আমার তুমি |
০১!!
গলা দিয়ে গোঙানোর মতো শব্দ বের হচ্ছে আরিশার। মাকে দেখছে ও অনেকদিন পরে৷ কেন মা কথা বলছে না ওর সাথে!? একটু একটু করে কেন দূর থেকে আরো দূরে চলে যাচ্ছে!! ওই যে ধুমধামে পা ফেলার শব্দ ভেসে আসছে কারো। শব্দটা যতই এগিয়ে আসছে মা যেন তত দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ যেন ওর মাথার কাছে এসে থেমে গেছে। এখন কি গায়ে বেতের বাড়ি পড়বে!!পুরো শরীরটা কেঁপে উঠতেই ঘুমটা ভেঙে গেল আরিশার। এখনো কাঁপছে মেয়েটা। বুকের ভেতরে যেন হাতুড়ি পিটাচ্ছে কেউ। এই একই স্বপ্নটা কয়বার আর দেখবে!! কেন অতীতগুলো পিছা ছাড়ে না ওর!!
আবার বিছানা কাঁপিয়ে ফোনে ভাইব্রেশন হলে হুঁশ হলো আরিশার৷ কলটা রিসিভ করে কানে লাগিয়ে অন্য পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।
-হ্যালো আরু??? কখন থেকে কল করছি? ঠিক আছো তুমি?? কথা বলো না কেন??
-আমি----ঠিক--ঠিক আছি--।
-আবারও সেই স্বপ্নটা দেখসো না তুমি?? তোমাকে বলসি রাতে ঘুমানোর আগে এতো বেশি হাইপার হয়ে কান্নাকাটি করবা না---।
-------------------------------
-আরু---?? বেশি ভয় করছে??
-নাহ---। আমি ঠিক আছি--। ভয়ের অংশ আসার আগেই তো তুমি জাগিয়ে দিলে---।।
-উঠে যাও--। ফ্রেশ হয়ে রেডি হও।।
-এখন কেন!!?
-কজ কাল আমরা দেশে ফিরছি। আজ শপিং, প্যাকিং, বেড়ানো সব করবো----।
-আমি তো তোমাকে বলেছি আমি দেশে ব্যাক করবো না--। কথা শুনো না কেন তাওহীদ??!
-আরু ম্যাডাম--? আপনি তো জানেন আমি জোঁক টাইপের বন্ধু আপনার। এতো সহজে হাল ছাড়ি না!! উঠে চেইঞ্জ করো।। তাড়াতাড়ি--।
-আমি দেশে---৷
-উফ--।। তুমি জানো আমি কালকে একেবারের জন্য দেশে ফিরছি--। আর ব্যাক করবো না অস্ট্রেলিয়ায়। তুমি একা একা থাকতে পারবা??
-পারবো--। তোমার যাওয়া তুমি যাও না--? ধরে রেখেছি আমি??
-জানি ধরে রাখবেও না।। তাই তোমাকে নিয়েই যাব--। আর তোমার মামা মামি দুজনেও তো চায় তুমি দেশে ব্যাক করো--। কোম্পানিটা সামলাও--। তাদের ভালোবাসাটার অন্তত একটা সম্মান করো---।।
-দেখো তাওহীদ তুমি----।।
-তুমি রেডি হবা না তো? দরজা খুলো--।৷ আমি রেডি করাই--। খুলো--??
-এই না----।।
-তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমি--। আর উনি যাবে না--। গতকাল রাতেই প্রমিস করেছ আমি যা বলি শুনবা--। তাড়াতাড়ি রেডি হও।৷ আজ সারাদিন ঘুরে দেখবো। কতগুলো বছর পার করেছে এই সিডনিতে আছো সিডনির বিখ্যাত জিনিসগুলোই দেখো নি। কেউ বিশ্বাস করবে?? এই যে সিডনি অপেরা হাউজ, মিউজিয়াম! বন্ডাই বিচ-যেখান থেকে প্রশান্ত মহাসাগরটা এতোটা কাছ থেকে আর গভীরভাবে উপভোগ করা যায়। সেখানেও যাও নি--। ঘর থেকে বেরই হতে চাও না। কেউ বিশ্বাস করবে পাগলী??
-বিশ্বাস না করলে নেই--। তুমি যাও--। আমি যাব না-----।।
-আমার তো কতো শখ ছিল তোমাকে নিয়ে পুরো অস্ট্রেলিয়াটা শুধু ঘুরবো--। বিসব্রেন, শাইন কোস্ট, মেলবোর্ন, ক্যানবেরা-এক একটা শহরের প্রতিটা কোঁণার সৌন্দর্যগুলো তোমার সাথে দেখবো--। আর বিয়ের পর---।
-কার বিয়ে??
-না মানে হানিমুনে সিডনির বাড়িটায় থাকবো বউ নিয়ে----।।
-তো থাকো।৷ একটা বিয়ে করো---।
-আর বিয়ে!!! পাত্রি জানেই না- আর আমার নাকি বিয়ে!!
-কি??
-কিছু না---। উঠো তো?? কথা কম বলো।
-ধ্যাত -- রাখো তো।। কোথাও যেতে পারবো না--।
-ওকে---।
দরজায় খুট করে শব্দ হতেই আরিশা দরজার দিকে মুখ করে তাকাতেই তাওহীদকে দেখে উঠে বসলো।
-তোমাকে না বললাম উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হও--। আমরা ঘুরতে যাব আজকে---।
-তুমি রুমে কি করে আসলা??
-সেটা তোমার জানার কাজ কি!?
-মানে কি!! তুমি আমার রুমে আসবা আর---।।
-হুসসস--।উঠো---??
-না---।
তাওহীদ আরিশাকে পাঁজাকোলা করে তুলে খাট থেকে নামিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো।
-তাওহীদ?? কি করছো?? আমি স্লিপিং সুট পড়া!!?
-এতোক্ষণ ধরে রেডি হতে বলছি--। শুনসিলা তুমি?? আমিও শুনবো না--।
-এই না না--। আচ্ছা রেডি হচ্ছি--।
-শুধু রেডি না--। কাল সন্ধ্যায় আমরা দেশে ফিরছি--। রাজি কিনা??
-নো ওয়ে-----।
-তাহলে আমার কি!! এখনই যাব--।
-এই না না না----। নামাও নামাও--।
-না-----।।
-আচ্ছা ঠিক আছে---। যাবো---।
তাওহীদ আরিশাকে নামিয়ে দিয়ে কপালে চুমো খেল।। আরিশা ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
-এই তো লক্ষী মেয়ে --। যাও তো আরু--। তাড়াতাড়ি করো--।
-তুমি??!
-আমি এখানেই বসছি ম্যাডাম--।
-এই না--। বের হও--।
-আচ্ছা--। ২০ মিনিট টাইম---। এর মধ্যে রেডি হবা--। এক সেকেন্ডও আর সময় দিবো না পরে--।
-হুহ.....। যাও এখন---।
আরিশা লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। ধবধবে সাদা শার্ট প্যান্ট পড়ে নিল। চুলগুলো শুকিয়ে নিল ড্রায়ার দিয়ে। হালকা একটু মেকাপের টাচ দিতেই খেয়াল করলো দরজায় টোকা দিচ্ছে। নির্ঘাত তাওহীদ। এই ছেলেটা একটু শান্তি দেয় না কেন কে জানে!!?
-কই হলো তোমার???
বিরক্ত হয়ে দরজাটা খুলে দিল আরিশা।
-তোমার সবসময় এতো তাড়া কিসের তাওহীদ?
-তোমাকে দুচোখ ভরে দেখার তাড়া আরু----।।
-কি??
তাওহীদ কিছু না বলে অপলকে আরিশাকে দেখছে।
০২!!
আরিশা তাওহীদের সামনে এসে দু আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজালো কয়েকবার। তাওহীদের হুঁশ হলে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল আারিশার হাতে।
-কি এতো দেখো হা করে বুঝি না--।
-যাও--। এতো বুঝতে হবে না তোমার। চেইঞ্জ করে এসো।৷ এভাবে যাচ্ছি না কোথাও---।।
-মানে!!
-মানে এই সাদাপরীটাকে নিয়ে বিচের পানিতে নামবো!! মজা করবো!! হবে না। তাই না পরী?? এখন মানুষ হয়ে আসুন--।
-আমি সাদা ছাড়া অন্য কিছু পড়ি না--।
-তোমার লাইফে রঙ ছোয়ানোর দায়িত্বটা তো নিয়েছি--। সো--। তাড়াতাড়ি করো--।
-উহু----।
-আমি বুঝসো এখনো ঠিক করে বলছি--। পরে জোর করলে কি হবে কল্পনাও করতে পারবা না--।
-এই শার্টে কি সমস্যা???
-সমস্যা তোমার দেখতে হবে না। আমি বলছি চেইঞ্জ করবা-মানে করবা। কথা শেষ---।।
-তুমি!!!???
তাওহীদ আর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এই মেয়ে জীবনেও ওর ফিলিংস বুঝবে কিনা সন্দেহ। নিচে এসে বাসার সার্ভেন্টদেরকে সব কিছু বুঝিয়ে দিল। আজ সিডনি শহরটা ঘুরে রাতে ক্যানবেরায় যাবে। কাল সারাদিন ঘুরাঘুরি শপিং শেষ করে সন্ধ্যার ফ্লাইটে বাংলাদেশ। সবাইকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে গাড়িতে এসে বসেছে তাওহীদ। মেয়েটা এতো দেরি করে কেন কে জানে!! আর একটা শার্টই তো চেইঞ্জ করবে!! তাতেও এতোক্ষণ!!
আরিশাও ইচ্ছে করেই বসে আছে৷ সাদা শার্টটা বদলে তাওহীদের দেয়া নেভি ব্লু রঙা টপসটা পড়েছে। সুন্দর, মোলায়েম টপসটা। উপরে লেইস কেটে লাভ শেইপ করা। বেশ কিছুক্ষণ পর এসে তাওহীদের পাশে গাড়িতে এসে বসেছে আরিশা। দুজন মিলে পাড়ি জমিয়েছে অজানায়।
বিচে যাওয়ার আগে সিডনি ডার্লিং হারবারের বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গাগুলোয় ঘুরে এলো ওরা দুজন। সিডনি হারবার ব্রিজ, সিডনি অপেরা হাউস আর অপেরার পাশের পার্ক। অপেরা হাউজে গিয়ে তো আরিশার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। আজ কোন শো হচ্ছে না। আজ হচ্ছে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান। এশিয়ান গার্ডেরা অপেরা হাউজের সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করছে। আর বাকিরা যার যার মতো কাজে ব্যস্ত। এতো সুন্দর বিয়ের অনুষ্ঠান!! না দেখে যেতেই ইচ্ছে করছে না।। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে বিকেল পেরিয়ে গেল।
সন্ধ্যায় সূর্য ডোবা দেখতে ওরা আসলো বন্ডাই বিচ। প্রশান্ত মহাসাগরের বেলাভূমির নির্জন পাথরে পা ঝুলিয়ে পাশাপাশি বসে দুজনে সূর্যাস্ত দেখলো। মহাসাগরের কোলে আছড়ে পড়া বিশাল বিশাল এক একটা ঢেউ ওদেরকে একেবারে কাক ভেজা করে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বারবার। তবুও জায়গাটা ছেড়ে উঠতে কারোই ইচ্ছে হলো না। পাথরের উপরে বসে আরিশা আলো কমে আসায় গাঙচিলদের ঘরে ফেরা দেখছে। আর তাওহীদ দেখছে আরিশাকে। সন্ধ্যার আধো আলোয় কতটা আবেদনময়ী লাগছে মেয়েটাকে সেটা ও জানে?? অন্য আর দশটা মেয়ের মতো এতো সৌন্দর্যের উত্তেজনায় হুটোপুটি করছে না। প্রকৃতির এতো সৌন্দর্য যেন মেয়েটাকে একেবারেই শান্ত করে দিয়েছে।
অনেকক্ষণ সেখানে বসে থেকে তারপর উঠেছে তাওহীদ আর আরিশা। তাওহীদ সাঁতার কাটার কথা বলেছিল। আরিশা রাজি হয় নি। একটা হোটেলে ফ্রেশ হয়ে সেখানের রেস্টুরেন্টেই খেয়ে নিয়েছে দুজনে। আরিশা না খেয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে দেখে তাওহীদ ওকে খাইয়েও দিয়েছে।। খেয়ে দেয়ে আবার গাড়িতে এসে বসেছে দুজন। এখনো চুপচাপ বসে আছে আরিশা। মেয়েটার মনে কি চলছে কিছুই বুঝতে পারছে না তাওহীদ। আলতো করে আরিশার মাথায় হাত রেখে চুলগুলো এলোমেলো করে নাড়িয়ে দিল। অন্য সময় হলে বিরক্ত হয়ে ধমক লাগাতো আরিশা। আজ কিছু না বলে চুপ করে তাওহীদের দিকে তাকালো।
-কি হয়েছে আমার পাগলীটার??
-কিছু হয় নি---।
-তো মন খারাপ কেন?? জোর করে নিয়ে যাচ্ছি বলে রাগ করেছ??
-উহু---। আমি তো ফিরতেই চাই দেশে---। কিন্তু---। ওখানে এতো বাজে সব স্মৃতি জড়িয়ে আছে---।
তাওহীদ আলতো করে আরিশার মুখটা তুলে ধরে চোখ মুছিয়ে দিল।
-কাঁদবে না একদম--। তোমার সমস্ত কষ্টের স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়ে আনন্দে আনন্দে ভরিয়ে দিতে চাই তোমার জীবন---।
-হুম???
-সব কিছু নতুন করে শুরু করো। ভরসা করে হাতটা ধরো---। কখনো ঠকাবো না-----।।
-ভরসা করে মাও তো ওই লোকটার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল তাওহীদ---।
-সবাই তো তোমার বাবার মতো---।।
-লোকটা শুধু মায়ের সম্পত্তি পাবার জন্য মাকে বিয়ে করেছিল জানো? মা যখন সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে তার সাথে চলে আসলো আর নানুরা বিয়েটা মানলো না--তখন তার বিহেভিয়ারটাই বদলে গেছে--।আসল রূপটা সামনে এসেছে তখন---।
-কি হলো আরু?? আবার কেন কাঁদছ??
-মা তবু হাল ছাড়ে নি জানো?? লোকটা যখন ব্যবসার নাম করে অন্য মেয়ের সাথে ঘুরতো-ইন্টিমেট করতো- মা তখনো সবটা দেখেও চলে যায়নি--। সবটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল--। আমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল---।
-আরু???
-কিন্তু ওই লোকটা কি করতো?? প্রতিদিন---প্রতিদিন ড্রিংকস করে এসে মাকে আর আমাকে মারতো--। একদিন তো--। মাকে-- মেরেই---।।
তাওহীদ আরিশাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।।
-প্লিজ?? শান্ত হও---।।
-মাকে মেরে ফেলে আমাকেও বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে--। জানো? মামারা না নিয়ে এলে--সেদিন আমি কোথায়----!!??
-আরু??---হুসসসস। চুপ---। কাঁদে না তো পাগলি?? প্লিজ??
-আমি মাকে খুব মিস করি তাওহীদ। মায়ের কাছে চলে যেতে চাই--। কেন আটকাও আমাকে??
-বলেছি না চুপ?? আর যে লোকটা তোমার মাকে এতোটা কষ্ট দিলো তাকে শাস্তি দিতে চাও না? চাও না তোমার মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়গুলোর বিচার হোক??
-চাই তো----।।
-তবে আমরা দেশে ফিরি?? বাকি ব্যবস্থা আমি করবো--ওকে??
-হুম----।
-এখন একটু শান্ত হও তো বাবা---।
কাঁদতে কাঁদতে তাওহীদের বুকে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে আরিশা। ওকে সিটে শুইয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো তাওহীদ। তার পরীটাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি তো লোকটাকে ভোগ করতেই হবে। আর?? তাওহীদের বাসার সবাই, আরিশার মামা, মামী সবাই চাইছে ওদের বিয়েটা হোক৷ একবার মেয়েটা রাজি হয়ে গেলে পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট থেকে আগলে রাখবে তাওহীদ ওকে। সারাজীবন আগলে রাখবে বুকে করে।
০৩!!
সকালে আরিশার ঘুম ভাঙতেই দেখলো তাওহীদ ওকে বুকে টেনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। মনে হচ্ছে যেন ছেড়ে দিলেই আরিশা কোথাও চলে যাবে। আরিশা তাওহীদের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে চারপাশটা দেখেই আঁতকে উঠলো। এটা তো ওর বাসা না। তাহলে কি রাতে বাসায় ফিরে নি!! আর জায়গাটাই বা কোথায়!! ভয়ে ভয়ে রুমটা দেখলো আরিশা। ওর রুমের মতো করেই সাজানো রুমটা। তবে ওর রুমের সবকিছুই ধবধবে সাদা। আর এই রুমটার সব কিছুতেই উজ্জ্বল খয়েরী রঙ। পার্থক্য শুধু এটুকুই।
আরিশা তাওহীদকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে জাগালো।
-এই? এটা কোথায় এনেছ আমাকে বাড়িতে না নিয়ে??
-আমরা এখন ক্যানবেরাতে পাগলি। সিডনিতে না---।
-মানে!! ক্যানবেরা!! ক্যানবেরায় কখন আসলাম!!
-গতকাল রাতেই। এখন একটু ঘুমাতে দাও---। আজ সারাদিন ঘুরবো--। সন্ধ্যায় ফ্লাইট---।
-তুমি??!?!
তাওহীদ আরিশার একটা হাত ধরে টেনে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর আবার বুকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
-চুপচাপ ঘুমাও--। তুমি বুকে থাকলে শান্তি শান্তি লাগে--।
-আমি কি সত্যিই রাতে একবারও উঠি নি!! একবারও স্বপ্নটা দেখে--!
-আমার বুকে থাকলে কার সাধ্য তোমার ঘুম ভাঙায়!! হুম?? কার সাধ্য আমার সামনে তোমাকে কাঁদায়!!?
-কি!!??
-ঘুমাও ঘুমাও!! এতো সকালে বের হয়ে কাজ নেই। ৯ টার আগে গিয়ে কাজও হবে না---।।
-ঠিক আছে।
বহুদিন পর নিশ্চিতে ঘুমালো আরিশা। একবারও বাজে স্বপ্নগুলো তাড়া করে নি। একবারও ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে নি মেয়েটা। তাওহীদ ঘুম বাদ দিয়ে আরিশাকেই দেখছে। কি মায়াভরা মুখ মেয়েটার! সারাদিন দেখেও তাওহীদের যেন মন ভরে না। মেয়েটা কি আসলে কখনোই বুঝবে না এসব! নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে!! তাওহীদ কি একটা ভেবে হাসল। দেশে ফিরুক আগে৷ তারপর পালানো বের করবে সে আরিশার।
নাস্তা করে প্রথমে ক্যানবেরার পার্লামেন্ট হাউজ দেখতে গেল ওরা। পার্লামেন্টের ছাদ থেকে পুরো শহরটা কি অসম্ভব সুন্দর লাগে দেখতে! আর ৮১ মিটার উঁচু ফ্লাগমাস্টটা-পৃথিবীর অন্যতম স্টেইনলেস স্টিলের স্টাকচার-সেটাও খুব কাছ থেকে দেখলো। নিজেরাই পুরো পার্লামেন্টটা ঘুরে দেখেছে ওরা। তারপর গেছে অস্ট্রেলিয়ান ওয়ার মেমোরিয়াল এ। এতো এতো সংগ্রহ সেখানে!! সবকটা মুগ্ধ হয়ে দেখলো ওরা। সেখান থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেন আর অস্ট্রেলিয়ান জু এন্ড এ্যাকুরিয়াম দেখেও অসম্ভব অবাক হয়েছে আরিশা। এতো পশুপাখি-গাছপালা একত্রে কখনো দেখেনি আরিশা। আর রঙিন মাছগুলো!! যেন সমুদ্রের সমস্ত সৌন্দর্যই তুলে আনা হয়েছে এই এ্যাকুরিয়ামে।
তবে এসব সৌন্দর্য তো যেন কিছুই না। সন্ধ্যার দিকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে রাস্তার দুপাশে অসংখ্য ক্যাঙ্গারু দেখে আরিশার বাচ্চাদের মতো খুশি হওয়া দেখে তাওহীদেরও ভালো লাগলো ভিষণ। আরিশা অবাক হয়ে ক্যাঙ্গারুগুলো দেখছে। লেজে ভর দিয়ে কেমন জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে ক্যাঙ্গারুগুলো!! আর তার চেয়েও অবাক করা বিষয় বাচ্চা ক্যাঙ্গারুগুলো মায়ের পেটের থলিতে বসে আছে। ওদের দেখে আরিশার মনে হচ্ছে ওদের চেয়ে সুখী যেন পৃথিবীর আর কেউ নয়!!
সন্ধ্যায় চেকিংয়ের পর প্লেনে এসে বসেছে ওরা। সামনে লম্বা এক জার্নি। অস্ট্রেলিয়া থেকে সোজা বাংলাদেশে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রথমে বিশাল সাইজের প্লেনটায় করে মালেশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর পৌঁছবে ওরা। সেখানে ঘন্টা খানেক যাত্রা বিরতি, ঘুরাঘুরি, খাওয়াদাওয়া। তারপর অন্য এক প্লেনে করে পোঁছবে ঢাকায়। প্রায় পনেরো ষোল ঘন্টার জার্নি। প্লেনে কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বুজে গান শুনছে আরিশা। গানটা শুনে বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে উঠছে বারবার। কেন!?
"Mere dil mein teri dhadkane thi
Mujhko na aayi nazar
Tera ishq mujh mein saans le raha tha
Mujhko hui na khabar
Mere alaawa jaan gaye sab
Mujhpe tu kinna marda ae
Mujhe kaise pata na chala
Ki tu mainu pyaar karda ae
Mujhe kaise pata na chala
Ki mera hi intezaar karda ae
Mere alaawa jaan gaye sab
Mujhpe tu kinna marda ae
Mujhe kaise pata na chala
Ki tu mainu pyaar karda ae
Mujhe kaise pata na chala
Ki mera hi intezaar karda ae
Tere baad tujhko hum dhoondhte hain
Raahon se tera pata puchte hain
Milte hai jo pyaar mein aansu
Rab jaane kyun nahi sookhte hain
Dooriyan yeh teri chhoone lagi to
Jeene se dil mera darda ae
Mujhe kaise pata na chala
Ki tu mainu pyaar karda ae
Mujhe kaise pata na chala
Ki mera hi intezaar karda ae
Haathon mein ab tera haath nahi hai
Lagta laqeerein saath nahi hain
Tere bina dekha hai mehsoos kar ke
Jeene mein ab woh baat nahi hai
Saamne tu hai saamne main hoon
Phir jaane kaisa parda hai
Mujhe kaise pata na chala?
Ki tu mainu pyaar karda ae
Mujhe kaise pata na chala?
Ki mera hi intezaar karda ae
Mere alawa jaan gaye sab
Mujhpe tu kinna marda ae
Mujhe kaise pata na chala
Ki tu mainu pyaar karda ae
Mujhe kaise pata na chala
Ki mera hi intezaar karda aeae."
গানটা শুনতে শুনতে চোখটা একটু লেগে এসেছিল। তাওহীদের ছোঁয়ায় ঘুমটা ভেঙে গেলেও চোখ খুললো না আরিশা। কি করছে দেখতে চাইছে। একটু পর টের পেল তাওহীদ আরিশার মাথাটা নিজের কাঁধের উপর আলতো করে রেখে অন্য হাতে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আধা ঘন্টার মতো পরে তাওহীদ আরিশার হাত বুলাতে বুলাতেই ঘুমিয়ে গেছে। আরিশা মাথাটা তাওহীদের কাঁধে একটু কাত করে তাওহীদের মুখটা দেখছে। দুদিন এতো ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত মুখটা। তার উপরে এতো লম্বা একটা জার্নি। তারপরও নিজের খেয়াল না রেখেও প্রতিটা মূহুর্তে সে আরিশার খেয়াল রাখছে। তাওহীদের ক্লান্ত শান্ত মুখটা দেখে কেন আরিশার চোখদুটো ভরে আসছে পানিতে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
০৪!!
দুপুর বেলা ঢাকায় এসে পৌঁছলো আরিশা আর তাওহীদ। সারাটা পথ তাওহীদের কাঁধে মাথা রেখে ভেবেই গেছে আরিশা। কেন এই ছেলেটা ওর এতো খেয়াল রাখে?? কেন এক দন্ড ওকে একা হতে দেয় না?? তাওহীদ কি আসলেই ওকে ভালোবাসে!! ভালোবাসা শব্দটায় আসলেই কি বিশ্বাস করা যায়!!
ওদের রিসিভ করতে তাওহীদের বাবা মা আর আরিশার মামা মামি এসেছে। আরিশা ছুটে এসে মামা মামি দুজনকেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। তাওহীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরলো মামা মামির সাথে। বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা ছুটে গেছে। যেন কিছু হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে।।
আরিশা নিজেকে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে। মামা মামির তাড়ায় অফিসে জয়েন করেছে। কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। তাওহীদ বিজনেসের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো আরিশাকে বুঝিয়ে দেয়। এই নিয়ে চলছে দুজনের জীবন।
মাস দুয়েক পর।
তাওহীদ আরিশাকে কোথাও একটা নিয়ে এসেছে। বাইরের সাদা কালো স্যুট-কোট পরা মানুষগুলো দেখে বুঝতে পারছে আরিশা। এটা একটা কোর্ট।
-এখানে কেন এনেছ??
-আজকে একটা মামলার ফাইনাল হিয়ারিং হবে----।
-কিসের মামলা!! কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।।
-হুসসস--।। গেলেই বুঝতে পারবা।
কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে আরিশার পায়ের নিচের মাটি সরে যাওয়ার অবস্থা। যে লোকটার শুনানি হচ্ছে তিনি আর কেউ নন-আরিশার বাবা। আরিশার মায়ের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার জন্য এবং নির্যাতন ঘটিত মৃত্যুর জন্য লোকটাকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড আর পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরো ছয়মাস সশ্রম কারাদণ্ড। আর ছয় বছর বয়সী আরিশার মাকে হত্যা করার জন্য এবং তাকে শারীরিক নির্যাতন করার জন্য লোকটার সমস্ত স্তাবর অস্থাবর সম্পত্তি মালিকানা আরিশার নামে হস্তান্তর করার আদেশ জারি করেছে আদালত। বিচার কার্যক্রম শেষ হতেই আরিশা দেখলো লোকটাকে হাতে হাতকড়া পড়িয়ে পুলিশের লোকেরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। লোকটা অনেক কাকুতি মিনতি করছে। কেউ শুনছে না সেই অনুনয়। যেমনটা এতো বছর আগে আরিশার মায়ের সাথে করেছিল আজ তা সুদে আসলে ফিরতে পেয়েছে লোকটা।
বাসায় ফিরে শাওয়ার ছেড়ে কাঁদছে আরিশা। মায়ের উপর হওয়া এতোদিনের অন্যায়ের বিচার হয়েছে। মা যেখানেই থাক না কেন নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে সেটা৷ কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বসে পড়লো। একটু পরে ওয়াশরুমের দরজায় নক হতে হুঁশ হলো আরিশার।
-কে??
-আরু?? ওই মেয়ে বের হও---।।
-তাওহীদ?? তুমি কি করছো আমার রুমে?
-বলেছি না শাওয়ার ছেড়ে কান্নার শখটা বাদ দাও? আবার শুরু করেছ??
-তুমি যাও তো----।।
-তুমি বের হবা?? এতোক্ষণ ভিজলে তো ঠান্ডা ধরে যাবে!!??.
-বললাম না তুমি যাও এখন??
-তুমি বের হবা কিনা----।।
-না না না--।
-আমি কিন্তু এইবার দরজা ভেঙে ঢুকবো বলে দিলাম-----।।
-এতো জ্বালাতন করো কেন!?! আমি শাওয়ার নিচ্ছি না??
-আমিই তো---।
-কি বললা তুমি??
-পাঁচ মিনিট টাইম দিলাম---।। এর মধ্যে বের না হলে-----।।
-উফ----।অসহ্য লোক একটা--। বের হচ্ছি----।।
-গুড গার্ল।।
আরিশা বিরক্ত হয়ে শাওয়ার বন্ধ করে ভিজে কাপড় বদলে একটা সাদা থ্রিপিস জামা পড়ে চুলে টাওয়াল জড়িয়ে রুমে এলো। তাওহীদ রুমে নেই দেখে হাঁফ ছেড়ে চুল মোছায় মন দিল। একটু পরে টের পেল কেউ হাত থেকে টাওয়ালটা নিয়ে নিয়েছে। আর ওর চুলগুলো মুছে দিচ্ছে ভালো করে। ঠিক চুল মোছাও না চুলের বারোটা বাজাচ্ছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে। আরিশা হেসে ফেললো।।
-তুমি আমার চুল মুছে দিচ্ছো? নাকি চুলের চৌদ্দ্টা বাজাচ্ছো??
-তুমি চাইলে প্রতিদিন এভাবে চুলের চৌদ্দটা বাজিয়ে চুলগুলো মুছে দিতে পারি--।
-কি???
-আরু?? বাবা মা এসেছে--। নিচে আসবা একটু??
-হুম- চলো??
-এই ড্রেসটা একটু বদলে নাও না প্লিজ??
-কেন!!?
-তুমি সাদা পড়লে মনে হয় আমি যেন মরে গেছি----।।
-কি সব বলো!! আমার সাদা জামা পড়ার সাথে তোমার------।
-সেটা যদি বুঝতে তাহলে তো এতো কাহিনী করার কিছু ছিলই না---।
-মানে!!?
-চলো না প্লিজ??
-আসছি যাও----।।
-এটা পড়ো পছন্দ হলে----।।
তাওহীদ আরিশাকে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়েই বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আরিশা ব্যাগ থেকে ড্রেসটা বের করে হাতে নিল। নেভি ব্লু কালারের কাতানের থ্রিপিস।। সাদা সুতোর ফুলের কাজ করা। ড্রেসটা এতো পছন্দ হলো যে সেটা পড়েই ড্রইংরুমে আসলো আরিশা। নিচে আসতেই দেখলো তাওহীদের বাবা মা, ওর মামা মামি সবাই হাসিমুখে কথা বলছে। মামি হাত ধরে এনে আরিশাকে সোফায় বসিয়ে দিল। আরিশা হা করে সবাইকে দেখে বুঝার চেষ্টা করেছে কি হচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। তাওহীদের মা আরিশার চুলে হাত বুলিয়ে দোয়া করল। আর মামিও পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
-কি হচ্ছে এসব!!? মামা? মামি!! কিছু বলছ না কেন তোমার??
-তাওহীদের বাবা মার তোকে ভিষণ পছন্দ হয়েছে------।
-আমি বিয়ে করছি না----।। করব না বিয়ে---। তোমাদের সমস্যা হলে বলো আমি অস্ট্রেলিয়া ফিরত যাই--।।
আরিশা ছুটে উপরে রুমে চলে গেল কাঁদতে কাঁদতে। মামি পিছনে যেতে চাইলে তাওহীদ মানা করলো। নিজে আরিশার রুমে এলো। আরিশা বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছে।৷ তাওহীদ বিছানায় বসে আরিশার চুলে হাত বুলালো।
-আরু???
-কেন সবাই মিলে এমন করছো?? আমি বিয়ে করব না--। করব না বিয়ে--। শুনেছ তুমি??
-আচ্ছা পাগলী। কেঁদ না----।।
-বিয়ে নামের ছোট্ট শব্দটাকে ভয় হয় শুনতে। মায়ের পরিণতিটায় আমি ভালোবাসা-সংসার ব্যাপারগুলোর উপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। কেন বুঝতে পার না??
-আরু?? সবাই তো তোমার বাবার মতো নাও হতে পারে---। আমাকে তো তুমি এতোগুলো বছর ধরে চিনো???
-গতকালের পত্রিকাটা পড়েছ?? ছয় বছর প্রেম করে বিয়ে।। আরো ছয় বছরের সংসার। তারপর?? তারপর স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে গিয়ে নিজের হাতে খুন করলো স্ত্রী কে। এই সব খবর প্রতিদিন একটা দুটো পাবে পত্রিকায়-----।।
-আচ্ছা বাবা বুঝসি--। আর কেঁদ না---। আমার ভাগ্যে তুমি নেই। কি আর হবে!!
----------------------
সপ্তাহ খানেক পর।
তাওহীদের অফিসে একটা পার্টি হচ্ছে আজকে। আরিশাকপ নিয়ে এসেছে তাওহীদ। সবসময় তার আরিশাকে পাশে চাই। মেয়েটা কেন বুঝে না!! দুজনে কাউন্টারে টুলে বসে গল্প করছে। এর মধ্যে তাওহীদের ফ্রেন্ড তনয় আর একটা মেয়ে এলো। মেয়েটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল তনয় তাওহীদের।।
-সি ইজ ইউর হিউজ ফ্যান তাওহীদ--। জাস্ট গো--। তোদের কাপল ডান্সের নাম এ্যানাউন্স হইসে--।
-আর ইউ ম্যাড তনয়!!??
-যা তো বাবা--। তোর আরুর কথা ভাবিস না।। আমি আছি।৷ তুই পারফমটা করে আয়----।।
তাওহীদ কিছু বলার আগেই মেয়েটা তাওহীদের হাত টেনে নিয়ে চলে গেল ডান্সফ্লোরে।। তনয় আরিশার দিকে তাকালো।।
-দুজনকে বেশ মানিয়েছে না আরিশা??
-হুম????
-আন্টি বলেছে তুমি যে তাওহীদকে বিয়ে করতে রাজি নও।। ছেলেটা অনেক ভালো বুঝছো? ওরও তো লাইফে হ্যাপি থাকার অধিকার আছে। তাই আন্টি বলেছে যেন ওর জন্য কাউকে দেখি ভালো দেখে।। আর শেষে রাজি করাই বিয়ের জন্য---।। ওফস।। আমার একটা কল এসেছে। সরি আরিশা।। তুমি দুমিনিট বসো।। আমি আসছি---।
তনয় চলে যেতেই আরিশা ডান্স ফ্লোরের দিকে তাকালো। মেয়েটা ইচ্ছে করেই যেন তাওহীদকে জাপটে ধরে ডান্স করছে। দেখেই আরিশা কাউন্টারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।। চোখ দিয়ে বন্যা বয়ে যাচ্ছে আরিশার৷ আর একটার পর একটা ড্রিংকসের শট শেষ করছে।। তাওহীদ এসে দেখলো আরিশা কাউন্টারের টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে। আর ওর সামনে কাউন্টারে পড়ে আছে অনেকগুলো খালি গ্লাস।
০৫!!
সকালের আলো চোখে এসে পড়ায় ঘুমটা ছুটে গেল আরিশার। মাথাটা ভিষণ ভারি ভারি লাগছে। চোখ জোড়া যেন একে অন্যকে জড়িয়ে নিচ্ছে আবেশে। চেষ্টা করেও বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারছে না। এর মধ্যেই দরজায় নকের আওয়াজ শুনে চুপ করে রইলো আরিশা। মনে করার চেষ্টা করছে কি হয়েছে৷ কি হয়েছিল।। দরজা খোলার শব্দে একটু কেঁপে উঠলো। রুমে ও ছাড়াও অন্য কেউ ছিল। কে!! তাওহীদ!! কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে আরিশা। কি হচ্ছে।।
-তাওহীদ?? আরিশার ঘুম ভেঙেছে?
- না মা--। ঘুমাচ্ছে এখনো।।
-তুই এই মেয়েটার পিছনে আর কতো পাগলের মতো ঘুরবি?? যার কাছে তোর নূন্যতম সম্মানটুকুও নেই---।।
-মা যা ভাবছ তা নয়---।
-ওকে এই বাড়িতে কেন এনেছিস??
-আসলে কাল ও ভুল করে ড্রিংকস করে ফেলেছিল--। আর অনেক রাতও হয়ে গেছে তখন----।।
-তো ওই বাড়িতে দিয়ে আসতি---??
-মা কি বলছো?? মামা অসুস্থ। ওর এই অবস্থা দেখলে!! ভুলে গেছো ক'দিন আগেই হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছে-----।।
-ওর লাইফের সব ঝামেলা সামলানোর ঠ্যাকা নিয়ে রেখেছিস তুই??
-মা রেগে যাচ্ছ কেন?? তুমি তো জানো আমি ওকে ভিষণ----।
-আর একটা কথা বলবি থাপ্পড় দিব--। এতো বছর এই মেয়ের জন্য আসিস নি দেশে--। এখন এই মেয়ে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবি না!! কি পেয়েছিস কি তুই??
-মা--। আস্তে বলো--। আরু জেগে যাবে-----।।
-তনয়কে বলেছি মেয়ে দেখার জন্য। তোর পছন্দের আরু যখন তোকে বিয়ে করবেই না-তাহলে তুই আমাদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবি----।।
-আরে?? মা???!!
তাওহীদের মা চলে যেতেই তাওহীদ বিছানার পাশে এসে বসলো। মা খাবার নিয়ে এসেছিল। খাবারের প্লেটটা বেড সাইড টেবিলে রেখে আরিশার চুলে হাত বুলালো। আরিশার চোখের কোণা দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তাওহীদ চুলে হাত বুলাতেই চোখের জলের বন্যা বয়ে গেল।৷ তাওহীদ আরিশার চোখ জোড়া মুছে দিয়ে পায়ের উপর শুইয়ে দিল।।
-এই পাগলিটা?? আরু?? তাকাও?
আরিশা চোখ খুলে উঠে বসলো। তাওহীদ ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। আরিশা মাথা নাড়ল।
-কোথায় এনেছ!!?
-আমাদের বাসায়---।।
-আমাদের??!
-না মানে---। আমার বাসায়--।।
-আমি বাসায় ফিরবো---।
-ফ্রেশ হয়ে এসো--৷ খাইয়ে দিই-। তারপর দিয়ে আসবো--।।
-খাবো না--। আর দিয়ে আসাও লাগবে না--। আমি একাই যেতে পারব---।
-রাতে এতো ড্রিংকস করেছিলে কেন??
-এমনি------------।। মেয়েটা অনেক সুন্দর।। বিয়ে করে ফেলো।।
-তুমি ঐশীর ব্যাপারটা নিয়ে রাগ করেছ, না?? তনয় টা না কি করে!!
-তোমাকে বললাম বিয়ে করে নিতে---।
-ঐশী তনয়ের গার্লফ্রেন্ড আরু--। ওরা তোমাকে রাগানোর জন্য----।।
-মানে!!
-কিছু না।। ফ্রেশ হয়ে এসো?? যাও।
আরিশা হাত মুখ ধুয়ে আসতেই তাওহীদ ওকে খাইয়ে দিল। আরিশা একটু খেয়েই উঠে পড়লো।
-তুমি খাও--। আমি গেলাম।
-আরেকটু খাও না??
-নাহ।। অফিসে যাবো--। ড্রাইভারকে কল করেছি। চলে এসেছে---।
-অফিসে কেন?? আর আমি তো বললাম দিয়ে আসবো--??
-আসছি??
-আরে? আরু?
অফিসে ঢুকতেই কারো কন্ঠ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেল আরিশা।
-হ্যালো ম্যাডাম??
আরিশা আশেপাশে তাকালো। কে বলেছে কথাটা??
-তোমাকে না বলেছি খেয়ে নিবা দিয়া? ------। নো ওয়ে--। তাড়াতাড়ি খাও।। আমার কাজটা কমপ্লিট হয় নি গতকাল---। আরে বাবা--। রাগ কেন করো?? বাবুকে না খাইয়ে রাখবা?? ------।। হ্যাঁ বাবা-- আমি খারাপ--। চুপচাপ খেয়ে নাও।। আর কতটুকু খাচ্ছেন পিক দিবেন---। দরকার হলে ভিডিও করে দিবেন----।ওই?? একদম মাইর দিবো----। আচ্ছা খেয়ো না।। তুমি না খেয়ে থাকো।৷ বাবুও না খেয়ে থাক।। আমিও না খেয়ে থাকি---।। বায়----। খেলে কল দিও।৷ নইলে দিতে হবে না।।যাও।।
ছেলেটা মোবাইলে কথা বলছিল। কল কাটতেই আরিশাকে দেখে থতমত খেয়ে গেল।
-সরি ম্যাম। কাজের সময়----।। আসলে ---।
-আপনার ওয়াইফ??
-জি ম্যাম---।
-বেবি আছে!!??
-আসলে ম্যাম--। এখনো বাবু জন্মায় নি-----।
-ওহ আচ্ছা।। আপনার কাজ কমপ্লিট হয় নি??
-আসলে ম্যাম।। বাকি আছে।। হয়ে যাবে--------।
-আপনার আজকে ছুটি-----।।
-সরি ম্যাম---। ভুল হয়ে গেছে--।
-আরে না না।। ভুল হয় নি।। কাজটা বাকিরা করে নিবে।। আপনি এখন থেকে হাফ টাইম অফিস করবেন।।
-জি??
-জি।। ঘাবড়াবেন না।। বাবু এলে অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিতে ভুলবেন না।।
আরিশা অফিসে সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরলো। তাওহীদকে কল করলো। কল হতেই রিসিভ করলো।।
-তুমি আবার বাসায় চলে গেলে যে??
-এমনি--------।।
-আরু?? একটা কথা বলার ছিল--। আমি অস্ট্রেলিয়া শিফট করছি--। এখানে আর থাকা যাবে না। আজ মা চাপ দিচ্ছে বিয়ের--। কাল বাকিরাও দিলে--------।
-তাওহীদ??
-বলো??
-বাসায় একটা প্রোগ্রামের আয়োজন করে দিতে পারবা-----।
-কবে??
-আজকেই----।
-আজকেই কিসের প্রোগ্রাম!!
-সন্ধ্যায় বাসায় আসো---। তারপর বলছি-।।
তাওহীদ সন্ধ্যায় আরিশার বাসায় এসে জাস্ট হা করে রইলো। বাসাটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ফুল দিয়ে। আরিশা সোনালী পাড়ের লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে বসে আছে। আশেপাশে আর কেউ নেই দেখে তাওহীদ এগিয়ে আরিশার পাশে বসে তাকালো মুখের দিকে।।
-কি গো?? লালপরী?? আজ কি কিছু আছে? মনে পড়ছে না তো আমার।।
-পার্মানেন্টলি তোমার রঙে রাঙাতে চাই নিজেকে।।
-হুম!?
-এখনো কি বিয়ে করে সারাজীবন তোমার বুকে রাখতে চাও!!!
-সেটা তো সবসময় ই চাই পাগলী-।
এক সপ্তাহ পর।।
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। তিনবার 'কবুল' শব্দটা বলতে আরিশার মধ্যে অন্যরকম এক শিহরণ খেলা করে গেছে। আর রেজিস্ট্রিতে সাইন করতে হাতটা কেঁপে উঠেছে একবার। এখন পান পাতা ডিজাইন করা লাল টুকটুকে বেনারসি পড়ে স্টেজে বসে আছে আরিশা। তাওহীদটা কোথায় যেন গেছে৷ এতো ভারি মেকাপ, গয়না, ফুলের সাজে একটু হাঁপিয়ে উঠছিল আরিশা। হঠাৎ আলো নিভে যাওয়ায় সামনে তাকাতেই দেখলো সামনে অন্ধকারে কেউ দাঁড়িয়ে। ছোট্ট একটা আলো জ্বলে উঠতেই দেখলো মানুষটা তাওহীদ। আরিশা ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে?? তাওহীদ হাসল একটু।।
-এই গানটা তোমার জন্য লালপরী।।
"Jaanam Dekh Lo Mit Gayi Dooriyan
Main Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan..
Jaanam Dekh Lo Mit Gayi Dooriyan
Main Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan
Kaisi Sarhadein, Kaisi Majbooriyan
Main Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan Hoon... Yahaan
Tum Chhupa Na Sakogi Main Woh Raaz Hoon
Tum Bhula Na Sakogi Woh Andaaz Hoon
Gunjtaa Hoon Jo Dil Mein To Hairaan Ho Kyon
Main Tumhare Hi Dil Ki To Aawaz Hoon
Sun Sako To Suno Dhadkanon Ki Zaban
Main Yahaan Hoon, Yahaan Hoon,
Yahaan Hoon, Yahaan
Kaisi Sarhadein, Kaisi Majbooriyaan
Main Yahaan Hoon, Yahaan Hoon,
Yahaan Hoon, Yahaan
Main Hi Main Ab Tumhaare Khayaalon Mein Hoon
Main Javaabon Mein Hoon, Main Sawalon Mein Hoon
Main Tumhaare Har Ek Khwaab Mein Hoon Basaa
Main Tumhaari Nazar Ke Ujaalon Mein Hoon
Dekhti Ho Mujhe Dekhti Ho Jahaan
Main Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan
Jaanam Dekh Lo … Yahaan Hoon… Yahaan
Main Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan Hoon, Yahaan"
গানটা শেষ হতেই সবার হাততালির মাঝেই তাওহীদ স্টেজে উঠে এলো। আরিশার চোখ থেকে পানি পড়ছিল দেখে তাওহীদ মুছে দিল চোখ জোড়া।আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
-বলেছি না পাগলীটাকে কাঁদতে দিবো না---। এতো দিনের অপেক্ষার পর তোমাকে পেয়েছি বিশ্বাসই হচ্ছে না আরু। সবাইকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আজকে। আমার তুমি-শুধুই আমার তুমি---।।
আরিশা হেসে ফেললো। ছোট্ট একটা হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণে। আর মনের ভিতর থেকে কেউ বলছে।
-আমার তুমি-শুধুই আমার তুমি।।
***(সমাপ্ত)***