!!৬৭!!
মাহা এই বাড়িতে এসেছে আজ পনেরো দিন। এই পনেরো দিনে ঘটে গিয়েছে অনেককিছু। লুবান কানাডা চলে গিয়েছে। কিন্তু যাওয়ার আগে খুবই অসভ্য একটা কাজ করে গিয়েছে সে। আল্লাহ সহায় ছিলো বলে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলো মাহা। এই তো সাতদিন আগে। সার্থক বাসায় নেই। উপরতলায় বাড়ির মানুষ বেশি একটা আসেনা। বাগান, অদ্ভুত মাছ, টিভি আর বই। এভাবে কাটছে মাহার দিন। নিভা মাঝেমধ্যে উপরে আসলে যা একটু কথা হয়। সার্থকের বিশাল একটা বইয়ের সংগ্রহশালা আছে। সেই যে মাহা সেদিন অদ্ভুত একটা প্রাণীর ছবি টানানো দেখেছিলো দেয়ালে সেই ছবিটার পাশেই দরজাটা ছিলো। তালাবদ্ধ। প্রথমদিন মাহা ছবিটায় লেখা নাম খেয়াল করতে পারেনি। দ্বিতীয়দিন সে যখন আবার দেয়ালে তাকালো ছবিটা সেখানে নেই। নিভাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো এমিলিন ছবিটা পরিষ্কার করা কালে ভেঙে ফেলেছেন। এমিলিন হলেন সেই বৃদ্ধা কাজের মহিলা। যিনি মাহার সাথে কথা বলেন নি। সার্থকের কাছে মাহা জিজ্ঞেস করেছিলো এই তালাবদ্ধ ঘরে কি আছে। সার্থক কিছু না বলেই তার হাত ধরে ঘরের সামনে নিয়ে চলে আসে। অতঃপর দরজাটা খুলে দিতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মাহা। সারাঘরের দেয়াল জুড়ে বইয়ের থাক। দেশ-বিদেশের হরেকরকম বই। ঘরের মাঝে একটা টেবিল রাখা। টেবিলের চারপাশে চারটা চেয়ার। সার্থক নিজের ঝাঁকড়া চুলে হাত চালিয়ে মন কাড়া হাসি দিয়ে বলেছিলো,
"বুঝলে মাহা। আমার বই সংগ্রহের বড় শখ। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় যে বই পছন্দ হয়েছে তাই কিনে এনেছি।"
মাহা হালকা গলায় বলেছিলো,
"বাংলায় লেখা বই আছে তো?"
"তুমি আমাকে ঠিক কি মনে করো বলোতো? কানাডায় বড় হয়েছি মানছি। তাই বলে আমি বাংলা সাহিত্য পড়বোনা?"
এদিকে আসো। ঘরের ডানদিকটায় মাহাকে টেনে নেয় সার্থক। মাহা তাকিয়ে আছে সার্থকের হাতে ধরে রাখা নিজের হাতটার দিকে। পরিচয় হলো বেশিদিন তো না। অথচ লোকটা এতো আপন করে নিলো তাকে? এই লোকটা এতো ভালো কেন! ঝাঁকড়া চুলের মানবটাকে কে বলেছিলো এতো ভালো হতে!
"এই যে ম্যাডাম দেখুন।"
শরৎচন্দ্র, বিভূতি-ভূষণ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ সবার বই সারি সারি করে রাখা সেখানে। কি যে সুন্দর লাগছে দেখতে! মাহার হাতটা ছেড়ে ঘরে থাকা বড় কাঁচের জানালাটা খুলে দিলো সার্থক। আলোর দলেরা মুহূর্তেই এসে ভিড় জমালো ঘরে। জানালার পাশে সার্থকের পাশে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিচে রাখা ফুলদানিতে পা লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মাহা। সার্থক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। মাহার ব্যথার চেয়ে বেশি লজ্জাই লাগছে। তখনো চোখমুখ কুঁচকে রেখেছে মাহা। সার্থক উদ্বিগ্ন গলায় পায়ে হাত দিয়ে বললো,
"মাহা? এই মেয়ে বেশি লেগেছে?"
মাহা তখন কি যে বলেছিলো। খেয়াল নেই। তবে লজ্জা পেয়েছিলো খুব। সার্থক কোলে করে ঘরে নিয়ে এসেছিলো তাকে। সেই থেকে মাহার অবাধ বিচরণ সেই লাইব্রেরি ঘরে। পছন্দের বইগুলো হাতে পেয়ে শোক কাটিয়ে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পায় মাহা।
!!৬৮!!
তেমনই একদিন। এক ম্লান দুপুরে ভালো লাগছিলোনা মাহার। সার্থক জরুরি কাজে হসপিটাল গিয়েছে। মাহা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে কিছু মুহূর্ত কাটালো। আগামীকাল লুবান চলে যাবে। মাহার শান্তি লাগছে খুব। লুবানের দৃষ্টি খুব জঘন্য। লাইব্রেরিতে ঢুকে শরৎচন্দ্রের "পরিণীতা" বইটা হাতে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায় মাহা। মনটা আজ বড়ই উদাস লাগছে। বাবা মারা যাওয়ার পর কবর যিয়ারত করার ভাগীদারও মাহা হতে পারেনি। নিজেকে হঠাৎ করেই নিজের কাছে নিকৃষ্ট লাগছে তার। কেমন মেয়ে! বাবার কবর পর্যন্ত যিয়ারত করা তার ভাগ্যে নেই! আকাশে কয়েকটা চড়ুই উড়ে বেড়াচ্ছে। কি যে সুন্দর লাগছে। নিচে ছোট একটা মাঠ। যদিও মানুষজন এদিকে বেশি একটা আসেনা। মাঠের পাশে একটা ছোট পুকুর। পুকুরের চারপাশে গাছপালা। হঠাৎ দরজা বন্ধ করার শব্দে ভাবনা বন্ধ হয় মাহার। তড়িৎ গতিতে পিছনে ফিরে আঁতকে উঠে মাহা। দরজা লাগিয়ে লুবান দাঁড়িয়ে। বৃহদাকার শরীর।
"আপ..আপনি!"
কালো মুখে বিদঘুটে হাসে লুবান। আস্তে আস্তে মাহার কাছে এগিয়ে আসে সে। ব্যাঙ্গ করে বলে,
"কি করবো ভাবি? আপনি তো আমার সামনে ধরা দেন না।"
"মানে?"
ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে মাহার। কি বলবে! কি ভাববে কোনো ঠাউর সে করতে পারছেনা। মাহার একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে লুবান।
"প্লিজ, আপনি...আপনি এমন করছেন কেন। আমাকে যেতে দিন।"
মাহার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। কি শব্দ তৈরি করবে ঠাউর করতে পারছেনা তার বাকযন্ত্র। মাহার পরনে সবুজ রঙা থ্রি-পিস। মাথায় উড়না। হলদে ফর্সা মুখটায় চিন্তার রেশ। মাহার হাত থেকে বইটা নিয়ে নিচে ফেলে দিলো লুবান। অতঃপর মাহার মাথা থেকে সবুজ উড়নাটা খুলে নিলো একটানে।
"এসব কি দিয়ে রাখেন ভাবি। আপনার কোঁকড়া চুলগুলো তো ভিষণ সুন্দর।"
মাহা চিৎকার করে উঠলো একবার। দ্বিতীয়বার চিৎকার করার সুযোগ পেলোনা সে। তার মুখ হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো লুবান। বিরক্তিতে চোঁ শব্দ করে বললো,
"কি যে করেন না ভাবি। আপনার নাগর তো হাসপাতালে। এখানে হাজার চিৎকার পারলেও সে আসবেনা।"
মাহা এবার কান্নাই করে দিলো। এদিকে লুবান খারাপ স্পর্শ করছে তার ঘাড়ে, শরীরে। মাহা চিৎকার করবে সে শক্তি তার নেই। মুহূর্তেই যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো মাহা। নিজের পবিত্র শরীরে অপবিত্র স্পর্শে মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। পাশে ছোট টেবিলে একটা টেবিলল্যাম্প রাখা। ধস্তাধস্তি করে লাভ হবেনা মাহা জানে। বৃহদাকার লুবানের সাথে সে কোনো ক্রমেই পারবেনা। আস্তে করে ডানহাতে তুলে নিলো টেবিলল্যাম্পটা। লুবান যখন মাহার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়াতে ব্যস্ত তখনই পিছন থেকে তার মাথায় ল্যাম্পটা দিয়ে জোরে আঘাত করলো মাহা। ভিষণ চমকে মাথার পিছনের অংশটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে একটা খারাপ গালি মাহার উদ্দেশ্যে ছুঁড়লো লুবান। মাহা ততক্ষণে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে। পিছন ফিরে দৌড়ানোর একপর্যায়ে কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেলো মাহা। তাকাতে হলোনা আর।
!!৬৯!!
মন আপনা-আপনি বুঝে গেলো লোকটা কে। আঁকড়ে ধরলো মাহা নিজের আপন মানুষটাকে। সার্থক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ। হাতে থাকা শপিং এর প্যাকেটগুলো পরে গেলো নিচে। নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করলো,
"কি হয়েছে?"
শক্ত তার কন্ঠ। মাহা কিছু বলার আগেই লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো লুবান। আর কোনো কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলোনা সার্থক। মাহাকে ছাড়িয়ে লুবানের দিকে তেড়ে গেলো সে। মুখ বরাবর ঘুষি লাগিয়ে এলোপাতাড়ি মারলো লুবানকে। লুবানের মত শক্তপোক্ত শরীরও সার্থকের শক্তির সামনে পেরে উঠছেনা। লুবান একবার মুখ খুলে বলেছিলো,
"সার্থক, একটা মেয়ের জন্য তুই তোর এতদিনের বিশ্বস্ত বন্ধুটার উপর..
আর কিছু বলার আগেই একটা ঘুষি পড়লো তার মুখে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে নিভাসহ রবার্ট, মুইংচিন, এমিলিন, পরিচারিকা কয়েকজন ছুটে এলো উপরে। নিভা ঝগড়া থামালো দুজনের। সেদিন রাতেই বাড়ি ত্যাগ করেছে লুবান। মাহা এতকিছুর পরে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলো এমিলিনের মুখের হাসি দেখে। যেখানে সবাই উদ্বিগ্ন সেখানে তিনি এতো খুশি কেন! প্রশ্নটা আজো ভাবায় মাহাকে।
_______________
মিস তাজের দেওয়া ফাইলটা অনুসন্ধান করে বারবার সিলেটের দিকেই ইঙ্গিত পেয়েছে রেজওয়ান। যদিও কাজকর্মে অনেকটা উদাসীন হয়ে উঠেছে সে। এইতো একটু আগেও প্রলয় তাকে ওয়ার্নিং দিয়েছেন। সে একমাসের সময় চেয়েছে। দীর্ঘদিনের ভালোবাসা হারিয়ে কি করে কাজ মন দিবে রেজওয়ান! এত সহজ সবকিছু!
.
.
.
চলবে.......................