আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

আড়ালে আবডালে - অন্তিম পর্ব ২৫ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


৪৯!!

ভোরের আলো ফুঁটতে চলল। প্রতিদিনকার মতো সূর্য উদয় হয় আবার অস্তও যায়। শুধু মানুষের জীবনের পরিবর্তনগুলোই ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। কখনো রক্তিম আভায় রাঙায়িত আবার কখনো ঘন মেঘ বর্ষণের আবর্তিত রূপ। বিছানায় এসে বসতেই চিন্তায়, অস্থিরতায় ক্লান্তিরা চোখে ঘুম নিয়ে এসেছিল আমানের। কখন যে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়েছে সেটা বুঝতেও পারেনি। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কানে প্রবেশ করতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। মাথা ঝিম ধরে আছে। নিহির কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। কান্নারা দলা পাকিয়ে আটকে থাকে গলায়। এভাবে বসে থাকলে চলবে না। খুঁজতে হবে নিহিকে৷ বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার লাগে। পূণরায় বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করে আগে। তারপর মিটমিট করে চোখ মেলে তাকায়। জুতা পরতে গিয়ে দেখে একটা আছে, আরেকটা নেই। পরক্ষণে মনে হলো গতকাল রাতে জুতা খুলতে গিয়ে ঠেলে খাটের নিচে ছুঁড়ে মেরেছে। অলসতায় আনাও হয়নি৷ ফ্লোরে বসে জুতা আনতে হাত বাড়ায়। খাটের শেষ প্রান্তে জুতো। হামাগুড়ির মতো করে খাটের নিচে ঢুকতেই দেখতে পায় পাপোশ বিছানো। খাটের নিচে কেন পাপোশ থাকবে? হয়তো পুরান পাপোশ! মাথা আর না ঘামিয়ে জুতার জন্য হাত বাড়াতেই হাতের সাথে পাপোশ লেগে পাপোশটা সরে যায়। তখন আবছা আবছা একটা ঢাকনার মতো কিছু স্পষ্ট হয়।

পকেট থেকে ফোন বের করে টর্চ অন করে। আসলেই একটা সিমেন্টের একটা ঢাকনার মতো স্তুপ। কিন্তু এটার নিচে কী? এই রুমে সচারাচর কারো আসা হয় না। রুমের দরজা খোলাই থাকে সবসময়। বাড়ির কারো এই রুমে আসার দরকার হয় না। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ঘর রয়েছে। আমান এখানে থাকে না বলে ওর রুমটা লক করা। অনলের সঙ্গে থাকতেও ইচ্ছে হচ্ছিল না বলে এই রুমে এসে শোয় আমান। মেহমানদের থাকার জন্য এই রুম ছাড়াও আরো তিনটা রুম আছে৷ অনেকেরই আছে একা থাকার অভ্যাস৷ তখন মেহমানদের মধ্যে কেউ কেউ এই রুমে এসে রাতে থাকে। তবে সেটাও খুব কম। রুমটা একদম শেষ প্রান্তে। এখানে কারো আসা-যাওয়া হয় না বললেই চলে। সব হিসেব মিলিয়ে আরো কৌতুহলী হয়ে পড়ে আমান। আস্তেধীরে ঢাকনাটি সরায়। তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি সুরঙ্গ পথ সঙ্গে একটি মই। নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমান মই বেয়ে নিচে নামে। অন্ধকার পুরো জায়গাটিতে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাটির ওপর পা রাখতেই মনে হলো পায়ের ওপর দিয়ে কিছু দৌঁড়ে গেল। চিল্লাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো সে। চারপাশ ঘুরে তাকাতে এক জায়গায় আলোর সন্ধান মিললো। সেদিকেই এগিয়ে যায় আমান। নিজেদের বাড়ির নিচে এমন একটা জায়গা! বিশ্বাসই করতে পারছে না। এই বাড়িটা বানানো হয়েছিল মায়ের পছন্দমতো। মা কি কখনো দেখেনি এই সুড়ঙ্গ? আলোর কাছে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। থমকে যায় সামনে তাকিয়ে।

কাঁচের তৈরি ছোট একটা ঘরে নিহিকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। কাৎ হয়ে চোখ বুজে আছে। মুখও বাঁধা। আমানের বুক কেঁপে ওঠে। সামনে এগিয়ে গিয়ে কাঁচের ওপর আঘাত করে নিহিকে ডাকে। আমানের কণ্ঠস্বর সেই ঘরে প্রবেশ করে না।
"ডেকে লাভ নেই। ঘরটা সাউন্ডপ্রুফ।"

আমান পিছনে ফিরে তাকায়। লিসাকে দেখে চমকে যায়। এখানে লিসা আসলো কীভাবে? আমান জিজ্ঞেস করে,
"তুমি অনলের ফ্রেন্ড না?"
লিসা শব্দ করে হেসে বলে,
"হ্যাঁ।"

এরপরই পেছন থেকে একজন আমানের মাথায় আঘাত করে। ঝাপসা হয়ে আসে তার চোখজোড়া। মাথা ফেঁটে রক্ত বের হয়। মাথা চেপে ধরে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। নিহি চোখ মেলে তাকায় তখন। দেখতে পায় আমানকে একজন টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে আর ফ্লোরে ছাঁপ রয়ে যাচ্ছে লাল টকটকে তাজা রক্তের। নিহি কেঁদে ফেলে। কিছু বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে কষ্টে।

মিনিট দশেক পর অনামিকা আসে। লিসাকে জিজ্ঞেস করে,
"ওর ব্যবস্থা করেছ?
উত্তরে লিসা বলে,
"মাথায় বারি মারা হয়েছে।অজ্ঞান আছে এখন।"
"খাটের নিচে ওকে ঢুকতে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। নিহিকে দুর্বল করার জন্য বলেছিলাম আমানকেও মেরে ফেলব। আমার উদ্দেশ্য ছিল শুধু নিহিকে মারা।নিহিকে মারলেই আমান পাগল হয়ে যেত।দেউলিয়া হয়ে ঘুরে বেড়াতো বন-জঙ্গলে। কিন্তু তা আর হলো কই! ভেবেছিলাম শুধু পাগলই বানাবো। এখন মনে হচ্ছে ওকেও পথ থেকে সরাতে হবে। যাই হোক, তুমি বাসায় যাও এখন। পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাগান দিয়ে যাবে।"
"আচ্ছা।"
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে বললেন,
"নজর রেখো ওদের ওপর।"
"ওকে বস।"


বিধ্বস্ত অবস্থায় উপমাকে যেই বাড়িতে আটকে রেখেছে সেই বাড়িতে আসে অনল। দরজায় নক করে। ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে রেখেছে উপমা৷
"কে?" জিজ্ঞেস করে উপমা।
"আমি অনল। দরজাটা খোলো।"
সঙ্গে সঙ্গে উপমা দরজা খুলে দেয়। অনলের চেহারায় চিন্তিত ভাব। পূণরায় উপমা জিজ্ঞেস করে,
"কী হয়েছে?"
অনল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল,
"নিহিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তোমার কি কোনোভাবে কাউকে সন্দেহ হয়? কে নিহিকে তুলে নিয়ে যেতে পারে!"

উপমা ঘাবড়ে যায়। সামিয়া নিহির জন্য ক্ষতিকর ছিল। কিন্তু সামিয়া তো এখন আর বেঁচে নেই। তাহলে নিহির নতুন শত্রু কে? নাকি অনলই নিহিকে আটকে রেখে কোনো নতুন নাটক করছে! সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনলকে পর্যবেক্ষণ করে উপমা। ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,
"আপনি নিহিকে আটকে রেখে নাটক করছেন না তো?"
"বোকার মতো কথা বোলো না! আমি কেন নিহিকে আটকে রাখব? এমন কোনো ইচ্ছে থাকলে আরো আগেই তুলে নিয়ে যেতে পারতাম।"
"তাহলে কে নিহিকে কিডন্যাপ করবে? আর কে আছে নিহির শত্রু?"
"আমি জানিনা!"

উপমা চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ ভাবলো। এই মুহুর্তে দুটো মানুষকে সন্দেহের তালিকায় রাখা যায়। ১. লিসা এবং ২.সুমাইয়া। শুরু থেকেই নিহিকে সহ্য করতে পারে না লিসা। তাই এই কাজটা ও করলেও করতে পারে। আর বাকি রইল সুমাইয়া। হতে পারে সুমাইয়া কোনোভাবে জানতে পেরেছে সামিয়াকে খুন অনলই করিয়েছে। আর তাই প্রতিশোধ নিতে নিহির ক্ষতি করতে চাচ্ছে। নিজের মনে নিজেই যুক্তি মেলানোর চেষ্টা করছে। কোথাও কোনো ভুল বা কমতি রয়েছে ভেবে নিজের সন্দেহের তালিকার দুজনের কথাই উপমা অনলকে জানায়।

উপমার কথাগুলো একদম ফেলে দেওয়ার মতো মনে হয়নি অনলের কাছে। তবে সুমাইয়ার সত্যটা জানার সম্ভাবনা খুব কম। লিসাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পথ নেই। তাই লিসাই এখন নেক্সট টার্গেট। যদি ও সত্যিই কিছু করে থাকে তাহলে ওর থেকেই সবটা জানা যাবে। অনল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে উপমাকে বলল,
"চলো।"
"কোথায়?"
"তোমার বাড়িতে।"
"ছেড়ে দিচ্ছেন?"
"হ্যাঁ।"
"যদি আমি সত্যিটা সবাইকে বলে দেই?"

অনল হাসলো। মনে হচ্ছে উপমা কোনো জোক্স শুনিয়েছে। হাসতে হাসতে অনল বলে,
"মুখে বললে তো অনেক কিছুই বলা যায়। এই যেমন ধরো, আমি যদি বলি সামিয়াকে তুমি খুন করেছ। তাহলে কি এটা সত্যি হয়ে যাবে? এর জন্য দরকার প্রমাণ। না, তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে। আর না আমার কাছে। বাড়িতে জানতে চাইলে বলবে, কারা তোমায় তুলে নিয়ে গিয়েছিল তা তুমি জানো না। আর সুযোগ পেয়ে আজ পালিয়ে গিয়েছ। এখন চলো।"

উপমা বুঝতে পারল অনলের বুদ্ধির সাথে উপমার মতো সাধারণ মেয়ে পেরে উঠতে পারবে না। একটা কালো কাপড় দিয়ে উপমার চোখ বেঁধে দিলো অনল। বলল,
"আমি এখন কলেজে যাচ্ছি। লিসা, সুমাইয়া দুজনের সাথেই কথা বলব। যদি কোনো ক্লু পাই তাহলে তোমায় জানাবো। কোনো কাজে তোমার হেল্পও লাগতে পারে আমার।"
"একটা কথা বলি?"
"হু।"
"আমি যাই, আপনার সাথে। আমি গাড়িতে থাকব। আপনি ওদের সঙ্গে দেখা করবেন। যদি কিছু জানতে পারেন তাহলে আমরা দুজনে মিলেই যাব নিহিকে আনতে। নিহির বিপদে আমি ওর পাশে থাকতে চাই।"
"আর যদি কিছু জানতে না পারি? বা আমাদের ধারণা মিথ্যা হয়?"
"তাহলে তখন আমি বাড়িতে ফিরে যাব।"
"ঠিকাছে। চলো।"

অনল উপমা এবং আরো কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে বের হলো।
________________

ক্ষুধায় পেটের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে নিহির। পানির জন্য ছটফট করছে। চিন্তা হচ্ছে আমানের জন্য। ওরা কি আমানকে মেরে ফেলল? চোখের সামনে নিরবের রক্তাক্ত দেহটা ভেসে ওঠে। চোখ ফেঁটে পানি চলে আসে। আমানের সাথেও কি ওরা এরকমটাই করবে? ভাবতে পারছে না নিহি। এরচেয়ে মৃত্যু ভালো। অনেক বেশি ভালো। এতো কষ্ট, প্রিয় মানুষ হারানোর দৃশ্য আর সহ্য করতে পারবে না। উপমারই বা কী খবর? ওকে কি ফিরে পাওয়া গেছে? বাড়ির সবাই কেমন আছে? ভালো আছে তো? ওদের আবার কোনো ক্ষতি হবে কী! প্রশ্নরা আর চিন্তা মাথার ভেতর এঁটে বসেছে। মাথা ভারী হয়ে আছে যন্ত্রণায়।

তখন দরজার লক খোলে ছেলেটি। এক হাতে খাবার আর অন্য হাতে পানির গ্লাস। ফ্লোরে প্লেট আর পানির গ্লাস রেখে হাতের বাঁধন খোলে। তাড়াতাড়ি পানির গ্লাসটা নিয়ে নিহি পানি পান করে। আমানের কথা মনে পড়তেই গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে ভেঙে যায়। ছেলেটি রেগে গিয়ে গালিগালাজ করে নিহিকে। তারপর কাঁচের টুকরো গুলো তোলা শুরু করে। এ খাবার নিহির মুখে রুচবে না। খাবার খাবে না জানিয়ে দেয় নিহি। আবারও হাতের বাঁধন লাগিয়ে ছেলেটি রাগ দেখিয়ে গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে যায়।

নিহি বাঁকা চোখে চারপাশটা দেখে। কোথায় কী আছে লক্ষ্য করে। একটা শেষ চেষ্টা করতে হবে। এভাবে মৃত্যু বা পরাজয় মেনে নিলে চলবে না। অন্তত আমানের জন্য হলেও কিছু করতেই হবে।

"কী ডিয়ার? খাবার খাওনি শুনলাম।"

নিহি দরজার দিকে তাকায়। অনামিকা রহমান এসেছেন। চারদিকে শুনশান নিরবতা। তিনি সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিহির উসকো-খুশকো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দেন। নিহি নিশ্চুপ রয়েছে।তিনি বলেন,
"খাবারের সাথে রাগ করে লাভ কী বলো? আজকেই তোমার জীবনের শেষ দিন। শেষ খাবারটা খাওয়া উচিত তোমার।"

নিহি এবার নড়াচড়া করে। কিছু বলতে চাইছে। তিনি সামনে বসে বলেন,
"কিছু বলবে?"
নিহি উপরনিচ মাথা নাড়ায়। তিনি মুখের বাঁধন খুলে দিতেই আগে প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় নিহি৷ একটু হাঁপিয়ে বলে,
"আমি শেষবারের মতো আমানকে একবার দেখতে চাই।"
"ওহো হো! ভালোবাসার মানুষটিকেই শেষমেশ দেখতে মন চাইলো? তোমার যখন ইচ্ছে হয়েছে তখন অবশ্যই ইচ্ছে পূরণ করব।"

তিনি ঐ ছেলেটিকে ডেকে বললেন,
"আমানের ঘরের লক খোলো।আমি নিহিকে নিয়ে আসছি।"

তারপর তিনি নিজেই নিহির হাতের বাঁধন খুলে দেন। রুমের ভেতর দুজন একা। সুড়ঙ্গ ঘরে কেউ নেই এখন। রাতে আসবে সবাই। এই সুযোগ। যদি কিছু করতে হয় তাহলে আজ এবং এখনই করতে হবে। ঘরও ভেতর থেকে লক করা। কাঁচ যে ভাঙবে এমন শক্তি কারো নেই। এই কাঁচ ভাঙবেও না। নিহি তখন ইচ্ছে করেই কাঁচের গ্লাসটা ভেঙেছিল এবং অতি গোপনে সরু একটা কাঁচের টুকরো হাতে লুকিয়ে রেখেছিল।

ছেলেটি চলে যেতে যেতে নিহির হাতের বাঁধন খোলা প্রায় শেষ। তিনি বলেন,
"ভুলেও এখান থেকে পালানোর চেষ্টা কোরো না। সব পথ বন্ধ।"

নিহি কিছু বলে না। চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে নিরবের মুখটা কল্পনায় দেখে নেয়। আমানের রক্তাত দেহ টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কষ্টগুলো এখন সব রাগ আর ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। হাতের মুঠোয় থাকা কাঁচের টুকরাটি চেপে ধরে। সরু বলে খুব সহজেই কাঁচটি হাতে ঢুকে যায়। চোখ খুলে গোপনে কাঁচটি হাতের তালু থেকে বেরও করে নেয়। অনামিকা রহমান যখন দরজার লক খুলতে যান তখনই পেছন থেকে তার মুখ চেপে ধরে কাঁচের টুকরো গলায় ঢুকিয়ে দেয় নিহি। তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন কিছুক্ষণের জন্য। চিৎকারও দিতে পারেন না।গলা থেকে কাঁচের টুকরোটি বের করে দুইচোখেও ঢুকায়। এবার তিনি ফ্লোরে বসে পড়েন। চিৎকার করেন। কিন্তু তার চিৎকারের শব্দ বাইরে প্রবেশ করে না। ছটফট করতে শুরু করেন। দপরাচ্ছেন। নিহির শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে কিছুটা। সময় নষ্ট না করে যেই রশি দিয়ে নিহিকে বেঁধেছিল সেই রশি দিয়েই তাকে বেঁধে ফেলে। নিহির ওড়না দিয়ে মুখ বেঁধে সেখান থেকে বের হয়। ঘর থেকে বের হতেই বাইরেই রাম দা দেখতে পায়। নিহি এখন আর নিজের মাঝে নেই। অনন্য রণচণ্ডী রূপ আজ তার মাঝে। সেই রাম দা নিয়েই আমানকে যেদিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই ঘরের দিকে যায়।

চোখ বন্ধ অবস্থায় বাঁ দিকে কাৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে আছে আমান। ওর হাত-পা'ও রশি দিয়ে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা। চুলে, কপালে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আর ঐ ছেলেটি আয়েশ করে বসে আছে আমানের চেয়ারের সামনের চেয়ারটিতে। আস্তেধীরে পা ফেলে নিহি এগিয়ে যায়। ছেলেটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোপ দেয় মাথায়। নিহিকে পাল্টা আঘাত করার পথ প্রথমেই বন্ধ করে নেয়। ইচ্ছেমতো কোপাতে কোপাতে শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। কোপ দিতে দিতে আর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"তুই-ই তো নিরবের পেটে ছুরি ঢুকিয়েছিলি না? তুই তো নিরবকে মেরে ফেলেছিস। তোকে তো আমি ছাড়ব না৷ কোনোভাবেই না।"

দেহ থেকে প্রাণ যেতেই ছেলেটির দপরানো থেমে যায়। ক্ষান্ত হয়ে থামে তখন নিহিও।
আমানের এখনো কোনো হুশ নেই। রক্তে একাকার পুরো ঘর। অনেক রক্ত আমান আর নিহির গায়েও ছিটে গেছে। এরপর রাম দা নিয়ে অনামিকার কাছে ফিরে আসে। নিরবের খুনি তিনি। নিহিকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। এমনকি আমানকেও! এই মহিলার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তখনই পেট বরাবর কোপ দেয় তার। গলগল করে রক্ত বের হয় পেট থেকে। বাঁচার জন্য ছটফট করেন। নিহি বলে,
"মৃত্যু আপনার হাতে আমার নয়। আমার হাতে আপনার মৃত্যু ছিল। আপনার মতো ছলনাময়ী, নিকৃষ্ট মহিলার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।"

অনামিকা রহমানকে কোপানো অবস্থায় ভেতরে আসে অনল এবং উপমা। লিসার কথায় লিসাকেই ফাঁসিয়ে ওরা সবটা জেনেছে। আর সময় বিলম্ব না করে ছুটে এসেছে। নিজের মাকে খুন করা অবস্থায় নিহিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় অনল। কী বলবে,কী করবে, কী করা উচিত তা এখন অনলের মাথায় ঢুকছে না।লিসার মুখে শুনেছে নিজের মায়ের অপকর্মের কথা। তবুও মনের কোথায় যেন একটা হাহাকার! উপমা দৌঁড়ে এসে নিহিকে টেনে সেখান থেকে সরায়। অনল মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তখনই কানে ভেসে ওঠে লিসার কথাগুলো। নিজের স্বার্থে তিনি আজমল আহমেদকেও খুন করেছেন। আমান, অনলের বাবা অনামিকার সব সত্যিটা জানতে পেরেছিলেন বলে তাকেও জীবন দিতে হয়েছে। অনল যখন বারবার জানতে চেয়েছিল, আব্বু কোথায় তখন তিনি বলেছেন অফিসের কাজে বাইরে গেছে। ব্যস্ত বলে ফোনও দিতে পারেন না। যেই মহিলা নিজের স্বার্থের জন্য স্বামীকে খুন করতে পারে সেই মহিলা তো নিজের সন্তানদেরও খুন করতে পারবে। তার তো বেঁচে থাকার অধিকার নেই। একদম না!
নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় অনল।

নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
"ভাইয়া কোথায়?"
নিহি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। কোনো কথা বলছে না। অনল আবারও জিজ্ঞেস করে,
"ভাইয়া কোথায়?"
নিহি তখন দৌঁড়ে আমানের কাছে যায়। পিছু পিছু উপমা আর অনলও আসে। নিহি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমানকে ডাকে। আমানের কোনো সাড়াশব্দ নেই। অনল নাকের কাছে হাত নিয়ে বলে,
"কিছু হয়নি। প্রাণ আছে। সেন্স নেই ভাইয়ার। তাড়াতাড়ি ভাইয়াকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে।"

অনল উপমাকে বলে,
"লিসা বলেছিল পেছনের দিকে একটা দরজা আছে। বাগানের মাঝ দিয়ে যেতে হয়। আমি গাড়ি নিয়ে আমার লোকদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি নিহি আর ভাইয়াকে নিয়ে এখনই যাও।"
"আর আপনি? আপনি তো পুলিশকে ইনফর্ম করবেন বলেছিলেন। করেছিলেন কী? তারা তো তাহলে এখনই চলে আসবে। আপনিও চলুন।"
"না। তোমরা যাও। পুলিশ যেকোনো সময় এসে পড়বে।"
"আসুক!" বলল নিহি।
অশ্রুশিক্ত দৃষ্টি মেলে অনলের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
"আসতে দিন। আমি খুনী। আমার শাস্তি তো হতেই হবে।"
"পাগলামি কোরো না নিহি। আমি লিসার মুখে সব শুনেছি। তোমার ওপর কোনো অভিযোগ রাখব না আমি। প্লিজ চলে যাও।"
"তাহলে আপনিও চলেন। আপনি কেন এখানে থাকবেন?"
"কথা বাড়িও না৷ প্লিজ যাও।"

অনল এর মাঝে একজনকে ফোন করে ভেতরে আনে। তাকে বলে আমানকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু নিহি কিছুতেই যেতে রাজি নয়। সে পুলিশের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করতে প্রস্তুত। নিরবের খুনের প্রতিশোধ এবং আমানকে বাঁচাতেই এই খুন করতে হয়েছে নিহির। নিহিকে ওর সিদ্ধান্ত থেকে যখন কোনোভাবেই টলানো যাচ্ছিল না তখন অনল বলে,
"নিহি প্লিজ! তুমি ভাইয়াকে বাঁচাতে খুন করেছো। ভাইয়া এটা জানলে বা তোমার ফাঁসি হলে ভাইয়া বাঁচবে না। যদি ভাইয়াকে মেরেই ফেলতে চাও তাহলে কেন বাঁচালে? আম্মুর হাতে দুজনই মরতে!"
"আপনি আমার কথা বুঝতে..."
"কিচ্ছু বোঝার সময় নেই এখন। যাও!"

"উপমা ওকে নিয়ে যাও প্লিজ!" উপমার দিকে তাকিয়ে বলল অনল।
উপমা নিহিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিহি ঝাপসা দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে অনলের দিকে তাকায়। অনলের চোখে পানি টলমল করছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি৷ সেই হাসি নিহিকে বিষাদিত করছে। বিষাদ! বিষাদ! বিষাদ!

৫০!!

শীতের সকাল। কুয়াশার আড়ালে সূর্যের রক্তিম আভা। দেখতে অনেকটা ডিমের কুসুমের মতো লাগছে। শীতল বাতাস শরীরকে সিথিল করে দিচ্ছে। উত্তরে হাওয়া জানালার গ্রিলের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে প্রবেশ করছে। থাই গ্লাস খুলে রাখায় ঠান্ডা বাতাসের ঘরে প্রবেশ করার দুঃসাহস হয়েছে। আর এই দুঃসাহস দিয়েছে নিহি।

কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে রুটি বেলতে ব্যস্ত নিহি। কখন থেকে আমানকে ডাকছে। কিন্তু শীতের অলসতা থেকে আমান বের হতে পারছে না। যতবার ডাকে ততবার একই কথা। 'আরেকটু ঘুমাই!' এই আরেকটু ঘুমাই আরেকটু ঘুমাই বলতে বলতে এক ঘণ্টা পার হতে চলল। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে না এখন আর উঠবে বলে। আজ বোধ হয় অফিসও কামাই দেবে। দিনদিন অফিসে যেতেও তার বড্ড আলসেমি। তার অবশ্য কারণও আছে। আগে তাকে একা সামলাতে হতো পুরো অফিস। আর এখন সাহায্যর হাত যে আছে সাথে।

ঠান্ডা বাতাসের ফলে কাঁপুনী বেড়ে যাচ্ছে আমানের। লেপের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে আঁটসাঁট হয়ে শোয়। এখন মনে হচ্ছে বাতাসের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু জানালা দিয়ে তো এতো বাতাস আসার কথা নয়। লেপের ভেতর থেকে মাথা একটু বের করতেই পুরো ঘর বরফের মতো ঠান্ডা অনুভূত হয়৷ ওপরে তাকিয়ে রীতিমতো অবাক৷ ফ্যান ছেড়ে দিয়ে গেছে নিহি! ফ্যান বন্ধ করার জন্য হলেও এখন আমানকে বিছানা থেকে উঠতে হবে। ঠোঁট কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে একটু জোরে চেঁচিয়ে বলে,
"নিহুপাখি, ফ্যানটা অফ করে দাও না প্লিজ! সত্যি বলছি আর বেশিক্ষণ ঘুমাবো না। আর দশ মিনিট।"

রান্নাঘর থেকে আমানের কথা শুনেও না শোনার ভান ধরে রইল নিহি। অগত্যা আমানকে উঠতেই হলো। রান্নাঘরে উঁকি দিতেই শয়তানি বুদ্ধি মাথায় আঁটে। প্যান্টের পকেটে দু'হাত ঢুকিয়ে হেলতে দুলতে রান্নাঘরে প্রবেশ করে। নিহির পাশেই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়৷ নিহি একবার তাকিয়ে আবার রুটি বানানোতে মন দেয়। আমান বলে,
"আমি হেল্প করি?"
"তার কোনো দরকার নেই। ফ্রেশ হতে যাও।"
"না বললে হয় নাকি? একটু তো হেল্প করা দরকার।"
"হু, তোমার হেল্প সম্পর্কে ধারণা আছে আমার। শুধু শুধু কাজ বাড়াবে।"

বাটি থেকে আটার গুঁড়ি নিয়ে নিহির কোমরে লাগিয়ে দিয়েই দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে আমান চলে যায়। নিহি কতক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর রান্নাঘর থেকেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে। আমান বেডরুমে গিয়ে ফ্যান বন্ধ করে আবারও শুয়ে পড়ে। আর নিহির গালি শুনে হাসতে থাকে।


অফিসে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে অনল। গায়ে জ্বর। শীতের মধ্যে রাত করে গোসল করায় এই জ্বরটা বাড়িয়েছে। এমনিতে তো ঠান্ডা লাগছিলোই। জ্বরের কারণে আরও বেশি ঠান্ডা লাগছে। বমি দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে আছে। টক টক লাগছে গলার মাঝে। বমিটা হয়ে গেলে একটু শান্তি লাগতো। কিন্তু এখন সেটাও হচ্ছে না। পরক্ষণেই ভাবলো এই অল্পস্বল্প জ্বর আসলে কিছুই না। সুস্থতা, অসুস্থতা সবই এখন শুধু নিজের কাছে। চোখ বন্ধ করে কপালের ওপর হাত রেখে ডুবে যায় অতীতের সেই দিনটাতে। উপমা, নিহি, আমানকে সেদিন হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে লিসার কাছে যায় অনল। অনলের বাকি লোকেরা লিসাকে আটকে রেখেছিল। অনল লিসাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিল। অনলের হাতে খুন হবে নাকি খুনের সব দায় নিজের ঘাড়ে নেবে। তৎক্ষনাৎ জীবনের মায়া ছিল লিসার। রাজি হয়ে যায় লিসা। মূলত লিসা রাজি হওয়ার পরই অনল পুলিশকে ইনফর্ম করে। মায়ের খুনি সাজায় লিসাকে। বাড়ির নিচের সুড়ঙ্গপথের আস্তানাটাকে লুকায়িতই রাখে। অনামিকা রহমানকে খুন করার দায়ে লিসার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। সেই ঘটনার আজ দুই বছর হতে চলল। এই দুই বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। আমানের সঙ্গে অনলের সম্পর্ক ঠিক হয়েছে। ভাই-ভাই মিলে গেছে। নিহির সঙ্গে হয়েছে বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক। অনল খেয়াল করেছে, এখনো অনলের মুখোমুখি হলে নিহির অস্বস্তিতে পড়া চেহারাটি। এই অস্বস্তির কারণ দুটো হতে পারে। এক. অতীতে অনলের করা বিশ্বাসঘাতকতা আর দুই.নিহিকে মায়ের খুন করতে দেখা।

অস্বস্তিতে নিহিকে খুব একটা পড়তে দেয় না অনল। সত্যি বলতে আমানের সঙ্গে নিহিকে দেখলে বুকের ভেতর চিনচিন করা সেই ব্যথাটা এখনো জেগে ওঠে। সহ্য করতে কষ্ট হয়। তার কারণ! তার কারণ, আজও যে আড়ালে-আবডালে শুধু নিহিকেই ভালোবাসে। অস্বস্তি থেকে নিহিকে দূরে রাখা এবং নিজেকে কষ্ট থেকে দূরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করতেই দু'ভাই আলাদা বাড়িতে থাকে। আগের বাড়িটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে আমান এবং অনল। অফিসে আসলে আমানের সঙ্গে দেখা হয়। নিহির সঙ্গে দেখা হয় না বললেই চলে। বলা যায়, অনল নিজেই চায় না। মাঝে মাঝে নিজেকে বড়ো একা লাগে তার। একাকিত্বরা ঘিরে ধরে। মরে যেতে ইচ্ছে করে তখন। কিন্তু মৃত্যু কি আর এতো সহজ? চাইলেই পাওয়া যায়?

চোখ মেলে বড়ো করে শ্বাস নেয় অনল। চোখের কার্ণিশে হাত দিয়ে দেখে অশ্রুকণা জমা হয়েছে। মৃদু হাসলো সে। দরজায় নক করছে তার পি.এ নীরা। অনল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
"আসুন।"

নীরা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একটা ফাইল রাখলো টেবিলের ওপর। অনলের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে যায়। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
"আপনার চোখমুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? আপনি ঠিক আছেন?"

অনল সোজা হয়ে বসে ফাইল ঘাটতে ঘাটতে বলল,
"একটু জ্বর এসেছে।"
তৎক্ষণাৎ নীরা অনলের কপালে হাত রেখে জ্বর মাপতে গেলে অনল সরে গেল। নীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
"নিজের লিমিট ক্রস করবেন না।"
অনলের কথায় অপমানিত অনুভব করে নীরা। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপমানে চোখমুখের বর্ণ পাল্টে গেছে। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলে,
"আ'ম স্যরি স্যার। ফাইলটা দেখে রাখবেন। আমি আসছি।"

নীরা দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে। সে চলে যেতেই ফাইল রেখে অনল আবার চেয়ারে মাথা ঢেকিয়ে বসলো। অস্বস্তি হচ্ছে খুব। নীরা মেয়েটাকে কিছু বলা যায় না৷ একটু ধমক দিলেই গাঢ় কাজল কালো চোখ জোড়ায় বর্ষার আগমণ হয়। কখনো কান্না আটকে রাখতে পারে তো কখনো আবার পারে না। এই মেয়েটা কষ্ট পেলে কেন জানি অনলের নিজেরও খারাপ লাগে। তবে এই খারাপ লাগার অন্য একটা কারণ আছে। এই কারণটাই যথেষ্ট অনলকে কাবু করতে। নিহির সাথে নীরা মেয়েটার অনেক মিল রয়েছে। চোখ আর চুলগুলো একদম পাল্টানো যাবে। স্বভাবও নিহির মতো। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, নীরাও একদিন নিহির মতো ভিম সাবান দিয়ে আপেল ধুয়ে দিয়েছিল। মূলত সেদিন থেকেই নীরাকে চোখে পড়েছে অনলের। আর নীরা যে কখন অনলের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে বুঝতেও পারেনি। কখনো বলতে পারবে নাকি সেটাও নীরা জানে না।

শরীরটা আরো বেশি খারাপ লাগছে। বিশ্রাম না নিয়ে উপায় নেই এখন। ফাইল না দেখেই বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য বের হয় অনল।

শিশির ভেজা ঘাসের ওপর পা ডুবিয়ে একসঙ্গে হাঁটছে নিহি, উপমা আর দীপ্ত। তিনজন আবারও একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। পুরনো বন্ধুত্বের আড্ডায় প্রাণ ফিরে এসেছে। সংসার, ভার্সিটি দুটোই সামলাচ্ছে নিহি। সংসার বলতে আর তেমন কী! টুকটুকি আর আবুল তো আছেই। নিহি শুধু ওদের সঙ্গে টুকটাক কাজ করে।

ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে নিহি একবার বাবার বাড়িতে যায়। বাড়িটায় এখন আর বাবা নেই। কষ্ট হয় খুব। বাবার কাছে চাওয়া শেষ ইচ্ছেটাও আর বলা হলো না। একটাবার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলা হলো না ভালোবাসি! নিষ্ঠুরের মতো একা করে চলে গেল। বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে কলিংবেল বাজালো। দরজা খুলে দিলো তিতির। নিহিকে দেখেই ফুপি ফুপি বলে জড়িয়ে ধরে। তিতিরকে কোলে নিয়ে চুমু খায় নিহি। ভেতরে গিয়ে দরজা লক করে সালেহা বেগমকে ডাকে।
"আম্মু!"

সালেহা বেগম ঘর থেকে বের হোন। এক গাল হেসে নিহিকে জড়িয়ে ধরে প্রাণভরে আদর করে দেন। সমস্ত মুখে চুমু খেয়ে বলেন,
"আমার ছোটো আম্মাজান!"
মাকে দেখলে কষ্ট হয় খুব। বাবার কথা তখন আরও বেশি করেই মনে পড়ে। নিহি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
"আচ্ছা আম্মু তুমি আমার বাসায় আসো না কেন?"
"কোথাও যেতে ভালো লাগে না রে মা।"
"আমায় দেখতেও ইচ্ছে হয় না?"
"হয় তো! তখন তো আমার মা আমার কাছে চলেই আসে।"
"হুম বুঝলাম। আমার সাথে চলো। কয়টাদিন আমার কাছে থাকবে।"
"না রে, মা। আজ নয়। অন্য একদিন যাব।"
"তোমার অন্য একদিনটা কবে আসবে বলো তো?"
"যেদিন আসবে, সেদিনই যাব। এখন খাবি চল।"

নীলম অফিসে। তমা রান্নাবান্না শেষ করে টেবিল সাজাচ্ছে। নিহি তিতিরকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে বলে,
"যেদিনই আমি আসি সেদিনই তুমি এতো রান্না কেন করো ভাবি?"
"এটা কেমন কথা? আমার আদরের ছোটো ননোদের জন্য এইটুকু করব না?"

নিহি মিষ্টি করে হাসলো। খাবার মাখতে মাখতে বলল,
"আচার বানিয়ে দিও তো মা।"
ভাবি তখন মজা করে বলে,
"কেন ননোদী? সুখবর আছে নাকি?"
"ভাবি!"
তমা শব্দ করে হেসে বলল,
"কী? ভাবি কী? আসবে নাকি নতুন অতিথি?"
"ধুর! যাও। আমি নিজেই তো একটা বাচ্চা।"

তিতির তখন নিহির গালে হাত রেখে বলে,
"আর আমি তোমার বাচ্চা।"
নিহি হেসে তিতিরের গালের সাথে গাল মেশায়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে। বাড়িতে যাওয়ার সময় তিতিরকেও সঙ্গে নেয়।
মাঝ রাস্তায় আমান ফোন করে। নিহি ফোন রিসিভ করতেই আমান বলে,
"কোথায় তুমি এখন?"
"বাড়িতে যাচ্ছি।"
"ওহ্। আমি অফিসে এসেছি বুঝেছো। অনলের শরীর ভালো না। জ্বর অনেক। অফিসে আসার আগে আবুল আর টুকটুকিকে পাঠিয়েছিলাম। ফোন দিয়ে খবর নিলাম জ্বর নাকি আরও বেড়েছে। তুমি যাও তো একটু ওর বাসায়। আমিও একটুপর আসছি।"
নিহি ইতস্তত করে বলে,
"আমি যাব?"
"হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যাও।"

আমান ফোন রেখে দিলো। নিহি রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা ঘুরাতে বলল। অনলের বাসায় যাবে এখন।
______________

বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে অনল। ডাক্তার এসে চেকআপ করে ওষুধ দিয়ে গেছে। আবুল পাশে বসে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। টুকটুকি স্যুপ বানাচ্ছে রান্নাঘরে। নিহির আসতে ত্রিশ মিনিটের মতো লাগে। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে আবুল দরজা খুলে দেয়। নিহি জিজ্ঞেস করে,
"জ্বর কমেছে?"
"না আফামুনি। জ্বর তো কমতাছে না। চোখ লাল টকটকা হইয়া আছে।"

নিহি কোনো উত্তর করলো না। ভেতরে গেল। অনল চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। একটা চেয়ার টেনে অনলের মাথার সামনে বসলো। আবুলকে বলল,
"আবুল ভাই আমাকে আধা বালতি পানি এনে দিতে পারবেন?"
"হ৷ পারমু না ক্যান।আনতাছি।"

আবুল পানি আনতে যাওয়ার পর নিহি খুঁজে খুঁজে বড় মোটা একটা পলিথিন বের করে। নিহির কণ্ঠস্বর শুনে অনল চোখ মেলে তাকিয়েছে। পাশে বাবু হয়ে বসে আছে তিতির। ওর ছোটো ছোটো হাত দিয়ে অনলের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয়। তিতিরের দিকে তাকিয়ে হাসে অনল। তিতির জিজ্ঞেস করে,
"তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে পঁচা আঙ্কেল?"
অনল আগের হাসি বজায় রেখেই বলল,
"না, আম্মু।"

আবুল পানি আনার পর অনলের মাথার নিচে বালিশের ওপরে পলিথিন বিছিয়ে দিলো নিহি। মাথার সম্মুখে বসে মাথায় পানি ঢালে। চুলে হাত বুলাতেই বুঝতে পারে মাথার উত্তাপে ঠান্ডা পানিও গরম হয়ে যাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিটের মতো মাথায় পানি ঢেলে জ্বর কিছুটা কমায়। আবুল পরে টাওয়াল দিয়ে অনলের মাথা মুছে দেয়। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে নিহি রান্নাঘরে যায়। টুকটুকিকে জিজ্ঞেস করে,
"হয়নি আপা?"
"হ, আপাজান। হইছে। লইয়া যান।"

স্যুপের বাটি নিয়ে ঘরে ফিরল নিহি। অনল খেতে নারাজ। নিহি রাগ দেখিয়ে ধমক দেয় অনলকে। বলে,
"খাবেন না কেন? না খেলে ওষুধ খাবেন কীভাবে? সুস্থ হতে হবে না?"
অনলের চোখমুখ শুকনো। শুকনো ঠোঁটেই হাসার চেষ্টা করে। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। তিতির বলে,
"ফুপি তুমি পঁচা আঙ্কেলকে বকো কেন? দেখছো না আঙ্কেল অসুস্থ!"

নিহি চুপ করে রইল। অনল হেসে বলে,
"এই বকাতেই ভালোবাসা খুঁজে নিই মামনী।"
নিহি ছোটো বাক্যে বলল,
"খেয়ে নিন।"
স্যুপের বাটি হাতে দিতে গিয়ে দেখল অনলের হাত কাঁপছে। নিজে থেকে সে খেতে পারবে না। নিহি তো নিজেও খাইয়ে দিতে পারবে না। তাই আবুলকে বলল খাইয়ে দিতে। স্যুপ খাওয়ার শেষের দিকে আমান আসে। আদরযত্ন করে ছোট ভাইকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। এখন অনেকটাই সুস্থ লাগছে নিজের কাছে। আমান রাতে এখানে থাকতে চাইলেও অনল বারণ করেছে। নিজেকে সামলে নিতে পারবে বলেও জানিয়েছে। অনলের পীড়াপীড়িতে আবুলকে রেখে ওরা বাড়িতে ফিরে আসে।


শীতের কুয়াশায় সূর্যের অস্ত যাওয়াটাও দৃশ্যমান হয়নি। এখন চাঁদকেও দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে ধরণী। হাত বাড়ালেই মনে হয় কুয়াশার মাঝে তলিয়ে যাওয়া যাবে। বারান্দায় বসে কুয়াশা দেখছিল আমান। তিতিরকে ঘুম পাড়িয়ে নিহিও আসে। আমানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
"ঘুমাবে না?"
আমান কাঁধের ওপর থেকে নিহির হাত নিয়ে হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেল। তারপর হাত টেনে ধরে কোলের ওপর বসায়। আমানকে আবেগী লাগছে। নিহিকে জড়িয়ে ধরে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। আমানের চুলের মাঝে হাত বুলাতে বুলাতে নিহি জিজ্ঞেস করে,
"কাঁদছো কেন?"
"আগের কথা খুব মনে পড়ছে নিহু! বাবা-মা, নিরবকে খুব মিস করছি।"

নিহির বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। চোখে পানি চলে আসে বাবা আর নিরবের জন্য। বাবার তো রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছিল। না চাইতেও মেনে নিতে পেরেছিল। কিন্তু নিরব! নিরবের মৃত্যুটা যে অনাকাঙ্ক্ষিত। শুধুমাত্র নিহিকে বাঁচাতেই ওর জীবন দিতে হয়েছে। নিরবের মৃত্যুটা এখনো মানতে পারে না নিহি। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল শুরু হয়। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। এখন কাঁদলে চলবে না। আমানকে সামলাতে হবে। নিজেকে সামলে নিয়ে আমানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বুকে মাথা চেপে ধরে বলল,
"কিছু অতীত মিষ্টি হয়। আর কিছু অতীত হয় বিষাদে গ্লানিত। তবে খুব কম মানুষের অতীতই সুন্দর হয়। যাদের অতীত সুন্দর ওরা হয় ভাগ্যবান নয়তো ভাগ্যবতী। আর দুনিয়ার এই ভাগ্যবান, ভাগ্যবতী মানুষগুলো খুব কম। আমাদের না চাইতেও অনেক অপ্রিয় সত্য মেনে নিতে হয়।"

আমান নিশ্চুপ। নিহি আবারও আমানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
"এখন চলো ঘুমাবে।"
আমান বারণ করল না।
__________________

পরেরদিনও অনল অফিসে যায়নি। জ্বর অনেকটা কমেছে কিন্তু শরীর দুর্বল। আমান সকালে অফিসে যাওয়ার সময় অনলকে দেখে গেছে। আর বারণ করে গেছে কিছুদিন অফিসে না যেতে। অফিসে এসে নীরার মন অস্থির। অনলের জ্বর কমেছে নাকি কে জানে! অফিসেও তো আসেনি। অনলকে না দেখে শান্তিও পাচ্ছে না। কোন বাহানায় অনলের বাসায় যাবে সেটাও বুঝতে পারছে না। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে থাকতে না পেরে অবশেষে মনস্থির করল বাড়িতে যাবেই। না হয় বেহায়াই ভাববে। ভাবুক! তাতে কী আসে যায়? অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে অনলের বাড়িতে যায় নীরা।

দরজা খুলে দেয় আবুল। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই নীরা জিজ্ঞেস করে,
"অনল স্যার বাড়িতে?"
"হ। আপনি কে?"
"আমি স্যারের পি.এ।"
"ওহ। আহেন। ভিতরে আহেন।"

নীরা ভেতরে গিয়ে অনলের ঘরের সামনে দরজায় নক করে বলে,
"আসব স্যার?"
অনল তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন চাপছিল। নীরাকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
"আরে মিস নীরা! ভেতরে আসুন।"

নীরা ভেতরে গিয়ে পুরো রুমটা আগে ঘুরেফিরে দেখল। তারপর পড়ার টেবিলের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বলল,
"এখন কেমন আছেন স্যার?"
"হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ। এখন অনেকটা ভালো।"
অনল আবুলকে ডেকে কফি বানাতে বলল। নীরা তখন বলল,
"আমি কিছু খাব না স্যার।"
"তা বললে হয় নাকি। ব্যাচেলর মানুষ তেমনকিছু খাওয়াতে পারব না।"

নীরা মিষ্টি করে হাসলো মাথা নুইয়ে। তারপর অনলের দিকে তাকিয়ে বলল,
"বিয়ে কেন করছেন না?"
"বিয়ে করে কী হবে?"
"এটা কেমন প্রশ্ন ছিল?"
"প্রশ্ন যেমনই হোক। উত্তর তো আছে।"
"না, নেই।"
"তাহলে আপনার প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।"
"সারাজীবন কি তাহলে সিঙ্গেলই থাকবেন? বিয়ে করবেন না?"
"আমি সিঙ্গেল কে বলল?"
"মানে? কেউ আছে আপনার?" ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন করে নীরা।

অনল ঘোর লাগানো কণ্ঠে বলে,
"দৃশ্যমান নয় সে। আমার ভালোবাসার মানুষটি আড়ালে। আমি আড়ালেই তাকে ভালোবাসি।"
নীরার মনে আশার আলো উদয় হয়। খুশি খুশি লাগে। এর আগেও অনলের বাড়িতে অফিসের কাজের জন্য আসতে হয়েছিল নীরাকে। বেডরুমে অবশ্য আজই প্রথম। নীরা দেখেছে অনলের একটা নোটে নকশা করে এন(N) লেখা। মনে হলো, অনল কি তাহলে আমাকেই ভালোবাসে? আনন্দের পাশাপাশি লজ্জাও লাগছে। আজ তাহলে মনের কথাটা বলেই দিবে সে অনলকে। সেই প্রথম থেকে অনলের প্রতি যেই ভালোবাসার দানা বুকের জমিনে বুনতে শুরু করেছিল তার প্রকাশ আজ করবে। করতেই হবে। নীরা ভাবে অনলও নীরাকে ভালোবাসে। নীরা আমতা আমতা করে বলে,
"একটা কথা বলব।"
"হ্যাঁ, শিওর।"
"মানে! কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।"
"আরে বলুন। সমস্যা নেই।"
"হয়তো কথাটা শোনার পর আমায় বেহায়া মনে হবে। অথবা একটা মেয়ে হয়ে কথাগুলো নিজের বলা ঠিক হচ্ছে কী-না আমি সেটাও বুঝতে পারছি না।"
"আপনি বলুন। কোনো সমস্যা নেই।"
"আপনি হয়তো এতদিনে এটা বুঝতে পেরেছেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি।"
অনল মৃদু হেসে বলল,
"কতটুকু জানেন আমার ব্যাপারে?"
"না জেনে ভালোবাসা যায় না?"
"জানলে হয়তো ভালোবাসতেই ইচ্ছে করবে না।"
"ভালোবেসেছি। ভালোবাসবো।"
"আমিও একজনকে ভালোবেসেছি। এখনো তাকেই ভালোবাসি!"

নীরার ভয় হচ্ছে। ভীতিগ্রস্ত হয়ে নীরা প্রশ্ন করে,
"কে সে?"
"আছে একজন।"
"আমি কি তাকে চিনি?"
"চিনতেও পারেন। নাও পারেন। আপনার প্রতি আমার পজিটিভ চিন্তাধারা,ব্যবহার দেখে হয়তো ভেবেছেন আমিও আপনাকে ভালোবাসি তাই না? আসলে এই ধারণাটা সত্য নয়। আমি আপনাকে পছন্দ করি। কিন্তু ভালোবাসি না। আপনি প্রায় অবিকল আমার সেই ভালোবাসার মানুষটার মতো দেখতে। আমি দেখেছি আপনি, এন(N) অক্ষরটা দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন। মজার বিষয় হচ্ছে তার নামের প্রথম অক্ষরও এন(N)। নামের ঐ অক্ষরটা আমি আপনাকে নয় তাকে মনে করে লিখি। তার স্বভাবের সঙ্গে আপনার স্বভাব কিছুটা মিল আছে বলেই আমি আপনাকে পছন্দ করি। শুধুই পছন্দ। অন্য কিছু নয়।"
"তার মানে আপনি আমায় ভালোবাসেন না?"
"না। প্রথমদিকে আমার কিছু ফল্ট ছিল। নিজের দোষেই আমি তাকে হারিয়েছি। জানেন, সে আমায় বলেছিল, আমি যেদিন নিজের ভুল বুঝতে পারব সেদিন অনেক দেরী হয়ে যাবে। সত্যিই তাই হয়েছে। আর এতটাই দেরী হয়েছে যে, মনের মাঝখানে তার নাম খোদাই করে লেখা হয়ে গেছে। সেই লেখা কখনো মুছে ফেলা সম্ভব নয়। জখমও ধরবে না। ভালোবাসার নাম হয়ে চিরউজ্জ্বল হয়ে থাকবে। হয়তো কখনোই তাকে ভালোবাসি কথাটা বলতে পারব না। কারণ সেই অধিকার আমি বহু আগেই হারিয়েছি। জানি না আর কখনো জ্ঞানত আমি কাউকে ভালোবাসতে পারব নাকি!"
নীরা অভিমানীস্বরে বলে,
"আপনি তো বললেন আমি নাকি তার মতো। তাহলে আমায় কেন ভালোবাসতে পারবেন না? একটা সুযোগ তো দিন।"
অনল ব্যথিতভাবে মৃদু হেসে বলে,
"আপনি তার মতো। কিন্তু সে নন! আজও আড়ালে আবডালে আমি শুধু তাকেই ভালোবাসি।"

নীরার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট! ভালোবাসার মানুষটার মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসার ব্যাখা শোনাটা কষ্টদায়ক। মানুষগুলো বড্ড অদ্ভুত! বড্ড! ছলছল নয়নে সে জিজ্ঞেস করে,
"সে কোথায় এখন? কথা হয় না?"
"হয়! আরও একটা কঠিন সত্য আছে। সে এখন অন্য কারো।"
"তাহলে তার জন্য আপনি কেন অপেক্ষা করে আছেন?"
"অপেক্ষা করে নেই তো! তার সুখ-ই দূর থেকে দেখি। একটা সময়ে তাকে পাওয়ার প্রবণতায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তার বাবার কাছে পা ধরে তাকে চেয়েছিলাম। তিনি রাজি হননি। অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। রাগে, জিদ্দে, অপমানে ভালোবাসার মানুষটির বাবাকে মেরে ফেলতেও দু'বার ভাবিনি।"
"মানে?" চমকে জিজ্ঞেস করে নীরা।
"মানে আমি খুনি! তাকে খুন করিয়েছি। এক্সিডেন্ট করিয়ে আমিই মেরেছিলাম তাকে। একজনকে খুনি কি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?"

কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে নীরা। অনলের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। জ্বরের ঘোরে কি সে আবোলতাবোল বলছে? নীরা তাড়াহুড়ো করে বলে,
"আমার মনে হচ্ছে আপনার এখন রেস্ট নেওয়া উচিত স্যার। আমি না হয় পরে আসব।"
"আমি ঠিক আছি। আপনি বসুন। অনেকদিন ধরে বুকের ভেতর কথাগুলো পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলাম। আজ আপনাকে বলে শান্তি লাগছে।"

নীরা উঠতে গিয়েও বসে থাকে। অনল বলে,
"সে আমায় বলেছিল, সে আমায় ঘৃণাও করে না। আমি নাকি তার ঘৃণারও যোগ্য নই। একদিন তাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি আমি। তারপর থেকেই আমার প্রতি তার অনুভূতি সংমিশ্রিত। সে আমায় ভালোওবাসতে পারে না। ঘৃণাও করতে পারে না। এই যে এখন তার সঙ্গে বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক আছে এটাই অনেক।
সত্যি তো এটাই আমি এখনো আড়ালে তাকেই ভালোবাসি। আর ঐ একটা সত্যিই লুকায়িত আছে। যেটা তার আড়ালে।"
"কোন সত্যি"
"ঐযে ওর বাবার খুনি আমি। ঐ এক্সিডেন্টটা আমিই করেছিলাম।"
_________________

বাগানের ফুলগুলোতে আজ নতুন নতুন ফুল ফুঁটেছে। সবগুলো গাছ আমান আর অনল মিলে লাগিয়েছিল। তার কারণ নিহির ফুল পছন্দ। পুরো বাড়িটা বানানো হয়েছি নিহির মনমতো করে। দো'তোলার বারান্দায় দাঁড়ালেই ফুলের বাগানটা দেখা যায়। সকালে আর রাতে ভেসে আসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ। বিমোহিত হতে হয় নিহিকে। এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগান দেখছিল আমান। চোখ উপচে পানি আসতেই ঘরে চলে আসে। বারান্দার দরজা লাগিয়ে দেয়।
অনলের মৃত্যুর ৭ম দিন আজ। আমান অন্ধকার রুমে বসে কাঁদছে। নিহি আমানের কাছে গিয়ে বসে। কাঁধে হাত রেখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। আমান নিহির কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে। নিহির বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অজানা কষ্টে বুকের ভেতরে হাহাকার করছে। এই অনুভূতির নাম নেই। আমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নিহি। কাঁদতে কাঁদতে আমান বলে,
"কেন আমার সঙ্গে এমন হলো নিহু? বাবা-মাকে হারালাম। এখন ছোটো ভাইকেও। অনল কেন নিজেকে শেষ করে দিলো? ওর কষ্টটা কেন ভাগ করেনি বলো?হাসপাতালে ওর শেষ সময়ের করুণ মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। শেষ সময়টাও আমার ভাইটা হাসার চেষ্টা করেছে। ওর ঐ হাসি আমাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে। কেন সবাই আমায় ছেড়ে যায় বলো নিহু?"

একটু থেমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আবার বলে,
"এখন আমার তোমায় নিয়ে ভয় হয়। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার। কখনো আমায় ছেড়ে যেও না প্লিজ!"
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিহি আমানকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
"ভয় পেও না। আমি কোথাও যাব না তোমায় ছেড়ে। এখন একটু ঘুমাও।"

আমান নিহির কোলে মাথা রেখে শোয়।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিহি মনে মনে বলে,
"আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও আমান। অনেক সত্যি তোমার আড়ালে রেখেছি। এই সত্যিগুলো যে তুমি মানতে পারবে না। তোমার বাবার খুনি তোমার মা। যাকে এতো ভালোবেসেছ সে তোমার আপন মা নয়। সৎ মা। তোমায় খুনও করতে চেয়েছে সে। আর তোমার মাকে খুনটা আমিই করেছি। এগুলোর কোনোকিছুই তুমি সহ্য করতে পারবে না। এমনকি! এমনকি, তোমার ভাইকেও আমিই খুন করেছি। আমার বাবার খুনির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! অনল কেন শেষ মুহূর্তে এসেও বলেনি আমিই ওকে মারতে চেয়েছি! আমি জানিনা! আমি জানি না কখনো আড়ালে থাকা এই সত্যিগুলো তোমার সামনে আসলে তুমি কী করবে! সব সত্যি জানার পর যদি আমায় ঘৃণা করো তাহলে তোমার হাতে মরতেও আমার আপত্তি নেই। তুমি যা চাইবে সেদিন তাই-ই হবে। শুধু একটা কথাই বলব, ভালোবাসি তোমায় খুব।"

আমান ঘুমিয়ে পড়েছে। নিহি আমানের কপালে চুমু খায়। বালিশে আমানকে শুইয়ে দিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে ভাবে সেদিনের কথা। যেদিন অনলকে খুন করেছে নিহি!

সেদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে অনলের বাড়িতে গিয়েছিল নিহি। বাইরে থেকে নীরা আর অনলের কথোপকথন শুনে আর ভেতরে যায়নি। ভেবেছে গার্লফ্রেন্ড হবে হয়তো। তাই ওদের স্পেস দিয়ে চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই কানে ভেসে আসে অনলের কথা। শেষ কথাটুকু শুনে বুঝতে অসুবিধা হয়নি ঠিক কোন সত্যটার কথা অনল বলেছে। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। অনলের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কারো সঙ্গে দেখা না করে, কাউকে কিছু না বলেই নিহি বাড়িতে চলে আসে। কোনোভাবেই কোনোকিছুতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না। এরপরে কয়েকবার অনলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। যতবার অনলকে দেখেছে ততবার রাগে, জিদ্দে নিজের ওপর নিজের ঘৃণা হয়েছে। ভেবে নিয়েছিল হয়তো নিজে এই পৃথিবীতে থাকবে নয়তো বাবার খুনি!

সেদিন রাতের কথা।
আমান গভীর ঘুমে। নিহির পরনে লাল পাড়ের একটা সাদা শাড়ি। লম্বা কালো চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। রাত প্রায় ১২টার পর অনলের ফ্ল্যাটে যায়। অনল সবেমাত্র তখন নীরার জন্মদিনের পার্টি থেকে ফিরেছে। সব সত্যি জানার পরও নীরা অনলকে ঘৃণা করতে পারেনি। বলেছিল, ভালো না বাসলেও যেন বন্ধু হয়ে থাকে। অনল আপত্তি করেনি। নীরা বায়না করেছিল অনল যেন নীল পাঞ্জাবি পরে আসে। নীরার আবদারের কাছে হার মানতে হয়েছিল অনলকে। নীরা নীল শাড়ি পরেছিল। আর অনল নীল পাঞ্জাবি।

আকাশের অবস্থা ভালো না আজ। শীতের সময়ও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শীতের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও।
অনলের বাড়িতে গিয়ে দরজায় নক করে নিহি। অনল দরজা খুলে নিহিকে দেখে অবাক হয়।অনল বাড়িতে একা। নিহি তখন অস্থির হয়ে বলে,
"আমাদের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। মাঝপথে বৃষ্টিতে পেলো।"
"ভেতরে আসো। এতো রাতে একা ফিরছিলে? ভাইয়া জানে?"
বলতে বলতে অনল ভেতরে গেল। নিহিও যায় পিছু পিছু। একটা বড় ছুরি নিয়ে এসেছিল শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে। ভেতরে যেতে যেতে অনলের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। অনল ঘাড় বেঁকিয়ে একবার নিহির দিকে তাকিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নিহি হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে অনলের সামনে। অনলের চোখদুটো ছলছল করছে। নিহির চোখেও কেন জানি পানি টলমল করছে। নিহি ঠোঁট কামড়ে ধরে শেষ আঘাতটা করে অনলের বুকে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নিহি বলে,
"আপনি আমার বাবার খুনি! কখনো ভাবিনি, আপনার এই বুকের আঘাতটা ছুরি দিয়ে করতে হবে আমার!"

ব্যথায়, কষ্টে মুখের বর্ণ পাল্টে গেছে অনলের। তবুও মুচকি হাসার চেষ্টা করে। রক্তাক্ত হাত নিহির গালে রাখার চেষ্টা করে। তার আগেই রক্তাক্ত হাতটি ফ্লোরে পরে যায়! আবারও কাঁপা কাঁপা হাতটি তুলে ওঠায়। নিহির গাল ছুঁয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
"আ..ড়ালে এতদিন ভালো..বেসে..ছি! এখনো ভালোবাসি তোম..."
পুরো কথা সম্পূর্ণ করার আগেই চোখ বন্ধ হয়ে যায়। বড়ো শ্বাস নিয়ে হাতটি ফ্লোরে পড়ে যায় অনলের। নিহি হুহু করে শব্দ করে কাঁদে। কেন কাঁদে সেই উত্তর তার কাছে নেই। নেই!



                                ***(সমাপ্ত)***
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।