০১!!
নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছে তনয়া। কিন্তু তনয়াকে দেখলে কেউ বুঝবে না মেয়েটা নিজের বিয়ে থেকে পালিয়েছে। বুঝবে কি করে? সেকেলে বোরকা পরে পুরো আন্টি হয়ে রাস্তায় হাঁটছে। পায়ের মল জোড়া ছম ছম শব্দ করছে দেখে, খুলে হাতের ব্যাগটায় নিয়ে নিলো।
রশ্মিদের বাড়ির পাশের পার্কে এসে রশ্মিকে ফোন করলো। রশ্মি তনয়ার ক্লাসমেট। মোটামুটি ভালো সম্পর্ক ওদের। রশ্মিও তনয়ার ফোন তুলে বললো
__হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম কে বলছেন?
__তোর বাবার মা রে হারামি। চুপ কোন কথানা। কেউ যাতে বুঝতে না পারে তুই আমার সাথে কথা বলছিস। তাহলে তোর অবস্থা, গো-ওয়েন্ট-গন হয়ে যাবে। শুধু হু হাতে জবাব দিবি। ওক্কে!
__ওকে!
__দাড়া আগে তোর সালামের জবাব নিয়ে নি। নয়তো পাঁপ হবে। ওয়ালাইকুম আসসালাম।
__এতগুলো কথা বলার পর সালামের জবাব কেন নিলি।
__চুপ ছেমরি। খালি প্যাঁচাল পারে। এখন যা জিজ্ঞেস করছি তা বল?
__হুমম
__আমাদের বাড়ির অবস্থা কেমন?
__পুরো আগুন। (তোর বাবা বলছে তোকে আর মেয়ে হিসাবে মেনে নিবেনা।)
__গুড। একদম ঠিক বলছে। আমিও আপাতত কদিন তাকে বাবা বলে মানিনা। কদিন পর থেকে আবার মানবো। শোন বাড়ির সব ঝামেলা ঠান্ডা হলে, তোদের বাড়ির পেছনের পার্কে চলে আয়। বিস্তারিত সেখানেই বলছি।
__ওকে বলে রশ্মি ফোনটা কেটে, তনয়ার মায়ের কাছে গেলো। গিয়ে বললো, আন্টি এখন তো আর বিয়ে হবে না আমি তাহলে বাসায় যাই। আসলে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এখন না গেলে যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে।
__তনয়ার মা বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে যেও। আর তনয়ার কোন খোঁজ পেলে আমায় জানিও। মেয়েটা কেন যে এমন করলো? কোথায় গেছে? কি করছে? আল্লাহ্ মাবূত জানে? ওর বাবা কত রাগ করছে। নেহাৎ ছেলের বাড়ির লোক ভালো দেখে তেমন অপমান করেনি নয়তো কি যে হতো? ওর বাবা তো বোধয় এখন আর ওর সাথে কথাও বলবে না। মেয়েটা কেন যে এমন করলো? এসব বলতে বলতে তনয়ার মা (নয়না চৌধুরি) কান্না করছে। রশ্মি কতক্ষন তাকে শান্তনা দিয়ে সোজা তনয়ার সাথে দেখা করতে গেলো।
তনয়া পার্কে বসে ঝালমুড়ি খাচ্ছে। রশ্মি আসতেই ওর সামনে ঝালমুড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো
__নে খা। ভিষন টেস্টি। আমি তো চার বার খেয়েছি। কি করবো বল, একা একা খুব বোর হচ্ছিলাম আর খুব খিদে পেয়েছিলো।
রশ্মি অগ্নি চোখে তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
__হারামি এতগুলো মানুষকে টেনশনে ফেলে এখানে বসে মুড়ি গিলছিস? তোর বাবা মা কত চিন্তা করছে জানিস? তোর মা খুব কান্না করছে। তারা তোকে কত ভালোবাসে।
__আমাকে জোড় করে বিয়ে দেয়ার সময় ভালোবাসা কোথায় ছিলো? তখন ভালোবাসার কথা, টেনশনের কথা মনে ছিলো না। এখন একেবারে ভালোবাসা উতলে উতলে উঠছে। ওসব কথা বাদ দে তো। এখন আমি কোথায় যাবো সেটা বল?
__কুত্তি বাড়ি থেকে পালানোর সময় কোথায় যাবি সেটা ঠিক করে পালাস নি?
__হ্যাঁ। পালাতে পালাতে ভাবলাম রুমা (তনয়ার বেষ্ট ফেন্ড) ওদের বাসায় যাবো। তারপর ভাবলাম ও আমার বেশি ক্লোজ ওর বাসায় গেলে পাক্কা ধরা খাবো। কিন্তু তুই ভালো বন্ধু হলেও তোর বাসায় আসলে কেউ সন্দেহ করবে না। তাই তোর বাসায় যাবো। তাছাড়া তুই একা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকিস। সো কোন প্রবলেমই হবেনা। আমার খরচা নিয়ে তোর টেনশন করতে হবে না। গায়ে যে, গয়না আছে আর বাসা থেকে আসার সময় বাবার আলমারি থেকে যা ঝেড়ে দিছি তা দিয়ে মাস চার পাঁচ সুন্দর ভাবে চলে যাবে। ততদিনে একটা জবের ব্যবস্থা করে ফেলবো। আর বাবা মায়ের রাগও ততদিনে পড়ে যাবে। শত হলেও একমাত্র মেয়ে বলে কথা। আর শোন আমার হেল্প করার বদলে আমার মেঝো ভাই তামিম এর সাথে যে, তোর ইঞ্চি ইঞ্চি ভাব চলছে তা পুরো জমিয়ে ক্ষির করে দিবো, তোকে ভাবি বানিয়ে নিবো। এখন বল হেল্প করবি কিনা?
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে দম নিলো তনয়া।
রশ্মি হা হয়ে কতক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে,
__সবাই ঠিক বলে তোর মত শয়তানি বুদ্ধির মেয়ে পৃথিবীতে দ্বিতীয় আরেকটা বিরল। তা পালালি কেন? তোর তো কোন বি এফও নাই।
__দূর চুল। বি এফ থাকলে সে গাঁধাকে নিয়ে পালাতাম না। তোর কাছে কি লুডু খেলতে আসতাম। আমি এত তারাতারি ফাঁসিতে ঝুলতে চাইনা। আমি বাঁচতে চাই নিজের মত। আমার অবেলায় বোনা হাজারো অভিলাষ পূরন করতে চাই। সে অভিলাষ গুলো পূরন করতে দূর অজানায় লোকালয় থেকে দূরে বহু দূরে হারাতে চাই। আর তার জন্য আমার যা করা লাগে তা করবো।
__দেখি তোর অবেলার অভিলাষ পূরন হয় কিনা! চল বাসায়? আর যেতে যেতে বল এত লোকের ভিরে পালালি কি করে?
দুজন হাঁটতে হাঁটতে তনয়া বলছে,
__দুপুরে আমাকে সাজানোর পর তোরা সবাই আমাকে রুমে একা রেখে বর দেখতে নিচে চলে গেলি। তখন রুমে ফুপির বোরকাটা পেলাম। সেটা পরলাম, পিছনের দরজা দিয়ে সোজা বেড়িয়ে ছু মন্তর হয়ে গেলাম।
০২!!
তনয়া রশ্মির সাথে রশ্মির বাসায় গিয়ে, বোরকা খুলে ভারী গহনাগুলো খুলে, লেহেঙ্গা পরা অবস্থায় রশ্মিকে নিয়ে বের হলো। উদ্দেশ্য কিছু হালকা পাতলা জামা কিনবে, আর রেস্টুরেটে পেট পুরে খাবে।
শপিং করে তনয়া রশ্মি রেস্টুরেন্ট এ বসে বিরিয়ানি খাচ্ছে আর তনয়া বকবক করছে। তনয়া রশ্মিকে বলছে,
__তুই না এক নাম্বারের গাঁধি?
__আমি আবার কি করলাম?
__কেনরে আমাদের বাড়ি থেকে আসার সময় বাটিতে করে বিয়ের খাবার নিয়ে আসতি! কত দিনের শখ নিজের বিয়ের খাবার নিজে খাবো সেটা আর হলো না রে। দুঃখে মাত্র দু প্লেট বিরিয়ানি খেলাম। খেতেও পারছি না।
__চুপ খাদক কোথাকার!
__আরে শোন___ তনয়া কিছু বলতে যাবে এর মধ্যে একটা স্প্রাইট এর মুখের সিপি এসে তনয়ার প্লেটে পড়লো। তনয়া সিপিটা হাতে নিয়ে দেখলো ওদের টেবিল থেকে কিছুটা দূরের টেবিলের ছেলে গুলো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তনয়া সিপিটা নিয়ে পাশে টেবিলে গিয়ে বললো, এটা কে মারছে? একটা ছেলে (নাইম) উঠে দাড়িয়ে বললো,
__স্যরি আমি স্প্রাইট এর সিপি খুলতে গিয়ে সেটা জোড় লেগে আপনার গায়ে লাগছে।
__স্যরি বললেই হলো নাকি? এই সিপিটা যদি আমার চোখে লেগে চোখ নষ্ট হয় যেতো তখন আপনার চোখ কি আমায় দিতেন? আমি অন্ধ হলে আমার স্বপ্ন কি আপনার দাদা পূরন করতো?
__রাজু বললো ও তো স্যরি বলছে তবে আর কি করবে? একটু কড়া গলায়?
__তনয়া বললো, দেখুন নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে এসে নিজের বিয়ের ভাঙায় পার্টি করছি পার্টিটা নষ্ট করতে চাইনা। তাই ঝামেলা করলাম না নয়তো দেখিয়ে দিতাম। হুহ
তনয়ার কথা শুনে চেয়ারে বসা আরেকটা ছেলে যে,স্প্রাইট খাচ্ছিলো তার বিষম লেগে গেলো। কাঁশতে কাঁশতে পানি খেয়ে কোন মতে শান্ত হলো। আর হ্যাঁ ছেলেটা আর কেউ নয় আমাদের আয়াত। একটু শান্ত হয়ে আয়াত বললো,
__কি বিয়ে থেকে পালিয়ে এসে কেউ নিজের বিয়ে ভাঙার পার্টি করে আজ প্রথমবার দেখলাম মানে শুনলাম!
__আরে দেখছেন না এখনো বিয়ের সাজে আছি। খোলার টাইম পাইনি।
আয়াত তনয়ার আপদমস্তক তাকিয়ে দেখলো। ভারী পাথর আর সুতার কাজের টকটকে লাল রঙের ল্যাহেঙ্গা পড়া, ওড়নাটা একেবারে কড়া লাল, হাত ভর্তি লাল চুড়ি, চুলের খোপার ফুলগুলো একটু এলোমেলো হয়ে গেছে, গায়ে ভারী গয়না গাটি তেমন নেই, তবে চোখে গাঢ়ো করে কাজল দেয়, কপালে লাল ছোট্ট একটা টিপ, এমন সাজে মেয়েটাকে অপরূপ লাগছে। যে কেউ দেখলে মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাবে। তনয়া আয়াতের চোখের সামনে তুরি মেরে বললো
__ও হ্যালো কি দেখছেন?
__তোমাকে কিভাবে পটানো যায় সেটা ভাবছি। (দুষ্টমি করে)
তনয়া আয়াতের কথা শুনে হা হা করে হেসে বললো,
__বাহ্ প্রথম দেখায় পটানোর প্ল্যান। আই এ্যাম ইমপ্রেস। গুড! বেস্ট অব লাক।
__ধন্যবাদ মিস_____।
__মিস তনয়া। চলুনা আপনারও আমাদের সাথে আমার বিয়ে ভাঙার পার্টিতে জয়েন করবেন।
__রাজু বললো তা বাড়ি থেকে পালালে কেন? বয়ফ্রেন্ড জন্ডিস কেস নাকি?
__তনয়া রাজুর দিকে তাকিয়ে বললো যা সন্দেহ করেছিলাম সেটা ভুল হলো। যা অনুমান করিনি সেটা ঠিক হলো!
__রাজু কৌতুহল চোখে তাকিয়ে বললো, মানে?
__আপনাকে দেখে প্রথমে সন্দেহ করছিলাম আপনার মাথায় গোবর আছে কিন্তু সেটা ভুল হলো। আমার অনুমান বলছে আপনার মাথায় গোবর না, ছাগলের গু আছে।
__হোয়াট? বলে রাজু চোখ বড় বড় করে তাকালো তনয়ার দিকে।
__এভাবে সিরিয়ালের এ্যাক্টরদের মত রিয়াক্ট কেন দিচ্ছেন? হ্যাঁ আপনার মাথায় ছাগলের গু। কারন গোবর থেকে ভালো জৈবিক সার তৈরী হয় তাই ও জিনিস আপনার মাথায় নেই । ছাগলের গু থেকে কিছু করা যায়না তাই ওটা আপনার মাথায়।
__রাজু রাগ করে বললো, ঐ মেয়ে কি বলছেন এসব?
__তো কি বলবে? বয়ফ্রেন্ড কেস হলে এখন এখানে বসে পার্টি কেন করবো? বয়ফ্রেন্ড থাকলে এতক্ষনে তাকে বিয়ে করে বাসর ঘরে থাকতাম। এই সাধারন কথাটা গরুতেও বুঝবে কিন্তু আপনি না। কারন আপনার মাথায় তো ছাগলে ইয়ে।
তনয়ার কথা শুনে আয়াত হা হা করে হেসে দিলো। রাজু দুজনার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুসছে। তনয়া আয়াতের হাসি দেখে বললো
__আপনার হাসিটা ভয়ংকর সুন্দর। প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে।
কথাটা বলে নিজেই নিজে বোকা হয়ে গেলো। নিজের জ্বীবে কামড় দিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
আয়াতসহ বাকি সবাইও 'থ' হয়ে গেলো। এর মধ্যে রশ্মি পাশের টেবিল থেকে ওদের টেবিলে এসে আয়াতকে দেখে ভয়ে ঘামতে লাগলো। চোখ বড় বড় করে আয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো
—————
রশ্মি আয়াতকে দেখে ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে বলে,
__স্যার আপনি এখানে কি করছেন? আসলে স্যার সেদিন-----
রশ্মি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো, আয়াত চোখের ইশারায় রশ্মিকে থামিয়ে বললো,
__সেটাতো আমারও প্রশ্ন রশ্মি? তুমি এখানে কি করছো? তুমি তো অসুস্থ ছিলা, তাই আজ রাতের শিফট অফ করছো। তাহলে এখানে কি করছো? আর এত বড় মিথ্যাটা কি না বললেই হতো না?
__আসলে স্যার আমার বান্ধবী তনয়ার জন্য। ওর আসলে-----
তনয়া রশ্মিকে থামিয়ে বললো,
__ওনাকে কেন স্যরি বলছিস?
__তনয়া ওনি আমাদের অফিসে বসের ছেলে। বর্তমানে অফিসের দায়িত্ব আয়াত স্যারের উপর।
__ওহ। তারপর তনয়া আয়াতকে উদ্দেশ্য করে বললো, আরে বড় ভাই রাগ করেন কেন? ভুল মানুষ মাত্রই। আর এমন কোন মানুষ নেই যে জীবনে দু একবার মিথ্যা না বলছে। হিউম্যান সাইকোলোজির মতে মানুষ একমাত্র প্রাণী যারা মিনিটে মিনিটে শত শত মিথ্যা বলতে পারে। সেখানে রশ্মি নিজের বান্ধবীর জন্য একটা মিথ্যা বলছে। হ্যাঁ ও ভুল করছে কিন্তু অন্যায় নয়। প্লিজ ওকে মাফ করে দিন। আসলে আমার কারনে ওকে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। তার জন্য রিয়েলি স্যরি স্যার।
তনয়ার মুখ থেকে বড় ভাই ডাক শুনে আয়াতের বেশ হাসি পেলো। হালকা হাসি দিয়ে বললো,
__ইট'স ওকে। বাট নেক্সট টাইম যেনো না হয়। মাইন্ড ইট।
__তনয়া বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই মনে রাখবে। আমি আছিনা ওর সাথে, ওকে সব শিখিয়ে দিবো। ডোন্ট ওরি। চলুন চলুন একসাথে পার্টি করি।
বেশ কিছুক্ষন কথা বলার পর আয়াত তনয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
__তা বিয়ে থেকে কেন পালালেন?
__আসলে পালাতাম না। নিজের স্বপ্ন গুলো বিসর্জন দিয়ে হলেও বাবার কথায় বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়তাম। কিন্তু ছেলেটা সুবিধার না।
__যেমন?
__যে, ছেলে এনগেজমেন্ট হবার নয় দিনের পর মানে বিয়ে হবার মাত্র তেরো দিন আগে হবু স্ত্রীর সাথে রুম ডেট করতে চায় সে ছেলে আর যাই হোক বিশ্বাসের যোগ্য না। ছেলেগুলো এমন কেন? এরা সবসময় মেয়েদের রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত কেন হয়? তার আগে তাদের চেনা জানারও তো প্রয়োজন আছে। কিন্তু তারা কেমন সেটা বুঝে না। হ্যাঁ আমি জানি সব ছেলে একনা। কিছু ছেলে এমন নোংড়া মানুসিকতার। কিন্তু তারাইবা এমন কেন?
আয়াত মাথা নিচু করে ফেললো। কারন এমন ঘটনা আজকাল অহরহর। তনয়া আবার বললো,
বাবাকে লজ্জায় বিষয়টা বলতে পারিনি। শুরু থেকেই বিয়েতে আমার ঘোর আপত্তি ছিলো। কিন্তু তবুও বাবার কথা ভেবে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন ফোনে ঐ নোংড়া কথা বলার পর রিসাদের (যার সাথে তনয়ার বিয়ে হবার কথা ছিলো) উপর ঘৃণা জন্মে গিয়েছিলো। মাকে বললাম কিন্তু মা বললো, মজা করছে হয়তো। তুই বুঝতে পারিসনি। আমি সবসময় সব কিছু মজার ছলে নেই বলে নিজের জীবনটাকে মজার ছলে নিবো তা তো নয়! কোনটা মজা আর কোনটা সিরিয়াস কথা তা বোঝার মত যথেষ্ট বয়স আমার হয়েছে। রিসাদ আধুনিকতায় মোড়কে মোড়ানো নেহাৎ একটি নোংড়া ব্যক্তিত্য।
অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে আটকাতে পারিনি। শেষ মেষ বাধ্য হয়েই আমাকে পালাতে হয়েছে।
তনয়া কথা শুনে আয়াত একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
__হুম বুঝলাম। আচ্ছা আপনি তো আমাদের চেনেনা তবে এত সহজে আমাদের এ কথাগুলো কেন বলে দিলেন?
__দেখুন আমি ভনিতা করা পছন্দ করিনা। যাকে ভালো লাগে তাকে মনের সব কথা বলে দি। লুকুচুরি খেলা আমি পারিনা।
আর রিসাদ হয়তো নিজের জায়গায় ঠিক! কারন আমার মত খুদ যুক্ত অপূর্ণ কোন মেয়েকে কেউ এমনি এমনি বিয়ে করেনা। সে তার বাবার যত টাকাই থাকনা কেন?
__সেটা আপনাকে দেখলেই বোঝায় যে, আপনার মধ্যে লুকুচুরি নেই। কিন্তু আপনি তো পারফেক্ট। আপনার মধ্যে খুদ কোথায়?
তনয়া নিজের ডান হাতটা টেবিলের উপর রাখলো। আয়াত সহ বাকি সবাই তনয়ার ডান হাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠে। কারন তনয়ার ডান হাতে তিনটা আঙুল। রিং ফিঙ্গার আর কনিষ্ট আঙুল দুটো আঙুল নেই। মানে কাটা।
তনয়া মৃদু হেসে বললো, আমার দু হাতে টোটাল ৮ টা আঙুল। এটা কি বড় ধরনের খুদ নয়! আপনি কি জেনে শুনে এমন মেয়েকে বিয়ে করবেন যার ডান হাতের দুটো আঙুল নেই। সোজা কথায় প্রতিবন্ধী।
পুরো টেবিল জুরে একটা থমথমে পরিবেশ তৈরী হয়ে গেলো। তনয়া বিষয়টা খেয়াল করে বললো, জাস্ট চিল। এসব বিষয় নিয়ে আমি কেয়ার করিনা। আমার মতে আমি সম্পূর্ণ পরিপূর্ণ একজন মানুষ। কারন দুটো আঙুল না থাকলেও মহান আল্লাহ্ তা'আলা আমায় সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ করেছে। তার জন্য তার কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া। এইরে অনেক রাত হয়ে গেলো। রশ্মি বাড়ি চল।
__আয়াত কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু না বলে বললো, আমরা ড্রপ করে দিবো?
__তনয়া বললো আপনাদের কেন বিশ্বাস করবো? যদি মাঝ রাস্তায় গাড়ি জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে আমাদের সাথে উল্টা পাল্টা কিছু করেন? তখন আমাদের কি হবে?
__আয়াত চোখ বড় বড় করে বললো কী? ওই আমাদের কি রেপিস্ট মনে হয়?
__না তবে রেপিস্ট এর গায়ে তো আর নাম লেখা থাকেনা। তবে বিশ্বাস করি কি করে! হি হি
__স্যরি ম্যাডাম। আপনাকে লিফট দেবার কথা বলে ভুল করছি। আপনারা যান।
রশ্মি আর তনয়া যেতে নিলে, আয়াত রশ্মিকে ডাক দিয়ে একা একটা কর্ণারে নিয়ে গিয়ে বললো,
__রশ্মি তনয়ার সম্পর্কে সেদিন মিথ্যা না বললেও পারতে?
__স্যরি স্যার।
__তোমার স্যরি দিয়ে এখন কি হবে? যা হবার তা তো হয়ে গেছে। একবার ভাবো তো তনয়া বুদ্ধি করে পালিয়ে না আসলে হয়তো রিসাদের সাথে ওর বিয়ে হতো আর তখন ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতো।
__রশ্মি নিশ্চুপ।
ওরা দুজন চলে যেতেই নাঈম বললো,
__বাপরে কোন মেয়ে যে, এমন কথা বলতে পারে জানা ছিলো না। বাঁচাল মেয়ে।
__রাজু বললো, তবে যাই বলিস মেয়েটার কথা শুনে খারাপ লাগলো। তবে হ্যাঁ বড্ড দুষ্ট মেয়েটা।
__আয়াত বললো, ও স্বচ্ছ আয়নার মত। যার ভিতর বাহির একদম এক।
০৩!!
রাত একটা।
রশ্মি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তনয়ার ঘুম আসছে না। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। বিশেষ করে বাবার কথা। বাবাকে আজ ও খুব কষ্ট দিয়ে ফেলছে। কিন্তু আর কোন অপশন যে ছিলো না ওর কাছে। অনেক ভাবে চেষ্টা করছে বিয়েটা আটকানোর কিন্তু লাভ হয়নি। বাবা মা তনয়াকে নিয়ে এজন্য চিন্তিত কারন তনয়ার একটা হাতে দুটো আঙুল নেই। বিয়ের প্রস্তাব এসে ফিরে যেতো। অবশ্য তনয়ার এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। মাত্র দুটো আঙুলের কমতি কোন মানুষের জীবনে চলার পথে সুখের গতি থামাতে পারেনা। কিন্তু বাবা মায়ের খুব চিন্তা করে। তাদের মতে এবার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে এম বি এ তে ভর্তি হয়েছি, বয়স ২২+। এখন বিয়ে না দিলে আর বিয়ে হবে না। ভালো ছেলে বিয়ে করবে না। যেমনটা আমারা বাঙালীরা ভাবি। আচ্ছা বিয়েটা কি জীবনে সত্যি খুব জরুরি?
উত্তর: হ্যাঁ আবার না। দিন শেষে মনের কথা বলার জন্য একজন জীবন সঙ্গী দরকার। কিন্তু সে মানুষটা যদি আপনার মনটাকে প্রধান্য না দেয়, তবে কিসের মন আর কিসের কথা?
রিসাদ প্রথম দেখায় আমার রূপে, সৌন্দর্য্যে মহিত হয়েছিলো। তাই বিয়েতে রাজি হয়েছিলো কিন্তু আমার অপূর্ণতা নিয়ে রোজ মজা করতো, আমায় ছোট করতো। যে, মানুষটার সাথে সারা জীবন কাটাবো সে যদি আমার অপূর্ণতা নিয়ে মজা করে তবে তা মেনে নেয়া যায় না। তারপরও মেনে নেয়ার কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু যখন বুঝলাম তার নজড় আমার শরীরটা তখন মেনে নিতে পারিনি। দেয়ালে পিট ঠেকে গেছিলো তাই বাধ্য হয়েছিলাম পালাতে। আচ্ছা বাড়ি কি একটা ফোন দিবো? নাহ্ থাক। এত রাতে ফোন দেয়া ঠিক হবে না।
এখন একটা জব খুঁজতে হবে। নিজের অপূর্ণতা নিয়ে বসে থাকা যাবে না। সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, শরীরের একটা অঙ্গের অপূর্ণতা কখনো মানুষকে থামিয়ে রাখতে পারেনা।
আর আমার বেলা অবেলায় দেখা স্বপ্ন, আমার অভিলাষ সেগুলোও পূরণ করতে হবে। সবার জীবনে বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য থাকে আমার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য নাহয় আমার অবেলার অভিলাষ গুলো হবে।
হঠাৎ পিঠে কারো হাত পড়তেই পিছনে তাকায় তনয়া। রশ্মি হাই তুলতে তুলতে বললো,
__কিরে ঘুমাবি না?
__হ্যাঁ বলেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো তনয়া।
রশ্মি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছে, বাইরে থেকে যে, বাচ্চা তনয়াটাকে আমরা চিনি তার ভিতরটা ঠিক উল্টো। যে, বাচ্চামি করতে জানেনা, জানে সবাইকে নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্ন দেখতে। নিজের ছোট ছোট ইচ্ছা গুলোকে পূরন করার আশা করতে । ওপস স্যরি ইচ্ছা না তনয়ার ভাষায় অভিলাষ।
খুব সকালে ফজরের নামাজের সময় তনয়ার ঘুম ভাঙলো। ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙলো সকাল দশটায়। রশ্মি আটটায় অফিস চলে গেছে। তনয়াকে বলে গেছে, নাস্তা করে নিতে।
তনয়া ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে নিলো। একা ঘরে কেমন যেনো গা ছমছম করছে। মনে হয় দেয়ালগুলো ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ফোনটা নিয়ে বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ফোন করলো। ফোনটা তনয়ার বড় ভাই তানভির ধরলো। তনয়া মুখে রুমাল দিয়ে চেপে ধরে আওয়াজ বদলে কথা বললো,
__হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম।
__ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?
__আমি তনয়ার বান্ধবী নেহা বলছি। তনয়া কি বাড়ি ফিরছে?
__তনয়া, আমার সাথে আওয়াজ বদলে কথা বলার কোন দরকার নাই বাচ্চাটা।
__দাদাভাই----- কি করে বুঝলে?
০৪!!
আয়াত রশ্মিকে নিজের কেবিনে ডাকলো। রশ্মি অনেকটা ভয়ে ভয়ে কেবিনে গেলো। কারন রশ্মি জানে, প্রায় ষোল সতেরো দিন আগে যে মিথ্যা বলছিলো আজ স্যার তার জবাব চাইবে। রশ্মি আয়াতের কেবিনের সামনে গিয়ে বললো,
__মে আই কাম ইন স্যার?
__শিওর!
রশ্মি ভিতরে ডুকতেই আয়াত বললো,
__রশ্মি সেদিন তুমি মিথ্যা কেন বললা যে, তনয়ার বিয়ে হয়ে গেছে? যদি বিয়ে হতো তবে তনয়া নিজের বিয়ের আসর থেকে পালালো কি করে?
__আসলে স্যার____