!!৭০!!
বাগানের অলকানন্দা গাছটা ভিষণ সুন্দর। সবুজের মাঝে থোকায় থোকায় কি সুন্দর ফুলগুলো ফুটে আছে। মাহা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে নির্ণিমেষ। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সার্থক ঘরে ল্যাপটপে কাজ করছে। হয়তো কোনো দরকারি কাজ। মাহা বিরক্ত করেনি। ওদের সম্পর্কটা এখন বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছে। মাহা আসলে বুঝেনা তার মন কি চায়। নিজের অনুভূতি নিয়ে নিজেই সন্ধিহান। ছোটবেলা থেকেই একাকী ছিল তার জীবন। মাহা যখনই যাকে ভালোবেসেছে সেই তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ভালোবাসতে বড্ড ভয় মাহার। অবচেতন মন হয়তো কবেই সার্থকের মায়ায় আটকে গিয়েছে। লম্বা চওড়া মানুষটা, ঝাঁকড়া চুলগুলোতে হাত দেওয়ার বড়ই বদঅভ্যাস। যখন কথা বলে মুখে গাম্ভীর্য রেখেই হাসে। মাহার কি যে ভালোলাগে। আশপাশের মানুষের সাথে মাহার খুব একটা পরিচয় নেই। তাছাড়া এই বহুতল ভবনে সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। প্রতিবেশীর খবর নেওয়া তারা খুব একটা পছন্দ করেনা।
"মাহা।"
সার্থকের ডাক শুনে ঘরে ছুটে এলো মাহা। সার্থক ল্যাপটপ পাশে রেখে ডানহাতটা মাথার উপর রেখে শুয়ে আছে।
"কি হয়েছে আপনার?"
"আমাকে এককাপ কফি করে দিতে বলো।"
সবসময়ের মতো উৎফুল্ল শুনালোনা সার্থকের সুর। মাহার সাথে কথা বলার কালে সার্থক নরম সুরে কথা বলে। এমনভাবে যেন একটু জোরে কথা বললেই মাহা ভয় পাবে। মাহা একছুটে নিচে রান্নাঘরে চলে এলো। যদিও সে খুব একটা রান্নাঘরে আসেনা। এমিলিন ছিলেন রান্নাঘরে। মাহা কফি খুঁজে পাচ্ছিলোনা। সে বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পায়নি এমিলিনের কাছে। হতাশ হয়ে নিজেই খোঁজ করছিলো। তখনই আরেক পরিচারিকা মেরি তার হাতে কৌটা বের করে দিলো। মেরি মেয়েটা কানাডিয়ান। নিভার মুখে শুনেছিলো মাহা। যদিও সে বেশি একটা নিচে নামেনা। উপরেই সময় কাটে তার। মাহা কফি বানিয়ে উপরে চলে এলো। সার্থক তখনো মাথার উপর হাত রেখে শুয়ে। মাহা ডাকলো,
"শুনছেন? সার্থক। আপনার কফি।"
সার্থক উঠলোনা। মাহা আবার ডাকলো। বাইরে খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালাটা আটকানো প্রয়োজন। ঘর ভেসে যাচ্ছে পানিতে। সাদা টাইলস পানিতে ছেয়ে যাচ্ছে। মাহা কফির কাপটা রাখলো পাশের টেবিলে । নীল রঙা উড়নাটা টেনে মাথায় দিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলো জানালার কাছে। তবে তা হলোনা। সার্থক তার ডানহাত টেনে ধরেছে। অজানা কারণেই কেঁপে উঠলো মাহা।
"আপনার কফি পাশে রাখা।"
সার্থক শুনলোনা সেসব কথা। একটানে মাহাকে নিজের বুকের উপর নিয়ে এলো। মাহা আজ নতুন কোনো সার্থক কে দেখছে। যার চোখে তৃষ্ণা। কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা। মাহা উঠে যেতে চাইলে তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক।
"কি..কি করছেন আপনি?"
"শসস্।"
মাহার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হলো তাকে। সার্থকের কপালের উপরে চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত। দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের। দমকা হাওয়ায় জানালার কপাট নড়ছে। সার্থক ঘোর লাগা কণ্ঠে বললো,
"প্লিজ, মাহা। আজ তোমাকে আমার ভিষণ প্রয়োজন।"
মাহা মুখে কিছুই বললোনা। নিরবতা সম্মতি ভেবে সার্থক ডুব দিলো মাহার মাঝে। প্রিয়তমার নরম অধর নিজের অধরে ডুবিয়ে দিয়ে একাকার হয়ে গেলো দুজনে। বাইরে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছে। ভিতরে নিজেদের মাঝে উন্মাদনায় মত্ত দুটো দেহ। তাদের মাঝেও উষ্ণতার ঝড় বইছে।
!!৭১!!
রাতেরবেলা সবাই খেতে বসেছে। রবার্ট, মুইংচিন, নিভা, সার্থক এবং মাহা। রবার্ট বরাবরই কম কথার মানুষ। মুইংচিন নিজের আদো আদো বাংলায় কথা বলে। মাহার খুব মিষ্টি লাগে শুনতে। সার্থক, মাহা সামনাসামনি বসেছে। একান্ত মুহূর্তের পরে মাহা একবারের জন্যও সার্থকের সামনে যায়নি। সার্থক মাহার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। চোখাচোখি হতেই চোখ টিপলো সে। মাহা হতভম্ব হয়ে গেলো। এই ডাক্তার যে এতটা বেহায়া তার জানা ছিলোনা। মাহা দ্রুত মাথা নামিয়ে খাওয়ায় মন দিলো। নিভা সবই খেয়াল করেছে।
"কি ভাইয়া? আজ এতো খুশি কেনো তুমি?"
সার্থক মাহার মুখপানে তাকিয়ে বললো,
"আমার বসন্ত এসেছে বুঝলে নিভা।"
"বসন্ত তো সে কবেই এসেছে, ভাইয়া।"
নিভার বোকা প্রশ্নে সার্থক হাসলো। অতঃপর বললো,
"আমার বসন্তের ফুল আজকেই ফুটেছে।"
মাহা দ্রুত টেবিল ছেড়ে উপরে চলে এলো। ডাক্তারের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। আবোল তাবোল বকছে খালি। টেবিলে হাসির রোল পড়ে গেলো। দূর থেকে কেউ একজন সেদিকে তাকিয়ে রইলেন অগ্নিচোখে। হাসিতে বড্ড গাঁ জ্বালা করছে তার। মাহা ঘরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটা। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ায় হালকা শীত পড়েছে। বাইরে ফকফকা চাঁদের আলো। মাহা নিজেদের একান্ত মুহূর্তের কথাগুলো ভেবে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠছিলো। তার হলুদ ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে উঠেছে। লুবান যাওয়ার পর থেকে মাহা বেশ ভালো আছে এ বাড়িতে। একে একে মনে পড়ছে ফেলে আসা অতীত দিনগুলো। এই একুশ-বাইশ বছরের জীবনে কতকিছু দেখেছে সে। ছোটবেলা মা মারা যাওয়ার পর বাবা আবার বিয়ে করলেন। ছোট মাহা ভেবেই নিলো আসন্ন মহিলা সত্যিই তার আরেক মা। কিন্তু এক গাছের ফল কি আর অপর গাছে জোড়া লাগে! সৎমায়ের ব্যবহারে দিনদিন আবেগশূন্য হয়ে পড়ছিলো মাহা। স্কুলে কোনো বন্ধু-বান্ধবী নেই। একেবারে একা জীবন মাহার। কলেজেও তাই। বাবা আদর করতেন লুকিয়ে। সৎ মাকে ভয় করতেন কিনা! মাহা জানতো তার বাবা তাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। রেজওয়ানের বাবা আর মাহার বাবা বন্ধু ছিলেন। রেজওয়ান আসতো প্রায়ই মাহাদের বাসায়। মাহাকে টুকটাক সাহায্য করতো। মাহাও তাকে নিজের বড় ভাইয়ের মতোই দেখে। এতকিছুর পরেও মনে আপনজনের খাতাটা ছিল শূন্য। এমন কেউ ছিলোনা যে মাহাকে বুঝবে। মাহা যার সাথে নিজের সমস্তটা তুলে ধরতে পারবে। একটা মানুষ। একটা মনের মানুষ। একটা আপন মানুষ। ভার্সিটি কোচিং করা কালে চৈতির সাথে পরিচয়। কি মিষ্টি মেয়েটা। মাহার মনে হলো সে একটা বোন পেয়েছে। একটা ভালো বন্ধু পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অর্থনীতি বিভাগে চান্স পাওয়ার পর থেকে জীবনটা অনেক বদলে গিয়েছিলো মাহার। যদিও বন্ধুমহল সীমিত। তবুও খুবই ভালো সময় কাটছিলো তার। পরে কি যেন হলো। আবছা স্মৃতি। মাহার মনে আছে তাদের পরীক্ষা শেষ হলো। ফোনে কারো সাথে খুব কথা হতো। কার কথা হতো! তার না চৈতির! তারপর মাহা যখন চোখ খুললো নিজেকে আবিষ্কার করলো রুমানাদের বাসার সামনে। কি করে এলো! কেন এলো! কিভাবে এলো! কোনো কিছুই মাহার মনে নেই। অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন আসে ঘুমালে। সেগুলো বাস্তব না কল্পনা মাহা জানেনা।
!!৭২!!
অতঃপর ঘটে গেলো কত ঘটনা। অনাঙ্ক্ষিত বিয়ে, চৈতির মৃত্যুর খবর, বাবার মৃত্যুর খবর, সৎ মায়ের দোষারোপ। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কি হলো তা মাহার খেয়াল নেই। কিন্তু যখন চোখ খুললো তখনই কারো বুকে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। এতটা আপন কখনো কাউকে লাগেনি। লোকটার মায়ায় পড়েছে মাহা। মনের ভিতরে ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাখা। মাহা তুই প্রেমে পড়েছিস। ডাক্তারকে তুই ভালোবাসিস। মাহা চিন্তায় পড়লো তার মতো চালচুলোহীন মেয়েকে কি মেনে নিবে এত বড় মাপের মানুষটা! মাহার মনে দ্বিতীয় ভয় সে ভালোবাসলেই তো দূরে চলে যায় আপনজনেরা। মাহার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে সার্থক স্বীকৃতি দিলো তাকে। পরিস্থিতি, মন, মস্তিষ্ক সব ভাবনায় মত্ত হয়ে মাহাও সায় দিলো সে সিদ্ধান্তে। মানুষটার ভালোবাসায় পড়েছে মাহা। কখনো এতটা আপন কাউকে মনে হয়নি। এতটা নিজের কাউকে মনে হয়নি। শুধু এই ঝাঁকড়া চুলের মানুষটাকে নিজের মনে হয় মাহার। এই পৃথিবীতে মাহার একমাত্র আপনজন। তাই তো আজও সেই মানুষটার একান্ত ডাকে সাড়া না দিয়ে মাহা পারেনি। এসব ভাবতে ভাবতেই মাহার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা নিরব অশ্রু ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো। আল্লাহর কাছে খুব করে চাইলো মাহা। এই মানুষটা যেন সবার মতো হারিয়ে না যায়। এত কষ্ট মাহা সইতে পারবেনা। মাহার দম বন্ধ হয়ে যাবে। এই মানুষটাকে মাহার চাই। সারাজীবনের জন্য চাই।
হঠাৎ তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সার্থক। ঘাড়ে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিতে দিতে বললো,
"ভালোবাসি, অলকানন্দা।"
মাহাকে নিরব দেখে নিজের দিকে ফিরালো সার্থক। মাহার চোখ-মুখ লাল। কেঁদেছে বোধহয়। বুকটা ছেৎ করে উঠলো তার। কোনো কি অপরাধ করে ফেলেছে সার্থক। এভাবে মাহাকে কাছে টেনে নেওয়াতে মাহা কি খুশি না! সার্থক আজ প্রচুর মানসিক পীড়ায় ছিল। মাহার সান্নিধ্যে তা কেটে গিয়েছে অনেকটা। সে কি কোনো ভুল করে ফেললো! থমথমে গলায় সার্থক বললো,
"আমি কি কোনো ভুল করে ফেলেছি মাহা? আমি ক্ষমা চাচ্ছি তবুও দয়াকরে তুমি কেঁদোনা। আমি..
মাহা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। মুখের কথা মুখেই রইলো। হাতটা চলে গেলো মাহার মাথায়। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সার্থক জিজ্ঞেস করলো,
"কি হয়েছে বউ?"
মাহা ভেঙে আসা গলায় বললো,
"আমি আপনাকে ভালোবাসি সার্থক। আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না আপনি। আমার সব ভালোবাসার মানুষ গুলো আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে সার্থক।"
সার্থক হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাহার মাথায়। তারও চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কি?
.
.
.
চলবে......................