আশ্রয়

পড়ুন সুলতানা পারভীন'এর লেখা একটি অনু গল্প আশ্রয়
আশ্রয়
আশ্রয়

০১!!

আজ আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। বিশ বছর আগের এই সুন্দর দিনটাকে ক্যামেরাবন্দী করা হয়ে উঠে নি।তখন তো আর হাতে হাতে ক্যামেরা বা স্মার্টফোন ছিল না। তবে বিশ বছর আগের এই দিনটার কথা চিন্তা করলে আজো মনের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে। 
আমার আর মোহনার বিয়েটা হয়েছিল একেবারে খাপছাড়া। কোন অনুষ্ঠান নয়-কোন আত্মীয় স্বজন নেই।একদম কিচ্ছু না।পানসা পানসা টাইপের একটা বিয়ে।। কেবল কাজী অফিসে গিয়ে কোনমতে নামমাত্র বিয়ে যাকে বলে।অথচ এই দিনটার জন্য আমাদের পাঁচ-পাঁচটা বছরের কতো স্বপ্নীল জল্পনা কল্পনা ছিল।হয়ত আরো ছমাস আগে হলেও সবগুলো স্বপ্নই দুটো পরিবার সুন্দরভাবে পূরণ করতেন। তবে তাতে কোন ক্ষোভ নেই আমার। বিয়ের দুষ্টু মিষ্টি আচার অনুষ্ঠানগুলোর চেয়েও যে দামি জিনিসটা আমাদের কাছে ছিল-সেটা হল মহুয়া। আমাদের ছোট্ট মহুয়া।

কোলে মহুয়াকে নিয়ে যখন বিয়ের রেজিস্ট্রিতে আমি আর মোহনা সাইন করছিলাম-তখন কাজি সাহেব আর অন্যদের মুখ হয়েছিল দেখার মতো।। ভাবলে এখনো হাসি পায়। ভাগ্যিস ছবি-টবি নেই-তাহলে আমাদের বিয়ের ছবি দেখে মহুয়ার যে কি হাল হতো কে জানে!!??

আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম মোহনা সুন্দর করে সেজেছে। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হতে লাগল।

-তোমার মেয়ের কান্ড দেখেছ??? এতো সকালে এভাবে সেজেগুজে থাকার মানে আছে বলো তো???
 
মোহনার হাত ধরে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম।

-তোমাকে কিন্তু ভিষণ সুন্দর লাগছে----। 
-বাবা---????আমি কিন্তু কিছু দেখি নাই---।

মহুয়ার কণ্ঠ শুনে ঘুরে ওর দিকে তাকালাম।মহুয়া চোখের সামনে একটা হাত দিয়ে চোখ ঢাকার মতো করে দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটা যে কখন এসেছে টের পাই নি।।মিটি মিটি হাসছে এখন।

-মহুয়া---।তোর জন্য কি আমি একটু প্রেমও করতে পারব না তোর মায়ের সাথে--???
-ওমা!!!!আমি কি করলাম!!! আমি তো তোমাকে নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি দিতে এলাম--।

এবারে খেয়াল করলাম মহুয়ার হাতে সত্যি সত্যিই নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি।

-কি রে---। তোর মাকে বউ সাজিয়ে বসে আছিস--আর এখন আমাকে বর সাজাচ্ছিস--। তোদের কাহিনীটা কি????
-বাবা---। এতোদিনে এই প্রথমবার আমার কোনো আইডিয়া তোমার মহুয়ার পছন্দ হয়েছে----।
-বাঁধন-------???????!!!!!!

আমার হাতে পাজামা-পাঞ্জাবি দিয়ে দাঁত কটমট করতে করতে মহুয়া বাঁধনকে ধরার জন্য ছুটল।

বাঁধন---আমাদের জীবনের আর এক টুকরো খুশির নাম। মহুয়ার দু বছরের ছোট। কিন্তু মহুয়াকে ডাকবে নাম ধরে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। মহুয়া ধরতে পারলে আর রক্ষে থাকে না বেচারার।

কিন্তু বাঁধনের কোন আইডিয়া মহুয়ার পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারছি না।এই দুইটা পুরোপুরি বানরের পর্যায়ের। ফলে এরা কোন আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে-তাও আবার একত্রে কাজ করছে শুনলে মনে হয়-আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবে।
পাগল দুইটার কান্ড কারখানা বোঝার চেষ্টা করছি-হঠাৎ মোহনার দিকে নজর গেল।ভ্রু কুঁচকে কি যে এতো ভেবে যাচ্ছে কে জানে!!!

-এই যে??? ভ্রু কুঁচকে মেকাপটা নষ্ট করো না----। মেয়ে অনেক কষ্ট করে সাজিয়েছে----।
--------------------
-মোহনা??????
-হুঁম???কিছু বলছ????

এবারে আমি ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবনা চিন্তার মুড নিয়ে মোহনার দিকে তাকালাম।

-এভাবে কি দেখো আকাশ???
-কি ভাবছ??
-ভাবছি সেদিন যদি সবাই মিলে----।
-মা-বাবা???তোমরা রেডি না হয়ে কথা বলছ???--বাবা তুমি রেডি হও--। মা তুমি চলো--।চলো----??
-রেডি হয়ে কি হবে???
-তোমাদের জন্য সারপ্রাইজ আছে---।
-তোদের সারপ্রাইজের জন্য তো দেখছি কবে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে---।
-বাবা---???কি আজে বাজে কথা বলো না!!!!মা তুমি চলো তো। বাঁধন তুই বাবার কাছে থাক---। ভুল করেও যেন টাইমের আগে রুম থেকে না বের হতে পারে--। আর মুখ খুলবি তো মাথা ফাটিয়ে দিব--মনে থাকে যেন---।
-তুই যা তো এখন---। তুই মুখ বন্ধ রাখিস----।যা যা---।খালি খালি জ্ঞান দেয়-----।

দুজন দুদিকে গজগজ করতে লাগল।মহুয়া মোহনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।আর বাঁধন রুম লক করে আমাকে অর্ডার করল-"বাবা রেডি হও---।"

আমিও আর কি করা!!রেডিই হচ্ছি।।।
আর আজকের দিনে কি কি হতে পারে সেটাই ভেবে যাচ্ছি।

০২!!

রেডি হয়ে কতোক্ষণ রুমে বসে ছিলাম খেয়াল নেই। প্রায় দুঘণ্টা তো হবেই। এর মধ্যে মহুয়া খাবার দিয়ে গেল। খাবার খেয়ে ভেবেছিলাম রুম থেকে বের হতে পারব-তা আর হল কই!! বিবাহ-বার্ষিকীর এই দিনে গৃহবন্দী করে রাখার কোন মানে আছে???!!!

বসে বসে বিরক্ত লাগছিল।কি ভেবে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।। অনেকগুলো ফুলের গাছ।। ফুলের গন্ধে সারা বারান্দা মো-মো করছে।।ফুল দেখে খেয়াল হল-প্রতিবছর এই দিনটাতে মোহনা গাছ থেকে ফুল তুলে নিজ হাতে মালা বানায়-আর আমি ওর চুলে সুন্দর করে লাগিয়ে লাগিয়ে দেই।।কিন্তু এইবার একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা!! কোথায় অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিলাম একটু দিনটা ভালো করে সেলিব্রেট করব!!এখন ভেবে আর কি হবে!!!!

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মোহনাকে কল দিলাম।

-হ্যালো--??মোহো???
-হুঁম---।
-কি হচ্ছে কি বলো তো??!!!!!
-আমি কি জানি??!!মহুয়া আমাকে রুম থেকেই বের হতে দিচ্ছে না----।
-আর আমাকে বাঁধনটা----। আসামী আসামী লাগছে----।
-হুঁম----।
-মোহো--মন খারাপ তোমার???
-না--। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব---।
-চলো---। আবার পালিয়ে যাই----।
-তুমি যে কি বলো না?? একবার পালিয়ে পরিবার থেকে এতোগুলো বছরের জন্য আলাদা হয়ে গেলে--আবারও পালানোর কথা ভাবতে পার???!!
-পালাই তো নি মোহো---? ছেড়ে এসেছিলাম।।আর হয়ত সেদিন সব ছেড়েছুড়ে না আসলে---আজকের দিনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো---।
-তাতে কি খুব বেশি কিছু হতো??
-হতো না আবার?? তোমাকে পেয়েছি- মহুয়াকে পেয়েছি--তখন তো পেতাম না--।একটা জীবন অপূর্ণই থেকে যেত---।
- ------------------
-মোহো?? কান্নাকাটি করবে না কিন্তু একদম---।
-আজকের দিনটাতে তুমি পরিবার থেকে একেবারে আলাদা হয়ে গেছো-এটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনা আকাশ----।
-এতো ভেব না---।মা পুরো ব্যাপারটাতে এতো বেশি গন্ডগোল করে দিয়েছিল-একটা রাস্তা বেছে নেওয়া ছাড়া তখন আমার কিছু করার ছিল না---। কারণ ও বাড়িতে থাকতে হলে--মহুয়াকে আমাদের ছাড়তে হতো---।সেটা ভাবতে পারিনি কখনোই----।
-তুমি চাইলেই কিন্তু-----।
-তবে চাইনি----।তোমার কোলে মহুয়াকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম-সেটা আজো ভুলিনি মোহো---। আর ওকে যখন প্রথমবার কোলে নিয়েছিলাম আমি- বাবা হওয়ার আনন্দটা তখনই টের পেয়েছিলাম--। এর পর মহুয়াকে কোথায় কোন অনাথ আশ্রমে ছেড়ে আসার কথা আমি ভাবতেই পারিনি----। 
-কিন্তু তুমি আমাদের জন্য----।
-মোহো---তুমি না বেশি বেশি ভেবে ফেলো---। তোমার ভাবনা চিন্তায় মাঝে মাঝে আমিও নিজেকে গুলিয়ে ফেলি----। মহুয়া শুধু তোমারই মেয়ে?? আমার কেউ না নাকি!!???
- ------------------

-মা----!!!!!!! তোমরা আবার--!!!!এই বাবা!!! তোমার কি ব্যাপার বলো তো?? একটু না দেখে থাকতে পারছ না মাকে??
-না বাবা পারছি না---।তোর একটা বিয়ে দিয়ে দিই তখন বুঝবি তুই পারিস কিনা---।
-আমার বুঝতে হবে না যাও---।
-আহারে আমার মহুমাটা লজ্জা পয়েছে--!!।।
-বাবা!! ভালো হবে না---।
-এবার তোমার ভাই থেকে রেহাই দে মা---।আমি একটু বাইরে যাব---।
-জ্বি না--।আমাদের সারপ্রাইজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা রুমের বাইরেই আসতে পারবে না--।ঘরের বাইরে তো ভুলেই যাও---।
-মহুয়া---!!!!!!

মেয়েটা মোবাইলটা কেটে দিল।এটা কোন কথা হলো!!!কেমন পাজি হচ্ছে দিন দিন। আর ছেলেটা!!!! সে তখন থেকে মোবাইল গুতিয়েই যাচ্ছে। কতরকম ঘুসের লোভ দেখিয়েও কাজ হচ্ছে না। এদের প্লানটা কি আল্লাহ মালুম!!!!!

বাইরে থেকে মনে হচ্ছে অনেক লোকের গলার আওয়াজ পাচ্ছি। পরিচিত কিছু কণ্ঠস্বর। কারা হতে পারে???কেউ কি বাসায় এসেছে??!!

০৩!!

বাইরে কি হচ্ছে সেটা দেখতে যাব কিনা ভাবছি। এমন সময় দরজার বাইরে মহুয়ার গলা শুনলাম।
-বাবা---। তাড়াতাড়ি এসো---। 

কি হচ্ছে দেখতে রুমের বাইরে বের হলাম। সত্যিই ভিষণ অবাক হলাম। বিশটা বছর পর আজ আবার মায়ের মুখটা দেখতে পেলাম। মা বলে জড়িয়ে ধরলাম।যতই রাগ করে ঘর ছেড়ে আসি না কেন চোখের জলেরা বাঁধা মানল না। আমি আর মা-দুজনেই কেঁদে সাগর না হলেও ছোটখাটো একটা পুকুর বানিয়ে ফেলতে পারতাম।তবে সেটা আর হয়ে উঠল না।

ছোট বোনও আমাকে এসে জড়িয়ে ধরল।নন্দিতা-আমার থেকে কম করেও হলেও দশ বছরের ছোট।আমি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম তখন ও বড় জোর ১৩-১৪ বছরের কিশোরী।তাই এতোদিন পরে নন্দিতাকে চিনতেই দু মিনিট লাগল।এর শাস্তিস্বরূপ ও অবশ্য আমাকে শুকনো হাতজোড়া দিয়ে ধুমধাম দু-তিন ঘা লাগিয়ে দিল না। ওর শুকনো হাতগুলোতে পুরু পুরু একটা ভাব এসেছে।চেহারাতেও একটা গিন্নি গিন্নি ভাব এসেছে।

আমি মা আর নন্দিতাকে দেখে যতটা না অবাক হয়েছি-তার চেয়ে কম করে হলেও হাজার গুণ বেশি অবাক হয়েছি দুটো বাচ্চার নন্দিতার পিছন থেকে উকিঁ মারা দেখে। নন্দিতা ঠেলেঠুলে বাচ্চা দুটিকে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।কি সুন্দর হাসি হাসি মুখ দুজনের। ১০-১১ বছরের বড় একটা ছেলে-৮-৯ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। মেয়েটা আমার হাতে ঝাড়া দিতে লাগল।

-তুমি আমাদের মামা হও??!!!

আমি দুই ভাগিনা ভাগনিকে নিয়ে মেতে আছি এমন সময় মোহনাকেও নিয়ে এল মহুয়া।বাচ্চা দুটিও মামি মামি করতে করতে মোহনার দিকে ছুটল। বাঁধন এতোক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে!! এতোক্ষণে বসার ঘরে আসতেই মা বাঁধনে জড়িয়ে ধরে আাবার বিলাপ করলেন অনেকক্ষণ।কিছুক্ষণ গায়ে মাথায় হাত বুলালেন।কিছুক্ষণ পাশে বসিয়ে রাখলেন-পাশ থেকে বেচারাকে কোথাও নড়তেই দিলেন না।।

বারবার একটা কথাই আওড়ালেন:- তুই কতো বড় হয়ে গেছিস ভাই!!!

এতোক্ষণে মহুয়ার দিকে আমার নজর গেল। মেয়েটা একপাশে দাঁড়িয়ে মা আর বাঁধনকে দেখছিল।আমার দিকে চোখ পড়তে মিষ্টি করে একটু হাসল।তবুও আমি তো বাবা-সেই হাসির পিছনে মহুয়ার চোখের ছলছলানি আমার ঠিকই চোখে পড়ল।।।

মেয়েকে তাই কাছে ডাকলাম।

-মহুমা---।ভাই-বোনের সাথে কথা হয়েছে??
-হ্যাঁ বাবা---। তুমি তো নামও জানো না--। ফুপ্পির সাথে তো কথা হয়েছে।রবিন আর মিমের সাথেও কথা হয়েছে---। তাই না বাচ্চা পার্টি???

এবারে রবিন আর মিম মোহনাকে ছেড়ে মহুয়াকে নিয়ে পড়ল।

-মহু আপ্পি----?? 

কতো সহজে মহুয়াটা বাচ্চাগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। মা বোধ হয় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন।তাই বাঁধনকে নিয়ে যেন আরো বেশি করেই আহ্লাদ করতে লাগলেন।।

আমি গিয়ে মোহনার পাশে বসলাম।এই বয়সে একটা দিনের জন্য এতোটা ধকল যথেষ্ট। আর ধকল শরীর নিতে পারবে না। মোহনার তাকাতে খেয়াল করলাম মোহনা মহুয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

-মহুকে এভাবে কি দেখছ??
-আমাদের মেয়েটা কতো বড় হয়ে গেছে-তাই না আকাশ??
-তা বড় তো হবেই----।
-অনেক বড় হয়ে গেছে---।
-ওই---!? এতো তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি না আমি----।মহু পড়ালেখা শেষ করবে-----।তারপর না হয়---।
-আকাশ আমি সে কথা বলছি না---। মেয়েটাকে দেখো-আমাদের বাড়িতে সবাই যখন মহুয়ার বদলে বাঁধনকে আদর করত-মহুয়া কতো কাঁদত--।মা যখন বলত-আমরা মহুয়াকে কুড়িয়ে পেয়েছি--আমার না হয় তোমার কোলে মুখ লুকিয়ে সারারাত ফোঁপাতো--। 
অথচ আজ দেখো--মেয়েটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে আছে--।একেবারে চুপচাপ---।

আমি মোহনাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম।সেটা আর বলা হল না মায়ের একটা কথায়।

-আমি তোদের নিতে এসেছি--।তোরা আজই আমার সাথে যাবি---।
-মা---।তা হয় না--। মহুয়ার ভার্সিটি এখান থেকেই যেতে হবে--।আর বাঁধনও সামনে ভর্তি হবে ভার্সিটিতে----।
-মহুয়া হোস্টেলে থেকে পড়বে--।এ আর এমন কি!!
-তা হয় না মা--।
-তার মানে---। বিশ বছর আগে যার জন্য ঘর ছেড়েছিস--আজ বিশ বছর পরেও তুই তার জন্যই ঘরে ফিরবি না???
-মা---?? কি সব বলো না তুমি--!!
-থাক যাস না--।নন্দিতার তো একটা ছেলে একটা মেয়ে---।
-মা ---মহুয়া আর বাঁধন ও তো---।
-ভেবেছিলাম ছেলের ঘরের নাতিনের বিয়েতে শখ করে আনন্দ করব---।তা আর হল কই??!!
-মা---মহুয়া তো তোমার নাতনি ই???

মা কেমন যেন রেগে নাক সিটকালেন---।

-নাতনি----!!!কে কার নাতনি!!!!!

০৪!!

মায়ের কথাটা শুনে এক ঝটকায় ঘুরে মহুয়াকে দেখার চেষ্টা করলাম। মেয়েটা এক মনে রবিন আর মিমের সাথে খেলছে। একটু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মাকে কিছু বলার জন্য মুখ খুললাম ততক্ষণে মোহনার বাড়ির লোকজনও চলে এসেছে।এতোদিন পরে পরিবারের সবাইকে একসাথে দেখেও মোহনাও খুশি হতে পারল না। আর আমি মনে মনে ভাবছি- আমাদের জন্য দিনটা স্পেশাল বানানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মেয়েটা নিজের জন্যই দিনটাকে ভয়ানক কষ্টের করে তুলেছে।

মোহনার বাড়ির সবাইও খুশি খুশি হয়ে আমার বাড়ির সবার সাথে-নয়ত মোহনার সাথে-নয়ত আমার সাথে-নয়ত বাঁধনের সাথে কথা বলছে বা আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।মহুয়াকে যেন কেউ দেখছেই না। 

মহুয়া অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে বলে মনে হল না।সবাইকে এটা ওটা সার্ভ করছে।কখনো কাজটা একটু রেখে আমার আর মোহনার কিছু লাগবে কিনা খোঁজ নিচ্ছে।আবার রান্নাঘরের দিকে ছুটছে।।কি যে করছে কে জানে!!

দুটো পরিবারের সকলের একসাথে জড়ো হওয়ার রহস্যটা বুঝতে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল। বাঁধন কোথা থেকে জানি একজন বয়স্ক হুজুরকে ধরে নিয়ে এসেছে। অবশ্য ধরে নিয়ে আসে নি। আমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে নতুন করে কাজীর কাজ করার জন্য খবর দিয়ে এনেছে। 

এদিকে এবার মোহনার সাথে লাল-নীল-বেগুনী হতে লাগলাম। মোহনা লজ্জায় লাল হচ্ছে-আর আমি লাল হচ্ছি রাগে। মহুয়া আর বাঁধনটা যে কি করে!!! আমাকে আগে থেকে বললে কি এমন ক্ষতি হতো!!!! এখন তো বিয়ে করব না বলে বেঁকেও বসতে পারব না।। হাজার হোক-এতোটা ভালোবাসি আমি মোহনাকে। তার উপর বউ বলে কথা!! পরে তো আমার ঘরে থাকতে হবে নাকি!!! মোহনার যা জেদ-কি করতে কি করে বসে কেউ জানে না---।।

বিয়েটা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। মহুয়া মোহনার সাথে দুষ্টুমি করছে। আর মোহনা রাগে কটমট করছে। কিন্তু এক ঘর লোকের সামনে কিছু বলতেও পারছে না।। আহা বেচারি!!!

-মা??? তোমার না বিয়ে হয়েছে?? নতুন বউরা বিয়ের পর কত কান্নাকাটি করে--। নাকি মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে তাই----??
-মহুয়া---????!!!!!!

এদিকে বাঁধন আর আমি হেসে কুটিকুটি হচ্ছি।

মা আর নন্দিতা বাচ্চাগুলোকে নিয়ে চলে গেল।মোহনার মা বাবা আর বোন এসেছিল। উনারাও চলে গেলেন। এতোক্ষণে ঘরটা ফাঁকা হয়ে এলো। মহুয়া আর বাঁধন বাঁদরামি করে আমাদের ঘরটা আজ সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। তারপর মোহনার কটমটানি স্বত্বেও আমদের দুজনকেই ঘরে ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিল।

কি আর করা!! রুমে গিয়ে দেখলাম মোহনা রেগে মেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আর আমি ওকে দেখে হাসছি। তাতে হিতে বিপরীত হল।

-আকাশ!!!! তোমার খুব হাসি পাচ্ছে না???
-তোমার মেয়ে কিন্তু তোমাকে ফাটাফাটি করে সাজিয়েছে---।।।
-আকাশ???তোমার মজা লাগছে না??? বের হও--।বের হও ঘর থেকে---।
-কিভাবে বের হব??? দরজা তো বাইর থেকে----।
-যাও---??

আমাকে যেতে বলে বেচারিই রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আমিও কি করব বুঝতে না পেরে বারান্দায় গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম।
বাইরে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো মোহনার মুখে এসে পড়েছে। মুখটাতে মায়া মায়া একটা ভাব আছে মোহনার।

মোহনা মুখ ঘুরিয়ে আমাকে দেখে হাসল। ওর মুখে রাগের ছিটে ফোঁটাও নেই আর।

-ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছ??
-আমার চাঁদটাকে---।
-ওই কোণায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখা যায়???
-আমি আমার চাঁদ দেখি-তুৃমি তোমার আকাশের চাঁদ দেখো।।

ভাবছি মোহনার পাশে দাঁড়িয়ে সারা রাতটা কাটিয়ে কেন সারা দিনটাই কাটিয়ে দিতে পারব।।।

০৫!!

এখন যেভাবে অবাক হয়ে মোহনাকে দেখছি ঠিক তেমনিভাবে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম যেদিন প্রথম দেখেছিলাম।। ভার্সিটির নবীন বরণে ওর সাথে আমার প্রথম দেখা। ওদের নবীনবরণের আয়োজনটা করেছিলাম আমাদের ৩য় বর্ষের ছাত্ররা। আর এই নবীনবরণেই মোহনা নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে এসেছিল। একেবারে ডানাকাটা নীলপরী যাকে বলে আর কি!!!

আমি এতোটাই মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম সারা অনুষ্ঠানটা।বোধ হয় ওইদিনই ব্যাপারটার গুজব আমাদের ডিপার্টমেন্টে ছড়িয়ে যায়।।

যদিও মোহনার ব্যাপারটা মোহ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত-কিন্তু তা আর হল কই। মোহনার প্রতিটা কাজই প্রতিনিয়ত আমাকে ওর দিকে আকৃষ্ট হতে বাধ্য করত।। মিলমিশ স্বভাব-অসাধারণ বাচনভঙ্গি- শান্ত মেজাজ- অখন্ড যুক্তিবাদীতা- আর অসাধারণ একটা দৃষ্টিভঙ্গি।

আর ওর প্রতিটা কাজের অবাক দর্শক আর সাপোর্টার বলেই কিনা কে জানে ওর সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচয়টা হয়ে গেল।পরিচয়-বন্ধুত্ব-সবশেষে ভালোবাসা।

কিভাবে কেমন করে মোহনা যে আমার জীবনের সাথে এতোটা মিশে গেছে নিজেও ভেবে পাই না।।
সকলকে কন্ট্রোল করার অসাধারণ একটা ক্ষমতা মোহনার ছিল।আর বন্ডিংও।। কিভাবে কিভাবে দুটো পরিবারকেই ম্যানেজ করে ফেলল। অথচ ওই সময়টাতে আমার চাকরি বাকরি তো দূরের কথা পড়াই শেষ হয়নি।

বেশ ভালোই কাটছিল সময়টা।
অন্তত মোহনার ফাইনালের আগ পর্যন্ত।।
আমিও ততোদিনে মানানসই একটা চাকরি পেয়ে গেছি।।

এদিকে পরীক্ষায় দিন দিন পড়ার চাপ বাড়ার সাথে সাথে মোহনার শরীরটাও খারাপ হতে থাকে। বাসা থেকে বার বার বারণ স্বত্বেও মেয়েটার পরীক্ষার টেনশন যেন না কমে বেড়েই চলেছে। ফলে যা হবার তাই হল। মোহনা মোটামুটি ভালোভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়ল। যদিও ততোদিনে ফাইনাল এক্সাম শেষ।। বাসা থেকে শেষমেশ জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।। ডাক্তার বললেন:-কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে। বেড়ানোও হবে। আবার মনটাও ফ্রেশ হবে। তাড়াতাড়ি সুস্থও হয়ে উঠবে।।
মোহনা যাবে না যাবে না করেও আমাদের সবার কাছে শেষমেশ হার মানল।

মোহনা বাবা মা আর বোনের সাথে সিলেট ঘুরতে গেল। পাহাড়ি জায়গা-ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া।। থাকার কোন সমস্যা নেই। মোহনার কোন এক দুষ্সম্পর্কের এক আত্মীয় থাকে। তাই চিন্তারও কিছু নেই।।
মাসখানেক অনায়াসেই কাটিয়ে দেয়ার কথা।। 

কথায় বলে- মানুষ যা ভাবে হয় তার উল্টো।।এইবারেও তাই।। মাসখানেকের প্ল্যানিং করে গেলেও আমি ঠিক জানতাম মোহনা একসপ্তার বেশি থাকতে পারবে না।। হলোও তাই।। সাত-আটদিন পর হঠাৎ মোহনার কল এলো একদিন।। গলা শুকনো।। কণ্ঠস্বরে হাসিখুশি ভাবটা নেই। তেমন কিছু না বললেও বেশ বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। তবে ঠিক যে কি হয়েছে সেটাই বুঝলাম না।।

মোহনা বিকেলে বাসায় যেতে বলেছিল।। ছুটির দিন।। কি করব ভেবে সময়ের একটু আগেই বেরিয়ে গেলাম।। এদিক ওদিক ঘুরে তারপর মোহনার বাসায় যাব-এই খেয়ালে।।

মোহনার বাসায় এসে একটু অবাকই হলাম। অন্য সময় আমি যাব জানলে সবাই অপেক্ষা করার মতো করেই বসার ঘরাটাতে বসে থাকত।। এইবার মনে হল বাড়িটা একেবারে নিশ্চুপ। কেমন মনমরা মনমরা ভাব আজকে বাড়িতে।।

আমাকে দেখে মোহনার ছোট বোনটা এল।। অন্যদিনের মতো "দুলাভাই-দুলাভাই" করে পাগল করে দিল না। আমাকে বসতে বলে পাংসু মুখে মোহনাকে ডাকতে রুমে চলে গেল।।মোহনাটা নিজের রুমে থাকত খুবই কম।। আমার কলের অপেক্ষায়ই হোক বা অন্য কোন কারণে-সারাক্ষণ বসার ঘরে ঘুরঘুর করত।। আজ সেটাও একটু অদ্ভুত ঠেকল।। আমি উল্টাপাল্টা কিছু করলাম নাকি!!!মনে তো পড়ছে না।।আসতেও দেরি হয়নি।তাহলে কি হতে পারে!!!??এসব ভাবতে ভাবতে খেয়ালই ছিল না কিছু।।

-কেমন আছো আকাশ??

মোহনার কথায় যখন বাস্তবে ফিরলাম তখন মোহনাকে দেখে যে কতোটা অবিভূত হলাম সে আর কি বলব।।

মোহনার মাতৃমূর্তি!!!!

একদম পিচ্চি একটা বাচ্চা মোহনার কোলে।। বাচ্চাটার বয়স সর্বোচ্চ দু-তিন দিন।।। মাথায় অনেক প্রশ্ন খেলা করছে।। অথচ এর মধ্যেও আমি অবাক হয়ে মোহনার নতুন রূপ দেখছি।।
বাচ্চাটাকে ঠিক করে সামলাতে পারছে না। অথচ কি অপরূপ মানিয়েছে দুজনকে!!!

০৬!!

অনেকক্ষণ অবাক চোখে মোহনাকে দেখার পর কি বলব ভেবে পেলাম না।।

-মোহো---!!তোমাকে একেবারে অসাধারণ লাগছে!!! মনে হচ্ছে এক সপ্তার মধ্যে একেবারে সংসারী মুডে ফিরে এসেছে---।
----------------
-এই মোহো?? কি ভাবো???
-কেমন আছ তুমি??
-এখন একদম ফাটাফাটি রকমের ভালো আছি।।
-এখন ভালো আছ মানে?? কি হয়েছিল তোমার??
-আরে ধুর পাগলি--কিছু হয়নি।। অনেকদিন পরে তোমাকে দেখলাম তো--।তাই একটু বেশি ভালো আছি।এতো তাড়াতাড়ি ফিরলে যে--!! তোমার তো মাসখানেক থাকার কথা??!!
-হুঁম????
-আর বাবুটা কে গো???কি কিউট একটা বেবি--। তোমার কোলে কতো সুন্দর লাগছে------।।।মনে হচ্ছে না----।।।
-এটা আমার বেবি------।
-ওয়াও---!! আমাদের জুনিয়ার মোহো?? হ্যালো বাবা--কেমন আছো??
-আকাশ,আমি সিরিয়াস------।

মোহনার সিরিয়াস শুনে আমিও একটু সিরিয়াস মুখ করে শোনার চেষ্টা করলাম। এই মেয়ের সিরিয়াস মানে সাংঘাতিক সমস্যা।এখন মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। নইলে কপালে দুঃখ আছে।।

-ওমা!!আমি কি ফাইজলামি করছি নাকি!!
-আকাশ ও আমার মেয়ে----।
-বলছি না আমাদের মেয়ে----???

মোহনা রাগি লুক দিল নাকি আমার ছেলেমানুষিতে বিরক্তি লুক দিল ঠিক বুঝলাম না।।

-আচ্ছা বলো--।।আমি চুপ করছি--।
-বলছি যে ও আমার মেয়ে--। মা-বাবার মতো তোমারও যদি এ ব্যাপারে কিছু বলার থাকে----তাই তোমাকে আসতে বলেছি।।।
-এতো ছোট্ট একটা বাচ্চা--!!! কার বাচ্চাটা??ওর মা কোথায়!!
-আমিই ওর মা-বাবা-সব-।।।
-মোহো--। এক সপ্তার মধ্যে একটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে দেয়া যায় না--।।।কোত্থকে এল??এতো ছোট্ট বাচ্চার তো তার মায়ের কাছে থাকা উচিত---।
-সিলেটে----।
-সে তো বুঝতেই পারছি-।।আচ্ছা-সরি--।তুমি বলো।।
-একদিন ভোরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম।একা একা।। সবাই তখনো ঘুম।। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে চা বাগানের দিকে চলে গেছি খেয়াল নেই--।একটা চাপা কান্নার আওয়াজে কাছে গিয়ে দেখি পাতার স্তূপের মধ্যে বাচ্চাটা পড়ে আছে---। যাচ্ছেতাই অবস্থা---।।বাসায় আনার আগে অনেকক্ষণ আশেপাশে খুঁজেছি-কাউকে না পেয়ে শেষে বাসায় নিয়ে আসলাম।মা তো ঘরে ঢুকতেই চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিল।। আমি পাত্তা দিলাম না--। এতো ছোট একটা শিশু--তার উপরে অসুস্থ।। কি হয়েছে সে তো আমি বুঝব না--। মা রাগে গজগজ করতে করতে এসে দেখে তো থ!! মেয়েটার নাকি নিউমোনিয়া হয়েছে---।।।তাই ডাক্তার আঙ্কেলকে খবর পাঠাল বাবা।।
-শুনছি--তারপর???
-ডাক্তার আঙ্কেল যখন গেলেন ততোক্ষণে ওর যায় যায় অবস্থা--। আমি আর মা কেনো মতে ওকে পরিষ্কার কাপড় পড়িয়ে গরম কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছি।।ডাক্তার আঙ্কেল এসে দেখে ওষুধ-ইনজেকশন দিয়ে অনেকটা সামলে নিলেন।।
-এর পরে কি হল??
-ডাক্তার আঙ্কেল বাবাকে বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েটাকে যেন অনাথ আশ্রমে রেখে আসি--।ইশারা ইঙ্গিতে উনি বাবাকে এটাও বুঝিয়ে দিলেন-অনেক মেয়েই আনওয়ান্টেড বেবিগুলোকে এভাবে জন্ম দিয়ে অনাথ আশ্রমগুলোর সামনে ফেলে আসে--। বা অনাথ আশ্রমে রেখে আসে--।আর প্রতি মাসে মাসোহারা পাঠিয়ে দেয়--।।

কথাগুলো বলতে বলতে মোহনার গলাটা ধরে এলো।।

-ওকে আমার কাছে দাও--। আর তুমি বসো তো একটু---।।
-তুমি পারবে না--। পড়ে যাবে ও----।।
-আরে আমি বাচ্চা সামলানোর ওস্তাদ---।।। দাও তো--কিছু হবে না--। তুমি বসে রেস্ট করো---।।

মোহনার সামনে ওস্তাদগিরি ফলাতে গিয়ে টের পেলাম এতো ছোট্ট একটা বাচ্চাকে সামলানো কতটা মুশকিল।।মনে হচ্ছে বাচ্চা না-একটুখানি পানি ধরে আছি-একটু এদিক ওদিক হলেই হাতগলে পড়ে যাবে।। 

তাই একটু সাবধানে আগলে নিলাম।।জীবনে প্রথমবার বাবা হওয়ার অজানা এক আনন্দ অনুভব করলাম।।কি এক প্রশান্তি!!! এতো সুন্দর একটা বাচ্চাকে কেউ রাস্তায় ফেলে যেতে পারে!!!
মোহনার দিকে তাকালাম।। ও মনে হয় ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে আমার দিকে-কখন না বাচ্চাটা আমার হাত ফসকে পড়ে যায়।।বাচ্চা মেয়েটার জন্য সুন্দর একটা নাম মাথায় এলো-"মহুয়া"।।

০৭!!

ছোট্ট মহুয়াকে কোলে নিয়ে প্রথমবার বাবা বাবা একটা অনুভূতি হচ্ছে। মেয়েটা পড়ে যেতে পারে ভেবে মোটামুটি পাথরের মূর্তি হয়ে আছি। আর একটু বড় হলে হয়ত দু-একটা কথা বলার চেষ্টা করা যেত।। মোহনা কি ভাবছে কে জানে?ড্যাবড্যাব করে আমাকে দেখছে।। দেখলে দেখুক।।
কখন যে মোহনার বাবা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে টের পাই নি।। হয়ত মোহনাও টের পায়নি।

-এই মেয়েটাকে একটু বোঝাও আকাশ-অন্তত তোমার কথা যদি একটু শোনে--।

গলা শুনেই এক প্রকার আঁতকে উঠলাম।। ভদ্রলোক এমনিতে অমায়িক।। মোলায়েম কণ্ঠস্বর শুনেছি সবসময়। আজকে তাই কর্কশ কণ্ঠটা আমার আত্মা কাঁপিয়ে দিল।।

কি বোঝাবো নিজেই বুঝলাম না।। মোহনা ততোক্ষণে মহুয়াকে আমার কোল থেকে নিয়ে নিয়েছে। মোহনার বাবা দরজার সামনে থেকে ব্যাপারটা হয়তো দেখতে পাননি।।

-দেখো বাবা-লোকজন এর মধ্যেই কানাঘুসা শুরু করে দিয়েছে। কথাটা তোমার মায়ের কান পর্যন্ত যেতে বেশি দেরি হবে না--। এর পরে কি হবে সেটা এই মেয়েটার ভাবা উচিত নয়??--- তুমিই বলো, তোমার মা আমার কথা শুনবেন নাকি আর দশজনের??

অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ালাম। ব্যাপারটা আমি হয়ত ততো গুরুত্ব দিচ্ছি না। মাও দিবেন না।। কিন্তু মোহনার বাবা আশপাশের মানুষের কথা শুনে শুনে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছেন।।ভাবলাম আমি।। এখন হাঁ-হুঁ করে যাই বাকিটা পরে দেখা যাবে।

আমার চুপ করে থাকা দেখে মোহনার বাবার বোধ হয় সুবিধা হল।তিনি আমাকে বুঝাতে লাগলেন।।কয়েকটা অনাথ আশ্রমে কথা হয়েছে উনার।। মোটামুটি সব জায়গায়ই তাকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে। সবার ধারণা:-টাকা দিয়ে বাচ্চাটা ঘাড় থেকে নামাতে চাইছেন।। তবে একটা অনাথ আশ্রম থেকে একটু আশা দিয়েছে। তবে বাচ্চার ছ'মাস হওয়ার আগে সেখানে দেয়া সম্ভব নয়।।অবাঞ্চিত একটা শিশুকে ছয় মাস নিজেদের মাঝে রাখতে হবে-ব্যাপারটা সহজ নয়।। অজানা-অচেনা-নাম পরিচয়হীন একটা বাচ্চাকে আশ্রয় দেয়া সহজ ব্যাপার নয়। আর বাড়িতে যদি বিয়ে উপোযোগী মেয়ে থাকে-তবে তো আশ্রয়ের প্রশ্নই উঠে না।।কিন্তু মেয়েটা যেহেতু বড় ধরনের একটা বোকামি করে বাচ্চাটাকে বোঝা বানিয়ে ঘরে নিয়ে এসেছে-তাকে ছয়টা মাস তো অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। এরপরে হলেও অন্তত ব্যাপারটা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।।

আমি কি বলব বুঝতে না পেরে বোকার মতো মোহনার বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতো সুন্দর একটা বাচ্চা থেকে সবাই মিলে মুক্তি চাচ্ছেন!!বাচ্চাটা কি এতোই বড় বোঝা!!!

-আমি ওকে কোন আশ্রম-টাশ্রমে পাঠাবো না।ও আমার মেয়ে-ও আমার কাছে থাকবে-----------।
-একদম চুপ--। যাও বাচ্চাটাকে মায়ের কাছে রেখে আসো---।যাও-----?আর এইটাকে রেখে এসে আকাশের সাথে কথা বলো----। যাও-----।।

এই প্রথমবার খেয়াল করলাম।। মোহনার চোখে পানি টলমল করছে।।এখনই হয়ত কেঁদে ফেলবে।।আমার চোখে চোখ পড়তে মুখ লুকিয়ে চলে গেল।। মোহনার বাবা গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।। আমি অনপকক্ষণ বসে রইলাম। মোহনা একবারও এলো না আর।।কি করব বুঝতে না পেরে আমিও বাড়ির পথ ধরলাম।।

০৮!!

এর পরে কয়েক মাস মোহনার সাথে আমার আর দেখা হয়নি।মাঝে মাঝে কথা হত-তবে কেমন যেন মন মরা একটা ভাব ছিল ওর মধ্যে। আমি বাড়ি গেলে হয় ওর রুমে ঘুমাচ্ছে-নইলে ছোট্ট মহুয়াকে গোসল করাচ্ছে-খাওয়াচ্ছে-ঘুম পাড়াচ্ছে। শুধু আমার জন্যেই মোহনার সময় নেই। কখনো কখনো ইচ্ছে হতো মোহনাকে বলি চলো মহুয়াকে নিয়ে আমরা দুজনে কোথাও চলে যাই। কিন্তু কেন জানি তা বলা হয়ে উঠেনি।। দূরত্বটা বাড়ছিল আমাদের।তবে ঠিক কি কারণে সেটা বুঝে উঠতে পারিনি।

 অবশ্য মোহনার বদলানোর সাথে সাথে আরো একটা জিনিস বদলে যেতে শুরু হয়েছিল আমার জীবনে।আমার মা।।

প্রথম থেকেই আমার ধারণা ছিল মা খুব খুশি হয়ে মোহনার সাথে সাথে মহুয়াকেও বাড়ি নিয়ে চলে আসবেন-আর সমস্যার ঝটপট একটা সমাধান হয়ে যাবে। দেখা গেল-ঘটল ঠিক উল্টো। মা কিছুতেই ছোট্ট শিশুটিকে মেনে নিলেন না।শুধু যে মেনে নিলেন না তাই নয়-বাচ্চাটাকে অনাথআশ্রমে রেখে শুধু মোহনাকেও মেনে নিবেন না বলে পণ করে বসলেন।।

মোহনাকে আমি বা আমার পরিবার প্রায় বছর পাঁচেক ধরে জানি।তবুও মায়ের যখন দশ জন পাড়া-প্রতিবেশীর আলোচনায় মনে হলো যে বাচ্চাটা মোহনারই-তখন ব্যাপারটা মোটামুটি আমার খালি রাস্তায় ধাক্কা খাওয়ার মতো হলো।।

একে তো মোহনাকে কিছুতেই বুঝাতে পারছি না যে বাচ্চাটাকে আমিও আমাদের সাথে রাখতে চাই-তার উপরে মায়ের আমার জন্য অতিশীঘ্রই পাত্রী দেখা-দুটোয় মিলে পুরো পাগল হওয়ার দশা হলো। মাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলাম। মা কিছুতেই মোহনাকে মেনে নিলেন না-ছোট্ট মহুয়ার কথা তো বাদই দিলাম।।

কিছু বুঝতে পারছিলাম না কি করব।তখন  আমার এক বন্ধু বুদ্ধি দিল :-বিয়েটা আগে করে ফেল-পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। নয়তো মায়ের কথা রাখতে গিয়ে অন্য কাউকেই বিয়ে করতে হবে।।

মহুয়ার বাড়িতেও ওর বিয়ের তোরজোড় চলছে।অনেক সাহস নিয়েই একদিন মোহনার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম।

মহুয়াটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। হামাগুড়ি দিচ্ছে-অবোধ্য কোন একটা ভাষায় নিজের মনেই বকবক করে চলেছে। আজই নাকি মহুয়াকে আশ্রমে দিয়ে আসার কথা। মহুয়ার বাবা ইতস্তত করছেন। হয়ত আমাকে দেখে-নয়ত বাচ্চাটাকে আশ্রমে নিয়ে যেতে হবে তাই। এটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। আমি এসেছি অন্য কাজে।এইসব ব্যাপারে মাথা নাই বা ঘামালাম।

আমি ড্রইংরুমে বসে আছি।মোহনা বাচ্চাটার সাথে যাবে। সুযোগ বুঝে আমিও কথা পাড়লাম।

-আঙ্কেল-আপনার এতো কষ্ট করে যাওয়ার দরকার নেই। আমিই মোহনার সাথে যাই।বাড়ি পৌঁছে দিব নাহয় ফেরার সময়---।

ভদ্রলোক যেতে চাচ্ছিলেন না। তাই হয়তো কথাটা তার মনে ধরল।।মোহনার যে এমন একটা গর্হিত কাজ করা উচিত হয় নি এবং আমার মা যে বিয়েটা ভেঙে দিয়ে খুব ভুল কিছু করেন নি তা উনি অনেকবার করে বললেন। এবং আমি যে তবুও আশা ছাড়ি নি তার জন্য অনেকবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। আমিও হুঁম-হ্যাঁ করে গেলাম।।

মোহনাটা কতো দেরি করছে। কি এতো গুছাচ্ছে কে জানে!!আরে বাবা-আমরা তো সব নতুন করে শুরু করব---।। ইস্। মোহনাকে তো কথাটা বলাই হয়নি?! সবার নাকের ডগা দিয়ে মোহনাকে নিয়ে যাচ্ছি। তবে বাচ্চাটাকে কোথাও ছেড়ে আসার জন্য নয়।।

এসব ভাবছিলাম হঠাৎ মোহনাকে দেখে থমকে গেলাম। এতোক্ষণ বোধ হয় ছোট্ট মহুয়াটাকে হারানোর চিন্তায় কান্নাকাটি করছিল।অন্তত চোখ মুখের অবস্থা তো তাই বলছে। অথচ মোহনাকে একেবারে পরীর মতো লাগছে।জলপরী।। চোখ দুটো দেখলেই মনে হয় এখনই বৃষ্টি নামবে ঝরঝর করে।। 

আর মহুয়া?? মহুয়া তো আমার রাজকন্যা!! এতো সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে।।একজন পরীর কোলে ছোট্ট একটা রাজকুমারী।।আমি আবার সব ভুলে ওদের দিকেই হা করে তাকিয়ে রইলাম।।

০৯!!

কতোক্ষণ অবাক হয়ে মোহনা আর মহুয়াকে দেখেছি কে জানে। তবে হুঁশ হলো মোহনার বাবার কথায়। উনি বোধ হয় খেয়াল করেছেন আমি যে চুপ করে গেছি।। আমি সাথে যাবো শুনে মোহনা একেবারে দমে গেল।কিছুক্ষণ 'কেউ যেতে হবে না' বলে জেদ ধরল। কিন্তু আজ আর কেউ শুনল না। সুতরাং মোহনা আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল।আমি যেন নিজেই মানা করে দেই সেই জন্য হয়ত। আজ অবশ্য আমিও মোহনার কথা শুনলাম না।।তাতে ও রেগে গেলেও কিছু করার নেই।।

আমরা বের হবার আগে বাড়ির মেয়েরা ছোট্ট মহুয়াকে কোলে নিলেন-কেউ কেউ কান্নাকাটিও করলেন। কি আশ্চর্য!!যে শিশুকে স্বেচ্ছায় ঘরে রাখা যায় না-তার চলে যাওয়ায়ও মানুষের চোখ ভরে আসে!!

আমি গাড়ি নিয়েই এসেছিলাম।। মোহনা মহুয়াকে সাথে করে গাড়িতে বসল।।জিনিস-পত্র-ব্যাগ-খেলনা-সব গাড়িতে রাখতে রাখতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল।।মহুয়া দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল।।
আমিও সবাইকে বিদায় দিয়ে অজানায় পাড়ি জমালাম।।

গাড়িতে প্রথম মোহনাই মুখ খুলল।গলার স্বরে আঁতকে উঠলাম।।মেয়েটা রেগে মেগে না কোন কান্ড ঘটিয়ে বসে।।

-এসব নাটক করে কি লাভ আকাশ??
-যাব্বাবা!??আমি কি করলাম!??
-তুমি কি করছ তুৃমি জানো না?
-সে তো জানি-।। এতো বকছো কেন??
-তুমি এই পার্কটার সামনে আমাদের নামিয়ে দাও তো--।। আমার আর আমার মেয়ের জন্য কাউকে কোন কষ্ট করতে হবে না----।।
-নামিয়ে দিব মানে কি??আমি তোমাদেরকে সাথে নিয়েই যাচ্ছি....।
-আমি আশ্রমে যাচ্ছি না আকাশ----।
-সে তো আমিও নিচ্ছি না----।
-তো কোথায় যাচ্ছি আমরা???
-মহুয়া---মাকে বলো তো চুপ করে থাকতে---।।এতো কথা বললে গাড়ি চালানো যায়?!
-------তুমি কার সাথে কথা বলছ??
-এই যে আমার ছোট্ট রাজকুমারীটার সাথে------।।
-আকাশ তুমি বুঝতে পারছ না--তোমার মা কখনো আমাদের মেনে নিবেন না--।।
-মামণি-।।মায়ের কথা শুনো না তো--...। খালি আজে বাজে চিন্তা করে----।।। এই তো---বাবা একটটু পরে কোলে করছি কেমন--???
-আকাশ কি শুরু করেছ বলো তো??আমি তোমার সাথে কথা বলছি---।।

গাড়িটা ব্রেক করলাম।। সিট বেল্টটা খুলে মহুয়াকে কোলে নিলাম।

-জ্বি ম্যাডাম এবার বলুন?
-কি করছ তুমি আকাশ???

মোহনা মাথা নিচু করে নিয়েছিল। আমি মোহনার মুখটা একটু তুলে এক হাতে ভিজে চোখ দুটো মুছে দিলাম।

-আমি কিছুই করছি না মোহো--।।আমার পরীটা-আর রাজকুমারীটাকে ছাড়া আমি আর থাকতে পারছি না---।।
-আকাশ---??
-সারাদিন কান্নাকাটিই করবে??বিয়েটা সেরে মহুয়ার জন্য একটা দোলনা কিনতে হবে--।।।ঘর-টর গুছাতে হবে--।। অনেক কাজ বাকি---।।

মোহনা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইল।।

-কেন করছ এসব আকাশ???

আমি মোহনার কপালে হালকা ঠোঁট ছোঁয়ালাম।

-তোমাদের দুজনকেই খুব ভালোবাসি তাই।। 

বিয়েটা শেষ করে আমরা সত্যি সত্যি ছোট্ট একটা দোলনা কিনতে গিয়েছিলাম।। দোলনায় দোল খেতে খেতে মহুয়ার সে যে কি হাসি!!

১০!!

সকালে ঘুম ভাঙতে খেয়াল হলো বারান্দায় দোলনাটায় শুয়ে আছি।। মোহনা গুটিশুটি মেরে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে।। বিশ বছর আগের দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি তার খেয়ালই নেই।।
বোধহয় আমার নড়াচড়াতেই মোহনার ঘুম ভেঙে গেল।

আজ রুম থেকে বেরিয়ে আরেক কান্ড।।মহুয়া রান্না করছে। আর বাঁধন মহুয়াকে সাহায্য করছে।। আমি আর মোহনা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।। এটা কি হলো?? স্বপ্ন দেখছি না তো??!!নিজেকে চিমটি কেটে হুঁশ হলো।। নাহ-স্বপ্ন দেখছি না।। তবে দুই বাঁদর মিললো কিভাবে??!!!!

নাস্তা করে মহুয়াকে কাছে ডাকলাম।।

-কিরে মহুমা??? এতো আয়োজন?? ব্যাপার কি??
-বাবা-আজ বাসায় মেহমান আসবে--।
-কে আসবে মা??
-তুমি বাঁধনকে জিজ্ঞেস করো--। এই বাঁধন-বাবা ডাকছে----।।

আমি মহুয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রয়েছি।মেয়েটাকে কি এমন জিজ্ঞেস করলাম যে ও লজ্জায় লাল হয়ে গেল!!??
বাঁধনও এসে আমাকে দেখে থতমত খেয়ে গেল।।এদিকে আমি চিন্তা করছি কি হল ব্যাপারটা।।যে ছেলে সারাদিন বাঁদরামি করে বাসার সবার মাথা খারাপ করে রাখে সে নাকি আমাকে দেখে থতমত খাচ্ছে। আর যে মেয়েটা পাগলামি করা শুরু করলে আমরা নিজেরাই মাঝে মধ্যে লজ্জা পেয়ে যাই-সেই মেয়েটা নাকি লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না-কি এমন বললাম যে দুটোর মুখ এতো পাংসু হয়ে গেল!!??

-কিরে-কি হচ্ছে এসব বলনা??
-বাবা---না মানে----।
-কি রে??!!!
-না বাবা-হল কি-আজ আবীর ভাইয়ার মা আসবে বাসায়--।।
-আবীর টা কে??! আর তার মা আসবে--তোদের দুজনের কি হলো তাতে??এমন করছিস কেন??
-না মানে বাবা--।আবীর ভাইয়ের মা আসবে মহু আপুকে দেখতে--।।

চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে কথাটা বলে ফেলল বাঁধন।কি বলল বুঝতে আমার কিছুটা সময় লাগল।যখন বুঝতে পারলাম আজ মহুয়াকে দেখতে আসছে তখন আমি তো থ।মোহনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও হাসছে। গিয়ে আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে মেয়ের সাথে রান্নায় যোগ দিয়েছে।

এবার আমার রাগ হল ভিষণ।এটা কোন কথা হলো?ওরা সবাই সবটা জানে। মাঝখান থেকে নাকি আমিই বাদ পড়ে গেলাম।ধুর।।

কি আর করা! রাগ করে সোফায় এসে বসে রইলাম।বাঁধনটা আমার সামনে ঘুরঘুর করছে।সাহস করে কিছু বলছে না।মহুয়া এসে পাশে বসল।

-বাবা---।

আমি রাগ করে জবাব দিলাম না।কিছু বলবই না।

-এই বাবা---কথা বলো না??
-কি??
-রাগ করছ কেন??
-এমনি।কারো যখন কিছু বলার ইচ্ছে হয়নি-তো এখন বলছে কেন??
-বাবা-শোন না??
-বল না বাবা-শুনছি তো--।
-রাগ করে বললে কিন্তু বলব না---।
-বলিস না-আমার কি??
-ঠিক আছে বলব ই না যাও---।।

মহুয়াটা রাগ করে উঠে যাওয়ার আগে আমি ওকে থামালাম।

-ওরা কখন আসবে রে মহুমা?
-এই তো দুপুরের দিকে।
-মহু-আবীর কে খুব ভালোবাসিস??
-বাবা??

মেয়ে হেসে উঠে চলে গেল।।আমি বসে ভাবছি-মেয়েটা কতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল।মনে হয় এই তো সেদিন প্রথম ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম।

দুপুরে আবীর আর ওর মা মহুয়াকে দেখতে এলো।পছন্দও করল।একটা কথা আমার মনে খচখচ করছিল। মহুয়া আমাদের মেয়ে এটা আমরা যেমন মানি-আমাদের পরিবারের বাকিরা তো মানে না। বিয়েতে যদি এ নিয়ে কোন কথা উঠে তখন??!!আবীর কি আমার মহুয়াটাকে এতোটা ভালোবাসে যতোটা ভালোবাসলে সব কিছু ভুলে একটা নতুন জীবন দেয়া যায়?? এতোটা ভালোবাসে-যতটা ভালোবাসলে ভালোবাসার একটা নতুন আশ্রয় দেয়া যায়??!

ভাবছি বসে বসে।বসার ঘরে আমি একা। সবাই যে যার কাজে গেছে।সামনে তো অনেক কাজ--।।কখন যে আবীর এসেছে আমি টেরই পাই নি--।

-আঙ্কেল,আপনি কি কিছু ভাবছেন?
-না বাবা-বলো?!
-আমাকে বোধ হয় আপনার পছন্দ হয়নি.
-আরে না না--। তেমন কিছু না---।।
-তাহলে বলুন কি ভাবছেন--।।
-একটা কথা বলার ছিল-কিন্তু---।
-আপনি মহুয়ার কথাটা বলতে চাচ্ছেন তো??মহুয়াকে আপনারা মানুষ করেছেন আপনাদের পরিচয়ে-আসলে কিন্তু--।
-মহুয়া আমার মেয়ে--।।
-জানি আঙ্কেল---।।
-খবরদার এসব কথা কখনো ওকে বলবে না--।
-আঙ্কেল আপনি শান্ত হোন--।। আমি মহুয়ার থেকেই কথাটা জেনেছি--।আর মাও জানে।।আর এই ব্যাপারে মার ও কোন সমস্যা নেই--।।।

আমি অবাক চোখে আবীরকে দেখছি। যে কথাটা মহুয়ার কাছে লুকানোর জন্য এতোটা চেষ্টা করেছি-মেয়েটা সেটা জানে। কতোটা কষ্ট পেয়েছে?ও চায়নি আমরা এসব ভেবে কষ্ট পাই-তাই আর জানায়ও নি।।আবীরকে প্রাণ ভরে দোয়া করলাম। সুখী হও বাবা। সুখী হও।।এতো দিনে আমার মহুয়াটা তার সত্যিকারের আশ্রয়টা খুঁজে পেয়েছে। ভালোবাসার আশ্রয়।।



***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন