একটু ভালোবাসা - পর্ব ০৩ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


০৫!!

প্রিয়ু বাড়িতে ফিরে দেখে মনসুর আলী, আলেয়া বেগম কেউই এখনো বাড়িতে ফেরেনি। আশা অসুস্থ শরীর নিয়েই রান্না করছে। একটু পরপর হাঁচি, কাঁশি দিচ্ছে। প্রিয়ু তাড়াতাড়ি করে ব্যাগটা ঘরে রেখে রান্নাঘরে যায়। জোর করে আশাকে ঘরে রেখে নিজে রান্না করতে বসে। আগুন দপদপ করে জ্বলছে। শীতের সময় বলে আগুনের তাপ ভালো লাগছে। গরম হলে সহ্য করা খুব কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু কিছু করার নেই। এতিমদের সবসময় রয়েসয়েই থাকতে হয়। একমনে রান্না করতে করতে অনেক চিন্তাভাবনা মনের ভেতর ঘুরপাক খায়। অরণ্য আর তিতলির কথাটাও মাথায় জেঁকে বসে। দুই ধর্মের ভালোবাসার শেষ পরিণতি কী? পরিবার, সমাজ কখনো কি ওদের ভালোবাসা মেনে নেবে? কী করবে ওরা? সিয়াম ডাক্তারকে প্রিয়ুর বেশ ভালো লাগে। শান্ত আর ইনোসেন্ট একটা লোক। চোখের ভাষাও সহজ-সরল। আশা আপুর সাথে ডাক্তার সিয়ামের বিয়ে হলে আশা আপু ভীষণ সুখে থাকবে। কিন্তু আশা আপু কী চায়? জিজ্ঞেস করতে হবে একবার। সর্বশেষ মাথায় আসে রিশাদের কথা। ওর কথাগুলো মনে পড়লে একা একাই হাসি এসে পড়ে। শপিংমলে রিশাদের বলা 'আমি কিছু করিনি।' কথাটা মনে পড়তেই খিলখিল করে হেসে ফেলে।

"কী ব্যাপার? মনে এত ফূর্তি ক্যান?"
রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে আলেয়া বেগম। প্রিয়ু কিছু বলে না। শুধু হাসিটাই থেমে যায়। চেহারায় বিরক্তির ছাপ। প্রিয়ুকে চুপ থাকতে দেখে তিনিও এই বিষয়ে কিছু বলেন না। 
"একটু পানি খাওয়া তো।"
প্রিয়ু উঠে গিয়ে আলেয়া বেগমকে পানি দেয়। পানি পান করে আলেয়া বেগম বলেন,
"কালকে পিঠা বানিয়ে দেবো। ঐগুলা নিয়ে আমার ভাইর বাসায় যাবি।"
তৎক্ষণাৎ প্রিয়ু উত্তর দেয়,
"আমি পারব না। ভাইয়াকে বলো গিয়ে।"
"মুখে মুখে তর্ক করা বন্ধ কর। আমিনকে পাঠানোর হলে তোকে তো আর বলতাম না।"
"আমি ঐ বাড়িতে যাব না, মানে যাব না।"

প্রিয়ু রান্নাঘরে চলে যায়। রান্নাবান্না শেষ করে ঘরদোর পরিষ্কার করে ফেলে। রাতে আর খেতে ইচ্ছে করে না বলে না খেয়েই শুয়ে পড়ে। প্রিয়ু খেল কী না খেল তাতে কারো কিছু যায় আসে না। আশাকে আগেই খাইয়ে দিয়েছে। আশা এখন ঘুমিয়ে আছে। জেগে থাকলে জোর করে হলেও প্রিয়ুকে খাওয়াত। মনটা ভালো লাগছে না। ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে। মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। ঘরের জানালা খুলে দেয়। শাই শাই করে দল বেঁধে যেন বাতাসেরা ঘরে প্রবেশ করল। শীতে কেঁপে ওঠে প্রিয়ু। মায়ের সঙ্গে একা একা হাজারটা কথা বলে। সবকিছুই বলে। উত্তর পাবে না জেনেও!


রেষ্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে পূজা সরকার আর অরণ্য। পূজা সরকারকে ভীষণ শান্ত দেখাচ্ছে। তিনিই অরণ্যকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই কথার প্রসঙ্গ তিনিই তুলেন। জিজ্ঞেস করেন,
"তিতলির সাথে তোমার সম্পর্ক কত বছরের?"
"তিন বছরের।"
"তুমি জানতে না তিতলি হিন্দু?"
"জানতাম।"
"তাহলে জেনেও কেন সম্পর্কে জড়ালে?"
"এতকিছু ভাবিনি। শুধু জানি ভালোবাসি।"
"দেখো আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। বাস্তবতা ভাবো। তোমাদের সম্পর্কের কোনো ভিত্তি নেই। কখনো সম্ভব না তোমাদের এক হওয়া। আমি তিতলিকেও জোর করে বিয়ে দিতে পারছি না।"
অরণ্য নিশ্চুপ। তিনি আবার বলেন,
"দেখো তোমার কাছে যেমন তোমার ধর্ম বড় তেমনি আমার কাছেও আমার ধর্ম বড়। তুমি কি পারবে তিতলির জন্য হিন্দু হতে? আমি জানি তুমি পারবে না। তেমনি আমরাও পারব না তিতলিকে মুসলিম হতে দিতে। তাছাড়া সমাজে আমাদের অন্য রকম একটা সম্মান আছে। আমার মেয়ে মুসলিম ধর্মের একটা ছেলেকে বিয়ে করবে এটা জানাজানি হলে আমার মান-সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমি অনেক অসহায় আর নিরুপায় হয়ে তোমার কাছে এসেছি। তুমি প্লিজ তিতলির জীবন থেকে সরে যাও। আমার ভাইপো বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছে। আমরা সবাই চাই তিতলির সাথে ওর বিয়ে দিতে। কিন্তু তিতলি রাজি হচ্ছে না।"
"আপনি চাচ্ছেন আমি তিতলিকে বলব অন্য কাউকে বিয়ে করতে?"
"তুমি বোঝার চেষ্টা করো। সবদিক ভেবে বলো বাবা। আমায় এভাবে ফিরিয়ে দিও না। তুমি একবার ভাবো শুধু তিতলির কথা। তুমি চাও না তিতলি সুখী হোক?"

সমুদ্রের অথৈ জলে ভেসে বেড়ানো এক প্রাণী মনে হচ্ছে অরণ্যর নিজেকে। যে না পারছে ডুবতে আর না পারছে পাড়ে ওঠতে। তিতলিকে ছাড়া অরণ্য কীভাবে থাকবে? কীভাবে অন্য কারো সঙ্গে তিতলিকে সহ্য করবে? ভাগ্যের পরিহাসে তিতলিকে হারাতে হবে? অরণ্য চায় তিতলি সুখী হোক। পূজা সরকারকে অরণ্য কথা দিয়েছে। তিতলিকে ঐ বিয়েতে রাজি করাবেই। তারপর নিজে কীভাবে আর কী নিয়ে বাঁচবে তা অরণ্য জানে না। এই মুহূর্তে প্রিয়ুকে দরকার। খুব দরকার। ওর সাথে কথা বললেই মনে শান্তি আসবে। কোথায় পাব এখন প্রিয়ুকে? ওর বোনের ফোনে ফোন দেবো? না, থাক! কাল প্রিয়ু ভার্সিটি যাওয়ার সময়ই দেখা করব।

তিনদিন পার হয়ে গেলেও প্রিয়ুর দেখা পায় না অরণ্য। মেয়েটা হঠাৎ গুম হয়ে গেল নাকি। চারদিনের দিন আশার সঙ্গে দেখা হয়। আশার কাছেই জানতে পারে প্রিয়ু মামার বাড়ি গেছে। আজ ফিরে আসবে। অরণ্য জানায় বাড়িতে ফিরলে দেখা করতে।
তিনটা দিন ভীষণ অস্বস্তিতে কেটেছে প্রিয়ুর। সবার কথা খুব মনে পড়লেও রিশাদের কথা বেশিই মনে পড়েছে। কেন এত বেশি মনে পড়েছে প্রিয়ু জানে না। রিশাদের সাথে সময় যে খুব বেশিই কাটিয়েছে তা নয়। খুব অল্প সময় কাটিয়েছে। তবুও মানুষটা যেন মনের অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিকেলে বাড়িতে ফিরেই রিশাদের বাড়িতে চলে যায়। সিকিউরিটি সালাম চাচা প্রিয়ুকে দেখে চিনতে পারে। প্রিয়ু সালাম দিয়ে বলে,
"কেমন আছেন চাচা?"
"ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?"
"আলহামদুলিল্লাহ্‌। রিশাদ বাসায়?"
"না। আজকে সকালেই কোথায় নাকি গেছে।"
"কবে আসবে?"
"তা তো কিছু জানি না।"
"ওহ আচ্ছা।"

প্রিয়ু মন খারাপ করে চলে যায়। রাতেও একবার বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে যায়। সালাম চাচার কাছে জানা যায় রিশাদ বাড়িতে ফেরেনি। মন খারাপ করে বাড়িতে ফেরার সময় অরণ্য ভাইয়ার সাথে দেখা হয়।
"কী রে কোথায় গিয়েছিলি?" জিজ্ঞেস করে অরণ্য।
"এইতো! এখানেই।"
"তোর মন খারাপ?"
"না তো!"
"সত্যি করে বল।"
"একজনকে খুব মিস করছি।"
"কাকে?"
"রিশাদকে।"
"এই রিশাদ কে?"
প্রিয়ু শুরু থেকে রিশাদের গল্প করে। অরণ্য বুঝতে পারে প্রিয়ু না চাইতেও রিশাদের ওপর দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনিতেই প্রিয়ুর এখন মন খারাপ। তাই নিজের মন খারাপের গল্প শুনিয়ে মন খারাপ বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয়নি অরণ্যর। প্রিয়ুকে হাসাতে বলে,
"দেখলি বলেছিলাম না কয়েকদিন পর নিজেই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যাবি?"
প্রিয়ু অবাক হয়ে বলে,
"আমি কখন বিয়ের কথা বললাম?"
"প্রথমে ভালোলাগা, পরে মিস, তারপর ভালোবাসা, তারপরই তো বিয়ে। তুই এখন দ্বিতীয় ধাপে আছিস।"
"ধুর! ফালতু কথা শুধু।"
"হইছে ভাইয়ের কাছে আর লুকাতে হবে না। আমার সাথে দেখা করিয়ে দিস। বোন জামাইকে দেখতে হবে তো?"
"তুমি অনেক অগ্রিম ভেবে ফেলতেছ ভাইয়া। এমন কিছুই নয়।"
"আচ্ছা। বেশ! এখন বল কী খাবি?"
"আইসক্রিম খাব।"
"এই শীতের মধ্যে আইসক্রিম?"
"হুম। শীতের মধ্যেই তো আইসক্রিম খাওয়ার আসল মজা। শীতে কাঁপতে কাঁপতে আইসক্রিম খেয়ে কাঁপুনী বাড়িয়ে দেওয়ার মজাই আলাদা।"
অরণ্য হেসে বলে,
"পাগলী!"
প্রিয়ুর জন্য আইসক্রিম আর নিজের জন্য সিগারেট কেনে। আইসক্রিম হাতে নিতেই মুখটা মলিন হয়ে যায় প্রিয়ুর। বিষাদিত কণ্ঠে বলে,
"জানো ভাইয়া, ছোটবেলায় মায়ের কাছে যখন আইসক্রিম খাওয়ার বায়না করতাম, মা খুব বকত। হেসে হেসে বকত। রাগ আসত না। মিথ্যে রাগ দেখাত। আমি বুঝে ফেলে খুব হাসতাম। একবার শীতে আমার এমন ঠান্ডা লেগেছিল যে আমি কথাই বলতে পারছিলাম না। ডাক্তার বলে দিয়েছিল গরম পানি ছাড়া কোনে পানি না খেতে। এমনকি তিনবেলা গরম ভাত, গরম তরকারি খেতে বলেছিল।ঐ সময়ে আমি বায়না ধরেছি আইসক্রিম খাব। আব্বা জানলে তো খুব বকবে তাই মা লুকিয়ে কিনে দিয়েছিল। শর্ত দিয়েছিল আমায় ওষুধ ঠিকমতো খেতে হবে। আমার সব আবদার, বায়না পূরণ সবকিছু ঘিরে ছিল ঐ একটাই মানুষ। মা পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সাথে সাথে সবকিছুই আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমার নিজের বলতে কিছুই রইল না ভাইয়া।"

অরণ্যর বুকের ভেতর ব্যথা হয়। বোনটার কিছু কথায় মুখে যেমন হাসি ফোঁটায় তেমনি কিছু কথা বুকের ভেতরটা ভেঙেচুরে দেয়। প্রিয়ুর মাথায় হাত বুলিয়ে অরণ্য বলে,
"তুইও একদিন সুখী হবি দেখিস। খুব সুখী হবি। তখন সুখও তোকে হিংসে করবে।"
"সুখ আমার কপালে নেই ভাইয়া।"

--------------------------------------

তিতলির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে অরণ্য। হয়তো আজই শেষ দেখা হবে দুজনের। পূজা সরকার তিতলির বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। তার কথাতেই আজ তিতলির সাথে দেখা করতে এসেছে অরণ্য। তিতলি কান্না করছে সামনে বসে। অরণ্যর হাত ধরে বলে,
"প্লিজ অরণ্য কিছু করো। চলো আমরা কোথাও পালিয়ে যাই।"
অরণ্য কিছুক্ষণ ধাতস্থ থেকে বলে,
"আমার পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তিতলি। ঝোঁকের বসে সম্পর্কে জড়িয়ে গেলেও এখন আমি সবটা বুঝতে পারছি। বাড়িতে তোমার কথা জানিয়েছি আমি। তোমার পরিবার যেমন আমায় মেনে নিতে পারেনি। তেমনি আমার পরিবারও তোমায় মেনে নেবে না। আর পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"

তিতলি অবাক হয়ে অরণ্যর কথা শোনে। বিশ্বাসই করতে পারছে না অরণ্য এসব কথা বলছে। চেনা মানুষটাও এমন হুট করে পরিবর্তন হয়ে গেল? ভাঙা ভাঙা গলায় তিতলি বলে,
"এভাবে বোলো না অরণ্য। আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না। তুমি তো জানো আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি!"
"আমি নিরুপায় তিতলি। আমার কিছু করার নেই। তোমার জন্য আমার বাবা-মাকে আমি ছাড়তে পারব না। তোমার মা যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছে। তুমি তাকেই বিয়ে করে নাও। সুখী হও তুমি।"

তিতলি রাগে অরণ্যর শার্টের কলার চেপে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"সম্পর্কে জড়ানোর আগে পরিবারের কথা মনে পড়েনি? এখন যখন তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না তখন তুই আমায় ফিরিয়ে দিচ্ছিস? সুখী হতে বলছিস? বেঈমান, শুধু নিজের কথাটাই ভাবলি তুই।"
অরণ্য তিতলির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তিতলি কাঁদতে কাঁদতে টেবিলে মাথা ঢেকিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। অরণ্য নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। এভাবে কখনো তিতলিকে কষ্ট দেবে, কাঁদাবে স্বপ্নেও ভাবেনি অরণ্য। কিন্তু অরণ্যরই বা কী করার আছে? ভাগ্য যে ওদের সহায় নেই। পরিবারকে যে এখন ইস্যু করতে হলো মিথ্যা বলে। সম্পর্কের শুরু থেকেই অরণ্যর পরিবার তিতলির কথা জানতো। তারা সবসময়ই বলত, 'তুই সুখে থাকলেই আমরা খুশি।' সেই পরিবারকে নিয়েও আজ মিথ্যা বলতে হলো। 
তিতলি আবারও অরণ্যর হাত ধরে বলে,
"প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না অরণ্য প্লিজ। আমি তোমায় ছাড়া বাঁচব না। বাঁচতে পারব না আমি।"
"আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি।"বলে, হাত ছাড়িয়ে নেয় অরণ্য। উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে। আরেকটু সময় তিতলির সামনে থাকলেই চোখের পানি দেখে ফেলত তিতলি। তিতলির সামনে দুর্বল হওয়া যাবে না একদম। পিছু ফিরেও তাকানো যাবে না। ঐ মুখের দিকে তাকালে ভুল হয়ে যাবে। খুব বড় ভুল!


গরমে তিরতির করে ঘামছে প্রিয়ু। শীতের মধ্যেও গরম লাগছে। কী অদ্ভুত! জ্যামের কারণে বাস আটকে আছে। সূর্যও আজ প্রখর কিরণ দেওয়া শুরু করেছে। প্রিয়ু বসেছে জানালার পাশে। সূর্যের তাপ প্রিয়ুর চোখেমুখে পড়ছে। এতই গরম লাগছে যে গায়ের শাল খুলে ব্যাগে ভরে রেখেছে। আজ তো প্রথম ক্লাশ মিস যাবেই। সীটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। জ্যাম ছুটতে শুরু করেছে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই অপর একটি বাসে দেখতে পায় রিশাদকে। ডাক দেওয়ার আগেই জ্যাম সম্পূর্ণ ছুটে যায়।বাস তার নিজ গতিতে চলতে শুরু করে। প্রিয়ু এখন কী করবে না করবে দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞানটুকুও হারিয়েছে। প্রতিটাদিন প্রিয়ুর চোখ রিশাদকে খুঁজে বেড়িয়েছে। আর আজ এতদিন পর তার দেখা মিলল। মনের ভেতর খুশিগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।  দেখা করতে হবে। এখনই রিশাদের সাথে দেখা করতে হবে। ভার্সিটিতে আজ যাবে না প্রিয়ু। নিজের সীট ছেড়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে,
"মামা বাস থামান। আমি নামব।"
হেল্পার বলে,
"এইহানে কই নামবেন? মাঝ রাস্তায়!"
"আমি এখানেই নামব। বাস থামাতে বলেন আপনি।"

হেল্পার বাসের গায়ের জোরে জোরে বারি দিয়ে বলে,
"ওস্তাদ বাস থামান!"
মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামানোতে হেল্পার ও ড্রাইভার কিছুটা বিরক্ত বটে। কিন্তু তাতে কী? এসব চিন্তা মাথায় নিলে হবে না। রিশাদের সঙ্গে দেখা করতে হবে, কথা বলতে হবে। বাস থেকে নামার পর কোনো গাড়ি দেখতে পায় না প্রিয়ু। সব চলতি বাস। কোনো বাস থামবে বলেও মনে হয় না। সিএনজি যা আসছে তা সবই ভর্তি। গাড়ির আশায় না থেকে প্রিয়ু হাঁটা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে সামনের বাস স্টপেজে চলে আসে। হয়রান হয়ে গেছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। বাস আসার পরই বাসে ওঠে পড়ে প্রিয়ু।  এইতো আর কিছু পথ। এই অল্প পথই আজ অনেক বেশি মনে হচ্ছে। শেষ হতে চাইছে না যেন।

বাজারে এসে বাস থামে। বাস থেকে নেমে প্রিয়ু রিশাদের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করে। সালাম চাচাকে কিছু না বলেই ভেতরে চলে যায়। বেশ কয়েকবার কলিংবেল বাজায়। দরজা খুলছে না রিশাদ। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। আবার কলিংবেল বাজায়। রিশাদ এসে দরজা খুলে দেয়। মাত্রই গোসল করে বেরিয়েছে। ভেজা চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে কপালে। স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। ক্লান্ত মুখেই এক গাল হাসে প্রিয়ু। 
"আপনি হঠাৎ?" জিজ্ঞেস করে রিশাদ।
রিশাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাগ দেখিয়ে প্রিয়ু বলে,
"জানেন আপনাকে আমি কত খুঁজেছি? বাড়িতে কতবার এসেছি! কোথায় গেছিলেন আপনি?"
"বিয়ে করতে।"

০৬!!
 
প্রিয়ু নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যা শুনল তা কি সত্যিই শুনল? নাকি ভুল শুনল? নিজের কানকেই এই মুহূর্তে প্রিয়ুর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা রিশাদ বিয়ে করলেই বা কী? এত কষ্ট কেন লাগছে? এটা কষ্ট নাকি খারাপ লাগা? প্রিয়ুকে চুপ থাকতে দেখে রিশাদ প্রিয়ুর চোখের সামনে তুড়ি বাজায়। প্রিয়ু আঁৎকে ওঠে। রিশাদ জিজ্ঞেস করে,
"কী হলো? হঠাৎ এমন চুপ হয়ে গেলেন যে?"
আমতা আমতা করে প্রিয়ু বলে,
"আপনি সত্যিই বিয়ে করেছেন?"
"আপনার কী মনে হয়?" ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে রিশাদ।
প্রিয়ু ঘামছে। অনবরত ঘামছে। পায়ের নিচের মাটিকেও নড়বড়ে মনে হচ্ছে। রিশাদ বলে,
"শীতের মধ্যেও দেখি ঘামছেন। আসুন ভেতরে আসুন।"

রিশাদ সরে গিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য রাস্তা করে দেয়। প্রিয়ু গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে। ওড়না দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নেয়। বসার পর বুঝতে পারে শুধু পা-ই নয় বরং পুরো শরীর কাঁপছে প্রিয়ুর। প্রিয়ুর মুখোমুখি বসে আছে রিশাদ। পানির গ্লাস প্রিয়ুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
"কী সমস্যা?"
"ক..ই? কোনো সমস্যা নেই তো।"
"তাহলে এভাবে কাঁপছেন কেন?"
"বোধ হয় শীতে!"
"আজ শীত একেবারে কম। তাছাড়া আপনি ঘামছেন। এতেই স্পষ্ট আপনি শীতে কাঁপছেন না।"

হাতের গ্লাস টেবিলের ওপর রেখে কথা এড়িয়ে প্রিয়ু বলে,
"আপনি কিন্তু বললেন না।"
"কী?"
"এইযে সত্যিই বিয়ে করেছেন কী না?"
"আপনার কী মনে হয় বললেন না তো।"
"আমার মনে হওয়া দিয়ে কী আসে যায়?"
"শুনতে চাই।"
"হেয়ালি না করে বলেন প্লিজ!"
"না।"
"কী না?"
"বিয়ে করিনি।"
মুহূর্তেই চেহারার বর্ণ পাল্টে যায় প্রিয়ুর। চোখেমুখে খুশির ছড়াছড়ি। রিশাদ বুঝতে পারে প্রিয়ুর খুশি হওয়ার পেছনে থাকা কারণটা। কিন্তু প্রিয়ু কি কাজটা ঠিক করছে? 
"তখন মিথ্যে কেন বললেন?" জিজ্ঞেস করে প্রিয়ু।
"মজা করলাম। আপনার রিয়াকশন টা দেখার জন্য।"
"আমার প্রাণটাই বুঝি বের হয়ে গেছিল।"
"কেন?"

প্রিয়ু থতমত খেয়ে যায়। কী বলতে কী বলে ফেলল এটা? এখন কী বলবে? 
"খাব! খিদে পেয়েছে আমার।"
প্রসঙ্গ পাল্টাতে খাওয়ার কথা ছাড়া আর কোনো কথা মাথায় আসলো না। এখন এই ব্যাপারেই বা রিশাদ কী ভাববে কে জানে! 
"আমি তো একটু আগেই এসেছি। রান্না করতে হবে। বাহির থেকে খাবার অর্ডার করি?"
"উম! না। আপনার হাতের রান্নাই খাব। আপনি রান্না করেন। আমি আছি।"
"ভার্সিটিতে যাবেন না?"
"না। ভার্সিটিতে গেলে আগেই যেতাম।"
"আচ্ছা। আপনি তাহলে বসেন। আমি রান্না করি।"
"শুনুন।"
"শুনছি।"
"আমি তো আপনার থেকে ছোট। তাহলে এমন আপনি আপনি করে বলেন কেন?"
"কী বলব?"
"তুমি করে বলবেন।"
"আপনি ডাকটাই সুন্দর।"
প্রিয়ু মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
"না। তুমি বলতে বলেছি আপনি আমায় তুমি করেই বলবেন।"
"আচ্ছা চেষ্টা করব।"
"চেষ্টা নয়। পারতে হবে। দেখি এখনই একবার বলুন তো।"
"কী বলব?"
"তুমি করে বলেন।"
"আপনি তুমি কী খাবেন?"
প্রিয়ু ফিক করে হেসে ফেলে। রিশাদ ইচ্ছে করেই প্রিয়ুকে হাসানোর জন্য এমন জগাখিচুড়ী বানিয়ে বলেছে। হাসুক না একটু! ভালোই তো লাগে। প্রিয়ু হাসছে। রিশাদ রান্না করতে চলে যায়। হাসি শেষ হলে প্রিয়ু একবার রান্নাঘরে উঁকি দেয়। তারপর রিশাদের বেডরুমে যায়। টেবিলের ওপর বই নাড়াচাড়া করতে গিয়ে প্রিয়ুর চুলের কাটা খুঁজে পায়। সাথে ভীষণ অবাকও হয়। রিশাদ কোথায় পেল এটা? রিশাদ রুমে এসে দেখে প্রিয়ু চুলের কাটার দিকে তাকিয়ে আছে।
"ওটা আপনারই। মুহিতদের বাড়িতে পেয়েছি। আপনাকে ফিরিয়ে দেবো দেবো করেও ভুলে গেছিলাম।"

প্রিয়ু কোমরে হাত দিয়ে বলে,
"আবার আপনি?"
"আচ্ছা স্যরি।"
"আমার সাথে কথা বলার সময় এত ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হবে না। আমায় তুমি করে বলবেন। যখন আমি ডাকব, তখন 'হ্যাঁ', 'শুনছি', 'বলেন' এসব বলবেন না। সুন্দর করে বলবেন বলো।"
"আর কিছু?"
"না। আপাতত এতেই চলবে।"
"একটা কথা জিজ্ঞেস করি?"
"হ্যাঁ।"
"গায়ে হলুদের দিন মুহিতদের বাসায় গিয়ে ঘুমিয়েছিলেন কেন?"
"আবার আপনি?"
"স্যরি। ঘুমিয়েছিলে কেন? আর আমায় কি দেখোনি?"
"বাড়িতে সৎ মায়ের জ্বালায় ঘুমাতে পারি না। একটা ফুলের বাগান আছে আমার। কয়েকটা তাজা গোলাপ চেয়েছিল সকালে মিনার মা। এজন্যই গিয়েছিলাম। আন্টি বলেছিল পরে বাসায় যেতে। ভাবলাম যে তাহলে একটু ঘুমিয়ে নিই। কিন্তু আপনাকে দেখব মানে? আপনি সেই রুমে ছিলেন?"
রিশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
"তার মানে তুমি জানোই না আমি ছিলাম? তোমার জন্যই তো আমার এত সুন্দর ঘুমটা নষ্ট হয়ে গেছিল।"
"আমি কী করেছি?"
"কী করেছ মানে? একা রুমে আমার পাশে শুয়েছিলে। যদি কেউ দেখে ফেলত? আবার ঠান্ডা হাত আমার গায়ের ওপর রেখেছ।"

শেষের কথায় প্রিয়ু লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে যায়। সেদিন কোনোকিছুই জানতো না প্রিয়ু। আজ জেনেছে তাও আবার সেই মানুষটাই জানালো যাকে ছাড়া সময়গুলো এখন কাটতেই চায় না। টিউশানির সময় রিশাদের বাড়ি থেকে বের হয় প্রিয়ু। সন্ধ্যার দিকে টিউশনি থেকে বাড়ি ফেরার সময় চায়ের দোকানে রিশাদকে দেখতে পায়। রিশাদ একা নয়। সাথে একটা মেয়েও আছে। একবার মনে হলো বাস থেকে নেমে দেখবে। পরে ভাবলো না, থাক! কালই জিজ্ঞেস করে নেবে। কিন্তু মনকে মানানো যাচ্ছে না। মেয়েটার সাথে চা খেতে খেতে হেসে কথা বলার দৃশ্যটা চোখে ভাসছে শুধু। অযথাই কষ্ট হচ্ছে। বাড়িতে ফিরে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আশা এসে জিজ্ঞেস করে,
"কীরে কী হয়েছে?"
"কিছু না।"
"মন খারাপ কেন?"
"মন খারাপ না।"
আশা প্রিয়ুর পাশে বসে বলে,
"কী লুকাচ্ছিস বল তো?"
"লুকানোর কিছু নাই।"
"আহা! বল না।"

প্রিয়ু এবার কেঁদেই ফেলে। কেন কাঁদে তা জানে না। শুধু জানে অসহ্যকর কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ করে কেঁদে ফেলায় আশা ভড়কে যায়। প্রিয়ুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
"আমায় বল কী হয়েছে?"
"আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আপু।"
"কেন বনু? মা কি বকেছে আবার?"
"না।"
"তাহলে অন্য কেউ কিছু বলেছে?"
"কেউ কিছু বলেনি।"
"তাহলে?"
"আমি রিশাদকে অন্য একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখেছি।"
"তাতে কী?"
"ওরা খুব হেসে হেসে কথা বলছিল।"

আশা এবার প্রিয়ুর মুখটা দু'হাতে তুলে ধরে। মুচকি হেসে বলে,
"আমার বোনটা কি প্রেমে পড়েছে?"
"জানি না আমি। রিশাদের সঙ্গ আমার ভালো লাগে। ও যখন আমায় হাসায় তখন আমার ভালো লাগে। ও যখন বোঝায় তখন আমার ভালো লাগে। ও যখন গান শোনায় তখন আমার ভালো লাগে। আমার মনে হয় ও আমার সুখের ঠিকানা।"
"ও জানে?"
"কী?"
"এইযে তুই ও'কে ভালোবাসিস।"
"এটাই কি ভালোবাসা?"
"তাই তো বলে মন।"
"এত অল্প পরিচয়েও ভালোবাসা হয়?"
"বোকা মেয়ে! ভালোবাসা কি সময় ধরে হয় নাকি? ভালোবাসা কারো ইচ্ছাধীন নয়। মনের অধীনে থাকে ভালোবাসা। আর মনের ওপর কারো কোনো হাত থাকে না।"
"আমি এখন কী করব?"
"সময় থাকতে ও'কে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিবি। আর পারলে কালই। এখন আয় খেয়ে ঘুমাবি।"
"খিদে নেই।"
"ভাতের ওপর রাগ করবি না একদম। চল বলছি।"
রাতের খাবার খেয়ে দু'বোন পাশাপাশি শুয়ে আছে। মাথা থেকে কিছুতেই দূর হচ্ছে না দৃশ্যটা। 
"আপু!"
"হু।"
"মেয়েটা কে হতে পারে? গার্লফ্রেন্ড?"
"বোন হতে পারে, বন্ধু হতে পারে।"
"অন্য কেউও তো হতে পারে?"
"হুম পারে। তবে কখনো নেগেটিভ কিছু ভাববি না। সবসময় পজেটিভ ভাববি।"
"এই কথাটা রিশাদও বলে।"
"তাই নাকি? কী বলেছে শুনি?"
"আমি বলেছিলাম, ছোট থেকে যখন সুখ দেখিনি। তখন আমার কপালে আর সুখ নেইও। ও বলেছিল, ভাগ্যে কী আছে আর কী নেই তা আমরা জানি না। তবে আমরা চেষ্টা করতে পারি ভালো থাকার। আর সবসময় যেটাই ভাববেন পজেটিভ ভাববেন। নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করা মানেই সেধে সেধে পেইন নেওয়া। ডিপ্রেশনে ডুব দেওয়া। পজেটিভ ভাবলে ভালো কিছুই হয়।"
"ঠিকই তো বলেছে। এখন তুইও নেগেটিভ কিছু ভাববি না। শুয়ে শুয়ে রিশাদের সাথে কাটানো ভালো ভালো মুহূর্তের কথা ভাব। দেখবি ঘুম এসে পড়বে।"
"আচ্ছা।"

---------------------------------

তিতলিদের বাড়িতে এখন খুশির আনন্দ। তিতলি বিয়েতে রাজি হয়েছে। অরণ্যর ওপর পাহাড় সম রাখা অভিমান, জেদের বশেই এই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে তিতলি। রাতে অরণ্যকে শেষবারের মতে কল করে তিতলি। অরণ্য ফোন রিসিভ করে স্বাভাবিকভাবেই বলে,
"কী খবর?"
"খুব ভালো। আমি বিয়েতে রাজি। সময়মতো ইনভাইটেশন কার্ড পাঠিয়ে দেবো। পরিবার নিয়ে চলে আসবে।"
"আমি আসলে তুমি বিয়ে করতে পারবে?"
"তুমি যদি নিজে দাঁড়িয়ে আমার বিয়ে দেখতে পারো তাহলে আমিও পারব।"
"এইতো শক্ত মনের মেয়ে!"
"তুমিই বানিয়েছ।"
"তিতলি!"
তিতলি চুপ।
"ভালো থেকো তুমি তিতলি। সুখে থেকো।"
এতটুকু বলে ফোন কেটে দেয় অরণ্্য। কান্নারা আর বাঁধা মানছে না। দু প্রান্তে বসে দুজনে চোখের পানি ফেলছে। অন্ধকার সবার থেকে আড়াল করে ফেলছে দুজনের এই নিরব কান্না।


ভার্সিটি থেকে ফিরে রিশাদের বাসায় যায় প্রিয়ু। পুরো দুটো দিন রিশাদের সাথে দেখা করেনি প্রিয়ু। ভেবেছিল এটা হয়তো ক্ষণিকের ভালোলাগা। ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় রিশাদ আর কোথায় প্রিয়ু! বামণ হয়ে আকাশের চাঁদ ধরতে চাওয়ার আশা করতে নেই। নিজের মনের সাথে এই দুটো দিন যুদ্ধ করে থাকলেও আর পারছে না। এত অসহায় প্রিয়ুর কখনো লাগেনি। রিশাদের সাথে দেখা না করে, কথা বলে নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল।
রিশাদ বাড়িতে নেই। অফিসে গেছে। আসবে সন্ধ্যার পর। সালাম চাচার থেকেই এসব ইনফরমেশন যোগার করেছে। এই সুযোগে টিউশনিগুলো করিয়ে আসে প্রিয়ু। ক্লান্ত হয়েও যায় রিশাদের বাসায়। আজকেই সব জানাতে হবে। মনের কথাগুলো আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। 
মাত্রই অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে রিশাদ। আর তখনই কলিংবেল বাজে। শরীরের আরাম করাও হয় না আর। গেট খুলে প্রিয়ুকে দেখে। প্রিয়ু বলে,
"কথা আছে কিছু।"
"ভেতরে আসো।"
ভেতরে গিয়ে দুজনে ড্রয়িংরুমে বসে। এক হাত আরেক হাতের মুঠোয় নিয়ে আঙুল ফুঁটাচ্ছে প্রিয়ু। রিশাদ সোফার সাথে হেলান দিয়ে প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ ইতস্তত করে প্রিয়ু বলে,
"আমি যা বলার সোজাসুজিভাবেই বলছি।"
রিশাদ মজা করে বলে,
"কথা বুঝি আবার আঁকাবাঁকাও হয়?"
"উফফ! সিরিয়াস আমি।"
"আচ্ছা বলো।"
"সেদিন সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে যে মেয়েটার সাথে কথা বলছিলেন সে কে?"
"কলিগ।"
"বিবাহিত?"
"না। কেন?"
"আপনার তাকে কেমন লাগে? তারই বা আপনাকে কেমন লাগে?"
"এসব প্রশ্ন কেন?"
"আমি জিজ্ঞেস করেছি। উত্তর দিন।"
"আমি তাকে কলিগ ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না।"
"আর সে?"
"তার কথা জানি না।"
"তার মানে সে আপনায় পছন্দ করে?"
রিশাদ এবার সোজা হয়ে বসে বলে,
"করতেই পারে। তাতে কী?"
"না পারে না। কেউ পছন্দ করবে না আপনাকে। কারণ..."
"কারণ?"
"কারণটা আপনি জানেন।"
"কী জানি?"
"আমি যে আপনার মায়ায় জড়িয়ে গেছি আপনি বুঝেন না?"
"বুঝি।"
"আপনাকে যে আমি ভালোবেসে ফেলেছি আপনি জানেন না?"
"জানি।"
"তাহলে সব জেনেবুঝেও অবুঝের মতো করেন কেন?"
"কারণ সম্পর্কে জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"
ভাঙা গলায় প্রিয়ু বলে,
"আপনি কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন?"
"না। কাউকেই ভালোবাসি না আমি। ভালোবাসা, রিলেশন এসব নিয়ে আমার মাথায় কোনো চিন্তাভাবনা নেই।"
"বাট আই লাভ ইউ রিশাদ!"
"ভুল কোরো না প্রিয়ু। ভুল মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পাবে।"
"আমি আমার জন্য সঠিক মানুষটাকেই বেছে নিয়েছি। আমি আপনায় ভালোবাসি। আমার আপনাকেই চাই।"
"পাগলামি করে কোনো লাভ নেই।"
"প্লিজ বোঝার চেষ্টা করেন প্লিজ!"
"খাইছ তুমি?"

বসা থেকে দাঁড়িয়ে প্রিয়ু চেঁচিয়ে বলে,
"কথা ঘুরাবেন না একদম। আমি আমার উত্তর চাই।"
"উত্তর দিয়ে দিয়েছি আমি। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি পারব না ভালোবাসতে।"
"কেন পারবেন না? আমি আপনার যোগ্য নই বলে? আমার কেউ নেই এজন্য? ঠিকই তো আছে। যেখানে পরিবারের ভালোবাসাই আমি পাই না সেখানে আপনার ভালোবাসা পাব এটা ভাবাও তো বোকামি! কোথায় আপনি আর কোথায় আমি! আমি সত্যিই বোকা সত্যি।"
 
কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় প্রিয়ু। রিশাদের ডাকও শোনেনি। রিশাদকে দেখে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে।


বাড়িতে গিয়ে মায়ের কবরের কাছে যায়। বাঁশের বেড়া ধরে কাঁদতে থাকে ইচ্ছেমতো। এত কষ্ট কেন হচ্ছে প্রিয়ু জানে না। রিশাদকে ওর চাই! না হলে প্রিয়ুর ভালো থাকা সম্ভব নয়। একদম নয়। ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়ু বলে,
"মা! কেউ আমায় ভালোবাসে না কেন? আমি কি এতই খারাপ? এতই বাজে? ও মা! আমি এত অভাগী কেন মা? আমার জীবনে কি আমি সুখের দেখা কখনোই পাব না? মা, ও মা আমি রিশাদকে চাই মা প্লিজ! প্লিজ তুমি রিশাদকে বোঝাও একটু। তুমি বললে রিশাদ আমায় ভালোবাসবে। বলবে মা? বলবে একটু ভালোবাসতে?"

কাঁধে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রিয়ু ফিরে তাকায়। আবছা অন্ধকারে আশাকে দেখতে পায়। আশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদে প্রিয়ু। ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
"রিশাদ আমায় ভালোবাসে না আপু! রিশাদ আমায় ভালোবাসে না!"
"একবার ফিরিয়ে দিয়েছে বলেই হাল ছেড়ে দিবি? তার সামনে তোর ভালোবাসা প্রমাণ কর। তাকে ছাড়া থাকতে পারবি তুই?"
"জানি না আমি! কিচ্ছু জানি না। আমি শুধু জানি, আমার রিশাদকে চাই।"

আকাশে মেঘ জমেছে। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকানোর ফলে অন্ধকার সবকিছু আলোতে পরিণত হচ্ছে। আবার সবকিছু অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। আশা ঘুমিয়ে আছে। প্রিয়ুর চোখে ঘুম নেই। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাকার অবস্থা। মাথায় ভূত ওঠেছে এখনই রিশাদের কাছে যাবে। ছোট একটা কাগজে একটা চিরকুট লিখে আশার বালিশের নিচে রাখে। রাতের অন্ধকারে একাই বেরিয়ে পড়ে প্রিয়ু। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এবার বড় বড় ফোঁটায় পড়ছে। শীতের সময়ে বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর, ঠান্ডা নিশ্চিত। এসব নিয়ে প্রিয়ুর কোনো মাথা ব্যথা নেই। রিশাদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ ফাঁকা। একটা কুকুরও পর্যন্ত নেই। একই তো শীত তারমধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে। দৃষ্টি রিশাদের ফ্ল্যাটের দিকে। সিকিউরিটি রুমে সালাম চাচা এতক্ষণ ঝিমুচ্ছিল। হঠাৎ নড়াচড়া করতে গিয়ে সামনে তাকিয়ে প্রিয়ুকে দেখে। কিন্তু অন্ধকারে দেখে চিনতে পারে না। ছাতা নিয়ে বাইরে এসে প্রিয়ুকে দেখে চমকে যায়। অবাক হয়ে বলে,
"মা! এত রাতে তুমি?"
প্রিয়ু কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে গেছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
"আমি রিশাদের কাছে যাব চাচা।"
"সকালে আসতে। এখন তো মনে হয় ঘুমায়।"
"না, আমি এখনই যাব।"

উপায় না পেয়ে তিনি রিশাদকে ফোন দেয়। রিশাদ জেগেই ছিল। ফেসবুকিং করছিল। এত রাতে সালাম চাচার ফোন পেয়ে অবাক হয়। রিসিভ করে বলে,
"বলেন চাচা।"
"নিচে আসো একটু।"
"কেন?"
"প্রিয়ু আসছে।"
"কী? এত রাতে?'
"হ্যাঁ।"
" এই মেয়ে দেখি পাগল হয়ে গেছে।" বলে দৌঁড়ে ব্যলকোনিতে আসে। প্রিয়ু এতক্ষণ ব্যলকোনির দিকেই তাকিয়ে ছিল। রিশাদের বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে। এমন পাগলামি করার কোনো মানে হয়? কল কেটে দিয়ে রিশাদ ছাতা নিয়ে নিচে নামে। প্রিয়ুর সামনে এসে দুজনের মাথায় ছাতা ধরে বলে,
"কেমন পাগল মেয়ে আপনি? শীতের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজতেছেন। আবার এত রাতে একা বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। ভয় করে না? দেশের কোনো খবর রাখেন? যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যেত?"
"ভালোবাসি রিশাদ! একটু ভালোবাসেন।" ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে প্রিয়ু।
রিশাদ কপাল চাপড়ায়। বলে,
"চলেন। বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।"
"আমি যাব না। কোথাও যাব না।" বলে রিশাদের হাত চেপে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"প্লিজ ফিরিয়ে দিবেন না আমায়। আমার কিচ্ছু চাই না। শুধু একটু ভালোবাসেন আমায়।" বলে মাটিতে বসে রিশাদের পা ধরে। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ুর হাত ধরে দাঁড় করায়। প্রিয়ুর বর্তমান কন্ডিশন বুঝতে পারে রিশাদ। তাই আর কিছু না বলে প্রিয়ুকে সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে যায়। মেয়েদের কোনো কাপড় তো রিশাদের কাছে নেই। এই ভেজা অবস্থায় থাকলে ঠান্ডা আরো বেশি লাগবে। একটা টি-শার্ট আর ট্রাউজার দিয়ে প্রিয়ুকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়। প্রিয়ুর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে। রিশাদের টি-শার্ট প্রিয়ুর হাঁটুর একটু ওপরে ছুঁই ছুঁই করে। সঙ্গে তো প্রচুর ঠিলে। ট্রাউজারও ভীষণ বড়।  রিশাদের সামনে কাকতাড়ুয়ার মতো দু'হাত করে দাঁড়িয়ে বলে,
"এটা কী? আরো দুজন ঢুকতে পারবে।"

রিশাদ হেসে ফেলে। প্রিয়ু মিথ্যে বলেনি। দুজন না হলেও একজন তো অনায়াসেই এই টি-শার্টের ভেতর প্রবেশ করতে পারবে। হাস্যকর দেখাচ্ছে। প্রিয়ু ভাবলেশহীন। চোখগুলো ঘোলা ঘোলা লাগছে। জ্বর যে আসবে তা তো শিওর। রিশাদকে হাসতে দেখেও প্রিয়ু কিছু বলে না। সোফায় গিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকে। এই বুঝি চোখের পাতায় ঘুম এসে পড়ল। ওষুধ এনে প্রিয়ুকে শুয়ে থাকতে দেখে রিশাদের মায়া হয়। জীবনে এত কষ্ট সহ্য করেও আবারও নতুন করে ভালোবেসে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখছে মেয়েটা। আচ্ছা রিশাদ কি হার মানবে কখনো প্রিয়ুর এই পাগলামি ভালোবাসার কাছে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন