০৫!!
দেখতে দেখতে ঈদের ১৬ দিন কেটে গিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজও খুলে ফেলেছে।
ঈশাকে স্কুলে দিয়ে আসার জন্য রেডি করাচ্ছে রূপকথা। সবার জন্য নাস্তা তৈরি করে ঈশাকে খাইয়ে দিয়ে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। ঈশাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসার সময় আরিশের সাথে দেখা হয়ে যায় রূপকথার। আরিশ গাড়ি থেকে নেমে আসে রূপকথার সামনে।
- আরে রূপকথা আপনি!
- জ্বী
- কেমন আছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ্, ভালো আছি। আপনি?
- হ্যাঁ, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
- ভালো। আসি এখন
- দাঁড়ান। এত তাড়া কিসের রূপকথা? বয়ফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে নাকি? (মুচকি হেসে)
- জ্বী না আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।
- সিরিয়াসলি?
আরিশ পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো রূপকথার।
- কি ব্যাপার? এভাবে কি দেখছেন?
- আপনাকে দেখছি।
- এত অবাক হয়ে দেখার তো কিছু নেই।
- আছে। এত সুন্দর মায়াবী একটা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নেই?
- সবার যে বয়ফ্রেন্ড থাকতে হবে এমন কোনো কথা আছে?
- উহু তা অবশ্য নেই। কিন্তু আপনার যে বয়ফ্রেন্ড নেই এটা বিশ্বাস করা সত্যিই খুব কষ্টকর
- তাই? আপনিও তো অনেক সুন্দর, হ্যান্ডসাম তাহলে আপনার কেন গার্লফ্রেন্ড নেই?
- জটিল প্রশ্ন।
- প্রশ্ন জটিল নাকি কারণ বলবেন না?
- কিসের কারণ?
- কিছুনা। আচ্ছা আমি এখন আসি। বাড়িতে কাজ পড়ে আছে অনেক। ঐগুলা শেষ করে আবার ঈশাকে আনতে যেতে হবে।
-বাড়িতে কাজের লোক নেই?
- আমি নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করি।
- বাহ্! খুব ভালো।
- হুম
- আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ
- কেন?
- আজকে কতদিন যাবৎ আপনার ফোন হারিয়েছে আপনি জানেন?
- হারাবে কেন? ফোনটা তো আমি ভুলে আপনার রুমে রেখে এসেছি।
- তাহলে আর আনতে গেলেন না কেন?
- আপনি বুঝি অপেক্ষায় ছিলেন?
- হুম তা তো একটু ছিলাম বটে।
- আপনিই তো বললেন সেদিন আমার মত অশুভ ছায়া যেন আপনার সামনে না আসে।
- স্যরি
- স্যরি কেন?
- সেদিনকার ব্যবহারের জন্য আমি সত্যিই খুব দুঃখিত আর লজ্জিত।
- ঠিক আছে, ব্যাপার না। আমি এসবে অভ্যস্ত।
- স্যরি? বুঝলাম না।
- কিছুনা। আর কিছু বলবেন?
- নাহ, আপাতত আর কিছু বলার নেই কিন্তু আপনার ফোনটা নিবেন না?
- এনেছেন?
- না,ফোনটা তো আমার রুমেই আছে।
- তাহলে নিবো কি করে?
- আমার সাথে চলুন
- কোথায়?
- আমার বাসায়
- না পারবো না।
- কেন?
- বললামই তো বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে
- আমি গাড়িতে করে ড্রপ করে দিয়ে যাবো।
- নাহ, তার আর দরকার হবে না। নেক্সট টাইম দেখা হলে নিবোনি।
আসি ভালো থাকবেন
- হুম আপনিও।
পিংকি যাচ্ছে প্রিয়ার রুমে। বেলা কত হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখনো অব্দি ঘুম থেকে উঠার কোনো নামই নেই।
- এই প্রিয়া এই উঠ
- কি হয়েছে আপু? এত সকালে ডাকছো কেন? (ঘুম ঘুম কন্ঠে)
- কিহ? এত সকাল? ৯টা বাজতে চললো
- মাত্র নয়টা?
- মানে কি?
- মানে ১২টার আগে ডাক দিবা না।
- দাঁড়া তোকে ১২টা পর্যন্ত ঘুম পাড়াচ্ছি আমি।
পিংকি প্রিয়ার কান মলে দিলো।
- আহ্! আপু লাগছে তো!
- লাগুক! উঠ তাড়াতাড়ি।
- হু উঠতেছি ছাড়ো।
- উঠে ফ্রেশ হয়ে নে আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
- নিয়ে আসবে কেন? নিচে নেমেই খাবো সবাই মিলে।
- বাকিরা কি তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে নাকি?
- সবার খাওয়া শেষ?
- না। মা তো এখনো ঘুম থেকেই উঠেনি। বাবা খেয়ে অফিসে চলে গিয়েছে।
- আর প্রিয়ম?
- ওতো অনেক আগেই স্কুলে চলে গিয়েছে।
- আচ্ছা। তুমি নাস্তা টেবিলেই সাজাও আমি আসছি।
- ঠিক আছে।
প্রিয়া ফ্রেশ হয়ে নিচে যায় নাস্তা করার জন্য। নিচে গিয়ে দেখে পিংকিকে খুব করে বকছে ওদের মা। কিন্তু কারণটা কি। প্রিয়া এগিয়ে যায় ডাইনিং টেবিলের দিকে।
- কি হ্যাঁ? এসব কি রান্না করেছো পিংকি? মুখে তুলাই যাচ্ছে না। ডিম ভাজিতে কেউ এত লবণ দেয়? এত কড়া করে ভেঁজেছো কেন? মনে হচ্ছে পুড়ে গিয়েছে। এসব পোড়া খাবার খাওয়ানোর কোনো মানে হয়? আর পরোটারগুলো কি ছিড়ি? এত তেল দিয়ে ভাঁজছো কেন? বাপের টাকা বলে এভাবে নষ্ট করে যাচ্ছো। স্বামীর বাড়ি যখন করবে তখন চুলের মুঠি ধরে শ্বাশুরী বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
এতগুলো কথা বলা সত্ত্বেও একটাবারও মুখ ফুটে কিছু বলেনি পিংকি। কোনো জবাবও দেয়নি। অপরাধীর মত মাথা নিচু করে রয়েছে। সবটাই দাঁড়িয়ে দেখছিল প্রিয়া। ভেবেছিল ওর আপু হয়তো কিছু একটা বলবে। কিন্তু না, বলেনি। সারাজীবন এরকম বকাঝকা, চড়-থাপ্পড়, অবহেলা সহ্য করবে তবুও মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলবে না। প্রিয়া মাঝে মাঝে এটাই ভেবে পায় না যে এতটা শান্ত স্বভাবের কি করে হয় একটা মানুষ!
কিন্তু প্রিয়া দমে যায়নি। প্রিয়া একটা চেয়ার টেনে ওর মায়ের পাশেই বসলো। ততক্ষণে ভদ্র মহিলা ৪র্থ বারের মত পরোটা ছিড়ে ডিম দিয়ে মুখে দিচ্ছিলো। তার আগেই হাত ধরে ফেলে প্রিয়া।
বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে প্রিয়ার দিকে ভদ্রমহিলা!
- এটা কি ধরণের অসভ্যতা প্রিয়া?
প্রিয়া পরোটার টুকরা হাত থেকে নিয়ে প্লেটে রাখতে রাখতে তার উদ্দ্যেশ্যে বললো,
- সভ্যতা কি তা আপনার কাছে শিখতে হবে মিসেস রাহেলা বেগম?
- বেয়াদব মেয়ে! আমি তোমার মা হই আর তুমি আমার নাম ধরে কথা বলছো!!
- মা?!
উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলো প্রিয়া। হাসি থামিয়ে বললো,
- হ্যাঁ! তা তো বটেই। মা বলে কথা। কিন্তু আপনি তো শুধু মা নন। আপনি তো সৎ মা!
- তবুও আমি তোমাদের মা!
- মা? আপনাকে মা বলতে আমার বড্ড বেশি ঘৃণা হয়। এরকম ছোটলোক মনের মানুষ কখনো আমাদের মা হতে পারে না।
- প্রিয়া! কি হচ্ছে এসব? (পিংকি)
- আপু তুমি চুপ করো। আমাকে থামিয়ে দিয়ো না। আজ যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে আর কবে করবো?
আর এইযে মিসেস রাহেলা বেগম,
একটু আগে যেন আমার আপুকে কি কি বলছিলেন?
ডিম ভাজিতে লবণ বেশি? ওটাকে লবণ বেশি দেওয়া বলেনা, বলেন যে আপনি ডিম ভাজাতে লবণ খান না। আর পুড়ে গিয়েছে বললেন না? ওটাকে পোড়া বলে না। আপনার মত হালকা ভাঁজা আমরা খাইনা। আর পরোটায় তেল বেশি বলে যেন কি বলছিলেন?
বাপের টাকা বেশি তাই অপচয় করে যাচ্ছে? শ্বশুর বাড়ি গেলে শ্বাশুরী চুলের মুঠি ধরে বের করে দিবে?
হাহাহা!! অনেক হাসি পায় আপনার কথাগুলো শুনলে। আমার আব্বুর টাকাগুলি আমার আপু না বরং আপনি নষ্ট করতেছেন। রাতদিন পার্টি, ঘুরে বেড়ানো, ড্রিঙ্কস করা এগুলা তো আপনার নিত্যনতুন রুটিন। অথচ বিয়ের আগে কিন্তু পান্তা ভাতের সাথে নুনও জুটতো না। যাকগে, সেসব কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিয়ে আপনার এই সুন্দর নোংরা বর্তমান নষ্ট করতে চাই না।
আমার আপুর শ্বাশুরী আপনার মত নিকৃষ্ট মনের মানুষ হবে না।
লজ্জা করেনা? খাবার খারাপ হয়েছে বলে চেঁচিয়ে মরে যাচ্ছেন আবার সেই খাবারগুলিই আরাম করে খাচ্ছেন। বুয়ার রান্না মজা না? আমার আপুর রান্না খাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগেন কেন? নাকি আপুকে দিয়ে কাজ করিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পান আপনি? কান খুলে শুনে রাখুন, আজ এই মুহুর্ত থেকে আপু আর কোনো রান্না করবে না। যদি করেও তবে সেটা শুধু আব্বুর জন্য।
মিসেস রাহেলা বেগম রাগে ফুঁসতে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে।
- মুখে খুব বড় বড় কথা ফুটেছে তাই না? বিদেশ থেকে কেন এসেছিস? আমাকে জ্বালাতে?
- ধুর! কি বলেন না বলেন। নোংরা একটা মানুষকে আমি জ্বালাতে যাবো? আমি বিদেশ থেকে এসেছি দুইটা কারণে।
একটা কারণ আমি আপনাকে বলতে ইচ্ছুক নই তবে অন্য কারণটা আপনি জানতেই পারেন। অন্য কারণটা হলো আমার আপুকে কালসাপের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য!
- কালসাপ!!
- হু কালসাপ। আর সেটা আপনি।
এবার রাহেলা বেগম প্রচণ্ড রাগ নিয়ে থাপ্পড় দিতে গেলেন প্রিয়াকে। কিন্তু তার আগেই হাত ধরে ফেললো পিংকি।
- মা, ওকে মারবেন না প্লিজ। ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। কি বলতে না বলতে সব বলে ফেলেছে।
এবার রাহেলা বেগম পিংকির দিকে তেড়ে গেলেন। পিংকির চুলের মুঠি ধরে বললেন,
- সব নষ্টের মূল তো তুই। তুই'ই ওর কানে এসব বিষ ঢেলেছিস। এখন আবার সাধু সাজা হচ্ছে।
প্রিয়া এতক্ষণ রাগ কন্ট্রোল করে কথা বললেও এবার আর রাগ সংযত করতে পারেনি। ওরই সামনে ওর বোনের চুলের মুঠি ধরেছে। প্রিয়া চেয়ার ছেড়ে রাহেলার বেগমের থেকে আপুকে ছাড়িয়ে নিয়ে সজোরে ধাক্কা দেয় রাহেলা বেগমকে। রাহেলা বেগম টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে যান। প্রিয়া রাহেলার বেগমের সামনে বসে,
- এই হাত দিয়ে আমার আপুর চুলের মুঠি ধরেছেন তাই না? হাত খুব বড় হয়ে গিয়েছে?
কথাগুলো বলতে বলতে প্রিয়া, মিসেস রাহেলা বেগমের হাত মুচরে ধরেছে। নোখ বসিয়ে দিয়েছে হাতে। রাহেলা বেগম ব্যথায় চিৎকার করছে।
- নেক্সট টাইম যদি আমার আপুর গায়ে হাত তোলারও চেষ্টা করেন তাহলে এই হাত আর আস্ত রাখবো না আমি বলে দিলাম।
পিংকিকে নিয়ে প্রিয়া বাহিরে চলে যায় সকালের নাস্তা করার জন্য।
রেষ্টুরেন্টে খাবার অর্ডার করে বসে আছে দুজনে। খাবার সামনে আসা সত্ত্বেও খাচ্ছে না পিংকি।
- কি হলো আপু? খাচ্ছো না কেন?
- (চুপ)
- মন খারাপ?
- (চুপ)
- কিছু তো বলো? সাজ্জাদ ভাইয়াকে ফোন দিয়ে আসতে বলি?
- ওকে কেন আসতে বলবি?
- বাব্বাহ্! সাজ্জাদ ভাইয়ার কথা শুনেই মুখে বুলি ফুটলো
- ফাজিল!! একদম ফাজলামি করবি না।
- আমি না করলে কে করবে? তোমাকে কত করে বলি আপু যে এবার সাজ্জাদ ভাইকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যাও সংসার করো।
- হ্যাঁ আমার তো আর খেয়ে কাজ নেই। তোকে মায়ের কাছে একা রেখে যাবো আমি! কখন কোন ক্ষতি করে বসে তার কোনো ঠিক আছে নাকি?
- ধুর! তুমি অযথাই ভয় পাচ্ছো। উনি কিছুই করতে পারবে না।
দাঁড়াও আমি সাজ্জাদ ভাইয়াকে ফোন দেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাজ্জাদ এসে পড়ে। সাজ্জাদ পিংকির বয়ফ্রেন্ড। পাঁচ বছর যাবৎ রিলেশন ওদের। সাজ্জাদ কত করে বলে এবার বিয়েটা করে ফেলি চলো। কিন্তু পিংকির এক কথা। প্রিয়াকে একা রেখে কিছুতেই যাবে না। সাজ্জাদ প্রিয়াকেও বলেছিল ওদের সাথে থাকতে। কিন্তু প্রিয়া নারাজ। কারণ ঐ বাড়িতে বাবা আছে, মায়ের স্মৃতি ছোটবেলার স্মৃতি। এসব ছেড়ে ও কোথাও যাবে না।
প্রিয়া, সাজ্জাদ আর পিংকিকে আলাদা সময় কাটানোর জন্য রেষ্টুরেন্টে রেখে বাসার উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে।
প্রিয়া, ফোনটা পার্সে রাখতে রাখতে হাঁটছিল। তখনি হুট করেই একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খায়। সামনে তাকিয়ে যেই না স্যরি বলতে যাবে, ওমনি দুজন দুজনের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন কত জনমের শত্রু সামনে পড়েছে। প্রিয়া সামনে থেকে চলে যাওয়া ধরলো কিন্তু পেছন থেকে হাত টান দিয়ে ধরলো ছেলেটি..........
০৬!!
প্রিয়া সামনে থেকে চলে যাওয়া ধরলো কিন্তু পেছন থেকে হাত টান দিয়ে ধরলো ছেলেটি। প্রিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেটির দিকে,
- হুট করে ধাক্কা লাগলে যে স্যরি বলতে হয় সেই কমনসেন্সটুকুও কি এত বড় মেয়ের মাথায় নেই?
- হুটহাট করে একটা অপরিচিত মেয়ের হাত ধরা যে অন্যায় এটাও কি এত বড় দামড়া ছেলের মাথায় নেই?
- এই মেয়ে এই! কথা ঠিক করে বলো! দামড়া কাকে বলছো তুমি হু?
- যে আমার হাত'টা ধরে আছে তাকেই বলছি।
আদিত্য খেয়াল করে দেখলো আসলেই সে এখনো হাতটা ধরে আছে। তাই হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো,
- স্যরি বলো
- কিহ? কি বলবো?
- শুনতে পাওনি কি বলেছি? স্যরি বলো স্যরি।
- স্যরি? বলবো? আমি? তাও আপনাকে? হাহাহাহাহা
- আশ্চর্য! হাসির কিছু বলেছি নাকি আমি?
- তার চেয়ে কমও কিছু না।
- আমাকে কি জোকার মনে হয় তোমার?
এবার প্রিয়া একটু আদিত্যকে ভালো করে খেয়াল করলো। আদিত্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
- না, জোকার'রা সাধারণত এত কিউট হয়না।
- রাবিশ!!
- খবিশ!
- এই এই কি বললে তুমি?
- শুনেননি আপনি? আরেকবার বলবো?
খবিশ বলেছি খবিশ।
আদিত্য রাগে কটমট করছে। পারে তো প্রিয়াকে পানি ছাড়াই কাঁচা গিলে ফেলে। এরমধ্যে আদিত্যের ফোনের রিংটোন বাজছে। আদিত্য পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে স্নেহা ফোন দিয়েছে।
- হ্যালো বেবি বলো!
প্রিয়ার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে!
-হায় আল্লাহ্! এতো দেখছি হাওয়াই পরিবর্তন হয়ে গেছে একদম। ফোনের এপাশে ঝাঝালো আর ঐপাশে মধু! মনে হচ্ছে গার্লফ্রেন্ড। পুরাই গিরগিটি একটা। (মনে মনে)
আদিত্য ফোনে কথা বলা শেষ করে বলে,
- কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
- গিরগিটি দেখছি।
- এখানে গিরগিটি কোথায় পেলে?
- ওমা! আমার সামনেই তো একটা জীবন্ত গিরগিটি দাঁড়িয়ে আছে।
- উফফ! ইচ্ছে করছে তোমাকে!......
- দাঁড়ান। ইচ্ছে করলেই হলো নাকি? গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও অন্য একটা মেয়েকে উল্টাপাল্টা কথা বলেন । ছিঃ ছিঃ ছিঃ
- ঐ রাখো তোমার ছিঃ! আমি সেরকম কিছু মিন করিনি।
- হু বুঝি। বাদ দিন। অনেক বকবক করেছি এখন আসি।
- দাঁড়াও। স্যরিটা কে বলবে?
- আপনিই বলেন।
- আমি কেন বলবো?
- তাহলে আমি কেন বলবো?
- ধাক্কাটা তুমিই দিয়েছো।
- মোটেও না।
- তুমি স্যরি বলবে কি না?
- একবার যখন বলেছি বলবো না, মানে বলবো না।
- তুমি জানো আমি কে?
- নাহ্ জানিনা। আর দরকারও নেই।
আদিত্যকে আর কিছু বলতে না দিয়ে প্রিয়া চলে গেল। সেই সাথে রাগে হনহন করে আদিত্যও রেষ্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেল।
দেখতে দেখতে কলেজের ক্লাস করার ডেট ও এসে পড়েছে। রূপকথা খুব খুশি। আজ এতকিছুর পরও যে ওর পড়াশোনাটা বন্ধ হয়নি এটা ভেবে। অবশ্য এসবের পিছনে বাবার ক্রেডিট'টাই রয়েছে।
এদিকে প্রিয়াও প্রস্তুতি নিচ্ছে কলেজে যাওয়ার জন্য।
নতুন কলেজ:
পরিবেশ একদম অন্য রকম। যদিও প্রিয়া বা রূপকথা কারোরই পরিচিত কেউ নেই কলেজে তবে নতুন বন্ধু/বান্ধব হতে কতদিন। রূপকথা অনেকক্ষণ আগেই এসে বসে আছে।
পিংকি প্রিয়াকে ড্রপ করে দিয়ে চলে গিয়েছে। কলেজের গেট দিয়ে যখন প্রবেশ করতে যাবে তখন আদিত্যকে দেখে একটি মেয়ের সাথে। মনে হচ্ছে এটাই সেই বেবি মানে গার্লফ্রেন্ড আর কি!!
প্রিয়া ক্লাসে প্রবেশ করতেই রূপকথাকে দেখতে পায়। রূপকথাও প্রিয়াকে দেখে অবাক হয়ে যায়। দুজনেই একসাথে বলে উঠে,
- তুমি!!!
আবার দুজনেই উচ্চস্বরে হেসে দেয়। প্রিয়া রূপকথার পাশে বসতে বসতে বলে,
- আমি ভাবতেও পারিনি এখানে পরিচিত কাউকে পাবো তাও আবার তোমাকে।
- আমিও ভাবতে পারিনি গো। তবে অনেক খুশি হয়েছি তোমাকে এখানে পেয়ে।
দুজনে ক্লাশ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত গল্প করেই যাচ্ছে। যেন গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছিল ওরা। রূপকথাকে দেখে বুঝার উপায়ই নেই বাড়িতে এত কষ্ট পায় ও। রূপকথা আজ মন খুলে হাসছে।
দূর থেকে এগুলো সবই লক্ষ করছে স্নেহা। আর নিজে নিজেই বিড়বিড় করছে।
- খুব খুশি তাইনা! আজ বাড়িতে চল একবার রূপকথা তোকে যদি বকা না খাইয়েছি। আসতে না আসতেই হাসি-তামাশা তাও আবার এই মেয়েটির সাথে।
প্রিয়াকে একদম সহ্য করতে পারেনা স্নেহা। তার কারণটা অবশ্য আদিত্যকেই ঘিরে। আদিত্যের শত্রু মানে ওরও শত্রু। আদিত্যও প্রিয়াকে দেখতে পারে না আর প্রিয়াও আদিত্যকে দেখতে পারে না
একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল প্রিয়া। মুখোমুখি এগিয়ে আসছিল স্নেহা আর আদিত্য। আদিত্যের ডান হাত ছিল স্নেহার হাতে আবদ্ধ। আর বাম হাত দিয়ে আদিত্য সিগারেট খাচ্ছিলো। আদিত্যের বাম পাশ দিয়েই আসছিল প্রিয়া। কাকতালীয়ভাবে সিগারেট'টা প্রিয়ার ওড়নায় লাগে এবং সিগারেটের আগুনে ওড়না বেশখানিকটা পুড়ে যায়। সেদিন প্রিয়া খুব রাগ নিয়ে আদিত্যকে ঝেড়েছিল। আদিত্য স্যরি বলাতেও থামেনি প্রিয়া কারণ হিসেবে জেনেছিল ওড়নাটা প্রিয় মানুষের গিফ্ট করা ছিল।
ঝামেলা সেখানেই মিটতে পারতো। কিন্তু মেটেনি। প্রিয়া আদিত্যের হাত থেকে সিগারেট টা নিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় এবং জুতো দিয়ে দুমরে মুচরে দেয়। কতটা অপমানিত হয়েছিল সেদিন আদিত্য এটা ভাবতেই স্নেহার গায়ে জ্বালা ধরে। চলে যাওয়ার আগে স্নেহাকেও উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছিল,
- জানিনা এই অভদ্র লোকটা আপনার কে। কিন্তু হাবভাবে মনে হচ্ছে বয়ফ্রেন্ড হবে। সে যাই হোক, এভাবে বয়ফ্রেন্ডের সিগারেট খাওয়াকে এলাও করা উচিত না। যাকে ভালোবাসেন তাকেই মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছেন বাহ্! গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরে ঘুরছে আর সিগারেট খাচ্ছে। বাহ্ কি দারুণ দৃশ্য!
শুনুন সময় থাকতেই এই অভ্যাসটা পরিহার করাবেন।
স্নেহাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রিয়া চলে গিয়েছিল। সেই থেকেই আদিত্য, স্নেহা কেউই প্রিয়াকে দেখতে পারে না। নিজের শত্রু মনে করে।
কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই মেয়েটার সাথেই এক কলেজে এক ক্লাসে ক্লাস করতে হবে। আবার শত্রুর সাথে কি সুন্দর হেসে কথা বলছে নিজের বোন। নাহ্ নিজের বোন তো নয় সৎ বোন, এজন্যই বোধ হয় পাড়ছে। কিন্তু এই মেয়েটার সাথে রূপকথার পরিচয় কিভাবে!
প্রথমদিন হওয়ায় আজ মাত্র দুইটা ক্লাস হয়েছে। ক্লাশ শেষে বারান্দা দিয়ে হাঁটছিল রূপকথা আর প্রিয়া। পেছন থেকে স্নেহা রূপকথাকে ডাক দেয়।
- কোথায় যাচ্ছিস? (স্নেহা)
- বাসায় যাচ্ছি আপু। কেন?
- আহ্! কতবার বলেছি আপু আপু করবি বাসার বাহিরে। এভাবে পাবলিক প্লেসে আপু ডেকে কি প্রমাণ করতে চাস আমি তোর থেকে অনেক বড়? একই ক্লাসে পড়ি, এসব লোক জানিয়ে হাসাবি আর আমাকে অপমান করাবি?
রূপকথা মাথা নিচু করে বলে,
- আমি এরকম কিছু ভেবে বলিনি।
- তো কি ভেবে বলছিলি শুনি? শুন এরপর থেকে নাম ধরেই ডাকবি।
- আচ্ছা।
- এখন চল।
- কোথায়?
- আমার সাথে বাড়ি যাবি।
- তুমি তো তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে যাও।
- তো?
- আমার আনইজি লাগে।
- ঢং করিসনা তো! আনইজি লাগে! যত্তসব ন্যাকামি। চল আমার সাথে চল।
রূপকথার হাত ধরে এগোতে থাকে স্নেহা। মাঝপথে রাস্তা আটকে দাঁড়ায় প্রিয়া।
- ও যখন আপনার সাথে যেতে চাইছে না। তখন জোর করছেন কেন?
- আমার বোন আমি যা খুশি করবো তাতে তোর কি?
প্রিয়া মৃদু হেসে বলে,
- সেদিনের রাগ যদি এভাবে উসুল করতে চাস তাহলে তুই ভুল। আমাকে তুইতোকারি করলে আমি যে সম্মান দিয়ে কথা বলবো এটা ভাবলেও ভুল।
- তুই কাউকে সম্মান দিতে জানিস নাকি?
- হু জানিতো! তবে মানুষকে সম্মান করি আমি কোনো শাঁকচুন্নি বা রাক্ষসকে না।
- ঐ শাঁকচুন্নি আর রাক্ষস কাকে বললি তুই?
- কাকে আবার? তোকে আর তোর বয়ফ্রেন্ডকে।
- বুঝেছি। তোকে এভাবে কোনো শিক্ষা দেওয়া যাবে না। যা করার আদিত্যকে দিয়েই করাবো। দেখে নিবো তোকে।
- আচ্ছা ছবি পাঠিয়ে দিবো, দুজনে মিলে মন ভরে দেখে নিস।
রূপকথার হাত ধরে চলতে শুরু করলো প্রিয়া।
- কাজটা ঠিক করলে না প্রিয়া।
- কোন কাজ?
- এই যে স্নেহা আপুকে এভাবে অপদস্থ করলে।
- তাতে কি ভয় পাচ্ছো? বাড়িতে কিছু বলবে বলে?
- ভয় পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমার জন্য না। তোমার জন্য। আমাকে না হয় দু'চারটা চড়-থাপ্পড় আর বকাঝকাই করবে বাড়িতে। কিন্তু ওরা যদি তোমার কোনো ক্ষতি করে?
- ধুর! অযথাই ভয় পাচ্ছো তুমি। ঐ শাঁকচুন্নি কিছুই করতে পারবে না আমার।
- এত হেলা করো না গো! স্নেহা আপুর বয়ফ্রেন্ড'রা অনেক বড়লোক। গুন্ডা টাইপ ছেলে। তাকে দেখলে আমার ভয় লাগে। তার অনেক ছেলেপুলে। শুনেছি এই কলেজের যে দু'জন মালিক তার একজন হলো আদিত্য ভাইয়ার বাবা। বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ীর একমাত্র আদুরে ছেলে। ছোট একটা বোনও আছে। শুনেছি এইটে পড়ে। সে কথা বাদ আমি ভাবছি, আদিত্য ভাইয়া যদি কোনো ক্ষতি করে!
- পাগলী! কিচ্ছু হবে না আমার। ঐ ব্যবসায়ী, নেতাফেতা আমি কিছুরই ধার ধারি না। আর আমি ঐ আদিত্য রাক্ষসটাকেও চিনি।
- কি বলো! কিভাবে চিনো?
- বলবোনি পরে। তার আগে বলো তো এমন একটা ছেলের সাথে তোমার আপুর রিলেশন হলো কি করে?
- সে অনেক কথা।
- শর্ট করে বলো।
- আচ্ছা বলছি।
তখন আমি আর আপু ক্লাস নাইনে পড়ি। আর আদিত্য ভাইয়া অনার্সে পড়ে। বাড়িতে কাজ করতে হতো বলে আমার নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হতো না। কিন্তু স্নেহা যেত। একদিন স্নেহা স্কুল থেকে আসার পর এক্সিডেন্ট করে। আর সেই গাড়িতেই ছিল আদিত্য ভাইয়া মানে তার গাড়ির সাথেই এক্সিডেন্ট করে। বেশিকিছু না হলেও কপালে আর হাতে লেগেছিল অনেক। ব্লিডিং ও হয়েছিল অনেক। আমরা সবাই খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি স্নেহা ঘুমিয়ে আছে আর পাশে আদিত্য ভাইয়া বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে। সব জানানোর পর সে মায়ের কাছে ক্ষমা চায় আর যাওয়ার আগে নিজের ফোন নাম্বারটা দিয়ে যায়, যদি কিছু লাগে তাহলে তাকে যেন ফোন দিয়ে জানাই।স্নেহাকে তিনদিন হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় দিনও আদিত্য ভাইয়া স্নেহাকে দেখতে এসেছিল। সেদিন স্নেহার সাথে কথাও হয় তার। আমি পাশেই ছিলাম তখন। স্নেহাকে দেখছিলাম কেমন যে লজ্জা লজ্জা পাচ্ছিলো আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তার দিকে।
স্নেহা আমাকে কাছে ডেকে বললো,
- তার ঠিকানা জোগার করতে পারবি?
- আমি কি করে পারবো আপু? আমার তো বাড়িতে কত কাজ। তবে হ্যাঁ সে তার ফোন নাম্বারটা দিয়ে গেছে।
- সত্যি?
- হ্যাঁ।
- কোথায় সেটা?
- আমার ব্যাগই আছে।
- দে দে নাম্বারটা দে প্লিজ।
আমি আপুকে আমার ব্যাগ থেকে নাম্বার টা দেই। আপু খুব খুশি হয়েছিল তখন। আমার গালে চুমু খেয়ে বলেছিল,
- আমার লক্ষী বোন! আর নাম্বারের ব্যাপারে প্লিজ মাকে কিছু বলিস না।
- আচ্ছা।
এতটুকু বলেই থামে রূপকথা। প্রিয়া কৌতুহল নিয়ে বলে,
- তারপর? তারপর কি হলো বল!
- বলছি। তারপর শুরু হলো আদিত্য ভাইয়াকে ফোন দেওয়া। মা আপুকে অনেক আগেই ফোন কিনে দিয়েছিল। সেটা দিয়েই কথা হতো। প্রতিদিন এমনিতে টুকটাক কথা হতো ওদের। একদিন স্নেহা ওর মনের কথা আদিত্য ভাইয়াকে বলে। কিন্তু আদিত্য ভাইয়া সরাসরি স্নেহাকে না করে দেয়। কারণ জানতে চাইলে বলে,
- তুমি তো আমার থেকে অনেক ছোট। তাছাড়া আমার পড়াশোনা , আর রাজনীতি এসবের মাঝে কোনো সময় নেই যে একটা গার্লফ্রেন্ড পালবো। তুমি পিচ্চি মানুষ আবেগে এসব কথা বলেতছো। দুইদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
একথা শুনে তো স্নেহার কান্না দেখে কে! এরপর ঘটিয়ে বসে এক কেলেঙ্কারি ঘটনা!
-কি করেছিল?............