ভরসা - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - অনু গল্প

পড়ুন মুন্নি আক্তার প্রিয়া'র লেখা একটি সামাজিক অনু গল্প ভরসা
ভরসা
ভরসা by মুন্নি আক্তার প্রিয়া

ক্লান্তি ভঙ্গিতে অযথা নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার পাশের সীটে বসে থাকা ছেলেটি আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। আমি বিরক্ত হয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলাম, ছেলেটি ঘুমে কাতর। ইচ্ছে করছিল দু'চার ঘা দিয়ে জিজ্ঞেস করি,

'বাস কি ঘুমানোর জায়গা?'

কিন্তু সেই ইচ্ছেটাও দমিয়ে নিলাম। কারণ সারাদিন অফিস করে এখন আর আমার কথা বলার মতো কোনো এনার্জি নেই। তবে মনে মনে ভাবছি, ছেলেটার কোনো বদ মতলব নেই তো? চারদিকে অন্ধকার। গাড়ি ছুটছিল তার আপন গতিতে। রাস্তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সোডিয়াম আলোর নিচে গাড়ির সাথে মানুষজনকেও পায়ে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। আমি সাবধানী হয়ে ছেলেটির দিকে তাকালাম। ছেলেটি হাত দুটো জড়ো করে নিজের কোলের ওপর রাখা ব্যাগের ওপর রেখে দিয়েছে। শুধুমাত্র ছেলেটির মাথা আমার কাঁধে ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও স্পর্শ লাগেনি। এমনকি পাশাপাশি বসা সত্ত্বেও হাতে হাত লাগেনি। হয়তো গাড়ির সীটগুলো বড়ো বলেই। যাক, ছেলেটাকে কিছু না বলে মাথাটা ধরে সীটের সাথে হেলিয়ে দিলাম। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তার শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেশি। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় আর যাই হোক, কোনো মানুষের বদমতলব নিশ্চয়ই থাকবে না। কিন্তু কে জানে, থাকতেও পারে। আজকের দুনিয়ায় তো অমানুষগুলোও দেখতে অবিকল মানুষেরই মতোন। আমি যতটা সম্ভব আরো আঁটসাঁট হয়ে জানালার দিকে সরে বসলাম। সাঁইসাঁই করে বাতাস আসছিল জানালা দিয়ে। কিছুক্ষণ আগেই হন্তদন্ত হয়ে ছেলেটি প্রায় লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে চলন্ত বাসে উঠে পড়েছিল। উঠেই সামনে আমার পাশের সীটে বসেছে। মিনিট দশেক জেগেই ছিল। এরপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানি না। যা হোক, আমি তো অপেক্ষা করছি কখন রাস্তা ফুরাবে আর কখন আমি বাড়ি ফিরতে পারব। তবে কিছুক্ষণ বাদেই আমি আবার খেয়াল করলাম, ছেলেটি আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। বিরক্ত হলেও আমি আবারও মাথাটা সোজা করে দিলাম। এভাবে একবার, দু'বার নয়; পরপর চারবার! এবার আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হলাম ছেলেটি তাহলে ইচ্ছে করেই এমন করছে। অসুস্থ শরীরে মানুষের মন এমন নিকৃষ্ট মনোবাসনা করে কী করে? আমিও নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম। এবার ব্যাটাকে ছাড়ব না। অসুস্থ বলে এতক্ষণ ছাড় দিয়েছিলাম তাই বলে, সে কি ভেবেছে আমি তাকে প্রশ্রয় দিয়েছি? সে ভুল। আমি কিছু বলার পূর্বেই ছেলেটির ফোন বেজে ওঠে। ছেলেটি ফোন রিসিভ করে বলল,

'বল।'

ওপাশ থেকে কোনো নারী নাকি পুরুষ কথা বলছে তা আমি জানি না। এমনকি সে কী বলছে তাও আমার জানা নেই। আমি শুধু চুপচাপ বসে ছেলেটির বলা কথাগুলো শুনে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, ওপাশের আগুন্তুকটি ঠিক কী বলতে পারে। ছেলেটি এবার বলল,

'মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছিল, তাই কিছু না বলেই চলে এসেছি।'

'..........'

ছেলেটি এবার হাসার চেষ্টা করে বলল,

'এইটুকু অসুখে কিছু হবে না আপু।'

বুঝলাম ফোনের ওপাশে থাকা আগুন্তকটি ছেলেটির বোন। আবারও ওপাশ থেকে কিছু বলল। এবার ছেলেটির মুখ কেমন যেন কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল। আমি আড়চোখে তাকালেও সরাসরি তাকাতে পারছিলাম না। ছেলেটি বলল,

'তাতে কী হয়েছে? মায়ের কবরটা তো দেখতে পারব?'

ছেলেটি ফোন রেখে কান্না লুকানোর চেষ্টা করল। বাসভর্তি মানুষজন, পাশের সীটে একটা মেয়ে; এদের সম্মুখে কান্নাটা নিশ্চয়ই লজ্জাজনক। আচ্ছা এমন কেন? ছেলেরা কেন কারও সামনে মন খুলে কাঁদতে পারে না? তবে তার শেষ কথাটি শুনে আমার রাগটাগ সব চলে গেছে। উপরন্তু বুকটাতেও কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। যার মা নেই, তার মতো অভাগা দুনিয়াতে আর কেউ আছে নাকি? এসব কথা ভাবতে ভাবতে এবার আমার ফোনটি বেজে ওঠে। মা ফোন করেছে। আমি ফোন কেটে দিয়ে ব্যাক করলাম। ওপাশ থেকে মা উদ্বিগ্নকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

'কতদূর এসেছিস মা? আর কতক্ষণ লাগবে?'

'এইতো মা, প্রায় এসে পড়েছি। বেশি সময় লাগবে না।'

'সাবধানে আসিস কেমন?'

'আচ্ছা।'

'রাখছি তাহলে।'

'মা, শোনো।'

'কী মা?'

আমি হেসে বললাম,

'যেতে যেতে তোমার সাথে একটু গল্প করি?'

ফোনের ওপাশ থেকেই শুনতে পেলাম, মা হাসছে। আসলে চাকরী নেওয়ার পর থেকে আমার চঞ্চলতা একদম কমে গিয়েছে। দু'দণ্ড বসে যে কথা বলব সেই ফুরসতটুকুও তো এখন আমার নেই।
মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনুভব করলাম, ছেলেটি ফের আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। আমাদের অপজিটে বসে থাকা এক আঙ্কেল শুরু থেকেই বিষয়টা খেয়াল করছিলেন। তাই তিনি ছেলেটিকে ডাকার জন্য হাত বাড়াতেই, আমি ইশারায় থামিয়ে দিলাম। খুব আস্তে করে বললাম,

'সমস্যা নেই।'

গাড়ির হর্ণ আর কোলাহলের শব্দে আমার কথাটি শুনতে পেলেন কিনা জানি না। তবে আঙ্কেলটি কেমন যেন মিষ্টি করে একটু হেসে তার পাশে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মহিলাটির দিকে তাকালেন। আমি খেয়াল করে বুঝলাম, ঐ তাকানোটা তৃপ্তির ছিল। বাস গন্তব্যপথে আসার পর আমি ছেলেটির মাথা পূণরায় সীটের সাথে হেলিয়ে দিলাম এবং নামার পূর্বে আঙ্কেলটিকে বললাম,

'একটু খেয়াল রাখবেন আঙ্কেল। ছেলেটির গায়ে ভীষণ জ্বর।'

আঙ্কেলটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। আমি বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, আসলে দিনশেষে প্রতিটা মানুষেরই ভরসা করার জন্য একটা কাঁধ প্রয়োজন হয়। হোক মানুষটা অপরিচিত! তবুও যদি সেই সময়টিতে অপরিচিত কারও থেকে এই ভরসাটুকু পাওয়া যায় কিংবা অপরিচিত কাউকে ভরসাটুকু দেওয়া যায় তবে মন্দ কী?
বাড়িতে ফিরে একসাথে খেতে বসে মাকে পুরো ঘটনাটি বললাম। মা শুনে শুধু একটু হাসলেন। মা না থাকার কষ্টটা আমার মা-ও উপলব্ধি করেছেন এক সময়ে, এটা বলতে বলতেই সে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। আমি তখন হুট করে আবেগের সময়ে অবান্তর একটা প্রশ্ন করে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম,

'আচ্ছা মা, ছেলেটি কি কখনো জানবে সে অপরিচিত একটা মেয়ের কাঁধে অসুস্থ অবস্থায় শান্তিতে মাথা রেখে ঘুমাতে পেরেছিল?'




***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন