আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

প্রেমাতাল - পর্ব ০৯ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


১৭!!

পুরাদস্তুর জঙ্গল যাকে বলে! কখনো বাঁশঝাড়, কখনো বিশাল বিশাল নাম না জানা গাছ, কখনো বিভিন্ন রকমের লতা, ছোট বড় পাহাড়! তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ঝিরিপথটি। হাটতে হাটতে তিতির খেয়াল করছিল দোলা সাফির সাথে ঝগড়া করছে। ঝগড়ার টপিক কোমড় সমান পানি সাফি ওকে হাটিয়ে পার করিয়েছে। আর মুগ্ধ তিতিরকে কোলে নিয়ে পার করলো! দোলা চাপা স্বরে বললেও শুনতে পাচ্ছিল তিতির। দোলা বলছিল,
-"বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু শেখ!"
সাফি বিরক্ত মুখে বলল,
-"প্রেমটা ওর সাথেই করতা।"
-"কি বললা তুমি?"
-"কি বলবো? তোমরা মেয়েরা এমন কেন? একজনকে একটা কিছু পেতে দেখলেই সেটা তোমাদেরও লাগবে! কিন্তু কেন?"
-"তুমি জানো আমি কত কষ্টে পানিটা পার হয়েছি?"
-"জানি। ইভেন তুমিও জানতা এরকম হতে পারে। জেনেই তো এসেছো। দোলা এখানে আমরা ঘুরতে এসেছি প্রেম করতে না। প্রেম ঘরের দরজা বন্ধ করেই করা যায়। তার জন্য জঙ্গলে আসতে হয়না।"
-"আবার প্রেম শুধু ঘরের দরজা বন্ধ করে না। জঙ্গলে এসেও করা যায়।"
-"উফ তুমি একটু চুপ করবা?"
-"কেন চুপ করবো? আমাকে কোলে নিলা না কেন তুমি?"
-"অদ্ভুত তো!"
-"অদ্ভুত না। বলো বলো?"
-"আমি কি ভাইয়ার মত স্ট্রং নাকি যে তোমাকে কোলে নিব? তোমাকে কোলে নিয়ে আমি হাটতে পারবো? প্রেম করার সময় দেখে নাও নাই কেন?"
-"কিহ? তুমি আমাকে মোটা বললা?"
-"কখন বললাম? আমি তো বললাম আমার কথা। তোমার ওজন ৫০ আমার ৬৩। কিভাবে কোলে করে হাটবো? তিতিরের বড়জোড় ৪৫/৪৬ হবে। সেখানে ভাইয়ার ৮০। ওর পক্ষে এটা ইজি ছিল। তোমার বেশি শখ লাগলে ওর কোলেই চড়ো গিয়ে।"
-"তুমি.. তুমি আমার সাথে কথাই বলবা না।"
-"আচ্ছা বলবোনা, যাও যাও.. হুহ।"
মুগ্ধ তিতিরের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
-"এইযে, তিতিরপাখি.. অন্যের ঝগড়া হা করে দেখতে হয়না।"
তিতির চমকে উঠে বলল,
-"না না, কই আমিতো অন্যের ঝগড়া দেখছিনা।"
-"আমি তো দেখলাম দোলা সাফি আবার লেগেছে। ওরা সারাদিন ঝগড়া করতে থাকে। এবার কি নিয়ে লাগলো?"
-"আমি অন্যের পারসোনাল কথা শুনিনা।"
মুগ্ধ হাসছিল। তিতির বলল,
-"হাসছেন যে?"
-"এমনি।"
একথা বলেই আবার হাসলো। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টালো,
-"কেমন লাগছে এই বুনো সৌন্দর্য?"
-"ভালই। কিন্তু এত মানুষ না থাকলে একটু গা ছমছমে অনুভূতি হত।"
পথে আরো পাঁচবার জোকে ধরলো তিতিরকে। পঞ্চমবার মুগ্ধ তিতিরের ঘাড় থেকে জোক ছাড়াচ্ছে এমন সময় ও বলল,
-"আচ্ছা আপনি কি জোকেদের সাথেও ভাব করে গেছেন? আমাকে পাঁচবার ধরলো আর আপনাকে একবারও না। কি আজব!"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"তোমার ব্লাডগ্রুপ কি বি+?"
-"হ্যা, আপনি কি করে জানলেন?"
-"যাদের ব্লাডগ্রুপ বি+ তাদের জোকে ধরে বেশি। মশা কামড়ায় বেশি।"
-"ও। হ্যা আপনি ঠিকই বলেছেন যেখানে কাউকে মশা কামডায় না আমাকে সেখানেও মশা কামড়ায়।"
-"হুম।"
-"আপনার ব্লাডগ্রুপ কি? যে জোকে ধরে না?"
-"ও+... এত বনে বাদারে ঘুরে বেড়াই। কোথাও জোকে ধরেনা। একমাত্র হাম হাম ঝড়নায় যাওয়ার সময় ধরেছিল একবার। ওখানে যাওয়ার রাস্তায় একটা যায়গা পড়ে। পুরো জোকের আখড়া।"
-"ওখানে আমি গেলে তো বোধহয় আমি শেষ।"
-"আমিও সেটাই ভাবছি।"
হঠাৎ মুগ্ধ তিতিরের হাত ধরে থামালো,
-"এই দাড়াও দাড়াও...।"
-"কি?"
তারপর মুগ্ধ ওর হাতের লাঠি দিয়ে গাছের ভেতর কিছু একটা দেখালো,
-"ওই দেখ।"
তিতির প্রায় লাফিয়ে উঠলো,
-"ওয়াও.. সাপ! বাট লাইট গ্রিন কালার! হাও কিউট। এত্ত সুন্দর সাপ আমি জীবনেও দেখিনি।"
-"ভয় লাগছে না?"
-"ভয় কিসের? আমি কি ওর কাছে যাচ্ছি না ও আমার কাছে আসছে? অযথা ভয় পাবো কেন?"
-"এক্সাক্টলি। এটাই অনেকে বোঝেনা। সাপ দেখলেই লাফালাফি শুরু করে দেয় ভয়ে।"
-"কিন্তু সাপের ক্ষতি না করলে
সাপ মানুষের ক্ষতি কক্ষনো করেনা।"
-"হুম, সেটাই।"
কিছুদূর যেতে না যেতেই সামনে দিয়ে একটা কুকুর আসছিল। একটু দ্রুতই হাটছিল কুকুরটা। কাছাকাছি আসতেই তিতির পেছনে দৌড়ে এসে ধাক্কা খেল মুগ্ধর সাথে। ওকে দৌড় দিতে দেখে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসছিল। মুগ্ধ কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিল। তারপর বলল,
-"জোকে নয়, সাপে নয়, ডাকাতে নয়, এমনকি পুরুষ মানুষেও নয়। বাঘিনী কিনা কাবু হলো কুকুরে?"
-"উফ আপনি মারাত্মক খারাপ লোক! সব মানুষেরই তো কোনো না কোনো ফোবিয়া থাকে। আমার আছে কুকুর ফোবিয়া। এটা নিয়ে এত মজা নেয়ার কিছু নেই।"
মুগ্ধ হাসছিল। তিতির বলল,
-"এত হাসছেন যে! নিজে মনে হয় কিছুকেই ভয় পান না?"
-"হুম পাইতো।"
-"কি ভয় পান?"
তিতিরের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-"মেয়েমানুষ!"
বলেই হেসে দিল মুগ্ধ।
ঝিরিপথ ধরে প্রায় আড়াই ঘন্টা হাটার পর দূর থেকেই জলপ্রপাতের জলকেলির শব্দ শুনতে পেল ওরা। কিন্তু তখনও জলপ্রপাতটা দেখা যাচ্ছিল না। তিতির আনন্দে লাফিয়ে উঠলো,
-"এসে গেছি!"
মুগ্ধ জানালো,
-"না মাত্র তো পানির শব্দ এল। আসলে ওখানে এত জোড়ে জোড়ে পানি পড়ে যে দূর থেকেও শব্দ শোনা যায়।"
-"ও।"
তারপর আরো ১৫/২০ মিনিট হাটার পর দেখা মিলল নাফাখুম জলপ্রপাতের। তিতির দূর থেকে দেখতে পেয়েই দৌড়ে গেল জলপ্রপাতের কাছে। চোখে না দেখলে ভাবা যায় না কী ভয়ঙ্কর এর সৌন্দর্য! ৪০ ফিট প্রশস্ত এই জলপ্রপাত। যেমন এর রূপ তেমনই তার গর্জন। ভয়ঙ্কর স্রোতে পানি আছড়ে পড়ছে রেমাক্রি খালে। তবে খালটা এখানে তুলনামূলক সরু যার দুপাশে পাথরের পাহাড়। সেই পাহাড়ের উপরেই ওরা দাড়িয়ে আছে। বিশাল জায়গা জুড়ে কি বিচিত্র সেই পানি পড়ার আওয়াজ। কোথাও ঝরঝর, কোথাও গমগম, কোথাও কলকল। সামনে, পাশে, একটু দূরে, আরও দূরে শুধু উন্মত্ত স্রোতধারা। অজস্র স্রোতধারাগুলো মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা লেগেছে কে কত জোরে, সবেগে আছড়ে পড়তে পারে। জলপ্রপাতটায় দুটো স্টেপের মত আছে। প্রথম স্টেপ থেকে ভয়ঙ্কর সেই স্রোতধারা গুলো সেকেন্ড স্টেপে গিয়েই ছড়িয়ে পড়ছে খালে। খালের পানিগুলোর রঙ সবুজ। কিনারে দাঁড়িয়েই পানির ছাট লাগছিল তিতিরের গায়ে। তিতির একটা কথাও বলছিল না। অবাক চোখে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছিল। মুগ্ধ এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। অন্যরা দুএকজন ওদের মতই কোনো এক কিনারে দাড়িয়ে জলপ্রপাতের তেজস্বী সৌন্দর্য দেখছে। আর ম্যক্সিমামই ছবি তোলায় ব্যস্ত।
কিন্তু আধুনিকতার কোন ছোঁয়াই এখানে এখনো পৌঁছায়নি বলে নাফাখুমের ভার্জিনিটি পুরোপুরি অনুভব করা যায়। স্রষ্টার তুলির স্পর্শে যেন সবকিছুই এখানে বর্ণময়। ফুল, পাখি, প্রজাপতি প্রকৃতির সমস্ত রং যেন এরা উজাড় করে পেয়েছে। নাম না জানা মিষ্টি পাখির ডাক পাহাড় থেকে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
মুগ্ধ বলল,
-"এখানে কিছুক্ষন থাকলে এক অদ্ভুত মোহময় ও প্রাচীন অনুভূতির গন্ধ পাওয়া যায়। তুমি কি পাচ্ছো?"
-"হুম পাচ্ছি বোধহয়। আর আমি এতক্ষণ এটাই ভাবছিলাম কিন্তু ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কি অসাধারণ!"
-"হুম। বান্দরবানের প্রাকৃতিক রূপ উপভোগ করতে হলে অবশ্যই নাফাখুমে একবার আসা উচিৎ।"
-"সত্যি। আচ্চা এর নাম নাফাখুম কেন হল?"
-"এটা নিয়ে স্থানীয়দের বেশ কয়েকটি মিথ আছে। তার মধ্যে যেটা বহুল প্রচলিত সেটা বলি, ম্রোং ভাষায় খুম মানে জলপ্রপাত। আর নাফা হলো নথ! আই মিন নোসপিন। তো আগে এখানে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যেত তাদের নাকে নথ পড়িয়ে রাখা হত। তাই এর নাম নাফাখুম।"
-"মাছ পাওয়া যেত মানে? এই খালে মাছ পাওয়া যেত?"
-"হ্যা তবে বেশি পাওয়া যেত গর্তে।"
-"গর্ত আবার কোথায়?"
-"এইযে বিশাল উন্মত্ত জলরাশি দেখতে পাচ্ছো এর নিচে ছোট ছোট গর্ত আছে যার মুখগুলো ম্যানহোলের সমান। কিন্তু অনেক গভীর, ৩০/৪০ ফিট পর্যন্ত। ওখানেই মাছ বেশি থাকতো।"
-"সেকী! তাহলে তো এখানে নামাটা খুবই রিস্কি। কখন কে ওইসব গর্তের মধ্যে ঢুকে যাবে কেউ কিছু করতেও পারবে না।"
-"ওই স্রোতের ওখানে গেলে গর্তে ঢোকার সময় পাবেনা। স্রোতই ভাসিয়ে খালে ফেলে কোথায় নিয়ে যাবে টেরও পাবেনা।"
-"ওহ।"
হঠাৎ সাফির গলা পাওয়া গেল,
-"ভাইয়া, এদিকে আয়। ওরা অনেকেই নামতে চাচ্ছে। আমার সাহস হচ্ছে না ওদের নামতে দিতে। তুই আগে নেমে দেখা কিভাবে নামতে হবে। তারপর যদি কেউ সাহস করে তো নামবে।"
মুগ্ধ সাফিকে বলল,
-"ওয়েট আসছি।"
তারপরর তিতিরকে বলল,
-"আপনি নামবেন নাকি?"
-"হুম।"
-"প্লিজ নামবেন না। এটা ভয়ঙ্কর রিস্কি যায়গা।"
-"আমার কিছু হবে না। আমি ওই খালে সাঁতারও কেটে আসতে পারবো। তাছাড়া আমার কাছে প্রটেকশন আছে। চলো চলো।"
তিতিরের বুক দুরুদুরু করছিল। কি করছে মুগ্ধ এটা। কেন করছে? সাফি থামাচ্ছে না কেন? এত রিস্ক নেয়ার কি দরকার? যায়গাটা তো সত্যিই অনেক ভয়ঙ্কর। মুগ্ধ ব্যাগ থেকে একটা বেল্টের মত কি বের করলো তার দুপাশে দড়ি বাধা। সেটাকে কোমরে আটকে নিল। জলপ্রপাতের দুপাশে কয়েকজন করে সেই দড়ি ধরে রাখলো। আর মুগ্ধ জলপ্রপাতের উপরের দিকটায় নামলো। সেখানে শুধু ছোট বড় পাথর আর জলপ্রপাতের স্রোতের পানির শুরু। তিতিরের মন চাইছে গিয়ে ওদের সাথে দড়িটা ধরতে। ওর মনে হচ্ছিল ও যদি দড়িটা না ধরে তাহলে মুগ্ধ সেফ থাকবে না। কিন্তু তিতিরের সব ভয় দূর হয়ে গেল যখন দেখলো মুগ্ধ তড়তড় করে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে লাগলো। নিচের দিকে স্রোতের তেজও বেশি পানিও বেশি। আস্তে আস্তে মুগ্ধ সেকেন্ড স্টেপটায় চলে গেল। পুরো জলপ্রপাতের পানি ওখানটায় গিয়েই পড়ছে। তিতিরের এবার নিঃশ্বাস টাই আটকে গেল। মুগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে আর স্রোতের ধাক্কায় বাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস যারা দড়ি ধরে ছিল তারা খুব শক্ত করে ধরে ছিল, আর মুগ্ধও পায়ের উপর সব জোড় দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর দড়িওয়ালাদের উদ্দেশ্য করে মুগ্ধ কিছু বলল। কিন্তু পানির শব্দে তিতির তা বুঝলো না। হঠাৎ দেখলো মুগ্ধ পায়ের ভয় ছেড়ে দিয়েছে। দড়িওয়ালা রা আরো শক্ত করে দড়ি ধরে আছে। মুগ্ধ তখন পানিতে ভাসছিল। আর কান্নায় ভাসছিল তিতিরের চোখদুটো। কেউ দেখলো না অবশ্য। সবার নজর তখন মুগ্ধর দিকে। একসময় এই দৃশ্যটাও তিতিরের চোখে সয়ে গেল। কান্না থামিয়ে চোখ মুছলো। এবার আর ভয় করছেনা। অনেকক্ষণ ওভাবে থাকার পর মুগ্ধ আবার পা ফেলল পাথরে। তারপর আস্তে আস্তে উঠে এল। উপড়ে উঠেই ব্যাগ থেকে পানি বের করলো এবং হাফ লিটারের পানির বোতল একটানে শেষ করলো। তারপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে হাপাতে লাগলো। একটা পা সোজা আরেকটা পা ভাজ করা ছিল। হাফ প্যান্ট পড়া মুগ্ধর ভেজা পায়ের হাটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। লোমগুলো ভিজে কেমন হালকা সবুজ একটা ভাব এনেছে। ওগুলো যেন ডাকছে তিতিরকে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল পা গুলো ধরতে। কিন্তু মেয়েদের সব ইচ্ছে পূরণ হয়না। এমনকি বলাও যায়না।
কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে উঠে বসলো মুগ্ধ। একজন এসে বলল,
-"ভাই বেশি খারাপ লাগছে?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আরে নাহ! ইট ওয়াজ স্পিচলেস! আমি জাস্ট একটু রেস্ট নিয়ে নিলাম। এটা আমার লাইফের সেকেন্ড টাইম। প্রথমবার যখন এসেছিলাম তখনও এরকমই করেছিলাম। তবে হ্যা পানির স্রোত অনেক শক্তিশালী।"
সাফি বলল,
-"নামার ইচ্ছে ছিল। বাট তুইই বাকা হয়ে যাচ্ছিলি। আমি তো দাঁড়িয়েই থাকতে পারবো না বোধহয়।"
দোলা সাফিকে বলল,
-"এই না তুমি নেমোনা। অতিরক্ত ভয়ঙ্কর ছিল ব্যাপারটা।"
দেখা গেল কেউই সেভাবে নামলো না। উপরের দিকে নেমে হাত ধরাধরি করে পা ভিজিয়ে হেটে চলে আসলো। মুগ্ধ একা হতেই তিতির ওর কাছে গিয়ে বলল,
-"আমাকে ওখানে নিয়ে যাবেন?"
-"তুমি যাবে?"
-"হ্যা। একা তো আর যেতে পারবো না। আপনি যদি নিয়ে যান তো যাব।"
-"সিওর?"
-"১০০% কিন্তু আপনি আবার নামলে আবার কষ্ট হবে।"
-"কিসের কষ্ট? আবার নামলে আবার ফিল করতে পারবো। খালি কনফার্ম করো সত্যিই যাবা কিনা।"
-"সত্যিই যাব।"
আবার একই ভাবে সব ব্যবস্থা হলো। এবার একই বেল্টের মধ্যে দুজন। সবাই তিতিরের সাহস দেখে রীতিমত অবাক। যদিও একই বেল্টের মধ্যে দুজন বাধা ছিল তবু তিতির জোকের মত আঁকড়ে ধরেছিল মুগ্ধকে। আস্তে আস্তে উপর থেকে নিচে নামার সময়েই তিতিরের পা ফেলতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ভাল লাগছিল খুব বেশি। সেকেন্ড স্টেপে যেতেই তিতিরের পা ভেঙে আসছিল। স্রোতের এত জোড়! মুগ্ধ বলল,
-"ভরসা আছে তো আমার উপর?"
-"১০০% আছে।"
মুগ্ধ তিতিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে তিতিরকে উঁচু করলো। এবার আর মুগ্ধ পাথর থেকে পা সরালো না। তিতির চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। দু'পাশ থেকে উপর থেকে সব দিক থেকে স্রোতের পানি এসে পড়ছিল ওর গায়ে। তখন ও ভাসছিল জলপ্রপাতের উত্তল স্রোতধারায়। ভাসছিল প্রেমের জোয়ারেও। এখন আর কষ্ট হচ্ছে না। স্রোত তিতিরের পা এমনভাবে ভাসিয়ে নিয়েছে যে তিতিরের মনে হচ্ছিল ও সেই স্রোতের উপর শুয়ে আছে। বালিশটা ছিল মুগ্ধর শক্ত বুক! তখন পর্যন্ত ওটাই ছিল ওর জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত! হঠাৎ তিতির উপরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মুগ্ধ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুগ্ধর চোখে চোখ পড়তেই তিতির হাসলো, হাসলো মুগ্ধও।

১৮!!

জলপ্রপাতের পানিতে ভাসতে ভাসতে আর স্রোতের ধাক্কা খেতে খেতে তিতিরের সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে পড়ছিল। তিতির পানি থেকে ওঠার কথা মুগ্ধকে বলতে গিয়ে দেখলো কোনো কথাই বলতে পারছেনা। কথা বলার জন্য যে মিনিমাম শক্তিটুকু দরকার তা ওর ওই মুহূর্তে ছিলনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুগ্ধ বলল,
-"এইযে তিতিরপাখি, চলো এবার ওঠা যাক। এর বেশি থাকলে পরে তোমার কষ্ট হবে।"
তিতির কিছু বলতে পারলো না। মুগ্ধ ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই উপরে উঠলো। সাথে সাথে দোলা এসে ওদের বেল্ট আর দড়ি খুলে দিল। তিতির নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়েছে। মুগ্ধর ব্যাগে আরো দুই বোতল পানি ছিল। একটা বের করে তিতিরকে খাওয়ালো। তিতির অর্ধেকটা পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো। মুগ্ধ বাকি পানিটুকু খেয়ে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিল। হঠাৎ তিতিরের দিকে তাকাতেই দেখলো তিতির উঠে বসেছে। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর হাসছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তাকিয়ে আছে জলপ্রপাতের সেই স্রোতধারা গুলোর দিকে। কিছুক্ষণ পর তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল,
-"আপনি জানেন না আপনি আমাকে আজ কি দিয়েছেন! এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। যতক্ষণ আমি ওখানে ছিলাম আমার মনে হচ্ছিল আমি অন্য কোনো এক জগতে আছি। যদিও আমার একফোঁটা শক্তি ছিলনা কিন্তু আমার খুব ভাল লাগছিল। খুব খুব খুব!"
মুগ্ধ হাসলো শুধু কিছু বললনা। দোলা বলল,
-"এত ভাল লাগছে তাহলে কাঁদছ কেন?" তিতির হাসতে হাসতে বলল,
-"আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না আপু। আমার এই কান্নাটা অবশ্যই খুশির কান্না! আমার জীবনে এত সুখের মুহূর্ত আগে কখনো আসেনি। কিন্তু কেন জানিনা কান্নাটা আমি থামাতে পারছিনা।"
মুগ্ধ বলল,
-"আমি তো দেখছি তুমি হাসিটাও থামাতে পারছ না!"
তিতির আবার হাসলো। মুগ্ধ ব্যাগ থেকে টাওয়াল বের করে দিল। বলল,
-"নাও মাথাটা ভাল করে মুছে নাও।"
তিতির টাওয়াল নিল। মুগ্ধ ব্যাগ নিয়ে উঠে কোথায় চলে গেল। একটু পর ভেজা থ্রি-কোয়ার্টার পালটে শুকনো একটা পড়ে ফিরে এল। তিতির এখনো সেই যায়গায় একা একা বসে আছে। আর গ্রুপেরই একটা ছেলে ওর দিকে তিতিরের দিকে তাকিয়ে আছে। নজরটা যে কোনদিকে তা বুঝতে মুগ্ধর অসুবিধা হলো না। ট্রিপে এসে ছেলেটাকে কিছু বলাও তো যাবে না। তিতিরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-"তিতির ব্যাগ তো আনোনি না?"
-"না।"
-"এক্সট্রা কাপড় যখন আনোনি ভেজাটা উচিৎ হয়নি।"
তিতির বলল,
-"প্রব্লেম নেই।"
-"প্রব্লেম আছে। দোলা ছোট একটা ব্যাগ এনেছে, ওকে জিজ্ঞেস করো তো ওর কাছে এক্সট্রা কাপড় আছে কিনা।"
তিতির উঠে গিয়ে দোলার সাথে কথা বলে ফিরে এল। বলল,
-"আপু ব্যাগে কাপড়চোপড় আনেনি। শুকনো খাবার এনেছে।"
-"ও।"
তারপর মুগ্ধ নিজের ব্যাগ থেকে একটা টি-শার্ট বের করে তিতিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-"নাও এটা পড়ো।"
তিতির অবাক চোখে,
-"এটা আপনার?"
-"হ্যা।"
এবার তিতির হো হো করে হেসে উঠলো,
-"ওর মধ্যে দুটো আমি ঢুকতে পারবো।"
-"সেটা আমি জানি। লাগলে তিনটা তুমি ঢোকো গিয়ে। যাও, আর একটা কথাও না বলে চেঞ্জ করে এসো। ওই ঝোপের আড়ালে গিয়ে চেঞ্জ করো।"
-"থ্যাংকস বাট সত্যি কোনো দরকার নেই। আমার ঠাণ্ডা লাগবে বলে বলছেন তো? আমার এটুকুতেই ঠান্ডা লাগেনা, কোনো প্রব্লেম হবেনা। এটা আপনিই পড়ুন।"
-"তিতির বাম পাশের চেক শার্ট পড়া ছেলেটা তোমার ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি দেখেছি, দেখে খুব রাগ লেগেছে। মন চাইছিল চোখদুটো গেলে দিই। ট্রিপে কোনো ঝামেলা করতে চাচ্ছিনা। তাই বলছি চেঞ্জ করো।"
তিতিরের চোখগুলো রসগোল্লা হয়ে গেল। নিজের কানকে বিঃশ্বাস করতে পারছিল না। মুগ্ধ বলল,
-"একদম ডিরেক্টলি না বললে কিছুই বোঝোনা কেন? আজব!"
তিতির আর একটা কথাও না বলে টি-শার্ট টা নিয়ে ঝোপের মধ্যে চলে গেল। তারপর টি-শার্ট টা বুকে জড়িয়ে ধরলো, স্মেল নিল। ইশ, মুগ্ধ কত খেয়াল রাখে ওর যতটা ও নিজেও রাখতে পারেনা। উড়তে ইচ্ছে করছে, উড়তে! মুগ্ধর স্মেলটাও এত মারাত্মক কেন?
মুগ্ধর টি-শার্ট টা তিতিরের হাটু সমান লম্বা হয়েছে, আর এত ঢোলা যে আরো দুএকজন ঢুকতে পারবে। তাতে কিছু যায় আসেনা। মুগ্ধর টি-শার্ট পড়া মানে অনেক কিছু যা কেউ বুঝবে না। আরেকবার টি-শার্ট টা নাকের কাছে এনে স্মেল নিয়ে বেড়িয়ে এল ঝোপের বাইরে। ওকে দেখে দোলা হেসে দিল। আরো অনেকেই হাসলো বোধহয় কিন্তু ও একটুও অস্বস্তিবোধ করছিল না। খুব পার্ট নিয়ে ছিল।
এবার ফেরার পালা। প্রায় ৪-৫ ঘন্টা নাফাখুমে কাটিয়ে ওরা ফেরার পথে হাটা ধরলো। পথে তিতিরকে ৯ বার জোকে ধরলো, মুগ্ধ একইভাবে জোক ছাড়িয়ে দিল। সবারই কেমন যেন কথাবার্তা ফুরিয়ে গেছিল, জলপ্রপাতের ঘোর কারোরই কাটেনি। সেই কোমড় সমান পানির যায়গায় এসে মুগ্ধ বিনাবাক্যে তিতিরকে কোলে নিয়ে হাটা শুরু করলো। কোলে নিতেই তিতির ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। একটা অদৃশ্য অধিকারবোধ দুজনের মধ্যেই কাজ করছিল। মুগ্ধর টি-শার্ট তিতিরকে দেয়ার কারনে মুগ্ধ ছিল খালি গায়ে। এটাও একটা দেখার মত দৃশ্য ছিল। তিতিরের কেমন যেন লাগছিল! মুগ্ধ ছিল খালি গায়ে আর লজ্জা লাগছিল ওর। হাতগুলো মুগ্ধর খালি গায়ে লাগছিল। আর যখনি সে হাতের কুনুই ওর বুকের লোমগুলোর সাথে লাগছিল তখন সুড়সুড়ি লাগছিল তিতিরের। যেদিন এসেছিল সেদিন মুগ্ধর মুখে খুব ছোট ছোট দাঁড়ি ছিল। এখন সেগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। তিতির সেদিকে তাকিয়ে ছিল। মুগ্ধকে এখন আরো বড় বড় লাগছে। তিতির মুগ্ধর গলার পিছনে দুহাত বেধে রেখেছিল। হঠাৎ একটা হাত দিয়ে মুগ্ধর গলা জড়িয়ে আরেকটা হাত নামিয়ে মুগ্ধর দাড়িতে রাখলো। মুগ্ধ চমকে তাকালো তিতিরের দিকে। তিতির লজ্জা পেয়ে ওর দাড়ি ছেড়ে দিয়ে আবার গলার পিছনে হাত বাধলো।
রেমাক্রি ফিরতে ফিরতে বিকাল ৫ টা বাজল। সবাই ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে নিল। তারপর যে যার মত রেস্ট নিচ্ছিল। তিতির বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। খুব ক্লান্ত লাগছিল। পা গুলো যেন ভেঙে আসছিল। জানালা গুলো নিচু হওয়ার কারনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নদী, পাহাড় সবই দেখতে পাচ্ছিল তিতির। হঠাৎ বারান্দায় মুগ্ধকে দেখা গেল। মুগ্ধ ওকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করল,
-"কি ব্যাপার? ঘুমকুমারী না ঘুনিয়ে তাকিয়ে আছে যে!"
-"আমার এত ক্লান্ত লাগছে যে ঘুমাতেও পারছিনা।"
-"আরে ঘুরতে আসলে ওরকম একটুআধটু হয়। রাতে একবারে ঘুমিও। এখন চলো তো।"
-"কোথায়?"
-"রেমাক্রি বাজারে যাব। চলো মজা হবে।"
-"কি মজা?"
-"বাজারে কতরকম ফল, সবজি ওঠে। সব তুমি চিনবেও না।"
-"না প্লিজ আমি যাব না, আপনি যান। আমি এখন আরো হাটলে মরেই যাব।"
-"এহ! তুমি হাটলা কখন? কোলে কোলেই তো গেলে আসলে। আর জলপ্রপাতের পানিতে? সেখানেও তো কোলেই ছিলে।"
তিতির অবাক হয়ে বলল,
-"মানুষের উপকার করে আবার খোঁটা দিচ্ছেন? কি খারাপ আপনি।"
-"সেটাতো অবশ্যই।"
-"আপনি যান। আমি যাবনা।"
-"কোলে করে নিলে যাবে?"
তিতির মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। মুগ্ধও হেসে দিল। তারপর বলল,
-"আচ্ছা তুমি রেস্ট নাও। আমি যাই।"
তিতির কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা ওর মনে নেই। ঘুম ভাঙলো দোলার ডাকে। উঠতেই দোলা বলল,
-"আহা ঘুমিয়ে ছিলে, ওদিকে তোমার আশিক তো তোমাকে ছাড়া মরেই যাচ্ছিল। মনের দুঃখে শেষে রান্নাই করতে চলে গেল।"
তিতির লজ্জা পেয়ে হাসলো। দোলা বলল,
-"আরে এত লজ্জার কি আছে? আমিই তো।"
-"নাহ আসলে তেমন কিছু না।"
-"ইশ আর লজ্জা পেয়ে মিথ্যে বলতে হবেনা। আমরা এতক্ষণ তোমাদের এডভেঞ্চারের গল্প শুনছিলাম।"
-"কোন গল্প?"
-"ডাকাতের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার গল্প।"
-"ওহ।"
-"তাইতো বলি দুজনের মধ্যে এত ভাব হলো কখন?"
তিতির কি বলবে লজ্জায় তো শেষ হয়ে যাচ্ছিল। দোলা বলল,
-"তুমি খুব লাকি বুঝলে? তোমার আগে কোনো মেয়েকে ভাইয়া এতটা প্রায়োরিটি দেয়নি। ওদের একটা কাজিন আছে 'ইকরা'। ভাইয়াকে পাগলের মত লাভ করে আর ভাইয়া পাত্তাই দেয়না।"
হঠাৎ তিতিরের মনে পড়লো সেইযে মেসেজ দেয় 'পেরা' সেই ইকরা নয়তো? কিন্তু সে তো ভার্সিটির, কাজিন তো না। নাকি কাজিনই বাট একই ভার্সিটিতে পড়ে। দোলা বলল,
-"এই বলোনা, কিভাবে প্রোপোজ করল?"
তিতির বলল,
-"প্রোপোজ! তুমি ভুল ভাবছো.. সত্যি প্রোপোজ করেনি। আমাদের মধ্যে তেমন কিছুই হয়নি।"
দোলা অবাক হয়ে বলল,
-"ভাইয়াও তাই বলল। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। আই মিন তোমাদের মধ্যে রিলেশনশিপ চলছে সে ব্যাপারে আমি সিওর ছিলাম তা নাহলে কোলে নেয়া। একই দড়িতে পানিতে নামা। দুজনের কথাবার্তা, দুজনের দুজনের দিকে তাকানো! এসব কিভাবে সম্ভব!"
তিতির এবার বলল,
-"আসলে আমি ওনাকে পছন্দ করি। উনিও হয়তো করে কিন্তু কিছু বলেনি তো কখোনো। তাই সিওর না।"
-"ওয়াও, দ্যাটস গ্রেট। তুমি তাহলে ওকে বলে দাও তোমার ফিলিংসের কথা।"
-"না না আমি বলতে পারবো না।"
-"কেন?"
-"উনি যদি পছন্দ না করে আর রিজেক্ট করে তাহলে মানতে পারবো না। তার চেয়ে অপেক্ষা করি।"
-"সেকী! রিজেক্ট কেন করবে?"
-"হতেও তো পারে ওনার আমাকে পছন্দ না। আফটারঅল মাত্র ৩/৪ দিন ধরে চিনি আমরা একে অপরকে।"
-"আরে আমরা তো চিনি ভাইয়াকে। ও ভাল না বাসলে এরকম করতোই না।"
-"তবু আমি অপেক্ষা করবো আপু।"
-"কতদিন অপেক্ষা করবে? এর মধ্যে যদি অন্য কেউ ঢুকে পড়ে? আর ভাইয়া তার হয়ে যায়?"
-"উনি আমার হলে কখনোই অন্য কেউ ঢুকে পড়তে পারবে না। আর ঢুকলেও উনি তার হবে না। হলে বুঝতে হবে আমি ভুল ভেবেছি। উনি আসলে আমাকে ফিল করেনি।"
-"হায় আল্লাহ! কোন দুনিয়ায় আছি।"
তিতির দোলার হাত ধরে বলল,
-"প্লিজ আপু আমাকে ছুঁয়ে বলো যে তুমি ওনাকে আমার ফিলিংসের কথা কিছু বলবে না। আমি চাই উনি নিজ থেকে আমাকে বুঝুক আর প্রোপোজ করুক।"
দোলা তিতিরের হাত ধরে হেসে বলল,
-"আচ্ছা বলবোনা। দোয়া করি খুব তাড়াতাড়ি আমার বড় জা হয়ে যাও।"
তিতির লজ্জা পেয়ে গেল। দোলা হাসতে হাসতে বাইরে বেড়িয়ে গেল।
রাতে সবাই খেতে বসেছে। তিতির বারান্দায় দড়িয়ে ভাবছিল মুগ্ধরই কথা। এমন সময় পিছন থেকে মুগ্ধ বলল,
-"এইযে সুন্দরী, আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে যাচ্ছি।"
-"মোটেই খোঁজেননি। আমি এখানেই ছিলাম।"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"আচ্ছা আচ্ছা, তোমার ক্লান্তি গেছে?"
তিতির হেসে বলল,
-"হুম, ঘুমিয়েছি না?"
-"পা ব্যাথা?"
-"পা ব্যাথা আছে। এত হাঁটিনিতো কখনো।"
-"ওহ। হুম ডিনার করে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিও। ব্যাথা কমে যাবে।"
-"আচ্ছা।"
-"তোমার জন্য বাঁশ রেঁধেছি। চলো খাবে।"
-"কি?"
মুগ্ধ হেসে বলল,
-"বান্দরবানে বলেছিলাম না বাঁশ কুরুইল খাওয়াবো সুযোগ পেলে? ওটাই রান্না করেছি। ওটা আনতেই বাজারে গিয়েছিলাম।"
বাঁশ কুরুইল টা সত্যি অসাধারণ ছিল। নরম নরম আর খুব টেস্টি। চিকেন দিয়ে ঝাল ঝাল করে রান্না করেছে মুগ্ধ। তিতিরের মনে হলো এত সুস্বাদু খাবার ও আর খায়নি। খেতে খেতে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছিল,'আমি আপনার কাছ থেকে সব রান্না শিখবো। তারপর আর আপনাকে রাঁধতে দেবনা। আমি আপনাকে রেঁধে খাওয়াবো।'
খুব ভোরে ওরা রওনা দিয়েছিল যাতে রাতে থানচিতে থাকতে না হয়। কারন, থানচি যায়গাটা কারোরই তেমন পছন্দ হয়নি। সন্ধ্যার মধ্যেই ওরা বান্দরবান পৌঁছলো। তারপর রাতের বাসে ঢাকা। ঢাকার বাসেও তিতির মুগ্ধ পাশাপাশি বসলো। তিতিরের মন খারাপ লাগছিল। পথ তো শেষ হয়ে যাচ্ছে, মুগ্ধ এখনো কিছু বলল ন। মুগ্ধ আর ও টুকটাক কত গল্প করছে। ম্যক্সিমাম ট্রাভেলিং রিলেটেড। ১০ দিনের ট্যুর ৫ দিনে শেষ হয়ে গেল পারমিশন না পাওয়ার কারনে। ৪০% টাকা ফেরত পেল। এই টাকা দিয়ে তো অন্য কোথাও ঘুরে আসা যায়! তিতিরের ইচ্ছে করছে মুগ্ধর সাথে অন্য কোথাও চলে যেতে কিন্তু ও কখনোই তা বলতে পারবে না। এত চিন্তার মধ্যেও ও বেশ কয়েকবার ঘুমালো। উঠলো, গল্প করলো। কিন্তু মুগ্ধ কিছুই বলল না।
আস্তে আস্তে একসময় সকাল হল। বাস চলে এল ঢাকায়। মুগ্ধ আর তিতিরের গন্তব্য একই যায়গা, ধানমন্ডি ১১ নম্বর রোড। দুজনে একটা সিএনজি নিল। তিতিরের বাসার সামনে এসে মুগ্ধ সিএনজি ছেড়ে দিল। একটা বাসা পরেই ওর বাসা। হেটেই চলে যেতে পারবে।
দুজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিতিরের বাসার সামনে রাস্তার অপজিটে। দুজনেরই মন খারাপ। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। ভেবে পেলনা কি বলবে। একসময় মুগ্ধ ম্লান হেসে বলল,
-"ওকে বাসায় যাও তাহলে।"
-"হ্যা যাচ্ছি।"
-"ভাল থেকো। নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। সাবধানে থেকো।"
-"আপনিও ভাল থাকবেন।"
তিতির আর দাঁড়ালো না, চলে গেল। গেটের সামনে গিয়ে তিতির একবার পিছন ফিরে তাকালো। মুগ্ধ পকেটে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে ফিরে তাকাতে দেখেই হাসলো। তিতিরও একবার হাসলো। তারপর গেটের ভেতর ঢুকে গেল।
তিতির ভেতরে যাওয়ার পর মুগ্ধ উলটো ঘুরে নিজের বাসার দিকে হাটতে লাগলো। বাসার গেটের ভেতর ঢুকতেই মনে পড়লো তিতিরের ফোন নাম্বারটাই তো আনা হয়নি! কোনরকমে গেটটা খুলে দৌড় দিল। এক দৌড়ে চলে এল তিতিরের বাসার সামনে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
অন্যদিকে এক সিঁড়ি উঠে দোতলার অর্ধেকে যেতেই তিতিরের খেয়াল হল মুগ্ধর ফোন নাম্বার নেয়া হয়নি। এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমতেই বাবার সাথে ধাক্কা লাগলো। বাবা ওকে দেখে খুশিতে বলে উঠলো,
-"ওরে বাবা! আমার আম্মা দেখি ১০ দিনের যায়গায় ৫ দিনে এসে গেছে। কিন্তু আম্মা দৌড়াচ্ছে কেন?"
-"বাবা সিএনজিতে আমার পার্স ফেলে এসেছি।"
এছাড়া আর বিশ্বাসযোগ্য কোন কথা খুঁজে পেলনা তিতির। বাবা বলল,
-"বাইরে তো কোন সিএনজি নেই।"
-"ওহ! বাবা আমি আরেকটু খুঁজে দেখি?"
-"নেই তো মা। বাদ দে। কি এমন ছিল পার্সে?"
-"টাকা।"
-"ওহ। তাতে কি হয়েছে? টাকা গেছে যাক। আমার মেয়ে তো সেফলি ফিরে এসেছে।"
-"বাবা ওতে পাঁচ হাজার টাকা ছিল। ট্যুরের টাকা বেচে যাওয়ার ফেরত পেয়েছি। আমি ভেবেছিলাম ওটা দিয়ে কিছু করবো। বাবা আমি যাই?"
-"আরে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা? চল আমি তোকে এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি। এর জন্য নাকি আমার আম্মা এত সকালে বাইরে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে।"
তিতির মন খারাপ করে বাবার সাথে সিঁড়িতে উঠলো,
-"এত সকালে তুমি কোথায় গিয়েছিলে বাবা?"
-"নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। এত সকালে আর কোথায় যাব? চল চল। উপড়ে চল। আজ আমি নিজে বাজারে গিয়ে বাজারের সবচেয়ে বড় ইলিশ মাছটা নিয়ে আসব আমার আম্মার জন্য।"
কিন্তু তিতিরের অস্থির লাগছিল। একেকটা সিঁড়ি যেন একেকটা উঁচু পাহাড়ের চেয়েও বেশি উঁচু মনে হচ্ছিল।
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।