্প্রদান করে দিলে কি সত্যি মেয়ের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? কনকাঞ্জলীর পর মেয়ের কোনো ঋণ থাকে না? সে মেয়ে বলে তার ভাই বোনের প্রতি কি আদৌও কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবে না? ব্যাপারগুলো কি হাস্যকর না!”

উমার কথা শুনে থমকে যায় রুদ্র। উমার শান্ত চাহনীতে নিজের ষোড়শীকে যেনো কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। সেই ভীত, সঙ্কিত উমাটি আজ নেই। আজ এক নির্জীব শক্ত পাথর দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রের সামনে। এবার খানিকটা দমে রুদ্র। কিঞ্চিত বিনয়ী স্বরে বললো,
“তুমি ভুল বুঝছো উমা, আমি কিন্তু বলি নি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। আমি বলছি দায়িত্ব বিভিন্নভাবেও পালন করা যায়। আর তোমার মায়ের গুনের তো শেষ নেই, মা হবার মতো যোগ্যতাও তার নেই। তোমার উপর কম অত্যাচার তো সে করে নি। আস্ত একজন লোভী মহিলা। তাকে নিয়ে এতো মাতামাতির কি খুব দরকার?”
“বাবাও তো অনেক কিছুই করেছেন, তাই বলে কি বাবাকে ছেড়ে দিতে পারবেন আপনি? পারবেন না তো? তাহলে আমাকে এই প্রশ্নটি করার কি মানে? আপন মায়ের মুখখানাও আমার মনে নেই, মা বলতে আমি এই না্রীকেই চিনে এসেছি। আজ তাদের এখানে ছেড়ে এতো দূরে কিভাবে যাই বলুন তো? আপনার মত না থাকলে আমি জোর করবো না। আমি তো জোর করার কেউ নই ও, বাড়ি আপনার, টাকা আপনার; সুতরাং সিদ্ধান্ত ও আপনার। পরজীবি মানুষের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে এমনটা বাধ্যবাধকতা নেই। আমি আসছি, দেখে আসি গোপালটা খেয়েছে কি না”

বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো উমা। রুদ্র খানিকটা আহত হলো, উমার ভালোর জন্য ই সে রতীকে তার থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু উমা সেটা বুঝতেই চাচ্ছে না। উপরন্তু তাকেই ভুল বুঝছে। সে তো একটিবারের জন্য গোপাল কিংবা রাজশ্বীর ব্যাপারে অমত জানায় নি। উমার বোন হিসেবে সকল দায়িত্বের পালন সে করতে রাজী। তবে কেনো উমা তাকে বুঝে না, কেনো বারে বারে তাকেই পৃথক করে দেয় নিজের থেকে। 

নিজ রুমে একা একা বসেছিলো রতী। নিখিলের সকল জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে স্টিলের ট্রাংকে রেখে দিয়েছে সে। ট্রাংকটির চাবিখানা নিজের বালিশের তলে রাখলো সে। মানুষটা নেই, অথচ দিনগুলো কেটেই যাচ্ছে। কিছুই আটকে থাকে না কারোর জন্য। শুধু মানুষটির জায়গাতাই ফাঁকা। এমন সময় উমার আগমন ঘটে সেই রুমে। শান্ত গলায় বলে,
“আসবো মা?”

রতী চোখ মুখে নেয় আচলে। ভাঙ্গা গলায় বলে,
“আয়”

উমা ভেতরে এসে তার পাশে বসে। রতী ধীর কন্ঠে বলে,
“কিছু বলবি?”
“তুমি তো জানো আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। সেজন্য কালীগঞ্জ যেতে হবে। আমি চাচ্ছিলাম, তোমরা যেনো আমার সাথে যাও।“
“এ ভিটে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।“

স্পষ্ট কন্ঠ রতী কথাটা বলে দেয়। উমা অবাক কন্ঠে বলে,
“আমার সাথে যেতে আপত্তি আছে তোমার?”
“আমাদের এখানে মেয়ের বাড়ির পানিটুকু খাওয়া বর্জিত সেখানে তোর বাড়ি কেনো থাকবো বলতো?”
“ছেলে হলেও এভাবে ফিরিয়ে দিতে?”
“হয়তো না, কারণ সে ছেলে। এটাই নিয়ম উমা। আর তোর বাড়ি কি ভরসায় থাকবো বলতো? জামাই এর খোটা শুনে এই বয়সে থাকার ইচ্ছে আমার নেই। গতবারের ভুলখানা আবার করতে চাই না। আর আমি চাই না আমার গোপাল সারাটাজীবন রুদ্রের টাকায় বড় হোক। তুই যদি কামাই করতি হয়তো আপত্তি হতো না। আগের অবস্থা আর এখন তো এক নয় উমা। তখন তোর বাবা জীবিত ছিলেন, এখন সে বট গাছ টুকু নেই। সামনে রাজশ্বীর বিয়ের ব্যাপার ও আছে।“
“আমি কিন্তু গোপাল এবং রাজশ্বীর সুন্দর ভবিষ্যতটা ভেবেই বলেছিলাম। কালীগঞ্জের ভালো স্কুলে গোপাল পরতো। রাজশ্বীর পড়াশোনাটাও হতো।“
“জানি, তুই ওদের নিয়ে অনেক ভাবিস। কিন্তু আমি পরজীবি হয়ে থাকতে পারবো না। তুই চিন্তা করিস না, তোর বাপের দোকান টা ভাড়া দিয়ে দিবো। পশ্চিমের জমিগুলো বেঁচে দিবো। তাতে যা পয়সা পাবো, আমাদের তিনজনের চলে যাবে। আমার ভাইরাও তো আছে। ঠিক চলে যাবে। আমাদের নিয়ে এতটা ভাবিস না। যদি সমস্যা হয় তখন না হয় তোর থেকে চাবোক্ষনে। কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে জিদ করিস না। তোর শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে তোর কোনো সম্মান থাকবে না। অহেতুক কথা শুনতে হবে।“
“তুমি সত্যি কি এসব নিয়ে ভাবো?”
“নাহ, ভাবি না। কিন্তু এখন ভাবতে ইচ্ছে হয়। তোর বাপটা তো উপর থেকে দেখছে। লোকটা অহেতুক কষ্ট পাবে। মানুষটা তো গোবেচারা। এসব ছলছাতুরি বুঝে না। তাই তাকে কষ্ট দিতে চাই না।“

উমা চুপ করে থাকলো। বুকের কোনে ব্যাথা করছে। এক চিনচিনে ব্যাথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তাহলে তুমি যাবে না? আচ্ছা আলাদা বাড়ি নিলেও যাবে না?”
“যেদিন নিজে কামাই করবি, আমি সেদিন যাবো। তখন লোভ করলেও সেটা তোর পয়সা হবে।“

ম্লান হাসি হেসে রতী কথাটা বলে। একজন মানুষের মৃত্যু সবাই কে কোনো না কোনো ভাবে বদলায়। বদলেছে উমা, বদলেছে রতীও। সময় ই সবকিছুর মলম, সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই বদলায়। উমা আর বসে রইলো না। ধির কন্ঠে বললো,
“ঘুমিয়ে পড়ো। কাল ও বাড়ি চলে যাবো। সকালে উঠতে হবে। আসি”
“আয়”

উমা আর অপেক্ষা করলো না। রতীর ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো। কালচে আকাশের বুকে হাজারো তারার মেলা বসেছে। তারা দেখতে ভালোই ঠেকছে। ছোট বেলায় ঠাম্মা বলতো, 
“মরলে তারা হয়ে যায় মাইনশ্যে”

উমার মনে হলো তার পিতাও হয়তো আকাশের এক কোনে লুকিয়ে আছে। উমা ধীর স্বরে বললো,
“আমি একদিন নিজ পায়ে দাঁড়াব বাবা, তুমি চিন্তা করো না। এই তিনজনকে আমি দেখে রাখবো।“

১৬!! 

কালীগঞ্জে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে উমা এবং রুদ্র। ভ্যান এসেছে, কাপড়ের ট্রাংক গুলো তোলা হয়েছে। উমা সকলকে গড় করে প্রনাম করলো। লক্ষী দেবী না চাইতেও বললেন,
“দীর্ঘায়ু হও, সুখী হও”

রুদ্র লক্ষী দেবীকে জড়িয়ে বললো,
“আসি মা, আমি একখান মোবাইল ফোন কিনে পাঠিয়ে দিব। তারপর যোগাযোগ করবো প্রতিদিন”
“না গেলে হয় না?”
“না মা, সম্ভব না”

লক্ষী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অভিনব সিংহ কিছু বললেন না। রুদ্র এবং উমা বেড়িয়ে গেলো। লক্ষী দেবী ধীর স্বরে বললো,
“দূগগা, দূগগা”

রুদ্ররা চলে গেলো, সেই মূহুর্তে দীপঙ্কর ছুটে এলো। হাফতে হাফতে বললো,
“জ্যেঠু, ফোন এসেছে গুদামে……………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন