১৭!!
-অনু? এই যে ম্যাডাম? এখনো ঘুমিয়ে আছেন? জানতাম তো কেউ ডাকে নি আপনাকে, আর আপনিও আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। পাগলিটা দরজাটা খোলো না? আমি এসেছি। অনু? উঠেছ?
দরজার বাইরে হালকা যে শব্দটা শুনেছিল রিশাদ আর অনামিকা দুজনেই, সেটা আর কিছু নয়, অরণ্যের হালকা হাতে দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ। অনামিকার যাতে ঘুমটা না ভাঙ্গে সেজন্যই দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই হালকা গলায় কথাগুলো বলছে অরণ্য। অনামিকা ঘুমে থাকলে জীবনেও যে অরণ্যের এমন নিচু গলার ডাকটা শুনতে পেত না সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগলো না অনামিকার। কিন্তু এখন জেগে থেকেও তো নিজের অসহায়ত্বের কথাগুলো বলতে পারছে না মেয়েটা অরণ্যকে। কথাটা ভাবতেই হাউমাউ করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে অনামিকার। কিন্তু রিশাদ মুখটা বা হাতের তালু দিয়ে এমন শক্ত করে চেপে ধরেছে যে নিজের সিচুয়েশন থেকেও ব্যথায় আরো বেশি চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে মেয়েটার চোখ বেয়ে। অনু নিজের মাথাটা নাড়িয়ে রিশাদের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে গিয়েও থমকে গেল যখন দরজায় অরণ্যের হালকা হাতের টোকা দেয়ার শব্দটাও বন্ধ হয়ে গেল।
-অনু তো মে বি এখনো ঘুমোচ্ছে। উমমম। এই মূহুর্তে মেয়েটাকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। বাট না ডেকে দিয়ে গেলে তো দুপুরে না খেয়েই ঘুমিয়েই কাটাবে মেয়েটা। মা আর তাহিয়ারাও কখন আসবে কে জানে? এই মেয়েটা কি সারাদিন না খেয়ে থাকবে নাকি? উমমম। আমি তো বেশিক্ষণ থাকবো না। সবার সাথে লাঞ্চ করেই চলে আসবো বাড়িতে। মেয়েটা বাড়িতে কতোক্ষণ একা একা থাকবে? আরো কিছুক্ষণ নাহয় ঘুমিয়ে নিক। এসেও যদি দেখি ঘুমিয়ে আছে তারপর নাহয় ডেকে তুলবো। উমমম। এটাই বেটার হবে। আপনি আরো ঘন্টাখানেক আয়েশ করে ঘুমিয়ে নিন ম্যাডাম। আপনার ঘুমের বারোটা বাজাতে জলদীই আসছি। বায়।
অরণ্য কথাগুলো বলা শেষ করতেই অনামিকা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজেকে শেষ বারের মতো রিশাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। অনামিকার মুখের উপরে চেপে ধরা হাতের তালুটা সরে যেতেই অনামিকার ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে অরণ্যের নাম ধরে ডাকার আগেই রিশাদ আবার অনামিকার গাল টিপে ধরলো। প্রচন্ড ব্যথায় গলা দিয়ে গোঙরানোর মতো শব্দ বেরিয়ে এলো মেয়েটার। রিশাদ নিজের সমস্ত রাগই ঝাড়ছে অনামিকার উপরে। অরণ্যের এই দিন দুপুরে হুট করে চলে আসাটাও যেন অনামিকারই দোষ এমন ভাব নিয়ে অনামিকার চুলের মুঠি এক হাতে ধরে অন্য হাতে অনামিকার মুখটা আবার নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। অনামিকা নিজেকে ছাড়াতে না পেরে রীতিমতো ধস্তাধস্তিই শুরু করেছে এতোক্ষণে। অরণ্য একবাস বেরিয়ে গেলে বাঁচার শেষ আশাটাও তে ভেসে যাবে, এ চিন্তাটাই অসহ্য ব্যথার পরও লড়াই করার সাহসটা কাজ করছে মেয়েটার মনে।
-এখন ছাড়া পেয়ে গেলে কি হবে ভাবিজান? আপনিও এই বাড়িতেই থাকবেন, আর আমিও। নিজের ইচ্ছেটা তো এখন না হোক দুদিন পরে হলেও আমি পূরণ করবোই করবো। ভাবলাম সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গলটা নাহয় একটু বাঁকিয়েই তুলবো। বাট ওই হারামিটা এসে তো সব গন্ডগোল করে দিল। বাট কতোক্ষণ আর থাকবে? তাড়াতাড়ি ফিরলেও ঘন্টাখানেকের আগে তো আসবে না। সেটাই এনাফ হতো আজকের জন্য। বাট এখন আর মুড নেই। শশশশ। একটা টু শব্দও না। আপনার মিস্টার অরণ্য বেরিয়ে গেলে আমিও চলে যাবো। ওর আগে রেস্টুরেন্টে গিয় পৌঁছেও যাবো। তারপর? তারপর তুমি অরণ্যকে সবটা বলে দাও আই ডোন্ট হ্যাভ এনি প্রবলেম। আমার ভাই, ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত যাদের আত্মার সম্পর্ক, সামান্য দুদিন আগে আসা একটা মেয়েট জন্য কি সেটা নষ্ট হতে পারে?! নট এ চান্স। বাট তুমি তোমার স্যাটিসফেকশনের জন্য বলতেই পারো। নো প্রবলেম। বাট রিমেম্বার ওয়ান মোর থিংক অনু। অরণ্যের রুমের একটা চাবি সবসময় আমার কাছে আছে। হা হা হা। ওকে? এই রুমে আমি যখন ইচ্ছে যেকোনো সময়েই আসতে পারি। বুঝলে? সো যা বলার সামলে বলবে ওকে?
মুখের উপর থেকে রিশাদের হাতটা সরাতে না পেরে এতোক্ষণ অন্য একটা চেষ্টায় লেগেছিল অনামিকা। রিশাদের ওভার কন্ফিডেন্টে বকবক করার মাঝেই অনামিকা নিজের সমস্ত শরীরটা ছাড়ানোর চেষ্টার ফাঁকে নিজের ডান হাতটা ছোটাতে পেরেই বিছানায় পড়ে থাকা ফুলদানিটা ফ্লোরে যতদূরে সম্ভব ছুঁড়ে ফেললো। রিশাদ শেষ মূহুর্তে খেয়াল করলেও ভারি পোঁড়ামাটির ফুলদানিটা ফ্লোরে আছড়ে পড়ে টুকরো।টুকরো হয়ে সারা মেঝেতে যেমন ছড়িয়ে পড়লো, তেমনে শব্দটা বেশ অনেকটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। রিশাদ এবারে রাগে লাল হয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে অনামিকার গালে। থাপ্পড়টা এতো জোরে এসে লেগেছে যে অনু বিছানার উপরেই এসে পড়েছে। রিশাদ আবার এক পা এগিয়ে এসে অনামিকার দিকে এগিয়ে আসার আগেই আবার দরজায় খটখট শব্দ শুরু হলো। এবারে দরজায় টোকা নয়, দরজার বাইরে উদ্বিগ্ন অরণ্যের ধুপধাপ দরজায় বাড়ি দেয়ার আওয়াজ রিশাদ আর অনামিকার দুজনেই শুনতে পাচ্ছে।
-অনু? কি পড়লো? আরে? অনু্? উঠেছ তুমি? দরজাটা খোলো না? এই মেয়ে শুনতে পাচ্ছ তুমি? এই অনু?
অরণ্যের ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য মুখ তুলে তাকাতেই রিশাদের দিকে চোখ পড়তেই অনামিকা থেমে গেল। রিশাদ অনুর দিকে আঙ্গুল শাঁশিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে কতোগুলো কথা বললো।
-একটাও টু শব্দ করলেও অরণ্য রুমে আসবে তো ঠিক, কিন্তু বেঁচে আর এই রুমের বাইরে পা ফেলতে পারবে না। কথাটা মাথায় রেখো। আর যদি এসব না চাও চুপচাপ বসে থাকো। একদম নড়বেও না।
এদিকে, অনামিকাকে বাড়িতে একা রেখে যেতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছিল না অরণ্যের। রুম থেকে চিন্তা করতে করতে ড্রইংরুম পর্যন্ত গিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছে অরণ্য। কাজিনদেরকে কল করে লাঞ্চে জয়েন করতে পারবে না জানিয়ে দিলেই তো ঝামেলা মিটে গেল! যেই ভাবা সেই কাজ। অরণ্য ড্রইংরুমের দিক থেকে আবার নিজেদের রুমের দিকে যেতে যেতে রিশাদের নাম্বারটা সবে ডায়েল করেছে এমন সময় রুমের ভিতরে সশব্দে কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দে ছুটে রুমের বাইরেই এসে দরজায় বাড়ি দিচ্ছে অরণ্য। মেয়েটার কি হয়েছে, দরজা খুলছে না কেন, এসব চিন্তা করেই নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল অরণ্যের। পর মূহুর্তেই খেয়াল হলো রুমের লকের চাবি তো ওর নিজের কাছেই আছে, তাহলে ও খামাখা এতো প্যানিক করছে কেন? নিজের ওয়ালেট থেকে রুমের চাবিটা বের করেই লকটা খোলায় মন দিল অরণ্য। দরজা খুলেই অনুকে বিছানার উপরে কেমন একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে থাকতে বা পড়ে দেখে অরণ্য ছুটে অনামিকার কাছে বিছানায় এসে অনামিকাকে টেনে ঠিক করে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। অনামিকা ওর দিকে না তাকিয়ে ঠিক পর পিছনেই কিছু একটা দেখছে দেখে অরণ্যও এক নজর পিছনে ফিরে তাকিয়ে কিছু না দেখে আবার সামনের দিকে তাকালো।
- কি দেখছ এভাবে অনু? আর তোমার এই অবস্থা কেন? ঘুমিয়েছিলে? নাকি কারো সাথে যুদ্ধ করেছিলে? আমি বাসায় থাকলে নাহয় ভাবতাম ঘুমের ঘোরে আমিই কিছু একটা করেছি। বাট এ তো দেখছি চুল এলোমেলো, পড়নের শাড়িটা কেমন দুমে কুঁচকে গেছে, চোখ মুখ কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তোমার? ব্যাপারটা কি?
অন্যদিকে, দরজায় লকের খচখচ শব্দে রিশাদ একদম দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে রুমে ঢোকার সময় অরণ্য ওকে দেখতে না পায়। হলোও তাই। দরজা খুলেই অনামিকার দিকে খেয়াল করে ছুটে আসায় দেয়ালের সাথে টিকটিকির মতো সেটে থাকা রিশাদের দিকে অরণ্যের নজর পড়ে নি। অরণ্য অনামিকাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই অনামিকার দিকে তাকিয়ে বিশ্রি একটা হাসি দিয়ে রিশাদ বেরিয়ে গেছে। আর অরণ্য থ হয়ে রিশাদের চলে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখছে। সামনে যে অরণ্য বসা সেদিকেও যেন হুঁশ নেই মেয়েটার। অনুকে চুপ করে থাকতে দেখে অরণ্য আলতো করে অনামিকার গালে হাত ছুঁইয়ে দিল। প্রচন্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল অনামিকা।
-তোমার কি হয়েছে অনু? শরীর খারাপ লাগছে? পুরো গাল, চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। গা ও তো কেমন গরম গরম লাগছে। যাওয়ার সময়ও তো দেখলাম সব ঠিক আছে। এখন হঠাৎ করে কি হলো? আর এই ফ্লাওয়ার ভাস! এটা কি করে এতো দূরে গিয়ে পড়লো?
-আচ্ছা অরণ্য? কেউ যদি আপনি দোষ না করার পরও আপনাকে অপরাধী বানিয়ে দেয়, সেটার সাজা ভোগ করতে হয় আপনাকে বছরের পর বছর। বা নিজের বাকি জীবনটাতে। তাহলে কি করা উচিত আপনার? কেউ যদি ইচ্ছে করে আপনার সাথে অসভ্যতা করে, তাহলে কি মনে হবে আপনার? আপনার মনে হবে না আমার মধ্যেই তো কোনো দোষ নেই তো? বা আমার সাথেই কেন এমনটা ঘটলো? সব কিছু মুখ বুজে আপনি সহ্য করে নিতে পারবেন শুধু আপনি সবার চোখে অপরাধী বলে? কেউ পাশে দাঁড়াবে না এই ভয়ে কি হার মেনে যাবেন? তীলে তীলে নিঃস্ব হয়ে মরে যাওয়ার চেয়ে কি একেবারে মরে যাওয়াটা আপনার কাম্য হবে না তখন?
১৮!!
"তীলে তীলে নিঃস্ব হয়ে মরে যাওয়ার চেয়ে কি একেবারে মরে যাওয়াটা আপনার কাম্য হবে না তখন?"
অনামিকার এমন কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে অবাক চোখে এবারে একটু ভালো করেই অনামিকার দিকে তাকালো অরণ্য। মেয়েটার দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভিতরটা কেমন কেঁপে উঠলো অরণ্যের। এক সেকেন্ডের জন্য থমকে থেকে প্রায় বিদ্যুৎ বেগেই এগিয়ে এসে অনামিকার মুখটা দু হাতের আঁজলায় তুলে ধরে তাকালো অরণ্য। অনামিকার ফর্সা ঈসৎ রক্তিম মুখটায় বেশ লাল হয়েই কয়েকটা দাগ ফুটে আছে। স্পষ্ট, আর তাজা দাগগুলো দেখে কারো হাতের ছাপ বলেই মনে হলো অরণ্যের। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ছেলেটা। অরণ্যের হাতের আলতো স্পর্শেও যে মেয়েটা ব্যথাটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সেটা বুঝতেও বেশি সময় লাগলো না অরণ্যের। অরণ্য যত ধীরে সম্ভব নিজের হাত দুটো অনামিকার গাল থেকে সরিয়ে নিয়ে একহাতে অনামিকাকে নিজের সাথেই আলগা করে জড়িয়ে নিয়ে অন্য হাতে অনামিকার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিল। আর অনামিকা! কোনো এক অজানা আশংকায় হাত পা রীতিমতো ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভয়টা অরণ্য কোনো প্রশ্ন করবে কিনা এটা ভেবে, নাকি আবার রিশাদ চলে আসবে কিনা এটা ভেবে, সেটা অনু নিজেও জানে না। শুধু জানে প্রচন্ড ভয় করছে মেয়েটার।
-অনু? কি হয়েছে তোমার? আমাকে বলো কি হয়েছে? তুমি তো রুমে একাই ছিলে? তাহলে আমার এমন কেন লাগছে যে তোমার সাথে কিছু হয়েছে, একটু আগেই হয়তো ঘটেছে। প্লিজ অনু। আমাকে বলো। এমন বিধ্বস্থ দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
-অরণ্য........।
-অনু এবার প্লিজ এটা বলো না যে কিছু হয়নি। কিছু একটা তো হয়েছে। সেটা আমি রুমে ঢুকেই টের পেয়েছি। রুমের ফ্লাওয়ার ভাসটা ভাঙা, তোমার এই অবস্থা? বিছানার, রুমের? অনু প্লিজ? আমার টেনশন হচ্ছে ভিষণ। বলো আমাকে প্লিজ?
-কি হয়েছে তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো হলো আমি আপনাকে সবটা বলার পর কি হবে।
-মানে?
-আপনার সাথে কেউ যদি ভিষণ অসভ্যতা করে, বিনা অপরাধেও আপনি শাস্তি পান, কেউ বিশ্রিভাবে----বিশ্রিভাবে আপনাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। কি করবেন আপনি?
-আমি কি করবো জানি না। বাট আমার ওয়াইফের দিকে যে চোখ তুলে তাকাবে তাকে খুন করে ফেলবো আমি। আর এই মেয়ে? আজেবাজে চিন্তা একদম মাথায় আনবে না। কিসব তিলে তিলে মরার কথা বলো হ্যাঁ? তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছি, ঝুম বৃষ্টিতেও ঝালে লাল হয়ে ছেলেমানুষি করতে করতে বন্ধুদের সাথে ফুচকার চ্যালেঞ্জ করতে। সেই হাসি মাখা মুখটা, সেই জেতার নেশায় হার না মানার স্পিরিট, সেই জিতে গিয়েও ঢকঢক করে পানি খাওয়া ছেলেমানুষি ভরা অনুকে চাই আমার। আজীবন তাকে চাই আমি। প্রতিটা সেকেন্ডে, তার ভুলে, অন্যায়ে, অভিযোগে, ভয়ে, হতাশায়, বিজয়ে, প্রতিটা মূহুর্তে তার পাশে থাকতে চাই আমি। বলবে আমাকে প্লিজ অনু? কি হয়েছে?
-আপনি সবসময় আমার পাশে থাকবেন অরণ্য? যদি তার জন্য আপনার প্রিয় কারো বিপক্ষে দাঁড়াতে হয়, তবুও?
-তুমি কার কথা বলতে চাইছ আমি জানি না অনু। বাট তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছে, তাকে আমি ছাড়বো না। কি হয়েছে, কি করেছে তোমার সাথে, তুমি না বলতে চাইলে বলতে হবে না। তুমি জাস্ট আমাকে তার নামটা বলো।
-নাম? নাম বললেও নিজের কথাগুলো প্রমাণ করার জন্য কোনো প্রমাণও তো আমার কাছে নেই। আপনি নাহয় বিশ্বাস করবেন আমার কথা। কিন্তু কখনো না কখনো আপনারও তো মনে হবে যে আপনি হয়তো আমাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছেন।
-অনু? এতো অতিরিক্ত বুঝো কেন মেয়ে তুমি? আমাকে শুধু তুমি নামটা বলো। কার এতো বড় সাহস হয়েছে আমার বউয়ের গায়ে হাত তোলার।
'বউ' শব্দটা কানে এসে বাজতেই অনামিকা একটু চুপ করে অরণ্যের বুকের কাছে সেঁধিয়ে অরণ্যের শার্টটা খামচে ধরে বসে রইলো। কি ঘটেছে না বুঝতে পারলেও কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে অরণ্যের রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনামিকার যে অবস্থা তাতে মেয়েটাকে জোর করে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে সেটাও সাহস হচ্ছে না অরণ্যের। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অনামিকার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল অরণ্য। এর মধ্যেই অরণ্যের মোবাইলে কল এলো। এতোক্ষণে কাজিনদের সাথে লাঞ্চের কথাটা মনে পড়লো অরণ্যের। তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করতেই অনামিকাও একটু সরে এসে বসেছে অরণ্যের কাছ থেকে। অরণ্যের মোবাইলের স্ক্রিনে 'রিশাদ' নামটা দেখেই অনামিকা যা ও কিছুটা সামলে নিয়েছিল নিজেকে, আবার ভয়ে জড়সড় হয়ে অরণ্যের হাতটা চেপে ধরলো। কোনো মতে মাথা নাড়িয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও বেচারি সফল হলো না। অরণ্যও থতমত খেয়ে অনামিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কলটা ততক্ষণে একবার বাজতে বাজতে কেটে গিয়ে আবার বাজতে শুরু করেছে। অরণ্য অনামিকার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার জড়িয়ে ধরলো।
-অনু? এমন করছ কেন? বলবে তো কি হয়েছে? আরে পাগলি আমি কোথাও যাচ্ছি না তোমাকে রেখে রিল্যাক্স। রিশাদরা কল করছে। ওদেরকে বলছি বাড়ি ফিরতে-----।
-না প্লিজ। কাউকে কিচ্ছু বলবেন না প্লিজ। কারো আসার দরকার নেই। আপনি শুধু বলে দিন, আমি একটু অসুস্থ। তাই আপনার দেরি হচ্ছে। আপনিও যান। আমার কিছু হয়নি। কিচ্ছু হয়নি।
-অনু?
-প্লিজ অরণ্য। আপনি কলটা না রিসিভ করলে ওরা সবাই হয়তো বাসায় চলে আসবে। যা ইচ্ছে কিছু একটা বলে দিন।
-ওকে। এক মিনিট।
অরণ্য অনামিকাকে বুকের সাথে জড়িয়ে রেখেই রিশাদের কলটা রিসিভ করলো। এর মধ্যেই ছেলেটা ৫/৬ বার কল করে ফেলেছে। কলটা রিসিভ হতেই অপরপ্রান্ত থেকে বেশ কয়েক রকমের গাড়ির হর্নের সাউন্ড শুনতে পেয়ে অরণ্যের ভ্রু জোড়া আপনা আপনি কুঁচকে গেল। অপরপ্রান্ত থেকে প্রায় এক নিঃশ্বাসে রিশাদ বকবক শুরু করলো নিজের।
-কি রে অরণ্য? কখন থেকে তোর জন্য ওয়েট করছি আমরা সবাই? তুই আসবি কখন? আমরা সবাই তোর অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে পাথরের মূর্তি হয়ে গেলে তখন? কখন থেকে কল করছি, কলও রিসিভ করছিস না? তোর না মিটিং শেষ করেই আমাদেরকে জয়েন করার কথা ছিল? মিটিং শেষ করে কি মিস্টার বউকে নিয়ে বিজি হয়ে গেছ?
-ফার্স্ট অফ অল, আমি বউকে নিয়ে বিজি নাকি মিটিং এ তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো তুই কোথায়? এখনও ট্রাফিকের সাউন্ড পাচ্ছি। রেস্টুরেন্টে তো যাস নি তাহলে।
-আরে আমি একটা জরুরি কাজে আমাদের ব্রাঞ্চে এসেছিলাম। ছুটি নিয়েও শালার শান্তি নেই। মাত্র সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বের হলাম। আর তোকে কল করলাম।
-ওহ! বাকিরা কোথায়? তারাও কি তোর মতো আর্জেন্ট কাজে এদিক ওদিক ঘুরছে? নাকি রেস্টুরেন্টেই আছে?
-ওরা গত এক ঘন্টা ধরে রেস্টুরেন্টে বসে তোর আসার অপেক্ষা করছে। এতো জেরা না করে তুই কোথায় বল? বাড়িতেই নিশ্চয়ই? হুম হুম?
-তোর কি ধারণা আমি অফিস থেকে ডিরেক্ট রেস্টুরেন্টে চলে যাবো? চেইঞ্জ করা লাগবে না?
-ওহ! তা মশাই চেইঞ্জ করতে এসেছেন? তা চেইঞ্জ করতে হেল্প লাগছে নাকি ভাবির? আমরাও হেল্প করতে আসবো নাকি?
-নো থ্যাংকস। আর আমিও আসছি না। তোরা সবাই মিলে এন্জয় কর। অনুর শরীরটা খারাপ। জ্বর এসেছে। সকাল থেকেই দেখছি জ্বরটা আবার এসেছে। এখন দেখছি বাড়ছে। সরি রে। আমি জয়েন করতে পারছি না আজকে।
-ওহ শিট! কি বলিস! ভাবির হঠাৎ কি হলো? আজকের প্ল্যান ক্যানসেল তাহলে। আমি বাকিদেরকে ব্যাক করতে বলছি।
-আরে!? রিশাদ? না না না। পাগল নাকি তুই? অনুকে আপাতত ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। এখন সবাই লাঞ্চ না করে ব্যাক করলে তো আরেক ঝামেলা। তার চেয়ে তোরা নিজেদের মতো করে ঘোরাঘুরি কর। মেডিসিন নিয়েছে তো। সন্ধ্যের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
-ওকে ভাই। আমাকে জানাস কোনো দরকার হলে।
-ওকে ভাই। রাখছি রে। কিছু খেয়ে আমিও ঘুমাই একটু। টায়ার্ড লাগছে প্রচন্ড।
রিশাদ কলটা কাটতেই অরণ্য মোবাইলটা পাশে রেখে অনামিকার দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো মেয়েটা ওর শার্টটা খামচে ধরে হালকা হালকা কাঁপছে। সম্ভবত রিশাদ আর অরণ্যের কথাগুলো শুনতে শুনতে অজান্তেই ফুঁপিয়ে উঠছিল মেয়েটা। রিশাদের এমন এক্টিং দেখে রাগেই সম্ভবত কান্না এসে গেছে অনামিকার। এতো নিখুঁত অভিনয় স্বয়ং শয়তানও করতে পারে কি না কে জানে! অনামিকার ফোঁপানো টের পেয়ে অরণ্য হালকা করে অনামিকাকে টেনে বসিয়ে দেয়ারে চেষ্টা করতেই অনামিকার ঘাড়ে কালশিটে কামড়ের দাগটায় চোখ আটকে গেল অরণ্যের। অজান্তেই অনামিকার হাতটা যে শক্ত করে চেপে ধরেছে সেটাও টের পেল না অরণ্য। অনামিকার ঘাড়ে ফুটে থাকা কালশিটে দাগটা হাতে ছুঁয়ে অজান্তেই একটা প্রশ্ন বেরিয়ে গেল অরণ্যের মুখ দিয়ে।
-এটা কিসের দাগ?
রাতের বেলা,
খাওয়া দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে কেবলই সবাই শুয়েছে এমন সময় সবাই ধড়ফড় করে উঠলো অরণ্যের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে। কাঁচ জাতীয় কিছু একটা ফ্লোরে ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাওয়ার শব্দে গেস্টরুমে থাকা অরণ্যর কাজিনরা সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়াচাউয়ি করলো। কিছু একটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিল্লাচিল্লি করে একটু পরেই গেস্টরুমেই এসে হাজির হয়েছে অরণ্য। হাতে একটা বালিশও আছে দেখে রিশাদ আর বাকিরা একজন অন্যজনের তাকিয়ে অরণ্যকে কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা সেটা ভাবার চেষ্টা করলো। অবশ্য প্রশ্ন করার মতো সুযোগ অরণ্য কাউকে দিলোই না। ফ্লোরে যে বেডিংটা পাতা ছিল সেখানেই বালিশটা ফেলে ধপ করে শুয়ে পড়লো অরণ্য। বাকিরা থতমত খেয়ে অরণ্যের রাগে লাল মুখটা দেখে চুপসে গেল। প্রশ্ন করার সাহস কারো হলো না। অরণ্যের রাগে গজগজ করতে থাকা কয়েকটা কথা শুনেই সবাই যে যার মতো কাহিনী আন্দাজ করার চেষ্টা করলো কি ঘটেছে। অরণ্য তখনো চোখের উপরে হাতের বাহুটা দিয়ে মুখ ঢেকে নিজের মনেই বিড়বিড় করছে।
-তার একেক দিন একেক কাহিনী। এটা হয়েছে, ওটা হয়নি। এটা বলবো না, আজ না কাল, কাল না পরশু। এমন বালের কাহিনী করতে বিয়ে করেছিলাম। শালার জীবনটাই তেজপাতা বানিয়ে দিলো। ইচ্ছে করতেসে সব ছেঁড়েছুড়ে বনবাসে চলে যাই। প্রতিদিনের এসব কাহিনী তাহলে আর দেখতে হতো না। ডিজগাস্টিং।