ভোরের রোদ - পর্ব ০২ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৩!! 

-এই মেয়ে? তোর সাহস তো কম নয়? এভাবে আমার সামনে তুই ভিজলি কোন সাহসে? সামনে না তোর পরীক্ষা? আর এখন জ্বর টর বাঁধিয়ে পরীক্ষায় গোল্লা মারতে চাস তুই? ফেইল টেইল করলে চাচ্চু রাগ করে তোর বিয়ে দিয়ে দিবে এমন কিছু প্ল্যান আছে নাকি তোর? তোর মতো ফেলটু মেয়েকে বিয়ে করবে কে রে হ্যাঁ? তুই তো দেখছি চাচ্চু আর ছোট মাকে একটুও শান্তিতে থাকতে দিবি না ভোর-----। 

রোদের কথাটা শুনে ভোর হা করে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগ উঠলেই ভোরের আর কোনো কিছুর হুঁশ থাকে না। নাহয় রাগ করে একটু ভিজেছিল। তাই বলে এই বজ্জাত লোকটাকে এসব বলতে হবে? আর সে যেন চিন্তায় মরে যাচ্ছে ফেইল করলে বিয়ে হবে না ভোরের। হুহ। আজাইরা সব কথাবার্তা। ভোর পরীক্ষার আগে একদিনও পড়তে না বসলেও ফেইল করবে না। উঁহু। কক্খনোই ফেইল করবে না। ফেইল করারইবা কি হলো? এস এস সি কি এমন একটা কঠিন পরীক্ষা! এটায় আবার ফেইল করার কি আছে! সব সাবজেক্টই তো কয়েকবার করে রিভাইস করা হয়ে গেছে ভোরের। 

-অবশ্য---। ফেইল করলেও সমস্যা নেই। আমার অবশ্য ফেলটু বউও চলবে। কিন্তু এমন ঢং করে রাগ দেখিয়ে এমন  চুবচুবে হয়ে ভিজে আবার জ্বর বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে থাকবি! সেটা তো একদমই চলবে না ভোর। ভিজে ঠান্ডা বাঁধালে সেই ঠান্ডার মধ্যেই দেখবি ফ্রিজের বরফ ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিবো তোকে আমি---। মনে থাকে যেন কথাটা--।

-হুহ---। আমার বয়েই গেছে এমন----।

-কিছু বললি?

-কই! না তো! কিচ্ছু বলি নি----।

-আমি তো শুনলাম কিছু বলছিলি তুই---। কি বয়ে যায় নি তোর----?

-আরে না না--। আমি কিছু বলি নি---। তুমিও তো ভিজে গেছ রোদ ভাইয়া--? চেইঞ্জ করে নাও না? তোমারও তো ঠান্ডা লেগে যাবে?

-আমার ঠান্ডা লাগলেও আজকে তোর খবর আছে---। সব দোষ তোর---। 

-আমি কি করেছি?

-কি করেছিস জানিস না? সামান্য একটা টিশার্টের জন্য এমন কেঁদেকেটে দুনিয়া ভাসিয়ে দিচ্ছিলি---। আবার রাগ দেখিয়ে শাওয়ার ছেড়ে কাঁদছিলি---। তোর কান্না থামাতে এসেই তো আমিও ভিজে গেলাম---।

-তোমাকে কে আসতে বলেছে আমার কান্না থামাতে?

-এই কি বললি তুই? তুই এমন মরা কান্না কাঁদবি তো আমি আসবো না? তো আর কে আসবে? ওই মেঘ আসবে? ও আসলে ভালো হতো?

ভোর কিছু না বলে মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকালো। এই ছেলেটার এমন অদ্ভুত কথাবার্তার মাথামুণ্ডু কিছুই ভোর বুঝতে পারে না। কোথা থেকে কি বলে সে নিজেও হয়তো জানে না। এখানে মেঘ বজ্জাত ছেলেটা আসছে কোথা থেকে? সব দোষ ওই পচা ছেলেটার। আজই কেন তার রোদের সাথে এই বাড়িতে আসতে হলো? আর আসবি আয়, ভালো কথা। এমন হা করে কেন তাকিয়ে থাকতে হবে কেন ভোরের দিকে? তাও আবার রোদের সামনে! কত্তো বড় সাহস ছেলের! আরও কি কি বলেছে কে জানে! নইলে রোদটা ওই পাজি লোকটার কথা বলে এতো খোঁচা দিতো না একদমই। নিশ্চয়ই এমন কিছু বলেছে যাতে রোদের এমন রাগ হয়েছে। ভোরের ইচ্ছে করছে এক্ষুণি গিয়ে মেঘ নামের লোকটার মাথায় বড় একটা ফুলদানি ভাঙ্গতে। অসভ্য লোক একটা! কত বড় সাহস! কি না কি বলে রোদকে রাগিয়ে দিয়েছে! এখন কি হবে!

ভোর মুখটা একটু নিচু করে কথাগুলো ভাবছিলো। এমন সময় রোদ ভোরের মুখে আলতো করে নিজের ভিজে হাতটা ছুঁইয়ে দিয়ে ভোরের মুখটা তুলে ধরলো। 

-কি ভাবসিস ভোর?

-উঁহু---। কিছু না----।

-নিশ্চয়ই ভাবছিস তোর রোদ ভাইয়াটা কত পচা তাই না? কথায় কথায় খালি বকে, মারে---। রাগ দেখায়। তাই না? 

-আরে? না না---।

-আমি জানি ভোর আমি তোকে অনেক জ্বালাই--৷ অনেক বেশি বিরক্ত করি, অযথাই শাসন করি--। হয়তো কখনো কখনো তোর দোষও থাকে না তবু বাড়াবাড়ি করে ফেলি---। এমন উদ্ভট কাজগুলোর পিছনে আমার কতোটা ভালোবাসা যে লুকিয়ে আছে তোর জন্য-- সেটা কখনোই বুঝলি না তুই---। যখন থাকবো না তখন টের পাবি---৷ হয়তো মিস করবি। তখন হাজার খুঁজলেও, আমার একটা ধমক শোনার জন্য মাথা কুটে মরলেও আমাকে পাবি না----।

-এমন করে বলছো কেন? কোথায় যাবে তুমি?

-জানি নাহ---। 

-কি হয়েছে তোমার?

-আমার কি হয়েছে দিয়ে তুই কি করবি? আমি চলে গেলেই তো তুই বেঁচে যাবি তাই না? অনেক খুশি হবি তাই না চলে গেলে? একেবারে মুক্ত হয়ে যাবি তখন--।

-কোথায় যাবে তুমি?

-জাহান্নামে। তাতে তোর কি?

ভোর আবার মন খারাপ করে চুপ করে গেল। রোদের রাগ দেখে বেচারি চুপসে গেছে একেবারে। রোদের এবারের রাগের কারণটা ভোর কিছুতেই ধরতে পারছে না। তাই হয়তো রোদ আরো রেগে যাচ্ছে। কিন্তু না বললে বুঝবে কি করে ও?

-ভোর?

-হুম?

-একটা প্রমিস করবি?

-কি?

-তোর এই----। 

-হুম? কি? বলো না?

রোদ কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজে ফ্লোর থেকে উঠে ভোরকেও টেনে তুললো। তারপর শাওয়ার ওফ করে একটা শুকনো টাওয়াল জড়িয়ে দিলো ভোরের গায়ে। 

-কি রে? আজকে তোর স্যার আসবে না? পড়ালেখা কি সত্যি সত্যি ছেড়ে দিয়ে জঙ্গলে চলে যেতে চাস নাকি ভোর? সেরকম হলে আগেভাগে বলে দে। এমন পড়াচোর মেয়ের পিছনে নিজের এতো মূল্যবান সময় আর নিজের ভবিষ্যতটা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।

-আমি কখন বললাম এসব? আর জঙ্গলে যাবো কোন দুঃখে?

-বলবি কেন? বুঝাই তো যাচ্ছে---।

-বেশি বেশি বুঝা ভালো না---।

-তাই নাকি? আজকাল মুখে মুখে কথা বলাও শিখে গেছিস দেখছি? বাহ! বেশ উন্নতি হয়েছে তো এই কয় দিনে----! নতুন স্যারটা ভালোই ট্রেনিং দিচ্ছে তাহলে--?

-----------------------------------------------

-তোকে পনেরো মিনিট সময় দিলাম ভোর। এর মধ্যে এই ভিজে জামা কাপড় চেইঞ্জ করবি---। একদম গা, মাথা, চুল, হাত, পা সব ঢেকে তোর ওই স্যারের কাছে পড়তে বসবি--। মুখে তখনের মতো ক্রিম, ট্রিম মেখেছিস দেখলে কপালে শনি আছে তোর। মনে থাকবে?

ভোর কিছু না বলে নিজের মনেই ভাবার চেষ্টা করলো। এমন করে পুরো র্যাপিং হয়ে পড়তে বসার চেয়ে একেবারে বোরখা পড়ে পড়তে বসলেই তো হয়! একদম চোখ, নাক, মুখ কিছুই দেখতে পাবে না স্যার। শুধু পড়িয়েই চলে যাবে! ব্যাপারটা কি রোদের মাথায় আসে নি? একবার বলে দেখবে! অবশ্য বলা যায় না আইডিয়াটা ভদ্রলোকের পছন্দ হলে সেটাই করতে হতে পারে। লোকটা সত্যি একটা পাগল। এমন করে কেউ? ভোর কথাটা ভাবছে এমন সময় রোদ ভোরের চোখের সামনে তুড়ি বাজালো।

-আইডিয়াটা তো মন্দ না ভোর। সম্ভব হলে বোরখা পড়েই যেতে বলতাম তোকে---। ওয়েট--। একচুয়েলি তোর আইডিয়াটা দারুণ। দাঁড়া আমি তোর জন্য বোরখার ব্যবস্থা করছি----।

-বা-বা-বাসায় বোরখা!

-কেন? কোন সমস্যা?

-হুম? উঁহু---। না না--। কোনো সমস্যা না---।

-গুড---। তাড়াতাড়ি চেইঞ্জ করে নে। আর ঠান্ডা লাগলে তোর কপালে খারাবি আছে আজকে----।

-হুম----।

-ভোর? শোন না?

-হুম?

ভোর মুখ তুলে রোদের দিকে তাকাতেই রোদ ভোরের ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিলো। ভোরের কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো ওর শরীর বেয়ে হাই ভোল্টেজের কারেন্ট পাস করছে। ভোরের হাত দুটো যন্ত্রের মতো রোদের গলা জড়িয়ে ধরার জন্য উঠতেই রোদ সরে এলো। ভোর হাত নামিয়ে নিলেও চোখ মেলে রোদের দিকে তাকাতে পারলো না। রোদ কিছুক্ষণ ভোরের লাজুক মুখটা দেখে একটু পরে এগিয়ে এসে ভোরের কানের দিকে ঠোঁট বাড়ালো।

-এরপর থেকে আর কখনো ভুলেও এমন ভিজে ঠোঁট নিয়ে আমার সামনে আসবি না ভোর---। তোর এমন রসালো ঠোঁট জোড়া দেখলেই একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে আমার---। আর হ্যাঁ? ভুলেও আর এমন করে ভিজবি না আমার সামনে---। আজ শুধু চুমোয় ছেড়ে দিলাম--পরের বার কিন্তু এতো সহজে ছাড়া না ও পেতে পারিস--৷ মনে থাকবে?

-হুম---। আচ-আচ্ছা----।

-এভাবে একদম কাঁপবি না তো--। তোর ঠোঁট জোড়া এমন করে হাতছানি দিয়ে আমাকে কাছে ডাকলে আমি না এসে পারি না জানিস না? আর এভাবে যে ভিজে কাপড় নিয়ে আমার সামনে বসে আছিস? লজ্জা করছে না তোর? আজকাল কি তোর আর লজ্জা টজ্জা কটকটিওয়ালার কাছে বেচে খেয়েছিস নাকি?

-আসলে---। আমি-----।

-আজ একসাথে অনেকগুলো ভুল করেছিস---। শাস্তির জন্য রেডি হয়ে থাকিস---। সব হিসেব রাতে হবে একেবারে---। 

ভোর এবার ভয়ে ভয়ে রোদের দিকে তাকালো। রোদের কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে না সে এখন রাগ করে আছে। তবু এমন আত্মা কাঁপানো কথাগুলো কেন বলছে ওকে? শুধুই কি ভোরকে ভয় দেখানোর জন্য? ভোরের এমন ভীত মুখটা দেখে রোদ একটু হাসলো৷ তারপর আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আর এক মূহুর্তও দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে ভোরকে রেখেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। নিজের ভিজে জামার টপটপ করা পানি ঝড়ছে সেদিকেও যেন তার কোনো খেয়াল নেই। রোদের এই হন্তদন্ত ভাবটা দেখে ভোরের কেমন একটা লাগলো। ও নিজেও তাড়াতাড়ি ভিজে জামাটা বদলে একটা লম্বা হাতাওয়ালা থ্রিপিস পড়ায় মন দিলো। দেরি হলে সত্যি আজ ওর কপালে শনি ভর করবে৷ আপাতত আজকের দিনে আর কোনো ভুল করে রোদের বকা খাওয়ার ইচ্ছে নেই ভোরের। আজকের দিনটা ভোরের কাছে ঈদ ঈদ লাগছে। আজ তাই কোনো মতেই নতুন করে ভুল করা যাবে না। উঁহু। একদমই না।

০৪!! 

ভোর জামা চেইঞ্জ করে রুমে এসে দেখলো ওর পড়ার টেবিলের উপরে ছোট্ট একটা ট্রে রাখা। ট্রে তে একটা স্যান্ডুইচ, দুটো সিদ্ধ ডিম আর এক গ্লাস জুস রাখা। ট্রেটা দেখেই ভোর হাসলো। রোদের এই কাজটা ভোরের সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। যত রাগই করুক না কেন শান্ত হওয়ার পর সে ভোরের এমন ভাবে খেয়াল রাখে যেন ভোর নিতান্তই একটা বাচ্চা মেয়ে। অন্য সময় হলে নিজ হাতে খাইয়েও দিতো। আজ কি হলো কে জানে! ভোর নাস্তা করতে করতে ভাবতে লাগলো। রোদ কি এখনো রাগ করে আছে তার উপরে? টিশার্টটা যে ভোর রোদকে না জানিয়ে এনেছে সেটার জন্য রাগ করে আছে? অনেকগুলো নাকি ভুল করেছে ভোর৷ কি কি? আর তার শাস্তিই বা কি হতে পারে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ভোর খেয়ে উঠলো। বই, খাতা, টেস্ট পেপার সব নিয়ে নিচ তলায় ড্রইংরুমে চলে এলো। সেখানেই স্যার এসে পড়াবেন। রোদ সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে কোনো টিচার কখনো ভোরের রুমে এলাউড না। সে যেই হোক না কেন।

ভোর নিচে এসে দেখলো স্যার চলে এসেছেন। আজ অবশ্য আশেপাশে কোথাও রোদের ছায়াটুকু পর্যন্ত দেখা গেল না৷ ভোর একটু চিন্তিত মুখে পড়তে বসলো। স্যার কি বলছে কিছুই যেন আজ ভোরের মাথায় ঢুকছে না। এমন ঘটনা এর আগে তো কখনো হয় নি! রোদ বাড়িতে আছে অথচ ভোরের পড়ার সময় সেখানে আসে নি এমনটা কখনোই হয় না৷ তাহলে আজ কি হলো? রোদ কি চলে গেছে! কিন্তু কেন? কোথায়? আর কি আসবে না? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই স্যারের কাছে একটা ধমক খেল ভোর। একটু ভয় পেয়ে পড়ায় মন দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু কারো শূন্যতার পুড়ছে বেচারি। অসম্ভব মিস করছে একজনকে। আর সেই একজনটা আর কেউ নয়। ভোরের রোদ। এভাবে কারো শূন্যতা গ্রাস করলে কি আর পড়ায় মন বসে?

ভোরের এমন উদাসীনতা দেখে স্যার খানিকটা বিরক্ত হয়ে খাতায় কিছু একটা লিখে ভোরের দিকে এগিয়ে দিলো। ভোর ফ্যালফ্যাল করে একবার স্যারের দিকে আর একবার খাতায় লেখা আঁকিবুঁকিগুলোর দিকে তাকালো। কিছুই যেন ওর মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। স্যার বিরক্ত হয়ে খাতাটা ভোরের সামনের টেবিলে থপ করে প্রায় ছুঁড়ে দিলেন।

-ধরো ভোর? এই ইকুয়েশনটা কমপ্লিট করো৷ পাঁচ মিনিট সময় দিলাম--। জলদি---।

ভোর খাতাটা নিয়ে ইকুয়েশনটার সমাধান করতে করতে আনমনে আবার ভাবতে লাগলো। রোদ কি আজ ওকে না বলেই চলে গেছে? ওই মেঘ বজ্জাতটার কারণে রাগ হয়েছে তার? কিন্তু ভোর কি করেছে? ভোর তো ওই বজ্জাতটার দিকে তাকায়ও নি ঠিক করে! তাহলে? নাকি ওই লোকটার আনা গ্লাস থেকে পানি খাওয়ায়? এতো রাগ হয়েছে রোদের? কিন্তু তখন তো কতো সুন্দর করে আদর করল রোদ ওকে? তাহলে? কথাটা ভাবতেই লজ্জায় ভোরের নাকে আর চিবুকে রক্তিম একটা আভা ফুটে উঠলো। আর তার ঠিক এক মিনিটের মাথায় ভোরের ডান হাতের পিঠে ঠাস করে একটা স্টিলের স্কেলের বাড়ি পড়লো। ব্যথায় প্রায় ককিয়ে উঠতে গিয়েই স্যারের দিকে তাকিয়ে চুপসে গেল ভোর। কোনমতে বাম হাত দিয়ে ডান হাতটা ডলে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করলো। ভোর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলানোর চেষ্টা করলো। 

-তোমার কাহিনীটা কি? সামনে পরীক্ষা আর তুমি আজ হঠাৎ এমন নাটক শুরু করলে কেন? আমি এক ঘন্টা হয় এসে বসে আছি, তোমার আসার নাম নেই। আর ঘন্টা কাবার করে যা ও এসেছ একেবারে র‍্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে---। আর এখন পড়ায় মনোযোগ নেই। মশকরা পেয়েছ তুমি আমার সাথে? হ্যাঁ? এই সামান্য একটা ইকুয়েশন করতে পারছ না পরীক্ষায় কি দিবে? আমার মাথা? আর তোমার এমন নাটক ফাটক করে রেজাল্ট খারাপ হলে তার দায়টা কার হবে? তোমার জীবনে এমন ফালতু নষ্ট করার মতো অনেক  সময় থাকতে পারে, কিন্তু তোমার পিছনে এতো আজাইরা নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই---। বুঝতে পেরেছ?

স্যারের স্টিলের স্কেলটা আরেকবার ভোরের দিকে তেড়ে আসছে দেখে ভোর ভয়ে চোখ বুজে নিলো। কিন্তু স্কেলের বাড়ি গায়ে এসে না পড়ায় একটু সাহস করে চোখ মেলে তাকালো ভোর। আর যা দেখলো তাতে খুশি হবে নাকি ভয় পাবে সেটাই ভোর ভেবে ঠিক করতে পারলো না। রোদ স্যারের স্টিলের স্কেলটা ধরে ফেলেছে। আর মানুষটার চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। রোদের সাথে চোখাচোখি হতেই ভোর ভয় পেয়ে মুখ নিচু করে নিলো। রোদ এবারে স্যারের দিকে তাকিয়ে হাত থেকে স্কেলটা টেনে নিয়ে নিলো।

-আপনার যদি এতোই সময়ের অভাব হয় তাহলে কাল থেকে আপনাকে আর আসতে হবে না। আর দয়া করে ভোরের রেজাল্ট নিয়ে আপনাকে টেনশন করতে হবে না। আমি জানি ভোর অনেক ভালো রেজাল্ট করবে-----।

-আপনি জানেন না রোদ সাহেব। ভোর আজকাল অনেক ফাঁকিবাজ হয়ে গেছে। পড়া শিখে রাখে না, হোমওয়ার্ক দিলে করে না। আর এখন দেখুন আমি পড়াতে এসেছি তাও অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে--। আর এই সিম্পল একটা ইকুয়েশন সলভ করতে গিয়ে-----।

-তাই বলে আপনি ওকে এই স্টিলের স্কেল দিয়ে মারবেন? আশ্চর্য তো! এক্সিডেন্টলি এই ধারালো স্কেলের কোণায় লেগে ওর হাতটা যদি কেটে যেত তখন? আর হাত না কাটলেও ওর হাতে কতোটা লেগেছে দেখতে পাচ্ছেন আপনি? আপনি টিচার করে কি করে এমন অমানবিক কাজ করেন বলুন তো তাসমিদ সাহেব? 

-আসলে----। আমি বুঝতে পারি নি এমন কিছু হবে---। কয়েকদিন ধরে পড়ায় মনোযোগ নেই ওর। তাই আমার রাগ উঠে গিয়েছিল----।

-নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে শিখুন তাসমিদ সাহেব৷ আপনার জন্যই ভালো হবে সেটা৷ আর আপনি আজকে আসতে পারেন। বাকি যা বলার সেটা চাচ্চু মানে ভোরের বাবা আপনাকে বলে দিবে। ধন্যবাদ৷ ভোর? রুমে যা---।

ভোর একবার মুখ তুলে স্যারের হতভম্ব চেহারাটা দেখতে পেল। আবার রোদের দিকে তাকিয়ে মুখটা নিচু করে চুপ করে বসে রইলো। বেচারি পড়েছে দোটানায়। স্যারের সামনে থেকে এভাবে উঠে চলে গেলে ব্যাপারটা বেয়াদবি হয়ে যাবে না? কিন্তু না গেলে তো রোদ আরো রেগে যাবে? ভোর কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না এমন সময় স্যার আস্তেধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে সেখান থেকে চলে গেলেন। আর রোদ থপ করে ভোরের সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। ভোর মুখ তুলে তাকাতেই রোদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। রোদ একটু হাসার চেষ্টা করে ভোরের গাল ছুঁয়ে দিলো আলতো করে। 

-রুমে যা ভোর। আমি এক্ষুণি আসছি। কেমন?

-হুম----। আচ্ছা।

ভোর টেবিলের উপরে থাকা বই খাতাগুলো গোছানোর জন্য হাত বাড়াতেই রোদ নিজে বই, খাতাগুলো নিজে নিয়ে নিলো। 

-এগুলো থাক। তুই যা। 

-আচ্ছা---।

ভোর রুমে আসার মিনিট পাঁচেকের মাথায় রোদ ওর রুমে হাজির হলো। ভোর বিছানার উপরে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। রোদকে আসতে দেখে উঠে বসেই অবাক হলো ভোর। রোদের এক হাতে ভোরের বই খাতাগুলো আর অন্য হাতে দুটো বক্স৷ বক্সে কি আছে ভাবতে ভাবতেই রোদ বই খাতা ভোরের পড়ার টেবিলে রেখে ভোরের হাতে একটা বক্স ধরিয়ে দিয়ে ভোরের সামনাসামনি বসে অন্য বক্সটা খুললো। ভোর হা করে বক্সের ভিতরে থাকা আইস কিউবগুলো দেখলো। রোদ একটা আইস কিউব নিয়ে আলতো করে ভোরের ডান হাতের পিঠে ছোঁয়াতেই ভোর কেঁপে উঠে হাত টেনে নেয়ার চেষ্টা করলো। রোদ মুখ তুলে ভোরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো।

-এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকার কি হলো? আমি আমার কাজ করছি। তুই তোর কাজ কর---।

-আম-আমি? আমি কি করবো?

-বক্সটা খুলে দেখ। তারপর বুঝতে পারবি---।

ভোর বুঝতে পারলো না এক হাতে বক্সটা কি করে খুলবে। তবু কয়েকবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে করুণ মুখে রোদের দিকে তাকালো। রোদ এতোক্ষণ ধরে ভোরের দিকে তাকিয়ে ছিল। এবারে বিরক্ত হয়ে নিজেই বক্সটা খুলে ফেললো। তারপর বক্সের ঢাকনাটা পুরো আলগা না করেই ভোরের হাতে ধরিয়ে দিলো। 

-গাধী একটা! সামান্য একটা বক্সের ঢাকনাটা পর্যন্ত খুলতে পারে না। ধর? এবার হাতটা দে তো দেখি---।

ভোর একটু অভিমান করেই আবার এক হাতে বক্সের ঢাকনাটা খুলতেই ওর চোখ জোড়া খুশিতে চিকচিক করে উঠলো৷ পুরো এক বক্স আইসক্রিম! খুশির চোটে ভোরের মনে হলো কি বলবে সব গুলিয়ে ফেলছে। মুখ তুলে রোদের দিকে তাকাতেই দেখলো রোদের ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি খেলা করছে৷ কিছু বলার চেষ্টা করতেই রোদ ভোরের হাতে একটা চামচ ধরিয়ে দিলো। 

-এভাবে কতোক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকবি? আইসক্রিমটা গলে পানি হয়ে যাবে না? খা?

-হুম---। থ্যাংক ইউ-----। 

-তাড়াতাড়ি খান ম্যাডাম। এক্ষুণি তো লাঞ্চের জন্য ডাক পড়বে---। আমি আইস কিউবগুলো রেখে আসি। 

-হুম----।

ভোর মনের আনন্দে আইসক্রিম খাওয়ায় মন দিয়েছে। রোদ আইস কিউবের বক্সটা ফ্রিজে রেখে এসে দেখলো ভোর মজা করে আইসক্রিম খাচ্ছে। মেয়েটার চোখে মুখে তৃপ্তির স্বাদ দেখে ভালো লাগছে রোদের। রোদের দিকে চোখাচোখি হতেই ভোর মিষ্টি করে হেসে এক চামচ আইসক্রিম রোদের দিকে বাড়িয়ে দিলো। আর তাতেই রোদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু একটা হাসি খেলা করে গেল। ভোর সেসব কিছুই বুঝতে পারলো না। তাই বাচ্চাদের মতো জেদ করলো।

-কি হলো? খাও না?

-এভাবে চামচ থেকে খেয়ে তো মজা নেই ভোর। অন্য কোনোভাবে খাওয়াতে পারলে খাওয়া---।

রোদের কথাটায় কি ছিল কে জানে ভোর লজ্জায় লাল হয়ে চোখ বুজে নিলো। আর সাথে সাথেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। ভোরের চোখের সামনে একটা অদৃশ্য পর্দায় যেন একটা ছোট্ট দৃশ্য দেখা গেল। সেখানে রোদ এক চামচ আইসক্রিম মুখে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ভোরের ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের ভাঁজে বন্দি করে নিলো। ঘটনাটা ভোরের এতোটা বাস্তব মনে হলো যে ভোরের সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠলো। একটু পরেই টের পেল রোদ সত্যি সত্যিই এগিয়ে আসছে ওর দিকে। আগে পিছে কিছু না ভেবেই ভোর হাত থেকে আইসক্রিমের বক্সটা রেখে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে আরেকটু হলেই পড়ে যেত। অবশ্য তার আগেই রোদ ওকে শক্ত করে ধরে ফেলেছে। এভাবে রোদের শক্ত বাঁধনে বাঁধা পড়ে ভোরের লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। এবারে কি হতে যাচ্ছে ভাবতেই ওর মায়াবী মুখ, নাক আর চিবুক লাল আভায় রেঙে উঠলো। আর সেই রক্তিম মুখটা দেখে রোদ বোধ হয় আরেকবার তার পিচ্চি পরীটার প্রেমে পড়লো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন