মায়াবতী (পর্ব ১৫)


২৯!! 

লিজা অফিস থেকে ফিরে এই ভর সন্ধ্যায়ই লম্বা একটা শাওয়ার নিয়েছে। একটা হালকা গোলাপি রঙা থ্রি পিস পড়ে ভিজে চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে রুমে ঢুকেছে মেয়েটা। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ভিজে জামা বারান্দায় মেলে দিয়ে ফিরে এসে নিজের গাধামির জন্য জিভ কাটলো। ভিজে জামার পানি পড়ে রুমের মেঝেটা কেমন পিচ্ছিল হয়ে গেছে। রিমনটা ছুটোছুটি করতে গিয়ে পিছলে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেতে পারে কথাটা মনে পড়তেই তড়িঘড়ি করে আবার বারান্দায় গিয়ে একটা পুরোনো কাপড় এনে মেঝে থেকে পানিটা মুছে দিলো লিজা। কাপড়টা আবার বারান্দায় রেখে এসে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসে ভিজে চুলগুলো মোছায় মন দিলো লিজা। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে চুল মোছার মাঝে আবার ভাবনার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। আজ ইচ্ছে করেই সন্ধ্যে পর্যন্ত অফিসে কাটিয়েছে লিজা। দ্বীপের সাথে মায়ার বিয়েটা হবে প্রায় কনফার্ম। মায়ার মতো এতো ভালো একজন মানুষের পাশে দ্বীপের মতো শয়তান একটা লোককে কল্পনা করতেও কেমন গা ঘিনঘিন করে লিজার। তাই আজ মায়ার গায়েহলুদের অনুষ্ঠানেও যায় নি লিজা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মায়ার গায়েহলুদের অনুষ্ঠানটা শুরু হয়ে গেছে! সবাই মিলে হয়তো খুব আনন্দ করে মায়াকে হলুদে রাঙিয়ে দিচ্ছে। আর রাহাত স্যার? উনি কি এখনো নিজের মনের কথাটা বুঝতে পারেন নি? চোখের সামনে দিয়ে মায়াকে অন্য কারো হতে দেখতে পারবেন তো উনি? 

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে লিজার খেয়ালই করে নি কেউ একজন বহুক্ষণ ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে অপলকে দেখছিল। লোকটা যে এক পা দু পা করে ওর দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে সেটাও বিন্দুমাত্র টের পায়নি লিজা। হঠাৎ কেউ লিজাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই চমকে উঠলো মেয়েটা। লোকটার শক্ত হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে না পেরে আয়নায় লোকটার দিকে তাকিয়ে রীতিমতো চমকে গেল লিজা। এই লোকটা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ওকে ফলো করতে করতে? লিজার ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে ডুবিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে দেখে লিজার এবার ঘোর কাটিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলো লোকটাকে। এতে কাজের কাজ যা হলো তাতে লোকটার বাঁধনটাও যেমন শক্ত হলো, তেমনি স্পর্শটাও যেন আরো কিছুটা গভীর হলো। কেমন ঘোর ধরানো ছোঁয়া মানুষটার। যেই স্পর্শ পাবার পর নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টাটা হয় বৃথা। নিজের ভাবনার গোলকধাঁধায় তলিয়ে যাওয়ার আগেই নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ছোটার চেষ্টা করলো লিজা। আর লিজার এই দশা দেখে লোকটা মিটিমিটি হাসছে। আয়নায় তার হাসির প্রতিবিম্বটা দেখেও লিজা রাগে ফুঁসছে। 

-কি সমস্যা কি আপনার? এভাবে ধরে রেখেছেন কেন? ছাড়ুন আমাকে? আমি কিন্তু চিৎকার করে পুরো মহল্লার লোকজনকে জড়ো করে ফেলবো বলে দিলাম। ছাড়ুন?

-এতো চিল্লাপাল্লা করো কেন বলো তো? আর তোমার গলা তো না মাশাল্লাহ লাউডস্পিকার। কানের পোকা সব মরে গেল রে বাবা! আস্তে কথা বলতে পারো না একটু?

-ছাড়ুন বলছি দিহান। আপনি আমার বাসায় কি করছেন? অফিসে সারাদিন জ্বালিয়ে কি সাধ মিটে নি আপনার? যে এখন সোজা বাসায় এসে হামলা করছেন?

-তোমাকে এমন আদুরে হামলা করার জন্যই তো নিজের করে পেতে চাই। তুমি তো পচা মেয়ে। রাজি হও না একদমই। তাই নিজেই তোমাকে আমার ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধতে এলাম গো ময়না পাখি। আর শোনো? আমি না তোমার বাসায় আসি নি বুঝছ?

-তাহলে কার বাসায় এসেছেন?

-আমার হবু শ্বশুরবাড়িতে এসেছি। শাশুড়ি মা আর শালাবাবুর সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু তোমার এই সদ্যস্নাত মায়াকাড়া মুখটা দেখে এখনিই তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে। 

দিহানের মুখে বিয়ের কথা শুনে লিজা এক ঝটকায় সরে এসে দিহানের দিকে রাগী চোখে তাকালো। লোকটা সেই আবার বিয়ের জন্য পিছে লেগেছে। লোকটা এমন কেন সেটাই বুঝতে পারে না লিজা। দিহানও হাত বাড়িয়ে লিজার ভেজা চুল থেকে টাওয়ালটা নিয়ে নিজেই লিজার ভেজা চুল মোছায় মন দিলো। লিজা বিরক্ত হয়ে দিহানের হাত থেকে টাওয়ালটা নেয়ার চেষ্টা করতেই দিহান টাওয়ালটা টেনে ধরে লিজাকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। লিজা আবার ছোটার জন্য ছটফট করতে শুরু করেছে ততক্ষণে। 

-আরে বাবা! আবার নাচানাচি শুরু করেছ? এমন করো কেন বলো তো?

-ছাড়ুন। আর এক্ষুণি আমার রুম থেকে, এই বাসা থেকে বেরিয়ে যাবেন। নইলে এবারে লোকজন ডেকে----।

-আরে অদ্ভুত! আমি সারাজীবন তোমার পাশে থাকতে চাইছি। আর তুমি কি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইছ? এটা কেমন কথা লিজা?

-সারাজীবন পাশে থাকার রঙিন স্বপ্ন দেখাতে সবাই-ই আসে। আর কাজ হাসিল হয়ে গেলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যায়। এসব দেখে দেখেই বড় হয়েছি মিস্টার দিহান। এসব সস্তা স্বপ্ন দেখে নিজেকে আপনার হাতে তুলে দেয়ার আগে প্রয়োজন হলে আত্মহত্যা করব।

-আরে! লিজা? কিসব বলছ? আমি কি বলছি আর তুমি কি বলছ? আমি আন্টির সাথে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। দেখো লিজা? মাথা ঠান্ডা করে আমার কথাটা শোনো। আমি জানি তোমার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। আন্টির আর রিমনের দায়িত্বটা কি আমরা একসাথে নিতে পারি না লিজা? তুমি রাজি থাকলে আন্টি আর রিমন আমাদের সাথেই থাকবে। বাবা মায়ের এতে কোনো আপত্তি হবে বলে মনে হয় না। তবু আমি----।

-বেরিয়ে যান দিহান।

-হোয়াট! লিজা তোমাকে আমি কি বলছি----।

-জাস্ট গেট আউট। আপনি আপনি বসের বন্ধু। এর বাইরে আপনার সাথে না আমার কোনো পরিচয় আছে, না সম্পর্ক। দয়া করে আর কখনো বিরক্ত করতে আসবেন না। বাসায় তো ভুলেও না। আমার মা ভাই বোকার মতো আবেগের বশে আপনার কথাগুলো হয়তো বিশ্বাস করে ফেলবে। কিন্তু আমি চাই না তারা আবার ঠকুক। আর দয়া করে আমাকে ফলো করা বন্ধ করুন। আমি আমার মা আর ভাইকে নিয়ে ভিষণ ভালো আছি। আমাদেরকে প্লিজ এভাবেই ভালো থাকতে দিন। হাত জোড় করছি আপনার কাছে। 

লিজার কথাগুলো শুনে কখন হাতের বাঁধনটা আলগা হয়ে এসেছে দিহান নিজেও জানে না। লিজা এবারে দিহানের হাত থেকে টাওয়ালটা ছাড়িয়ে নিল। দিহান এতোটা অবাক হয়েছে যে কয়েক মিনিট কি বলবে সেটাই বুঝতে পারলো না। দিহানের এমন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকায় লিজা কিছুটা বিরক্ত হল এবারে। 

-প্লিজ চলে যান এখান থেকে। আপনার আসা নিয়ে মহল্লায় কোনো চটকদার খবর ছড়াক সেটা চাই না আমি। দয়া করে আর আসবেন না। 

-লিজা? আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর কতবার বললে বিশ্বাস করবে বলো তো? ঠিক কি করলে তুমি রাজি হবে বলবে প্লিজ?

-ভালোবাসা জিনিসটা একতরফা হয় না মিস্টার দিহান। আর ভালোবাসা নামক সোনার হরিণের পিছনে ছোটার মতো সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। আপনি প্লিজ চলে যান।

-কেন এমন করছ বলো তো? তোমার আমাকে ভালোবাসতেও হবে না যাও। আমি তোমাকে এতোটা ভালোবাসবো যে একটা জীবন তোমাকে বুকে আগলে ঠিক পার করে দিতে পারো দুজনে। শুধু পাশে থাকার সুযোগটা অন্তত দাও? প্লিজ?

-আপনার দয়া আমি চাই না দিহান। মা আর রিমনকে আমি নিজেই দেখে রাখতে পারবো। কিন্তু আপনার করুণার বোঝা বইতে পারবো না। কখনো না।

-ভেবে বলো লিজা। আগেরবার তোমার করা প্রত্যেকটা অপমান হজম করেও কিন্তু ফিরে এসেছি।  এবারে হয়তো না ও ফিরতে পারি।

-আমি তো আপনাকে ফিরতে বলি নি। আপনি যা ইচ্ছে করুন, বিয়ে করুন, সংসার করুন। আমাকে প্লিজ মাফ করুন। 

-ঠিক আছে লিজা। তুমি যখন চাইছ না তাহলে আর বিরক্ত করবো না তোমাকে। বারবার ফিরে আসছি বলে ভালোবাসাটাকে দয়া বলে ফিরিয়ে দিলে। কিন্তু আমিও দেখবো কতদিন পারো আমাকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে। এবার আমি আর তোমার কাছে আসব না লিজা। তুমি আসবে--। দেখে নিও---।

-আকাশ কুসুম ভাবুন তাতে সমস্যা নেই। তবে এখানে নয়। আপনি নিজের বাসায় গিয়ে স্বপ্ন দেখুন কেমন?

-ইয়াপ। তোমার সামনে আমি আর আসবো না লিজা, যতক্ষণ না তুমি নিজে ডাকো আমাকে। একটা কথা মনে রেখো লিজা। মাঝে মাঝে ভালোবাসাটা উপলব্ধি করতে দূরে যাওয়াটাও জরুরি। এতোটা দূরে চলো যাবো যে আমার ছায়াও তুমি খুঁজে পাবে না। দেখে নিও।

-মানে?

-মানে কিছু না। ভালো থেকো। আর একটা কথা লিজা। বড্ড বেশিই ভালোবাসি তোমাকে। তাই আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার। আসি।

দিহান রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই লিজা আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। লোকটার বলে যাওয়া কথাগুলো বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে লিজার। লোকটা দূরে কোথাও চলে যাবে বলেছে। কথাটা শুনেই কেন বুকের ভিতরে ধ্বক করে উঠেছিল ওর? লিজা কি চাইছিল লোকটা ওর পাশে থাকুক? সবসময়ের মতো বিরক্ত করুক, আলতো করে তার কাঁধে মাথা রেখে সব কষ্ট, ভয়, অবিশ্বাস ভুলে যেতে ইচ্ছে করছিল কি লিজার? মাথা থেকে দিহানের সমস্ত ভাবনা সরিয়ে ফেলে চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো লিজা। কিন্তু ওর মাথার মধ্যে দিহানের আনাগোনা চলছে। লোকটা কি সত্যিই আর আসবে না কাল থেকে? একবারের জন্যও কি লোকটার দুষ্টু হাসি মাখা মুখটা দেখা হবে না? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে লিজার চোখ জুড়ে রাজ্যের ঘুম নামলো। 

এদিকে রাহাতের রাতটা কাটছে নির্ঘুম। বাসায় ফিরে মায়ার দেয়া ব্যাগটা খুলে গাউন আর অর্নামেন্টগুলোর সাথে স্মৃতির ডায়েরিটাও হাতে পেয়েছে রাহাত। ডায়েরিটা হাতে পেয়েই পড়তে শুরু করেছে রাহাত। প্রায় ছয় সাত বছর আগের একটা তারিখ দেয়া আছে ডায়েরিতে। হ্যান্ডরাইটিংটা যে স্মৃতির সেই ব্যাপারে রাহাতের কোনো সন্দেহই নেই। পর পর ছোট ছোট অনেকগুলো নোট লেখা আছে ডায়েরিটায়। আর কিছু না ভেবে লেখাগুলো পড়ায় মন দিলো রাহাত।

"বাসায় এতো কষ্ট করে বাবাকে আর মাকে ম্যানেজ করে কক্সবাজার আসাটা এই মূহুর্তে সফল মনে হচ্ছে। সন্ধ্যার আবছা আলো আর পায়ের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়া ঢেউগুলো ভালোলাগাটায় আরো একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে আজকে। কলেজ থেকে ট্যুরে না আসলে তো জানাই হতো না ঢাকার চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হওয়ার বাইরেও একটা জীবন আছে। এই যে বুক ভরে নিঃশ্বাসের সাথে সাগরের লবণাক্ত বাতাস নিচ্ছি সেটাতেও কেমন একটা স্বাধীনতার নেশা মিশে আছে। ঘোলাটে পানিগুলো ছুঁয়ে দিতে যে আনন্দটা হচ্ছে সেটা ট্রাফিক সিগন্যালে ঘোমড়া মুখ করে গাড়িতে বসে থাকায় কি পাবো কখনো? এই যে জায়গাটায় এতো ভিড় থাকার পরেও যে দু একজন মানুষ আলাদা করে চোখে পড়ছে সেটা কি ওই ইট পাথরে ঘেরা শহরটায় হবে কখনো? এই যে এতো ভিড়ের মাঝেও এই লোকটার খালি গলায় গাওয়া গানটা দুনিয়ার সবচেয়ে মধুরতম সঙ্গীত মনে হচ্ছে, সেটা কি ঢাকার কোনো স্টেজ শো দেখতে গেলে হবে? গানের সুর আর সাগরের ঢেউ, ঠান্ডা বাতাস, মাতাল করে দেয়া একটা অদৃশ্য টান লোকটার জন্য ইট পাথরের শহরে তা কি অনুভব করতে পারবো কখনো?"

"কি অদ্ভুত লোকটা! এইমাত্রই তো দেখলাম গান করছে। আবার এখনই দেখছি বন্ধুদের সাথে হুটোপুটি করে সাগরে ডুব লাগাচ্ছে, ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দিয়ে ঘোলা জল গায়ে মাখছে। ট্যুরে এসে মজা করার বদলে আমি এই লোকটাকেই কেন দেখছি বারবার? বান্ধবীদের সাথে আনন্দ করার বদলে আমার চোখ জোড়া বারবার কেন তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে? কে এই লোকটা? কিসের একটা নেশা তার দিকে আমাকে এতো টানছে?"

"এটা কোনো কথা হলো? ভাবলাম আজ তার সাথে সরাসরি কথা বলবো। আর এদিকে ভদ্রলোককে আজকে কোথাও খুঁজেও পেলাম না। আমাদের ফেরারও সময় হয়েছে। অথচ এই লোকটাকে নিজের মনের হাল না জানিয়ে যেতেও ইচ্ছে করছে না। তাদের পুরো টিমটাই নাকি ঢাকায় ফিরে গেছে আজ সকালেই। লাগেটা কেমন? অবশ্য ইট পাথরের শহরে তাকে এবার খুঁজবো কোথায়? অবশ্য একটু কষ্ট করে লোকটার নামটা জানতে পারলাম। মাহবুব চৌধুরী। কি কাঠখোট্টা নাম রে বাবা! একটু ছোটোখাটো নাম হলে কি হতো! এখন এই মিস্টার মাহবুব চৌধুরীকে খুঁজতে কি করা যায় একটা প্ল্যান করে ফেলতে হবে। আর সেটাও খুব জলদী।" 

এতোটুকু পড়েই রাহাত হেসে ফেললো। ডায়েরিটা বুকে চেপে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে স্মৃতির মুখটা ভাবার চেষ্টা করলো। এই পাগলিটা সম্পর্কে যত জানছে ততই আরো বেশি করে ওকে নিজের মধ্যে অনুভব করছে রাহাত। স্মৃতিকে ঘিরে যে রহস্যের জাল তৈরি হয়েছিল সেটা নাহয় একসময় পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েটা যে ওর থেকে এতোটা দূরে চলে গেছে সেটা রাহাত মানবে কি করে? কি করে এই দুষ্টু মেয়েটাকে ভুলবে রাহাত? যার জন্য নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে রাহাত তাকে ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ? নাকি তার জায়গায় অন্য কাউকে এতো সহজে বসাতে পারবে ও? 

৩০!! 

"প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ফুপির আর আম্মুর উপরে। একে তো আমি মিস্টার চৌধুরীকে কোথায় খুঁজবো ভেবে পাচ্ছি না। তার উপরে মা আর ফুপি আবার নিরবের সাথে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। এই লোকটাকে এতো অসহ্য লাগে আমার এরা কি বুঝে না? অফিসে, বাসায় সবখানে এই লোকটার এতো মাতব্বরি করা লাগে কেন? অসহ্য!"

"দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেছে। লোকটার কোনো খোঁজই পেলাম না৷ একটা মানুষ কি করে এমন ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে! বাবাকে যে একবার খোঁজ নিতে বলবো তারও সুযোগ নেই। আয়ারল্যান্ডের বিজনেসটা নিয়ে এমনিতেই বাবাকে এতো টেনশন করতে হচ্ছে। আর তার উপরে নিরব। ছেলেটার কাজকর্ম কেমন যেন সন্দেহজনক লাগছে। এদিকের ব্যবসার চৌদ্দটা বাজিয়ে এবারে সে গেছে আয়ারল্যান্ডের ব্যবসা সামলাতে। হাস্যকর!"

"এদিকে তাকে আমি খুঁজে মরছি, আর সেই ভদ্রলোক কি না আয়ারল্যান্ডে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে! বহু কষ্টে বাসার সবাই আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার অনুমতি দিলো। অবশ্য এখানেও নিরব নাক গলাতে চলে এসেছে। ব্যাপার না বাচ্চু। শুধু একবার আমাকে দেশের বাইরে পা রাখতে দাও, তারপর তোমার বিয়ের করার সাধ মিটিয়েই। আর তোমার এই ন্যাকা ন্যাকা লক্ষী ছেলের মুখোশটাও যদি সবার সামনে খুলতে না পারি তাহলে আমার নাম মৌনিই নয়।"

"রাহাত! এই নামটা ঠিক আছে। আচ্ছা হুট করে লোকটা কোনোদিন সামনে এসে দাঁড়ালে কি কথা হবে আমাদের? প্রতিদিন দূর থেকে তাকে দেখে আজকাল আর মন ভরে না। সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে এতোদিন ধরে মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসার ঝাঁপি খুলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন্তু একটা ভয় আমার মনে কাঁটার মতো খচখচ করে সবসময়। সবাই বলে একবার দেখেই নাকি ভালোবাসা হয় না। লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে নাকি কিছু নেউ, সবই নিছক মায়া। বাবা বলে ছেলেটা যদি ভালো না হয়? সে যদি অন্য কাউকে ভালোবাসে? বা তার জীবনে ভালোবাসা নামে যদি কোনো অনুভূতির জায়গাই না থাকে? তাহলে?"

"আচ্ছা আজকে আমাকে কোন পাগলে পেয়েছে? নিজেকে ওর কাছে স্মৃতি বলে কেন পরিচয় দিলাম? আমি আজীবন ওর স্মৃতিতে মিশে থাকতে চাই বলে? কেমন গাধার মতো ওর বাড়িতেও চলে এলাম! কি ভাবলো লোকটা? হয়তো ভেবেছে চিপ টাইপের একটা মেয়ে একবার বলাতেই সুড়সুড় করে সোজা বাড়িতেও চলে এসেছে! ছি! অবশ্য রাহাত নামের লোকটারও তো একটা টেস্ট নেয়া উচিত। যার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই তার চরিত্রটা কেমন জানবো না? বাইরে থেকে জেন্টেলম্যান মনে হলেই কি সে ভালো হয়ে যাবে নাকি? অবশ্য মনে হচ্ছে তার মনে একটু হলেও জায়গা করে নিতে পেরেছি।"

"মায়ের কথা শুনে আজ প্রচন্ড রাগ হলো। কোথাকার কে নাকি বলেছে রাহাত নাকি ভালো না। এই সেই। নিশ্চয়ই এটা নিরবেরই কাজ। অসভ্য একটা ছেলে। এদিকে ব্যবসাটার বারোটা বাজিয়েছে আর এখন আমার রাহাতকে নিয়ে বাজে কথা! ওকে তো আমি খুন করে ফেলবো। রাহাতকেও বলে দিয়েছি৷ একদম কিছু না জানতে চেয়ে যদি বিয়ে করতে পারো তাহলেই থাকবো৷ রাহাত মেনেও নিয়েছে শর্তটা। বিয়ে করেই দেশে ফিরবো আমরা। তখন নিরবের এসব মিথ্যেগুলোও প্রমাণ করে দিবো। আর কতোটা নিচে নামবে ও! এতো লোভ কেন!"

"জানো রাহাত? তোমার সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মূহুর্তই আমাদের জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়। আর গত কয়েকটা দিনের কথা নাই বা বলি। কেন জানি না ভয় হচ্ছে ভিষণ। তোমার সাথে বাকিটা জীবন কাটাতে পারবো তো? এতো সুখ, তোমার এতো ভালোবাসা কপালে সইবে তো আমার? নাকি এই স্মৃতি নামটা শুধু তোমার স্মৃতিতেই থেকে যাবে?"

ডায়েরিটায় আর কোনো লেখা নেই। হয়তো মৌনি আর লেখার সুযোগই পায় নি। তার আগেই ওর ভয়টা সত্যি হয়ে গেছে ওদের জীবনে। রাহাতের জীবনে আর আসা হয়নি মেয়েটার। কথাটা ভেবেই রাহাত ডায়েরিটা বুকে চেপে ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলো। চোখের পানিগুলো আজ বাঁধা মানতে চাইছে না রাহাতের। স্মৃতি নামের মেয়েটা সেদিন হুট করেই ওর জীবনে এসে ওর অস্তিত্বের সাথেই যেন মিশে গেছে। গত পাঁচটা বছর রাহাত ওর অপেক্ষা করেছে। মেয়েটাকে সামনে পেলে কি কি বলবে, কথা শোনাবে নাকি ফিরে পেয়ে নতুন করে সবটা শুরু করবে এমন হাজারটা ভাবনা নিয়েই রাহাতের কেটে গেছে পাঁচটা বছর। আজ রাহাতের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। কিন্তু স্মৃতি আর ফিরবে না কথাটা মেনে নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে রাহাতের। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ গালে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে চোখ মেলে তাকালো রাহাত। প্রতিবারের মতো এবারে আর মেয়েটা হাওয়ায় মিশে যায় নি। শান্ত ভঙ্গিতে রাহাতের মাথার কাছে বসে মেয়েটা। পড়নের মলিন শাড়িটার মতোই মলিন মুখটা দেখেই রাহাত চমকে উঠে বসলো। হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁয়ে দেয়ার আগেই রাহাত থেমে গেল। ছুঁয়ে দিলেই তো ধোঁয়াশার সাগরে হারিয়ে যাবে ওর স্মৃতি। 

-এখনো রাগ করেই থাকবে রাহাত? এবার অন্তত মাফ করে দাও? আমার যে বড্ড কষ্ট হয় তোমাকে এভাবে দেখতে। তোমাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে আমি তো চলেও যেতেও পারি না রাহাত। 

-ফিরে এসো না স্মৃতি? প্লিজ? তোমাকে ছাড়া আমিও যে ভালো নেই। একবার ফিরে এসো প্লিজ? বুকের মাঝে আগলে রাখবো তোমাকে বিশ্বাস করো? 

-সব ভালোবাসার পরিণতি মিলন হয় না রাহাত। আমাকে যে যেতে হবে। কিন্তু এতো অদৃশ্য পিছুটান তোমার ভালোবাসায় রাহাত, আমি যে চাইলেও সেই টানটা এড়াতে পারি নি এতোদিন। কিন্তু আমাকে যে যেতেই হবে রাহাত। এই জগতটা আর আমার নয়। তোমার স্মৃতিতেই নাহয় আমি বেঁচে থাকবো। 

-যেও না স্মৃতি। আমাকে একা ফেলে প্লিজ যেও না।

-তোমাকে একা ফেলে আমি তো যাচ্ছি না রাহাত। যে তোমাকে আগলে রাখতে চায় তাকে খুঁজে নিতে এতো কেন দেরি? আমার ভুলটা তুমি কেন করবে? হারিয়ে ফেলার পর হাজার খুঁজলেও তো তাকে পাবে না রাহাত। তাই হারানোর আগেই তাকে অধিকার নিয়েই কাছে টানো। তোমার স্মৃতি অন্য কোনো জগতে যুগের পর যুগ তোমার অপেক্ষায় থাকতে পারবে রাহাত। কিন্তু তোমাকে এভাবে তিলে তিলে মরতে দেখতে পারবে না। 

-তোমাকে ভালোবাসি স্মৃতি। 

-সেও তো তোমাকে ভালোবাসে রাহাত। এতোটা ভালোবাসে যে তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে নিজের কথাও ভাবে নি। সে ও তো তোমার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে রাহাত। নিজেকে কি আরেকটা সুযোগ দিতে পারো না রাহাত? যে নেই তার পিছনে না ছুটে, যে আছে তাকে নিয়ে কি সুখী হতে পারো না? অন্তত তোমাকে সুখে থাকতে দেখে আমিও নাহয় অন্য কোনো দুনিয়ায় সুখে থাকবো৷ 

-মায়ার সামনেই বা আমি কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো স্মৃতি? আমি নিজের হাতে ওকে অন্য কারো নামের হলুদে রাঙিয়ে এসেছি। মায়াবতীটা ভালো থাকবে এই আশায় ওকে যে আরো বেশি করে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। কি করবো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। না আমি তোমাকে ভুলতে চাই, না মায়াবতীটাকে হারাতে চাই। তোমার জায়গটা মায়াকে দিলে তোমার ভালোবাসাটার অপমান করা হবে। আর মায়া? ও তো কোনো স্বার্থ ছাড়াই আমাকে ভালোবেসেছে। 

-অতীত আগলে আর কতোদিন এভাবে কষ্ট পাবে রাহাত? যে চলে গেছে, সে ফিরবে না জেনেও তার জন্য আর কতদিন তাকে খুঁজে বেড়াবে? নিজে তো কষ্ট পাচ্ছই আবার মেয়েটাকেও কষ্ট দিচ্ছ। কেন বলো তো?

-কিন্তু মায়া যদি আমাকে এ্যাকসেপ্ট না করে? 

-যে ভালোবাসে সে সবসময় সব পরিস্থিতিতেই তোমাকে ভালোবাসবে রাহাত৷ হয়তো রাগ করে দূরে সরে যাবে, অভিমান করে হয়তো গাল ফুলিয়ে থাকবে ঠিকই, আবার রাগ ভাঙিয়ে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে চাইলে ধরাও দিবে ঠিকই।

-কিন্তু---। মায়াকে তোমার জায়গাটা আমি দিবো কি করে স্মৃতি?

-কারো জায়গা কাউকে কখনো দেয়া যায় না রাহাত। জায়গা বানিয়ে নিতে হয়। আর বানানোর সুযোগটাও দিতে হয়। তুমি মায়াকে সুযোগ দাও আর নাই দাও, ও কিন্তু তোমার হৃদয়ে নিজের জায়গাটা করে নিয়েছে রাহাত। কিন্তু সেটাও তো তোমাকে বুঝতে হবে। ওকে ওর জায়গাটা দিতে হবে। ভালোবাসা সব ক্ষত মুছে দিবে একসময়। অতীতটাকে আগলে অন্ধকারে পড়ে না থেকে বর্তমানের সাথে নিজেকে তো মানিয়ে নিতে হবে রাহাত। আর সেই পথ ধরেই নাহয় একটা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে তোমরা।

-কিন্তু মায়া------।

-ভালো থেকো রাহাত। আর তোমার ঘৃণা আর ভালোবাসার দেয়াল হয়ে এই জগতে আটকা পড়ে থাকতে হবে না। অন্য কোনো দুনিয়ায় তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবো। তুমি খুব খুব খুব সুখে থেকো। আজকের পর আর এভাবে অদৃশ্যের বাঁধনে তোমার সাথে থাকবো না। আজ যখন তুমি আমার সব রহস্যই জেনে গেলে তখন এই পৃথিবীর সব মায়া থেকে মুক্তি পেলাম। সব টানাপোড়েন, পিছুটান থেকে আজ আমি মুক্ত। আসি রাহাত?

-স্মৃতি?

জোরে স্মৃতির নামটা ধরে ডাকতেই চোখ ছুটে গেলে এক লাফে বিছানায় উঠে বসলো রাহাত। বুকের উপরে স্মৃতির ডায়েরিটা আছে নিজের জায়গাতেই। কিন্তু স্মৃতিকে কোথাও দেখতে পেল না রাহাত। মিষ্টি গন্ধটা এখনো নাকে এসে লাগছে রাহাতের। স্মৃতি আসলেই কি আসলেই এসেছিল নাকি স্বপ্ন দেখেছিল রাহাত? রাহাত ডায়েরিটা পাশে রেখে আবার শুয়ে পড়লো। চোখ বুজতেই এবারে মায়ার হাসোজ্জ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো রাহাতের। নিজের মনের সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে মায়ার কাছে ফিরবে রাহাত। মায়া ওকে ফিরিয়ে দিবে নাকি গ্রহণ করবে সেটা নাহয় এবারে মায়ার উপরেই ছেড়ে দিবে। কিন্তু এবার নিজের অনুভূতিগুলো আর গোপন করবে না রাহাত। এবার শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন