সংসার - পর্ব ১৯ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩৭!! 

-দেখি দেখি দেখি? ওঠো ওঠো ওঠো তো অনু? শরীর খারাপ লাগছে বলে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন সেটা তো মানবো না ম্যাডাম। এই অনু? ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলে তো হবে না ম্যাডাম। উঠো না? হা করো তো দেখি? তারপর আবার ঘুমিয়ো। অনু? আর ঘুমের এক্টিং করে লাভ নেই কিন্তু।

অরণ্য শপিং ব্যাগগুলো আলমারিতে কোনোমতে গাদাগাদি করে ঢুকিয়ে রেখেই বেরিয়ে গেছে। ফিরে এসে অনামিকাকে কয়েকবার ডাকার পরও অনামিকার ওঠার নাম গন্ধ নেই দেখে অরণ্য নিজেই অনামিকাকে টেনে উঠিয়ে বসিয়ে দিল। অরণ্যের দিকে বিরক্তিমাখা চোখে এক নজর তাকিয়ে আবার শুয়ে পড়ার চেষ্টা করতেই অরণ্য অনামিকার একটা হাত চেপে ধরে নিজের সাথে জড়িয়ে বসিয়ে দিল।

-শোনো বউপাখি, না খেয়ে ঘুমানোর কথা ভুলে যাও বুঝলে? যত জলদী প্লেট খালি হবে, তত তাড়াতাড়ি আমিও ছেড়ে দিব ওকে? আরেকবার যদি নাটক করে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করেছ তো সোজা বাথরুমে নিয়ে গিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিব বলে দিলাম অনু সোনা। ওকে?

-খিদে নেই বললাম তো। উফ! ঘুম আসছে আমার। আআআআআ।

অনামিকা আরো কিছু বলার আগেই অরণ্য বেড সাইড টেবিলের ট্রে থেকে প্লেট উঠিয়ে অনামিকার মুখে বড় সড় এক লোকমা খাবার পুরে দিল। অনামিকা বিরক্ত হলে বাকি রেগে গেল সেটা ভাবায় সময় নষ্ট করলো না অরণ্য। অনামিকা বাচ্চা মেয়ের মতো বিরক্তিমাখা কণ্ঠে খাবার মুখে কি বললো সেটাও শোনার চেষ্টা করলো না অরণ্য। 

-অনুপাখি? মুখে খাবার নিয়ে কথা বলতে হয় না সোনা। আগে খাওয়া শেষ করো। তারপর তুমি বকবক করো, আমি সারা রাত জেগে সেসব শুনবো, কেমন? এখন ভাত মুখে নিয়ে কথা বলতে গেলে বিষম খেয়ে কি কান্ড বাঁধিয়ে বসে থাকবে। এতো রিস্ক নিয়ে গল্প করার তো দরকার নেই তাই না?

-আমি তোমার সাথে গল্প করছি? চিটচ্যাট হচ্ছে এখানে? বলছি তো খিদে নেই। আর এতো খাবার কে খাবে?

-কে খাবে মানে? খিদেয় কেমন রেগে রেগে কথা বলছ। তাই তো বেশি করে আনলাম। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। দেখবে খিদে মিটে গেলে মিষ্টি মধু ঝড়বে আমার বউপাখিটার মুখ দিয়ে।

-আমি খিদেয় এমন করছি?

-নয়তো কি। আমার বউটা সবসময় কি মিষ্টি মিষ্টি করে হাসে, কথা বলে, আদর করে দেয়। অথচ আজ দেখো এতোক্ষণ বাইরে ঘুরতে ঘুরতে খাওয়ার কথটা মনেই ছিল না। আর আসার সময় যে বৃষ্টি নামলো তাতে ভিজে তো চুপচুপে হয়ে গিয়েছিলাম সবাই। সরি বউটা।

অরণ্যের কথা শুনে অনামিকা রাগের চোটে একটা কথাও বলতে পারলো না। অরণ্য সেটা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসছে নিজের মনেই। অরণ্য আরেক লোকমা মুখের সামনে তুলে ধরার আগেই অনামিকা অরণ্যের কাছ থেকে প্রায় লাফিয়ে সরে এসে বিছানা থেকে নেমে গেল। অরণ্য নিজেও প্লেট হাতেই বিছানা  ছেড়ে নামলো।

অনু? খাওয়া শেষ না করে এক পা ও নড়বে না বলে দিলাম কিন্তু। আর একটুখানি বাকি। বললাম না খেয়ে নিয়ে তারপর ঘুমাবে? খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘুম টুমও ভুলে যাও।

-এটাকে একটুখানি বলে? আমার পেটে আর এক ফোঁটাও জায়গা নেই। আমি খাবো না।

-জায়গা অনেক আছে। আর তোমার খাবো না আমি শুনছি না। হা করো?

-ধুর। আমি থাকবোই না এইরুমে। গেলাম আমি। তুমি নিজেই খাও।

-বললেই হলো আর কি? খাবারটা শেষ করো। এক গ্লাস গরম দুধ খাও। দেখবে পেটের ব্যথাটা একটু কমবে। লক্ষী মেয়ের মতো কথা শুনলে গিফ্ট পাবে বুঝলে। এখন দেখি, ছুটোছুটি না করে বিছানায় এসে বসো?

-আমি খাবো না। একবার বের হতে পারি রুম থেকে। তারপর দেখাচ্ছি তোমাকে।

-রুম থেকে বের হওয়ার কথা ভুলে যান ম্যাডাম। দরকার হলে আপনার হাত পা বেঁধে জোর করে আপনাকে খাইয়ে দেয়া হবে। এভাবে ছুটোছুটি যত করবে, তত ব্যথা আরো বাড়বে। পরে কিন্তু ঘুমাতেও পারবে না।

-অরণ্য? আমার পেট ভরে গেছে। আর না প্লিজ?

-ভাত নিয়ে এলাম আমি, মাখিয়ে দিলাম আমি, খাইয়ে দিচ্ছি আমি। আর দু তিন লোকমা খেতে না খেতেই পেটও ভরে গেল আপনার? বাহ! আমাদের ফুলির মায়ের মেয়েটাকে দেখেছ? ১০/১২ বছরের বাচ্চা মেয়ে। ফুলিও তোমার চেয়ে বেশি ভাত খায় জানো?

-তো আমি কি করবো?

-কিছুই করবে না। এভাবে সারা ঘরে ছুটোছুটি না করে শান্ত হয়ে বসো। আমিও ভালোয় ভালোয় তোমাকে খাইয়ে দিই। এতো যে ছুটোছুটি করছ, প্রবলেম কিন্তু তোমারই হচ্ছে। 

-উফ! আমি মরছি আমার জ্বালায়! আর উনি পড়েছেন খাওয়ার পিছনে। বলছি তো খাবো না। 

-আমার সাথে অযথা তর্ক করে লাভ নেই সেটা কি এখনো বুঝতে পারেন নি ম্যাডাম? 

অরণ্যের হাত থেকে বেশিক্ষণ পালিয়ে বেড়ানো সম্ভব হলো না অনামিকার। সারা ঘর অনামিকা ছুটোছুটি করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়েই বিছানায় বসে পড়লো। অরণ্যও মিষ্টি করে হেসে অনামিকার পাশে বসে আবার অনামিকাকে খাইয়ে দেয়ায় মন দিল। রাগে, ক্ষোভে, বিরক্তিতে বেচারি আর একটা কথাও বললো না। চুপচাপ প্লেটের খাবার পেটে চালান করে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে পানিটা খেয়ে গ্লাসটা ঠাস করে বেড সাইড টেবিলের উপরে রাখলো। অনামিকা রাগটা টের পেয়ে হাসলো অরণ্য। হাত ধুয়ে অনামিকার মুখ মুছিয়ে দিয়ে অনামিকার মুখের দিকে তাকালো।

-খেতে ইচ্ছে করছে না, খিদে নেই, এমন করে না খেয়ে থাকলেই কি পেটের ব্যথা কমবে মেয়ে? চাইলেই তোমাকে সোজা কোলে করে তুলে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে সবার সাথে খেতে বসাতে পারতাম। কাজটা করিনি কেন জানো? তখনও দু তিন লোকমা খেয়েই চলে আসতে। এভাবে না খেয়ে থাকলে এই অবস্থায় শরীরের প্রয়োজনীয় নিউট্রেশন পাবে কি করে?

-এই অবস্থায় মানে কি! 

-এই সময়টায় তোমার শরীরটা নতুন করে গঠন হবে। ভবিষ্যতে কারো আসার জন্য শরীর নিজেকে তৈরি করে প্রতি মাসে। মাসের অন্য দিনগুলোর চেয়ে এই সময়টায় শরীরের আরো বেশি করে যত্ন নেয়ার কথা। আর তুমি কিনা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়ার প্ল্যান করছ। গত তিনটা মাস কি করেছিলে আমি তো সেটাই ভেবে কূল পাচ্ছি না। এসব কিন্তু চলবে না ম্যাডাম।

-তুমি! তোমাকে কে বললো এসব!

অনামিকা চোখ বড় বড় করে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেই আবার চোখ নামিয়ে নিল। এতোক্ষণে লজ্জায় মেয়েটার কান, নাক, গালে লালিমা ছড়িয়েছে। অরণ্য সেটা দেখে হেসে অনামিকার গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে দুষ্টু একটা হাসি ফোটালো ঠোঁটের কোণে।

-কেউ বলে দিতে হয় নাকি? গুগল মামার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর আছে। গুগল করে জেনেছি।

-কি জেনেছ গুগল করে? 

-কি জেনেছি মানে! এসময় কি কি প্রবলেম হয়। কি কি খাওয়া শরীরের জন্য ভালো, কোনটা এভয়েড করতে হয়, এই যে তোমার মুড সুইং, বডি পেইন, মাথাব্যথা, এসব আর কি।

-আমার প্রবলেম চলছে তোমাকে কে বললো? আমি তো বলি নি কিছু----।

অনামিকা প্রশ্নটা করে লজ্জারাঙা মুখটা নামিয়ে নিতেই অরণ্য অনামিকার চুলগুলো এক হাতে হালকা করে টেনে অনামিকার মুখটা তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।

-আই এম ইওর হাজবেন্ড ম্যাডাম। আপনার না বলা অনেক কথাই আমি আগে থেকেই জেনে যাই। এটা বুঝতে একটু দেরি হয়ে গেল এই আর কি। আর ম্যাডাম, প্রবলেম চলছে এটা কেমন কথা? এই ছোট্টো পরিবর্তনটা আমাদের নতুন অতিথি আসার পূর্ব প্রস্তুতি বুঝলে? এখন চুপচাপ কিছুক্ষণ রেস্ট করো। আমি এক গ্লাস গরম দুধ এনে দিচ্ছি। লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নিবে। দেখবে ভালো একটা ঘুম হবে।

-উঁহু। এমনিতেই এতো খাইয়েছ যে বমি আসছে। আবার দুধ! অসম্ভব। আর এতো অস্বস্তি লাগছে, মনে হয় না ঘুম আসবে আজকে।

-বেশি খারাপ লাগছে? ব্যথা করছে বেশি?

-উঁহু।

-দেখো অনু। এমন লজ্জারাঙা মুখটা আদর করার সময় করে আমাকে পাগল বানিয়ো। এসব ব্যাপার নিয়ে লজ্জা পেতে হবে না। ক্লিয়ার করে খোলাখুলি নিজের মনের কথা আমার সাথে শেয়ার করবা। হাজবেন্ডের এই সামান্য একটা ব্যাপার শেয়ার করতে না পারলে আর কার সাথে করবে?

-হুম।

-তোমার কিছু লাগবে কি না বললেও তো না? লাস্ট কয়টা মাস ম্যানেজ করেছ কি করে? 

-উমমমমম। তাহিয়া---।

-এবার থেকে আমাকে বলবে কখন কি লাগবে। ওকে?

-তুমি তো এখনো খাও নি কিছু। খেয়ে নাও না?

-কথা ঘোড়ানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। তখন শপিং ব্যাগগুলো রাখতে গিয়ে কোণায় ন্যাপকিনের খোলা প্যাকেটটা দেখে কথাটা মাথায় এলো। এসব ব্যাপার না লুকিয়ে সহজভাবে ডিস্কাস করতে হয় বুঝলে মেয়ে? লুকোচুরির কিছু নেই। আমিই তো?

-যাও তো তুমি? ঘুম পাচ্ছে আমার। খেয়ে এসো। আমি ঘুমাই। গুড নাইট।

অনামিকা কথাগুলো বলতে বলতেই কোনোমতে গুটিশুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে চাদর টেনে দিল গায়ে। অরণ্য হেসে অনামিকার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে খাবারের ট্রেতে রাখা প্লেট, বাটি, গ্লাস গুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনামিকাও এবারে নিজের পা জোড়া পেটের কাছে সেঁধিয়ে নিয়ে দলা পাকিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে নিজের পেটের ব্যথাটা হজম করার চেষ্টা করলো। এতো ব্যথা লাগছে যে একটু নড়াচড়া করলেই মনে হচ্ছে কেউ যেন হাড়গোড়গুলো ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। নিজের শরীরের উষ্ণতা, সারাদিনের ক্লান্তি, ব্যথা সব মিলিয়ে কখন রাজ্যের ঘুম এসে দু চোখের পাতা ভারি হয়ে গিয়েছিল টেরই পায়নি অনামিকার। কিছুক্ষণ পরেই পায়ে কারো হাতের স্পর্শে ঘুমঘুম চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করলো অনু। 

-তুমি? কি করছ?

৩৮!! 

-আরে এভাবে আঁতকে উঠছ কেন অনু? আমি তো! সরি কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে দিলাম তোমার। পায়ে ব্যথা করছিল বলেছিলে তাই ভাবলাম ম্যাসাজ করে দিলে একটু ভালো লাগবে। সরি সরি হ্যাঁ? তুমি ঘুমাও কেমন?

পায়ে অরণ্যের হাতের স্পর্শ লাগতেই অনামিকা ধড়ফড় করে উঠে বসার চেষ্টা করতেই অরণ্য আলতো হাতে অনামিকাকে আবার শুইয়ে দিয়ে অনামিকার পায়ে আবার স্পর্শ করতেই অনামিকা থতমত খেয়ে পা গুটিয়ে নিল। অরণ্য কিছু বলার চেষ্টা করে অনামিকার দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করতেই অনামিকা অরণ্যের হাতটা ধরে ফেললো। 

-পায়ে হাত দিচ্ছ কেন? ছি ছি! আমার কোন ব্যথা ট্যথা করছে না। একটু টায়ার্ড লাগছে, ঘুমিয়ে নিলে চলে যাবে।

-এই সময় হাতে, পায়ে, কোমড়ে, পেটে ব্যথা হবে সেটা স্বাভাবিক। আর তুমি এমন করছ কেন বলো তো? আ'ম ইওর হাজবেন্ড ম্যাডাম। এখন পা মেলে ঠিক করে শোও তে? 

-এই একদম পায়ে হাত দিবে না। ছি! তোমার অফিস আছে না সকালে? ঘুমাও না কেন? 

-অনু? বেশি বকবক না করে যেটা বলছি সেটা করো। একটু ল্যাভেন্ডার ওয়েল দিয়ে ম্যাসাজ করলে দেখবে আরাম লাগবে। 

-উফ! লাগবে না। তুমি শোও তো? তোমার বুকে মাথা রাখলে এমনি ঘুম চলে আসবে। এসো?

-জো হুকুম মহারাণী। পরে আবার আমাকে বলতে পারবে যে আমি সারা রাত জেগে আছি, আর ভদ্রলোক পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছেন। তাহলে কিন্তু খবর আছে তোমার।

-আচ্ছা বলবো না। এখন শোও তো? কত রাত হয়েছে খবর আছে?

-ইয়েস ম্যাডাম।
    

সারাদিনের ক্লান্তিকর দিনের পর অরণ্যও এবারে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। অনামিকা এখনো গুটিশুটি হয়ে বসে আছে দেখে অরণ্য নিজেই অনুর হাত টেনে নিজের বুকের উপরে অনামিকার মাথাটা রেখে ছোট্ট করে একটা চুমো আঁকলো অনামিকার কপালে।

-একটা ইন্টারেস্টিং ডিস্কাশন মিস করেছ তুমি বুঝলে। ডিনার টাইমে সবার সাথে জয়েন করা উচিত ছিল তোমার। 

-কেন? কি হয়েছে? কোনো প্রবলেম?

-আরে প্রবলেম না। স্নিগ্ধ তো আজ এখানেই ডিনার করেছে। শাওয়ার নিয়ে চেইঞ্জ করে আমার ড্রেস পড়েছে। সবার সাথে ডিনার করেছে। এদিকে বাবার সে কি আফসোস জানো?

-কি গোল গোল ঘুরিয়ে কথা বলছ? বাবা কি নিয়ে আফসোস করেছে? কেন?

-আরে বাবা শোনো না? বাবা আফসোস করছে আমি স্টাডি কমপ্লিট করে বাবার সাথে নিজেদের বিজনেস না সামলে একটা বিজনেস ফার্মে জব নিয়েছি। আর তাহিয়া? ওর তো বিজনেস নিয়ে বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই। সেটা নিয়েই হা হুতাশ চলে বাবার দুদিন পর পর। আজও সেটা নিয়েই স্নিগ্ধকে দুঃখের কাহিনী শুনাচ্ছিল আর কি।

-ওহ! তুমি নিজেদের বিজনেস জয়েন না করে জব করছ? কেন?

-নিজের বাবার অফিসে জয়েন তো যে কোনো সময়ই করতে পারবো। বাট আমি চেয়েছি নিজের যোগ্যতায় একটা চাকরি জোগাড় করে নিজেকে টেস্ট করতে। তাছাড়া যে বিজনেস ফার্মে জয়েন করেছি সেখানে এক্সপেরিয়েন্সের জন্য জয়েন করা। দু বছর পর এমনিতেই আমাদের কোম্পানিতে জয়েন করবো ভেবেই রেখেছি। বাট আমার বস, মানে যেখানে জব করছি সেখানকার এমডি। হি ইজ এ ভেরি গুড ম্যান। আমাকে এতো ভালোবাসে ইউ কান্ট ইভেন ইমাজিন। নইলে চিন্তা করো দুদিন পর পর হুটহাট করে ছুটি নিচ্ছি। অন্য কোথাও হলে এতোক্ষণে টার্মিনেশন লেটার হাতে থাকতো আমার।

-বাবাকে বলেছ কথাটা?

-ইয়াপ। বাবাকে বলে দিয়েছি আজকে বস নেক্সট মান্থে রিটায়ার করবে। তারপর একটা ব্রেক নিবো, তারপর বাবার দুঃখ মোচন করবো। আই মিন বাবার বিজনেস জয়েন করবো। এট আগে না।

-বাবা কিছু বলে নি?

-বলবে কি! আমার প্ল্যান শুনে ক্লিন বোল্ড। আমাকে খোঁচানোর জন্য স্নিগ্ধের সাথে কথাগুলো বলছিল না? সুযোগ পেয়ে আমিও নিজের আর স্নিগ্ধদের রাস্তা ক্লিয়ার করে নিয়েছি। হা হা হা।

-কি আজব! হাসছ কেন এভাবে? কিসের রাস্তা ক্লিয়ার করেছ তোমার আর স্নিগ্ধ ভাইয়ার?

-কথাটা শুনলে এই মাঝরাতে আবছা অন্ধকার রুমটাতেও কেউ একজনের মুখটা লজ্জায় রক্তবর্ণ হয়ে উঠবে। সেটা দেখে নিজেকে সামলাতে পারবো কিনা ভাবছি। এখন তো কারো মধ্যে ডুব দেয়াও যাবে না। 

-কি? কিসব আজাইরা কথা বলো সবসময়? আমার লজ্জা পাবার কি হলো এখানে?

-উমমমম। এতোই যখন জানতে চাইছ তাহলে বলছি শোনো। বাবা আমাকে এটা ওটা বলে টিজ করছিল। আমিও বললাম অফিসে জয়েন করবো কি তিন-চার মাস হয়ে গেল বিয়ে করলাম এখনও হানিমুনে পাঠাতে পারলে না। 

অরণ্যের কথা শুনে অনামিকা ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খেয়ে বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করেছে। অরণ্য সেটা দেখে হা হা করেই রুম কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করেছে। অনামিকা অরণ্যের বুকে ধুপধাপ কতোগুলো কিল ঘুষি বসাতেই অরণ্য হাসতে হাসতেই অনামিকাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিল। অনামিকা রাগে লাল হয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই অরণ্য আরো শক্ত করে অনুকে জড়িয়ে নিল।

-আরে বাবা আমি তো আগেই বলেছিলাম তুমি লজ্জায় পড়ে যাবে। তুমিই তো জোর করলে বলার জন্য।

-তুমি এতো অসভ্য! বাবার সামনে এসব বলেছ?  সবার সামনে! ছি ছি ছি! মুখে কিছু আটকায় না তোমার? 

-আরে আটকাতে যাবে কেন? আর তুমিই বলো? বিয়ের এতোগুলো দিন কেটে গেল কেউ একবারও আমাদের হানিমুন নিয়ে ভেবেছে? পাঠানো তো দূরে থাক। একবার জিজ্ঞেস তো করবে যাবো কিনা। ফ্রি আছি কি না।

-অসভ্য লোক একটা! ছাড়ো তো! বাবা, মা, তাহিয়া, এমন কি স্নিগ্ধের সামনে কথাগুলে বলেছ? একটুও লজ্জা বলতে কিছু নেই এই লোকটার? ছি!

-আরে আশ্চর্য! লজ্জা পাওয়ার কি হলো? আর স্নিগ্ধের কথা বলছো? ওরা আর আমরা একসাথেই হানিমুনে যাবো সোনা। শুধু বিয়েটা হতে দাও একবার। তারপর একটা লম্বা ডুব দিবো তোমাকে নিয়ে।

-অসভ্য লোক একটা! সরো তো সরো? 

-আরে বউ? রাগ করো কেন? আচ্ছা আপাতত লজ্জায় লাল না হয়ে ঘুমাও লক্ষী মেয়ের মতো। কেমন? এখন হানিমুন প্ল্যান করে মাথা খারাপ করার মানেই হয় না। 

-যাও তো। ঘুম পাচ্ছে।

-তাই নাকি? আসো মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। চোখ বন্ধ করো? 

-ঘুমাও তুমিও। অনেক রাত হয়েছে। 

-আর শোনো? এই কয়দিন একদম ঠান্ডা কিচ্ছু খাওয়া চলবে না। নো আইসক্রিম, নো সফ্ট ড্রিংকস, তো চিলড ওয়াটার। ওকে?

-ঘুমাও তো? 

-আরে কথা শোনো না কেন? এ সময় ঠান্ডা কিছু খাওয়া উচিত না। ইভেন শশা ও না। ব্লাড ক্লট হয়ে মেয়েদের অনেক প্রবলেম হয় এসময় ঠান্ডা কিছু খেলে। ইভেন কনসিভেও অনেক প্রবলেম হয়। 

-তুমিইইইই চুপ করবা? 

অনামিকা কোনো মতে অরণ্যের মুখে হাত চাপা দিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো। অরণ্য দুষ্টুমির ছলে অনামিকার হাতের তালু আদরে, কামড়ে ভরিয়ে দিয়ে দুষ্টুমিতে মাতলো। আর অনামিকা অন্য হাতে ধুমধাম কিল বসিয়ে দুজনেই খুনশুটিতে মাতলো দুজনে।

দেখতে দেখতে আরো দশটা দিন কেটে গেল। তাহিয়ার গায়ে হলুদ আজ। অনামিকা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গুনগুন করতে করতে কানে হলুদ ফুলের দুল পড়ছে। পড়নের সেনালি পাড়ের হলুদ লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করে হলুদ ফুলের গয়নার সাজে সেজেছে অনামিকা। আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে নিয়ে চুলগুলো ঠিক করে খোঁপার বাঁধনে জড়িয়ে পিছনের দিকে তাকাতেই দরজার দিকে নজর পড়লো অনামিকার। অরণ্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপলকে অনুকেই দেখতে দেখতে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে অনামিকার দিকে। অনামিকাও চমকে উঠে ধীর পায়ে এক পা দু পা করে পিছিয়ে যেতে যেতে একেবারে দেয়ালের সাথে মিশে যাওয়ার দশা হলো। অরণ্যও এগিয়ে আসতে আসতে একদম অনামিকার সামনে এসে দেয়ালে দুপাশে হাত আটকে অনামিকার পালানোর পথ বন্ধ করলো। অনামিকা অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি চলছে ওর মনে। অনামিকার লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং করে গোল্ডেন কালারের পাজামার সাথে হলুদ পাঞ্জাবি পড়েছে। অরণ্য আলতো হাতে অনামিকার চুলের খোঁপাটা খুলে দিয়ে অনামিকার গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিল। অনামিকা একবার কেঁপে উঠে চোখ বড় বড় তাকালো অরণ্যের দিকে।

 -আরে নিচে সবাই ওয়েট করছে। কি করছ? খোঁপা খুলছ কেন? এখন আবার চুল বাঁধবে হবে। ধ্যাত। বউ গিয়ে বসে আছে স্টেজে হলুদের জন্য। আর এদিকে হলুদ দেয়ার মানুষ রেডিও হতে পারে নি এখনো। সবাই আজও হাসাহাসি করবে দেখো।

-করলে করুক। আর ভুলেও আজ খোঁপা করার কথা মাথায় আনবে না। পিছন থেকে না দেখলে তো খেয়ালই করতাম না জিনিস টা। এতোদিনেও কেন দেখলাম না বলো তো? আর তুমিও তো বলো নি। এটা কোনো কথা?

-কি দেখলে? কি বলি নি? খোঁপায় ভালো লাগছে না? লেহেঙ্গার সাথে বেণী করবো চুল? কেমন কেমন লাগবে না? আরে একটা কথা বলে এমন হা করে তাকিয়ে থাকো কেন হ্যাঁ? কিছু তো বলো? 

অনামিকা বিরক্ত হয়ে সরে আসার চেষ্টা করতেই অরণ্য অনামিকার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজেই দেয়ালে হেলান দিয়ে অনামিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো যেন অনামিকা হুট করে পালাতে না পারে। অনামিকা সরে আসার চেষ্টা করতেই অরণ্য ফুঁ দিয়ে অনামিকার মুখের উপরে আসা চুলগুলো সরিয়ে দিল।

-তোমার পিঠের কুচকুচে কালো তিলটা এতোদিন চোখে পড়ে নি কি করে সেটা ভেবেই অবাক লাগছে আমার। কি করে মিস হয়ে গেলো বলো তো হলুদিয়া পাখি?

-পিঠে তিল! সিরিয়াসলি? আমার পিঠে কি দুটো চোখ গজিয়েছ যে নিজের পিঠের তিল দেখবো। আর সেটা তোমাকে বলি নি বলে কি শুরু করেছ।

-ইশ! এখনই দেখতে হলো! হলুদের ফাংশন কখন শেষ হবে অনু? আজকে আপনাকে হলুদিয়া পাখি সাজানো হবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।

-একদম হলুদ লাগাতে আসবে না বলে দিলাম। দেরি হচ্ছে আমি গেলাম।

-আরে! অনু? চুল তো বাঁধো? ফুল নিয়ে এসেছি। সবাই কখন থেকে অপেক্ষা থেকে! এখনো রেডি হতে পারলে না! আসো? আমিই চুল সেট করে দিচ্ছি। দেখি? পিছনে ঘুরো তো?

-তুমি যাও তো যাও? যাওওওও। নিজেই দেরি করিয়ে আবার টিজ করতে এসেছে লোকটা। যাওওওও।

অনামিকা কোনোমতে নিজেকে অরণ্যের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে অরণ্যকে রুমের বাইরে বের করে দিয়ে দরজা লক করে দিল। অরণ্য বেচারা আর কি করবে নিচেই ফাংশানের অবস্থা দেখতে চলে গেল। অনামিকাও খোলা চুলগুলো বেণীতে জড়িয়ে নিয়ে অরণ্যের দেয়া ফুলগুলো চুলে জড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হলো। অনামিকা নিজের লেহেঙ্গার দেপাট্টাটা ঠিক করতে করতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই চোখের সামনে ঘন অন্ধকার ছেড়ে গেল অনামিকার। কেউ একজন পিছন থেকে আচমকাই অনামিকার চোখ জোড়া ধরে ফেলেছে। স্পর্শটা পরিচিত নয় বলেই ভয় পেয়েই থমকে দাঁড়িয়ে গেল অনামিকা। সাবধানী হাতে চোখ ধরে রাখা হাতটা ধরে বোঝার চেষ্টা করলো কে হতে পারে। পরিচিত কেউ?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন