০১!!
সকালে এক গুচ্ছ তীক্ষ্ম আলো চোখে এসে পড়ায় ঘুম ভাঙলো ভোরের। আর ঘুম ভাঙতেই মেজাজটা গেল বিগড়ে। মাকে কতো বার করে বলেছে সকালে জানালার পর্দাটা যেন না সরায়। ঘুমের মধ্যে চোখে এতো রোদ এসে পড়লে কেমন লাগে? রোদের কথা মনে পড়তেই চোখ না খুলেই ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠলো ভোরের। উঠে বসে আড়মোড় ভেঙে চোখের ঘুমটা কাটানোর জন্য হাই তুললো। কিন্তু চোখে ঘুমটা কেন জানি আরো জেঁকে বসতে চাইছে। ভোর কোনমতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। এখন কিছুতেই ঘুমালে চলবে না। সামনেই পরীক্ষা। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে রোদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কি করে? রোদের সামনে দাঁড়াতেও তো একটা যোগ্যতা লাগবে নাকি! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ব্রাশ করে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো ভোর।
চোখের ঘুমটা কেটে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে চুলগুলো ভালো করে আঁচড়ে নিলো। তারপর একটু ক্রিম মাখলো মুখে। ঠোঁটে একটু লিপ জেল লাগিয়ে বিছানার দিকে তাকাতেই একেবারে থতমত খেয়ে গেল বেচারি। রোদ ভোরের বিছানায় শুয়ে ভ্রু কুঁচকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভোরের দিকে। ভোর বুঝতে পারছে না এটা কি কল্পনা! নাকি রোদ সত্যি সত্যিই এসেছে! আর বাস্তব হলেও কি করে এখানে সে!
-ভোর? তুই কি স্যারের কাছে পড়তে যাস? নাকি ফ্যাশন করতে? এমন ক্রিম মেখে, চুল আঁচড়ে! স্যারকে নিজের রূপে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছিস নাকি?
-কি! কি বলছ এসব রোদ ভাইয়া? আমি কি করেছি?
রোদ বিছানা থেকে নেমে এক পা দু পা করে ভোরের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে ভোর কিছুটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল ধীরে ধীরে। একসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ভোর কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটার সবই ভোরের ভালো লাগে। এই যে মায়া ভরা তার চোখ দুটো, দুষ্টু হাসি মাখানো ঠোঁট জোড়া, কুচকুচে কালো চুল, ফর্সা গালে লেপ্টে থাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সব। কিন্তু এই রাগটা! এতো রাগ কি করে করে একটা মানুষ সেটাই ভোরের মাথায় ঢোকে না। ভোর এসব ভাবতে ভাবতেই রোদ এসে ভোরের কাঁধ বরাবর দেয়ালে দু পাশে হাত রেখে শান্ত চোখে ভোরের চোখের দিকে তাকালো।
-দিন দিন এতো বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস কেন রে ভোর? টিচারের সামনে এভাবে তোর পিংক ঠোঁটটাকে আরো পিংকিশ করে কেন যেতে হবে তোর? তুই কি চাস সে সুযোগ বুঝে তোর এই ফুলো ফুলো ঠোঁটের স্বাদ নিক? কি হলো কথা বলিস না কেন? উত্তর দে?
-ছি ভাইয়া! তুমি কিসব বলছো? স্যারের নামেই বা কিসব বলছ? ছি!
-খুব গায়ে লাগছে না তোর? খুব লাগছে? তোর সাহস হয় কি করে ঠোঁটে এসব লাগিয়ে পড়তে বসার? হ্যাঁ? বল আমাকে?
-ভাইয়া? আমি----।
-আবার ভাইয়া ডাকছিস! তোকে কয়বার বলেছি ভোর ভাইয়া বলবি না আমাকে? আমার নাম নেই? সেটা ডাকা যায় না?
-আমি তো----। আসলে---। সত্যি আমি ইচ্ছে করে---। ঠোঁট ফেটেছে তো তাই লিপজেল দিয়েছি। আর কিচ্ছু না। সত্যি---।
-তোর ঠোঁটটাকে তো আমি----।
রোদ কথাটা শেষ করলো না। ভোরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে রাগ ঝাড়তে লাগলো। ভোরের নরম ঠোঁট জোড়া নিজের মুখে পুরে নিয়ে কখনো চুষে দিচ্ছে, আবার কখনো কামড়ে দিচ্ছে। রোদের এমন কাজে ভোর হতভম্ব হয়ে গেলেও রোদের উষ্ণ স্পর্শে কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগতে শুরু করেছে ভোরের। অজান্তেই ভোরের হাত জোড়া রোদের গলা জড়িয়ে ধরলো। আর রোদও দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে শক্ত করে ভোরের কোমড় জড়িয়ে ভোরের ঠোঁটেই যেন ডুবে গেল। একটু পরে রাগটা শান্ত হলে রোদ একটু সরে এসে ভোরের লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখলো। মেয়েটা চোখ বুজে আছে। ঠোঁট জোড়া আলতো করে কাঁপছে এখনো ওর। ভোরের ঠোঁটের এই কাঁপন দেখে রোদের ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আবার ভোরের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো রোদ। তবে এবারে আক্রোশে নয়। পরম আদরে ভোরের ঠোঁট দুটো নিজের মুখে পুরে নিলো এবারে সে। এক হাতে ভোরকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত ভোরের কোমড় ছাড়িয়ে ভোরের লজ্জারাঙা মুখটা তুলে ধরে রেখেছে। বেশ অনেকক্ষণ পর রোদ একটু সরে এসে ভোরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ বড় করে নিঃশ্বাস নিলো।
-ভোর? রাগ করেছিস?
-উঁহু----।
-দেখ ভোর? তোর এই মিষ্টি ঠোঁটের স্বাদ টেস্ট করার অধিকার শুধু আমার। আর কেউ তোর দিকে তাকালেও কিন্তু খুন করে ফেলবো বলে দিচ্ছি।
-হুম----।
-সত্যি বলছি ভোর। তোর দিকে কেউ খারাপ নজর দিক আমি সত্যি চাই না রে। তুই শুধু আমার ভোর। কেউ তোকে বাজে নজরে দেখলে আমি ঠিক থাকতে পারি না। জানিসই তো?
-হুম।
-রাগ করেছে আমার ভোর সোনা? হুম? এভাবে কামড় দিয়ে ঠোঁটটা লাল করে দিয়েছি বলে? সরি রে। তুই তো জানিস আমি রাগটা সামলাতে পারি না। আর সেটা যদি তোর উপরে হয় তো----।
-আমি একটুও রাগ করি নি রোদ ভাইয়া।
-আবার ভাইয়া? তুই কি রে ভোর? আমি তোকে কতো আদর করে ডাকি। আর তুই কিনা--। ওই এক ভাইয়াই লাগিয়ে রাখিস সারাদিন। থাকবো না বুঝলি? এমন ভাইয়া ভাইয়া করলে থাকবো না দেখবি।
-কেন? কোথায় যাবা?
-যখন যাবো তখনই দেখিস। তখন তুই কেঁদে কেটে মরে গেলেও আর দেখতেও আসবো না আমি। দেখিস তুই।
রোদের এমন কথা শুনে ভোরের চোখ জোড়া পানিতে ভরে গেছে হঠাৎ করেই। চোখের পলক পড়লেই যেন চোখ বেয়ে নামবে অঝোর ধারার বৃষ্টি। রোদ সেটা খেয়াল করলো। তাই আর কথা বাড়ালো না। ভোরের মুখটা দু হাতে তুলে ধরলো।
-ভোর? একবার বল না ভালোবাসি? দেখবি আমি সব ছেড়ে শুধু তোর কাছে থাকবো। একদম তোকে বুকের মধ্যে আগলে রাখবো সবসময়। বল না ভালোবাসিস তোর এই রাগী রোদটাকে?
ভোর লজ্জায় লাল হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আর সাথে সাথেই ওর চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। রোদ এক মূহুর্ত থমকে থেকে এগিয়ে এসে ভোরের কান্নার দু ফোঁটা জলই ভোরের গাল থেকে শুষে নিলো। তারপর আস্তে করে ভোরকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।
-যেদিন আমি থাকবো না ভোর সেদিন বুঝবি এই রোদ কি ছিল। তোর জন্য কতোটা পাগল ছিল সে। সেদিন শুধু একবার 'ভালোবাসি' কথাটা বলার জন্য ছটফট করবি তুই। কিন্তু আমাকে আর পাবি না। মিলিয়ে নিস তুই আমার কথাটা।
কথাটা বলেই রোদ ভোরের রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগোলো। কিছু একটা মনে হতেই পিছন ফিরে একবার ভোরের দিকে তাকালো। ভোর থতমত খেয়ে নিজের ঠোঁটের হাত ছুঁইয়ে যেন রোদের স্পর্শটাকে ছুঁয়ে দিতে চাইছে। রোদ হেসে ফেললো বাচ্চাটার পাগলামি দেখে। রোদের হাসির শব্দ শুনে মুখ তুলে রোদকে দেখেই লজ্জা পেয়ে গেল বেচারি। রোদ আবার ভোরের কাছে এগিয়ে এসে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে ভোরের চিবুক তুলে ধরে মুখের দিকে তাকালো।
-এভাবে আমাকে আর পাগল করিস না ভোর। তোর দোহাই লাগে। এমন করে আমাকে তিলে তিলে মারিস না তুই।
-আমি কি করেছি?
-তুই আবার কি করবি? আর এমন গাধা কেন রে তুই? ঘুমানোর সময় দরজাটা বন্ধ করিস না কেন? আমি না এসে অন্য কেউও তো আসতে পারতো? তখন কি করতি তুই? তোকে সব বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য আমি তো আর সবসময় তোর পাশে না ও থাকতে পারি। তাই না?
-কেন? কোথায় যাবা তুমি ভাইয়া?
-জাহান্নামে যাবো বজ্জাত মেয়ে। তোর তাতে কি? যেটা বলছি চুপচাপ সেটা শোন। আর কখনো যেন দরজা খোলা রেখে ঘুমাতে না দেখি বলে দিলাম।
-আমার তো ভয় করে---।
-রুমে কি ভূত আছে যে তোকে খেয়ে ফেলবে? ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিবো আজাইরা তর্ক করবি। হেহ! তার নাকি ভয় লাগে? নাটক করিস তুই আমার সাথে? নাটক? ওই তুই কার জন্য দরজা খোলা রাখিস? হ্যাঁ? কার জন্য? থাপড়ে গাল লাল করে দিবো যদি কাল থেকে রাতে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ না পাই। বলে দিলাম কিন্তু ভোর। খুব খারাপ হয়ে যাবে যদি---।
-হুম---। ম-ম-মনে থাকবে---।
-তাকা আমার দিকে? এমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিস কেন? আমি কি তোকে সত্যি সত্যি মেরেছি? নাকি আমি মরে গেছি?
-উঁহু।
-তাহলে? নাকি দরজা খোলা রাখতে পারবি না বলে কাঁদছিস? কোনটা?
-তুমি আমাকে এভাবে বকছো কেন? আমি কি করেছি?
-তুই কি কি করেছিস সেটার বিচার তো আজ রাতে হবে। এখন তো তোর স্যার চলে আসবে। যা আগে নাস্তা করে নে। তারপর এই টিশার্ট পাল্টে নিয়ে একদম গা মাথা ঢেকে পড়তে বসবি---। নইলে আজ রাতে তোর কি যে হবে ভোর সেটা উপরের এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।
-তুমি আজ থাকবে? সত্যি?
-কেন? থাকলে কোন সমস্যা আছে? চলে যাবো?
-না না না।
-হুম---। যা এখন নাস্তা করতে যা। আমি আছি।
-হুম। তুমি নাস্তা করবে না?
-আমি তো আর তোর মতো দিনের দশটা পর্যন্ত তো পড়ে পড়ে ঘুমাই না ভোর। তাই না? তোর তো শুধু নামেই ভোর। আমি কিন্তু ঠিকই ভোরে ভোরে ঘুম থেকে উঠি, জগিং করি। আর তাই আমার নাস্তা করাও বহু আগেই হয়েছে। আজ অবশ্য নাস্তার পরে মিষ্টিও পেলাম। জানিস দারুণ ছিল মিষ্টিটা---।
-আমি---আমি যাই----।
ভোরের ছুটে পালানো দেখে হাসলো রোদ। এই বাচ্চা মেয়েটাকে ওর কেন এতো নিজের বুকের একদম ভিতরে মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে? পিচ্চিটা কবে যে ওর ভালোবাসাটা বুঝবে কে জানে! রোদ এবারে উঠে ভোরের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। রোদকে সামনে না পেলে পাগলিটা তো ঠিক করে খাবেও না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ড্রইংরুমের সিঁড়ির কাছে চলে এসেছিলো রোদ৷ কিন্তু সিঁড়ি পর্যন্ত এসেই একটা ঘটনা দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রোদের। একজন হা করে ভোরের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ চোখ লাল করে এক পা দু পা করে ভোরের দিকে এগিয়ে এলো। আজ এই মেয়ের কপালে কি শনি আছে সে নিজেও জানে না।
০২!!
ভোর সবে স্যান্ডুউইচে কামড় বসিয়েছে এমন সময় রোদ হঠাৎ করেই ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। রোদের লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখেই ভোরের গলায় খাবারটুকু আটকে বেচারি বিষম খেল। রোদ দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে ভোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। ভোর আর রোদের মা দুজনেই ভোরের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর কেউ একজন এসে এক গ্লাস পানি হাতে ভোরের সামনে ধরলো। ভোর এতো কিছু খেয়াল না করেই পানিটুকু গটগট করে খেয়ে ফেললো। পানির গ্লাসটা ডাইনিং টেবিলের উপরে রাখতে গিয়েই মানুষটাকে দেখে একেবারে চমকে উঠলো ভোর। লোকটা আর কেউ নয়। রোদের বেস্টফ্রেন্ড। মেঘ। এই লোকটা কোথা থেকে এলো সেটা বুঝতে না পারলেও এবারে রোদের রাগের কারণটা বুঝতে পারলো ভোর। অসহায় চোখে রোদের দিকে একবার তাকাতেই রোদের রাগী চোখ মুখ দেখে বেচারি একেবারে চুপসে গেল। মাথা নিচু করে রেখেই বুঝতে পারলো ওই বজ্জাত মেঘটা সবসময়ের মতো হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ আর তাই ওর রোদ ওর উপরেই খেপে গেছে। ধুর।
-ছোটমা? ভোরের খাওয়া হয়ে গেছে। ভোর? রুমে যা। কিসব পড়ে আছিস? লাগছে কেমন তোকে? পুরোই শাঁকচুন্নির মতো? যা চেইঞ্জ কর গিয়ে?
-হুম---। যা-যা-যাচ্ছি---।
ভোর এক ছুটে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটলো। আর মেঘ সেদিকে আবার হা করে তাকিয়ে রইলো। রোদের সাথে চোখাচোখি হতেই মেঘ হাসলো।
-ভোরকে তো বেশ লাগছিলো টিশার্ট আর স্কার্টটায়। ওভাবে বললি কেন রোদ? আর ওকে মোটেই শাঁকচুন্নি লাগছিল না৷ অনেক---। অনেক সুইট পুতুলের মতো দেখতে লাগছে--। একদম বারবি ডলের মতো---।
রোদ ভ্রু কুঁচকে মেঘের দিকে তাকাতেই মেঘ আর কথাটা শেষ করলো না। রোদ টেবিলের উপর থেকে একটা নাস্তার প্লেট মেঘের হাতে ধরিয়ে দিলো।
-ধর। তুই নাস্তা কর। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।
-এখন শাওয়ার নিবি রোদ?
-কি করবো বল? যা দেখছি সব হট হট লাগছে। তাই শাওয়ার নেয়াটা জরুরি---। তুই নাস্তা কর। আমি যাই---।
মেঘ থতমত খেয়ে রোদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। আর এদিকে ভোর আর রোদের মা দুজনেই মুখ টিপে হাসাহাসি করতে করতে নিজেদের কাজে মন দিলেন। পাগলটা একটু পরে আবার এসে ভোরের জন্য খাবার চাইবে সেটা আর কেউ জানুক না জানুক উনারা বেশ ভালোই জানে। ভোরের জন্য রোদের এমন পাগলামি দেখতে তাদেরও ভিষণ ভালোই লাগে।
এদিকে ভোর রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু এপাশ ওপাশ ঘুরে নিজেকে দেখতে লাগলো। রোদ কেন বললো ভালো লাগছে না ওকে? এই নেভি ব্লু রঙা টিশার্টটা তো---! হঠাৎ ধুম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে ভোর চমকে পিছনে ফিরে রোদকে দেখে একেবারে ভয়ে জমে গেল। রোদের মুখের ভাবটা আরো শক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু ভোর তো কিছু করে নি? ও তো নাস্তা করতে গেছে নিচে। তাও আবার রোদের কথাতেই। কথাগুলো ভাবার মাঝেই রোদের শক্ত হাতের একটা চড় এসে পড়লো ভোরের নরম গালের উপর। চড়টা এতো জোরে ছিল যে বেচারি টাল সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের কোণার উপরে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলো। কিন্তু কপালের কিছুটা কেটে গেল ড্রেসিং টেবিলের কোণায় লেগে। রোদের সেসব কিছুর খেয়াল নেই। সে ভোরকে টেনে তুলে ভোরের একটা হাত মচকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।
-তোর সাহস হয় কি করে এসব পড়ে অন্য একটা ছেলের সামনে যাওয়ার? বল? আর কখন পাঠিয়েছি তোকে চেইঞ্জ করতে? এতোক্ষণ লাগে এই টিশার্টটা খুলতে? হ্যাঁ? জবাব দে?
-আমি আসলে-----।
-আবার কথা বলছিস? তুই টিশার্টটা খুলবি? নাকি আমি নিজের মতো করে খুলে নিবো এটা? কোনটা চাস? খোল খোল বলছি? এক্ষুণি খোল?
-ভাইয়া এমন করো না প্লিজ? ছিঁড়ে যাবে-----।
-তোর এই টিশার্টের ছিঁড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা হচ্ছে? আমি যে তোকে চেইঞ্জ করতে বলেছি সেটা কিছু না? আজ তো তোর এই টিশার্টটা আমি কুঁচি কুঁচি করে ফেলবো---। খোল শিগগিরই?
-এটা ছিঁড়ো না রোদ ভাইয়া প্লিজ?
-তোর এতো সাহস ভোর? তুই এই সামান্য টিশার্টের জন্য আমার মুখে মুখে তর্ক করিস?
-না আসলে----। আসলে এটা আমার---।
-আর একটাও কথা বললে তোকে মেরে এখানে পুঁতে ফেলবো বলে দিলাম ভোর--। আমাকে আমার কাজটা করতে দে----। তোর টিশার্ট খুলতে হবে না। আমিই খুলে নিচ্ছি---।
ভোর রাগের চোটে ভোরের টিশার্টটা খুলে নেয়ার চেষ্টা করলো। ভোরও নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে রোদকে বাধা দিচ্ছিলো। ফলস্বরূপ দুজনের টানাটানিতে টিশার্টের কাঁধের অনেকখানি ছিঁড়ে গেল। আর সেটা দেখেই ভোর এবারে কেঁদেই ফেললো। ভোরের কান্না শুনে রোদের এতোক্ষণে হুঁশ হলো। ভোরের হাতটা ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসতেই ভোর এক ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। রোদের নিজের কাছেও খারাপ লাগলো। এভাবে জোর করায় মেয়েটা হয়তো ভয় পেয়ে গেছে ভেবে রোদ এগিয়ে এসে ওয়াশরুমের দরজায় নক করতে শুরু করলো।
-ভোর? আম সরি ভোর? আমি এমন কিছু করতে চাই নি বিশ্বাস কর? এই ভোর? শোন না? দরজাটা একবার খোল না প্লিজ?
ভোর দরজা খুলছে না দেখে রোদ আরো জোরে দরজা ধাক্কাতে শুরু করলো। ভোর কাঁদছে। এই একটা কথাই রোদের মাথায় ঘুরছে। মেয়েটা এখন নির্ঘাত শাওয়ার ছেড়ে কাঁদতে বসেছে৷ কথাটা ভাবতেই রোদের বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠলো।
-ভোর ভোর ভোর? লক্ষী না প্লিজ? দরজাটা খোল একবার? আর একটুও বকবো না প্রমিস। দরজাটা খোল?
--------------------------------------------------
-এবার কিন্তু আমি খুব রেগে যাচ্ছি ভোর? তুই দরজা খুলবি? নাকি আমি দরজা ভেঙে ঢুকবো? কোনটা?
রোদের কথাটা শেষ হতেই ভোর ওয়াশরুমের দরজাটা খুলে দিয়ে আবার শাওয়ারের নিচে বসে পড়লো। রোদ তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে ভোরকে ফ্লোরে বসা দেখে নিজেও বসে হাত বাড়িয়ে ভোরের গাল ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো৷ ভোর কাঁদতে কাঁদতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো। রাগ করে ধরতে দিলো না। রোদ তবু দু হাতে ভোরের মুখটা শক্ত করে টেনে নিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে চোখে চোখ রাখলো।
-ভোর? সোনামনি? সরি তো? এই দেখ কান ধরছি? আমি সত্যি ইচ্ছে করে এমন করি নি--। আমার এমন কোনো ইনটেনশনই ছিল না রে বিশ্বাস কর?
-তুমি খুব খুব খুব খারাপ রোদ ভাইয়া। খুব পচা৷ তুমি ইচ্ছে করে--। ইচ্ছে করেই আমার এতো সুন্দর টিশার্টটা ছিঁড়ে ফেলেছ। আমি এখন গন্ধ নিবো কি করে? আআআআ।
-কি?
-তুমি? তুমি যাও যাও যাও। একদম আমার কাছে আসবা না তুমি। যাও।
-ভোর? ভুল হয়ে গেছে রে জান? আর হবে না। এবারের মতো মাফ করে দে না প্লিজ?
-না না না। মাফ করলেই কি আমি আমার টিশার্টটা আর ফিরত পাবো? না মাফ করবো না একদমই না৷
-তুই এই সামান্য একটা টিশার্টের জন্য আমার সাথে এমন করবি ভোর?
-এটা একদম সামান্য টিশার্ট না। তুমি যাও তো। যাও এখন।
-ভোর? শোন না? এই?
-তুমি তোমার ওই বজ্জাত বন্ধুর কাছেই যাও। আমি কি করে জানবো ওই খারাপ ছেলেটা যে এসেছে--? তুমি নিজে ওকে নিয়ে এসে এখন আমাকেই বকছ? আমি যেন ওর সাথে কথা বলতে গেছি--?
-ও তোর দিকে কেমন করে তাকাচ্ছিল ভোর। আবার বলছিল এই টিশার্টে তোকে----।
-তো? আমি কি করবো? আমি বলতে বলেছি ওই বেয়াদপ ছেলেটাকে? নাকি তাকিয়ে থাকতে বলেছি? নাকি আমি জানতাম তুমি তোমার ওই খারাপ বন্ধুকে নিয়ে আসবে? --- আর তুমি! আমার টিশার্টটা--! আমি এখন কোথায় পাবো---?
-কি কোথায় পাবি? আর এই এক টিশার্টের জন্য এমন মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিস কেন রে তুই? আমি যে সরি বলছি সেটা কানে যাচ্ছে না তোর?
-তোমার সরি দিয়ে আমি কি করবো? তোমার সরি আমার টিশার্টটা এনে দিতে পারবে? যত্তসব!
রোদ ভ্রু কুঁচকে ভোরের পড়নের টিশার্টটার দিকে তাকালো। কি এমন আছে এই টিশার্টটায়? যে মেয়েটা সাত চড়ে রা করে না সেই মেয়েটাই কিনা এই সামান্য একটা টিশার্টের জন্য রীতিমতো রোদের সাথে ঝগড়া করছে? ভোর নিজের গায়ের টিশার্টটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে দেখে রোদের কৌতূহলটা যেন আরো বেড়ে গেল। হঠাৎ করেই এই নেভি ব্লু রঙা টিশার্টটার রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল রোদের কাছে৷ এই টিশার্টটা রোদের। একদিন পড়েছিল। এরপর আর খুঁজে পায় নি। কথাটা মনে পড়তেই রোদের ঠোঁটের কোণে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। ভোরকে তখনো কাঁদতে দেখে রোদ ভোরের মুখটা তুলে ধরলো দুহাতে।
-ভোর? এভাবে কাঁদিস না প্লিজ? আচ্ছা যা। তোকে একদম হুবহু এমন এক জোড়া টিশার্ট কিনে দিবো আজই।
-লাগবে না-----।
-তাহলে কি লাগবে আমার ভোরসোনার? বল?
-তোমার কিছুই করা লাগবে না। যাও তুমি এখান থেকে--।
-আচ্ছা যা। আমার সবগুলো শার্ট, টিশার্ট সব তোকে দিয়ে দিবো। আজ থেকে আমার সব তোর। চুরি করে আমাট টিশার্ট পড়তে হবে না আর তোকে। কি রে চুন্নি? এবার খুশি তো?
রোদের কথাটা শুনে ভোর চমকে রোদের দিকে তাকাতেই দেখলো রোদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু একটা হাসি ফুটে আছে৷ রোদ ভোরকে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
-এতো পাগলি কেন রে তুই ভোর? তোকে ছাড়া আমার একটা মিনিটও কাটবে কি করে বল তো?
রোদ ভোরের মাথাটা নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে চিন্তা করতে লাগলো। এই পাগলি মেয়েটাকে ছেড়ে ও কি করে থাকবে? এই পাগলিটা থেকে দূরে গিয়ে ও বাঁচবে কি করে? রোদের অস্তিত্বের শুরুই তো ভোরকে দিয়ে। কি করে পারবে রোদ নিজের অস্তিত্ব থেকে দূরে থাকতে? কি করে?