অর্ধ চাঁদ

পড়ুন শারমিন আক্তার সাথী'র লেখা একটি অনু গল্প অর্ধ চাঁদ
অর্ধ চাঁদ
অর্ধ চাঁদ

১!!

আমার বি‌য়ের ঊনিশ বছ‌রেও আমার নিজের বল‌তে ‌কো‌নো সংসার হয়‌নি। যৌথ প‌রিবা‌র সে কার‌ণে যে সংসার হয়‌নি তা নয়। কারণ যৌথ প‌রিবা‌রে থাক‌লেও অনে‌কে নি‌জের মত সব গু‌ছি‌য়ে নেয়। সুন্দর ক‌রে সব সাজায়। আমার বেশ কিছু বোন, বান্ধবী‌ বা প‌রি‌চিত‌দের দেখে‌ছি। তারা যৌথ প‌রিবারে থে‌কেও সুন্দর ভা‌বে সংসার ক‌রে‌ছেন। তা‌দের সংসার হ‌য়ে‌ছে। মূলত এত বছ‌রেও আমার সংসার হয়‌নি আমার শাশু‌ড়ির কার‌ণে। আমার শাশু‌ড়ির ম‌তে তি‌নি যত‌দিন বেঁ‌চে আছেন সংসার তার। তার সংসা‌রে তার মত ক‌রে চলতে হ‌বে। আমি তার মত ক‌রেই চলতাম। ত‌বে ম‌নে ম‌নে সব মে‌য়ে‌দের মত নিজের একটা সংসারের খুব শখ ছিল। যখন আমার কা‌জিন বোনরা, বা বান্ধবীরা বলত সংসা‌রের জন্য এটা সেটা কিন‌ছে, স্বামীর জন্য এটা ওটা রান্না কর‌ছে, এখা‌নে সেখা‌নে ঘুর‌তে গে‌ছে, তখন এক বুক ভারী করা দীর্ঘশ্বাস নেয়া ছাড়া আমি আর কিছুই কর‌তে পারতাম না। অামার বা‌কি জা‌'য়ে‌দেরও বোধ হয় তেমন ম‌নোভাব।

আমরা নি‌জের মত সংসার করা তো দূ‌রে থাক, নি‌জে‌দের পছন্দমতো রান্নাও কর‌তে পা‌রি‌নি। রোজ সকা‌লে শাশু‌ড়ি ঠিক করে দেন বাসায় কি কি রান্না হ‌বে? আমি বছর আঠা‌রো আগে নি‌জে‌দের ম‌তো ক‌রে ক‌দিন রান্না করে‌ছিলাম। যার প্র‌তিউত্তর হিসা‌বে শাশু‌ড়ি ঘরভ‌র্তি সবার সাম‌নে ব‌লে‌ছি‌লেন,
'এ সংসা‌রে আমার চল‌বে, তোমার নয়। ক‌দিন মনমা‌নি ক‌রে‌ছ, সেটা আমি বি‌বেচনায় মাফ ক‌রে দিলাম। ফের আমার সংসারে নি‌জের মনম‌র্জি চালা‌বে না।'
আমার বরও নিশ্চুপ ছি‌লো। অবশ্য সে বরাবরই মা ভক্ত। সে‌দিনের পর নি‌জের মত ক‌রে আর রান্না করি‌নি কখ‌নো। বি‌য়ের পর পর এক‌দিন এক ভাবি‌কে কথায় কথায় ব‌লে‌ছিলাম সংসারটাতো আমারই। শাশু‌ড়ি মা সে‌দিন তার সামনেই ব‌লে‌ছি‌লেন, সংসারটা এখ‌নো তে‌ামার হয়‌নি। আমি যত‌দিন জী‌বিত থাকব তত‌দিন সংসার শুধু আমার। যখন ম‌রে যা‌বো তখন নি‌জের সংসার নি‌জের ম‌তো ক‌রে গু‌ছি‌য়ে নিও। তারপর থে‌কে নি‌জের সংসার কখ‌নো ব‌লি‌নি। 

এভা‌বেই বছ‌রের পর বছর চল‌তে লাগল। আমার বা‌কি তিন জা আসল। আমি ঘ‌রের বড় বউ, যখন আমি আমার শাশু‌ড়ি‌কে কিছু বলতাম না, তাই তারাও বল‌তে সাহস করত না। সেজ আর ছোট জা যাও মা‌ঝে মা‌ঝে প্র‌তিবাদ করত কিন্তু দেবর‌দের জন্য তা পারত না। শাশু‌ড়ির চার ছে‌লেই খুব বে‌শি প‌রিমা‌নে মাতৃভক্ত। এমন মাতৃভক্ত সন্তান পৃ‌থিবী‌তে খুব কম আছে। তারা মা‌কে সম্মান দি‌তে গি‌য়ে, ভা‌লোবাস‌তে গি‌য়ে ভু‌লেই গি‌য়ে‌ছিল যে স্ত্রীর প্র‌তিও স্বামীর একটা দা‌য়িত্ব আছে। দা‌য়িত্ব আছে ভা‌লোবাসার, দা‌য়িত্ব আছে সম্মান শ্রদ্ধার। 

২!!

যা তা ক‌রে ঊনিশটা বছর তো কা‌টি‌য়ে দিলাম। কিন্তু আমার বিপ‌ত্তি বাঁধল এবার। এত বছর মুখ বু‌জে সব সহ্য কর‌তে পার‌লেও এব‌ার পারলাম না। আমার শাশু‌ড়ি আমার স‌তে‌রো বছ‌রের মে‌য়েটা‌কে বি‌য়ে দেয়ার জন্য উঠে প‌ড়ে লে‌গেছেন। মে‌য়েটা বি‌য়ে কর‌তে একদম নারাজ। অত্যা‌ধিক মেধা‌বি আমার মে‌য়েটা ক্লাস ফাই‌বে, এইটে ট্যা‌লেন্টপু‌লে বৃ‌ত্তি পে‌য়ে‌ছি‌লো। এসএসসি, এইচএসসি তে গো‌ল্ডেন ফাইব পে‌য়ে‌ছে। এখন সে মে‌ডি‌কে‌লের জন্য কো‌চিং কর‌ছে। অথচ আমার এত মেধাবী মেয়েটার ভ‌বিষ্যৎ ন‌ষ্টের জন্য তি‌নি উঠে প‌ড়ে লে‌গে‌ছেন। এবার চুপ থাক‌তে পারলাম না। প্র‌তিবাদী হ‌য়ে উঠলাম।
ক‌ঠিন গলায় বললাম,
'আমার মে‌য়ে‌কে আমি এত তাড়াতা‌ড়ি বি‌য়ে দেব না।'
শাশু‌ড়িও ক‌ঠিন গলায় বল‌লেন,
'তোমার মতামত চায় কে?'
আ‌মি এবার বেশ উঁচু গলায় ক‌ঠিন ক‌রে বললাম,
'মে‌য়ে যখন আমার তখন মতামতও আমারই হ‌বে। আপ‌নি আপনার সন্তা‌দের উপর অধিকার খাটা‌তে পা‌রেন কিন্তু আমার সন্তা‌নের উপর না। আপ‌নি দা‌দি, তাই তা‌কে ভা‌লোবাসা, আর আল্হাদ করা পর্যন্ত আপনার অধিকার। তার জীব‌নের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আপনার নেই। আমি আমার জীব‌নের সকল শখ আল্হাদ বিসর্জন দি‌য়ে‌ছি কিন্তু আমার মেয়ের স্বপ্ন আমি ভাঙ‌তে দিব না। তার জন্য য‌দি আপনার সাম‌নে দাঁড়াতে হয়, আমি র্নিভ‌য়ে দাঁড়াব।'

শাশু‌ড়ি কিছু বলার আগেই আমার স্বামী সবার সাম‌নে বসে আম‌ার গা‌লে চড় ব‌সিয়ে দি‌লেন। তার মা‌য়ের সা‌থে উঁচু গলায় কথা বলার মত দুঃসাহস ক‌রে‌ছি ব‌লে। চড় খে‌য়েও আমি র্নি‌ভি‌কের মত ব‌লেছিল‌াম,
'আমা‌কে মে‌রে ফেল‌লেও আমি আমার সিদ্ধা‌ন্তে অটল থাকব।'
তখন প্রচন্ড রে‌গে শাশু‌ড়ি বল‌লেন,
'তাহ‌লে এ বা‌ড়ি থে‌কে মে‌য়ে নি‌য়ে বে‌ড়ি‌য়ে গি‌য়ে যেখা‌নে খু‌শি দাঁড়াও।'
আ‌মি কো‌নো কিছু না ব‌লে রু‌মে চ‌লে গেলাম। সবাই ভে‌বে‌ছি‌লো আমি হয়‌তো রু‌মে গি‌য়ে কান্না করব। কিন্তু আমি মে‌য়ের আর আমার কাপড় গু‌ছি‌য়ে একহাতে ব্যাগ নি‌য়ে আর অন্য হা‌তে মে‌য়ের হাত ধ‌রে সাম‌নে এসে বললাম,
'এত বছ‌রেও নি‌জের সংসার বল‌তে কিছুই হ‌লো না। যে সংসা‌রে আমার মতাম‌তের কো‌নো গুরুত্ব নেই, যে সংসা‌রে আমার কাজ শুধু রান্নাবান্না আর স্বামীর প্র‌য়োজন মেটা‌নো সেখা‌নে আমি না থাক‌লে তেমন বি‌শেষ ক্ষ‌তি হ‌বে না।'
সবাই আমার এমন রূপ দে‌খে হয়‌তো অনেক অবাক হ‌য়ে‌ছি‌লো। সেই চুপচাপ থাকা ঘ‌রের গৃ‌হিনী কিভা‌বে এমন মুখ ফু‌টে উচ্চবাচ্য কর‌ছে। মে‌য়ের হাত ধ‌রে যখন বের হ‌য়ে আস‌ছিলাম, তখন আমার দুই জা বা‌দে আর কেউই আমা‌দের থামা‌তে আসে‌নি।

৩!!

‌মে‌য়ে নি‌য়ে বাবার বা‌ড়ি আসার পর প্রথ‌তে মা-বাবা, ছোট ভাই-ভা‌বি খু্ব খু‌শি হ‌লেও প‌ড়ে যখন শু‌নল একেবা‌রে শ্বশুর বা‌ড়ি ছে‌ড়ে চ‌লে এসে‌ছি, তখন তা‌দের চো‌খে মু‌খে চিন্তার ভাব ফু‌টে উঠল। আমি মা‌য়ের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বললাম,
'সোনালীর মে‌ডি‌কে‌লে ভ‌র্তি পরীক্ষাটা শেষ হ‌তে দাও, তত‌দি‌নে আমি চাক‌রির একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। তারপর এখা‌নে আর থাকব না।'
ছোট ভাই বলল, 
'আপা তোর চাক‌রির কী দরকার? আমি আছি তো। এটা তোরও বা‌ড়ি। তুই এখা‌নেই থাক। কোথাও  যে‌তে হ‌বে না। ভাই‌য়ের বউ‌য়ের চো‌খে না বির‌ক্তি দেখলাম না তেমন খু‌শি। বুঝ‌তে পারলাম না তার ম‌নের ভাবনা! অবশ্য তার বির‌ক্তি হওয়াও আমি তেমন অবাক হতাম না। কারণ নিজ সংসা‌রে উট‌কো ঝা‌মেলা কেউই পছন্দ করে না। ভাই‌কে বললাম,
'না‌রে এখা‌নে থাক‌লেও নি‌জের ব্যবস্থা আমি নি‌জেই করব। তুই নাহয় একটু হেল্প ক‌রিস।'

বাবা কিছু বল‌লেন না। তি‌নি সোনা‌লীকে নি‌য়ে ব্যস্ত হ‌য়ে পড়‌লেন। বাবার প্রথম নাতনী সোনা‌লি। বর্তমা‌নে বাবা বোধ হয় সব‌চে‌য়ে বে‌শি ভা‌লো সোনা‌লি‌কে বা‌সেন। তি‌নি সোনা‌লির এখা‌নে থাকায় বরং বে‌শিই খু‌শি হ‌লেন। কিন্তু মা খুব চি‌ন্তিত। মা আমা‌কে বল‌লেন,
'‌বি‌য়ের পরও তো মে‌য়েরা পড়া‌লেখা কর‌তে পা‌রে।'
আ‌মি মা‌য়ের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বললাম,
'মা আমার যখন বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছি‌লো তখন আমি অনার্স সে‌কেন্ড ইয়া‌রে পড়তাম তাও ইং‌রেজী নি‌য়ে। মা তোমার ম‌নে আছে না আমি পড়া‌শোনায় কেমন ছিলাম? এসএস‌সি, এইচএস‌সি তে ফাস্টক্লাস পে‌য়ে‌ছিল‌াম আর অনার্স প্রথম ব‌র্ষেও ফাস্টক্লাস পে‌য়েছিলাম। আমার ভা‌র্সি‌টির স্যাররা তে‌ামার কা‌ছে কত প্রশংসা করত আমার। কিন্তু তোমার কি কর‌লে? ২য় ব‌র্ষের ইন‌কোর্স পরীক্ষার ক‌দিন পরই আমার বি‌য়ে দি‌য়ে দি‌লে। বল‌লে তারা বি‌য়ের পর পড়‌তে দি‌বে। কিন্তু কী হ‌লো? বি‌য়ের পরই আমার শাশু‌ড়ি কড়া গলায় ব‌লে‌ছি‌লেন তার সংসা‌রে থাক‌তে হ‌লে লেখা পড়া বন্ধ কর‌তে হ‌বে। আমার মে‌য়ের কপাল য‌দি আমার মত হয়।'
মা তবুও বল‌লেন,
'সবার প‌রিবার কী এক?'
'হ্যাঁ এক নয় ত‌বে মা বি‌য়ের পর সংসা‌রের চাপে মে‌য়ে‌দের পড়া‌লেখার ইচ্ছা থাক‌লেও রেজাল্ট তেমন ভা‌লো কর‌তে পা‌রে না। তারপর য‌দি আবার একটা বাচ্চা কাচ্চা হয় তখন তো লেখা পড়া শি‌কেয় উঠে। আমি এটা বল‌ছি না বি‌য়ের পর পড়া লেখা হয় না। হয় ত‌বে আগের মত গ‌তি তখন থা‌কে না। আর মে‌ডি‌কে‌লের পড়া তো মু‌খের কথা নয়।'
মা আর কিছু বল‌লেন না।

৪!!

পৃ‌থিবী‌তে কেউ আমা‌কে না বুঝ‌লেও মে‌য়ে বুঝল। সে দিন রাত এক ক‌রে প‌রিশ্রম কর‌তে লাগল। মহান আল্লাহ আমা‌দের দ‌ুজনার ক‌ষ্টের সন্তু‌ষ্টিকর ফল দি‌লেন। মে‌য়ের কষ্ট স্বার্থক হ‌লো। মে‌য়েটা সরকা‌রি হাসপাতা‌লে চান্স পে‌লো। ভ‌র্তির টাকার ব্যবস্থা আমার ভা‌গের জ‌মি বি‌ক্রি ক‌রে হ‌বে। মে‌য়ে মে‌ডিকে‌লে চান্স পাবার কথা শু‌নে মে‌য়ের বাবা আমার শাশু‌ড়ি আর জা'‌য়েরা আমা‌দের বা‌ড়ি‌তে আস‌লেন। এত মা‌সে যারা আমা‌দের একটা খবর নেয়‌নি, তারা এমন প‌রিবারসহ আস‌বে তাও এত এত ফল মি‌ষ্টি নি‌য়ে তা আমার ভাবনার বাই‌রে ছি‌লো। আমার শাশু‌ড়ি সোনালীকে আল্হাদ কর‌তে কর‌তে বল‌লেন,
'আমার রক্ত ব‌লে কথা। ওদের বংশটাই তো সব মেধাবী দি‌য়ে ভর‌া। ওর বাবা, দাদা, চাচারা কম কোথায়! ও মে‌ডি‌কে‌লে চান্স পা‌বে না‌তো কে পা‌বে?'
‌ভে‌বে‌ছিলাম এত মাস পর এসে‌ছে হয়‌তো তার চো‌খে মু‌খে কিছুটা আফসুস দেখ‌বো, আমা‌দের কষ্টা বুঝ‌বে। কিন্তু তার চো‌খে মু‌খে এখ‌নো আগের মতই দম্ভ। তার চো‌খে মু‌খে এমন দম্ভ আর অহংকার দে‌খে আমি বেশ হতাশই হলাম। সোনালী‌কে বলল,
'‌সোনা তোর মা‌কে বল বাবার বা‌ড়ির জ‌মি বি‌ক্রি কর‌তে হ‌বে না। আমার নাত‌নির পড়ার খরচ দেয়ার মতো সামার্থ্য আমার আছে। আমার একটা কেন সব না‌তি নাত‌নিও মে‌ডি‌কে‌লে পড়‌লে তার খরচ চালা‌তে আমার কষ্ট হ‌বে না। তারপর আমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে কড়া গলায় বল‌লেন, অনেক‌দিন বা‌পের বা‌ড়ি বে‌ড়ি‌য়ে‌ছো। এবার নি‌জের বা‌ড়ি চ‌লো। বু‌ড়ো বয়‌সে পুত্রবধূ‌দের ন্যাকা‌মি আমার ভা‌লো লা‌গে না। তোমার বয়স তো কম হ‌লো না। ছে‌লে মে‌য়ে বড় হ‌য়ে‌ছে। এবার ‌থে‌কে যাই কর‌বে তেমন চিন্তা ভাবনা ক‌রে কর‌বে।'

আমার কী বলা উচিত বুঝ‌তে পার‌ছি না। আমি একবার সোনালীর বাবার দি‌কে তাকালাম। চোখ মুখ বসে গে‌ছে লোকটার। কয়‌ মা‌সেই বয়সটা যে‌নো বে‌ড়ে গে‌ছে। আমার দি‌কে একবার তা‌কিয়ে আবার নি‌চের দি‌কে তা‌কি‌য়ে রই‌লেন। আ‌মিও আর তার দি‌কে তাকালাম না।

বাবা-মা, ছোট ভাই-ভা‌বি তা‌দের আপ্যায়‌নে লেগে গেলেন। আমি রান্না কর‌ছি আর ভাব‌ছি বা‌ড়ি ফি‌রে যাব কী না? অনেকটা দোটনায় প‌ড়ে গে‌ছি। মা বল‌লেন,
'সুমনা এবার বা‌ড়ি যা। একসা‌থে সংসার কর‌তে হ‌লে এমন খু‌টিনা‌টি হয় তা ব‌লে কী সংসার ছা‌ড়ে কেউ?'
আ‌মি বিরস গলায় বললাম,
'মা আমার সংসার বলতে তো কিছু নেই। ওখা‌নে আমি শুধু সংসা‌রের সদস্য একজন। সংসা‌র তো আমার নয়।'

‌কোথা থে‌কে শাশু‌ড়ি এসে বল‌লেন,
'সংসা‌রের সদস্য বা‌ইরের কেউ হয় না। বরং সব‌চে‌য়ে কা‌ছের লোক যারা প‌রিবা‌রের ম‌ধ্যের, যারা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যারা আপন, একসা‌থে থা‌কে তারাই সংসা‌রের সদস্য। তু‌মি য‌দি নি‌জে‌কে সংসা‌রের সদস্য মনে ক‌রো তাহ‌লে তোমার বোঝা উচিত তু‌মি আমা‌দের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। রাগ ক‌রে মানুষ প্রিয়জন‌দের দু একটা কটু কথা ব‌লে, তারমা‌নে এই নয় যে, সে ঘর বা‌ড়ি ছে‌ড়ে চ‌লে যা‌বে। জল‌দি ব্যাগ পত্র গোছাও বা‌ড়ি যা‌বে। আমি বেঁ‌চে থাক‌তে সংসার কখ‌নোই তোমা‌দের হ‌বে না। ত‌বে আমার সংসা‌রের তোমরা প্র‌তি‌টি সদস্য আমার ছে‌লে, ছে‌লের বউ‌রা, না‌তি নাত‌নিরা, প্র‌ত্যে‌কে আমার কা‌ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবং এখান থে‌কে একজনও কমে গে‌লে আমার চল‌বে না। আমি চাই সবাই আমার সংসা‌রে আমার চো‌খের সাম‌নে ঘুরঘুর করুক, আমার কথামত চলুক। আমি দেখব, আমার চোখ তৃপ্ত হ‌বে। কিন্তু সংসার আমার থাক‌বে।
অামার ছে‌লের দি‌কে তা‌কি‌য়ে‌ছো একবার? কেমন শু‌কি‌য়ে গে‌ছে। তু‌মি চ‌লে আসার পর সবার সা‌থে স্বাভা‌বিক ভা‌বে চল‌লেও ও ভেত‌রে ভেত‌রে খুব ক‌ষ্টে আছে। ও হয়‌তো তোমা‌কে নিজের মনের কথা বল‌তে পা‌রে না, অনেকটা গাধা, কাঠ‌খোট্ট টাইপ মানুষ। কিন্তু তোমা‌কে ভীষণ ভা‌লোবা‌সে, কিন্তু সেটা সে বোঝা‌তে পা‌রে না। সে‌দিন রাগ ক‌রে তোমার গা‌য়ে হাত তু‌লে‌ছি‌লো। নয়ত এত বছ‌রে কখ‌নো এমন ক‌রে‌ছে? তাছাড়া তু‌মি ভুল ছি‌লে না, আবার কিছুটা ভ‌ুলও ছি‌লে কারণ তু‌মি তোমার মতামত তখন না ব‌লে প‌রে ঠান্ডা মাথায় বল‌লে পার‌তে। সবার মা‌ঝে মাথা গরম ক‌রে বলার কী দরকার ছি‌লো? মে‌য়েদের ধৈর্য্য থাক‌তে হয়।'

আ‌মি কিছু না ব‌লে শাশু‌ড়ির কথা শুন‌ছিলাম। ম‌নে ম‌নে বললাম,
'হ্যাঁ প‌রে কথা বুু‌ঝি‌য়ে বল‌তে পারতাম ত‌বে আমার সে রাগারা‌গির কার‌ণেই আজ‌কে মে‌য়ে মে‌ডি‌কে‌লে চান্স পে‌য়ে‌ছে। ত‌বে আমি আমার মু‌খের ভা‌বে, শাশু‌ড়ি‌কে বুঝ‌তে দিলাম না যে, আমি ম‌নে ম‌নে বা‌ড়ি যাওয়ার জন্য তৈরী হ‌য়ে‌ছি।'
'শাশু‌ড়ি আবার বল‌লেন একজন নারী নি‌জের খুব য‌ত্নে গড়া সংসার সহ‌জে কাউকে দি‌তে পারে না, দি‌তে চায়ও না। তোমারও তো ছেলে আছে। তার বি‌য়ে হবার পর বুঝ‌বে।'

‌সোনালী কাপড় ব্যা‌গে ভর‌ছে। আমার ছে‌লেটা আমা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে রে‌খে‌ছে। কে বল‌বে এ ছে‌লের বয়স প‌নেরো বছর। সে‌দিন রা‌গের মাথ‌ায় মে‌য়েকে নি‌য়ে চ‌লে এসে‌ছিলাম। প‌রে ভাবলাম ছে‌লেটা‌কেও নি‌য়ে আসা উচিত ছি‌লো। কিন্তু রোজ ফো‌নে ছে‌লের সা‌থে কথা হলেও ওকে না দে‌খে মনটা তৃপ্ত হ‌চ্ছিল না। ওর স্কু‌লে গি‌য়ে দে‌খে এসে‌ছিলাম ক‌য়েকবার। সোনালীর বাবা খা‌টের কোনায় চুপচাপ ব‌সে আছে। অপরাধী ভ‌ঙ্গি‌তে মাথা নিচু ক‌রে রে‌খেছেন। সোনালী ব্যাগ গোছা‌তে গোছা‌তে বলল,

'মা বাবা কিন্তু তোমা‌কে স‌রি ব‌লেছে আমরা চ‌লে আসার ক‌দিন পরই। আমি খা‌নিক অবাক হ‌য়ে মে‌য়ের দি‌কে তাকালাম। মে‌য়ে মুচ‌কি হে‌সে বলল, আস‌লে মা তোমার সা‌থে চ‌লে আসার প‌রের দিনই বাবা ফোন করে আমার সাথে কথা বলেন। লজ্জায় তোমার সাম‌নে আস‌তে পা‌রে‌নি। আমার সা‌থে প্রায়ই দেখা করত। কো‌চিং ফি আমি তোমা‌কে দুই হাজার টাকা বল‌লেও প্র‌তি মা‌নে ফি ছি‌লো সাত হাজার ক‌রে। বাবা বা‌কি টাকাটা দিত। আমি যে তোমা‌কে ব‌লে‌ছিলাম, পড়াশোনায় ভা‌লো ব‌লে, স্যার আমা‌কে আমার প্র‌য়োজনীয় বই গিফ্ট ক‌রে‌ছেন তাও মিথ্যা বাবাই সব বই কি‌নে দি‌য়ে‌ছি‌লেন। তু‌মি আমা‌কে বক‌বে না, যা বকার বাবা‌কে ব‌লো। আমা‌কে এরকম কর‌তে বাবা ব‌লে‌ছি‌লেন।'
আ‌মি ভদ্র‌লো‌কের দি‌কে আবার তাকালাম। তখনও তি‌নি অপরাধী ভ‌ঙ্গি‌তে নি‌চের দি‌কে তাকিয়ে ছি‌লেন। 

৫!!

‌কে‌টে গে‌ছে দশ‌টি বছর।
সোনালী আলহামদু‌লিল্লাহ গাই‌নো‌ক্লো‌জিস্ট হিসা‌বে প্রাক‌টিস কর‌ছে। এম‌বি‌বিএস শেষ হবার পর নি‌জের পছ‌ন্দের ছে‌লে‌কে বি‌য়ে ক‌রেছে।বি‌য়ের পরই বা‌কি প‌ড়া‌লেখা করে‌ছে, এখ‌নো কর‌ছে। আমার ছে‌লে সুমনেরও বি‌য়ে হ‌য়েছে। ত‌বে ইদা‌নিং আমার মন মান‌সিকতা অনেকটা আমার শাশু‌ড়ির মত হ‌চ্ছে। ছে‌লের বউ‌য়ের হা‌তে সংসার ছাড়‌তে কেন জা‌নি খারাপ লাগ‌ছে। নি‌জের এমন ক‌রে সাজা‌নো সব কিছু অন্য মে‌য়ের হা‌তে দি‌য়ে দিব? হোক সে মে‌য়ের মত পুত্রবধূ। হুট ক‌রে শাশু‌ড়ির বলা কথাগু‌লো ম‌নে পড়ল। এক‌দিন তু‌মিও শাশু‌ড়ি হ‌বে। শাশু‌ড়ি মারা যাবার কিছু‌দিন আগে এক রা‌তে সবাইকে তার রু‌মে ডাক‌লেন। তারপর বল‌লেন,
'‌তোমরা কী জা‌নো আমি এত বছ‌রেও কেন সংসা‌রের হাল ছা‌ড়িনি? আস‌লে আমার বি‌য়ে ক‌দিন পরই আমার শাশু‌ড়ি মারা যান তারপর থে‌কে একা হা‌তে পু‌রো সংসার সামলা‌তে হ‌য়ে‌ছে। সংসার সামলা‌তে গি‌য়ে নি‌জের সব শখ আল্হাদ বিসর্জন দি‌য়ে‌ছি। শখ বল‌তে শুধুই সংসার। তারপর যখন ছে‌লেদের বি‌য়ে হল, তখন প্রথম প্রথম ভাবতাম, নতুন বি‌য়ে ক‌রে‌ছে ওরা নি‌জে‌দের মত সময় কাটাক। স্বামী স্ত্রীর বি‌য়ের পর একে অপর‌কে সময় দেয়া জরু‌রি, যেটা তোদের বাবা আমা‌কে বা আমি তা‌কে দি‌তে পা‌রি‌নি। তাছাড়া এত বছর যাবত নিজ হা‌তে গড়া সংসারটা সহ‌জে হাতছাড়া কর‌তে মন চাইল না।
তারপর এক‌দিন আমার খালা‌তো বোন আমার বা‌ড়ি বেড়া‌তে আসল। তার কাছ থে‌কে শুনলাম বি‌য়ের পর তার ছে‌লেরা যার যার মত আলাদা হ‌য়ে গে‌ছে, আর তা‌কে বছ‌রে তিন মাস তিন মাস ক‌রে ভা‌গে ভা‌গে ছে‌লেদের ঘ‌রে থাক‌তে হয়। আমি ভয় পে‌লে গেলাম। নি‌জে‌র অবস্থান কেমন হ‌বে তা ভে‌বে। তারপর সব‌চে‌য়ে বে‌শি ভয় পেলাম আমার ছে‌লেরা আলাদা হ‌বে, একে অপ‌রের সা‌থে ঝগড়া কর‌বে তা আমি দেখ‌তে পারব না। তো‌দের বাবা‌কে হারা‌নোর পর তোরাই আমার সম্বল। তোরা যদি আমা‌কে নি‌য়ে ভাগাভা‌গি ক‌রিস ত‌বে আমি বাঁচ‌তে পারব না। ভয় পে‌য়ে আমি শক্ত হলাম। ছে‌লে ছে‌লের বউ‌দের উপর নি‌জের প্র‌তিপত্তি বিস্তার কর‌তে লাগলাম। সবাইকে নি‌জের ক‌ন্ট্রো‌লে নি‌তে লাগলাম। কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম সবার একটা জীবন আছে, স্বপ্ন আছে। আমার ছে‌লে এবং তা‌দের বউ‌য়েরাও এর ব্য‌তিক্রম নয়। তা‌দেরও সংসার করার, নি‌জের মত সংসার সাজা‌নোর ইচ্ছা আছে। সব জে‌নে বু‌ঝেও আমি আমার সংসার ছাড়‌তে পা‌রি‌নি। ত‌বে আজ থে‌কে তো‌দের সংসার তো‌দের। এখন তোরা নি‌জে‌দের ম‌তো ক‌রে নিজ নিজ সংসার সাজা‌বি না‌কি এক পা‌তি‌লে খা‌বি তা তো‌দের ইচ্ছা। আমার ভূ‌মিকা এখন শুধু ঘ‌রে মা, শাশু‌ড়ি, আর না‌নি দা‌দি হিসা‌বে। সময় ম‌তো খাবার আর ওষুধ পে‌লেই আমার হ‌বে। 

তার কিছুদিন পরই শাশু‌ড়ি মারা গে‌লেন। ত‌বে আমার শাশু‌ড়ি মৃত্যুর পূ‌র্বের ক‌য়েকটা বছর সব‌চে‌য়ে বে‌শি সময় দি‌য়ে‌ছিল সোনালী‌কে। যে মে‌য়ে‌কে তি‌নি বি‌য়ে ক‌রে যত দ্রুত সম্ভব তাড়া‌তে চাই‌তেন। সে মে‌য়েকেই তি‌নি সব‌চে‌য়ে বে‌শি ভা‌লোবাস‌তে শুরু ক‌রে। সোনালী যখন তা‌কে তার শরীর খারাপের জন্য টুকটাক ওষুধ লি‌খে দিত, তখন তি‌নি খু‌শি‌তে সবাই‌কে তা ব‌লে বেড়া‌তেন। বল‌তেন দে‌খো আমার ডাক্তার নাতনি আছে, আমার আর টাকা খরচ ক‌রে ডাক্তার দেখা‌তে হ‌বে না। 
শাশু‌ড়ি মারা যাবার পর সংসার এক পা‌তি‌লে আর রইল না। সংসার ভাগ হ‌লো, যে যার মতো ক‌রে নিজ নিজ সংসা‌রে ব্যস্ত হ‌য়ে পড়ল। 

এখন আসি আমার ছে‌লের কথায়। একজন মে‌য়ে, স্ত্রী আর ঘ‌রের বউ হিসা‌বে আমার চিন্তা ভাবনা যেমন ছি‌লো কিন্তু শাশু‌ড়ি হবার চিন্তাধারা কেমন যে‌নো পা‌ল্টে গে‌ছে। এখন ম‌নে হয় সংসা‌রের হাল ছাড়‌লে হয়‌তো আমার অবস্থান নড়ব‌ড়ে হ‌য়ে যা‌বে। এখন ম‌নে হ‌চ্ছে শাশু‌ড়ি তার অবস্থা‌নে ভুল ছি‌লো না, আর না ভুল আমি ছিলাম। ভুলটা সম‌য়ের। ভুলটা বয়‌সের। মানুষের চিন্তা সম‌য়ের সা‌থে সা‌থে, বয়সের সা‌থে সা‌থে পাল্টায়। মানু‌ষের চিন্তাধারা ষড়ঋতুর মত প্র‌তি ঋতু‌তে বদলায়।

এ সংসা‌রে আমি প্রথ‌মে চাঁদ ছিলাম ত‌বে অর্ধ চাঁদ। যে সংসা‌রে আলো দিত, ভা‌লোবাসা দিত। বা‌কি অর্ধেক চাঁদ আমার শাশু‌ড়ি ছি‌লেন, যি‌নি সংসার, আর প‌রিবার‌কে আগ‌লে রাখ‌তেন। আমারা দুজন মি‌লে পূর্ণ চাঁদ। বর্তমা‌নে আমি অর্ধ চাঁদ আর আমার পুত্রবধূ বা‌কি অর্ধেক। দুজন মিলে আমরা পূর্ণ চাঁদ।



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন