অনাকাঙ্ক্ষিত সে - পর্ব ০৫ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


মিশ্মি বাড়িতে গিয়ে দেখে বড় খালা খুব চেঁচামেচি করছেন। মিশ্মির পেছনে আলভী এসেও দাঁড়ায়। মিশ্মিকে দেখে মোহনা যখন এগিয়ে আসে তখনই বড়খালা মিশ্মিকে দেখতে পায়। তিনি চটপট এসে মোহনাকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়েই সরায়। মিশ্মির কনুই ধরে বলে,
"নাগর জুটাস বাইরে নাগর? তারা আবার বাড়িতে আসে? পেটে পেটে এত চলে তোর?"
মিশ্মিকে রেহেনুমা বেগমের সামনে গিয়ে বলে,
"আগেই বলেছিলাম তোর জামাইরে বুঝা। কলেজে পড়া লাগবো না। তুই তো শুনলিনা আমার কথা।"
"আমি কি করবো আপা? উনার মাইয়া উনি কলেজে পড়াবে এতে আমি কি বলতাম।"
"এত নরম হইছিস বলেই তো এই মেয়ে এত আশকারা পেয়েছে।"
হুটহাট এমন আচরণ দেখে আলভীর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আলভী এগিয়ে এসে বড়খালার থেকে মিশ্মিকে ছাড়ায়। মিশ্মি এতক্ষণ দেখেইনি যে আলভী ওর পিছু পিছু এসেছে। মিশ্মি অবাক হয়ে বলে,
"আপনি এখানে?"
আলভী সে কথার উত্তর দিল না। বড়খালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
"অদ্ভুত মহিলা তো আপনি। সেদিন হাসপাতালেও দেখলাম ওকে শাসাচ্ছেন। আর এখন কিসব যা তা বলছেন।"
বড়খালা মাথায় হাত দিয়ে বলেন,
"ওরে বাবা ওরে বাবা! মানুষ একটা পায় না আর এই মেয়ে দুইটা নাগর নিয়ে ঘুরে।"
"দেখেন আপনি কিন্তু... "
পুরো কথা বলার আগে মিশ্মি আলভীকে টেনে বাহিরে আনে।
"হাত জোর করে বলছি। এখান থেকে চলে যান প্লিজ।"
"আরে! ওরা যা তা বলছে তোমাকে। তুমি কিছু বলছো না কেন?"
"আমি এসব ব্যবহারে অভ্যস্ত। আপনি যান প্লিজ। আপনি থাকলে আরো বেশি ঝামেলা হবে। যান প্লিজ প্লিজ।"
আলভী কিছু বলতে গিয়েও আর বলতে পারলো না। মিশ্মির আকুতি ভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করতে না পেরে সেখান থেকে বাধ্য হয়ে চলে যায়। কিন্তু মনটা তখনও মিশ্মির কাছে। একটা মা ছাড়া মেয়েকে কেউ এত অত্যাচার করতে পারে!
ছোটখালা বাহিরে এসে মিশ্মির চুল ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। মিশ্মির গাল টিপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করে। মিশ্মি ছোট খালার হাত টেনে সরিয়ে দেয়।
"গালাগালি করবেনা একদম বলে দিলাম।"
বড়খালা মিশ্মির গালে থাপ্পড় দিয়ে বলে,
"কি করবি তুই গালাগালি করলে? কি করবি বল?"
আরেকটা থাপ্পড় যখন দিতে যাবে মোহনা এসে মিশ্মিকে জড়িয়ে ধরে। কেঁদে কেঁদে বলে,
"প্লিজ আমার আপুকে মেরো না খালা। কেন মারছো ওকে? ওর তো কোনো দোষ নাই। তোমরা সবাই মিলে মারলে আমার আপু মরে যাবে।"
বড়খালা বলেন,
"রেহু তোর মেয়েকে এখান থেকে সরা বলছি। নয়তো ওকেও কিন্তু দু'ঘা দিয়ে দিবো। সৎ বোনের জন্য কিসের এত দরদ হ্যাঁ?"
"তোমাদের চোখে সৎ, আপন থাকতে পারে। কিন্তু আমার চোখে না। তোমাদের মত অমানুষ তো নই আমি।"
রেহেনুমা বেগম মেয়ের মুখ চেপে ধরেন। অনেক কষ্টে টেনে-হিঁচড়ে মিশ্মির কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। মোহনার গালে সজোরে থাপ্পড় দিয়ে বলে,
"চুপ করে থাক। বড়দের মুখে মুখে কথা বলিস কেন?"
মিশ্মি বলে,
"ওকে মেরো না মা। তোমরা কেন এমন করছো একটু বলবে প্লিজ!"
তখন মামা বলল,
"আমি বলছি শোন। নুয়াজ কে? তার কাছ থেকে তুই টাকা নিয়েছিস?"
মিশ্মি এবার গভীর চত্বরে পড়ে যায়। নুয়াজের সাথে মিশ্মির যেই সম্পর্ক সেটা কখনোই কাউকে বলার মত না। কি করে বলবে এমন সম্পর্কের কথা। আর নুয়াজ কেনোই বা এটা করলো। কেন বাড়িতে এসেছিল নুয়াজ। 
"কিরে চুপ করে আছিস কেন?"
"নুয়াজ কি বাড়িতে এসেছিল?"
"হু। শুধু আসেই নি। তোর কুকীর্তিও বলে গেল।"
মিশ্মির বুক যেন ধক করে ওঠলো। তাহলে কি বাজে সম্পর্কের কথাটা নুয়াজ বাড়িতে সবাইকে বলে দিয়েছে।
"কতদিন ধরে সম্পর্ক?"
মিশ্মি আমতা আমতা করে বলে,
"ক..কিস...কিসের সম্পর্কের কথা বলছো মামা?"
বড়খালা দাঁত কটমট করে বলে,
"এত ভালো করে জিজ্ঞেস করলে ও প্রশ্নের উত্তর দিবে তোর মনে হয়?"
"আহ্! বড় আপা আমাকে কথা বলতে দাও।
কতদিন ধরে ওর সাথে তোর রিলেশন আছে মিশ্মি?"
মিশ্মি চুপ করে আছে।
"নুয়াজ কি বলেছে জানিস?"
"না।"
"নুয়াজ তোকে বিয়ে করতে চায়। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল।"
মিশ্মি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।
"নুয়াজ বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল?"
"হ্যাঁ। এখন আর কোনো প্রশ্ন করবিনা।যা ফ্রেশ হয়ে নে।"
হুট করেই যেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিক। বড় কোনো ঝড়ের পূর্বে মূলত এমনই হয়। মোহনাকে দিয়ে মিশ্মিকে ভেতরের রুমে পাঠায়।

বড়খালা রেগে বললেন,
"এটা তুই কি করলি?"
"মাথা গরম করে কি কিছু হবে? তুমি তো অযথাই ছেলেকে গালাগালি করলে। আরে টাকার বস্তা ঐ ছেলে। মিশ্মিকে বিয়ে করতে চায় এটা তো আমাদের জন্য সূবর্ণ সুযোগ। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ।"
"তোর কথা ঠিক আছে। কিন্তু মিশ্মি যেই মেয়ে ও কখনোই আমাদের টাকা এনে দিবেনা।"
"সেটা এখনই একবার ট্রাই করে দেখা যাক।"
"কিভাবে?"
"দেখতে থাকো।"

মিশ্মি আর মোহনা বিছানায় বসে আছে। মোহনা মিশ্মিকে জড়িয়ে ধরে আছে। বড়খালা, ছোট খালা, মা আর মামা রুমে আসে। মামা শান্তস্বরে মিশ্মিকে জিজ্ঞেস করে,
"তুই কি নুয়াজকে ভালোবাসিস?"
"না।"
"তাহলে ওর কাছে টাকা চাইলি কেন?"
"কারণ ও ছাড়া আর কেউ ছিল না আমাকে সাহায্য করার।"
"তুই জানতি যে, তুই চাইলেই ও টাকা দিবে?
"মনে হয়েছিল।"
"বেশ! তুই ওকে ফোন দিয়ে ১০ হাজার টাকা চা।"
"টাকা চাইবো কেন? আমার যতটুকু দরকার ছিল বাবার অপারেশনের জন্য নুয়াজ তা দিয়েছে।"
"তখন বাবার জন্য চেয়েছিস আর এখন আমাদের জন্য চাইবি। দেখ টাকার খনি কিন্তু এখন তোর হাতে। এটাকে কিন্তু তুই চাইলেই বিজনেস করতে পারিস।"
"ছিহ্ মামা! এত টাকার লোভ তোমাদের? আমি কখনোই চাইবো না ওর কাছে টাকা। আর তোমাদের তো দিবোই না।"
বড়খালা বলেন,
"বলেছিলাম না এই মেয়ে কথা শুনবে না? নুয়াজের সাথে ওর বিয়ে দিলে নিজে রাজরাণী হয়ে থাকবে। আমাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না।"
মিশ্মি দাঁড়িয়ে বলে,
"একদম ঠিক বলেছ। অন্তত তোমাদের মত মানুষরূপী পশুদের হাত থেকে তো বাঁচবো। বাবা শুধু সুস্থ হোক। বাবাকেও নিয়ে যাবো আমি। প্রয়োজনে অনেক দূরে চলে যাবো।"
বড়খালা তাচ্ছিল্য করে বলে,
"সেগুড়ে বালি রে মিশ্মি। তুই যেখানে খুশি চলে যা। তার আগে টাকার লক্ষীকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে।"
"মানে?"
"তুই নুয়াজকে বলবি যে, তুই ওকে বিয়ে করবি না। আর ওকে বুঝাবি আমার মেয়ে এ্যানিকে যেন নুয়াজ বিয়ে করে। তোকে দিয়ে তো আর টাকা আনতে পারবো না। তাই নিজের মেয়ের সাথেই বিয়ে দিব।"
"আর কত নিচে নামবে খালা? শেষমেশ নিজের মেয়েকে দিয়ে ব্যবসা করতে চাচ্ছো? এত লোভ তোমাদের?"
"তোর কাছে জ্ঞান নিতে চাচ্ছি না আমি। যেটা বলেছি সেটা কর।"
"নুয়াজ এ্যানিকে বিয়ে করবে না খালা।"
"কেন করবেনা? আমার মেয়ে কি কোনো অংশে কম? তুই নুয়াজকে ভালোমত বুঝাবি। যা রেডি হয়ে নুয়াজের কাছে যা। আমাদের হয়ে ওকে স্যরি বলিস। বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় নিয়ে আসিস। শোন ভুলেও ওর সাথে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবিস না। পরিণাম ভয়াবহ হবে বলে দিলাম।"

মিশ্মি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে এখন? নুয়াজ কখনোই এ্যানিকে বিয়ে করবেনা। ওর বিয়ে করার জন্য কি বড়লোক মেয়ের অভাব আছে! আর যদি বিয়ে হয়ও তাহলে এ্যানিকে ঠকানো হবে। আমি তো জানি নুয়াজ কেমন। নোংরা মনের মানুষ। তার চেয়েও তো নোংরা আমার পরিবারের মানুষগুলো।


ব্রিজের ওপর দিয়ে আনমনা হয়ে হাঁটছে মিশ্মি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে দেখেছে বিভিন্ন রকম আয়োজন করতে। বের হওয়ার আগে তো আজ বড়খালা গালে চুমুও খেয়েছে। ছোটখালা জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। মামা হাতে দু'শো টাকা গুঁজে দিয়ে সাবধানে যেতে বলেছে। তবে সবার এত আদরের শেষে একটা কথাই ছিল। তা হলো, মিশ্মি যেন বিয়েতে রাজি না হয়। আর এ্যানির জন্য নুয়াজকে রাজি করায়। তাদের বিশ্বাস মিশ্মি ঠিক রাজি করাতে পারবে। তবুও তাদের টাকা চাই'ই। আচ্ছা টাকার এত জোর? কাগজের তৈরি নোটগুলোর এত মূল্য যে মানুষকে পশু বানাতেও দু'বার ভাবেনা!
নুয়াজ অনবরত ফোন করেই যাচ্ছে। মিশ্মি ফোন ধরছেনা। কি হবে ধরে? কি বলবে? নুয়াজ কি শুনবে মিশ্মির কথা! বিশাল নদীর পাড়ে বসে আছে মিশ্মি। দৃষ্টি পানির দিকে স্থির। বাবাকে দেখতে যায়নি। দেখলেই পিছুটানে পড়ে যাবে। আর কোনো মায়া আর কোনো পিছুটান রাখা যাবে না। এই নিষ্ঠুর মানুষের ভীড়ে মিশ্মির প্রয়োজনীয়তা ফুঁরিয়ে এসেছে। এখনই জীবন বিসর্জন দিবে এই স্বচ্ছ পানির স্রোতে। একটা সময় লাশ ভেসে উঠবে। নাহ্! আর ভাবা যাচ্ছেনা। তার আগে নুয়াজকে লম্বা একটা ম্যাসেজ পাঠায়। সেন্ড বাটনে ক্লিক করতেই নুয়াজ এসে মিশ্মিকে দাঁড় করিয়ে গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। মিশ্মি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে। মিশ্মির বাহু ঝাঁকিয়ে ধরে বলে,
"ফোন ধরতে কষ্ট লাগে? সবসময় লোকেশন ট্র্যাক করে তারপর তোমার কাছে আসতে হবে?"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন