৪৩!!
দেখতে দেখতে আরো বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। তাহিয়ার বিয়ে, বৌভাত, তাহিয়ার নাইওর আসা, দুদিন থেকে আবার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাওয়া, সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় কেটেছে এতোদিন অরণ্য অনামিকার। সব ব্যস্ততা শেষ করে আজ এতোদিনে বিয়ের পর প্রথমবারের মতো অনামিকা বাড়িতে এসেছে। অরণ্য অবশ্য আগেরবার বিয়ের পরদিন যেভাবে এসেছিল, সেটাকে আর যাই হোক শ্বশুরবাড়িতে আসা বলা চলে না। যা হোক, এতোদিনে মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে পেয়ে অনামিকার মা বাবা যেন চাঁদ হাতে পেয়েছেন। মা যত রকম রান্না জানেন প্রায় সবই করে ফেলেছেন মেয়ে জামাইয়ের জন্য। সারাদিন চারজনে মিলে হৈ চৈ করে খাওয়া দাওয়া আর আড্ডা, টুকটাক অনুর আর বাবার ঝগড়া, মান অভিমান, এসব করেই কেটে গেল। রাতেও খাওয়ার পর বেশ অনেকক্ষণ গল্প করে তারপর অনামিকার রুমে এসে অরণ্য। অনামিকা মাকে হাতে হাতে একটু হেল্প করে দিয়ে রুমে এসে দেখলো অরণ্য বিছানায় মাঝামাঝিতে এলোপাথাড়ি হয়ে শুয়ে আছে। ভদ্রলোকের শোয়ার এমন অবস্থা দেখে অনামিকা হেসে ফেললো। অনামিকার হাসির শব্দে অরণ্য নিজের হাতের উপরে মাথাটা ভর দিয়ে অনুর দিকে তাকালো।
-হাসো হাসো। শ্বশুরবাড়িতে এসেও বউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এদিকে ম্যাডাম আমার দুরবস্থা দেখে হাসি থামাতেই পারছেন না। কি কপাল আমার!
-হাসবো না তো কি? এভাবে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বিছানার মাঝ এসে শুয়ে আছো। তোমার যে মাঝেমাঝে কি হয় একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। এখনও কিসব বলছ তার মাথামুন্ডু আছে কিছু?
-মাথামুন্ডু থাকতে হবে না সুইটহার্ট। এদিকে এসো তুমি। সারাদিন এতো ছুটোছুটি করো কেন? এখনও ঘুমানোর নাম নেই তার। আর কতোক্ষণ ধরে ওয়েট করাবে মেয়ে?
-আরেকটু না? স্মিতাকে একটা কল করেই শুয়ে পড়বো। ক্লাসের নোটগুলো দিতে বলেছিলাম ওকে। কাল পরশু দিতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করি।
অনামিকা কথাটা শেষ করার আগেই অরণ্য অনামিকাকে টেনে বিছানায় তুলে নিয়ে অনামিকাকে বিছানায় চেপে ধরে অনামিকার মুখের দিকে তাকালো। অনামিকা ভ্রু কুঁচকে মোবাইলে কিছু একটা করছিল। তাই অরণ্য হঠাৎ ওকে এভাবে চেপে ধরায় বেচারি থতমত খেয়ে অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্য আলতো করে অনুর গালে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়ে অনামিকার ঠোঁটের কাছে নিয়ে আঙুল নিয়ে থামালো। অনামিকা কেঁপে উঠে সরে আসার চেষ্টা করতেই অরণ্য অনামিকার দিকে আরো বেশ কিছুটা ঝুঁকে অনামিকার গলায় মুখ ডুবালো।
-কলেজে যাওয়া তো ছেড়েই দিয়েছেন ম্যাডাম। রাইট? ননদের বিয়ের ছুটির নামে যে এভাবে ফাঁকিবাজি করছো এক্সামে কি করবে? এমন করলে রিটেক দিতে দিতে আমাদের পিচ্চিরাও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়ে যাবে।
-বেশি কথা বলো না তো। স্মিতাকে কল করবো বললাম না? সরো না?
-আই থিংক বেচারি এখন হাজবেন্ডের সাথে একটু টাইম স্পেন্ড করছে। তাই ওকে বিরক্ত না করে একটু নিজের হাজবেন্ডের দিকে নজর দিন ম্যাডাম।
-ও এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। এন্ড ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন জনাব মিস্টার অরণ্য, স্মিতার এখনো বিয়ে হয়নি।
-ওহো! ওয়াও। একটা সুন্দরী আনম্যারেড মেয়ে তোমার ফ্রেন্ড, আগে বলবা না? বয়ফ্রেন্ড আছে কি না জানো? না মানে না থাকলে একটু সুখ দুঃখের আলাপ করতে পারতাম আর কি। নাম্বারটা দিও তো।
-অরণ্যওওওওও? তোমাকে তো আমি------। সরো? ছাড়ো? একদম ধরবা না বলে দিলাম।
-ওহো! বউ দেখি রেগে যাচ্ছে! আমি তো এমনি বললাম। আমার অনেক সিংগেল বন্ধু বান্ধব আছে তো। ভাবলাম ওদের কারো সাথে ম্যাচ করিয়ে দেয়া যায় কিনা। আর তুমি কিসব ভেবে রেগে যাচ্ছ? এজন্যই বলে এক মেয়ে অন্য মেয়ে সুখ দেখতে পারে না। সো স্যাড অনু। তোমার কাছে এমনটা আশা করি নি। আ'ম সো ডিজআপয়েন্টেড।
-তুমি কি মিন করে কথাটা বলেছ আমি বুঝি নি ভাবছ? এখন নাটক করে বন্ধুদের জন্য ঘটকালি করছ বললেই আমি ভুলে যাবো ভাবছ? কক্ষনো না। সরো?
অনামিকা সত্যি সত্যিই রাগে লাল হয়ে অরণ্যকে ধাক্কা দিয়ে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে মোবাইলটা বিছানার উপরে ছুঁড়ে ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকলো। বেচারা অরণ্য অনামিকার এতো রাগ দেখে কয়েক মিনিট থতমত খেয়ে গেল। একটু পরেই নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করলো। ভিতর থেকে বেসিনের পানির আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ পাচ্ছে না দেখে অরণ্য আরো কিছুটা জোরে দরজায় নক করলো। আরো মিনিট খানেক দরজায় ধাক্কাধাক্কির পর অনামিকা ওয়াশরুম থেকে বের হলো। অরণ্যকে দেখতেই পায়নি এমন ভাব করে অনামিকা একটা টাওয়ালে মুখ মুছতে মুছতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে অরণ্য নিজেই অনামিকাকে টেনে নিয়ে অনামিকার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।
-এই অনুপাখিটা? এতো রাগ করছ কেন? আমি তো এমনি দুষ্টুমি করে বলেছি কথাটা। আমাকে এই সামান্যতে ভুল বুঝলে বউ?
-কেউ জানে আমি রাগ করবো, তবু বলে কেন এসব?
-বলি কজ আমার বউকে রাগাবো আমি, হাসাবো আমি, আদর করবো আমি, কাঁদাবো আমি। তোমার কোনো প্রবলেম আছে তাতে?
-আমার আবার প্রবলেম? হুহ।
-এখন বউয়ের রাগ যেহেতু হয়েছে তাহলে বউকে উষ্ণতার চাদরে জড়িয়ে গভীর আবেশে রাগও ভাঙাবো আমি। কতোক্ষণ রাগ করে থাকতে পারো আমিও একটু দেখি।
-এই একদম না। গুনে গুনে দশ হাত দূরে থাকবে তুমি। আর স্মিতার নাম্বার চাইছিলে না তুমি? দাঁড়াও নাম্বারটাও দিচ্ছি তোমাকে।
অনামিকার রাগে লালিমা ছড়ানো মুখটা দেখে অরণ্য হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনামিকা বিছানার উপর থেকে নিজের মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়ার জন্য ঝুঁকছে দেখে অরণ্য অনামিকাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। অনামিকা ইচ্ছেমতো হাত পা ছুঁড়ে নামার চেষ্টা করেও সফল হলো না। অরণ্য অনামিকাকে ধপ করে বিছানায় শুইয়ে দিতেই অনামিকা তড়িঘড়ি করে উঠে বসার চেষ্টা করলো। ততক্ষণে অরণ্যও নিজের শরীরের ভারটা অনামিকার উপরে ছেড়ে দিয়ে অনামিকাকে চেপে ধরলো বিছানার সাথে। অনামিকা ছাড়া না পেয়ে কিটমিট করে অরণ্যের একটা হাত খামচে ধরলো। অরণ্যও সুযোগ পেয়ে অনামিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে ছোট্ট করে চুমোয় ভরিয়ে দিতে লাগলো।
-অভিমানের রাগটা নাহয় ভালোবাসার আদরে গলে যাক আজ। যত দূরে যাওয়ার চেষ্টা করবে তত আরো নিবিড় বাঁধনে জড়িয়ে নিবো ম্যাডাম। এক মূহুর্তের জন্য ছাড়াছাড়ি হবে না, মাইন্ড ইট।
কথাটা শেষ করেই অরণ্য আবার ভালোবাসার উষ্ণ চাদরে অনামিকাকে জড়িয়ে নিল। এই উষ্ণ ভালোবাসার কাছে শেষমেষ অনামিকাও হার মেনে গা এলিয়ে দিয়েছে অরণ্যের ভালোবাসার সাগরে। নিস্তব্ধ রাতটা ওদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়েই জেগে রইলো আজও।
মাঝরাতের দিকে অরণ্যের ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলো অনামিকা একদম গুটিশুটি হয়ে ওর বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে ঘুমাচ্ছে। অরণ্য মিষ্টি করে হেসে অনামিকার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে অনামিকাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই হাতে কিছু একটা লাগতেই খেয়াল করলো অনামিকার মোবাইল। কয়টা বাজে দেখার জন্য মোবাইলের হোম বাটনে কয়েকবার প্রেস করতেও কিছুই যখন হলো না তখন বুঝতে পারলো আজও মোবাইল চার্জ আউট হয়ে গেছে। এই মেয়েটার মোবাইলে হয় চার্জ থাকে না, আর নয়তো অলটাইম মোবাইল সাইলেন্ট মুডে দেয়া থাকে। কি যে করে মেয়েটা! কথাটা ভেবেই অরণ্য মাথা নেড়ে নিজেই হাসলো। বিছানার পাশেই চার্জার আর প্লাগ দেখে মোবাইলটা চার্জে লাগিয়ে মোবাইলটা অন করে ওয়াশরুমে গেল অরণ্য। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে রুমের লাইটটা অফ করে দিয়ে অনামিকার পাশে শুয়ে ঘুমন্ত অনামিকা কপালে ছোট্ট করে একটা আদরের পরশ বুলিয়ে দিল। অনামিকা ঘুমের ঘোরেই অরণ্যের কিছুটা গা ঘেঁষে আসতেই অরণ্যও অনামিকাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুজলো।
রাত গভীর থেকে আরো গভীরতর হচ্ছে। এদিকে অরণ্যের ঘুম আসছে না। অনেকক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে থেকে চেষ্টা করেও যখন ঘুম এলো না শেষে বিরক্ত হয়ে অনামিকাকে আবার শুইয়ে দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। হুট করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেলে নাকি মানুষের ঘুম আসতে চায় না। অরণ্যেরও বোধ হয় সেটাই হচ্ছে। অনুকে ডেকে তুলে গল্প করবে, নাকি বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ খোলা বাতাসে গিয়ে দাঁড়াবে চিন্তা করে শেষের অপশনটাই সিলেক্ট করলো অরণ্য। এতো রাতে অনামিকাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার কোনো মানেই হয় না। কথাটা ভেবেই বিছানা থেকে এক পা নিচে রেখেছে এমন সময় অনামিকার মোবাইলে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলো। অরণ্য ভ্রু কুঁচকে অনামিকার চার্জে লাগানো মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখলো প্রায় ২০ টার মতো মিসড কল শো করছে মোবাইলের স্ক্রিনে। সরাসরি মোবাইলের কল না। মেসেঞ্জারে কল। অন্য কোনো ল্যাঙ্গুয়েজে নাম। তাই বুঝতে পারলো না কার আইডি। এতোবার কে কল করেছে সেটা ভেবে অরণ্য আইডিটাতে ক্লিক করতেই চ্যাট বক্সটা ওপেন হলো মোবাইলের স্ক্রিনে। ইগনোর করে রাখা চ্যাটটার একচেটিয়া কয়েক শো কল আর মেসেজের ভিড়ে একটা মেসেজেই চোখ আটকে গেল অরণ্যের।
"অনামিকা ইট'স মি, সাহিল। প্লিজ আমার নাম্বারটা আনব্লক করো। ডোন্ট ব্লক মি এগেইন প্লিজ। যতবার ব্লক করবা ততবার নতুন করে আইডি বা নাম্বার থেকে কল করবো। জাস্ট দুইটা মিনিট, ফর গড সেইক, দুইটা মিনিটের জন্য কলটা রিসিভ করো প্লিজ।"
৪৪!!
-অনুউউউউউউউউ?
অনামিকার মোবাইলে সাহিলের মেসেজগুলো দেখার পর স্তব্ধ হয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে কতোক্ষণ তাকিয়ে ছিল অরণ্য নিজেও জানে না। অরণ্যের হুঁশ ফিরে অনামিকা ঘুমের ঘোরে অরণ্যের কোলের কাছে একদম গুটিশুটি হয়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরায়। অনামিকার স্পর্শে চমকে উঠে তাকাতেই অরণ্য দেখতে পেল মেয়েটা ঘুমের ঘোরেই অরণ্যকে জড়িয়ে ধরেছে। অরণ্য একটা হাঁফ ছেড়ে মেসেঞ্জার থেকে মেসেজগুলো আনসিন করে মোবাইলটা বেড সাইড টেবিলে রেখে দিয়ে অনামিকাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো। এতোক্ষণ এমনিতেই ঘুম না আসলেও এবারে হাজারটা প্রশ্নের ঘুরপাকেই ঘুম যেন উবে গেছে অরণ্যের। সাহিল এতোদিন পরে কেন আবার ফিরে আসতে চাইছে কথাটা ভাবতে ভাবতে কখন চোখ জোড়ায় ঘুম নেমে এসেছে অরণ্য নিজেও জানে না। চোখ জুড়িয়ে ঘুম নামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনামিকাকে আর নিজেকে একটা সুন্দর ফুলের বাগানে আবিষ্কার করলো অরণ্য। চারিদিকে হাজারো রঙের, হাজার হাজার রকমের ফুল যেন রঙিন হাসিতে বাগানটাকে মাতিয়ে রেখেছে। যেমন সুন্দর তাদের গঠন, রঙ, তেমনি মন মাতানো ঘ্রাণ। আর এই সৌন্দর্যের মাঝে অনামিকাকে যেন একটা ফুলপরীর মতো লাগছে। কত বছর, যুগ পেরিয়ে গেছে ওদের পুরো বাগানটা ঘুরে সবগুলো দেখতে দেখতে কে জানে। বাগানের শেষ প্রান্তে আসতেই দেখতে পেল একটা কালো কুচকুচে কাঁচের দেয়ালের মতো কিছু একটা। কালো কাঁচের আড়াল থেকে কেউ একজন অনামিকাকেই ডাকছে। আর অনামিকাও যেন সম্মোহিতের মতো সেই শব্দকে অনুসরণ করেই ধীরে ধীরে কাঁচের দেয়াল ভেদ করে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। অরণ্য হাজার চেষ্টা করেও অনামিকাকে বাধা দিতে বা আটকাতে পারছে না।
অনামিকা কাঁচের দেয়ালের ভিতরে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো অনামিকার নামটাই গলা দিয়ে বের হলো অরণ্যের। আর সাথে সাথেই চোখটা ছুটে যেতেই অরণ্যের মাথার কাছে বসে অনামিকাকে ওর গালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে ডাকতে দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসে অনামিকাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো অরণ্য। অরণ্যের এভাবে জড়িয়ে ধরায় অনামিকা যতটা না অবাক হয়েছে, তারচেয়েও বেশি অবাক হয়েছে অরণ্যের কাঁপা কন্ঠস্বরটা শুনে। মানুষটা কি কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছে?
-কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? আরেকটুর জন্য মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলছি চিরদিনের মতো। একটা বারের জন্য আমার দিকে ফিরেও তাকালে না পর্যন্ত! এভাবে একা ফেলে চলে যেও না অনু প্লিজ। মরে যাবো আমি।
-আরে? অরণ্য? কিসব বলছ? আমি আবার কোথায় গেলাম? শাওয়ার নিয়ে নিচে গিয়ে দেখলাম মা নাস্তা বানাচ্ছে। মাকে হেল্প করে তোমার জন্য নাস্তা রেডি করে তো তোমাকে ডাকতে এলাম। আর এসে দেখি ভদ্রলোক ধড়মড় করে উঠে বসেছে আমার নাম ধরে ডেকে। কি হয়েছে বলো তো?
-হুম? নাহ কিছু না। বাজে একটা স্বপ্ন ছিল। উফফফ।
-হি হি। স্বপ্নেও এসে জনাবকে জ্বালাতন করছি মনে হচ্ছে? এই? কি দেখেছ বলো না? কোথায় চলে যাচ্ছিলাম?
-নাহ। তেমন কিছু না। বাদ দাও। বউ একা একা শাওয়ার নিয়ে নিল? আমাকে একবার ডাকলে কি হতো? এখন একা একা শাওয়ার নিতে ভালো লাগবে বলো তো?
-কথা ঘুরাবে না একদম। বলো কি দেখেছ? আমি মরে গেছি? এমন টাইপের কিছু?
-অনু?
অরণ্যের ধমকে ভয় পেয়ে চমকে উঠে অরণ্যের মুখের দিকে তাকাতেই অরণ্য চোয়াল শক্ত করে অনামিকার একটা হাত শক্ত করে ধরে নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নিল।
-এমন আজেবাজে কথা যেন আর তোমার মুখে না শুনি। আর কখনো এসব মরে যাবো টাইপের কথা শুনলে আমি নিজেই গলা টিপে খুন করে রেখে দিবো বলে দিলাম।
-আরে বাবা! এটা আমার গলা না হাত! উফ! আমার হাত! ও মা গো! আমার হাতটা মনে হয় ভেঙ্গেই ফেলেছে এই লোকটা। মরে গেলাম আমি!
-রাগিও না বলে দিলাম কিন্তু অনু। তাহলে আমার থেকে খারাপ কিন্তু কেউ হবে না।
কথাটা বলেই অনামিকাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে এসে সোজা ওয়াশরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালো অরণ্য। মাথার উপরে ঠান্ডা পানির একটা স্রোত বয়ে যাওয়ার পরও অরণ্যের মনে হচ্ছে মাথা থেকে আগুন বের হচ্ছে। এরকম অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার মানে কি? তাহলে কি সত্যি সত্যিই অনামিকা সাহিলের ডাকে সাড়া দিয়ে-----? ছি ছি! নিজের ভাবনায় নিজেরই রাগ হলো এবারে অরণ্যের। কিসব ভাবছে সে! তাও আবার অনুকে নিয়ে? এমন ভাবনা কি করে মনে এলো ওর? অনু কিছুতেই এমন কাজ করবে না। কিছুতেই না। কিছুতেই না।
-এই যে? শাওয়ার নেয়া হলো? টাওয়ালটা কে নিবে শুনি? ওয়াশরুমে কি টাওয়াল আছে? আর কারো টাউজার আর টিশার্ট বের করে রেখেছি। সেগুলো কি নিবে? নাকি বেডের উপরেই রেখে যাবো?
অনামিকার কথাটা শুনতে পেয়েই অরণ্য ওয়াশরুমের দরজাটা খুলেই টাওয়াল হাতে অনামিকাকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে টাওয়ালটা র্যাকে ছুঁড়ে ফেলে অনামিকাকে ওয়াশরুমের দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। ঝরঝর শাওয়ারের পানির শব্দ ছাপিয়ে একটা কথাই অরণ্যের কানে গিয়ে পৌঁছালো।
-আরে আমার শাড়ি-------?
অনামিকা কথাটা শেষ করার আগেই অরণ্যের উষ্ণ ঠোঁটের বাঁধনে আটকা পড়লো অনামিকার ঠোঁটজোড়া। শাওয়ারের শীতল পানিগুলো কাঁপন ধরাচ্ছে নাকি ভদ্রলোকে উষ্ণ গভীর স্পর্শগুলো, সে ব্যাপারে অনামিকার মনে প্রবল সন্দেহ আছে। একটু পরেই অরণ্য মুখটা না সরিয়েই অনামিকার ঘাড়ে মুখ ডুবালো। অনামিকাও ততক্ষণে অরণ্যের আদুরে ভালোবাসায় ভাসতে ভাসতে অরণ্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।
-সরি বউপাখি। বেশি ব্যথা দিয়ে ফেলেছি না বউটাকে? জানো এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না আমার। তারউপরে বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে। তবু এসবই বলে আমার মাথাটা গরম করে দিতে হবে? রাগের মাথায় তোমাকে আবার কষ্ট দিয়ে ফেললাম না? সরি অনুপাখি।
-আরে আমি ব্যথা পাই নি তো সত্যি। তুমি রেগে গেছ তাই দুষ্টুমি করে বলেছি। আর আমি সত্যিই বুঝতে পারি নি তুমি এতো রেগে যাবে। আর এতো রাগ করো না প্লিজ? আমি আছি তো তোমার পাশে। আল্লাহ চাইলে এভাবেই আজীবন পাশে থাকবো।
-আই লাভ ইউ অনু। ভিষণ ভিষণ ভিষণ ভালোবাসি তোমায় বউপাখিটা। এন্ড আ'ম সো সরি।
-আই লাভ ইউ টু মিস্টার হাজবেন্ড।
-হাতে কোথায় ব্যথা লেগেছে দেখি তো অনু? বেশি ব্যথা পেয়েছ? এখন ব্যথা করছে?
-আরে নাহ! কি করছে লোকটা! মা নাস্তা নিয়ে বসে আছে। নাস্তা ঠান্ডা হচ্ছে কিন্তু বলে দিলাম।
-আগে আমাকে দেখতে দাও তো। কথা কম বলো।
বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো দুজনে। চেইঞ্জ করে নাস্তা করে অরণ্য কিছুক্ষণ বাবা মায়ের সাথে গল্প করে রুমে চলে এলো। অনামিকাও মাকে কাজে হাতে হাতে একটু হেল্প করে দিয়ে রুমে এলো। রুমে এসেই বেচারি জাস্ট হা হয়ে গেল। অরণ্য একেবারে ফার্মাল ড্রেসআপ পড়ে রেডি হয়ে অনুর রুমের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চুল সেট করায় ব্যস্ত। অনামিকা অবাক চোখে অরণ্যের দিকে বোঝার চেষ্টা করলো লোকটা এখন কোথায় যাচ্ছে?
-এই অনু? তোমার কিছু লাগবে? আসতে লেইট হবে আমার। আগে বলে রাখছি। রাগ করতে পারবে না ফিরতে দেরি হলে।
-তুমি কোথায় যাচ্ছ? আজ না অফিস থেকে ছুটি নিলে? কোথায় যাচ্ছ বলো না? বাসায় সবাই ঠিক আছে? মা বাবা? কি হলো বলো না কেন কিছু?
অনামিকার প্রশ্ন বানে জর্জরিত হওয়ার আগে অরণ্য উল্টো ঘুরো অনামিকাকে হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে কপালে ছোট্ট করে আদরের ছোঁয়া এঁকে দিল।
-আরে বাবা রিল্যাক্স। বাড়িতে সবাই ঠিক আছে। কারো কিচ্ছু হয়নি ম্যাডাম। আই নো আজ ছুটি নিয়েছিলাম। বাট একটা আর্জেন্ট কাজ পড়ে গেছে গো অফিসে। এম.ডি স্যারের কথা বলেছিলাম না তোমাকে? উনি রিটায়ার নিবেন নেক্সট উইকে। তাই অফিসের স্টাফটা সবাই মিলে স্যারের জন্য একটা ফেয়ারওয়েল পার্টি থ্রো করছে। স্যারের ফেভারিট ইমপ্লোয়ি আমি, সেটা সবাই জানে। তাই দায়িত্বটাও একটু বেশি পড়েছে আমার ভাগে।
-ওহ!
-আরে অনু? মন খারাপ করছ কেন বলো তো পাগলি? কাজ শেষ হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো, প্রমিস। ওকে ম্যাডাম? হ্যাপি নাউ?
-আমি আরো ভাবলাম তুমি ফ্রি থাকলে একটা কাজ করতে বলবো। থাক, বাদ দাও।
-আরে না না। কি কাজ বলো না? আমি ম্যানেজ করে নিবো। প্রবলেম নেই।
-নাহ। তেমন কিছু না। স্মিতা বলেছিল ক্লাস নোটগুলো দিয়ে যাবে বিকেলের দিকে। ভাবলাম তুমি টাইম পেলে গিয়ে নিয়ে আসতে।
-ওকে ডান। কোথায় যেতে হবে লোকেশন বলে দিও আমাকে। বাট তুমি কলেজে না গিয়ে কি করছ? তুমিও কি লিভ নিয়েছ কলেজ, ক্লাস, পড়াশোনা সবকিছু থেকে?
-স্যারদের সাথে কথা বলেছি। ক্লাস না করলেও এক্সাম দেয়া যাবে। প্রবলেম হবে না। আর দুই তিন মাস পরেই ফাইনাল। তাই নোটগুলো কালেক্ট করে রাখছি। কিছু পড়া হয়নি। কলেজে যেতে আসতে এতো সময় নষ্ট না করে বাসায় সিলেবাস কমপ্লিট করে ফেলবো।
-বাহ! একা একা অনেক ডিসিশন নিতে শিখেছ আজকাল। নিজেকে কি মহা কাবিল মনে করো? নাকি সর্বজ্ঞানীর ভূত তোমার ঘাড়ে ভর করেছে যে ক্লাস ট্লাস না করেই ঘরে বসে এক্সামে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যাবে! ওয়াও!
-বকছো কেন এভাবে? এমনিতে অনেক ক্লাস মিস গেছে। আর ক্লাসও তেমন হবে না এখন। সাজেশনও দিয়ে দিয়েছে। স্যাররা বলে দিয়েছে লেকচার বুঝতে প্রবলেম হলে যোগাযোগ করলে হবে।
-নিজে নিজেই যখন ঠিক করে ফেলেছ তাহলে যা ইচ্ছে করো। শুধু এক্সামে একটা সাবজেক্টেও রিটেক আসুক। তারপর তোমাকে দেখাচ্ছি আমি।
-কেন কেন কেন? কি করবে কি হ্যাঁ?
-তেমন কিছু না। ব্যাগ পত্র সব নিয়ে সোজা এখানে রেখে যাবো। রিটেক ক্লিয়ার করে তারপর নিজের বাড়িতে পা রাখবেন। এর আগে না।
-অরণ্য?! আমাকে বাপের বাড়িতে রেখে যাওয়ার থ্রেট দাও না? আমি আর যাবোই না ওই বাড়িতে। তোমার সাথে তো কখনোই না। হুহ।
-সেটা পরে দেখা যাবে। এখন অফিসে যাওয়ার অনুমতিটা দিন মাডাম। সত্যিই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
-আচ্ছা। যান। সাবধানে যাবেন। আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন।
-জো হুকুম মহারাণী।
-আর স্মিতার নাম্বারটা তোমাকে টেক্সট করছি। ওর সাথে কথা বলে পারলে নোটগুলো নিয়ে নিও।
-বাহ! কাল আমি নাম্বার চাইলাম বলে কি রাগটাই করলো মেয়েটা! আর এখন কি সুন্দর নিজেই নাম্বার দিয়ে বলছে, ধরো, কথা বলে নিও। হাহ।
-ওই? আমি কি তোমাকে ওর সাথে চিটচ্যাট করতে নাম্বার দিচ্ছি? উল্টাপাল্টা কিছু বলেছ যদি শুনি আমি তাহলে তোমার একদিন আর আমার একদিন।
-ওকে ওকে কুল কুল ম্যাডাম। উল্টাপাল্টা কিছু বলবো না। জাস্ট মাঝে মাঝে দেখা করতে বলবো আর কি।
-অরণ্য?!
-হা হা হা। আরে বউ চ্যাঁতো কেন? আমাকে এইটুকু ভরসা করতে পারো। আর যা ই করি তোমার বেস্টুর সাথে প্রেম করবো না। পাগল নাকি! ধরা পড়ে যাবো না?
-এই তুমি যাও তো যাও। তোমাকে নোটস ও এনে দিতে হবে না। অসহ্য!
-হা হা হা। পাগলি একটা। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে গো। তুমি নাম্বারটা দিয়ে রাখো। আমি টাইম বের করে তোমার নোটগুলো নিয়ে রাখবো।
-ওকে বায়।
অনুদের বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে এসে বসতেই মোবাইলে টুং করে অনামিকার মেসেজটা আসলো। অরণ্য অফিসে টুকটাক কাজ গুছিয়ে নিয়ে স্মিতাকে কল করলো। স্মিতাও এড্রেস বলে দিতেই অরণ্য গাড়ি নিয় স্মিতার বলা লোকেশনে পৌঁছে গেল। একটা রেস্টুরেন্টে বসে হালকা নাস্তার ফাঁকে স্মিতার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে নোটগুলো নিয়ে গাড়িতে এসে বসলো অরণ্য। স্মিতার সাথে দেখা করতে কেউ একজন আসবে তাই আর ওকে বাসায় ড্রপ করা হয়নি। নোটগুলো গাড়িতে রেখে কিছু একটা ভেবে নিজের মনেই উশখুশ করে আবার স্মিতার নাম্বারে কল করলো অরণ্য। কলটা রিসিভ হতেই অরণ্য এক নিঃশ্বাসেই কথাটা বলে ফেললো।
-আমাকে সাহিলের নাম্বারটা একটু দিতে পারবেন প্লিজ? এই ব্যাপারটা আমি এখানেই শেষ করতে চাই। প্লিজ?
৪৫!!
দেখতে দেখতে প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। অনামিকা বলতে গেলে এক প্রকার নিজের সাথেই যুদ্ধ করেই ফাইনাল এক্সামের সিলেবাস কমপ্লিট করেছে এবং মোটামুটি ভালোভাবেই এক্সাম শেষ করে রিল্যাক্স মুডে সময় কাটাচ্ছিল। অরণ্যও বাবার অফিসে জয়েন করেছে। ভালোই কাটছিল ওদের সময়গুলো। মাঝখানে বাগড়া দেয়ার জন্য সাহিল কোথা থেকে উদয় হলো সেটাই বুঝতে পারছে না অনামিকা। লোকটার সাথে যা কথা বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। অনামিকাও নিজের জীবন, নিজের ছোট্ট সংসারটা নিয়ে খুশিই ছিল। কয়েকদিন ধরে অরণ্যকে একটা ব্যাপারে বলবে বলবে করেও বলা হয়ে ওঠে নি অনামিকার। শেষে স্মিতার হেল্পে সাহসে ভর করে কাজটা করেই ফেললো। রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে শুনে অনুর ইচ্ছে করছিল সাথে সাথেই অরণ্যকে কল করে বলবে কথাটা। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে স্মিতার সাথেই বাসায় ফিরেছে অনামিকা। ফেরার সময় স্মিতার মুখেই অরণ্যের স্মিতার কাছ থেকে সাহিলের নাম্বার নেয়ার ঘটনাটা শুনে কেমন যেন ভয় করতেই শুরু করেছে অনামিকার। ছেলেটা এতোদিন ধরে সাহিলের ব্যাপারে কিছু জানতে চায় নি। এমনকি সাহিলও গত কয় মাসে একবারের জন্যও না কল করেছে, না কোনো মেসেজ। কি কথা হয়েছে অরণ্য আর সাহিলের মধ্যে?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাড়ির মেইন গেইটের সামনে চলে এসেছে। স্মিতা অনুকে সাবধানে থাকতে বলে চলে যেতেই অনামিকা চিন্তিত মুখে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই পার্কিং এরিয়ায় অরণ্যের গাড়িটা দেখে একটু অবাক হলো। এই সময় তো অরণ্যের আসার কথা না। কথাটা ভেবেই তাড়াতাড়ি মেইন ডোর দিয়ে ঢোকার সময় ড্রইংরুমে অরণ্যকে কারো সাথে বসে কথা বলতে দেখে অনামিকা সেদিকেই এগিয়ে গেল। লোকটা দরজার দিকে পিঠ করে বসায় অনামিকা বুঝতে পারে নি লোকটা কে। অবশ্য লোকটার দিকে খুব একটা খেয়ালও করে নি অনামিকা।
-এইতো অনুও চলে এসেছে। বাইরে যাচ্ছো একবার বলে যাবে না? আমি টেনশন করছিলাম কত জানো? ওই বাড়িতে কল দিলাম সেখানেও যাও নি। মোবাইলটাও রেখে গেছ। হোয়াট ইজ দিস অনু?
-একটু স্মিতার সাথে বের হয়েছিলাম। ও এতো তাড়া দিচ্ছিল যে মোবাইলের কথা খেয়ালই ছিল না আমার। পরে ওর নাম্বার থেকে তোমাকে কল দিলাম। কল এঙ্গেজড শো করছিল বারবার।
-ওহ!
-এই সময় বাড়িতে ফিরলে এলে আজ? শরীর ঠিক আছে তোমার?
-অনু? আ'ম ওকে। আমার ফ্রেন্ড, তোমার সাথে মিট করতে চাইছিল অনেকদিন থেকেই। তাই ওকে নিয়ে এলাম বাড়িতে।
-কি? আপনি!
অরণ্য ফ্রেন্ডের কথা বলায় এতোক্ষণে সোফায় বসা লোকটার দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলো অনামিকা। সাহিল সোজা ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অনামিকা এতোটা অবাক হলো বলার মতো না। অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেছে অনামিকা। সাহিল ততক্ষণে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অনামিকার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেই অনামিকা অরণ্যের দিকে তাকালো।
-এই লোকটা এখানে কেন অরণ্য?
-অনু সাহিলের সাথে আমার কথা হয়েছিল। উনি তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল। তোমার এক্সাম চলছিল তাই যা বলার এক্সামের পর বলতে বলেছি।
-বাহ! দারুণ তো ব্যাপারটা! বাট উনার সাথে তো আমার আলাদা করে বলার মতো কোনো কথাই নেই। আমার যদি কাউকে কিছু বলারও থাকে, সেটা শুধু তোমাকে বলার আছে অরণ্য। আর কাউকে না।
-অনু প্লিজ? আই থিংক ইউ সুড লিসেন টু হিম। তোমাদের মধ্যে কি নিয়ে ভুল বোঝাবোঝি হয়েছে সেসব কথা সাহিল আমাকে বলেছে। ওর নিজেরও তোমাকে কিছু বলার আছে। আই থিংক ওকে একটা সুযোগ দেয়া উচিত তোমার।
-সুযোগ! কি? কিসের সুযোগ!
-আই থিংক, তোমার নতুন করে একবার সবটা ভাবা উচিত। ভালোবাসা এতো সহজ না যে ভুলে যাবে। হয়তো তুমিও আজো সাহিলকে ভালোবাসো বলেই ওকে ইগনোর করতে চাইছ। কিন্তু প্রিয় মানুষটাকে দূরে সরিয়ে তুমি কি ভালো আছো? নিজের মনের বিরুদ্ধে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কি মানুষ ভালো থাকতে পারে? গত কয়টা মাস ধরে তোমাকে দেখছি অনু। সাহিল ফিরে আসার পর থেকে তুমি প্রচন্ড ডিস্টার্ব হয়ে আছো। হয়তো তোমার এই দোটানার কারণটা আমি। তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি, ইনফ্যাক্ট পাগলের মতো ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসি বলে তোমার সুখটা অদেখা করে পড়ে থাকবো তেমন কাপুরুষও আমি নই অনু। আমার কথা ভেবো না অনু। তুমি যা চাইবে তাই হবে। ছোট্ট একটা জীবন আমাদের মধ্যে এলে যাওয়াটা আরো কষ্টের হবে তোমার পক্ষে অনু। তাই বলছি, নতুন করে সবটা ভেবে দেখো অনু।
অরণ্যের কথাটা শুনে কতোক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অনামিকা। অরণ্য আর সাহিল দুজনেই মিনিট খানেক চুপ করে অনামিকার নিরবতা দেখলো। অরণ্য একবার সাহিলের দিকে তাকিয়ে একটু এগিয়ে এসে অনামিকার গালে ছুঁইয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই অনামিকা নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে অরণ্যকে ধাক্কা দিয়ে সরে এলো সামনে থেকে। রাগের চোটে কিছু একটা বলতে গিয়েও কান্নার দমকে কথাগুলো গলাতেই আটকে গেল অনামিকার। কোনমতে পার্স থেকে একটা খাম অরণ্যের হাতে ধরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে রুমের দিকে ছুটে গেল। অরণ্য পিছন থেকে কয়েকবার ডেকেও অনামিকার কোনো সাড়া না পেয়ে অনামিকার দেয়া সাদা খামটা খুলে একটা রিপোর্ট পেল। রিপোর্টের লেখাগুলো দেখে অরণ্যের চোখ বড় বড় তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। যা দেখছে সত্যিই তো! নাকি স্বপ্ন! হিজিজিবিতে ভরা রিপোর্টটা একটা লাল মার্ক করা লাইনেই চোখ আটকে গেছে অরণ্যের।
"Pregnency Test: Result positive. "
অরণ্য স্তব্ধ হয়ে কাগজটা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে দেখে সাহিলও এবারে এগিয়ে এসে অরণ্যের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দেখলো। কাগজের লেখাগুলো চোখের সামনে ভাসতেই সেখানেই ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লো সাহিল। অরণ্য সাহিলের দিকে একবারও তাকানোর প্রয়োজনও মনে করলো না। কত বড় গাধার মতো কাজটা করেছে বুঝতে পেরেই ছুটলো রুমের দিকে। এক ছুটে রুমে এসেছে বলে রীতিমতো হাঁপিয়ে গেছে অরণ্য। অনামিকা বিছানায় বসে ফোঁপাচ্ছে দেখে অরণ্য অনামিকার সামনেই বসে অনামিকার মুখটা ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই অনামিকা অরণ্যের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল।
-কাজটা একদম ঠিক করো নি তুমি অরণ্য। একদমই ঠিক করো নি। যে লোকটার নামটাও তুমি আমার মুখে শুনে সহ্য করতে পারতে না একদিন, আজ কত সহজেই তার সাথেই আমাকে নতুন করে সব শুরু করতে বলছ! সিদ্ধান্তটা নেয়ার আগে অন্তত একটাবার আমাকে প্রশ্ন তো করতে পারতে। যে আমি কি চাই, আধো সেই লোকটাকে চাই কিনা যে কিনা আধো কখনো আমাকে ভালোই বাসেনি। সেই অমানুষটার মুখটাও দেখতে চাই কিনা যে অন্য কারো সাথে বাজি ধরে আমার সাথে ভালোবাসার নিঁখুত অভিনয় করে গেছে দিনের পর দিন? আমি একা একটা মেয়ে মাঝরাতে তার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি জেনেও যে লোকটা একটাবার 'তোমাকে ভালোবাসি নি কখনো' এটা বলার জন্য পর্যন্ত সামনে আসে নি। নিজের আলিশান বাড়িতে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার গাধামির, বোকামির আর তার বাজি জিতে যাওয়ার খুশিটা সেলিব্রেট করছিল। সেই লোকটা যার কথাটা মনে পড়লে পর্যন্ত আমার নিজের উপরেই ঘৃণা হয়, সেই লোকটাকেই তুমি আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলছ সব ভুলে তার সাথে নিজের জীবনটা শুরু করতে? বাহ! ভেবেছিলাম অন্তত এই ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখা সংসারটা আমার, তুমি আমার। কিন্তু না। তুমিও প্রমাণ করেই দিলে মেয়েদের নিজের বলতে কিচ্ছু হয়না। সংসারও না।
-হোয়াট!
অনামিকার কথায় অরণ্যের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। অরণ্য কিছু বলতে যাবে এমন সময় অনামিকা মুখ তুলে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে নিজেই আবার বলতে শুরু করলো।
-একটু আগে কি বলছিলে আমাকে অরণ্য? নতুন করে সবটা ভেবে দেখতে? এখন তুমি বলো? একজন ফ্রড লোকের সাথে নতুন করে নিজের জীবন শুরু করার কথা ভাববো? এটাই চাও তো তুমি? ওকে। কি করতে হবে বলো আমাকে? এখনই চলে যাবো? ওকে। সাহিলকে গিয়ে বলো আমি রেডি হয়ে আসছি। ওয়েট। রেডি হওয়া লাগবে না। আমি এমনিতেই ঠিক আছি। চলো?
-অনু প্লিজ? শোনো? আমি--------।
-চলো? দাঁড়িয়ে রইলে কেন? চলো? তোমার তো এটাই ইচ্ছে ছিল তাই না? আর কি যেন বলছিলে তুমি? আমার সুখের কথা ভেবে আটকে রাখার মতো কাপুরুষ নও। আরো কি কি যেন বলছিলে?
-অনু? অনু? অনু? সরি তো সোনাপাখি?
-আর কি যেন বলছিলেন আপনি মিস্টার অরণ্য? ছোট্ট একটা জীবন আমাদের মধ্যে এলে আর যেতে পারবো না ইত্যাদি ইত্যাদি। বাট আপনি টেনশন করবেন না। আমি জানি সাহিল ভিষণ ভালো একজন এক্টার। আপনার বেবিকে সে বাবার ভালোবাসা দেয়ার এক্টিংটাও জমিয়ে করবে। সো চিল। স্যাল উই?
-অনু? অনু? অনু? আ'ম রিয়েলি সো সরি। আমি বুঝতে পারি নি সাহিল----।
-কি বুঝতে পারো নি তুমি? কি সুন্দর সাহিলকে নিয়ে এসে বললে 'নতুন করে ভেবে দেখো'। যে লোকটার নামটা পর্যন্ত তুমি আমার মুখে শুনে সহ্য করতে পারতে না আজ হঠাৎ কি এমন হলো বলো তো?
-সাহিলের সাথে লাস্ট কয়েক মাস আমি টাচে ছিলাম আমি অনু। এতোগুলো দিন ছেলেটা জাস্ট তোমার সাথে একবার দেখা করার জন্য, একবার কথা বলার জন্য অপেক্ষা করে ছিল। তোমার এক্সামের সময় ডিস্টার্ব করলে এক্সাম খারাপ হবে বলার পর এতোদিনে একবারও বিরক্ত করেছে? অথচ আমাকে দেখো? তুমি হলুদের দিন সাহিলের জন্য বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলে শুনে আমি তোমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি। তিনটা মাস এতো জঘন্য ব্যবহার করেছি যে নিজেরই নিজেকে ঘৃণা হয় আমার এখনো।
-ওয়াও! তা আপনার ওই মহান বন্ধুটিকে একবারও জিজ্ঞেস করেন নি কেন সেদিন আমি বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরেও পরেরদিন আপনার বউ হয়ে আপনার বাড়িতে এলাম?
-জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও সেদিন এসেছিল অনু। কিন্তু ততক্ষণে তুমি ফিরে গেছো।
-ওয়াও। এসো আমার সাথে? আমার সামনেই কথাগুলো বলুক তোমার ওই মহান বন্ধুটি। এসো আমার সাথে।
-অনু আস্তে? আমার আর কারো কাছ থেকে কিচ্ছু জানার নেই অনু। প্লিজ? সরি তো?
-সরি? সরি মাই ফুট! আমি বারবার তোমাকে কথাগুলো বলতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি? একবারও শোনার চেষ্টা পর্যন্ত করো নি। ওকে ফাইন। যার কথায় বিশ্বাস করে আমাকে নিজের জীবন থেকে দূর করতে চাইছিলে, তার মুখেই সব সত্যিটা শুনবে চলো। তারও তো জানা উচিত যে তার আসল রূপটা আমি সেদিনই চিনে ফেলেছিলাম। এসো? আর একটা কথাও বলবা না তুমি আমার সাথে।
-অনু? ওকে ফাইন যাচ্ছি আমি। এতো হাইপার হয়ো না প্লিজ? আর এই? তুমি স্মিতার সাথে গিয়ে টেস্ট করিয়েছ? আমাকে একটাবার বললে না পর্যন্ত! এতো বড় আনন্দের একটা খবর এমন সময়ে পেলাম! উফ! আই কান্ট বিলিভ দিস। আমি বাবা হতে চলেছি!
-আপনি বাবা হচ্ছেন না মিস্টার অরণ্য চৌধূরী। সন্তানটা আমার একার। ওর উপরে আপনার কোনো অধিকারই নেই।
-অনু? প্লিজ? শোনো না? ভুল হয়ে গেছে তো? এই?
অরণ্যের হাজার অনুনয় বিনয়ের পরও অনামিকা আর একটাও কথা বললো না। সোজা অরণ্যের হাত চেপে টানতে টানতে নিচে ড্রইংরুমে এসে সোজা সাহিলের মুখোমুখি হলো। অরণ্য আর অনামিকাকে সামনে দেখে এতোক্ষণে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে সাহিল। সাহিল কেমন হতভম্ব হয়ে নিজের হাতটা এগিয়ে অনামিকাকে ধরার চেষ্টা করতেই অনামিকা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সাহিলের গালে কষিয়ে একটা চড় বসালো। সাহিল কিচ্ছু না বলে শুধু ফ্যালফ্যাল করে অনামিকাকে দেখছে। মেয়েটাকে এতো রাগতে এই প্রথমবার দেখেছে সাহিল। এর আগে মেয়েটার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ছাড়া আর কিছুই দেখে নি সাহিল। এই রূপটা কি সবসময়ই ছিল অনামিকার? নাকি আজ অরণ্যের থেকে দূরে চলে যেতে হবে এই ভয়ে সদাহাসিখুশি মেয়েটা এতো তপ্ত জ্বালামুখীর রূপ নিয়েছে?
-কলেজে হাজারটা মেয়ে আপনার পিছনে পাগল দিওয়ানা হয়ে ঘুরতো কেন জানেন? আপনার এই ফেইক ভালো মানুষির মুখোশটার কারণে। আপনার কথাবলা, স্টাইল, সবার সাথে অমায়িক বিহেভ, সব কিছুতেই সবার মতো আমিও ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। কলেজ গ্রাউন্ডে যেদিন আপনি 'ভালোবাসি' কথাটা বলেছিলেন সেদিন মনে হয়েছিল আমার চেয়ে লাকি বুঝি পৃথিবীতে আর কেউ নেই। ক্রাশ ছিলেন, তাই আগে পিছে না ভেবেই আমিও আপনার প্রপোজ এক্সেপ্ট। করে নিই। আপনি যে মিছিমিছি ভালোবাসার নাটক করছেন সেটা জানতে আমার অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। কি করবো বলুন? আমি তো আর নাটক করি নি। সত্যি সত্যিই তো ভালোবেসেছিলাম। আর ভালোবেসেছিলাম বলেই আপনার জন্য ঘর ছাড়তেও পিছপা হইনি। আর আপনি?
-অনামিকা প্লিজ? তোমাকে কে কি বলেছে আমি জানি না। বাট বিলিভ মি। আই লাভ ইউ সো সো মাচ।
-জাস্ট শাট আপ। আর কত নাটক করবেন বলুন তো সাহিল? এসব নাটক করে আপনার হাজবেন্ডকে বুঝ দিতে পারবেন যে আমাকে কতটা সুখে রাখবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু আমাকে আর বোকা বানাতে পারবেন না।
-আমি কাউকে বোকা বানাচ্ছি না অনামিকা। ট্রাস্ট মি।
-আপনার বাবা আমাদের বাসায় এসে বাবাকে কি অপমানটাই না করেছে মনে আছে আপনার সাহিল? সেদিন বাবার অপমানের কথাটা আপনাকে জানানোর পর আপনার বাবা আবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন। সরি বলে ক্ষমা চাইতে নয়। আপনি যে শুধুই টাইম পাস করছেন আমাকে নিয়ে, আপনার যে অলরেডি আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেটা বলার জন্য এসেছিল। তারপর আমার বাসাতেও বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। আপনার বাবা কি বলেছেন আমার জানা ছিল না। হলুদের দিন আপনাকে আসতে বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে কতোক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন আপনি আসলেন না তখন আমি নিজেই আপনার বাড়িতে যাই সাহিল।
-হোয়াট! অনামি আই ক্যান এক্সপ্লেইন প্লিজ?
-আপনার মোবাইলে আমার মেসেজটা দেখে আপনাদের দুজনের হাসাহাসির করার মূহুর্তটা মনে পড়ে সাহিল? সেই মূহুর্তটায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিল জানেন? বাবা মায়ের সম্মানের কথাটা ভেবে সেদিন বাড়ি ফিরে আসি। আর সেই মানুষটাকেই বিয়ে করি যে আমাকে একনজর দেখেই সমাজে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের স্ত্রী করে ঘরে তুলেছে। আর আপনি চাইছেন আমি সেই মানুষটাকে ফেলে আপনার মতো একজন ধোঁকাবাজের হাত ধরে চলে আসবো? শুধু আমার সন্তানটা আসছে বলে নয়, এই মানুষটাকে আমি একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছি বলেও নয়, আমার সংসারের কথা ভেবেও নয়, আপনাকে নিয়ে যে মেয়েটা রঙিন স্বপ্নের দুনিয়ায় সংসার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে, তার জন্য হলেও আমি মরে গেলেও আপনার সাথে যোগাযোগ রাখবো না কখনো।
-আমি সেদিন এসেছিলাম অনামিকা। তোমার জন্য এসেছিলাম। ততক্ষণে তুমি চলে গেছো। তৃষার সাথে বাজি ধরে তোমার সাথে ভালোবাসার নাটকটা করতে করতে কখন তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি নিজেও জানি না। কথাটা তৃষাকে বলতেও পারছিলাম না। আগে বেস্টফ্রেন্ড ছিল, পরে পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়েটা ফিক্সজড হয়। ওকে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না, আর না তোমাকে ভুলে যাওয়ার। তুমি আমার এতোটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলে অনা যে আমি প্রতিদিন তোমার কলের অপেক্ষায় বসে থাকতাম। সেদিন হলুদের পর তোমাকে না পেয়ে কতবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি তুমি নিজেও জানো না। বিয়ের পর কলেজে আসছো না, বাড়িতে যাও নি, সব মিলিয়ে পাগল হয়ে ছিলাম একপ্রকার। শুধু সামনে দাঁড়িয়ে একবার তোমার চোখে চোখ রেখে 'ভালোবাসি' বলতে চেয়েছি অনা। কতোটা ভালোবাসি সেটা বলে বোঝাতে পারবো না তোমাকে। শুধু একটাই অনুরোধ, পারলে ক্ষমা করে দিও এই খারাপ লোকটাকে।
-ক্ষমা আমার কাছে না চেয়ে সেই মানুষটার কাছে চান যে সবটা জানার পরও আপনাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে। হ্যাঁ তৃষা। সেদিন আমি জানলার বাইরে থেকে লুকিয়ে আপনাদের কথাগুলো যখন শুনছিলাম, তৃষা আমাকে দেখে ফেলেছিল। মিথ্যে নাটক করে যে অন্যায়টা করেছেন, তার চেয়েও হাজার গুণ অন্যায় করেছেন কারো বিশ্বাসটা ভেঙ্গে। ক্ষমা যদি চাইতেই হয় তাহলে তার কাছেই গিয়ে ক্ষমা চান।
অনামিকার কথাগুলো শুনে সাহিল আর কিচ্ছু না বলে এগিয়ে এসে অরণ্যের সাথে হ্যান্ড শেইক করে বেরিয়ে পড়লো। সাহিল চলে যেতেই অনামিকা সোফায় বসে নিজের মাথাটা চেপে ধরে আবার ফুঁপিয়ে উঠলো। অরণ্য তড়িঘড়ি করে অনামিকার সামনেই বসে পড়ে অনামিকার মুখটা দুহাতের আঁজলায় তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।
-অনু অনু অনু? প্লিজ প্লিজ প্লিজ? এবারের মতো মাফ করে দাও প্লিজ? আর এমন ভুল জীবনেও হবে না বউ প্রমিস।
অরণ্যের কথাটার জবাব না দিয়ে অনামিকা বিছানা থেকে নেমে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অরণ্য অনামিকার হাত ধরে টেনে নিজের কোলেই বসিয়ে নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। অনামিকা রাগের চোটে ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই অরণ্য অনামিকার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে একহাতে অনুকে জড়িয়ে ধরে অন্যহাতে অনামিকার পেটে আলতো করে হাত রাখলো।
-তোমার এই রাগ করাটা হয়তো নিজের জায়গা থেকে সঠিক। কিন্তু বিশ্বাস করো অনু, তোমাকে হারানোর ভয়টা আমার মনে এতোটা চেপে বসেছিল আমি কি করছি, কেন করছি সেটা নিজেও বুঝতে পারি নি।
-হারাতে চাও না, তাই দূরে সরিয়ে দিচ্ছিলে তাই তো? তুমি ভাবলে কি করে আমি সাহিলের সাথে----। একবার আমার কাছে জানতে পর্যন্ত চাও নি কি হয়েছিল, কেন আমি সাহিলের থেকে সরে এসেছি। নিজের মতো করে যা ভাবার ভেবে নিলে। বাহ!
-এই অনু? কেঁদো না প্লিজ? সরি তো। তুমি সাহিলের ব্যাপারটা নিয়ে এতো ডিস্টার্ব ছিলে, তার উপরে সাহিলের কথাগুলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত।
-যা করার করেই ফেলেছেন। এখন ছাড়ুন। আমার ব্যাগ গোছানো বাকি।
-মানে? ব্যাগ গোছাবে কেন? কোথায় যাবে?
-আমি কোথায় যাবো সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার আর কোনো অধিকার তোমার নেই। আমি চলে যাই এটাই চেয়েছিলে না তুমি? সেটাই হবে। এর বেশি কিছু জানার বা শোনার প্রয়োজন নেই তোমার।
অনামিকার কান্নাভেজা কণ্ঠস্বরটা শুনে অরণ্য মুখ তুলে অনামিকার দিকে তাকিয়ে আলতো করে অনামিকার গাল ছুঁইয়ে দিল।
-পারবে আমাকে ছেড়ে যেতে অনু? একটুও কষ্ট হবে না আমাকে ছেড়ে থাকতে?
-কেউ যদি আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে থাকতে পারে, তবে আমি কেন পারবো না? কোনো ব্যাপার না। মা বাবা অফিস থেকে আসার সময় হয়ে গেছে। আমি গুছিয়ে নিই।
-এই যে ম্যাডাম। কোথাও যাওয়া চলবে না বুঝলেন? আমি আর পিচ্চি মিলে কোথাও যেতেই দিবো না আপনাকে বুঝলেন? আদরে যাকে বাধা না যায়, তাকে শাসনের চাদরে বাঁধতে হয়। আর শাসনে না বাঁধা গেলে ভালোবাসায়।
-আমি যাবো মানে যাবোই।
-আচ্ছা যাও তো দেখি?
এবারে অনামিকার রাগ ভাঙ্গাতে রীতিমতো যুদ্ধ জয় করতে হয়েছে অরণ্যকে। পুরো একটা মাস সময় লেগে গেছে বেচারার অনুর রাগটা ভাঙাতে। শেষমেশ হাজার খানেক বার সরি আর ভবিষ্যতে ভুলেও এমন কিছু ভাববেও না এই মর্মে লিখিত দেয়ার পর অনামিকা অরণ্যকে মাফ করেছে।
দেখতে দেখতে আরো অনেকগুলো মাস কেটে গেছে। হসপিটালে ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডের বাইরে তাইয়্যেবা জামান, আরহান চৌধূরী, অনুর বাবা মা, তাহিয়া, স্নিগ্ধ, সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে। অরণ্যও ব্যস্ত পায়ে হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে। কেমন গলা শুকিয়ে আসছে অরণ্যের। আর কিছুক্ষণের মধ্যে অনামিকার কোনো খোঁজ না পেলে হয়তো অরণ্যেরই দম বন্ধ হয়ে আসবে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডের দরজা খুলে ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই অরণ্য ছুটে তার দিকেই এগিয়ে গেল। বাকিরাও অরণ্যের পিছুপিছু এসে হাজির হয়েছে প্রায় সাথে সাথেই।
-কি হয়েছে ডক্টর? অনু? অনামিকা আমার ওয়াইফ কেমন আছে? আর আমাদের বেবি?
-রিল্যাক্স মিস্টার অরণ্য। মিসেস আর মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পেশেন্টকে কেবিনে দেয়া হবে। কিছু চেকাপ করা বাকি। নার্স? বেবিকে নিয়ে আসুন প্লিজ। ওকে মিস্টার অরণ্য। মিষ্টি চাই কিন্তু।
-ইয়া ডক্টর, অফকোর্স। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
ডাক্তার চলে যেতেই নার্স ধবধবে সাদা টাওয়ালে মোড়া একটা ছোট্ট পরীকে এনে অরণ্যের কোলে দিল। অনুভূতিটা এতোই অসামান্য যে অরণ্য স্তব্ধ হয়ে ছোট্টো ছোট্টো হাত পাগুলোর নড়াচড়া দেখলো। বাচ্চাটা ঠোঁট মুখ বাঁকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমার শব্দ করে নিজের আসার জানান দিচ্ছে দেখে অরণ্য হেসে ফেললো। বাকিরাও অরণ্যকে ঘিরে ধরে ছোট্ট নবজাতকের এই অপার সৌন্দর্যটা উপভোগ করতে লাগলো।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর অনামিকাকে কেবিনে দেয়ার পর অরণ্যই প্রথমে কেবিনে এলো অনামিকার সাথে দেখা করতে। নার্স আগেই বাবুটাকে নিয়ে চলে এসেছিল। টুকটাক চেকআপ করার পর আবার এতোক্ষণে বাচ্চাটা জায়গা পেয়েছে মায়ের কোলের কাছে। ছোট্ট শিশুটার নড়েচড়ে শব্দ করে হাসি কান্না দেখতে দেখতে অনামিকারও চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অরণ্য সেটা খেয়াল করে গভীর মমতায় অনামিকার চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে আদরের পরশ বুলিয়ে দিল অনামিকা আর বাবু দুজনের কপালে।
-আমাদের এই ছোট্ট পরীটা এসে তোমার আমার ভালোবাসার সংসারটা পূর্ণ করলো অনু। ওকে আমি পূর্ণতা বলেই ডাকবো। তোমার যা ইচ্ছে হয়। ডাকতে পারো। বাট ও আমার পূর্ণতা, পূ্র্ণামা।
-আমাদের ছোট্ট অনিন্দিতা চৌধূরী পূর্ণতা।
কথাটা বলেই অনামিকা একটু ঝুঁকে পূর্ণতার কপালে চুমো এঁকে দিতেই অরণ্যও চুমো আঁকলো মেয়ের কপালে। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতেই অরণ্য আর অনামিকা দুজনেই সামনের দিকে তাকাতেই দেখলো স্নিগ্ধ ক্যামেরায় মূহুর্তটাকে ক্যাপচার করে নিয়েছে। ধীরে ধীরে সবাই এগিয় এসে পূ্র্ণতাকে নিয়ে মেতে উঠেছে দেখে অরণ্য অনামিকার বেডের পাশে এসে দাঁড়ালো। দুজনেই হাসি মুখে তাদের ছোট্ট পরিপূর্ণ সংসারটাকে দেখছে। ছোট্ট পূর্ণতা এসে ওদের সংসারটাকে সত্যিই পূর্ণ করেছে। এভাবেই হাসি আনন্দেই যেন পূর্ণতা পায় সবার ভালোবাসার সংসারগুলো। সব অনামিকা আর অরণ্যের সংসারগুলো এভাবেই সুখে, হাসিতে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিক কোনো গুটিগুটি পায়ে পূর্ণতারা এসে।
***(সমাপ্ত)***