১১!!
সূর্য্যি মামা পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়েছে কতক্ষণ হলো কে জানে। এর মধ্যেই ভোরের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ঠিক ঘুম ভাঙ্গে নি, সারা রাতের ছাড়া ছাড়া ঘুমের পর এখন রোদের চলে যাওয়ার কথাটা আরো বেশি করে ঘুরঘুর করছে ভোরের মাথায়। ভোরের বারবার মনে হচ্ছে ও একবার ঘুমিয়ে পড়লেই রোদ চলে যাবে, ছোটোবেলায় যেমন ভোর ঘুম ভাঙলে আর রোদের দেখা পেত না, ঠিক তেমন করে। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর ভোর বিছানা ছাড়লো। ঘুম যখন আসবেই না তখন শুয়ে থেকে তো কোনো মানে নেই। এর চেয়ে রোদকেই আটকানো যাক। যেই ভাবা সেই কাজ ভোরের। পড়নের শাড়িটা বদলে নিয়ে একটা থ্রিপিস পড়ে ফ্রেশ হয়ে পা টিপেটিপে রোদের রুমে চলে এলো ভোর। দরজায় দাঁড়িয়ে ভোর কয়েক মূহুর্ত চিন্তা করে হাতল ঘুরাতেই টুক করে দরজা খুলে যেতেই মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠলো ভোরের ঠোঁটের কোণে। কেউ চলে আসার আগেই রোদের রুমে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ভোর। রোদের বিছানার দিকে চোখ পড়তেই চোখ আটকে গেল ভোরের। রোদ উপুড় হয়েই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। এভাবে খালি গায়ে ঘুমাচ্ছে কেন লোকটা! কথাটা ভাবতে ভাবতে বিছানার কাছাকাছি আসতেই হাতে একটা টান খেয়ে বিছানায় রোদের বুকের উপরে এসে পড়লো। ভোর চোখ বড় বড় করে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। রোদ তো উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল! তাহলে ভোর রোদের বুকে আসলো কি করে? তার উপরে লোকটার চোখ তো এখনো বন্ধ! জেগে আছে নাকি লোকটা? নাকি ঘুমের ঘোরেই---?
-এখন সময় হলো তোর আসার? আমাকে সারা রাত জাগিয়ে রেখে এখন এসেছিস সোহাগ দেখাতে? তোর এমন নকল সোহাগ আমার চাই না। যা বের হ আমার রুম থেকে।
-ওমা! সারা রাত জেগেছিলে কেন? ঘুমাও নি কেন? আচ্ছা সরি তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব করেছি--। ছাড়ো আমি রুম যাবো----।
-হ্যাঁ যাবিই তো। থাকবি কেন তুই? আমার কাছেই এলেই তো তোর পালানোর জন্য ছটফটানি বেড়ে যায়। এ আর নতুন কি?
-সরি তো। তুমি ঘুমাও এখন। সবে ভোর হয়েছে----।
-ভোর তো আমার অনেক আগেই হয়ে গেছে রে ভোরপাখি। তুই ই আমার কাছে আসতে দেরি করে ফেললি।
-কি?
-ঘুমাতে দে তো। এতো জ্বালস কেন তুই আমাকে? শান্তিতে একটু ঘুমাতেও দিস না। উফ! একবার তোকে নিজের করে পাই। তারপর আমিও তোকে বোঝাবো ভোর জ্বালানো কাকে বলে। আর সারা রাত ধরে জাগিয়ে রাখাই বা কাকে বলে।
-যাও! কিসব বলে সবসময়?
ভোরের লজ্জামাখা কণ্ঠটা শুনেই রোদ গড়িয়ে গিয়ে ভোরকে বিছানায় ফেলে ভোরের বুকে মাথা রাখলো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো যে ভোর নিজেকে ছাড়ানোর সুযোগও পেল। রোদ নিজের মাথাটা ভোরের বুকে রেখে ভোরকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজেই আছে এখনো। ভোর কিছুক্ষণ থতমত খেয়ে শুয়ে থেকে রোদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। রোদ এবারে ভোরের বুকে নাক ডুবিয়ে ভোরের মিষ্টি ঘ্রাণ নিলো। ভোর লজ্জা পেয়ে সরে আসার চেষ্টা করতেই রোদ ভোরের কোমড় পেঁচিয়ে আটকালো।
-সারা রাত ধরে কতো স্বপ্ন বুনেছি নির্ঘুম এই দু চোখের পাতায় জানিস? আমার ছোট্ট ভোর পাখিটাকে নিয়ে, আর আমাদের ছোট্টছোট্ট গোলুমলুদেরকে নিয়ে। আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন। আমার কিন্তু সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত সবাইকে চাই। বুঝেছিস? এনে দিবি ভোর পাখি?
-সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত! এগুলো আবার কি?
-আমাদের গোলুমলু বাচ্চাগুলোর নাম। সুন্দর না বল?
-কি!
-আরে! এভাবে অবাক হচ্ছিস কেন? আগে এই বাচ্চাটা তো বড় হোক। তারপর অনেকগুলো আদর দিবো আমার ভোরসোনাকে। আর বিনিময়ে ভোরপাখিটা আমাকে আমার ভালোবাসার উপহারগুলো এনে দিবে। কি বলিস ভোর? দিবি তো?
রোদের কথায় ভোরের লজ্জায় দম আটকে আসার জোগাড় হলো। রোদ ভোরের বুকে মাথা রেখেই ঢিপঢিপ শব্দটা শুনতে পেল। ভোরের বুকের ধুকপুকানির শব্দটাও যেন কিসের একটা মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে রোদের সমস্ত সত্তা জুড়ে। রোদ কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করে মুখ তুলে ভোরের লজ্জা রাঙা মুখটার দিকে তাকালো। রোদের সাথে চোখাচোখি হতেই ভোর চোখ বুজে নিয়েছে দেখে রোদ ছোট্ট করে একটা চুমু এঁকে দিলো ভোরের রক্তিম ঠোঁটজোড়ায়।
-তুই এমন লজ্জা পাচ্ছিস যে মনে হচ্ছে আমি এখনই চাইছি আমার বাবুগুলোকে। এখনই না তো বাবা। আগে বাবুগুলোর আম্মুটা একটু বড় হোক। নইলে এই বাচ্চাটা আমার দু্ষ্টু বাচ্চাগুলোকে সামলাবে কি করে হুম?
-রোদ----। আমমম। তুমি--তুমি ঘুমাও। আমি---আমি যাই এখন। সবাই উঠে পড়েছে এতোক্ষণে----।
-ইশ! বউটাকে একটু কাছে পেলেই ওমনি এ চলে এসেছে, সে চলে এসেছে এই ভয়টা থেকেই যায়। ধ্যাত। একদিন এই বাড়ি আর এই ভয়-দুটো থেকেই আমি আমার বউটাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো। সেদিন কে আসে আমিও দেখবো---।
-কোথায় যাবে?
-এখন বলা যাবে না। যখন যাবো তখন দেখিস। এখন যা ভাগ। এতো ভোরে আমার রুমে কি তোর?
-না মানে----।
-কি জন্য এসেছিস বল তাড়াতাড়ি। তোর এতো মানে মানে শোনার সময় নেই আমার। ঘুম পাচ্ছে ভিষণ।
-না মানে---। আসলে---। কাল তো আমার জামাটা তোমার রুমে রয়ে গেছিল। জামাটা নিতে এসেছি----।
-ওহ! জামার জন্য এসেছিস! কেন রে তোর কি জামার অভাব পড়েছে? ওই জামা আর পাবি না। ভাগ এখন।
-দাও না রোদ ভাইয়া? ওটা আমার সব থেকে ফেভারিট জামা। দাও না প্লিজ প্লিজ প্লিজ?
-ফেভারিট না কি সেটা আমার রুমে রেখে যাওয়ার আগে ভাবার দরকার ছিল। এখন যা সামনে থেকে---। কানের সামনে ঘ্যান ঘ্যান করবি না বলে দিলাম ভোর---।
-কিন্তু আমার জামাটা---?
-সেটা আজ থেকে আমার সম্পত্তি।
-আমার জামাটা তো এই এতোটুকু। তুমি তো পড়তেও পারবে না। আর পড়বেই বা না কেন?
-কি বললি তুই? আমি কি তোর জামা পড়বো বলে রাখছি? আজব! এই তুই যা তো। যা।
রোদ রাগে লাল হয়ে ভোরকে বিছানা থেকে ঠেলে নামিয়ে দিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইলো। ভোর থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ রোদের দিকে তাকিয়ে থেকে এবারে একটু অভিমান করে উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটা ধরলো। এভাবে ঠেলে বিছানা থেকে নামিয়ে দেয়া না! আসবোই না আমি আর। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ভোর দরজার কাছে পর্যন্ত এসেই রোদের ডাক শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
-বউ? একটু এদিকে এসে তো? একটু আদর করে দিয়ে যাও। ঘুমাবো কিছুক্ষণ।
-হুম?
-ও বউ? কি হলো এসো না? আমি উঠতে হলে কিন্তু---।
রোদের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ভোর গুটিগুটি পায়ে রোদের বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। রোদ এবারে চোখ মেলে কিছুক্ষণ ভোরকে দেখে হাত বাড়িয়ে ভোরকে নিজের কাছে টেনে নিলো। ভোর কিছু বলার আগেই রোদ ভোরের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়ে একটু পরে আবার সরে এসে ভোরের হাতটা ছেড়ে দিলো। ভোর তখনও চুপচাপ রোদের বুকে শুয়ে আছে দেখে রোদ হেসে ভোরের চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে বিলি কেটে দিলো কিছুক্ষণ।
-ভোর পাখি? অনেক তো ভালোবাসাবাসি হলো। এবার যাও। লক্ষী মেয়ের মতো নাস্তা করে নাও। কেমন?
-হুম।
-তার আগে কাবার্ড থেকে তোমার গিফ্টটা নিয়ে যাও।
-গিফ্ট! কিসের?
-কাল তো বউয়ের ফেভারিট একটা জিনিস নষ্ট করে দিয়েছিলাম। সেটার জরিমানা।
-কি?
-গিয়েই দেখো---।
-হুম।
-আর খবরদার তোমার ড্রেসটায় যদি হাতও লাগিয়েছ। তাহলে কিন্তু যেটা পড়ে আছো সেটা নিজেই খুলে নিবো। আর সেটা এখনই----।
ভোর চোখ বড় বড় করে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কি বলছে লোকটা এসব। রোদ ততক্ষণে আবার চোখ বুজেছে। ঠোঁটের কোণে আবার তার দুষ্টু হাসিটা খেলা করছে দেখে ভোর তাড়াতাড়ি সরে এলো রোদের বুকের উপর থেকে। রোদের কথাগুলোয় লজ্জায় লাল হতে হতে কাবার্ড খুলে সত্যিই একটা শপিংব্যাগও পেয়ে গেল ভোর। আর ব্যাগটা একটু খুলে ভিতরে উঁকি দিতেই হা হয়ে গেল ভোর।
-একটার বদলে চারটা। কি বলিস? লাভ হলো নাকি লস?
-হ্যাঁ? এতোগুলো টিশার্ট কেন?
-চারটা টিশার্টেই আমার গন্ধ মেখে দিয়েছি তোর জন্য। আমি যতদিন থাকবো না ততদিন আমার পড়া এই টিশার্ট থেকেই নাহয় আমার ঘ্রাণ নিস। কেমন?
-হ্যাঁ?
-তোর ঘ্রাণ নেয়ার জন্য তোর ড্রেসটা আমার কাছেই থাক। তোকে তো পাবো না। তোর জামাটা নাহয় নিজের কাছে রাখি। কি বলিস? যেদিন তোকে পেয়ে যাবো সেদিন আবার ফিরত দিয়ে দিবো নাহয়। এখন আর বকবক করিস না। নাস্তা করে পড়তে বস।
-হুম-----।
রোদের রুম থেকে এক ছুটে নিজের রুমে চলে এসেছে ভোর। নিজের অনুভূতিগুলো নিজের কাছেই এলোমেলো লাগছে ভোরের। কেমন একটা নির্লজ্জতা এসে ভর করেছিল যেন ভোরের মধ্যে তখন! নইলে কি করে রোদকে ওমন করে জড়িয়ে ধরেছিল! কেমন করে রোদের কথাগুলো শোনার পরও লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যায় নি! নতুন করে লজ্জার রঙ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ার আগেই ভোর রোদের দেয়া টিশার্টগুলো একসাথে বুকে চেপে ধরলো। টিশার্টে লেগে থাকা ঘ্রাণের সবটুকুতেই মিশে আছে ভোরের রোদ। আর সম্ভবত ভোর নিজেও তাই টিশার্টগুলোর প্রত্যেকটা সুতোয় নিজেকে মিশিয়ে নিতে চাইছে। কারণ রোদের এই ঘ্রাণটুকুর উপরেও শুধু ভোরের অধিকার। শুধুমাত্র ভোরের।
১২!!
-রোদ এখনো ওঠে নি? আমরা বের হবো কখন? কেউ রোদকে উঠতে বলো। এমনিতেই আমার দেরি হয়ে গেছে। অফিসে জরুরি মিটিং আছে। লাটসাহেব তো আর অফিসে যাবে না বলে দিয়েছে।
নাস্তার টেবিলে বসে বড় আব্বুর কথাগুলো শুনে ভোরের গলা শুকিয়ে এলো যেন। তবু কোনমতো নিজের ভয়টা কে নিজের মনেই চাপা দিয়ে প্লেটের নাস্তাটুকু নাড়াচাড়া করতে করতে বড় আব্বুর মুখের দিকে তাকালো। রোদের বাবা কিছুটা বিরক্ত মুখ নিয়ে খাবার মুখে দিচ্ছেন আর একটু পর পর গ্লাস থেকে এক চুমুক করে পানি খাচ্ছেন। ভোর একটু ভয়ে ভয়ে নজর ঘুরিয়ে বড় আম্মু আর নিজের বাবা মাকে একবার দেখে মুখ নিচু করে নিলো।
-বড় আব্বু তোমরা কতদিন পরে এলে। আর এখনই চলে যেতে চাইছ? এসব আমি মানবো না। তোমাদের কোথাও যাওয়া চলবে না।
-ভোর মামনি। বড় আব্বুর আজকে অনেক জরুরি মিটিং আছে। আর তোর বড় আম্মু না গেলে চলবে কি করে বল তো?
-তাহলে রোদ-রোদ ভাইয়া থাকুক না। ভাইয়ার তো এখন কাজ নেই কোনো।
রোদের বাবা মুখ তুলে ভোরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই এবারে রোদের মা একটু হেসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
-তাই তো। রোদের তো এখন বাড়িতে তেমন কোনো কাজ নেই। অফিসেও যাবে না। যাওয়ার আগে কয়টা নাহয় এখানেই থাকুক।
-কিন্তু---। ওর তো শপিং করতে হবে--। গোছগাছ করা বাকি এখনো। কবে---।
-এখান থেকে শপিং করা যাবে না নাকি? সেসব রোদ দেখে নিবে। আমরা তো থাকতে পারবো না। অন্তত রোদ থাকুক। তাহলে ভোরেরও ভালো লাগবে। কি বলিস ভোর?
ভোর এতোক্ষণে বড়আম্মুর মুখে হাসি ফুটতে দেখে থতমত খেয়ে গেছিল। কোথা থেকে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। এবারে বড় আম্মুর প্রশ্নে ভোর মুখ তুলে তাকালো ভোর।
-হ্যাঁ? হ্যাঁ বড় আম্মু।
-হয়েছে। ডিস্কাশন শেষ এখানেই। আমরা এক্ষুণি বের হবো। রোদ থাকুক কয় দিন। তুমি আর না করো না তো। তোমার মিটিংয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে না এখন? আমিও বাড়িতে ফিরবো তো-----।
রোদের বাবা একনজর ভোরের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের খাওয়া শেষ করায় মন দিলো। ভোরও নিজের খাওয়া শেষ করে রোদের বাবা মায়ের যাওয়ার সময় পর্যন্ত বসে রইলো ডাইনিং রুমেই। উনারা দুজনে গাড়িতে করে কিছুটা দূরে চলে যাওয়ার পর ভোরও নাচতে নাচতে দোতলার দিকে ছুটলো।
এদিকে রোদের বাবা মা দুজনেই গাড়িতে বসে আছেন। মায়ের ঠোঁটের কোণে হাসি আর ফুটে আছে আর বাবার চোখে রাগ। রাগটা কার উপরে সেটা বোঝা না গেলেও স্বামীর এমন থমথমে মুখের দিকে নিরবে হাসছেন শায়লা রহমান।
-তোমার ভিষণ হাসি পাচ্ছে তাই না শায়লা? কাজটা কি ঠিক করেছ মনে হয় তোমার?
-অবশ্যই। তাছাড়া তুমি নিজেই তো বলেছ ভোর যা চায় তাই হবে। ভোর চাইছে রোদ ওর সাথে থাকুক। তাই আমি তোমার কাজটা একটু সহজ করে দিলাম। ভালো করেছি না বলো আতিক?
আতিক আহমেদ এতোক্ষণে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তার চোখের দৃষ্টিটা এবারে কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে।
-তুমি থেকে গেলে না কেন? সারাদিন তো বাসায় বোর হয়ে যাবে একা একা? এখন তো তোমার ছেলেও ওই বাড়িতে-----।
-একচুয়েলি কি বলো তো? আমি ওদের মাঝে আসতে চাইছি না। বুঝলে? ওরা কিছুদিন নিজেরা নিজেদেরকে বুঝে নিক। ভালো হবে না সেটা?
-যত চেষ্টাই করো না কেন রোদকে আমস্টারডামে যেতেই হবে। সেটা কেউ আটকাতে পারবে না। তুমিও না।
-আমি জানি পারবো না। কিন্তু যে আটকাতে পারবে তাকে সুযোগটা আমি করে দিতে চাই। যাতে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আশা রাখতে পারি যে তোমার জেদের কারণে আমার ছেলেটা এতো দূরে চলে যাবে না।
-বৃথাই চেষ্টা করছ শায়লা। এর চেয়ে নিজের মনকে শক্ত করো।
-রোদকে দু-আড়াই বছরের জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর পরও তো তুমি থেমে থাকবে না তাই না? তুমি অন্য কিছু ভাববে যাতে রোদ দেশে ফেরার আগেই তুমি ভোরকে অন্য কোথাও পাঠাতে পারো। তাই না? আমি জানি না ভেবেছ? সেটা হচ্ছে না।
-দেখা যাক কি হয়। তোমরা তোমাদের মতো চেষ্টা করো। আমি আমার মতো। দিন শেষে বিজয়ীর হাসিটা কে হাসে দেখা যাক----।
এদিকে রোদের রুমের দিকে পা বাড়িয়েও থেমে গেছে ভোর। ছেলেটা সারা রাত ঘুমায় নি। এখন অন্তত কিছুক্ষণ ঘুমাক। ঘুম ভাঙলেই তো আবার ভোরকে নিয়েই পড়বে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে ভোর নিজেও। সারা রাতের ছাড়াছাড়া ঘুমের পর এখন যেন শান্তিতে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল মেয়েটা। কতোক্ষণ পরে ভোরের ঘুমটা ছুটে গেল কে জানে! শরীরটা হঠাৎ করেই কেমন ভারি ভারি লাগছে ভোরের কাছে। আর গলার কাছে অনুভব হচ্ছে কারো গরম নিঃশ্বাস। মনে হচ্ছে কেউ ভোরের উপরে শুয়ে গলায় মুখ গুঁজে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে। এতো সাংঘাতিক একটা অনুভূতি হওয়ার পরও ভোর চোখ মেলে মানুষটাকে দেখতে পারছে না। মেয়েটার দু চোখের পাতা যেন একে অন্যকে জাপটে ধরে অন্য কোনো দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে। কারো দুষ্টুমি মাখা স্পর্শও চোখের পাতা জোড়াকে আলাদা করতে পারছে না তাই। আরে কিছুক্ষণ পরে গলায় কেউ গভীর আদরে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই ভোর ঘুমের ঘোরের মধ্যেই লাফ দিয়ে উঠলো। ভোরের এমন আঁতকে ওঠা দেখেই পাশের মানুষটা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা হয়েছে ততক্ষণে। ভোর থতমত খেয়ে তার হাসিমাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মানুষটা ভোরকে নিজের বুকে টেনে নিলো এবারে।
-কি মড়ার মতো ঘুমাচ্ছিস রে ভোর? কতোক্ষণ ধরে ডাকছি তোকে? উঠছিসই না তুই? আমাকে কি আটকে রেখেছিস তোর ঘুমের পাহারা দেয়ার জন্য?
-তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে---। তা আমিও এসে ঘুমিয়ে পড়েছি---।
-তোকে না নাস্ত করে পড়তে বসতে বলেছিলাম? তার কি হলো?
-পড়া তো হয়েছে। আর কয়বার রিভাইস করব? এক পড়া এতোবার পড়া যায় তুমি বলো?
-ইচ্ছে করলেই যায়। একজনকে যদি হাজার হাজার দিনে হাজারটা নতুন রূপে দেখে নতুন ভাবে ভালোবাসা যায়, হাজার বার যদি তার ভালোবাসায় পাগল হওয়া যায়, তাহলে এক পড়া কয়েকবার পড়া যাবে না?
-কে হাজার হাজার বার ভালোবাসলো! কাকে?!
-সেসব তোর না জানলেও চলবে। এখন বল তো আমাকে কি মনে করে রেখে দিলি? আমার কি তোর মতো কোনো কাজটাজ নেই নাকি?
-কাজ থাকলে থাকুক। আমার কি? তুমি যেতে পারবে না ব্যাস।
-আচ্ছা! বাচ্চাটা এতো জেদ করে আমাকে আটকাচ্ছে কেন বল তো?
-বাচ্চাটা চায় তুমি তার পাশে থাকো। সবসময় থাকো।
-আচ্ছা? তাই নাকি? তো থাকলে কি হবে?
-এতো কিছু আমি জানি না। থাকতে হবে। আর কোথাও যাওয়া চলবে না।
-কেন যাবো না তার কারণ যদি বলতে পারিস তাহলে যাবো না।
-আমি যে তোমাকে যেতে বারণ করছি সেটাকে কারণ মনে হচ্ছে না তোমার?
-না হচ্ছে না। বারণ করছিস যেতে। কিন্তু কেন বারণ করছিস সেটা তো বলছিস না। যখন সেই কারণটা বলতে পারবি তখন ভেবে দেখবো যাবো কি না----।
-আমি তো-------।
-এখন বকবক না করে ফ্রেশ হয়ে এসে পড়তে বস। আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমালাম----।
-এখানে পড়তে বসবো?
-তো কি পড়তে বসার জন্য অন্য কারো বাসায় যাবি? আজব! তুই এতো বকবক করিস কেন রে ভোর?
-তুমি না বলেছিলে রুমে পড়তে না বসতে। যেন ড্রইংরুমে-----।
-নিয়মটা কি আমার জন্য ছিল নাকি তোর স্যারদের জন্য?
-ওহ!
-তুই কি ফ্রেশ হতে যাবি ভোর? নাকি আমি উঠবো?
-এই না না। যা-যাচ্ছি তো। তুমি ঘুমাও।
ভোর ফ্রেশ হয়ে হাত মুখ মুছে একটা বই নিয়ে বিছানায় এসে বসলো। পাশেই রোদ ঘুমিয়ে গেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। না চাইতেও একটু পর পরই ভোরের চোখ চলে যাচ্ছে রোদের দিকে। লোকটার ঠোঁটের কোণে কি দুষ্টু হাসিটা এভাবে সবসময় ফুটে থাকে? নাকি ভোরকে জ্বালাতন করতে ঘুমের মাঝেও তার ঠোঁটের কোণে এই হাসিটা লেগেই থাকে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হাতে একটা টান পড়তেই ভোর এসে রোদের বুকে লুটিয়ে পড়লো। আর রোদও চোখ বুজে থেকেই ভোরের ঠোঁটজোড়া নিজের ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিয়ে একটু পরেই ছেড়ে দিলো। রোদের হাতের আর ঠোঁটের বাঁধন হালকা হয়ে এলেও ভোর রোদের উপরেই পড়ে রইলো। প্রিয় মানুষটার বুক থেকে সরে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও নেই ভোরের।
-আদর খাওয়া হয়ে গেছে না? এবার আমাকে নিয়ে গবেষণা বন্ধ করে পড়তে বস তো ভোর। কাল টেস্টে কি লিখবি সেটা নিয়ে তো আমার চিন্তা হচ্ছে----।
-হুম?
-আরে বাবা! পড়তে বসতে বলেছি। আমার বুকে লুকিয়ে থাকতে বলি নি তো তোকে।
-উঁহু। উঠবো না।
-তোর মাথাটা তো দেখছি সত্যিই গেছে রে ভোর। বাবা তো দেখছি ঠিকই বলেছে আমি থাকলে তোর পড়া আসলেই হবে না।
-না হোক। এখন চুপ করে ঘুমাও তো।
-এই কি বললি? তুই ধমকাচ্ছিস আমাকে? তোর সাহস তো কম না ভোর?
-তুমিও তো বকছ আমাকে। আমি তো পড়ছিলাম। তুমিই তো আমাকে টেনে নিলে। আবার নিজেই এখন ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছ! এমন করো কেন সবসময়? হুহ।
-তুই বুঝি সত্যিই পড়ছিলি? চোখ বুজে আছি বুঝলি। কিন্তু তোর প্রত্যেকটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমি মিশে আছি। তুই কি করছিস, কি ভাবছিস সেটা আমি চোখ বুজেও টের পাই বুঝলি? এখন বকবক না করে পড়। পড়া শেষ হলে একটা স্পেশাল গিফ্ট আছে তোর জন্য।
-কি গিফ্ট! বলো না রোদ ভা----। প্লিজ বলো না?
-ভোর? তোকে পড়তে বলেছি। এতো কথা বললে আমি কিন্তু এক্ষুণি চলে যাবো----।
-হুহ-----। যাও না। ধরে কে রেখেছে?
ভোর একটু ঠোঁট বাঁকিয়ে রোদের উপর থেকে সরে এসে নিজের পড়ায় মন দেয়ার চেষ্টা করলো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চোখ চলে যাচ্ছে রোদের মায়াকাড়া মুখটার দিকে। আর সেটা বুঝতে পেরেই রোদের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসিটা আরো কিছুটা ঘন হচ্ছে। সেটা ভোরের চোখে পড়ছে কিনা কে জানে!