২৯!!
রাতের নিরিবিলি পিচঢালা রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে নিজ গন্তব্যে।জানালা খোলা থাকায় বাতাসের প্রবেশে প্রেমার চুল আউলিয়ে দিচ্ছে। বিরক্তিতে নাক ছিটকে চুলে কাটা খুঁজতে শুরু করে। চোখ যায় উরনার দিকে।কাটাটা সেখানেই আটকানো আছে। মনে পড়ে যায় তখন অভ্র ওর চুল থেকে কাটা নিয়ে উরনার সাথে আটকে দিয়েছিলো।
আবারও চোখের পানি চিকচিক করছে প্রেমার। ঘন নিঃশাস নিয়ে কান্নাকে কাবু করতে চাইছে।যা আঁড়চোখে পাশে বসা অভ্রের নানি খেয়াল করছেন।উরনা থেকে কাটা নিয়ে প্রেমার চুল বাঁধতে বাঁধতে উনি বললেন,
'ছেলেটা তোমার জন্য বিষণ পাগল। তাই এতো কিছু করেছে।'
বাক্যসমূহ প্রেমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অল্প কেঁপে উঠে।সচকিত হয় বেশ। বিষয়টা অনেক গভীর।করুনদৃষ্টে তাকায় প্রেমা। বিষণ ইচ্ছে করছে কিছু বলতে।কিন্তু সে ইচ্ছেটা নিমিষেই উধাও হয়ে যাচ্ছে।নির্বিকার চেয়ে থাকে।মৌনতাকে নিজের সঙ্গী করে নেয় আপাততে।
'সব চিন্তা বাইরে রেখে নিজের মন কি চাই সেটা বুঝো।সব সহজ হয়ে যাবে।'(মুচকি হেসে নানু বললেন)
'উদাসীন ভঙ্গিতে প্রেমা ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠে,
' আমার বিয়ে ভেঙেছে ও, আমার পরিবার কতোটা কষ্ট পেয়েছিলো।সব শেষে অপয়া নামের একটা ট্যাগ পেতে হয়েছে।সবই অভ্রের জন্য।(প্রেমা)
বুক চিরে শ্বাস বেড়িয়ে আসে অভ্রের নানুর।বুঝতে পারেন প্রেমাকে কোনো ভাবেই বুঝানো যাবেনা।যা মাথায় গেঁথে গিয়েছে তা সহজে বের হবে না।পরমুহূর্তে কিছু একটা ভেবে আপনমনে হাসলেন।
"আমি আর কিছু বলবো না।যা করার অভ্রই করবে।(মনেমনে কথাটা বলেন,এবং আলতো করে প্রেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন)
তখন প্রেমার দৃষ্টি জানালার বাইরে। বারবার অভ্রের স্বচ্চ,হাস্যজ্বল মুখটা প্রেমার চোখের সামনে ভাসছে।যতবার ভাবছে অভ্রের সাথে কঠিন ব্যাবহার করবে ততই বুকটা ভাড় হয়ে আসছে তার। যেনো মুহুর্তে নিঃশ্বাস আঁটকে মারা যাবে।
বাসায় পৌঁছেই নিশ্বব্দে পা চালিয়ে রুমে চলে যায় প্রেমা। রুমে প্রবেশ করতেই এলোমেলো ভাবে বিছানায় শুয়ে পরে।কাঁদার ফলে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। এখন আরো দ্বিগুন কান্নায় মেতে উঠেছে।
বালিশ খামছে ধরে প্রেমা নিঃশব্দে আবারও কান্নার গতি বাড়িয়ে দেয়।নিজের কান্নার কারন নিজেই বুঝতে পারছেনা।
'কেন এতো কষ্ট হচ্ছে,কান্না আসছে এতো,কি চাই আমি?? কেন আমার লাইফে আসলে অভ্র।ভালোই তো ছিলাম। কেন করলে এমনটা? (প্রেমা)
বেশকিছুক্ষণ কাঁদার পরে অনেকটা শান্ত হয় প্রেমা।চোখমুখ মুছেই ওয়াসরুমে চলে যায়। আর তখনি দরজায় টকটক শব্দ হয়।বিরক্ত হয়ে বের হয়ে যায় প্রেমা। দরজা খুলেই দেখে অভ্রের নানু দাড়িয়ে খাবার নিয়ে।প্রমাকে দেখে উনি স্বস্থির শ্বাস ছাড়েন।কারন অভ্র একটু আগে ফোন করে প্রেমাকে গোসল করা থেকে আটকাতে বলে। সে জানতো এতো কিছুর পর সেদিনের মতো প্রেমা আবারও রাতে গোসল করবেই।তাই অভ্র ফোনে সব জানিয়ে দেয়।
"ফ্রেস হওনি এখনো?
' না আসলে গোসল করতে যাচ্ছিলাম।'(প্রেমা)
'এতো রাতে গোসল,ঠান্ডা লেগে যাবে।তুমি বরং মুখহাত ধুয়ে খাবার খেয়ে নাও।(নানু)
'খাবো না নানু,খেতে ইচ্ছে করছে না প্লিজ। (প্রেমা)
'আমি এতো কথা জানিনা,ফ্রেস হয়ে আসো।আমি অপেক্ষা করছি।তুমি খাওয়ার পর শুয়ে পরো আমি নিজ হাতে তোমার মাথায় বিলি কেটে দিবো।(নানু)
উনার বিনীত স্বরে বলা কথাগুলো প্রেমা চেয়েও ফেলতে পারেনি।ফ্রেস হয়ে খেয়ে শুয়ে পরে।মাথায় বিলি কাটার ফলে প্রেমা দ্রুত ঘুমিয়ে পরে।এতো চাপ গেলো তাই শুতেই আরামের ঘুম চোখে নামে।
ফোন বাজলেই নানু ফোনটা রিসিভ করেন,
' নানু প্রেমা ঘুমিয়েছ?(ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করে অভ্র)
'হ্যাঁ,ঘুমিয়েছে,খেয়েছিস?(নানু)
" হ্যাঁ, একটু আগে। (অভ্র)
"এখন কোথায় তুই? কবে আসবি?
'সবসময় যেখানে থাকি সেখানেই আছি।কাল সকালেই আসছি।রাখছি এখন। (অভ্র)
প্রলুদ্ধ হয়ে যান অভ্রের আচরণে। কতোটা খেয়ারিং ছেলে অভ্র।তা ভেবেই ভালোলাগার শ্বাস ত্যাগ করছেন অভ্রের নানু। অতীতের কথাটা মনে আসলেই আবারও অভ্রের মুখটা উনার চোখে ভাসিত হন।
ফোন কাটার পর অভ্র ছাদের উপর গার্ডেন সাইডের কোণায় রেলিং এ হাতের ভর দিয়ে হালকা ঝুঁকে। এবং আবারও সোজা হয়ে দাড়ায়। ফোনটার ওয়েলপেপারের দিকে নজর দেয়। ফুলের মাঝখানে বসে থাকা প্রেমার ছবিটায় নিজের গাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অভ্র। হৃৎপিণ্ডের দুরুদুরু চলাচলের শব্দ অনুভব করতে পারছে। বুকের মাঝে আজ আর কোনো ব্যথা অনুভব করছেনা সে।সুখ লাগছে।
সাইকান এসে অভ্রের পাশে দাঁড়ায়। মাঝেমধ্যে অভ্রের কাছে নিজেকে নগন্য লাগে তার।সব দিক দিয়ে অভ্র অনবদ্য। পার্ফেক্টও বলা যায়। ভাবছে প্রেমা ওকে কোনোরকম কষ্ট দিবে না তো।নাহলে ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে সে নিশ্চিত।
'বাহ! শুধু ছবিই দেখোস সারাদিন।ফোনে তোর ছবি-টবি আছে? নাকি সব প্রেমাপুর ছবি?
সাইকানর কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় অভ্র,
'আমার ছবি দিয়ে কি করবো?(অভ্র)
'না মানে....
সাইকানের পুরো কথা না শুনে অভ্র ধপাধপ পা চালিয়ে চলে যায়।পেঁছন থেকে সাইকান অভ্রে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে বিড়বিড় করে বলে উঠে,
"বাইরে থেকে শালা ভালো সেজে থাকোস,ভেতরে তুই কেমন সেটা আমি আর আদ্রই ভালা জানি।
অভ্রের শ্রবণ শক্তি অনেক প্রকড়,তাই সাইকানের কথা ওর কানে আসতে সময় নেইনি।পা থেকে একটা স্লিপার খুলে সাইকানের পেট বরাবর ছুঁড়ে মারে।
সাইকান হালকা ব্যথা পাওয়ার বান করে বলে,
" শালা তোর ভালো হবেনা।
তখনি অভ্র অপর স্লিপারটা ছুঁড়ে মারে আবারও।
সাইকান হেসে ক্যাচ ধরে ফেলে।
রুমে এসেই অভ্র আরিয়ানকে ফোন দেয়।
'হ্যালো,কে বলছেন এতো রাতে?(আরিয়ান)
'আমি '(অভ্র)
আরিয়ান সাথে সাথে চমকে শুয়া থেকে উঠে যায়,
'অভ্র,তুই? এতোরাতে,? কোনো সমস্যা হয়েছে?
আরিয়ানের কথায় অভ্রের বিরক্তিতে গা জ্বলে উঠে,
ন্যাকা কথা বাদ দিয়ে সোজা কথায় চলে যায়।
'কাল বিকালে তোমাকে দেখা করতে হবে,ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে?(অভ্র)
'ইম্পর্ট্যান্ট কথা? কি কথা বলবি অভ্র?
" দেখা হলেই জানতে পারবা।(অভ্র)
কথাটা বলে ঠাস করে আরিয়ানের মুখের উপর ফোনটা কেটে দেয় অভ্র। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে পরে। ঘন সিল্কি চুল হাত দিয়ে উপরের দিকে তুলে দিয়ে,অদ্ভুদ একটা হাসি দেয়।
__________________
সকালের দিকে প্রেমা সম্পূর্ণ রেডি হয়ে বের হয় বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য। সঙ্গে প্রিয়াও।দাদি যাবে না।উনার সেখানে ভালো লাগে না।বাধ্য হয়ে প্রেমা প্রিয়াকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়। সবার থেকে বের হয়ে বিদায় নিয়ে বের হতে যাবে,সেই মুহুর্তে অভ্রের প্রবেশ।
অভ্রকে দেখে প্রেমার এবার অস্থিরতা বেড়ে যায়।এ্যাশ কালারের শার্ট,আর মুখটা সবসময়ের মতো ফ্রেস।যেটা দেখেই প্রেমার আরো বেসামাল অবস্থা।অভ্র প্রেমার দিকে না তাকিয়ে পাশ কেটে চলে যায়। প্রিয়ার হাত ধরে বলে উঠে,
"কিউটি! কেমন আছো?(অভ্র)
'ভালো,আংকেল তুমি কেমন আছো?
'ভালো। (অভ্র)
" অভ্র নাস্তা করেছিস? ( অভ্রের মা)
"হ্যাঁ করেছি,(অভ্র)
'তাহলে বাবা প্রেমা আর প্রিয়াকে দিয়ে আয়,(মা)
কথাটা শুনার সাথে সাথেই প্রেমা কাঁপা গলায় বলে উঠে,'না আন্টি আমরা যেতে পারবো।'
কেউ কিছু বলতে যাবে তার আগেই অভ্র বলে উঠে,
'মা আমি দিয়ে আসছি, চলো কিউটি। (অভ্র)
প্রিয়াকে নিয়ে অভ্র চলে যায়। উপায় না পেয়ে প্রেমাও অভ্রের পেঁছন পেঁছন হাঁটা দেয়।
প্রিয়াকে পেঁছনে বসিয়ে দিয়ে অভ্র সামনে ড্রাইবারের পাশের সিটে বসে।আর প্রেমা চুপচাপ প্রিয়ার পাশে বসে যায়।কারো মুখে কোনো কথা নেই।প্রেমা অনেকবার অভ্রকে বাঁকা চোখে দেখেছে।কিন্তু অভ্রের কোনো হেলদেল নেই।সে ফোন স্ক্রল করতে ব্যস্ত।
৩০!!
বিকেলের সোনালি রোদ অভ্রের ফর্সা মুখে এসে আঁছড়ে পরে।সূর্যের কিরণে অভ্রের মুখের সৌন্দর্য্য আরো দ্বিগুণ করে তুলছে। নদীর পাড়ে একটা বেঞ্চিতে বসে নিজের মনের সাথে কথোপকথনে ব্যাস্ত অভ্র।
কিছুক্ষণ আগেই আরিয়ান হাসিমুখে অভ্রের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আর আরিয়ানের বোকা হাসি দেখে অভ্রের ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে বাঁকা হাসি ফুটে উঠতে সময় নেয়নি।
নিরব-নিস্তব্ধ একটা পরিবেশে অভ্রের পুরোটা ভাবনাজুড়ে প্রেমা নামক অস্তিত্বের বিচরণ। বেঞ্চিতে গা টা এলিয়ে দিয়ে,উপরে ঘন নীল গগনের দিকে নিজের দৃষ্টি স্থির করে। আলতো করে চোখজোড়া বন্ধ করে।সঙ্গে সঙ্গে প্রেমার আশ্রুসিক্ত চোখ দু'টো ভেসে আসে।
চোখ বন্ধ অবস্থায় মৃদু হাসে অভ্র।'ঝড়ের পরমুহুর্তে যেমন চারপাশে শান্তি এবং সুখ অনুভুব হয়,এই মুহুর্তেও অভ্রের বুকে তেমন অনুভুতি হচ্ছে। অনেক জ্বালা সহ্য করেছিলো এতোদিন,অগুনের তাপে জ্বলে-পুড়ে গিয়েছিলো।কিন্তু এখনের শীতল অনুভুতিতে সে নিজেই বেশ আমোদিত।
বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা। চারপাশে ভ্যাঁপসা গরম।বৃষ্টির কোনো চিহ্নমাত্র ও নেই।কিন্তু কারো চোখের তুমুল বৃষ্টিতে চোখমুখ ভিজে স্যাঁতস্যাঁত অবস্থা। কান্না থামানো তার নিজের সাধ্যের বাইরে।
দুপুরে রুমে এসে বদ্ধ দরজায় আবদ্ধ হয়ে যায় প্রেমা।নিজের মধ্যকার আত্মকষ্টের কোনো কূল-কিনারা খোঁজে পাচ্ছে না। তবে জ্বলসে যাচ্ছে নিজের মৌন কষ্টে। বারবার অভ্রের মুখ ভেসে আসছে।নিজের মধ্যে ফাঁকা অনুভুব হচ্ছে বারবার।
আচমকা একটা বিকট শব্দে ধ্যান-দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসে প্রেমা।কান কাড়া করতেই প্রেমা তার ভাবি নাতাশার গলার স্বর শুনতে পাই।আপাততে কথা বলার নূন্যতম ইচ্ছেও নেই তার। বিষণ ইচ্ছে করছে উঁচু গলায় কারো সাথে জগড়া বাঁধাবে। কিন্তু শরীরে সেই শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। না খেয়ে থাকলে যা হয় আরকি।
" প্রেমু দরজা খুল, খাবি না?(নাতাশা)
নাতাশার কথায় বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে আসে প্রেমার।আটকে আসা নিভু কন্ঠে জবাব দেয় প্রেমা-
"না খাবে না।(প্রেমা)
'কেন খাবি না? (নাতাশার প্রশ্ন)
কথাটা শুনার সাথে সাথেই প্রেমার চোখ ভিজে যায়।
বিছানায় ধপ করে শুয়ে পরে।চোখের জ্বালাটা এখন আরো বেড়ে গিয়েছে। ঘন নিশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে।গরমটা এতক্ষণ ধরে সহ্য করা গেলেও এখন আর সহ্য করতে পারছে না।তাই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়।পাতলা একটা টি-শার্ট এবং প্লাজু নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে পরে। লম্বা একটা শাওয়ার এ মুহুর্তে শরীরের জন্য প্রয়োজন।
সন্ধ্যা হতেই অভ্র বাড়ি ফিরে আসে।অভ্রের মা আর আদ্র আরো আগে ফিরে এসেছে।
ফ্রেস হয়ে অভ্র সুইমিংপুলের কাছে আসতেই দেখে আদ্র মুখ ভাড় করে বসে আছে,পানিতে পা ডুবিয়ে। পানিতে কয়েকটা ফুল বাসানো। অভ্র হেসে আদ্রের গা ঘেঁষে বসে পরে। অভ্রকে পেতেই আদ্র মাথাটা অভ্রের কোলে দিয়ে শুয়ে পড়ে। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
'মন খারাপ?(অভ্র)
'উঁহুহ!'(অাদ্র)
"তাহলে? এতো চুপ কেন?(অভ্র)
'এমনি! (আদ্র)
"জগড়া কর আমার সাথে?(অভ্র)
"ইচ্ছে নেই। (অাদ্র)
আদ্রের কথায় অভ্র একটু হাসে। তারপর কপালে একটা চুমু দেয়।
"কাল তোকে নিয়ে বেড়াতে যাবো।
আদ্র পট করে উঠে বসে,এবং চোখ ছোট ছোট করে অভ্রের দিকে তাকায়।
'কোথায়? (আদ্র)
'গেলেই দেখতে পাবে! এখন রুমে যা তোর মিস. চলে আসবে।(অভ্র)
" আচ্ছা।(আদ্র)
কথাটা বলে আদ্র চলে যায়।আর অভ্র তার বাঁ পাশে তাকায়। সেদিন এই পাশটাই প্রেমা বসেছিলো।এখনো মনে হচ্ছে প্রেমা বসে আছে। কালও দুজন একসাথে ছিলো।অথচ আজ??
রুমে এসে ধপাস করে শুয়ে পরে অভ্র। প্রেমার কথা মনে পড়ছিলো বেশ। হাসি,কানে চুল গুঁজে দেওয়া,হাতে খোঁপা করা, আর আবাক হয়ে তাঁকানো। এসব চোখের সামনেই ভাসছে তার। সবচেয়ে বেশি আকর্ষনী হচ্ছে থুতনিতে থাকা তিল টি। যেটা অভ্র এতোদিন খেয়াল করেনি।
কাল যখন প্রেমা ওর কাছে ছিলো। একদম কম দূরত্বে ছিলো তখনি অভ্র প্রেমার তিল টা দেখতে পেয়েছিলো।
"ভাগ্য ভালো যে আমাদের বিয়ে হয়নি,নাহলে...
অভ্র নিজ মনে কথাটা বলে নিজের নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে। কালকে পাগল হয়ে গিয়েছিলো সে,অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।আপাততে নিজেকে উৎসর্গ করে দেওয়ার সময় হয়নি।
ভাবনার মধ্যে অভ্র ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত এগারোটা। গভীর আঁধার গ্রামের জন্য। বিছানায় শুয়ে এপাস ওপাস করছে প্রেমা। ঘুম কোনোমতে ওর চোখের নাগালে আসছে না। তার উপরে বিশ মিনিট যাবৎ লোডশেডিং। রাগ লাগছে এবার প্রেমার।
একটা শব্দে আচমকা প্রেমার রাগ,অস্থিরতা সব থেমে যায় সাময়িকের জন্য। দ্রুত উঠে হাত খোঁপা করে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। দরজা মেলতেই সামনের ঘুটঘুটে অন্ধকার চোখে এসে পড়ে। আশেপাশে উঁকি মারে।তখনি বাম পাশে চোখ যায়। দেখে মিটিমিটি কিছু আলো জ্বলছে। ফোনের লাইট নিয়ে সেদিকে যায়।আলোর উৎসের খোঁজ পায় চেয়ারের উপরে। দেখে কয়েকটা কাঁচের কৌটার ভেতরে জোনাকি পোকা।
আপনি-আপনি হাসি চলে আসে প্রেমার। ঠোঁট আলগা করে একটা শব্দ উচ্চারণ করে। " অভ্র"!
ফোনের লাইট বন্ধ করতেই কৌটার ভেতরে থাকা জোনাকি পোকা খুব সুন্দরভাবে আলো দিতে শুরু করে।গভীর অন্ধকারে এই মিটিমিটি আলো খুব ভালো লাগছে প্রেমার।হঠাৎ প্রেমা দাড়িয়ে যায়।আশেপাশে উঁকি দিতে শুরু করে অভ্রকে দেখার জন্য।ফোনের আলো জ্বালিয়ে কোনো মানুষের ছায়াও প্রেমার নজরে আসেনি। রাগে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে।ধপ করে চেয়ারে বসে যায়।কাঁচের কৌটা নিয়ে কোলে রাখে।এ মুহুর্তে অভ্রকে দেখার জন্য প্রেমার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
বারান্দার পাশে রয়েছে বড় একটা গাছ-বাগান। দূর থেকে গাছের সাথে ঠেসে দাড়িয়ে প্রেমার কর্মকান্ড দেখতে ব্যস্ত অভ্র। প্রেমার চোখ-মুখের মলিনতার কারণ সে নিজেই; ভাবতেই শরীরটা শিউরে উঠে। ওরনা ছাড়া প্রেমাকে আজ প্রথম দেখছে অভ্র।
যেনো সদ্য কিশোরীরুপে পদার্পণ করেছে। মশৃণ গাল দু'টো অল্প আলোতেও খুব পরিপক্ক ভাবে দেখা যাচ্ছে।
দূর থেকে এই দৃশ্যটাও অভ্র ক্যামেরা বন্ধি করে ফেলে।
নিজের প্রলুদ্ধ দৃষ্টি সরানোর বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই তার।মনেমনে পণ করে ফেলে যতক্ষণ পর্যন্ত প্রেমা চলে যাবেনা,ততক্ষণ পর্যন্ত অনড় দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থাকবে।
গরমে শরীর ভিজে কাহিল অবস্থা অভ্রের।আসমানি রঙের টি-শার্ট ভিজে যায়।বাধ্য হয়ে খুলে ফেলে। পাশে একটা বসার জায়গা পেয়ে সেখানে বসে যায়। দু'হাত দু'গালে দিয়ে প্রেমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেমার দৃষ্টি এখনো সেই কৌটার দিকে।
বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে অভ্রের। কারন প্রেমার ঘুমন্ত মুখ আরো বেশি ভয়ংকর সুন্দর দেখাচ্ছে। আরো একটু কাছে গিয়ে প্রেমাকে দেখতে শুরু করে। বারান্দাটা মাটির সাথেই যুক্ত।যার ফলে আরো ভালোকরে দেখার সৌভাগ্য হয় অভ্রের।
"আকুলতা ব্যাকুলতা শুধুই কী আমার হয়?তোমার হয়না? আমার বুকের মধ্যাকার হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক গতিবেগ, তোমার মধ্যেও কী অনুভব হয়? দেখো
"আমি-তুমি" এতো সহজে এক হবো না। যে চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে কষ্ট থাকবে না। সে অনুভূতির মর্ম কখনোই বুঝবে না।" (অভ্র)
নিজমনে কথাগুলো বলে অভ্র পাশ থেকে একটা ঢিল নিয়ে বারান্দার ফুলের টবের দিকে ছুড়ে মারে। সাথে সাথে প্রেমার ঘুম ভেঙে যায় এবং ধড়ফড়িয়ে উঠে যায়।দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখে নেয়।
রাত বারোটা। চোখ তো ছানাবড়া। এতোক্ষণ সে এখানেই ঘুমিয়েছে।ভাবতেই গা চমচম করে উঠে।এদিক-ওদিক না তাকিয়ে কাঁচের কৌটাগুলো নিয়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।এসব কান্ড যে অভ্রের ছাড়া অন্য কেউ করবেনা সেই ব্যাপারো সে নিশ্চিত।
প্রেমার কার্যকলাপে অভ্র হেসে দেয়। নিরব থেকেও অনেক কিছু করা যায়।যা সে প্রেমাকে নিজের মনে জায়গা দেওয়ার পর উপলব্ধি করেছে।
_________________
সকাল থেকেই প্রেমাদের বাড়িতে সবাই ব্যস্ত হাতে কাজ কর্ম করছেন।বাবা আর ভাই বাজার করে এনেছে,ভাবি বাড়িঘর পরিষ্কার এবং সাজাচ্ছে,আর মা রান্না করছে।
প্রেমা আর প্রিয়া সোফায় বসে সব দেখছে।প্রেমা এবার বিরক্ত হয়ে প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,
"হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছে বাড়িতে কোনো মেহমান আসছে,তাই না? (প্রেমা)
" হ্যাঁ,আমারও।(প্রিয়া)
"কে আসতে পারে বলতো? (প্রেমা)
" জানিনা তো ফুফি।(প্রিয়া)
হতাশার শিষ তুলে টিবিতে মনোযোগ দেয় প্রেমা আর প্রিয়া। কাল রাতের কথা প্রেমা সব ভুলেও গিয়েছে।
সকাল সকাল আদ্র আর অভ্র ক্রিকেট খেলছে। দু'ভাই বেশ সুন্দর করে খেলছে। তখনি ব্যাগাত ঘটায় আরিয়ান।
'আদ্র যা তো ছোটমা ডাকছে তোকে।(আরিয়ান)
আরিয়ানের কথায় আদ্র দ্রুত চলে যায়।বড় হিসেবে শ্রদ্ধ করে বেশ আরিয়ানকে।কিন্তু অভ্রের চোখে মুখে বেশ বিরক্তির চিহ্ন ফোটে উঠেছে। এ মানুষটা তার দু'চোখের বিষ। আরিয়ান অভ্রের সাথে কথা বলতে নিবে তার আগেই অভ্র বেট নিয়ে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে।
"অভ্র শুন? (আরিয়ান)
আরিয়ানের ডাকে অভ্র দাড়ালেও পেঁছন ফিরেনি।তাই আরিয়ান লম্বা পায়ে হেঁটে অভ্রের সামনে এসে দাড়ায়।
অভ্র চোখ তুলে আরিয়ানের দিকে তাকায়।
" ধন্যবাদ অভ্র,তোকে অনেক ধন্যবাদ।"(আরিয়ান)
আরিয়ানের কথার প্রতিউত্তরে মাথা নাড়িয়ে অভ্র বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় আবারও। আর অভ্রের লাল লাল ঠোঁটে মৃদু হাসি। যা আরিয়ানের দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যায়।