অলকানন্দা - পর্ব ২১ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৬১!!

কাকের মতো সরু মুখ, মাথায় গজানো অনেকগুলো হরিণের ন্যায় শিং। সাদাকালো ছবিটায় অদ্ভুত মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট একটা প্রাণী। নখগুলো বড় বড়। নখগুলো লাল, ঠোঁটও লাল। একটা জঙ্গলের ভিতর স্থির হয়ে বসে প্রাণীটা। দেখে মনে হচ্ছে শিকারের জন্য ওৎ পেতে আছে। পূর্ণিমার রাত। প্রাণীটার পিছনে কালো আঁধারে ঢাকা জঙ্গল। আকাশে বৃহদাকার চাঁদ। মাহা একধ্যানে তাকিয়ে ছবিটা দেখছে। গাঁ হঠাৎ শিউরে উঠলো তার। দুতালায় বদ্ধ ঘরটার পাশে দেয়ালে টানানো ছবিটা। নিচে ছোট করে কি যেন লেখা। মাহা কাছে এগিয়ে গেলো পড়তে। 
"ওয়েনডি......

আর পড়তে পারলোনা মাহা। ঘরে ফোন বাজছে। সময়টা বিকেল। দুতালায় আপাতত কেউ নেই। সেসময় মাহাকে ডেকে তুলে বেরিয়েছে সার্থক। মাহার হঠাৎ খেয়ালে এলো সে তো রেজওয়ান কে গুলশান আসতে বলেছিলো বিকালে। রেজওয়ান কে মাহা নিজের বড় ভাই হিসেবে মানে। আপন না হোক ছোট থেকেই অনেক সাহায্য করেছে তাকে। বিয়ের মতো এত বড় একটা সময়ে রেজওয়ান উপস্থিত থাকলে খানিক বল পাবে মাহা, প্রথমে ভেবেছিলো বাইরে দেখা করবে। পরে ভাবলো বিয়েতে তার পক্ষেরও কেউ থাকা দরকার। বাবার মৃত্যুর শোক ভুলানো কঠিন। আশ্চর্যভাবে সার্থক পাশে থাকলে মাহা সব ভুলে যায়। কষ্ট লাঘব হয় তার। তখন মনে এসে ভিড় করে একরাশ লজ্জা। ছবিটার লেখা আর পড়তে পারলোনা সে। এগিয়ে গেলো ঘরের দিকে। কিন্তু তার আগেই ল্যান্ডফোন বেজে থেমে গিয়েছে। নিভার সাথে দেখা করার প্রয়োজনবোধ করলো মাহা। ঠিকানা নেওয়া প্রয়োজন। এই জায়গাটা যে গুলশান তাই জানতোনা সে। সার্থকের মুখে শুনেছে। তাই রেজওয়ান কে বলেছিলো গুলশান আসতে। কিন্তু সকালের পর আর কোনো খবরই ছিলোনা রেজওয়ানের। মাহা ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নামলো। নিভা, সার্থক, মুইংচিন কাউকেই খুঁজে পেলোনা। একজন বৃদ্ধ বয়সী পরিচারিকা রাজকীয় সোফার পাশে রাখা ছোট টেবিল গুছিয়ে রাখছিলেন। তার কাছে এগিয়ে গেলো মাহা। নরম কন্ঠে বললো,
"শুনছেন?"

বৃদ্ধ পরিচারিকা জবাব দিলেন না। তার পরনে একটা কালো ঢোলা পোশাক। একেবারে পা পর্যন্ত। সাদা উড়নাটা মাথায় পেঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। শান্ত, অবিচল তার ভাবভঙ্গি। মাহা পিছন থেকে আবার ডাকলো, 
"আন্টি, একটু প্রয়োজনীয় কথা ছিলো।"

এবারেও বৃদ্ধ মহিলা চুপ। তখনই সদর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো লুবান। মাহার মাথা, চুল সবকিছু লাল উড়না দিয়ে ঢাকা। মাহা জানেনা কেন তবে লুবান কে পছন্দ হয়নি তার। কেমন যেন দৃষ্টি। কিভাবে যেন তাকিয়ে থাকে। এই দৃষ্টিতে মাহা খুঁজে পায় লোলুপ হায়নাদের দৃষ্টি। লুবান কথা বলার সময় বারবার তার বুকের দিকে তাকিয়েছিলো সকালে। ব্যাপারটা তার চোখ এড়ায়নি। কিন্তু সার্থক হাসিমুখে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো বিধায় নিজেও মুখে হাসি রেখেছে। বড়ই অস্বস্তি হচ্ছিলো তার। লুবান মুখে হাসি ফুটিয়ে মাহার দিকে এগিয়ে এলো। বৃদ্ধা ততক্ষণে সে স্থান ত্যাগ করেছেন। বাড়িটা বিশাল বড়। নিচে ড্রয়িং রুমটা বৃহৎ। 
"ভাবীজান? কোনো প্রয়োজন আপনার?"

বলেই ঈষৎ হাসলো লুবান। এমন ডাক শুনে ভড়কে গেলো মাহা। মাথা নিচু করে বললো,
"না।"
"যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে বলবেন ভাবীজান। সার্থক না থাকলেও আমি আছিতো। আপনার সব প্রয়োজন পূরণ করে দিবো। তাছাড়া.... 

লুবানের কথায় ব্যাঘাত ঘটালো নিভা। 
"লুবান ভাইয়া। ঘরে যান। আপনার জন্য একটা পার্সেল আসছে।"
"হুম, যাই।"

লুবান প্রস্থান করার আগে মাহার বুকের দিকটায় আবার তাকালো। গাঁ গুলিয়ে আসছে মাহার। এমন লোকের সাথে এবাড়িতে কি করে থাকবে সে! 

!!৬২!!

"নিভা আপু?"
"জ্বি, ভাবী?"
"উনি কোথায়?"
"কে? সার্থক ভাইয়া?"
"হুম।"

নিভা মুচকি হাসলো। আস্তে করে বললো,
"তোমার উনি কেনাকাটা করতে গিয়েছে। বিয়ের দিনে বউ মানুষ বেনারসি না পরলে বড্ড বেমানান দেখায়। আমি বলেছিলাম কাউকে পাঠাতে। কিন্তু ভাইয়া মানেনি।"

নিভা বয়সে মাহার থেকে অনেক বড়। তাই মাহা তাকে আপু বলেই ডাকে। নিভা ততক্ষণে সোফায় গিয়ে বসেছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই ড্রয়িং রুম। সেখানে রাজকীয় কায়দায় ডিজাইন করা সোফা রাখা। দামী আসবাব, উপরে ঝালরে সজ্জিত অসম্ভব সুন্দর ঘর। নিভা সোফায় বসে নিজের সোনালী চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,

"ভাবী, বসো। একটু গল্প করি।"

মাহা বসলো। 
"আপু, এই জায়গার ঠিকানাটা কি একটু দেওয়া যাবে?"

মাহার কথায় খানিক অবাক হলো নিভা। তৎক্ষনাৎ অবাক ভাব কাটিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
"অবশ্যই দেওয়া যাবে। কোনো প্রয়োজন ছিলো?"

একটু কেমন যেন শুনালো নিভার গলা। 
"না, মানে। আমার একজন পরিচিত আসবেন।"
"সার্থক ভাইয়ার পারমিশন নিয়েছো?"
"মানে?"
"আসলে ভাইয়া বাইরের মানুষ বাড়িতে বেশি একটা এলাউ করেনা।"
"উনি আমার খুবই কাছের একজন বড় ভাই। আমার বিয়েতে আমার পক্ষ থেকেও কেউ একজন থাকা উচিত। তাই আর কি....

মাহার নরম সুর। নিভা মুচকি হেসে বললো,
"এই ভাবী। রাগ করলে। আমি এমনি বলেছি।"

অতঃপর ঠিকানা বললো নিভা। মাহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপরে উঠে এলো। একা থাকার অভ্যাস তার আছে। সেই সাথে অবাধ স্বাধীন মেয়ে মাহা। সার্থকের রুমে প্রবেশ করে রেজওয়ান কে কলো দিলো সে। 
"হ্যালো, হ্যালো মাহা তুমি ঠিক আছো? আমাকে ক্ষমা করো মাহা। তখন আসছি বলেও আসতে পারিনি। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ পড়ে গিয়েছিলো। চিন্তা করোনা মাহা। আমি এখন গুলশান আসছি। যেখানেই থাকোনা কেন! তোমায় আমি উদ্ধার করবো মাহা। আমার বাসায় থাকবে তুমি।"

এক নিশ্বাসে কথাগুলো সারলো রেজওয়ান। মাহা তাকে থামিয়ে বললো,
"বিচলিত হবেন না ভাইয়া। আমি ঠিক আছি। আজ জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি, ভাইয়া। আপনি উপস্থিত থাকলে আমি বল পাবো। আপনাকে ছোট থেকেই বড় ভাই মেনে আসছি।"

রেজওয়ান চিন্তায় পড়ে গেলো খানিকটা। কিসের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত! কি করতে চলেছে মাহা! 
"তুমি কিসের কথা বলছো মাহা?"
"আপনাকে ঠিকানা জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি আসুন ভাইয়া। তারপর না হয় বিস্তারিত বলবো।"
"ঠিক আছে।"

ঠিকানা বলে ফোন কাটতেই ঘরে ঢুকলো সার্থক। গাঁয়ে কালো রঙের শার্ট। ডেনিম প্যান্ট। ঝাঁকড়া চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। গালে হালকা দাঁড়ি। মাহা একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। অবচেতন মস্তিষ্ক না চাইতেও ভাবছে, কেন সার্থক তাকে মেনে নিচ্ছে! কেন তাকে আশ্রয় দিচ্ছে? ওর মতো এতিম, চালচুলোহীন মেয়েকে সার্থকের মতো এতো বড় মাপের একজন প্রতিষ্ঠিত ডক্টর কেন বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাইছে? এটা কি তবে করুণা? শেষ পর্যন্ত মাহা কারো করুণার পাত্রী হলো! শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে মাহার দিকে এগিয়ে এলো সার্থক। শপিং ব্যাগগুলো এগিয়ে দিয়ে বললো,
"বেশি কিছু কিনতে পারিনি। তোমারও মন ভালোনা। এসব ভালোলাগবে না। একটা লাল বেনারসি আর কিছু গহনা এনেছি। কষ্ট করে একটু পরবে? মন না চাইলে দরকার নেই।"

সার্থকের গম্ভীর, ভারী সুরটা নরম, আকুতিভরা ঠেকলো মাহার কানে। 

!!৬৩!!

"ঠিক আছে। কিন্তু আমি শাড়ি পরতে পারিনা।"

হাসি ফুটে উঠলো সার্থকের মুখে। চুলগুলো ডানহাতে পিছনে ঠেলে বললো,
"নিভা পরিয়ে দিবে।"

রাত হয়ে এসেছে। সোফায় বসে আছে রেজওয়ান। এত বড় বাড়িতে মাহা কি করে এসেছে ভেবে পেলোনা রেজওয়ান। কলিং বেল চাপতেই একজন তরুণী সদর দরজা খুলে দিয়েছিলেন। তার পরনে পুলিশ ইউনিফর্ম। তরুণী কিছু না বলেই সরে দাঁড়িয়ে তাকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে। সোফায় বসার কথা বলে কোথায় যেন চলে গেলো। পাঁচ মিনিট যাবত সোফায় বসে আছে সে। 
"জ্বি, আপনি কার সাথে দেখা করতে এসেছেন?"

নিভার প্রশ্নে রেজওয়ান বললো,
"একটু মাহাকে ডেকে দিন।"
"আপনি একটু অপেক্ষা করুন। ভাইয়া, ভাবী আর কিছুক্ষণ পরেই নিচে নামবে।"

কথায় যেন দাম্ভিকতা ফুটে উঠলো। রেজওয়ান চুপ করে বসে আছে। ভাবী মানে! কিসের ভাবী! 

আস্তে আস্তে ড্রয়িং রুমে মানুষ বাড়ছে। রবার্ট, মুইংচিন, লুবান, নিভা, দুইজন পরিচারিকা, তিনজন পুরুষ কাজের লোক। মুইংচিন কিছুক্ষণ আগেই কাজী নিয়ে এসেছে। ঝালরের আলোয় ঝকঝক করছে চারপাশ। রবার্ট, লুবান কুশল বিনিময় করেছে রেজওয়ানের সাথে। সেও করেছে। কিন্তু কিছুই তার চৌকস মস্তিষ্কে ঢুকছেনা। হচ্ছে কি এসব! মোবাইলেও চার্জ নেই। এসব ভাবনার মাঝেই লাল টকটকে শাড়ি পরে হালকা সাজে সার্থকের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো মাহা। রেজওয়ান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন বউ সাজে মাহাকে সে কতরাত স্বপ্ন দেখেছে হিসেব নেই! মাহার হাত ধরে সার্থক হাসিমুখে রেজওয়ানের সামনে এসে দাঁড়ালো। বউ সাজে মাহার পাশে সার্থক কে দেখে অনেক অবাক হয়েছিলো রেজওয়ান। 
"খুব খুশি হয়েছি মিঃ রেজওয়ান । আপনি এসেছেন। মাহার তরফ থেকেও তো কেউ থাকা প্রয়োজন ছিল। আপনি বড় ভাই হয়ে না হয় থাকলেন। কি বলো মাহা?"

মাহা মাথা নিচু করে বললো,
"জ্বি?"

রেজওয়ান অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে। বিয়ে! তাও সার্থকের সাথে! কোনো কিছু বলার সুযোগই পেলোনা সে। চোখের সামনে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেলো। নিজের ভালোবাসার মানুষ কে অন্যের হতে দেখে বুকটায় অসহনীয় ব্যথা করছে রেজওয়ানের। মাহা! যদি তুমি জানতে আমি তোমায় ঠিক কতটা ভালোবাসি! আমি তোমায় পেলাম না মাহা। আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে! উপরে হাসিখুশি দেখালেও ভিতরে ভিতরে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে রেজওয়ান। সার্থকের ঠোঁটে ঈষৎ হাসি।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন