আড়ালে আবডালে - পর্ব ১৭ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


নিষ্প্রতিভ আবেদন আমানের। যা নিহিকে চুম্বকের আকর্ষণের মতো আকর্ষিত করছে। অথচ নিহি চাইছে না আর কারো দ্বারা আকর্ষিত হতে। আর কেই বা চায় বারবার বিশ্বাস করে ঠকতে? ফোনের রিংটোন তখনো বেজে চলেছে। অপর দিকে পুরো দুটি অচেনা মানুষ দুজন দুজনের দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে আছে। একজনের চোখে ঘোর তো অন্যজনের চোখে বিস্ময়। আমান নিহির চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
"আপনার ফোন বাজছে। কথা বলুন।"

এতটুকু কথা বলেই আমান আবার তৈরি হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমানের ঐ এক লাইনের কথার ঘোর নিহির কাটেনি এখনো। কেন করবে সে এমন আবেদন? কে সে? 'কে সে?' প্রশ্নটা করে যেন নিহি নিজেই থমকে গেল। নিহি কি সত্যিই জানে না সে কে? সে তো নিহির স্বামী। স্বামী! আচ্ছা, চাইলেও কী এই সম্পর্ক থেকে বের হওয়া এত সহজ হবে? হবে। হতেই হবে। নিজের জন্য তো অন্য কোনো মেয়ের ক্ষতি করা যায় না। তাছাড়া নিহি তো আর কারো দয়ার পাত্রী নয়। হতেই পারে সে নিহিকে দয়া করেই কথাটা বলেছে। নিহি কথাটা নিয়ে নিজেকে আর না ঘাঁটিয়ে ফোনটা রিসিভ করে। উপমা ফোন করেছে। নিহি ফোন রিসিভ করে বলে,
"বল।"
"কোথায় তুই? এখনো কলেজে আসিসনি কেন?"

নিহি ভাবছে, এতকিছু ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কি ফোনে বলা ঠিক হবে? না, হবে না। উল্টো উপমা প্রশ্ন করে করে মাথা খারাপ করে ফেলবে। সময় নিয়ে, মাথা ঠান্ডা করে বলতে হবে সব। ওপাশ থেকে উপমা তখনো হ্যালো হ্যালো করছে।
"ঐ কথা বলছিস না কেন?" জিজ্ঞেস করে উপমা।
"আজকে কলেজে আসব না রে। আপুর বাসায় আছি এখন।"
"ধ্যাত! আগে বলবি না? এখন একা একা ক্লাস করতে হবে আমায়।" বিরক্তিতে নাকমুখ কুঁচকে আসে উপমার।

"ঢং! যেন আমি একা ক্লাস করিনি কখনো। ঠিক হয়েছে। বেশ হয়েছে। একা ক্লাস করে দেখ কেমন লাগে।"
"তোর মাথা।"
উপমা রাগ দেখিয়ে ফোন কেটে দেয়। নিহি হাসে। আয়নার মাঝেই আমান দেখতে পায় নিহির শব্দহীন হাসি। কেন জানি আমানের ইচ্ছে হলো এই হাসি মুখটাকে একটু রাগিয়ে দেখতে। স্যুট পরতে পরতে আমান বলে,
"আগে শুনেছি, মানুষ নাকি প্রেমে পড়লে মিথ্যা বলে। এখন দেখছি, বিয়ে করলেও মিথ্যে বলে।"

নিহি কপাল কুঁচকে বলে,
"মানে?"
"মানে এইযে, আপনি তো আপনার আপুর বাসায় না এখন। তবুও বললেন যে, আপনি নাকি আপনার আপুর বাসায়।"
"হ্যাঁ, বলেছি। তো কী হয়েছে?"
"কিছুই হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। বিয়ে তো মাত্রই হলো তাই না?"

আমানের চোখেমুখে দুষ্টুমির ছাপ। আমান যে কী ইঙ্গিত করেছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না নিহির। আমানের এহেন কথাবার্তা, দুষ্টুমি কোনোটাই নিহির পছন্দ হয় না। বরং রাগকে কন্ট্রোলের বাহিরে নিয়ে যায়। নিহি কাঠখোট্টাভাবে উত্তর দেয়,
"নিজের সীমার মধ্যে থাকুন। আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলার অধিকার কোথায় পান আপনি? এখন হয়তো বলবেন, আমি আপনার বউ। তাহলে আমি বলব, আমি এই বিয়ে মানি না। এটা কোনো বিয়েই নয়। টোটালি একটা এক্সিডেন্ট। তাই পরেরবার থেকে এসব কথা আর বলবেন না। এটা ভাববেন না যে, আপনার কাছে থাকছি মানে আপনাকে আমি স্বামীর অধিকার দিয়েছি।"

কথাগুলো বলে অন্যদিকে মুখ করে তাকায় নিহি। আমান এতক্ষণ চুপচাপ নিহির কথা শুনছিল। প্যান্টের পকেটে দু'হাত পুরে, ঘাড়টা এদিক-ওদিক কাত করে বলে,
"দেখুন, আমি খুবই শান্তশিষ্ট একটা মানুষ। আমার দ্বারা ঝগড়া করা সম্ভব নয়। তাই ঝগড়া করার ইচ্ছে থাকলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখিয়ে ঝগড়া করেন। আমার অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসি।"

নিহি একদম হা হয়ে যায়। নিহির এত কড়া কড়া কথাও আমানকে তার জায়গা থেকে বিন্দু পরিমাণ টলাতে পারেনি। আমান অফিসে চলে যাওয়ার পর নিহি বিছানায় বসে পড়ে। মাথার চুল শক্ত করে ধরে টানতে থাকে। মাথা ফাঁকা হয়ে আছে। কী করবে, না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। নিহি বিছানা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে যায়। পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে। এই এপার্টমেন্টে মোট তিনটে রুম আছে। বাড়িটার রং সাদা। প্রত্যেকটা ফার্নিচার সেগুন কাঠের। এবং প্রতিটা রুমই সুন্দর করে সাজানো। কোনো রুচিশীল মানুষ ব্যতীত এত সুন্দর করে সাজানো সম্ভব নয়। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখে ফ্রিজ পুরো ফাঁকা। শুধু ডীপে মাছের কয়েকটা প্যাকেট রয়েছে। এই মানুষটা খায় কী কে জানে। অফিসেও গেল না খেয়ে। থাকুক, না খেয়ে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার পেট যে ক্ষুধায় এখন চো চো করছে। আপুর বাসায় গিয়েই বরং খেয়ে আসি।

মিহির বাসায় যাওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতেই কলিংবেল বাজে। নিহি দরজা খুলে দেখে বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড। হাতে অনেকগুলো খাবার প্যাক করা। ফুড পাণ্ডার সিলমোহর থেকে বুঝা যায় ফুড পাণ্ডারে অর্ডার করা হয়েছিল। নিহি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সিকিউরিটি গার্ড খাবারগুলো নিহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
"স্যার অর্ডার করেছিল।"
"আমার জন্য?" নিজের দিকে আঙুল তাক করে প্রশ্ন করে নিহি।
সিকিউরিটি গার্ড হেসে দিয়ে বলে,
"আপনি ছাড়া আর কে আছে? আপনার জন্যই অর্ডার করেছে।"

নিহিকে খাবারগুলো দিয়ে গার্ড চলে যায়। নিহি দরজা লক করে দিয়ে খাবারগুলো ডাইনিং টেবিলে রাখে। এই মুহুর্তে আমানকে নিয়ে মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্নকে প্রশ্রয় দিলে এখন চলবে না। বরং ক্ষুধা মেটাতে হবে। খাওয়া শেষ করে নিহি ঢেঁকুর তোলে। তখনই আবার কলিংবেল বেজে ওঠে। নিহি আগে পানি পান করে। তারপর দরজা খুলে দেয়। মিহি এসেছে। কোলে বাবু আর এক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। নিহি বাবুকে কোলে নিয়ে বলে,
"তুমি আবার খাবার আনতে গেলে কেন?"

মিহি দরজা লাগাতে লাগাতে বলে,
"বোকার মতো প্রশ্ন করিস না তো। তখন তো কিছুই খেলি না। তাই তাড়াতাড়ি করে রান্না করলাম। বাবুকে নিয়ে রান্না করতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেছে। কাজের খালাও আজ আসেনি। নে কথা না বলে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।" নিহির কোল থেকে বাবুকে কোলে নিয়ে বলে মিহি।

নিহি বলে,
"আমি তো খেয়েছি আপু।"
মিহি অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
"খেয়েছিস? খাবার কোথায় পেলি?"
"উনি পাঠিয়ে দিয়েছে।"
"আমান?"
"হু।"
"কত লক্ষী ছেলে ভাবা যায়?"
"যতটা ভাবো। ঠিক ততটাও নয়।"
"হয়েছে। খাবারগুলো তাহলে ফ্রিজে রেখে দে। পরে গরম করে খাস।"
"আচ্ছা। এখন চলো কিছুক্ষণ গল্প করি।"
"কী গল্প করবি?"
"চলো আজ জীবনের গল্পই করি। আমার এখন কী করা উচিত বলো? আমি তো কোনো দিক-দিশা খুঁজে পাচ্ছি না।"
"কী করবি আবার? সংসার করবি। পড়াশোনা করবি।"
"যত সহজেই সব বলছ, সব ততটা সহজও নয়।"
"সহজভাবে মেনে নিলেই সহজ। তাছাড়া আমান যদি খারাপ কোনো ছেলে হতো, আমরাই তোকে ওর কাছে রাখতাম না।"
"কতটুকু চেনো তুমি তাকে?"
"তুই যতটা চিনিস তার চেয়ে বেশিই চিনি এখনো। তবে সংসার করার পর, আমার থেকে অনেক বেশিই জানবি। বলতে গেলে তখন আমানকে তুই পুরোটাই জেনে ফেলবি।"

নিহি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সবাই যতটা সহজভাবে বলে, নিহি কেন ততটা সহজভাবে মেনে নিতে পারে না?
_____________________

কলেজে আসার পর থেকেই অনলের সঙ্গে লিসার বেশ কড়াভাবে ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়ার টপিক হচ্ছে ইরা। অনল আবার যে রিলেশনে গিয়েছে এটা লিসা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এক কথায়, দুই কথায় অনলের সঙ্গে লিসার তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায়। এক পর্যায়ে লিসা বলে,
"এই ইরার চেয়ে তো নিহি শতগুণ বেশিই ভালো ছিল। কী দেখে তুমি ইরার সঙ্গে রিলেশনে গেলে?"
উত্তরে অনল বলে,
"তোর সমস্যাটা কোথায় রে ভাই? প্রথমে নিহিকে নিয়েই তোর সবথেকে বেশি মাথা ব্যথা ছিল। এখন আবার ইরাকে নিয়ে পড়েছিস।"
"অনল, একটা কথা বলি দোস্ত। নিহিকে নিয়ে লিসার মাথা ব্যথা থাকলেও কিন্তু আমার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। তবে লিসার মতো ইরাকে নিয়ে এখন আমারও মাথা ব্যথা আছে। কেন জানিস? কারণ ইরা ভালোবাসার যোগ্যই না। আমি জানিনা, তুই এই রিলেশনটা নিয়ে সিরিয়াস কী-না! তবুও বলব ইরা তোকে ডিজার্ব করে না। আর এটাও সত্যি তুই নিহিকে ডিজার্ব করিস না। তোর আর ইরার মাঝে যেমন আকাশ-পাতাল তফাৎ ঠিক তেমনই নিহি আর তোর মাঝেও আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। আমার খুব গিল্টি ফিল হয়। কারণ, আমি না জেনে অনেকবার নিহির সঙ্গে তোর কথা বলার সুযোগ করিয়ে দিয়েছি। আমি যদি তখন একটাবারও বুঝতে পারতাম যে, তুই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এসব করেছিস তাহলে কখনোই আমি অন্তত তোকে সঙ্গ দিতাম না। নিহিকে দেখলে আমার খারাপ লাগে খুব। নিহির জন্য না, নিজের জন্য খারাপ লাগে।" শান্তকণ্ঠে কথাগুলো বলে সুমাইয়া।
সবাই নিশ্চুপ হয়ে শুনে। সাকিব বলে,
"আমি প্রথম থেকেই অনলকে বারণ করেছিলাম। তখন যদি অনল একটাবার শুনত।"
ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে সুমাইয়া বলে,
"যাই হোক, তোর যা ভালো মনে হয়েছে তুই করেছিস। তোকে কিছু বলার নেই আমার। আমি ক্লাসে যাচ্ছি।"

সুমাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে লিসাও ক্লাসে চলে যায়। সাকিব অনলের কাঁধে হাত রেখে বলে,
"চল। ক্লাসে যাই।"
"তোরা যা। আমি আসছি।" অনলের নিরব উত্তর।
মিলন আর সাকিবও ক্লাসে চলে যায়। অনল বাইকের ওপর চুপচাপ বসে থাকে। কলেজের স্টুডেন্টদের ক্লাস শুরু হয়েছে আরো আগেই। অনল ভাবছে নিহির কথা। একবার নিহির ক্লাসরুমের বারান্দার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই নজর সরিয়ে নেয়। বুকের কোথায় যেন একটা শূন্যতা অনুভূত হয়। এতদিন তো এমন হয়নি। আজ হঠাৎ? হয়তো সুমাইয়ার বলা কথাগুলোই প্রভাব ফেলেছে মনে। সত্যিই কি তাই? নাকি আবার অন্যকিছু? দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে ক্লাসে চলে যায় অনল।


অফিসের ফাইলগুলো দেখে চুপচাপ বসে আছে আমান। আমানের পি.এ নিরব দরজায় নক করে বলে,
"আসব স্যার?"
আমান দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,
"আসো।"
নিরব ভেতরে এসে বলে,
"ফাইলগুলো দেখা শেষ স্যার?"
"হ্যাঁ, শেষ। নিয়ে যাও।"
"আচ্ছা।"
নিরব ফাইলগুলো নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমান পিছু ডাকে। নিরব ফিরে তাকিয়ে বলে,
"জি স্যার?"
"তোমার কি এখন কোনো কাজ আছে? মানে, আমি জানতে চাইছি তুমি বিজি নাকি ফ্রি আছো?"
নিরব হেসে বলে,
"আপনার জন্য আমি সবসময়ই ফ্রি স্যার।"
"তাহলে বসো একটু।" দু'হাতে কলম নাচাতে নাচাতে বলে আমান।

নিরব ফাইলগুলো টেবিলের ওপর রেখে সামনের চেয়ারটিতে বসে। আমান কলমটা টেবিলের ওপর রেখে বাম হাতের তর্জনী দ্বারা কপাল চুলকে বলে,
"তুমি কখনো কাউকে ভালোবেসেছ?"

নিরব যে আমানের প্রশ্ন শুনে লজ্জা পেয়েছে তা বুঝা যাচ্ছে। নিরবের দিকে তাকিয়ে আমান হেসে ফেলে। হেসে হেসে বলে,
"আরে লজ্জা পাচ্ছ নাকি? লজ্জা তো নারীর ভূষণ।"
"না, স্যার। লজ্জা নয়। আনইজি লাগছে।"
"তাহলে ইজি হও। বড় ভাই মনে করে বলে ফেলো।"
"জি স্যার।"
"জি স্যার, জি স্যার না করে বলো।"
"না মানে, ভালোবেসেছি বলতে একজনকে খুব ভালো লাগে।"

আমান একটু সোজা হয়ে বসে। অবাক চাহনীতে বলে,
"ওয়াও। কাকে? সে জানে?"
"সম্পর্কে সে আমার কাজিন হয় স্যার। জানে না এখনো। বলিনি।"
"বলোনি কেন?"
"ভয় লাগে স্যার। যদি বাড়িতে জানিয়ে দেয়!"
"দিলে দেবে। বিয়ে করে ফেলবে।"
"বিয়ে কি আর মুখের কথা স্যার? তাছাড়া ওর পড়া শেষ হোক। তারপর পারিবারিক মাধ্যমে বিয়ে করার ইচ্ছে আছে।"
"যদি ততদিনে সে অন্য কারো হয়ে যায়?"
"হয়ে গেলে আর কী করার! ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে।"
"কথা হয় তার সঙ্গে?"
"প্রতিদিন না। মাঝে মাঝে।"
"আই সী!"
"স্যার, কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করব?"
"শিওর।"
"আপনি হঠাৎ এসব প্রশ্ন কেন করছেন? আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন?"
"তোমার কী মনে হয়?"
"মনে তো হয় বাসেন।"

আমান হাসে। হাত-ঘড়িতে সময় দেখে বলে,
"উত্তরটা তোলা রইল। অন্য একদিন দেবো। বাসায় যেতে হবে এখন।"
"স্যার আরেকটা কথা বলব?"
"বলো।"
"আপনি যাকে ভালোবাসবেন সে অনেক ভাগ্যবতী হবে।"
"আর যাকে বিয়ে করব?"
"সে তো আপনাকে পেয়ে পুরো দুনিয়াটাই পেয়ে যাবে।"
আমান এবারও হাসে। চেয়ারের ওপর থেকে কোট নিয়ে বাইরে চলে আসে। অফিসের সামনে অনেক ফুলের দোকান রয়েছে। এর আগে আমান অনেক ফুল কিনেছে। একজন প্রিয় মানুষের জন্য। আজ নিহির জন্য কিনতে ইচ্ছে করছে। আমান ফুলের দোকানের সামনে গিয়ে চোখ বুলায়। বেলীর ফুলের মালায় হাত বুলিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর ১০টা বেলী ফুলের মালা কিনে নিয়ে গাড়িতে ওঠে।
গাড়িতে বসে বসে আনমনে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসে আর ড্রাইভ করে।


বিশাল রান্নাঘরে মাদুর বিছিয়ে শাক বাছছে নিহি আর টুকটুকি। টুকটুকি নামটা শুনে অদ্ভুত মনে হচ্ছে না? নিহিরও প্রথমে অদ্ভুত লেগেছিল। আর নামটা শুনে কিছুক্ষণ হেসেছিল খুব। টুকটুকি এই বাড়িতে কাজ করে। রান্নাবান্না, থালাবাসন ধোয়া এগুলো সব টুকটুকি করে। ঘর মোছা, ময়লা ফেলা, বাজার করা এগুলো কাজ আবুল করে। ফ্রিজ শূন্য থাকার কারণ ছিল আমান বাসি খাবার পছন্দ করে না। প্রতিদিন তার তাজা তাজা শাক-সবজি চাই। আর তাই বাজারের দায়িত্বটা প্রতিদিনই আবুলকে পালন করতে হয়।আবুল আর টুকটুকি দুজনই বেশ সহজ সরল আর খুব মিশুক। টুকটুকি প্রথমে নিহিকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল। কারণ কাজের লোক এবং আরো একজন মেয়ে ছাড়া নিহিই তৃতীয় মেয়ে যাকে এই বাড়িতে দেখেছে টুকটুকি। শাক বাছতে বাছতে এই বাড়ির, ঐ বাড়ির গল্প শোনায় টুকটুকি। অনেকক্ষণ ধরে সাহস জুগিয়ে নিহিকে বলে,
"আপাজান একখান কথা কমু?"
"বলো।"
"আপনে ভাইজানের কী হন?"
নিহি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
"তোমার ভাইজানকে জিজ্ঞেস করিও।"

নিহির উত্তরে টুকটুকি নিরাশ হয়। আবু্ল এতক্ষণ ঘর মুছছিল। ঘর মোছা শেষ করে এসে বলে,
"আপামুনি আমিও আপনেগো লগে শাক বাছি দেন।"
টুকটুকি আবুলকে ধমক দিয়ে বলে,
"যা সর! আইছে শাক বাছতে। যা কাপড়গুলি গুছা গা।"
আবুল নিহির কাছে নালিশ দিয়ে বলে,
"দেখছেন আপামুনি দেখছেন ছেড়ি কেমনে কথা কয়? শাঁকচুন্নি ছেম্রি।"
"ওরে আবুইল্লা..."

নিহিকে দুজনকে থামিয়ে বলে,
"আহা! থামো তোমরা। এক সঙ্গে কাজ করো। তাও কেন এত ঝগড়াঝাঁটি করো? মিলেমিশে থাকতে পারো না?"
"ঐ-ই তো ঝগড়া করে আপামুনি।" মাথা নিচু করে বলে আবুল।
নিহি বলে,
"এখন থেকে আর কেউ কারো সঙ্গে ঝগড়া করবে না। মনে থাকবে?"
"আপনে যখন কইছেন, তখন মনে থাকব।" দাঁত কেলিয়ে বলে টুকটুকি।

শাক বাছা শেষ করে নিহি হাত ধুয়ে নেয়। হাত মোছার সময় কলিংবেল বাজে। আবুল আর টুকটুকি দুজন'ই কাজ করছে। তাই নিহিই এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। আমান এসেছে। নিহি সরে গিয়ে ভেতরে যাওয়ার জায়গা করে দেয়। আমান ঘরে যাওয়ার পর নিহি দরজা আটকে দিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে থাকে। আমান স্যুট, টাই খুলতে খুলতে ঘর থেকে নিহিকে ডাকে।
"নিহু।"
ডাক শুনেও নিহি চুপ করে থাকে। আমান আবার ডাকে। নিহি তাও চুপ করে থাকে। বারবার ডাকার পরও যখন নিহি উত্তর নিচ্ছিল না তখন আবুল বলে,
"আপামুনি ভাইজান আপনেরে ডাকতেছে।"
"তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসো কেন ডাকে।"
"আমি যামু?"
"হ্যাঁ, যাও।"
"যদি বকা দেয়?"
"তাহলে তুমিও দেবে।"
আবুল জিহ্বা বের করে দু'গালে হাত দিয়ে বলে,
"তওবা তওবা। জীবনেও পারমু না।"
"আচ্ছা পারতে হবে না। এখন গিয়ে শুনে আসো কী বলে।"

নিহির কথামতো আবুল আমানের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"ডাকছেন ভাইজান?"
আমান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
"তুই নিহি?"
আবুল পূণরায় জিহ্বা বের করে দু'দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
"না, না স্যার। আপামুনি কইল, আমি যেন শুইনা যাই আপনে ক্যান ডাকছেন তারে।"
"আমি আমার বউকে ডেকেছি। তুই আসবি কেন?"
'বউ' নাম শুনে আবুল বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে। মাথায় হাত দিয়ে বলে,
"ঠিকই ভাবছিলাম আমি আর টুকটুকি। আপামুনিরে জিগাইছিলাম। কয় নাই।"
"তোর কথা পরে শুনব। আগে তোর আপামনিরে পাঠিয়ে দে। আর শোন, বিয়ের কথা যেন কেউ না জানে এখন।"
"আইচ্ছা ভাইজান।"

নিহি বসে বসে টিভি দেখছিল। আবুল এসে জানায় আমান নিহিকেই যেতে বলেছে। বিরক্ত লাগছে নিহির। তবুও টিভি বন্ধ করে ঘরে যায়। ঘর ফাঁকা। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। তার মানে ওয়াশরুমেই আছে আমান। বিছানায় বসতে গিয়ে চোখ যায় ড্রেসিংটেবিলের দিকে। বেলী ফুলের মালা দেখে এগিয়ে যায় নিহি। একটা মালা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। আমান তখন ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। নিহির হাতে মালা দেখে বলে,
"কেমন?"
"কী কেমন?" আমানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে নিহি।
হাতে থাকা অবশিষ্ট পানি নিহির মুখে ছিটিয়ে আমান উত্তর দেয়,
"ফুলের মালা।"

নিহি চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। দাঁতমুখ খিচে বলে,
"এগুলো কী ধরণের অসভ্যতা?"
"জানিনা তো!" মুখ মুছতে মুছতে জবাব দেয় আমান। নিহি টাওয়ালটা টেনে নিয়ে নিজের মুখ মুছে। আমান হাসে। জিজ্ঞেস করে,
"বললেন না তো?"
"কী বলব?"
"বেলীর ফুলের মালা কেমন লেগেছে?"
"আমার সব ফুলই ভালো লাগে। তা হঠাৎ ফুলের মালা এনেছেন কেন?"

আমান তখন চুল আঁচড়াচ্ছিল। এতক্ষণ ঠোঁটে হাসি থাকলেও নিহির প্রশ্ন শুনে হাসিটা মিলিয়ে যায়। ঘরে নিহি ছাড়া আর আছে কে? কার জন্যই বা আনবে? আমান চিরুনিটা রেখে গায়ে শার্ট পরে চুপচাপ। নিহি উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আমান বলে,
"এইযে আমার সুন্দর চুলগুলো দেখছেন? একটা মালা চুলে দেবো। একটা গলায় দেবো। দুইটা দুই হাতে দেবো। আর বাকিগুলো চায়ের সঙ্গে গুলিয়ে খাব।"

আমানের উত্তর শুনে নিহি বোকা বনে চলে যায়। এরপরই খিলখিল করে হেসে ফেলে। আমান সেদিকে কোনো দৃষ্টিনিক্ষেপ করে না। টুপি মাথায় দিতে দিতে বলে,
"আমি নামাজ পড়ে আসি।"
"ঠিকাছে।"

আমান চলে যাওয়ার পর নিহি ভাবে নামাজটা পরে নেবে। পরে আবার ভাবে গোসল করা হয়নি। কাপড়ও নেই এখানে। নামাজ তো পরা যাবে না। আপুর কাপড়ও গায়ে লাগবে না। কারণ মিহি নিহির থেকে মোটাসোটা বেশি। ভাবিকে ফোন করে বলতে হবে কাপড় পাঠিয়ে দিতে। তাছাড়া এখানেই বা কতদিন থাকতে হবে কে জানে! নিহি বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঠান্ডা লাগছে খুব। লেপের ভেতর ঢুকে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে। তখনই বালিশের পাশে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে। প্রথমে ভেবেছিল নিহির ফোন। পরে দেখল আমানের ফোন বাজছে। ফোনের স্ক্রিনে লেখা, 'জান'। নিহি এক ধ্যানে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
.
.
.
চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন