কামরান সাহেব মা আর ছেলের বৌয়ের কথা শুনে বেশ বিপাকে পড়ে গেলেন। কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলছেনা। কামরান সাহেব নিসার সাথে আজও কথা বলেন না। বেশ কয়েক বছর আগে ফুয়াদের হাত ধরে সে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। তারপর বাসায় এসে তাদের জায়গা হলেও কামরান সাহেবের মনে জায়গা করে নিতে পারেনি নিসা। কামরান সাহেব সাদকে কোলে নিয়ে বাহিরে চলে গেলেন। দাদুর পিছন পিছন নিসার দুই মেয়ে, নিধি আর ফিহাও বের হয়ে গেল।
ছেলে উঠে চলে যাওয়াতে বাতাসি বিবি গুন গুন করে কান্নার সুর তুলে বলে উঠলো-
~" সমচার পাড়ে কালো গাই
সদই সদই দোবা যায়.........।
নাতী পাইছে এক্কান! জিউ যেন থামেনা। কিছু হইলে তারে লইয়া বাড়ি থাইকা ভাগবো। বলি তোর কি একা লাতী আছে, না দুনিয়ার আর কারো লাতী-পুত আছে?"
ফুয়াদ দ্রুত খাবার শেষ করে উঠতেই বাতাসি বিবি ওর হাত চেঁপে ধরে বলল-
~" ঐ খাড়া, তুই কই যাস? বউয়ের বিচার কইরা যা কইচি।"
~" আমাদের ভিতর ফুয়াদকে টানছেন কেন! দম ফুরে গেছে আপনার? আপনার মত নাটকবাজ মহিলা আমি বাবার জন্মেও দেখি নাই। না ছেলের সম্মান রাখেন, না বাসার বউদের সম্মান রাখেন। কথা বললেই মনে হয় বেঁচে যান। একবারও ভাবেন না তার কথার ধার কত!"
নিসার কথা শুনে ফুয়াদের হাত ছেড়ে দিয়ে চিয়ার থেকে উঠে দাড়ালো বাতাসি। তুই, তুই অ্যারে মহিলা কইলি!
অ্যাই মহিলা! বেডি তোর বাপ মহিলা, তোর মা মহিলা, তুই মহিলা, তোর দুই মাইয়া মহিলা, তোর ভাতারও মহিলা, তোর আগে পিছের পিড়ী সহ ১৪ গোষ্ঠী মহিলা। অ্যারে মহিলা কয়। সাহস কত্ত অ্যারে গালি দেয়। চোপা ভাঙ্গার সখ জাগছে! অ্যার পান ছেচা ঢুকনির বাড়ি দিয়া তোর চোপায় ভাঙ্গমু।
লাবীবা ও লাবী....বা, তোমার ব্যাটার বউ অ্যারে মহিলা কইছে, কিছু কইবা না? না তুমিও তার দলে ভিড়ছো?
ফুয়াদও কিছু না বলে তিতিরের দিকে শুধু চোখ ইশারা করে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করে উঠে পড়লো। এদের ঝগড়া একমাত্র তিতির ছাড়া কেউ মেটাতে পারবেনা।
মায়ের অপমানে ছেলে আর নাতী কিছু না বলাতে বাতাসি বিবির মুখ আর আটকানো গেলোনা। এই বাড়ীত দুই বউ আইসা অ্যার সংসারটা জ্বইলা-পুইরা আঙ্গার বানাইয়া ফেলল। দুই নাতীই তাগো বউয়ের আচলের নিচে বইসা ভ্যাড়ার মত শুধু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। আই থাকুমনা।লাবীবা, তোমার মামা শশুড় বুদুনরে এখুনি কল দাও। সে আইসা তার বুবুরে লইয়া যাক।
বাতাসির এমন কথায় সাবিনা মুখে ভেংচি কেটে বলল-
~" দাদী, আগেরবারের কথা ভুইলা গেছেন? আন্নের জন্য বুদুন দাদারে তার তিন বৌ মিইলা গরুর ঘরে রাখছিল। কি বেইজ্জতই না হইছিলো ছোড দাদা। বউদের নির্যাতন কারে কয় হেইরে না দেখলে কেউ বুজবার পারবোনা। আর আন্নে কিটা ভাবছেন! হেই আন্নেরে কি আর লইতে আইবো? অ্যার মনে হয়না লইতে আইবো। তার এত্ত সখ জাগে নাই বউদের পায়ের ব্যাকশর্ট খাওন।
বাবার বাড়ির কুকৃর্তির কথা ফাঁস হওয়াতে বাতাসির মুখ দেখার মত ছিল। কিন্তু সাবিনা মিথ্যা কয়নি। বরং সাবিনা ঠিক কতাই কইছে। কিন্তু নিজের মান-ইজ্জত বলেও তো কিছু আছে। তাই বাতাসি বিবি হুংকার দিয়ে বলল-
~" তুই অ্যার সেক্রেটারি হইয়া অ্যার বিরুদ্ধে কতা কস? তোর চাকরি আজ থেকে শেষ।"
অ্যার ঠেহা পড়ছে আন্নের মত বজ্জাতনির চাকরি করা। কয়বার চাকরি খাবেন। আই নিজেই ইস্তেফা দিলাম।অ্যার এহন অবসরের সময় আইছে। বরং অবসর ভাতা দিন আমারে।
কথাগুলো মনে মনে বলে সাবিনা সেখান থেকে চলে গেল। এদের এমন কান্ডে তিতির বাতাসির গায়ে হাত দিয়ে বলল-
~ " দাদী, সবার কথা ছাড়েন তো! আপনি হলেন এই বাসার রানী। আপনার কথা কি কেউ অগ্রার্য করতে পারে, এমন কারো সাহস আছে নাকি? রানীর পথ সবার উপরই হয়ে থাকে। রানী ছাড়া রাজ্য চলে নাকি! তাহলে পুরো রাজ্যই অচল হয়ে যাবে।"
বাতাসি বিবি তিতিরকে একদম পছন্দ করেননা। কিন্তু তিতিরের কথাটা তার খুব ভালো লাগলো। এই প্রথম ঠান্ডা মেজাজে তিতিরকে বলল-
~ " নিজের সোয়ামীরে সাবধান কইরা দিবা। যহন-তহন অ্যার উজ্জতের উপর যেন হামলা করতে না অ্যাহে। আর একটা মান-মর্যাদা আছেনা! বুইড়া বয়সে পোয়াতি হবার পারুমনা।"
বাতাসি বিবির কথা শুনে আরও একবার ভাবনার জগতে সবার হুমড়ি খাওয়ার মত অবস্থা হল। বাতাসি বলে কি! এ সত্যিই পাগল হয়ে গেছে।
তিতির মুখ টিপে হেঁসে তরকারির বাটিটা রান্না ঘরে নিয়ে যেতেই লাবিবা পিছন থেকে এসে বলল-
~ " তিতির, আম্মা দিন দিন বড্ড জেদি হয়ে পড়ছে। তিনি এমন এমন কথা বলেন, লজ্জায় মাথা আমার হেট হয়ে যায়। তাকে ডাক্তার দেখাবো কিনা সেই কথাই ভাবছি। উনিতো আবার ডাক্তারকেও দেখাবেন না। কি করি এখন বলতো?"
~" মা, দাদীকে ওনার মতই থাকতে দিন। ওনার এই স্বভাব ছাড়া ওনাকে একদমই মানায় না। শুধু ওনার একটু বেশি বেশি প্রসংসা করবেন, ব্যস দেখবেন উনি খুঁশিতে আত্যহারা হয়ে ঠান্ডা মেজাজে সবার সাথে কথা বলবে।"
তাই যেন হয় মা বলে লাবিবা চলে গেলেন।
.
রাতে মাহাদকে নিয়ে বাতাসি নিসার ঘরে হানা দিল। বাতাসি কেঁদে কেটে হুলুস্থু। আজ নিসার বিচার করতেই হবে। নিসা তাকে মহিলা বলবে কেন? কোন হুদ্দাই নিসা তাকে মহিলা বলেছে!
এমন অভিযোগ শুনেতো নিসা ক্ষেপে উঠেই মাহাদের সামনে বাতাসির দিকে তেড়ে যেতেই মাহাদ নিসাকে প্রচন্ড জোড়ে একটা ধমক দিতেই নিসা থমকে দাড়িয়ে গেল। নিধি আর ফিহা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। আর বাতাসি ভয়ে চুপ। তার মুখের বুলি পর্যন্ত হারিয়ে গেল।
নিসার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ে গেল। নিসার কন্ঠ ধরে এলো। নাক টেনে এবার জোড়েই কেঁদে ফেলল নিসা। ফিকরাতে ফিকরাতে বলে উঠলো-
~" তোর ভাইয়া পর্যন্ত কোনদিনও আমার সাথে উচু গলায় কথা বলেনি আর তুই আমাকে এভাবে বলতে পারলি! একবার শুনতেও চাইলিনা, তোর দাদী আমাকে কি কি বলেছে?"
নিসার কথা শুনে বাতাসি ফস করে বলে উঠলো-
~" তোর ভাতার কে আবার মরদ কওয়া যায় নাকি! ওতো একখান মাগীর ভ্যাড়া ছাড়া কিছুই নয়। অ্যার সোয়ামি মরদ বুঝলি মরদ মানুষ! ও নিজের বউরে ছাড় দেয়না আর তুই কে আইছোস যে তোরে ছাড় দিব!"
আহ্ দাদী কথাটি মাহাদ বলতেই নিসা চোখের পানি মুছেই বলল-
~" আমার সাথে শুধু লাগতে আসিস! দেখছিস কেমন তার মুখের ভাষা! তার কথা কি সরকারী কথা নাকি যে, সে যা ইচ্ছা যা খুশি তাই বলবে? তার কি কোন প্রতিবাদ করা যাবেনা?"
~" তুই বাসার বড় বউ হয়ে কিভাবে মুরব্বি মানুষের দিকে তেড়ে যাস! তাও আবার নিজের ছোট ছোট মেয়েদের সামনে? এই তোর শিক্ষা! এরা তাদের মায়ের কাছ থেকে কি শিখে বড় হবে?"
নিসা আর কথা বলতে পারেনা। মাহাদ বাতাসিকে নিয়ে রুম থেকে বের হয়েই রাগী লুকে দাদীর দিকে চাইতেই বাতাসি মিনমিন করে বলল-
~" তোর বিচার অ্যার খুব ভালা লাগছে মাহাদ।"
বাতাসির কথা শুনে ক্ষেপে গেল মাহাদ। এবার যদি তোমার বিরুদ্ধে কোন রির্পোট পাই তাহলে বাহিরের সুইমিংপুলে তোমায় চুবিয়েই তোমার ভিমরতি ছুটাবো। সারাদিন কাজ করে বাসায় এসে কোথায় শান্তিতে থাকবো! তা না তোমার অভিযোগ শুনতে শুনতে আমার আরাম হারাম হয়ে যায়। কেন তুমি এসব ভাষায় কথা বলো! তুমি আরও ইচ্ছা করে সবার সাথে যেচে লাগতে যাও। আর ভাইয়াকে ওমন ভাষায় কথা বল তুমি কোন রুচিতে! আমার ছেলে যদি তোমার এসব একটাও নোংরা ভাষা শিখে তাহলে তোমাকে সুইমিংপুল তো দুরে থাক কোথায় যে চুবাবো সেটা আমি নিজেও জানিনা। কথাগুলো বলেই মাহাদ চলে যেতে লাগলো।
মাহাদ অ্যারে অপমান করা কিন্তু ঠিক হইলোনা বলতেই মাহাদ পিছন ফিরে ধমক দিয়ে বলল-
~" বাতাসি.....। তোমাকে কি এখুনি সুইমিংপুলে নিয়ে যেতে হবে?"
বাতাসি হাত দিয়ে মুখটা চেঁপে ধরে বলল-
~" নাহ্ আইতো কিচ্ছু কইনি! খালি চেতস তুই। অ্যার মত ভালা মাইয়া তুই পাবি?"
মাহাদের গরম চোখ দেখে বাতাসি আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। মাথা নিচু করে গটগট করে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলো সে। নিসা শায়েস্তা হয়েছে এতেই সে বহুত খুশি।
মাহাদ দাড়িয়ে বাতাসির চলে যাওয়া দেখলো।
♥
কয়েকদিন পরে,
মাহাদ রুমের ভিতর ট্রেডমিলে ওর্য়াক আউট করছিল। এমন সময় সাদ দৌড়ে এসে বাবাকে সালাম দিয়েই পাশে দাড়ালো। মাহাদ কানে ইয়ারফোন গুজে সুরা শুনছে আর ওর্য়াক আউট করছে। বাবার কোন রেসপন্স না পেয়ে সাদ সামনে গিয়ে দাড়াতেই মাহাদ মিটার কমে দিয়ে নিচে নেমে হাসিমুখে সাদকে একটা সালাম দিয়ে বলল -
~" শুভসকাল বাবা।"
সাদ সালামের উত্তর দিয়ে অভিমানের স্বরে বলল-
~ " শুভসকাল আমার প্রিয় বাবা। আমিও আপনাকে সালাম দিয়েছিলাম।"
সাদের এখানে আগমন মানে সেও ট্রেডমিলে দৌড়াবে। একদম রেডী হয়েই সে এসেছে। মাহাদ ফোনটা বের করে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ট্রী টেবিলে রেখে খুব লো স্প্রিডে সাদকে ট্রেডমিলে চড়িয়ে দিল। সাদও খুঁশিতে দাড়িয়ে রইলো। শেষ প্রান্তে আসতেই সাদ আবার সামনের দিকে ফিরে, আস্ততে আস্তে দৌড়াতে লাগলো।
সাদ, এটার কিন্তু স্পিড বাড়িয়ে দিলাম বলেই মাহাদ আস্তে আস্তে স্পীড বাড়িয়ে দিয়েই শেষ প্রান্তে এসে দাড়িয়ে রইল। সাদও প্রানপনে দৌড়াতে লাগলো। শেষে যখন পেড়ে উঠতে পাড়লোনা তখনই মাহাদ খপ করে ওকে ধরে ফেলল। সাদতো ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। মাহাদ সাদের কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল-
~" খুঁশি হয়েছ বাবা?"
সাদ কোন কথা না বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাবার কপালে চুমা খেয়ে চুপ করে রইল। এখন মাহাদকে বুঝে নিতে হবে সাদ খুব খুঁশি হয়েছে। একটু রেষ্ট নিয়ে সাদকে নিয়ে মাহাদ ওয়াসরুমে গিয়ে গোসল করে দিল। তারপর চোখবন্ধ করে টাওয়াল পড়ে দিয়ে ওয়াসরুম থেকে বের করে দিয়ে নিজে গোসল করে রুমে আসলো। পাশাপাশি দুটো রুম। একটা জিম করার রুম অন্যটা ওদের বেড রুম। রুমে এসে দেখলো, তিতির কোরআন তেলায়াত করছে। আর সাদ তিতিরের পাশে চুপ করে বসে আছে। এদিকে অতিথী ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। মেয়ে মুখ গম্ভীর করে ঠোট উল্টিয়ে গালটা প্রসারিত করে কেবল কাঁদতে যাবে এমন সময় মাহাদ অতিথীকে কোলে তুলে নিয়ে আদুরে গলায় বলল-
~" এই তো মা, বাবা এখানে। আমার পুরো রাজ্যই তো এখানে। কিসের অভাবে তুমি কান্না করছো মা!"
বাবার কন্ঠের আওয়াজ চিনতে পেরে মেয়েটা কান্না বন্ধ করে চুপ করে ফ্যালফালিয়ে মাহাদকে দেখতে লাগলো। মাহাদ মেয়েকে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। তারপর একটা বালিশে অতিথীকে উপর করে সুয়ে দিয়ে ওর পিঠে হালকা একটু ম্যাসাজ করতেই ও খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। মাহাদ বার বার একই কাজ করছে আর মেয়েটা হেঁসেই চলছে। এর মধ্য তিতির তেলায়াত শেষ করে উঠতেই সাদ ঝট করে উঠে পড়ে বাবার কাছে এসে ওর পিঠটা এগিয়ে দিয়ে বলল-
~ " বাবা, আমায়ও দেন।"
মাহাদ অন্যহাতে সাদের শরীরেও একই ভাবে মাসেজ করে দিতে দিতে বলল-
~ " সাদ, পোষাক বদলাওনি কেন বাবা?"
মা কোরআন পড়ছিল বাবা। মা সবসময় বলেন, যেখানে "কুরআন" তেলায়াত করা হয় সেখানে চুপ করে তা শুনতে হয়। যদি আমরা তা না শুনি, তাহলে কুরআন কে অসম্মান করা হয়। আমরা কেন সুন্দর সুন্দর নেয়ামত থেকে নিজেদের বঞ্চিত করবো? তাই মায়ের কথা স্মরন হতেই সেখানে বসেছিলাম।
তিতির সাদের পোষাক এনে সাদকে একটা চুমা খেয়ে বলল-
~" আমার বাবাটা দেখছি খুব বুদ্ধিমান। আমার কথা সব সে স্মরনে রেখেছে।"
কিছু দোয়া পাঠ করে স্বামী ও দুই ছেলে-মেয়ের মাথায় ফু দিল তিতির। তারপর সাদকে পোষাক পড়িয়ে দিয়ে সাবিনাকে ডেকে ওকে নিচে নিয়ে যেতে বলল। কিছুক্ষন পর ওর হোম টিচার আসবে পড়াতে। সাদ চলে যেতেই তিতির মাহাদের কপালের মাঝখানে একটা কিস করে অতিথীকে ফিডিং করাতে লাগলো। তিতিরের কোলে একটুখানি জায়গা করে নিয়ে সেখানে মাথা রেখে সুয়ে পড়লো মাহাদ। মাহাদের ছোট বাচ্চাদের মত স্বভাব তিতিরের কাছে খুব ভালোলাগে। তিতির ডান হাত দিয়ে মাহাদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল-
~ " আপনি জানেন, রূপসা আপু আমাদের পরিবারের সবাইকে নিমন্ত্রন করেছে। ওনার ছেলের আকীকা উপলক্ষে সবাইকে ওনার বাসায় যেতে বলেছেন। বাবা আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।"
মাহাদ অন্যমনস্ক অবস্থায় চট করে উঠেই বলল-
~" রূপসা?"
~" হুম বাবাতো তাই বললেন। উনি নাকি বাবাকে খুব করে অনুরোধ করেছেন। সবাইকে যেতেই হবে।"
তিতিরের কথা শুনে মাহাদ কঠোর ভাষায় বলল-
~ " কে যাবে জানিনা, কিন্তু আমি আর তুমি একদমই যাচ্ছিনা। যে আমার প্রতি আজও তার দুর্বলতা প্রকাশ করে, সে কখনো ঠিক হবেনা। আমার সংসার ভাঙ্গার আবার চেষ্টা করবে। আমি আর বাড়তি দুঃশ্চিন্তা করতে পারবোনা। আমি আমার অতীত ভুলি নাই।"
তিতির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্ষীন কণ্ঠে বলে উঠলো-
~ " এখন যখন আমরা সবাই মিলেমিশে বসবাস করছি, তখন আমাদের অতীত ভুলে যাওয়াই ভাল। আমাদের তাদের ক্ষমা করে দেওয়ায় উচিত। আল্লাহ্ সুবহানাতালা নিজে অত্যান্ত ক্ষমাশীল। তাই তিনি ক্ষমাশীলদের ভালোবাসেন।"
মাহাদ আর কথা বাড়ালোনা। যেখানে আল্লাহর গুনগান করা হয় তখন সে সর্বদায় চুপ থাকে। আর লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে রাখে। এই স্বভাবটাও সে তিতিরের কাছ থেকেই শিখেছে। মাহাদ আর দেরী না করে ওর বাবার কাছে চলে গেল। অতিথী আর দুধ খেতে চাইছেনা তাই তিতির ওকে নিয়ে উঠে পড়লো। তারপর নিচে গিয়ে দেখে সাদ সোফায় একা বসে আছে। তিতির কাছে যেতেই সাদ মুচকি হেঁসে বলল-
~" মা, আমার খুব খুদা লাগছে। আমাকে খাবার দিন। স্যার আজ আসবেনা। ফোন করে বলে দিয়েছে।"
তিতির ছেলের মাথায় হাত নাড়িয়ে দিয়ে কোমল স্বরে বলে উঠলো-
~" একা খেতে নেই বাবা। সেটা কম খাবার কিংবা বেশি খাবারই হোকনা কেন! সবাইকে সাথে নিয়ে খেতে হয়। নিম্নে কোন একজন মানুষ হলেও তাকে শরীক করে খাবার খাবে। যাও রাতিশা, নিধি, ফিহা আপুকে ডেকে আনো।"
জ্বী মা বলেই সাদ দ্রুত উপরে উঠে ফুয়াদের রুমের সামনে দাড়িয়ে বলল-
~ " বড় বাবা, আসসালামু আলাইকুম। আমি কি ভিতরে আসবো?"
ফুয়াদ অফিসের কাগজপত্র ঠিক করছিল। সাদের কথা শুনে সালামের জবাব দিয়ে সব কাগজপত্র রেখে এসে সাদকে কোলে নিয়েই একটা চুমু খেয়ে বলল-
~" এ বাবা, আমি কাকে দেখছি! আমার বাবা এসেছেন আমার রুমে। কি প্রয়োজন বাবা!"
এমন সময় ওয়াসরুম থেকে নিসা বের হতেই সাদ তাকেও সালাম দিয়ে বলল-
~ " বড়মা, আপুরা কোথায়! আমার খুব খুদা লেগেছে।"
নিসা কাছে এসে সাদের গাল ছুয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল-
~ " তুমি একা খেয়ে নিতে বাবা! ওরাতো পড়ছে।"
সাদ মন খারাপ করে বলল-
~" আচ্ছা, মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তাহলে যাই।"
ফুয়াদ সাদকে নিচে নামিয়ে দিতেই ও দ্রুত বের হয়ে গেল। সন্তানকে মানুষ কিভাবে করতে হয় সেটা তিতিরকে না দেখলে কোনদিনও জানতামনা। এত সুন্দর শিক্ষা দিয়ে ও সাদকে মানুষ করে তুলছে। ফুয়াদ কথাগুলো বলতেই নিসা চটে গিয়ে বলল-
~" তোমার কি মনে হয়, আমি আমার দু'মেয়েকে শিক্ষা দিতে পারিনি?"
ফুয়াদ কথা না বাড়িয়ে কাজে মনযোগ দিল। এদিকে সাদ রুম থেকে বের হতেই মৌ কে সামনে দেখতে পেল, সাদ তার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল-
~" চাচী, আমার সাথে সকালের নাস্তা করবেন?"
মৌ সালামের জবাব দিয়েই বলল-
~" না সাদ, তোমার চাচ্চু কিছু কাজ দিয়েছে সেগুলো করেই আমি ফ্রী হব।"
সাদ সেখান থেকে ছুটে মায়ের কাছে এসে মাথা নিচু করে বলল-
~" মা, আমিতো একজনকেও পেলামনা। আপনিই আমার সাথে নাস্তা করেন।"
তিতির ছেলেকে আদর করে বলল-
~" যাওতো বাবা, তোমার বাতাসি বড়মা কে একবার বলে দেখতে পারো। তিনি এই সময় নাস্তা করে থাকেন।"
মায়ের কথা শুনে সাদ ছুটে গেল বাতাসির রুমে। দেখলো বাতাসি বড় মা বসে আছে। সাদ ছলছল চোখে বাতাসিকে সালাম দিয়ে বলল-
~ " বড়মা, আমার সাথে নাস্তা করবেন? আমার খুব খুদা লেগেছে। মা বলছে কাউকে শরীক করে খেতে হয়। আমি কাউকেই পেলামনা।"
কেডাই অ্যার বাবারে খাবার দেয়না! কার এত বড় সাহস অ্যার বংশের বাতিরে খাওন দেয়না? কথাগুলো বলেই বাতাসি নিজেই নিজের হাতে মুখখানা চেঁপে ধরলো। মাহাদ বার বার কইছে বেহুদা কতা না কইতে। তাই বাতাসি বিবি গলাটা খেকারি দিয়ে বলল-
~ " চল বাপ, আই আপনার লগে নাস্তা করুম।"
বাতাসির হাত ধরে খুশি মুখে সাদ রুম থেকে বের হতেই দেখলো, তার মা টেবিলে খাবার রেডী করে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সাদ একটা হাসি দিয়ে মায়ের কাছে এসে বসে বিসমিল্লাহ্ বলে খাবার খেতে লাগলো। বাতাসি বিবিও খেতে শুরু করলেন সাদের সাথে। একটু পর বাঁকিরাও এসে খেতে লাগলো সকালের নাস্তা।
খাবার টেবিলেই কামরান সাহেব সিদ্ধান্ত জানালেন, আগামীকাল বাসার সবাই রওনা দিবে। তিতির শুধু একবার মাহাদের দিকে চাইলো। মাহাদ কঠিনমুখ করে বসে আছে। তিতির জানেনা, বাবার সাথে মাহাদের কি কথা হয়েছে। মাহাদের এমন মলিন মুখ দেখে তিতিরের মন অস্থির হয়ে উঠেছে। তিতিরের মন বলছে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ভাগ্যর ফেরে সেই বিপদের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে তারা। যা হবার হবে কিন্তু আল্লাহ্ সুবহানাতালার কাছে সাহার্য্যর প্রার্থনাগুলো করতে হবে তো! যাতে সেই প্রার্থনাগুলো বিপদের সময়ে ঢাল হয়ে দাড়াতে পারে। সবার নাস্তা হয়ে গেলে, যে যার মত উঠে গেল। তিতির রুমে এসে সাদকে রেডী করছে স্কুলে পাঠানোর জন্য। এমন সময় মাহাদ তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকেই দরকারী ফাইলপত্র নিয়ে সাদের দিকে চেয়ে বলল-
~ " সাদ, তুমি রেডী বাবা?"
~" জ্বী বাবা।"
আসো বলে সাদকে কোলে নিয়েই রুম থেকে দ্রুত বের হয়ে গেল। তিতিরের সাথে কথা বলার সময় পর্যন্ত তার হলোনা। মাহাদ সাদকে নিয়ে গাড়ীতে উঠিয়ে দিয়ে ওর ব্যালকোনির দিকে তাকালো। আজ তিতিরকে ব্যালকোনিতে আর দেখা গেলোনা। নিজের যে ভুল হয়েছে কিছু কাজে সেটা সে বুঝতে পেরেই দ্রুত আবার রুমে এসে দেখলো, তিতির বিছানা গোছাচ্ছিল। মাহাদ কোন কারন ছাড়াই তিতিরকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে একটা কিস করে বলল-
~ " না তুমি নিয়ম ভাঙ্গতে পছন্দ করো, না আমি।"
কথাগুলো বলেই মাহাদ চলে গেল। মাহাদ চলে যেতেই তিতির ব্যালকুনিতে গিয়ে দাড়ালো। হ্যাঁ এবার ঠিক আছে। তিতিরকে দেখে গাড়ীতে উঠলো মাহাদ।