সবুজ কাজলের কৌটো - পর্ব ০৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৫!! 

চোখ ডলে ঘুমটা কাটানোর চেষ্টা করল মায়রা। নিশ্চয়ই আবার স্বপ্ন টপ্ন দেখছে। চোখ খুলে আবারও আয়ানকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে দু হাতে চোখ ঢাকলো। আয়ানের কোন সাড়াশব্দ নেই দেখে মায়রা ভাবলো আসলেই বুঝি সে স্বপ্ন দেখছে। চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দেখলো আয়ান এখনও তাকিয়ে আছে তার দিকে।

-এই যে!!??? 

-----------------------

মায়রা গুটিগুটি পায়ে খাট থেকে নেমে আয়ানের সামনে দাঁড়ালো। তারপর আয়ানের একটা হাত ধরে আলতো করে নাড়া দিলো।

-এই যে শুনছেন???

-হুম----।।

-কি সমস্যা আপনার?? কথা বলেন না কেন!!? আর এতো সকালে এখানে কি করে এলেন!!?

-এতো সকাল না বউটা।৷ ১০ টা বাজে।

-এমা!!!!! ১০ টা বাজে!!!!! তাথৈ আপ্পি কই!!! এখন কি হবে!!! 

মায়রার ছুটোছুটি দেখে আয়ান হেসে ফেললো। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান এখনো। আয়ানের দিকে চোখ পড়তেই মায়রার ভ্রু কুঁচকে গেলো। এই লোকটা এতো হাসছে কেন!! আর আসলো কি করে এখানে!!আয়ানের একদম সামনে এসে দাঁড়ালো মায়রা।।

-আপনি এখানে কেমনে আসলেন!!?

-দরজা দিয়ে!! কি আশ্চর্য!! আর কিভাবে আসবো!!??

-আমি বলছি কিভাবে---মানে কেমন করে এসেছেন!!??

-হেঁটে হেঁটে আর কি!!! সাধেই কি বাচ্চা বলি তোমাকে!!??

মায়রা এবার রেগে গেলো।। সকাল সকাল কি শুরু করেছে লোকটা!!! নিজে পাগল!! নাকি মায়রাকে পাগল বানাচ্ছে!!

-ওই?? ওই?? কি সমস্যা!!!

- কই কি সমস্যা পিচ্চি!!?? 

-পিচ্চি বলবেন না একদাম৷ ধুর---।। গেলাম আমি---।।

আয়ান হাত ধরে টেনে দাঁড়া করিয়ে মুখটা দু হাতে তুলে ধরলো।

-তোমার মোবাইলটা কই পিচ্চি..??

-ওই যে--। বেড সাইড টেবিলে-।

-সকাল থেকে কয়বার কল করেছি জানো!??

-হুম!!???

-কম করে হলেও ২০ বার কল করেছি।

-ইশ।। সরি।। ঘুমিয়ে ছিলাম তো।। মাফ করে দেন প্লিজ---।।

-উহু।। মাফ করছি না।। আমার কতো টেনশন হয়েছে জানো তুমি?? ঠিক কতোটা টেনশন হওয়ায় এখন এভাবে ছুটে এসেছি বুঝতে পারছো??

 
আয়ানের কথাটা শুনে খুব মন খারাপ হলো মায়রার।৷ নিজেকে অপরাধীও মনে হতে লাগলো। আসলেই তো!!! এতো বার কল করে না পেলে তো চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।। ফোন তো রিংটোন মুডেই দেয়া। আর বেডের পাশেই রাখা মোবাইলটা।। তবুও কেন এতোগুলো কল শুনতে পেল না মায়রা!! চিন্তা করতেই লজ্জায় গুটিয়ে গেল বেচারি।। কি মরণ ঘুম ঘুমাচ্ছিলাম!!! মায়রার লজ্জায় আর নিজের উপরে রাগে কান্না এসে গেল। কিছুতেই আয়ানের দিকে তাকাতেও পারছে না।। কথাও বলতে পারছে না।। গলাটা ধরে এসেছে।।

-সরি----।।

সরি বলামাত্রই চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।। আয়ান মায়রার মুখটা তুলে থমকে গেল কাঁদছে দেখে।। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে দিল।।

-আরে আরে----।। কাঁদছ কেন!!??

-সরি----।।

-না রে বাবা।। আমিই সরি---।। দুষ্টুমি করছিলাম তো!!? সত্যি কল করিনি।। মোবাইলে দেখ।। একটাও কল করিনি। সত্যি।।। একটু কাজে এসেছিলাম।। ঘুমন্ত বউটাকে এতো মায়া পরী লাগছিলো-----।।।

-আপ্পি কোথায়!!???

- রিহান কল করেছিল।।  তোমার ঘুম যাতে না ভাঙে তাই ওই রুমে চলে গেছে।।

-আর আপনি কখন এলেন!!!??

-এই তো একটু আগেই কিউটি বউটা-।

-আপনি একটা খারাপ-------।।।

মায়রা আয়ানের বুকে হাত আছড়ে সরে গেলো রাগ করে।। আয়ান হেসে ফেলল রাগ দেখে।। মুখে আবার একটু কৃত্রিম গম্ভীর ভাব আনলো।। 

-হুম।। যাও যাও---।। খারাপ বলেই কেউ তো ভালোবাসেও না----।। 

-হুম!!???

মায়রা অবাক হয়ে আয়ানের দিকে ঘুরে তাকাল। কি বলে এই ছেলে!!

-কি বলেন!!??

-হুম বুঝি তো।। কেউ ভালোবাসে না আমাকে।। আমিই খালি বউ বউ করে যাই। আর সে সারাদিন আপনি আপনি করে যায়---।। ভালো না বাসলে সোজা করে বলেই দেখো না পিচ্চি--??  কখনো সামনেও আসবো না।। সত্যি বলছি---।।

মায়রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আয়ানের দিকে। মানুষটা কি বলে এসব!! আয়ানকে ঠিক কতোটা ভালোবাসে তা মায়রা কাউকেই বলে বোঝাতে পারবে না। আর আয়ানকে বলা তো অসম্ভব।।

-ঠিক আছে--।। বুঝে গেছি--।৷ আসলেই কেউ আমাকে ভালোবাসে না।। কখনোই বাসে নি।। শুধু শুধুই আমার পাগলামির ভয়ে বলে উঠতেই পারে নি।। গেলাম মায়রা।। ভালো থেকো---।।

আয়ান উল্টে দিকে ঘুরেই মুচকি হাসলো। মায়রা আয়ানের হাত টেনে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়েই টুপ করে আয়ানের বুকে মুখ ডুবালো।। কি হলো বুঝতে আয়ানের কিছু সময় লাগল।। আজ প্রথম তার মায়া পরীটা তাকে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেছে।আয়ানও আলতো করে মায়রাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।।

-কিছু কি বলবেন ম্যাডাম??

-আপনাকে ভিষণ ভালোবাসি----।।।

-কি বললেন শুনতে পাচ্ছি না।। একটু জোরে বলবেন প্লিজ???

-আপনাকে-----।।।

-এখানে আপনিটা কে গো পরীটা???

-জানি না---।।।

-ঠিক করে বলুন।। নয়তো গেলাম আমি।

-এমন কেন করে??!!

আয়ান মায়রার মুখটা আবার তুলে ধরলো দুহাতে।।

-বলো???

-তোমাকে খুব ভালোবাসি---।।।

ভালোবাসি বলেই মায়রা আবার আয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে নিল।। আয়ানও হেসে ফেলল।। তার প্ল্যানটা কাজে লেগেছে শেষমেশ।।তার মায়া পরীর মুখ থেকে "ভালোবাসি" শুনা হলো অবশেষে।। 

পিছন থেকে খিলখিল শব্দ শুনেই দুজনেই চমকে উঠলো।।।

-এতোদিনে ভালোবাসি বলা হলো শেষে!!

তাথৈয়ের কথা শুনে আয়ান আর মায়রা দুজনেই লজ্জা পেয়ে একটু সরে এলো। মায়রা তো বেচারি মাথা নিচু করে আছেই তো মুখ তোলার নাম গন্ধ নেই।। আয়ান হেসে ফেলল মায়রাকে এভাবে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে।

-আয়ান--।। অন্তত দরজাটা তো বন্ধ করতে পারতি----।।

-তাথৈ---।।। এতো হারামি হয়ে যাচ্ছিস কেন!!!??? আর বের হ তুই--।। এখন বন্ধ করি দরজা হারামি----।।

-ওই তোর এত্তো বড় সাহস হয় কী করে!?

-তাথৈ-----।।।।

আয়ান রেগে গেলেও মায়রার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।।বেচারি এখনো ফ্লোরের দিকেই তাকিয়ে আছে।। মুখ টুকটুকে লাল হয়ে আছে। 

-পিচ্চি??? তাকাও তো একটু---।।

-হুম??!!!

মায়রা চোখ তুলে দেখলো আয়ান আর তাথৈ দুজনেই হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে।।

-হাসছো কেন তোমরা!!??

-মায়রা!! তোর লজ্জা করে না বড় একটা মানুষকে তুমি করে বলছিস----??!

-না মানে--।। ইয়ে-----।।

আয়ান হেসে ফেলল।। 

-তাথৈ পিচ্চিটারে জ্বালাইস না ভাগ---।

-আমি না তুই যাবি----।। যা যা এখন।। তোর জন্য আজকে সারপ্রাইজ আছে।। এখন যা তো----।।

-আচ্ছা যাচ্ছি বাবা---।।। মায়রা, বায় বউটা।। 

তাথৈ আর রিহানের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হলো।। তাথৈ আর রিহান স্টেজে বসা।। মায়রা গিয়ে গিয়ে তাথৈয়ের কি লাগবে না লাগবে দেখছে। আজ তাথৈ মায়রাকে জোর করেই সাজিয়েছে। সাজবে না সাজবে না করেও মায়রা শেষে কি ভেবে রাজি হয়েছে। তাথৈয়ের বেনারসির সাথে ম্যাচিং করে গোল্ডেন পাথর বসানো ব্লাড রেড লেহেঙ্গা পড়েছে মায়রা। সাথে টুকটুকে লাল ওড়ানা বিছা হার দিয়ে সেঁটে দেয়া।। লাল পাথর ঝুলানো এ্যন্টিক কানের ঝুমকো, হাতে হাতপদ্ম আর বাজুতে মান্তাসা। আর গলায় লাল পাথর বসানো এ্যন্টিক পাতিহার, নাকে ডিজাইন করা নথ, চুলের ফাঁকে এ্যান্টিক কালারের ডিজাইন করা টায়রা, খোঁপা করা চুলে খোঁপার জালি আর সাথে বেলীফুলের গাঁজরা।। আর হাতে এ্যান্টিক চুড়ির ফাঁকে লাল আর গোল্ডেন রেশমি চুড়ি আর পায়ের মল অন্যরকম একটা ফুটিয়ে তুলেছে মায়রার মধ্যে।।

মায়রা এদিক ওদিক ঘুরছে।। এতো ভারি পোশাক আর গয়না পড়ে ঘুরতে একটু হাঁপিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো এক সময়।। কখন আয়ান পাশে এসে বসেছে খেয়ালই করে নি ও।।

-মায়রা---।। বউ বউ লাগছে আজকে-।

হঠাৎই আয়ানের গলা শুনে চমকে উঠলো মায়রা।।

-আপনি এখানে!!!??

-আবার আপনি শুরু করেছ!!!! চলে যাব!??

-না না---।। 

----------------------

-আচ্ছা সরি-।। তুমি কি করছো এখানে!

-বসে আছি।।  

-হুম!!???

-তোমাকে একদম লাল টুকটুকে বউ লাগছে।। চোখের সবুজ কালো কাজল, লাল টিপ, টুকটুকে রাঙা ঠোঁট---।। সব মিলিয়ে একদম নতুন বউ বউ লাগছে--।। 

মায়রা লজ্জা পেয়ে মৃদু হেসে মুখ নামিয়ে ফেলল।।আর আয়ানও নিজের বুকের বাম পাশে হাত রেখে হাসল।।

-আর এই লজ্জা ভরা হাসি!! আমি তো পুরোই শেষ!!! চলো না বউটা বিয়ে করি---???

মায়রা হেসে আয়ানের হাত একটা আলতো কিল বসালো।।

- ভালো লাগলেই এতো বিয়ে করতে মন চায় কেন!!??

-কারণ আমার পিচ্চি সুন্দরী বউটার সৌন্দর্য শুধু আমি দেখব।। এখন তো সবাই তোমাকেই হা করে দেখছে--।। আমার কষ্ট হচ্ছে-----।।

আয়ানের কথা শুনে মায়রা হেসে ফেলল। আর আয়ান বসে বসে মায়রার হাসি দেখছে।। হঠাৎ কি মনে হতে মায়রা আবার আয়ানের দিকে তাকালে মুখ তুলে।

-শুনো না??? আপু বলেছে আপুর সাথে রিহান ভাইয়াদের বাসায় নিয়ে যাবে আজকে।।। যাবো??!!

আয়ান হেসে ফেলল।।

-যদি না করি যেতে!!???

মায়রা চিন্তা করতে লাগলো।। আয়ান মানা করলে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা। আর না গেলে তাথৈয়েরও কতোটা খারাপ লাগবে।। বা কতোটা রাগ করবে। বা কতোটা কষ্ট পাবে!!!!আর আয়ান বসে বসে মায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর ভ্রু কুঁচকে থাকা চিন্তিত মুখটা দেখছে।।

০৬!! 

আয়ান আলতো করে মায়রার মুখটা তুলে ধরলো। মায়রাও আয়ানের দিকে তাকাল।

-মায়রা?? আমি কি কখনো এমন কথা বলবো যাতে তোমাকেই তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয় বলো..??

-হুম??!!

-নিজে যদি ঠিক থাকো কখনো মাথা নোয়াবে না পিচ্চি।। সেটা আমার সাথে হলেও--।৷ বুঝেছো??

-উহু--।।

-হায়রে পিচ্চি---।। বোনের সাথে ওর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছো--।। এটা তো অন্যায় কিছু না বলো?? আর যতক্ষণ নিজে নিজের বিবেকের কাছে ঠিক থাকবে ততক্ষণ কাউকে নিজের মাথায় ছড়ি ঘোরাতে দিবে না পাগলি।। বুঝেছো??

-হুম---।। আর নিজে ঠিক কিনা বুঝবো কিভাবে!!??আর আমি ঠিক না হয়েও নিজেকে ঠিক দাবি করে কথা না শুনলে!!??

-আমার পাগলিটা ভুল করতেই পারে না।। বুঝেছ???

মায়রা আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো ফ্যালফ্যাল করে।।আয়ান চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।।

-আমি কি তাহলে যাব???

মায়রার এমন প্রশ্ন আয়ান থতমত খেয়ে হেসে ফেলল।। এতোক্ষণ এই মেয়েটাকে সে কি বুঝালো কে জানে!! আয়ান আলতো করে মায়রার গাল টেনে দিল।।

-বাচ্চা একটা---।।। বউটা--না গেলে তাথৈয়ের মন খারাপ হবে তো বাবা--তাই না??

-হুম---।। তুমি রাগ করবে না বলো??

-নাহ গো পিচ্চি রাগ করবো না।। বরং এতো সুন্দর একটা সারপ্রাইজের জন্য তাথৈকে থ্যাংকস দেয়া দরকার।।

-কেন!!??

-তোমার জন্যও সারপ্রাইজ আছে বউটা।

-বলো না!!

-উহু।। এখন বলা যাবে না।। আমি এখন আসছি---।। কাজ আছে।। পরে কথা হবে কেমন??

-কোথায় যাও?? আমাদের সাথে রিহান ভাইয়াদের বাড়ি যাবে না??

-না গো।। আমার আর্জেন্ট কাজ আছে একটা--।। 

-ওওওওওও।।

-মন খারাপ করে না বউটা।। পরে পুষিয়ে  দেব।। কেমন?? বায়--।।

মায়রা আয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। একটু আগেই না মরে যাচ্ছিল- সবাই হা করে তাকিয়ে আছে- কষ্ট হচ্ছে!? এখন কি হলো এটা!!? মায়রাও গাল ফুলিয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ।।তারপর উঠে তাথৈয়ের কাছে গেল।তাথৈ এতোক্ষণ ধরে ওদের দেখছে। আয়ান যাওয়ার সময় তাথৈকে থ্যাংকসও জানিয়ে গেছে। তবে তাথৈয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মায়রা যে ঠিক কি পরিমাণ একটা ধাক্কা খাবে সে ব্যাপারে বেচারি এখনো কিছুই জানে না।৷ সেটা নিয়েই এতোক্ষণ রিহান আর তাথৈ কথা বলছিল। মায়রা আসায় দুজনেই চুপ হয়ে গেল।। 

আর রিহান অবাক চোখে তাথৈকে দেখছে। দুটো দিনে কতোটা বদলে গেছে মেয়েটা। তাথৈ যে এতোটা কেয়ারিং একটা মেয়ে সেটা জানাই ছিল না রিহানের। এতোগুলো বছর ধরে ওকে একদম পাংচুয়াল একটা মানুষ হিসেবে দেখেছে। রেগে গেলে তুলকালাম কান্ড ঘটাতে দেখেছে।। কতো যে দেরি করে এসেছে বলে রিহানকে রাস্তায় সবার সামনে ঝাড়ি দিয়েছে বা কানে ধরিয়েছে তার হিসাব নেই। অথচ গতকাল থেকে তাথৈয়ের কেয়ারিং রূপটা দেখছে। শান্ত তাথৈকেও রিহানের ভালো লাগছে। সবার খেয়াল রাখছে। খোঁজ নিচ্ছে।। দেখতে ভালো লাগছে রিহানের। 

লাল বেনারসিতে আর ব্রাইডাল মেকাপে- গা ভর্তি নানারকম গহনায় তাথৈকে একদম পুতুল বউ পুতুল বউ লাগছে।। রিহানের সেটাও ভালো লাগছে।। মেয়েটা এতো সুন্দর কেন ভাবছে রিহান।। কতো বদলে গেছে।। বদলটা তবে ভিষণ সুন্দর। তাথৈয়ের রিহানের চোখে চোখ পড়ায় ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে??
রিহান এই প্রথম সাহস করে তাথৈয়ের দিকে হালকা ঝুঁকে মৃদু হাসলো।

-পুতুল বউটাকে দেখছি---।।। অসম্ভব রকমের সুন্দর লাগছে----।।।

আর এই প্রথমবারের মতো তাথৈ লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নামিয়ে নিলো।। রিহান অবাক চোখে তাথৈয়ের লজ্জা রাঙা মুখ দেখছে আর ভাবছে।।আসলেই কি বিয়ের পর মেয়েরা এতোটাই বদলে যায়!! এ ও কি সম্ভব!!??

আর মায়রা ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করতে লাগলো।। আয়ান এভাবে ওকে একা ফেলে চলে যেতে পারল!! তার চেয়ে বড় কথা।। তাথৈয়ের শ্বশুরবাড়ির প্রায় কাউকেই চিনে না মায়রা।। এটা জানার পরও কিভাবে পারলো মানুষটা ওকে ধুম করে রেখে চলে যেতে!!?? কি এমন জরুরি কাজ আছে তার!!এতোটা জরুরি!!? মায়রার চেয়েও??

তাথৈ আর রিহানের সাথে বাড়িতে আসতে আসতে রাত সাড়ে আটটা কি নয়টা বাজে। এসে খেয়াল হলো মায়রার এই বাড়িতে প্রয়োজনের তুলনায় মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। যারা আছে তারা নতুন বৌকে দেখে খেয়ে দেয়ে যার যার বাসায় ফেরত যাচ্ছে পরের দিন আসার জন্য। আর বাকি যারা আছে সবাই মায়রার কাছাকাছি বয়সী। তাথৈ আর রিহানের ফ্রেন্ড বা রিহানের কাজিন বা কলিগ।। তবুও মায়রার অস্বস্তি লাগছে।। আয়ানের উপর রাগও হচ্ছে।। যদিও আয়ান থাকলেই বা কি হতো!!! এতো মানুষের সামনে কথা বলা তো সম্ভব হতো না!! তবে মায়রা এতো রাগ করছে কেন!!! নিজেই নিজের মনকে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে বেচারি।। 

আয়ানের কথা ভাবতে ভাবতে একটা কথা মায়রার মাথায় এলো। রিহান, তাথৈ আর আয়ান এতো ভালো ফ্রেন্ড।। তাহলে তো আয়ানের মা বাবা- বা ফ্যামেলির অন্য কারোও তাথৈয়ের বিয়েতে আসার কথা ছিল!! সেরকম কেউ এসেছে বলে তো জানা নেই মায়রার।। আর কখনো আয়ান বা তাথৈ-কারো কাছেই আয়ানের ফ্যামেলি সম্পর্কে কিছুই শুনে নি মায়রা। কে কে আছে ওর পরিবারে!!?? তারা কি মায়রাকে মেনে নিবে!? যদি না নেয় কি হবে!!??? ব্যাপারটা চিন্তা করে ভয় পেয়ে ঢোক গিললো মায়রা।। আয়ানকে ছাড়া বেঁচে থাকা মায়রার জন্য এখন প্রায় অসম্ভব কল্পনার মতো ব্যাপার হয়ে গেছে ইদানিং। এই লোকটাকে ছেড়ে থাকা কিছুতেই মানতে পারবে না মায়রা। একদম মরে যাবে----।।

-এই যে মায়রা?? খাওয়া দাওয়া হয়েছে না??? ওই দিকের রুমটাতে গিয়ে রেস্ট করো---।। তাথৈকে রুমে নিয়ে যাচ্ছে।। আর বসে থেক না---।। সারাদিন অনেক ধকল গেছে---।।

-জি আচ্ছা---।।

মুখটা পাংশু করেই রুমটায় ঢুকল মায়রা। তাথৈ আর রিহানের জন্য বাসর সাজানো হয়েছে। তাথৈকে এখন সেখানেই নেয়া হচ্ছে। রিহানের কাজিনগুলো জ্বালাতন করবে অনেক দুজনকেই।। মায়রাও চাইলে যেতে পারতো।৷ কিন্তু বেচারির বড্ড বেশিই লজ্জা করছে। দুটো মানুষের ভালোবাসার পূর্ণতার রাত আজ।। তাদের মাঝে কাবাবের হাড্ডি হওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই ওর।। মায়রা আপাতত আয়ানের কথা ভাবছে। মানুষটার আসার কথা ছিল--।। না এলো-না একটা কল করলো??!!

টুং করে মোবাইলে একটা মেসেজ এলো। আয়ানের মেসেজ। মেসেজটা পড়ে মায়রা হা হয়ে গেল।। 

" খাটের উপর আপনার জন্য একটা শাড়ি রাখা আছে।। একটু পড়বেন প্লিজ?? পড়ে নিচে ড্রইংরুমে আসুন। 
ইতি,
আপনার পচা বরটা।"

রুমে এসে তখনো লাইটও অন করে নি মায়রা। এতোক্ষণে হুঁশ হতে লাইট অন করেই অবাক হলো মায়রা। খাটের উপর সত্যি একটা শপিং ব্যাগে কালো পাড় দেয়া রয়েল ব্লু কালারের একটা হাফ সিল্কের শাড়ি। পুরো শাড়িটায় চকলেট আর গোল্ডেন কালারের রেশমি সুতোর কাজ করা। শাড়ির সাথে যাবতীয় সব রাখা ব্যাগে। সাথে ব্লু কালারের রেশমি চুড়ি- কানের দুল- নীল টিপ-হালকা রঙের একটা লিপস্টিক -আর---??! আর মায়রার পছন্দের সবুজ কাজলের কৌটো!! কাজলের কৌটোটা মায়রার না। একদম নতুন কৌটো। ইনটেক।। এটা আয়ান পেল কোথায়!!

টুং করে আবার একটা মেসেজ এলো।

"তুমি কি ভাবনা বাদ দিয়ে রেডি হবে!? নাকি আমি এসে রেডি করিয়ে দিতে হবে!?"

মেসেজটা পড়েই মায়রার ভ্রু কুঁচকে গেল। এই লোকটা কি!! কিছু মুখে আটকায় না!? আর সে কীভাবে রেডি করিয়ে দিবে!!?? ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল।। লোকটা বেশিই খারাপ!! মায়রা আবার একটু চিন্তায় পড়লো।। উনি না কি এতো জরুরি কাজে গেছে--।। এখন এলো কিভাবে এখানে!!! আর এসবের মানেটা কি!!??

ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে আপাতত রেডি হওয়ায় মন দিলো মায়রা। যত্ন করে শাড়িটা পড়লো। থ্রি কোয়ার্টার কালো ব্লাউজের উপর রয়েল ব্লু হাফ সিল্কের শাড়ি। সেইফি পিন ছাড়াই শাড়িটা বেশ সুন্দর করেই পড়ে ফেলল। একটু চেষ্টা করতেই কুঁচিগুলোও প্রায় সামলে নিল। কানে দুল পড়লো।। হালকা সাজলো। তরপর চোখে সবুজ রঙা কৌটো থেকে কাজল পড়লো। তারপর দিলো কালো কাজলের ফিনিশিং টাচ। নীল একটা টিপ পড়ে রুম থেকে বের হলো মায়রা।। নিচে গিয়ে কি দেখবে সেটা ভাবতে ভাবতে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ালো।। 

ড্রইং রুমে এসে ধাক্কা মতো খেল মায়রা। রুমটা যাওয়ার সময় এভাবে সাজানো ছিল না। বেলুন আর ফুল দিয়ে সুন্দর করো সাজানো এখন। কাজটা আয়ানের বুঝাই যাচ্ছে।। কিন্তু কি হচ্ছে- আর কেন হচ্ছে সেটা মায়রার মাথায় ঢুকলো না। ও অবাক হয়ে চারপাশের ফুল আর বেলুনগুলো ছুঁয়ে দেখছে আর অভিভূত হয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে।। 

আর দূরে দাঁড়িয়ে মায়রার এই ছেলেমানুষিই দেখছে আয়ান। নীল শাড়িতে একদম নীল পরী লাগছে মায়রাকে। মনে হচ্ছে পরীর দেশের রাজকন্যাকে কেউ ভুল করে পৃথিবীতে রেখে চলে গেছে। না তার দুরন্তপনা কমেছে এখনো-না তার ছেলেমানুষি।। দুজনের চোখাচোখি হতেই দুজনেই লাজুক হাসলো একটু।। আয়ান ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই মায়রার দিকে এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন