অস্তিত্বে তুমি - পর্ব ১০ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৯!! 

-কাজটা কেন করলি মুগ্ধা? কেন জিশানকে এখানে নিয়ে এলি? আর কেনইবা জিশানকে নিয়ে একটা রঙ কনসেপ্ট নীলার মাথায় ঢুকিয়ে দিলি তুই? নীলাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার দিন থেকেই দেখছি। নীলার আমার মধ্যে না চাইতেও তুই ঢুকে পড়ছিস। বল তো কি চাস টা কি তুই? কেন এসব করছিস মুগ্ধা? চুপ করে থাকবি না মুগ্ধা। আনসার মি ড্যাম ইট।

ছোট্ট একটা বাচ্চা জিহানকে 'পাপা' ডাকছে শুনে নীলা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে করিডোর থেকে রুমের দিকেই পা বাড়িয়েছে। জিশান হঠাৎ করে এসে জড়িয়ে ধরায় আর নীলাও সেখানে চলে আসায় সব মিলিয়ে জিহান নিজেও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। নীলা কিছু না বলে চুপচাপ চলে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে জিহান জিশানকে কোলে তুলে নিয়ে নিজেও রুমের দিকে পা বাড়াবে ঠিক এমন সময় মুগ্ধা টুপ করে জিহানের সামনে এসে দাঁড়ালো। জিহান একে তো মুগ্ধার উপরে আগেই রেগে ছিল, তার উপরে এভাবে হুট করে জিশানকে নিয়ে আসার পিছনে মুগ্ধার মাথায় যে কোনো প্ল্যানিং কাজ করছে সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি জিহানের। জিহান এবারে সোজাসুজি মুগ্ধার দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলো। আর জিহানের রাগী মুখটা দেখে মুগ্ধা শব্দ করেই হেসে ফেললো এবারে। 

-ওপস! সরি সরি সরি জিহান। আমি না বুঝতে পারি নি তোমার ওয়াইফ জিশানের তোমাকে 'পাপা' ডাকতে শুনে এভাবে রিএক্ট করবে। উপস! আমি তো ভেবেছিলাম জিশান তোমাকে 'পাপা' ডাকতে শুনে ওই গাধা মেয়েটা তোমার গালে কষিয়ে দুইটা থাপ্পড় লাগিয়ে এই বাড়িটা থেকে চলে যাবে, আর তোমার পাশে, এই বাড়িতে তোমার ওয়াইফ, তোমার লাইফপার্টনার হয়ে আমি থাকবো। বাট নাহ। এই মেয়ে এতো সহজে তোমার লাইফ থেকে যাবে না দেখছি। ব্যাপার না। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে কি করে আঙুল বাঁকিয়ে ঘি তুলতে হয় সেটা আমার ভালোমতোই জানা আছে জিহান। নেভার মাইন্ড। আর মাত্র কয়েকটা দিন জিহান বেবি। তারপর এই নীলা নামের আপদটার তোমার লাইফে কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সো জাস্ট চিল।

-মুগ্ধা? হাউ ডেয়ার ইউ টু সে দ্যাট?

জিহানের একটা চড় এসে মুগ্ধার গালে পড়তেই মেয়েটা ছিটকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে পড়লো। আর জিহানের এমন রাগী আচরণে জিশান ভয়ে গুটিশুটি হয়ে জিহানের বুকের সাথে মিশে গেল। জিহান একটু শান্ত হয়ে জিশানকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মুগ্ধার দিকে তাকাতেই মুগ্ধার রাগে টকটকে লাল হওয়া মুখটা দেখতে পেল।

-এই নিয়ে সেকেন্ড টাইম ওই রাস্তার মেয়েটার জন্য তুমি আমার গায়ে হাত তুললে জিহান। এর ফলটা কিন্তু ওই মেয়েকেই ভোগ করতে হবে জিহান। ওকে আমি ছাড়বো না। আর তোমাকে? তোমাকে তো আমি নিজের করেই ছাড়বো। সোজা কথায় তুমি নীলাকে ছেড়ে আমার কাছে আসলে ভালো, নয়তো তোমাদের সুখের সংসারে কি করে আগুন লাগাতে হয় সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। এন্ড বিলিভ মি, এমন সাবধানে আলাদা করবো তোমাদের দুজনকে যে তোমরা নিজেরাও টের পাবে না, প্রমিস।

-জাস্ট গো টু হেল। জাস্ট গেট আউট ফ্রম হেয়ার।

-ওকে। আমি তো চলে যাবো। তোমার ছেলেকে কি নিয়ে যাবো হোস্টেলে? উমমমম? জিশান? পাপা না তোমার মামনির সাথে একটু বিজি আছে বুঝলে? তোমাকে আর আগের মতো সময় দিতে পারবে না বাবা। তুমি বরং আন্টির সাথে হোস্টেলে ফিরে চলো কেমন?

-জাস্ট গেট দা হেল আউট অফ হেয়ার মুগ্ধা। আর এই কাজের কি পরিণতি হবে সেটা তুই কল্পনাও করতে পারছিস না। এন্ড থ্যাংকস বাই দা ওয়ে। অনেক বড় একটা হেল্প করলি আজকে।

-টেনশনে তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে তাই না জিহান? নইলে আমাকে বের করে দেয়ার মতো এতো বড় ভুলটা করতে না তুমি। হুহ। আমার মনের মধ্যে কি চলছে সেটা তুমি সেদিনও বুঝতে পারো নি, আজও পারবে না। এর জন্যও তোমাকে পস্তাতে হবে জিহান। শুধু তোমাকে না, তোমার নীলাকেও পস্তাতে হবে। আর ওই গাধা মেয়ে যদি জিশানকে নিয়ে কোনো সিনক্রিয়েট না করে, তবে আরো বড় কোনো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করবে ওর জন্য। নট এ বিগ ডিল। 

-জাস্ট গেট লস্ট। 

 জিহান রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে মুগ্ধাকে বের করে দিয়ে মেইন ডোরটা বন্ধ করে দিল। মুগ্ধা বাড়ির মেইন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কিসব বলছে সেদিকে কান দিলো না জিহান। জিশানকে কোলে নিয়েই নীলার রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমের দরজাটা খোলা দেখে রুমে এসে নীলাকে বিছানায় মুখ নিচু করে বসে থাকতে দেখে জিহানও এক পা দু পা করে এগিয়ে এসে নীলার সামনে এসে দাঁড়ালো। নীলা মুখ তুলে এক নজর তাকিয়ে জিশানকে জিহানের কোলে দেখে আবার মুখ নামিয়ে নিল।

-নীল? তোমার সাথে দেখা করতে কে এসেছে দেখো? জিশানের সাথে কথা বলবে না?

-বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেছে। ওকে শুইয়ে দিন জিহান।

-আরে? দেখেছ? আমি খেয়ালই করি নি। শিট! নীল? জিশান আজ এই রুমে ঘুমাক? আমাদের সাথে?

-হুম।

নীলা মাথা নেড়ে সায় দিতেই জিহান ঘুমন্ত জিশানকে বিছানায় শুইয়ে দিল। আর সেই অপূর্ব দৃশ্যটা নীলা অপলকে কিছুক্ষণ দেখলো একমনে। জিশানকে শুইয়ে দিয়ে মুখ তুলে তাকাতেই নীলার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল জিহানের। জিহান ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা টেনে নীলার সামনে এসে দাঁড়াতেই নীলা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সরে আসতেই জিহান নীলার একটা হাত চেপে ধরলো। হাতে বাধা পড়তেই নীলার পা থেমে গেলেও জিহানের দিকে ফিরে তাকালো না মেয়েটা। জিহান এবারে নিজেই নীলার হাতটা টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে নীলার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের দিকে ফেরালো।

-কোথায় চললেন ম্যাডাম? আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি এখনো। কথা না শুনেই এবার রাগ করে পালালে তো চলবে না এবার। আর এবার তোমার রাগ বাড়ানোর কোনো প্ল্যানও নেই আমার। বুঝলেন ম্যাডাম? 

-আমার কিছু জানার নেই। আর আপনার আমাকে সাফাই দেয়ারও কিছু নেই। রান্নাটা কমপ্লিট হয়নি। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। ছাড়ুন।

-রান্না পরে হবে। আমার কথা শোনো আগে। আমি না ছাড়লে যেতে পারবে বলে মনে হয় তোমার?

-ছাড়ুন বললাম তো? আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না চাই না চাই না।

-নীল? আরে জিশান উঠে যাবে তো? কি করছ কি?

-ছাড়ুন? 

-আচ্ছা ছেড়ে দিবো বউপাখি। আমার কথাগুলো শুনতে শুনতেই কাজ করবে, তাহলে দুজনে মিলে একসাথে রান্নাঘরে যাবো আমরা। আর প্রস্তাবে রাজি না হলে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো, আমার বাহুডোরে বন্দি হয়ে।

-ওকে। চলুন। 

-দ্যাটস এ গুড চয়েজ ম্যাডাম। চলো। 

জিহান নীলাকে ছেড়ে দিতেই নীলা কিছু না বলে সোজা রান্নাঘরের দিকেই পা বাড়ালো। জিহানও একবার জিশানের পাশে একটা বালিশ রেখে সোজা রান্নাঘরে চলে এলো। নীলা ততক্ষণে নিজের কাজে লেগে পড়েছে দেখে জিহানও এগিয়ে এসে নীলার পাশে এসে দাঁড়ালো। নীলা দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করছে দেখে জিহান হাত বাড়িয়ে নীলার গালে আঙুল ছুঁইয়ে দিল। নীলা মুখটা সরিয়ে নিয়ে একটু সরে আসতেই এবারে হেসে ফেললো জিহান।

-এতো রাগ ম্যাডামের? আমার বউটা এতো বোকা কেন আমি বুঝি না। এতো ম্যাচিউর, অথচ মাঝেমাঝে এতো ছেলেমানুষি বিষয়গুলো নিয়ে কেন যে মেয়েটা মন খারাপ করে আমি বুঝি না। তুমি কি সত্যি সত্যি জিশানকে আমার ছেলে মনে করলে নাকি?

-আমি এতোটাও গাধা নই যে আপনাকে একটা পাঁচ ছয় বছরের বাচ্চার বাবা ভেবে বসে থাকবো। চার বছর আগে আপনার সাথে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আপনি ভার্সিটিতে থার্ড ইয়ার শেষের দিকে ছিলেন রাইট? তো এই বেবিটার বাবা হতে হলে আপনাকে আরো মিনিমাম দেড় দু বছর আগে বিয়ে করতে হবে তাই না? সেটা কি পসিবল?

নীলা ব্যস্ত হাতে চুলায় নিজের রান্নাটার উপর দিয়ে খুন্তির সাইক্লোন বইয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বলে আবার নিজের কাজ করছে দেখে জিহানও হেসে নীলাকে পিছন থেকে এক হাতে নীলার কোমড়টা জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে নীলার খুন্তি ধরা হাতটায় হাত রাখলো।

-পসিবল না কেন বলো তো? আজকাল তো কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের মধ্যেও কত কিছু হয়ে যায়। তেমন কিছুও তো ঘটতে পারে তাই না? 

জিহানের জবাবটা শুনে এবারে নীলার মেজাজটা এতো খারাপ হলো যে এক ঝটকায় জিহানকে সরিয়ে নিজেই সোজা জিহানের দিকে ফিরলো নীলা। জিহান নীলার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে নিজের হাসি আটকে রেখেছে বহু কষ্ট করে। সেটা বুঝতে পেরেও নীলার রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। 

-কি প্রবলেমটা কি আপনার? জিশান আপনার ছেলে এটা প্রমাণ করতে চাইছেন? ওকে, ফাইন। কনগ্রাচুলেশনস মিস্টার জিহান চৌধূরী। ডিজগাস্টিং!

-আমি বুঝতে পারছি না নীলপাখি। তুমি রাগ করছ কি কারণে। জিশানকে আমার ছেলে ভেবে রাগ করে চলে আসো নি। তাহলে এতো রেগে আছো কি জন্য? নাকি মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে কে জিতছে নিজেও বুঝতে পারছ না?

-আমি রাগ করবো কেন? বিনা কারণে নিজের শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হলো যার কারণে,  সে এই বাড়িতে কেন আসবে? আজ যখন জিশানকে নিয়ে এসেছে, তার মানে আগেও এসেছিল ও এই বাড়িতে?

-ওহো! এই ব্যাপার। ম্যাডামের রাগ তাহলে এই কারণে?

-কথা ঘুরাবেন না একদম বলে দিলাম। বলুন? ওই মেয়ে কেন আপনার পিছু পিছু এখানেও চলে এসেছে? আপনাকে নিয়ে আমার মনে সন্দেহ ঢোকানোর জন্যই জিশানকে নিয়ে এসেছে, এটা বোঝার মতো ক্ষমতা আমার আছে জিহান। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো কেন? কেন ওই মেয়েটা আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করতে চায়? কেন কেন কেন?

-মুগ্ধার কথা বাদ দাও তো নীলা। ওর মাথা এমনিতেই খারাপ। যখন যা চেয়েছে, যেটার জেদ করেছে, পেয়ে গেছে তো, তাই এমন বদমাইশ হয়েছে। মামা মামীর আদরের মেয়ে তো, কষিয়ে দু গালে দুটে থাপ্পড় লাগিয়ে শাসন করলে এমন বখে যেত না। ওর কথা বাদ দাও তো।

-এবারে তাহলে মুগ্ধা আপনাকে পাওয়ার জেদ করছে, তাই না জিহান?

-হোয়াট! নোওওও। শি ইজ মাই কাজিন। তুমিও ওই পাগলের চক্করে পড়ে পাগল হয়ে গেছো মনে হচ্ছে। ফরগেট অবাউট হার। আমি জিশানের কথা বলছিলাম সেটা না শুনে তুমি পড়লে মুগ্ধাকে নিয়ে। ধুর। শোনো না বাবা আমার কথাটা?

-হুম।।বলুন। শুনছি।

জিহান মুগ্ধার টপিকটা বাদ দিয়ে জিশানকে নিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু নীলার মন পড়ে আছে মুগ্ধার ব্যাপারটায়। কেন মেয়েটা নীলা আর জিহানের পিছনে পড়ে আছে? নীলাকে ও সহ্য করতে পারে না একদমই, সুযোগ পেলেই নীলাকে অপমান করার কোনো ছাড় দেয় না মুগ্ধা। কিন্তু কেন? এই কেন এর উত্তরটা মনে মনে ঠিকই টের পাচ্ছে নীলা। জিহান যত বলুক না কেন, নীলা জানে ওর এই ধারণাটা শতকরা একশো ভাগ সত্যি। একটা মেয়ে অন্য একটা মেয়ের প্রতি কখন এতো জেলাসি আর ঘৃণা নিয়ে পিছু লাগে সেটা বুঝতে মেয়েদের অন্তত ভুল হয় না।।

-তোমাকে একটা গল্প বলি নীলা। মন দিয়ে শোনো গল্পটা। আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগের কথা। রূপকথার গল্পের মতো একটা সুন্দর সংসার ছিল, একটা বিশাল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি, তাতে সুখী চারজন মানুষ। বাবা, মা, আর তাদের দুই ছেলে মেয়ে। মেয়েটা বড়, ছেলেটা তার অনেক ছোটো। রূপকথার গল্পের মতোই সেই রাজকন্যার মতো মেয়েটা পাশেরই কোনো রাজ্যের রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে। দুই পরিবারের কি নিয়ে যে এতো গভীর শত্রুতা এই দুই প্রেমিক যুগল বুঝতেই পারে না। হাজার বাঁধা পেরিয়েও এক হতে পারবে না জেনে তারা নিজেরাই সবার অজান্তে নিজেদের ছোট্ট একটা দুনিয়া সাজায়। সবার অজান্তেই তারা বিয়ে করে নেয়, যাতে কেউ তাদের আলাদা করতে না পারে। রাজকন্যার ছোট ভাইটা তত ছোটোও ছিল না যে বুঝবে না বোনের জীবনে কি চলছে। সেই রাজপুত্রের সাথে গভীর বন্ধুত্বও হয়ে যায় রাজকন্যার ভাইটির। তার পর দিন যায়, মাস আসে, দুই পরিবারই নিজেদের জেদ আর শত্রুতা ভুলে আত্মীয়তার বাঁধনে জড়াতে রাজি হয়। অথচ ভাগ্যের পরিহাস বলবে, নাকি প্রিয়জনের ধোঁকা বলবে, বিয়ের আসর পর্যন্ত এসেও রাজপুত্র আর রাজকন্যার এক হওয়া হলো না জানো? শেষ মূহুর্তে সেই শত্রু পক্ষের রাজকুমার নিজের আসল রূপটা দেখিয়ে দিয়েছে। ঠকিয়ে চলে গেছে নিজের পরিবারের কাছে, অন্য কোনো রাজকন্যাকে নিজের শিকার বানাতে। আরো মজার ব্যাপার কি জানো নীল? সেই বিশ্বাসঘাতক রাজপুত্রটি তার ভালোবাসার অংশের অস্তিত্বটাও জানতে পারে নি কোনোদিনই। কোনোদিন হয়তো জানতেও পারবে না তার এতো বড় আঘাতের পরও রাজকন্যাটি নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েও তার সন্তানকে রক্ষা করেছে, তার জিশানকে দুনিয়ার আলো দেখিয়েছে। 

২০!! 

-জিশান? কার কথা বলছেন? কে রাজকন্যা কে রাজপুত্র আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না জিহান। আর জিশানই বা আপনাকে বাবা বলে ডাকছে কেন? প্লিজ ক্লিয়ার করে বলবেন আমাকে?

জিহানের বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে মাথার মধ্যে তালগোল পাকাতে শুরু করেছে নীলার। এতো কমপ্লিকেটেড কথাবার্তা শোনার ফাঁকে রান্না করায় কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছে না মেয়েটা। আাপতত তাই কাজ ফেলে জিহানের কথা শোনায় মন দেয়ার চেষ্টা করলো। অন্তত তাতে যদি কিছু হলেও বুঝতে পারে আসলে জিহান কি বলতে চাইছে। এদিকে জিহানও নীলার হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে আবার বলা শুরু করলো।

-গল্পের সেই রাজকন্যার ছোটো ভাইটা হলাম আমি নীলা। সেই রূপকথার গল্পের মতো সুন্দর, সুখী পরিবারের গল্পটার মতো আমার পরিবারটা সেদিনের একটা ঘটনায় পুরো তছনছ হয়ে গেছে নীলা। 
চোখের সামনে আমার বোনকে ভেঙ্গে পড়তে দেখেছি। সবার অপবাদের আঙুল যখন ওর বাচ্চাটার দিকে উঠেছে তখনও নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল সেই অপমানের মোকাবেলা করার। ও তো কোনো পাপ করে নি, কোনো অন্যায় করে নি। ভালোবেসেছিল। সবাই যতই খারাপ কথা বলুক না কেন ওর সন্তানটা তো পাপের ফসল ছিল না। ওদের ভালোবাসার ফসল ছিল, দুই পরিবারের বৈধ উত্তরাধিকারী ছিল সেই অনাগত শিশুটা। অথচ একজন মানুষের, মানুষ কি বলছি, ওই অমানুষের ধোঁকায় একনিমিষেই ওদের সন্তানটাকেও সমাজের নজরে অবৈধ বানিয়ে দিয়েছিল সেদিন। তবু আমার বোনটা হাল ছাড়ে নি জানো? ওই অমানুষটাকেই বিশ্বাস করে অপেক্ষা করছিল তার ফিরে আসার। সমাজের হাজারটা লোকের হাজার কুকথা মুখ বুজে সহ্য করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল আমার বোনটা। 

জিহানের কথাগুলো শুনতে শুনতে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল নীলার। কেন জানে না মনে হচ্ছে এই ঘটনার সাথে নীলার নিজের কেউ জড়িত আছে। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? 

-জানতে চাইবে না নীল সেই বিশ্বাসঘাতক, অমানুষটা কে ছিল? 

-কে?

-তুমি তখন অনেক ছোটো ছিলে নীলা। সবটা বোঝার মতো বয়স হয়েছিল হয়তো, বাট ততটুকুই দেখেছো যতটা তোমার চোখের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই কে ভুল, কে ঠিক সেটাও অন্য কারো সিদ্ধান্তটাই তোমার নিজের ভেবে ভুল করেছ। আচ্ছা বলো তো নীল? তোমার বাবা আর ভাইয়ের সাথে আমার বিজনেস রাইভেলের বাইরেও যে আলাদা একটা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে জানো সেটা? কেন তোমার না চাইতেই সবকিছু সামনে এনে দেয়া বাবা, ভাইয়া তোমার হাজার কান্নার পরও তোমাকে আমার হাতে তুলে দিতে চায় নি জানো? 

-আমি সত্যিই জানি না। বাবা, ভাইয়া সবাই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে যতবার জানতে চেয়েছি ততবারই। ভাবিমা তো বলতে চায়,বাট ভাইয়ার কারণে বলতে পারে নি। তারপরও তো ওই ঘটনার পর বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়ার পর ভাবিমার কাছে একটা  নাম শুনলাম। কায়রা। ভাইয়া কি রেগে গেছিল নামটা শুনে। আর আজ আপনার মুখেও নামটা শুনলাম আবার। এই নামটা কেন জানি পরিচিত মনে হয় আমার খুব। কে এই কায়রা বলুন না প্লিজ? 

নীলার প্রশ্নটা শুনে জিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দরজার দিকে মুখ করে বলা শুরু করলো আবার।

-একটু আগে তোমাকে যার গল্প শোনালাম, সেই রাজকন্যার মতো মেয়েটাই ছিল কায়রা। ছোট্টো জিহানের বেস্টফ্রেন্ড, বাবা মায়ের চোখের মণি, সদ্য কৈশোরে পা রাখা এক কিশোরের সমস্ত বদমাইশির সঙ্গী। আমার ছোট্ট জিশানকে দেখলে না? ওর মা। আর-------।

-আর?

-আর? প্রায় সাতটা বছর আগে তোমার ভাই বিয়ের স্টেজ থেকে যাকে বিয়ে না করে নিহার ভাবিকে বিয়ে করেছিল, সেই মেয়েটাই ছিল কায়রা। তুমি তখন অনেকটাই ছোটো ছিলে নীল। তোমার মনে নেই হয়তো। কিন্তু কায়রা একদম আগের মতোই আছে। ভুল বললাম, বাইরে থেকে দেখে আগের মতোই একই আছে বলে ভুল হবে তোমারও। কিন্তু ভিতরটা পুরো মরে গেছে মেয়েটার। লাশের মতো বেঁচে আছে, অনেক চেষ্টা করেছিল সবটা ভুলে, সবার কটু কথাকে উপেক্ষা করে শুধু নিজের সন্তানটাকে নিয়ে বাঁচতে। কিন্তু এই ভদ্রলোকের মুখোশধারী সমাজের লোকগুলো ওর সেই সাহসটুকুও কেড়ে নিয়েছিল। তাই হয়তো আমার বোনটা বেঁচে থাকার শেস ভরসাটাও হারিয়ে ফেলেছিল। তাই নিজের সন্তানটাকে নিয়েই এই নষ্ট লোকে ভরা পৃথিবীটা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চেয়েছিল।

জিহান দরজার দিকে মুখ করে কথাগুলো বলছিল। ছেলেটার চোখের কোণা বেয়ে টপটপ করে ঝড়ছিল বলে ঝাপসা চোখে নীলার রিএকশনটা দেখতেই পায় নি জিহান। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে নীলার থতমত খাওয়া পাংশু মুখটা দেখলো জিহান। নীলার হাতটা ধরে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নিজেই রান্নার বাকি কাজে মন দিলো জিহান। নীলা জিহানের পড়নের টিশার্টটা খামচে ধরতেই জিহান কাজ করতে করতেই নীলার দিকে ফিরে তাকালো। নীলা কি বলবে বুঝতে না পেরে জিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। জিহান আবার রান্নায় মনোযোগ দিচ্ছে দেখে নীলা আবার জিহানকে আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে টানলো আরেকবার।

-মানে? কি বলছেন বলুন তো জিহান? নিজের সন্তানকে নিয়ে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চেয়েছিল মানে? তাহলে জিশান? আর লাশের মতো বেঁচে আছে মানে? কায়রা আপু কোথায় এখন? কি হয়েছে উনার? আর বারবার কেন বলছেন ভাইয়া ধোঁকা দিয়েছে? ওই দিন কি ঘটেছিল কায়রা আপুর আর আপনার ফ্যামেলির সাথে বলবেন প্লিজ?

-হাহ। ওইদিনের ঘটনাটা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে জানো নীল? কায়রা আপু আবরার ভাইয়াকে বাসায় পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ভাইয়ার সাথে কত ঘুরেছি, কত আড্ডা দিয়েছি, আজও মনে আছে আমার। তোমাদের বাবা এই বিয়েতে কিছুতেই রাজি ছিল না। যা হোক, আবরার ভাইয়ার জেদের কারণেই সেদিন কায়রা চুপচাপ কাউকে না জানিয়ে বিয়েটা করতেও রাজি হয়ে যায়। অথচ জানো? দুটো বছর পর দুটো পরিবার রাজি হওয়ার পর কি ঘটেছিল জানো নীল? বিয়ের আসরে কায়রা হঠাৎ করেই যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন আমরা কায়রাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটছিলাম, আর তোমার পরিবার? কায়রা হসপিটালে এডমিট জানা স্বত্বেও তোমার বাবা কি করলো? জোর করে তোমার ভাইয়াকে বাধ্য করলো নিহার ভাবিকে বিয়ে করতে। আর তোমার ভাই? মিস্টার আবরার খন্দকার। একটা সিদ্ধান্তে দুটো মেয়ের জীবনের সাথে সাথে একটা নতুন আশার যে কিরণ দেখা গিয়েছিল সেটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

-মানে? কিন্তু সেদিন------। কায়রা আপু এখন জিহান?

-আছে। আছে বেঁচে আছে। অবশ্য এটাকে বাঁচা বলে না মরাও বলে না। একদিন তোমাকে নিয়ে যাবো কায়রার কাছে। 

-কিসব বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। কায়রা আপুর কাছে নিয়ে যাবেন তো বুঝলাম, কিন্তু কোথায় সেটা? আর কবে নিয়ে যাবেন? আর জিশান------।

-জিশানের জন্মের পর ওকে সামলানোর মতো কেউ ছিল না। মাত্র ভার্সিটিতে এডমিট নিয়েছি। বাবা মা, নিজের পরিবার হারিয়ে মামা মামির দয়ায় শুধু বেঁচে ছিলাম নামমাত্র। এর মধ্যে ছোট্টো জিশানকে সামলানোর জন্য কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এতো ছোট্টো একটা বাচ্চা মাকে ছাড়া বেঁচে থাকার লড়াই করছে, অথচ ওর জন্য আমার কিছুই করার ছিল না। শেষে সবার কথায় জিশানকে একটা ফুলটাইম নার্সিং হোমে দিয়ে দিই। অনেকটা ফুল ডে ডে-কেয়ার হোমের মতো। তারপর কয়েকটা বছর কেটে যাওয়ার পর একটা বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেয়া হলো জিশানকে। দেখতে দেখতে আরো কতগুলো বছর কেটে গেছে। বোর্ডিং স্কুলে জিশান ওর বয়সী বাচ্চাদের কাছ থেকে বাবা মায়ের পরিচয় নিয়ে কথা না শুনলেও ওদের বাবা মাকে দেখে কেঁদে দুনিয়া ভাসাতো। মন খারাপ হলেই মায়ের বেডের পাশে বসে 'মা, মা' করে কাঁদতে পারলেও বাবা বলে ডাকার কেউ ছিল না জিশানের। তাই আমিই ওকে বলে দিয়ে আমাকেই পাপা বলে ডাকতে। তাতে অন্তত ছেলেটার একটু হলেও ভালো লাগবে। 

-জিশানকে বোর্ডিং স্কুলে? কেন?

-ওকে সামলানোর মতো কেউ ছিল না তাই। মামা বিজনেস নিয়ে বিজি, মামী সংসার সামলাতে ব্যস্ত, মুগ্ধা আর আমি বাচ্চা সামলাবো কি বলো? নিজেদেরকেই সামলাতে আরো তিনজন লাগে অবস্থা। তাই কি আর করা।

-এর পর থেকে জিশান কোথাও যাবে না জিহান। ও আমাদের সাথেই থাকবে। 

-সিরিয়াসলি নীল? আর ইউ সিরিয়াস?

নীলার জিহানের কথাটার উত্তর দেয়া হয়ে উঠলো না। এর আগেই ছোট্টো ছোট্টো দুটো হাত নীলাকে পিছন থেকে জাপটে ধরেছে। আর একটা ছোট্টো শব্দ মধুর সুরের মতো নীলার কানে এসে বাজলো।

-মামনি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন