সংসার - পর্ব ১৮ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


৩৫!! 

-অনু? রাগ করে আছো? দেখো তখন আমি সত্যিই ভিষণ ঘাবড়ে গেছিলাম। তাই ওভাবে বলে ফেলেছি অনুপাখি। সরি না? তুমি তো জানো এই সময়ে রাস্তায় কি পরিমাণ গাড়ি বের হয়। আর গাড়িগুলোর কত স্পিডে থাকে কোনো আইডিয়া আছে তোমার? তোমার কিছু একটা হয়ে গেলে আমি কি করতাম ভেবেছ একবারও? এই অনু? সরি তো? কিছু তো বলো প্লিজ? তোমার এভাবে চুপ করে থাকা আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে অনু। প্লিজ কিছু তো বলো? প্লিজ অনু? 

নদীর পাড়ে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে নি অরণ্যদের। পুরোটা রাস্তায় অনামিকা না আর একবারও বাইরের দিকে হাত, মাথা বের করেছে, আর না একটা কথাও বলেছে। অনামিকা গাড়ির জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে ছিল পুরোটা সময়। তাহিয়া আর স্নিগ্ধ কিছু বলতে চেয়েও কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে ছিল। অরণ্য নিজেও মেজাজ ঠান্ডা হওয়ার পর একটু পর পর অনামিকার দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটার চোখের কোণে পানির ছলছলানিটা এক মূহুর্তের জন্য চোখে পড়েছিল অরণ্যের। তাই অনামিকার মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার পর থেকেই অনামিকার মুখটা এক নজর দেখার জন্য অরণ্যের বুকের ভিতরটা যেন তোলপাড় করছে। অনামিকা কি কাঁদছে? কথাটা মনে পড়তেই অরণ্যের নিজেও খারাপ লাগছে। মেয়েটা সত্যি সত্যিই বেশি বলে ফেলেছে হয়তো।

তাহিয়া আর স্নিগ্ধ অরণ্য অনামিকাকে আলাদা করে নিজেদের মতো সময় কাটানোর সুযোগ দিয়ে নিজেরা চলে গেছে। তাহিয়ার আবদারে একটা নৌকা ভাড়া করে বেরিয়ে যাওয়ার পর অরণ্য আর অনামিকাও গাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অনামিকা কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে নদীর পাড় ধরেই হাঁটা শুরু করতেই অরণ্যও অনামিকার পাশে চলা শুরু করলো।

-এই অনু? সরি তো? শোনো না? আই নো আমার তখন ওভাবে বলা উচিত হয় নি। পাশ দিয়ে গাড়িগুলো কি স্পিডে চলছিল দেখেছ তো? তাই টেনশনে ওভাবে বকে ফেলেছি আমার বউটাকে। সরি তো? এই দেখো কান ধরছি? তুমিও আর এভাবে রাগ করে থেকো না লক্ষীটা প্লিজ? এই অনু?

অরণ্যের এতো বকবকের পরেও অনামিকা কিছু না বলেই চুপচাপ হাঁটছে দেখে অরণ্য অনামিকার একটা হাত টেনে ধরে নিজের দিকে ফিরাতেই অনামিকার ভেজা চোখ জোড়ায় অরণ্যের চোখ আটকে গেল। অনামিকা কোনোমতে মাথা ঝাঁকিয়ে সরে আসার চেষ্টা করতেই অরণ্য দু হাতে অনামিকার মুখটা তুলে ধরলো।

-অনু? আ'ম রিয়েলি সো সরি তো পাখিটা। জানোই তো কখন কি বলে ফেলি ঠিক নেই আমার। তবু রাগ করে থাকবে এভাবে? অনু? এই অনুপাখি?

-ইট'স ওকে। 

-দেখেছ? এখনো রাগ করে আছো। সরি তো বাবুতা। পরে অনেকগুলো আদর করে দেবো কেমন? প্লিজ প্লিজ? এবারে লক্ষী মেয়ের মতো একটু মিষ্টি করে হাসো প্লিজ?

অনামিকা না চাইতেও একটু হাসার চেষ্টা করলো। অরণ্য আলতো করে অনামিকার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই অনামিকার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। অরণ্য সেটা দেখেই ব্যস্ত হাতে অনামিকার চোখের পানি মুছিয়ে দিল।

-কি হয়েছে অনু? কাঁদছ কেন?

-জানো? আগে বাবা মায়ের সাথে বাইরে গেলে যখন আমি উইন্ডো দিয়ে হাত বের করতাম বা মাথা বের করে বাতাসের ঘ্রাণ নিতাম, মা কি বকতো আমাকে। বাবা সবসময় আমাকেই সাপোর্ট করতো যদিও। তবু আজ তোমার এভাবে রাগ করায়, বকায়, মায়ের কথা ভিষণ মনে পড়লো। খুব মিস করছি আজ মাকে। 

-অনু? মা বাবা নাহয় রাগ করে বকেছে, তার জন্য এভাবে ছেলেমানুষি করে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে নিজেও কষ্ট পাচ্ছ, উনাদেরকেও কষ্ট দিচ্ছ। এটার কি কোনো দরকার ছিল বলো?

-বাবা বা মা হাজার বকলেও আমার কষ্ট হতো না, হয়তো মারলেও এতোটা কষ্ট পেতাম না যতটা সেদিন পেয়েছিলাম। বাবা মা হিসেবে সেদিন তাদের কি উচিত ছিল না নিজের সন্তানের ভুল ত্রুটিগুলো বিচার করে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া? তুমি নাহয় রেগে ছিলে, কিন্তু বাবা মায়ের কি উচিত ছিল না কি হয়েছে সবটা জানার চেষ্টা করা, বা তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা? কিন্তু উনারা কি করলো? মেয়ে বিয়ের পরদিনই শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে আসবে এটাই তাদের কাছে বড় হয়ে গেল? শুধু নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে জাস্ট আমাকে তোমাদের বাড়িতে রেখে চলে এলো? মানে তাদের মেয়ের জীবনে কি ঘটবে তাতে তাদের কোনো দায় নেই! 

-বড়দের অনেক সিদ্ধান্তই আমাদের পছন্দমতো হয় না। কিন্তু তার পিছনেও কিন্তু আমাদের ভালোর চিন্তাই থাকে বুঝলে? সেদিন যদি তোমার বাবা মা তোমাকে নিজেদের সাথে নিয়ে যেত, তাহলে আজকের দিনটা কি আসতো আমাদের জীবনে বলো অনু? একবার তো সেই দিকটাও ভাবো।

-সবসময় তো এতো ভেবে ঠিক করা যায় না অরণ্য। বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট তো থেকেই যায়। সেটা কি কমবে কি হতে পারতো, কেন হয়েছে এসব ভেবে?

-অনু? একবার বাবা মার সাথে কথা বলো। দেখবে রাগও কমে যাবে, অভিমানটাও-----।

-কক্খনো না। যারা নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে আমাকে ফেলে গেছে, এতোদিনে আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি খবর নেয়ার পর্যন্ত প্রয়োজন হয় নি তাদের সাথে না আমার কোনো যোগাযোগ করার ইচ্ছে আছে আর না তাদের উপরে রাগ বা অভিমান করে বসে আছি যে বললেই তাদের কাছে ফিরে যাবো। এ জীবনে সেটা কখনো সম্ভব নয় অরণ্য।

-এতো জেদ কিন্তু ভালো না অনু। বাবা মা রাগের মাথায় যে ভুলটা করেছে তুমিও কেন সেটাই করবে? আমি বলছি কি শোনো, কাল আমি আর তুমি গিয়ে বাবা মাকে তাহিয়ার বিয়ের ইনভিটেশনটা দিয়ে আসি? দেখবে বাবা মাও রাগ করে থাকবে না আর। আর তোমরাই তো বাবা মা নাকি? কয়দিনই বা এভাবে রাগ করে থাকবে বলো?

-সব কথা শোনার পর যদি বাবা কিংবা মা আমার পাশে না দাঁড়াতো বা তোমাদের বাড়িতে রেখে চলে যেত, সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতো, তাহলে হয়তো আমি নিজেই বেহায়ার মতো হলেও তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। কিন্তু যারা আমার কথা শোনার আগেই আমাকে অপরাধীর ট্যাগ লাগিয়ে দিতে পেরেছে, তারা আমাকে নিজের সন্তান বলে সবার কাছে পরিচয় দিলেও সেদিনের পর থেকে তাদের সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।

-অনু? এতো রাগ কিন্তু ঠিক না। আমিও তো না শুনেই তোমার উপরে রাগ করেছিলাম। তেমনই বাবা মা ও না জেনেই------।

অরণ্য কথাটা শেষ করার আগেই অনামিকার হাতে ধরা মোবাইলটায় আলো জ্বলে ওঠার সাথেই ভাইব্রেশন হতেই অনামিকা চমকে মোবাইলের দিকে তাকালো। একটা অচেনা নাম্বার ভেসে উঠেছে মোবাইলের স্ক্রিনে। অনামিকাকে এভাবে চমকে উঠতে দেখে অরণ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অনামিকাকে হালকা করে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে।

-কি হলো অনু? কে কল করলো? কলটা রিসিভ করো? এভাবে আঁতকে উঠলে কেন?

-কই? না তো? নাম্বারটা চিনি না তো তাই রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না।

-আরে বাবা। পরিচিত কেউও তো হতে পারে নাকি?

-উমমমমম? হুম। তাও ঠিক। 

-কলটা রিসিভ করো পাগলি। কাল থেকেই দেখছি তোমার কারো কলই রিসিভ করার কোনো আগ্রহই নেই। ব্যাপারটা কি বলো তো?

-কই? না-না তো! 

অরণ্য আরো কিছু বলতে যাবে এর আগেই অনামিকা কলটা রিসিভ করে কানে ধরলো। অপর প্রান্তের মানুষটা কে বা কি বললো অরণ্য কিছুই বুঝে ওঠার আগেই অনামিকা কলটা কেটে দিল। অরণ্য অনামিকার কাঁধ চেপে নিজের সাথে আরো কিছুটা নিবিড় করে জড়িয়ে নিয়ে অনামিকাকে নিজের দিকে টানলো। অরণ্য এরপর কি প্রশ্ন করবে সেটা ভেবে দেখাতেও সময় নষ্ট করলো না অনামিকা। মোবাইলটা বিরক্ত ভঙ্গিতে পাওয়ার অফ করে দিয়ে অরণ্যের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

-বললাম না পরিচিত কেউ না। অযথাই বারবার কল করে বিরক্ত করছে। বিরক্তিকর!

-অনু? বিরক্ত করছে মানে? কবে থেকে? আমাকে কিছু বললে না কেন? কি বলেছে বলো আমাকে? নাম্বারটা আমাকে দাও। তারপর দেখছি কোন শালার এতো বড় সাহস হয় আমার বউকে বিরক্ত করে!

-এবার তুমিও বিরক্ত করো না তো। বিরক্ত হয়ে একসময় কল করা বন্ধ দিবে। অযথা ঝামেলা করার কি আছে?

-ঝামেলা করার কিছু নেই বলছ? আমার স্পষ্ট মনে আছে ওইদিন কেউ তোমার নাম ধরেই কথা বলেছিল। অপরিচিত হলে তো তোমার নামটা জানতো না তাই না? 

-এখন কি মাঝরাস্তায় এসব নিয়েও জেরা শুরু করে দিবে তুমি? এক কাজ করো তুমিই ওই লোকটাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করো আমাকে চিনে কি করে। বা আমি তাকে চিনি কি না।

-আরে অনু? শোনো না? রেগে যাচ্ছ কেন বউটা? আমি এমনি কথাটা বললাম। হয়তো অন্য কেউ কল।করেছিল। আমার তো নাম্বারটা খেয়াল নেই। হতেই পারে এটা অন্য কেউ। আবার হতেও পারে তোমার পরিচিত কোনো ফ্রেন্ডই দুষ্টুমি করে এমন করছে। আমি তো তাই সিম্পলি কথাটা বললাম।

-তুমি মোটেও সিম্পলি কথাটা বলো নি। তুমি কল করে ক্লিয়ার হয়ে নাও। তাহলে তোমারও ডাউট ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

-আরে! অনু? এই মেয়েটা এতো রাগ করছে কেন? এই পাগলি? তাকাও আমার দিকে? আমি ওভাবে বলেছি নাকি কথাটা? তাকাও না আমার দিকে? অনুপাখি? এই?

অনামিকা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই অরণ্য দু হাতে অনামিকার মুখটা তুলে ধরে নিজের দিকে ফিরালো। অরণ্যের সাথে চোখাচোখি হতেই টুপ করে এক ফোঁটা পানি অনামিকার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। অরণ্য আলতো হাতে অনামিকার চোখ মুছিয়ে দিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে একটা কথাই ভাবলো।

-এই মেয়েটার আজ হলোটা কি?

৩৬!! 

বাসায় ফিরতে অরণ্যদের যেমন রাত হলো তেমনি চারজনেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। হুট করে কোথা থেকে যেন একটা ঝড়ো বৃষ্টি এসে সবাইকে কাকভেজা করে ভিজিয়ে দিয়েছে। মাঝ নদীতে নৌকায় থাকা তাহিয়া আর স্নিগ্ধ যেমন ভিজেছে, তেমনি নদীর পার ঘেষে হাঁটতে থাকা অরণ্য আর অনামিকাও ভিজে গেছে। স্নিগ্ধের তাড়ায় মাঝনদীর নৌকা তীরের দিকে ভিড়লেও অরণ্যের হাজার বারণের পরও অনামিকার গাড়িতে ওঠার কোনো আগ্রহই দেখা গেল না। অরণ্য জোর কদমে কয়েক পা এগিয়ে পাশ ফিরে অনামিকাকে দেখতে না পেয়ে পিছনের দিকে তাকাতে দেখলো অনামিকা কোনো এক ভাবনার রাজ্যে ডুব দিয়ে যেন কোনো এক ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। বৃষ্টিতে মেয়েটার পড়নের শাড়িটা যে ধীরে ধীরে ভিজতে শুরু করেছে সেদিকেও যেন খেয়ালই নেই অনুর। অরণ্য অনামিকার কাছে ফিরে এসে অনামিকার গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিতেই অনামিকা চমকে তাকালো অরণ্যের দিকে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অরণ্যের চুল বেয়ে চোখ, মুখ, ঠোঁট ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। দৃশ্যটা দেখে অজান্তেই একটা হার্টবিট মিস হল অনামিকার। বৃষ্টির ভেজার পর এতো স্নিগ্ধ কেন দেখাতে হবে এই লোকটাকে?

-হা করে কি দেখছ অনু? বৃষ্টি বাড়ছে আরো। গাড়ির কাছে পৌঁছাতে রীতিমতো ছুট লাগানো দরকার। আর তুমি যেভাবে আঁকাবাকা এলো পায়ে হাঁটছ তাতে রোডে উঠতেই পনেরো মিনিট লাগবে। চলো চলো? বকবক করার আর সময় নেই।

-এতো তাড়ার কি আছে? কতদিন পর এভাবে ভিজতে পারছি! আবার কবে বৃষ্টির পানিগুলো এভাবে ছুঁয়ে দিবে কে জানে! আবার কবে একজন বৃষ্টিভেজা যুবকের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ হবো কে জানে! 

-এই অনু? পাগল হয়ে গেছ নাকি? বৃষ্টি! উফ! দেখছো? বললাম না বৃষ্টিটা বাড়বে? চলো?

-তুমি যাও। আমি ভিজবো আরো। 

-অনু? পাগলামি করো না পাখিটা। হঠাৎ এভাবে ভিজলে জ্বর আসবে শেষে। আর এমন আচমকা বৃষ্টিটা একদম ভালো না শরীরের জন্য। ভিজতে হবে না এতো। অনু?

বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দে আর মেঘের লাগাতার গর্জনে অরণ্যের কথাগুলো কানে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে কিনা অনামিকার সে ব্যাপারে অরণ্যের গুরুতর সন্দেহ আচ্ছে। অনামিকাকে আরেকবার ডাকতে গিয়ে অরণ্য হতাশ হয়ে খেয়াল করলো মেয়েটা মনের আনন্দে দু হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। মুষুলধারে বৃষ্টিতে ততক্ষণে অনুর পড়নের শাড়িটা ভিজে গায়ে লেপ্টে গেছে। অরণ্য কয়েক মিনিট সব ভুলে মুগ্ধ হয়ে অনামিকাকে দেখলো। একটু পরেই অরণ্য একটা অদ্ভুত ঘোরের মাঝেই অনামিকার ভেজা চুলে হাত ডুবিয়ে অনামিকাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে নিজের বৃষ্টি ভেজা ঠোঁটজোড়া ডুবিয়ে দিল অনামিকার ঠোঁটে। অনামিকাও একবার চমকে কেঁপে উঠে অরণ্যের একটা হাত খামচে ধরলো। বেশ কিছুক্ষণ পর অরণ্য সরে অনামিকার কাঁপা ঠোঁট জোড়া থেকে সরে এসে অনামিকার কানের কাছে ঠোঁট নিল।

-এই মাঝরাস্তায় আর আমাকে পাগল করো না প্লিজ অনু। বাড়ি ফিরে যত ইচ্ছে তোমার এই বৃষ্টিভেজা রূপে আমাকে মাতাল। আর বেশিক্ষণ কিন্তু তোমার এই ভেজা শাড়ির লুকটা হজম করতে পারবো না বলে দিলাম মেয়ে। ছোটো বোন আর নতুন জামাইয়ের সামনে একটা কেলেঙ্কারি ঘটে যেতে পারে আর এক মিনিটও এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে। তন আবার আমার দোষ দিও না।

-ওহ শিট! পুরো ভিজে গেছি! এবার কি করবো? একদম মনে ছিল না যে এখন ভেজা উচিত হবে না।

-কি আর করবে? দৌঁড় লাগাও। তাহিয়ারাও এতোক্ষণে এসে গেছে। আমাদেরকে না দেখতে পেলে টেনশন করবে। চলো চলো? রেডি, স্টেডি, গো।

বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে দৌঁড় লাগিয়ে নদীর পাড় থেকে মেইন রোডে গাড়ির সামনে আসতে বেশি সময় লাগে নি অরণ্য আর অনামিকার। তাহিয়া আর স্নিগ্ধও ততক্ষণে চলে এসেছে গাড়ির সামনে। আর দেরি না করে সোজা ভিজে চুপচুপে চারজন বাসায় ফিরলো। এমনভাবে ভিজে গেছে যে কোনো রেস্টুরেন্টে নেমে ডিনার করার কথা মাথাতেও আসে নি কারো। বাড়িতে আসতেই এভাবে ভিজার জন্য তাইয়্যেবা জামান সবাইকেই ইচ্ছে মতো বকলেন। বকাবকি পর্ব শেষ হতেই তাহিয়া আর অনামিকা রুমের দিকে পালালো। স্নিগ্ধকে গেস্টরুমে চেইঞ্জ করে নিতে বলে অরণ্যও রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে এসে দরজা লক করে আধখোলা আলমারি থেকে একটা শুকনো টাওয়াল বের করে সেটা গায়ে জড়িয়ে ভিজে কাপড় বদলে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে অনামিকার বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। বেশ অনেকক্ষণ পর অনামিকা ভেজা চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই অরণ্যের দিকে চোখ পড়তেই অনামিকা চুল মোছা বাদ দিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে এলো।

-সরি সরি! অনেক দেরি করে ফেলেছি। সরি। তুমি তাড়াতাড়ি চেইঞ্জ করে নাও যাও?

-যাব্বাবা! শেষমেশ বের হলে তাহলে? আমি তো আরো ভাবলাম ওয়াশরুমেই ঘুমিয়ে গেলে কিনা। 

-সরি তো!

-কোথায় ভাবলাম ভিজে টিজে এসেছি, দুজনে একসাথে শাওয়ার নিবো। তা ম্যাডাম যে শাওয়ার নিতে গেলেন, বের হওয়ার নামই নেই। সবসময় আমার রোমান্সে পানি না ঢাললে তার তো চলেই না। কি আর করা!

-হয়েছে তো! সরি বললাম তো? যাও না?

-বাব্বাহ! রাগ আমার করার কথা! এখন দেখছি ম্যাডাম আমাকে রাগ দেখাচ্ছেন! একেই বলে, উল্টা চোর কোতয়ালকো ডাটে। কি দিনকাল আসলো রে বাবা! হাহ! সবই কপাল!

-চেইঞ্জ করতে যাবে তুমি? 

-জি ম্যাডাম। যাচ্ছি। চাইলে আপনিও আসতে পারেন। একসাথে শাওয়ার নেয়ার অফারটা কিন্তু এখনও আছে। না মানে কেউ রাজি থাকলে আমি কিন্তু না করবো না।

-যাও-------।

অনামিকা মোটামুটি অরণ্যের একটা হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে তুলে ঠেলে ওয়াশরুমের দিকে পাঠিয়ে দিল। অরণ্য ঠোঁটের ইশারায় অনামিকাকে একটা চুমোর ভঙ্গি করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। মিনিট পাঁচেক পরেই ওয়াশরুমের দরজাটা হালকা করে খুলে গেল। 

-এই বউ? একটা ট্রাউজার আর টিশার্ট দাও তো? শুকনো কাপড় না দিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়েছ। এটা কোনো কথা?

-উফ! এতোক্ষণ রুমে বসে কি করছিল লোকটা কে জানে! 

-প্ল্যানিং করছিলাম গো সোনাবউ প্ল্যানিং। বউয়ের মন মেজাজের কাহিনী বোঝার চেষ্টা করে বিফল হয়ে কি করে আদর করে রাগ ভাঙ্গানো যায় সেটারই প্ল্যান করছিলাম। বাট কোনো প্ল্যানই কাজে এলো না। বেচারা আমি! বউটা সেই রাগ করেই আছে এখনো।

অনামিকা কিছু না বলে চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে এসে আলমারি থেকে ট্রাউজার আর টিশার্ট এনে অরণ্যের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। অরণ্য সেটা খেয়াল করে ভ্রু কুঁচকে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চেইঞ্জ করে বের হয়ে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বিছানার দিকে এগিয়ে এসে টাওয়ালটা এক পাশে ফেলে সোজা অনামিকার গায়ের উপরেই শুয়ে উঠলো। অনামিকা চোখ বুজে ছিল। হঠাৎ গায়ের উপরে চাপ পড়তেই অনামিকা ধড়ফড় করে বিরক্তিমাখা চোখ অরণ্যের দিকে তাকালো।

-উফ সরো তো! পুরো বিছানা খালি পড়ে আছে। আর তোমার আমাকেই বিছানা বানাতে ইচ্ছে করছে? সরো তো?

-আরে! তোমার মতো নরম তুলতুলে বিছানা আর এই দুনিয়ায় একটাও আছে নাকি বলো তো? কি সফ্ট! উফ! আমার তো ঘুম চলে আসছে।

-অসহ্য! সরো তো গায়ের উপর থেকে? এমনিতেই পুরো শরীরটা ব্যথা হয়ে আছে। পায়ে ব্যথায় নড়তেও পারছি না। আর নি এসেছে হাড়গোড় আরো গুঁড়ো করতে। সরো?

-যাব্বাবা! বউটার আজকে হলোটা কি? কখনো তুফানি রাগ করছে, অকারণেই বাচ্চাদের মতো পাগলামি করছে, হুটহাট বিরক্ত হচ্ছে, ছোট্টো কিউটি বেবির মতো কাঁদছে একেকবার। ব্যাপারটা কি বলো তো বউপাখি?

-সরো না? ব্যথা পাচ্ছি তো! উফ! ব্যথায় মরে যাচ্ছি। আর উনি আছে নিজের খোঁচাখুঁচি নিয়ে। যাও তো সামনে থেকে?

-ব্যথায় মরে যাচ্ছ। তবু শপিং তো ধুমিয়ে করলে। তারপর ঘুরার প্ল্যান তো ক্যানসেল করতে চাইলাম। তুমি তো শুনলেই না।

-উফ! অরণ্য? সরবে তুমি? শপিং ব্যাগগুলোও তো গাড়িতে রয়ে গেছে। সেগুলো আনতে হবে খেয়াল আছে? 

-ওহহো! আমার একদমই খেয়াল ছিল না। তুমিও ওঠো তো? ডিনার করে নাও। তারপর ঘুমিও।

-বিরক্ত করো না তো। খাবো না কিছু আমি এখন। তুমি নিজে গিয়ে খেয়ে আসো। সরো?

-তোমাকে তো পরে দেখে নিচ্ছি মেয়ে। আর হলো টা কি তোমার সেটা আগে ধরতে পারি তারপর কি করা যায় দেখা যাক।

অরণ্য আলতো করে অনামিকার কপালে চুমো এঁকে দিয়ে নিচের দিকে ছুটলো। গাড়ি থেকে শপিংব্যাগগুলো নিয়ে এসে তাহিয়ার আর বাকিদের ব্যাগগুলো রুমে দিয়ে এসে বাকি ব্যাগগুলো নিয়ে এসে রুমে চলে এলো। অনামিকা গায়ে কাঁথা জড়িয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে দেখে শব্দ না করেই শপিংব্যাগগুলো আলমারিতে রেখে সরে আসার সময়ই জিনিসটা চোখে পড়লো অরণ্যের। আর অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো।

-ও আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন