৩৯!!
-আরে এই অনু? কেয়ারফুল! ফারহা হোয়াট ইজ দিস? সারপ্রাইজ দিবে ভালো কথা। তাই বলে সিঁড়ির একদম কর্ণারে চলে এসেছ খেয়াল করবে না? আর তোমাকে বলছি অনু। বিয়ে বাড়িতে কতজন দুষ্টুমি করে চোখ চেপে ধরবে, তাই বলে ভয় পেয়ে সামনের দিকে পা বাড়াবে নাকি? আমি এসে না ধরে ফেললে কি হতো ভাবতে পারছ? সামনে যে সিঁড়ি সেই খেয়াল নেই তোমার?
নরম এক জোড়া হাত চোখে চেপে বসায় অনামিকা এতোটা চমক গিয়েছিল যে না চাইতেও এক পা সামনের দিকে বাড়িয়ে ফেলেছিল। এই ভয়টা কিসের অনামিকা হয়তো নিজেও জানে না। তবে কিছু ঘটার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন হঠাৎ করেই অনামিকার একটা হাত চেপে টেনে নিয়েছে। হাতে টান অনুভব করে অনামিকা যেমন দু কদম পিছিয়ে গেছে, তেমনি অনামিকার চোখ থেকেও ফারহার হাতটাও সরে গেছে। এক্সসাইটমেন্টে হোক, বা অনামিকাকে চমকে দিতেই হোক, কাজটা করার সময় এমন কিছু হতে পারে কথাটা মাথাতেই আসে নি ফারহার। তাই হঠাৎ করে অরণ্যের ধমক দিয়ে ওঠায় বেচারি একেবারে চুপসে গেছে। যদিও ফারহার চেয়ে অনামিকাকেই বেশি বকা খেতে হচ্ছে তবু নিজের গাধামির জন্য নিরবে আফসোস করা ছাড়া কিছুই ভেবে পেল না ফারহা। এভাবে ফারহার সামনেই এতোগুলো বকা খেয়ে অনামিকা নিজেও গাল ফোলালো এবারে। ও কি ইচ্ছে করে সামনে আসছিল নাকি? ভয়ে কখন পা জোড়া সিঁড়ির ধাপের দিকে চলে এসেছে সেটা অনামিকা নিজেও তো জানে না। এভাবে বকার কি আছে? তাও আবার ফারহার সামনে! মেয়েটা এতোদিন পরে এসে একটু দুষ্টুমিই তো করতে চেয়েছে! তাই বলে এভাবে বকবে?
-একটু সাবধানে চলাফেরা করতে পারো না তুমি? আরেকটু হলেই যে সিঁড়ি থেকে সোজা নিচে গিয়ে পড়তে সেটা বুঝতে পারছ? একসাথে স্টেজে যাবো বলে উপরেই ওয়েট করছিলাম তোমার জন্য। এখন আমি না দেখলে বা আমি উপরে না থাকলে কি হতে পারতো ধারণা আছে তোমার কোনো? সেসব তো বুঝবা না। শুধু বাচ্চাদের মতো গাল ফুলাতেই পারবে সারাদিন।
-কি আর হতো? পড়ে গেলে আর কি হতো? বড় জোর মরে যেতাম। এর বেশি তো আর কিছু হতো না তাই না? শুধু শুধুই ওভার রিএক্ট করো না তো। সবাই ওয়েট করছে আমাদের জন্য। চলো নিচে যাই। আর ফারহা তুমিও চলো। কতদিন পরে এলে। আজ থাকছ কিন্তু, না করলেও শুনছি না।
-আমার সাথে তোমার থাকারই ইচ্ছে নেই তাই না অনু? ঠিক আছে। চলে যেও। আজ তো সব ঠিক হয়ে যাবে। তাহুর বিয়েটা হোক। তারপর চলে যেও। আমি আর একবারও আটকাবো না তোমাকে।
-আরে? কি বলছো? আমি তো এমনি বললাম কথাটা! এই অরণ্য শোনো না? কি ঠিক হয়ে যাবে? কোথায় যাবো বলো তো আমার বাড়ি থেকে, এই বদরাগী লোকটাকে ছেড়ে?
-যেখানে ইচ্ছে হয় যেতে পারবেন, প্রবলেম নেই। তাহিয়ার বিয়েটা হয়ে যাক।
-আরে? অরণ্য?
অনামিকা আরো বেশ কয়েকবার অরণ্যকে ডেকেও সাড়া পেল না। ছেলেটা রাগে গটগট করে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ড্রইংরুমের সাজানো হলুদের স্টেজটার দিকে চলে গেছে। অরণ্যের এতো রাগ দেখে অনামিকা রাগ করার বদলে হেসে ফেললো। লোকটা মাঝেমাঝে এতো সামান্য বিষয় নিয়েও এতো কেন রিএক্ট করে কে জানে! পাগল একটা পুরো!
-ভাবি? স্যার তো রেগে গেছে অনেক! এবার কি হবে? আমার বোকামির কারণে আপনাদের দুজনের মধ্যে আবার ঝামেলা হয়ে গেল! সরি ভাবি! আমি আসলে দুষ্টুমি করতে গিয়ে বুঝতে পারি নি আপনি হঠাৎ ভয় পেয়ে যাবেন। সরি ভাবি, সরি।
-আরে! ফারহা! সরি বলছ কেন? তোমার কি দোষ বলো? আমি কিছু একটা ভাবছিলাম তো, তাই গন্ডগোল হয়ে গেল। তুমি শুধু শুধু মন খারাপ করো না তো। এবার বলো তো? তোমার নতুন জবের কি খবর? তোমার স্যার এখনও নতুন নতুন মিশনে পাঠায় নাকি?
-আরে নাহ ভাবি। অফিসের কাজ দারুণ চলছে। অফিস শেষ করে বাসায় মায়ের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। ছুটির দিনে হয়তো মা মেয়ে মিলে হৈচৈ করে রান্না করছি, অথবা কোথাও প্ল্যান ছাড়াই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ছি মায়ের সাথে। এভাবেই কাটছে সময় আমার। এতোদিন কেন যে এই ফিলিংসটা পাই নি কে জানে!
-ইশ! কত মজা করছ না তুমি আর আন্টি মিলে? মা বেস্টফ্রেন্ড হলে ব্যাপারটা আসলেই অন্যরকম প্রশান্তির হয়। সবার কপালে সেই সুখটা থাকে না হয়তো!
-ভাবি! কেয়ারফুল! এবারে ভাবতে গিয়ে পড়লে ধরে ফেলার জন্য কিন্তু স্যার নেই পাশে। আমি মায়ের পড়ানো এই প্যাঁচানো পুঁচানো শাড়ি পড়ে হাঁটতেই পারছি না, আপনাকে ধরবো কি! বাই চান্সলি এক্সিডেন্ট হলে স্যার আমার তো খবর করবেই, চাকরিটাও যাবে। না বাবা! এতো রিস্ক নেয়া যাবে না। এর চেয়ে একটু দেখে শুনে সিঁড়ি দিয়ে নামুন।
-এতো ভয় পাও স্যারকে! আর পড়বো না গো বোন। উনি রাগ করে কোথায় গেল দেখি চলো। তাহিয়াকেও হলুদ দেয়া বাকি। চলো চলো?
স্টেজে তাহিয়াকে হলুদ দেয়ার ফাংশানটা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। সবাই মিলে তাহিয়ার গায়ে, গালে, হাতে, মুখে হলুদ মেখে একেবারে যাচ্ছে তাই অবস্থা। অরণ্য তাহিয়ার কাজিনরাও একে অন্যকেও হলুদ মেখে বলতে গেলে ভূত বানিয়ে ছেড়েছে। অনামিকাকে হলুদ মাখাতে আসলেও অনামিকার চোখ রাঙানিতেই হোক, বা অরণ্যের 'খুন করে ফেলার' থ্রেটের ভয়েই হোক কেউ সাহস করলো না অনামিকাকে হলুদ লাগানোর। তাহিয়া আর ফারহাই শুধু অল্প করে অনামিকার গালে হলুদ ছুঁইয়ে দিয়েছে। হলুদে ভূত সাজা একেক জন হুটোপুটি করে শাওয়ার নিয়ে এসেছে বিয়ের কনে মানে তাহিয়াকে বিয়ের গোসল করিয়ে আনতে আনতে। পুরো সময়টা তাহিয়ার পাশে থাকলেও অনামিকার চোখ জোড়া বারবার অরণ্যকেই খুঁজেছে চারপাশে। লোকটা যে কোথায় গেল কে জানে! শাওয়ার নিতে রুমে গিয়েও অরণ্যকে দেখতে পায়নি। এখানেও মেহেন্দির স্টেজের দিকটাতেও নেই। লোকটা গেলটা তাহলে কোথায়? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তাহিয়ার হাতে সুন্দর করে মেহেদির ডিজাইন আঁকায় মন দেয়ার চেষ্টা করছে অনামিকা। সাথে ফারহাও যোগ দিয়েছে। একে একে তাহিয়ার কাজিনেরাও এসে জড়ো হয়ে হয় মেহেদির ডিজাইনে আর কি কি চেইঞ্জ করা লাগবে এসব নিয়ে লেকচার দিচ্ছে বা নিজেরাও নতুন কোনো ডিজাইন আঁকার চেষ্টা করছে তাহিয়ার হাতে। আর বেচারি তাহিয়া ধমক ধামক দিয়ে এই বিচ্ছুগুলোর হাত থেকে নিজের ওয়েডিং মেহেদি ডিজাইনটাকে কোনোমতে বাঁচিয়ে নিচ্ছে। কতোক্ষণ ধমক ধামক দিয়ে ডিজাইনটা আগলে রাখতে পারবে কে জানে!
অরণ্যের কাজিনরা রীতিমতো গোল করে ঘিরে বসে অনামিকার মেহেদি আঁকা দেখছে, টুকটাক এডভাইস দিতে দিতে নিজেরাই মারামারি, হাতাহাতি পর্যায়ে যেতে যেতে আবার একে অন্যের গায়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এসবের ফাঁকে অনামিকা যত তাড়াতাড়ি পারছে সাবধানী হাতে তাহিয়ার হাতে মেহেদি আঁকা শেষ করে হাঁফ ছাড়লো। সবাইকে বলতে গেলে থ্রেট দিল যেন কেউ তাহিয়াকে একদমই বিরক্ত না করে। সবার সাথে আড্ডা দিতে দিতে হলুদ, মেহেদি, খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে বেশ রাতই হয়ে গেল। মেহেদি বা খাওয়া দাওয়ার পুরো সময়টা একবারের জন্যও অরণ্যের সাথে দেখা হয়নি। লোকটা রুমে গিয়ে বসে আছে ভেবে একটু রাগই হলো অনামিকার। তাহিয়াকে রুমে রেখে নিজে রুমে এসেই লোকটার সাথে তুমুল ঝগড়া লাগানোর অনুর প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল। কারণ লোকটা রুমেও নেই। গেলটা কোথায় তাহলে? রুম থেকে বেরিয়ে আবার অরণ্যের খোঁজে যাওয়ার আগেই বারান্দার দরজার দিকে চোখ পড়লো অনামিকার। শাওয়ার নিয়ে জলপাই রঙা শাড়িটা পড়ে নিচে যাওয়ার আগে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করেই গিয়েছিল অনামিকা। কথাটা মনে পড়তেই এক ছুটে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো অনামিকা। অনুর এভাবে ছুটে আসায় বারান্দাট দোলনায় আয়েশ করে দোল খেতে থাকা মানুষটা এক নজর অনামিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার দোলনায় পা ঝুলিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকালো। অভিমানে, নাকি রাগে অনামিকার গলা বুজে এসেছিল কয়েক মিনিটের জন্য। নিজেকে বহু কষ্টে সামলে এগিয়ে এসে অরণ্যের একটা হাত ধরে টেনে দোলনা থেকে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। অরণ্য শান্ত চোখে অনামিকার দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করছে মেয়েটা কি করার চেষ্টা করছে।
-এখানে ঠান্ডায় বসে আছো কেন? রুমে যাবে চলো?
-আমার এখানে বসে থাকতেই ভালো লাগছে। ঘুম পেলে রুমে চলে আসবো। কারো ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।
-রুমে যাবে ওঠো বলছি না? অন্ধকারে বারান্দায় বসে থাকার কাজ কি? উঠো?
-তুমি গিয়ে ঘুমাও অনু। আমি পরে যাবো বললাম তো? তুমি যাও। চেইঞ্জ করে শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়েছে। কাল সকাল সকাল উঠতেও হবে। ঘুমাও যাও।
-পরে না এখনই যাবে তুমি। ওঠো বলছি না? ওঠো না অরণ্য? এই?
-কি?
-কিছু না। রুমে যাও। ওঠো?
-যাবো না বলেছি আমি? বললাম তো ঘুম আসলে চলে আসবো রুমে? তুমি যাও বললাম না?
-তুমি বললেই শুনতে হবে নাকি? আমি রুমে যেতে।বলছি যে শুনতে পাও না তুমি? দেখো রাগিও না বলে দিলাম। তাড়াতাড়ি ওঠো? রুমে যাও।
-রাগিও না! হুহ! আমার রাগার মতো কাজ করে বলতে আসবে 'রাগিও না বলে দিলাম'।
-বিড়বিড় না করে রুমে যাও তো? বাড়ি ভর্তি মেহমান। রাত দুপুরে কি শুরু করলে বলো তো? যাও তো রুমে যাও?
অনামিকার রাগী কথাগুলো শুনে অরণ্যও আর কথা বাড়ালো না। বিরক্ত হয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। আর অরণ্যের ওয়াশরুমের দরজাটা বন্ধ করার শব্দ শুনে অনামিকাও বারান্দার দরজাটা বারান্দার ভিতর থেকে লক করে দিয়ে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লো। মাথায় সাত পাঁচ হাজার রকমের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে অনামিকার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অন্ধকারে বহুদূরে তাকিয়েও টপটপ করে চোখের পানি ঝড়ছে অনামিকার। কত শত অভিমান জমে কান্না বিন্দুগুলোর সাথে হেঁচকি পর্যন্ত তুলছে মেয়েটার। অনামিকাও অভিমানী কান্নার বিন্দুগুলোকে বারবার দু হাতে মুছতে মুছতে নিজেই নিজের মনে বিড়বিড় করে কিছু বলছে।
"আমার সাথে একই রুমে থাকাও যায় না এখন না? থাকতে হবে না। তুমি কেন নিজের রুমে না থেকে বারান্দায় অন্ধকারে কষ্ট করে রাত পার করবে? দোষ যখন আমার, শাস্তিটাও আমারও পাওয়া উচিত। "
৪০!!
-তোমাকে ২ মিনিট টাইম দিলাম অনু। এর মধ্যে যদি রুমে না আসো তাহলে আমি দরজা ভেঙ্গে বারান্দায় আসবো। তারপর আমাকে তোমার এভাবে ব্যালকনিতে নিজেকে লক করে নেয়ার ব্যাখ্যা দিও। খুব বাড় বেড়েছে না তোমার? কিছু বলি না বলে মাথায় চড়ে বসেছ? ২ মিনিটের মধ্যে রুমে না এলে মাথা থেকে কিভাবে নামাতে হয় সেটাও দেখবে আজকে। জাস্ট টু মিনিট অনু, অনলি টু মিনিটস।
বারান্দার ফ্লোরে বসে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে অন্ধকারের শহরটার দিকে একমনে তাকিয়ে সারাদিনের চিন্তাগুলোর আঁকিবুঁকি করছিল অনামিকা। এমন সময়ই হঠাৎ বারান্দার দরজায় ছোট্টো করে নক করার শব্দে আচমকা আঁতকে উঠেছিল অনামিকা। পরমূহুর্তেই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে অভিমানে চুপচাপ দরজায় মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো অনামিকা। মিনিট খানেক পর দরজায় নক করার শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলো। দু পাশ থেকে দু জন মানুষের নিরব মান অভিমানের লড়াই শেষে অরণ্যই প্রথম কথাটা বললো। অনামিকা তবুও কিছু না বলে একা একাই বাচ্চা মেয়ের মতো মুখ বাঁকিয়ে বসে রইলো। বরাবর এক মিনিটের নিরবতার পর আবার রুমের ভিতর থেকে বেশ জোরেই দরজা ধাক্কানোর শব্দ হলো। অনামিকা একটু বিরক্তি নিয়েই সোজা হয়ে বসলো এবারে।
-গুড নাইট অরণ্য। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো।
-ঘুমাবো মাই ফুট। তোমাকে দরজা খুলতে বললাম না আমি? কথা কানে যাচ্ছে না তোমার? বেশি সাহস হয়েছে না তোমার? দরজা খোলো?
-মাঝরাতে এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন? আমার ঘুম পেলে আমি রুমে যাবো। তুমি ঘুমাও। এমনিতেও আমার সাথে একরুমে থাকতে তো আপনার প্রবলেম হচ্ছে অনেক। তাই বলছি, ঘুমিয়ে পড়ুন। ঘুমের মধ্যে আশা করি প্রবলেম হবে না কোনো।
-অনু? তুমি কি চাইছ এখন বাড়ির সবাই রুমে এসে জড়ো হোক? নাকি চাইছ আমি বারান্দার দরজাটা ভেঙ্গে ফেলি? কোনটা?
-আমি কিছুই চাইছি না। শুধু বলছি যে অনেক রাত হয়েছে। পাগলামি না করে ঘুমান।
-২ মিনিট হতে কাটায় কাটায় ৩০ সেকেন্ড বাকি। এই ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে যদি চুপচাপ এসে শুয়ে না পড়ো অনু, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।
-নিজে যে এতোক্ষণ এসে বারান্দায় এসে বসে ছিল তখন কিছু হয়নি। যেই আমি এসেছি, ওমনি তার হম্বিতম্বি শুরু হয়ে গেছে। যাবো না আমি রুমে। কি করবে তুমি হ্যাঁ? নিজে আমাকে কতগুলো বকা দিয়েছে, পুরো হলুদের প্রোগ্রামটায় লোকটাকে কত মিস করেছি। একবার এসেছিল? হুহ। এখন কি সুন্দর কথা! তার কথায় আমাকে দুই মিনিটের মধ্যে রুমে যেতে হবে। মগের মুল্লুক পেয়েছে আর কি! যাবো না, যাবো না, যাবো না।
-অনু?
নিজের মনেই রাগে, অভিমানে গজগজ করে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলছিল অনামিকা। এর মধ্যেই রুমের ভিতর থেকে অরণ্যের ডাক শুনে অনামিকা লক্ষী মেয়ের মতো উঠে এসে দরজা খুলে গুটিগুটি পায়ে রুমে ঢুকলো। অরণ্য চোখের উপরে একটা হাত রেখে বিছানায় শুয়ে আছে দেখে অনামিকা একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস চেপে বারান্দার দরজাটা লক করে দিয়ে আলমারি থেকে একটা প্লাজো আর টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকলো। ফ্রেশ হয়ে হাতের মেহেদিটা ধুয়ে ফেলে শাড়ি বদলে নাইট ড্রেস পড়ে নিল। শাড়িটা বারান্দায় মেলে দিয়ে রুমে ঢোকার আগেই অরণ্যকে একদম সামনে দাঁড়ানো দেখে একটু চমকে উঠে এক পা পিছিয়ে গেল অনামিকা। অরণ্যও ভ্রু কুঁচকে অনামিকার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
-কি প্রবলেম কি তোমার অনু? রুমে আসতে বলেছিলাম না? আবার বারান্দায় কি?
-শাড়িটা? শাড়িটা মেলে দিতে এসেছি। অনেকক্ষণ পড়ে ছিলাম। ঘামের গন্ধ হয়ে যাবে। তাই বাতাসে শুকাতে দিলাম।
-তো আমাকে দেখে পিছিয়ে যাচ্ছ কেন? আমি কি বাঘ? নাকি ভাল্লুক? যে এমন ভয় পাচ্ছ?
-ভয় পাচ্ছি না। তুমি হঠাৎ এসে দাঁড়িয়েছ টের পাই নি। সরো। অনেক রাত হয়েছে। সকালে অনেক কাজ আছে। তাহিয়াকে সাজাতে পার্লার থেকে মেয়েরা আসবে।
-বারান্দায় দরজা আটকে বসে ছিলে যখন তখন দেরি হচ্ছিল না? এখন বলো তো? কাজটা কেন করলে?
-আরেকজনও তো বারান্দায় বসে ছিল। তখন দোষের কিছু হয়নি?
-আমি তো দরজা আটকে বসেছিলাম না। ঘুম আসছিল না তাই বসেছিলাম। ঘুম পেলে রুমে আসবো বলি নি তোমাকে?
-কারো আমার সাথে এক রুমে থাকতেও প্রবলেম হচ্ছিল, তাই ব্যালকনির দরজা লক করে বসেছিলাম। হয়েছে? পেয়েছেন আপনার আনসার?
অনামিকা এবারে অরণ্যের পাশ কাটিয়ে চলে আসার চেষ্টা করতেই অরণ্য অনামিকাকে টেনে নিয়ে বারান্দার গ্রিলের সাথে আটকে ধরলো। অরণ্য অনামিকার দুপাশের গ্রিলে হাত দিয়ে এমনভাবে পথটা ব্লক করে রেখেছে যে অনামিকা চাইলেও সেখান থেকে বের হতে পারছে না। অরণ্য আরো কিছুটা এগিয়ে এসে আলতো করে অনামিকার চোখে মুখে ফুঁ দিয়ে চোখের সামনে আসা চুলগুলো সরালো। অনামিকা ততক্ষণে চোখ বুজে নিয়েছে অভিমানে। অনামিকার এমন অভিমানী কাঁপা ঠোঁট, রাগে লাল হয়ে আসা মুখ, চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে অরণ্য এবারে হেসে ফেললো।
-একে তো বেখেয়ালে চলতে গিয়ে আরেকটু হলেই পড়ে যেতে আমি না ধরে ফেললে, তার উপরে বার বার বলেছি এসব মরার কথা আমার সামনে বলবে না, সেটাও বন্ধ হয়না তোমার। তবু রাগটা তুমিই দেখাচ্ছ আমাকে। বলো তো অনু? রাগ তোমার করার কথা ছিল? নাকি আমার?
-সেই তো। আমি রাগ করবো কেন? রাগ করার অধিকার তো শুধু আপনার তাই না? আপনি রাগ করে আমাকে ফারহার সামনে একা ফেলে চলে যেতে পারেন, পুরো ফাংশনে একবারও সামনে নাই আসতে পারেন, এই যে মেহেদি দিয়েছি, সেটাও নাই বা দেখতে পারেন। রাগ করে আপনি যা ইচ্ছে করতে পারেন। আমার কিছু বলার আছে? নেই তো? রাগ আসলেই আপনারই করার কথা। ঠিকই বলেছেন। এখন আপনি চাইলে রাগ করে এখানেই বসে থাকুন। আমি গেলাম।
-আরে অনুপাখি?
অনামিকা প্রচন্ড অভিমানে অরণ্যের হাতের বাঁধনটা থেকে নিজেকে মুক্ত করে রুমের দিকে পা বাড়াতেই অরণ্য অনামিকাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে অনামিকার ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। অরণ্যের হঠাৎ এমন জাপটে জড়িয়ে ধরায় অনামিকার সমস্ত শরীরটা একবার কেঁপে উঠলো। অনামিকার শরীরের কাঁপনটা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়ার জন্যই অরণ্য নিজের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া দিয়ে অনামিকার কানে আলতো করে একটা কামড় বসালো।
-এতো রাগ মেয়েটার বাব্বাহ! কাউকে আজ হলুদিয়া পাখি সাজানোর কথা ছিল মনে আছে? একে তো আমাকে রাগিয়ে দিয়েছ তখন ওসব কথা বলে, তার উপরে দেরি করে এসেছ রুমে। দেরি করে এসেও সেই রাগিয়ে দেয়ারই কাজ করছ। এসব কি ঠিক বলো তো অনু? দুজনের রাগ অভিমান ভাঙ্গতে ভাঙ্গাতেই তো রাতটা পার হয়ে যাবে। ম্যাডামকে হলুদিয়া পাখি সাজাবো কখন বলো তো সোনাপাখি?
-এই একদম হলুদ লাগাবে না বলে দিলাম। এতোক্ষণে আসছে হলুদ লাগাতে। আমার হলুদ লাগানো শেষ, মেহেদি পড়াও শেষ। শাওয়ার নেয়াও শেষ। আর কিচ্ছু হবে না। এখন ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবো।
-ফারহা আর তাহিয়া ছাড়া আর কেউ এক ফোঁটা হলুদও তোমার গায়ে ছোঁয়ানোর সাহস দেখায় নি সোনাপাখি। জানি আমি। কজ আমার হলুদিয়া পাখিকে আমি সাজাবো, নিজের মতো করে। বুঝলে? আর মেহেদির কথা বলছ তো? তোমার মেহেদি পড়ায় আর পড়ানোর সব দৃশ্যই আমার দেখা হয়ে গেছে ম্যাডাম। তোমাকে দেখতে হলে আমার তোমার সামনে আসা লাগে না বউপাখি। বুঝলে?
-রাগও করেছে, আবার লুকিয়ে দেখেছে আমাকে। বাহ!
-জি ম্যাডাম। আপনার উপরে রাগ হতে পারে, অভিমানও হতে পারে। কিন্তু আপনার এই মিষ্টি মুখটা না দেখে তো থাকতে পারি না আমি। ইম্পসিবল সেটা।
-জি ধন্যবাদ। জেনে খুশি হলাম। সেজন্যই তখন বলছিলেন 'যেখানে ইচ্ছে হয় যেতে পারবেন, প্রবলেম নেই। তাহিয়ার বিয়েটা হয়ে যাক'। তাই না?
-ম্যাডামের রাগটা তাহলে এই কারণে? ওকে ওকে। সরি বাবা। কান ধরছি? সরি না প্লিজ অনু? এখন লক্ষী মেয়ের মতো যদি কথা শোনো তাহলে কাল সকালে একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য। ওকে?
-লাগবে না আমার এতো সারপ্রাইজ। ছাড়ো তো তুমি। আর একদম জ্বালাতে আসবা না বলে দিলাম।
-হায় হায়! কি বলো? আমার এতো সুইট একটা বউ! তাকে কি জ্বালাতে পারি আমি বলো? একদম জ্বালাতন করবো না প্রমিস। শুধু বউটাকে হলুদিয়া পাখি বানাবো আজ। তারপর হলুদে পরীটাকে প্রাণ ভরে দেখবো।
-এই আমি একটু আগেই শাওয়ার নিয়েছি হলুদ টলুদ মাখিয়ে এসে। আপনার এতো হলুদ দেয়ার শখ লাগলে নিজেই হলুদ ভূত হয়ে তারপর নিন, যান।
-বাহ! ভালো কথা বলেছ তো! আগে হলুদ ভূত বানানো, তারপর শাওয়ার শীতল পানিতে হলুদের রঙগুলো ধুয়ে-----।
-একদম না। না কিন্তু অরণ্য-----?
অনামিকা আর কথাটা শেষ করতে পারলো না। অরণ্য ততক্ষণে অনামিকাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকেই রওনা হয়েছে। অনামিকাকে সোজা ওয়াশরুমের ফ্লোরে নামিয়ে দিয়ে অরণ্য বেসিনের পাশ থেকে একটা কৌটো থেকে কাঁচা হলুদ বাটা আলতো হাতে অনামিকার গালে ছুঁইয়ে দিল। এতোক্ষণ লাফালাফি করে সরে আসার চেষ্টা যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি এবারেও অরণ্যের সামনে থেকে সরে আসার চেষ্টাটা বিফল হয়েছে অনামিকার। অরণ্যের ছোঁয়ায় অনামিকার যতটা হলুদিয়া পাখি রূপটা ফুটে উঠছে ততই দুজনেরই শ্বাস প্রশ্বাসগুলো গভীর আর ঘন হয়ে ভারী হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই অরণ্য হাত উঁচিয়ে মাথার উপরের শাওয়ারটা চালু করে দিতেই ছোট্টো ওয়াশরুমটা যেমন হলুদের রঙে রঙিন হলো, তেমনি ছোট্টো একটা শব্দও যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো ওদের দুজনকে ঘিরে। হলুদিয়া পাখির মাঝে ডুবে যেতে যেতেই সেই ছোট্ট শব্দটাই অরণ্যের সমস্ত স্বত্বা জুড়ে ছড়িয়ে গেল নিমিষেই। ছোট্টো একটা শব্দ। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।