০৯!!
শ্রুতির কথা শুনে আগেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল রূপকথার। কিন্তু এখন শুনছে আরিশ নাকি শ্রুতিকে দেখেছে। ভয়টা এবার যেন মনের মধ্য জেঁকে বসেছে।
- কোথায় শ্রুতি? এখানে সে আসবে কিভাবে?
- বোকার মত কথা বলছো কেন রূপ? ও তো বাংলাদেশেই থাকে।
- কিন্তু বাংলাদেশ তো আর ছোট কোনো জায়গা না।
- পৃথিবীটা গোলাকার। এত দিন পর যখন আমি শ্রুতিকে দেখেছি তখন আমি ওকে খুঁজে বের করবোই।
- খুব ভালোবাসেন শ্রুতিকে?
- খুব বললেও অনেক কম হয়ে যাবে।
রূপকথা অস্পষ্ট স্বরে বললো,
- আমিও যে আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি!
- কিছু বললে?
- না। গ্রীণ সিগনাল দিয়ে দিয়েছে। চলুন
আরিশ ড্রাইভ করা শুরু করেছে। এদিকে রূপকথার কান্না পাচ্ছে। তবে কি এতদিনে ভুল মানুষকে ভালোবাসলো সে!
রূপকথাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আরিশ নিজের বাড়ি গিয়েছে। রূপকথা রুমে গিয়ে দরজা লক করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নায় থাকা নিজের প্রতিবিম্বের তাকিয়ে বলে,
- এত সাজগোছ কার জন্য করলাম? অন্যের ভালোবাসার মানুষটির জন্য? আরিশ যে কাউকে ভালোবাসতো কই আগে তো বলেনি আমাকে। বলবেই বা কেন! আমি ওর কে? আমি তো কেউ না ওর!
শাড়িটা টেনে খুলে ফেলে রূপকথা। সাথে কানের দুল, হাতের চুড়ি। পুরো ফ্লোর জুরে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফ্লোরে বসে পরে রূপকথা।
-কেন! বারবার কেন আমার সাথেই এমন হয়। আমার জীবনটা এত অবহেলিত কেন, কেন আমি নিজে এত অবহেলিত। আজ আমার ভালোবাসাও অবহেলিত হতে যাচ্ছে। সব হারিয়ে যখন একটা মানুষকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলাম তখন আল্লাহ সেই মানুষটাকেও অন্যের জন্য পাঠালো। সবার সাথেই আমার সম্পর্কটা কি অবহেলিত!! অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে রূপকথা।
৬ দিন পর পিংকিকে রিলিজ করে দেওয়া হয় বাড়িতে। এতদিন প্রিয়া নিজেও কলেজে যেতে পারেনি। যতই হোক বড় আপু বলে কথা। তাকে এই অবস্থায় রেখে কোথাও শান্তি পেতো না।
আজ অনেকদিন পর কলেজে আসলো প্রিয়া। কিন্তু গিয়ে দেখলো রূপকথার মন খারাপ।
- কি রে রূপ? কি হয়েছে?
- কিছুনা
- সত্যি করে বল।
- বললাম তো কিছুনা।
- আমার দিকে তাকা। আমাকে বলবি না কি হয়েছে?
এবার রূপকথা ছলছল দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়ার দিকে। প্রিয়া বেশ বুঝতে পারে যে সাংঘাতিক কোনো বিষয়। তাই ক্লাস না করে রূপকথাকে নিয়ে একটা পার্কে যায়। নিরিবিলি একটা জায়গায় গিয়ে বসে দুজন।
- এবার বলতো কি হয়েছে?
- (চুপ)
- আরে বলনা! আরিশের সাথে দেখা হয়নি?
- হয়েছে।
- তাহলে? আরিশ কিছু বলেছে?
- না।
- তাহলে কি হয়েছে বলবি তো।
- আরিশ অন্য কাউকে ভালোবাসে।
- কিহ! তুই কি করে জানলি?
- ও নিজেই বলেছে।
- কবে?
- কালকে
- এই এতদিনে না বলে কালকেই বললো। রিলেশন কি কয়েকদিনের?
- না, অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে। কথায় কথায় কাল উঠলো এসব কথা।
- তুই শিওর?
- হুম।
- কি করবি তাহলে?
- কি আর করবো! জোর করে তো আর ভালোবাসা হয়না।
- কিন্তু তুই তো আরিশকে ভালোবাসিস।
- তাতে কি? আরিশ তো আর আমাকে ভালোবাসে না।
- তোর কষ্ট হচ্ছে না এভাবে বলতে?
- কষ্ট হলেই বা কি? সত্যি তো এটাই।
- আমার মনে হচ্ছে এমন কিছুই হবে না রূপ। আরিশ তোরই থাকবে।
এবার রূপকথা প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
- খুব ভালোবাসিরে আমি আরিশকে। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
- কান্না থামা প্লিজ। এত ইমোশনাল হলে হয় নাকি বোকা! তুই আমাকে বলতো ওদের রিলেশন রানিং কতদিন ধরে?
- রিলেশন নেই এখন।
- মানে?
- ব্রেকাপ হয়েছে আরো আগেই।
- তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই।
- সমস্যা আছে।
- কি সমস্যা?
- আরিশ এখনো ভালোবাসে ওকে।
- যোগাযোগ আছে নাকি?
- না।
- তুইও তো আরিশকে তোর ভালোবাসার কথা বলিসনি। ঐ মেয়ের সাথে আরিশের সম্পর্ক ঠিক হওয়ার আগেই তুই তোর ভালোবাসার কথা আরিশকে জানিয়ে দে।
- এটা কি করে সম্ভব?
- অসম্ভবের কি হলো? বাই দ্যা ওয়ে, এই রূপ তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস?
- হুহ! স্বাভাবিক। আমি মেয়ে হয়ে কিভাবে বলবো!
- ওলে বাবালে। দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, সমস্যা নেই। বলে দে।
- বলবো?
- আরে বাবা হ্যাঁ।
- এজন্যই তোকে আমার এত এত এত ভালো লাগে।
- কি জন্য?
- এই যে, যেকোনো সমস্যা তুই সহজেই সমাধান করতে পারিস।
- হু হইছে, শুকনো কথায় পেট ভরে না।
- কি খাবি বল?
- চল ফুসকা খাই।
- ওকে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে রূপকথা ও প্রিয়া দুজনেই দুইদিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে আগাচ্ছে। আকাশটা মেঘলা মেঘলা। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। ঝিরিঝিরি ফোঁটা পড়ছে বৃষ্টির। রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে প্রিয়া। ইচ্ছে করেই কোনো গাড়ি নিচ্ছে না প্রিয়া। এভাবে হাঁটতে দারুণ লাগছে প্রিয়ার।
মনে পড়ে গেল আজ থেকে ২ বছর আগের কথা।
- এই বাবুই প্লিজ প্লিজ দাঁড়াও। ভুল হয়ে গেছে তো আমার।
- চুপ কোনো কথা বলবা না তুমি।
- আমি স্যরি তো।
- রাখো তোমার স্যরি। যাও বেশি করে সুন্দরী মেয়ে দেখো।
- আমার সুন্দরী তো তুমি।
- চুপ! ঢপবাজ। তখন তাইলে অন্য মেয়ের দিকে তাকালি কেন?
- ঐটা তো তোমাকে রাগানোর জন্য তাকিয়েছি।
- ভালো করছিস, এখন রাগ ভাঙ্গা দেখি কেমন পারিস।
- তুমি তুইতোকারি করছো আমাকে বাবুই?
- তাহলে কি আপনাকে চুমু দিবো সাহেব?
আরিশ গালটা বাড়িয়ে দিলো।
- দাও না দাও, এইখানে দাও। আমি কি না করেছি বলো।
প্রিয়া দাঁত কটমট করতে করতে রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটা শুরু করলো।
- এই এই, আবার কই যাও।
- কথা বলবা না একদম।
প্রিয়া হেঁটে চলছে। তখনো আকাশ মেঘলা। বৃষ্টির ফোঁটা টুপটুপ করে পড়ছে। না চাইতেও মনে ভালো লাগা কাজ করে তখন। পেছনে তাকিয়ে দেখে আরিশ নেই। মেজাজ টা যেন আরো খারাপ হয়ে যায় প্রিয়ার।
এমনিতেই রেগে আছি, কই রাগ ভাঙ্গাবে। তা না! আমাকে একা রেখে চলে গেলো। বদ বজ্জাত ছেলে একটা।
পেছনে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটছিল আর আরিশের গুষ্টি উদ্ধার করছিলো প্রিয়া। সামনে তাকাতেই ঠাস করে ধাক্কা খায় প্রিয়া। উহু, অন্য কারো সাথে নয় আরিশের সাথেই। প্রিয়া টাল সামলাতে না পেরে আরিশের উপর পড়ে, প্রিয়ার ঠোঁট সোজা আরিশের ঠোঁটকে স্পর্শ করে। আরিশ শক্ত করে ধরে আছে যাতে পড়ে না যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যায় প্রিয়া। প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে, এক তোড়া গোলাপ ফুল প্রিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
- এই বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে বলতে চাই, এই বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটার কসম করে বলতে চাই, তোমার রাগান্বিত চেহারাটা এতই ভালো লাগে যা অন্য যেকোনো সৌন্দর্যকে হার মানায়। অন্য মেয়ের কথা শুনে যখন তুমি জেলাস হও, তোমার ঐ জেলাসময় চোখেমুখে আমি আমার জন্য তীব্র ভালোবাসা দেখতে পাই।
ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি তোমাকে।
প্রিয়া কিছু বলতে পারে না। ফুলগুলো নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরিশকে। ততক্ষণে বৃষ্টি জোরে পড়া শুরু করেছে। আশেপাশে অনেক মানুষ। কিন্তু কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না কারণ ঐটা বিদেশ। কেউ কেউ আবার মুচকি মুচকি হাসছে।
অতীতের কথা মনে পড়াতে প্রিয়ার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুঁটে উঠে সেই সাথে জরো হয় চোখের জল। কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছে না কারণ বৃষ্টি যে চোখের পানি নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। কখন যে বৃষ্টি এত জোরে আরম্ভ হয়েছে সেদিকে হুস ছিল না প্রিয়ার। হুস ফিরে তখনই যখন একটি গাড়ি কাঁদা ছিটিয়ে দিয়ে যায় প্রিয়ার গায়ে।
প্রিয়া রাগে হাত উঁচু করে গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
- আরে ইডিয়ট নাকি! এখনো গাড়ি ড্রাইভ করা শিখেনি। একেই তো কাঁদা ছিটালো আবার স্যরি পর্যন্ত বললো না।
কলেজ ড্রেসে কাঁদা লেগে একাকার হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির পানির সাথে হাত দিয়ে কাঁদা সরাচ্ছে ড্রেস থেকে। গাড়িটা যে পেছনে ব্যাক করে ওর সামনে এসেছে সেদিকে খেয়াল নেই ওর। হঠাৎ করে যখন মাথা উঁচু করে সামনের দিকে তাকায় প্রিয়া ভূত দেখার মত চমকে উঠে। গাড়ির কাঁচ খুলে কেউ একজন খুব মায়াভরা চাহনীতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মানুষটি আর কেউ নয়। আরিশ! প্রিয়ার আরিশ। প্রিয়া যেন নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। চুপ করে তাকিয়ে আছে।
আরিশ গাড়ি থেকে নেমে প্রিয়ার সামনে দাঁড়ায়। প্রিয়া তো আগেই ভিজেছে। এবার সাথে আরিশও ভিজছে। প্রিয়া এবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে আরিশের। ও শিওর হতে চাইছে সত্যিই কি সে আরিশ নাকি!
আরিশ কালো প্যান্টের সাথে নীল কালার শার্ট পড়েছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। বাম হাতে ঘড়ি। আরিশের চোখের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ কতগুলো দিন পর দেখছে আরিশকে এত কাছ থেকে।
আচমকা আরিশ, প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে।
প্রিয়া কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে আরিশকে বলে,
- আর..আরিশ! কি ক করছো এটা! ছাঁড়ো আমায়। এটা অস্ট্রেলিয়া না, এটা বাংলাদেশ। মানুষ খারাপ বলবে।
- তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। ওরা তো জানেনা আমি কি খুঁজে পেয়েছি এতদিন পর। আমি যে আমার জীবন, আমার ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি।
- এতদিন মনে পড়েনি?
- অনেক অনেক খুঁজেছি তোমাকে বাবুই।
- আরিশ আমাকে ছাড়ো
- না, না আমি আর হারাতে পারবোনা তোমাকে।
- কি শুরু করলে পাবলিক প্লেসে।
- অনেক কিছু বলার আছে তোমায়। তাহলে গাড়িতে চলো।
- না, আমি তোমার গাড়িতে যাবো না।
- তাহলে আমিও ছাড়বো না তোমায়।
আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরিশ। প্রিয়া কোনো উপায় না দেখে রাজি হয়ে যায়।
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে দুজন। এক হাত দিয়ে ড্রাইভ করছে আরিশ। অন্য হাত দিয়ে প্রিয়ার হাত ধরে আছে মুষ্টিবদ্ধ করে। এই বুঝি হারিয়ে গেলো!
এতদিন পর আরিশকে পেয়ে প্রিয়ার মনে যে কি ভালোলাগা কাজ করছে তা বলে বোঝাতে পারবেনা। কারণ প্রিয়া যে অনেক বেশিই ভালোবাসে আরিশকে।
- বাবুই
- হু
- আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?
- কিসের ক্ষমা?
- আমি ভুল করেছিলাম তোমাকে ভুল বুঝে।তোমাকে অনেক খুঁজেছি আমি অনেক। আমাকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও দাওনি তুমি। কিন্তু এবার যখন আমি এই সুযোগটা পেয়েছি আর হাত ছাড়া করতে চাইনা। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। অনেক ভালোবাসি তোমাকে অনেক।
- আরিশ আমি তো........
আরিশের ফোন আসায় সম্পূর্ণ কথা বলতে পারেনি।
আরিশ কলটা কেটে দেয়।
- বলো কি যেন বলছিলে?
- ফোনটা রিসিভ করো
- পরে কল ব্যাক করবোনি।
- আমার সামনে কথা বলতে সমস্যা? পার্সোনাল কেউ?
- আরে না। ও তো...
এর মধ্যে আবার কল আসে। এবার ফোনটা রিসিভ করে আরিশ।
- হ্যালো রূপকথা বলো।
রূপকথা!!! রূপকথা নামটা শুনে কলিজা কেঁপে উঠে প্রিয়ার। কোন রূপকথা ফোন দিয়েছে আরিশকে। প্রিয়া এতদিন যেটা ভাবতো সেটাই কি সত্যি তবে? প্রিয়ার আরিশই কি তবে রূপকথার ভালোবাসা!!!
না আর ভাবতে পারছে না প্রিয়া। অস্থিরতা কাজ করছে।
কল রেখে প্রিয়ার হাত শক্ত করে ধরে আরিশ।
- কি হলো বাবুই? এমন চুপচাপ হয়ে গেলে কেন?
নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে আরিশকে প্রশ্ন করে প্রিয়া
- কে ফোন করেছিল?
- রূপকথা।
- গার্লফ্রেন্ড?
- চুপ!! কিসের গার্লফ্রেন্ড? আমার ভালোবাসা শুধু তুমি, তুমি শুধুই তুমি।
- তবে কে?
- খুব ভালো ফ্রেন্ড আমার। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে।
- ছবি আছে?
- হ্যাঁ আছে।
- কই দেখি।
- তুমি না!! আগের মতই জেলাসী আছো এখনো হাহাহা।
দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
আরিশ ফোন থেকে রূপকথার ছবি বের করে প্রিয়ার হাতে দেয়।
রূপকথার ছবি দেখে বুকে মোচর দিয়ে উঠে প্রিয়ার। এ যে আর কেউ নয়। এ যে সেই রূপ! প্রিয়ার এতদিনের ফ্রেন্ড। এই রূপই যে আরিশকে এত্ত ভালোবাসে। কিছুক্ষণ আগে তাহলে আমার কথাই আমাকে বলছিল রূপ। কিন্তু রূপ তো জানেনা আমিই সেই শ্রুতি। প্রিয়া মেহেবুব শ্রুতি!!
যদি রূপ জানতে পারে ওর কলিজার ফ্রেন্ড, যাকে ও বোনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে সেই আমিই আরিশের ভালোবাসার শ্রুতি! তখন কি করবে রূপ। সহ্য করতে পারবে তো? কি করবো এখন আমি!!! একদিকে আরিশ আর অন্যদিকে রূপকথা!
১০!!
নিজের রুমে পায়চারী করছে প্রিয়া। একদিকে আরিশকে সে ভালোবাসে অন্যদিকে রূপকথা আরিশকে ভালোবাসে। প্রিয়ার পক্ষে না আরিশকে ছাড়া সম্ভব আর না রূপকথাকে কষ্ট দেওয়া সম্ভব।
-এদিকে তো আমি রূপকে বলে দিয়েছি আরিশকে ভালোবাসার কথা জানাতে। রূপ যখন আরিশকে ভালোবাসার কথা বলবে, তখন আরিশ তো রূপকে ফিরিয়ে দিবে। তখন! তখন কি হবে। না রূপ কখনো আরিশকে পাবে আর না আরিশ কখনো রূপকে ভালোবাসবে। কি করবো এখন আমি! কি করে রূপকে বলবো যে তোর ভালোবাসার মানুষটিই যে আমার আরিশ।
রূপ কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না এটা। কি করবো তাহলে আমি! আচ্ছা আরিশের সাথে তো আমার কোনো সম্পর্ক নেই এখন। তাহলে আরিশ তো চাইলেই পারে রূপকে ভালোবাসতে। কিন্তু আমি কি করে থাকবো আরিশকে ছাড়া। এতগুলো সময়, দিন, সপ্তাহ্, মাস, বছর যে আমি ওর ফিরে আসার প্রতিক্ষায় ছিলাম। সেই আমি কি করে আরিশকে অন্যের হাতে তুলে দিবো!
রূপকথাকে আটকাতে হবে। কোনোকিছু না ভেবে আগেই রূপকথার ভালোবাসার কথা আরিশকে জানানো যাবে না। কিন্তু রূপ তো কালই দেখা করবে আরিশের সাথে। আর আমি তো দেখা করতে বলেছি কাল বিকেলে।
আমি বরং কাল সকালে রূপের বাসায় যাই।
পরেরদিন সকালবেলা:
রূপকথা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিচ্ছে। আজকেও রূপ শাড়ি পড়েছে। তবে চুল খোঁপা করেনি। খোলা রেখেছে। কারণ আরিশের পছন্দ এটা।
রূপকথা এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে কি করে বলবে নিজের মুখে যে সে আরিশকে ভালোবাসে!
- না যে করেই হোক আমায় বলতেই হবে। আমি যে আরিশকে ভালোবাসি খুব বেশিই ভালোবাসি।
রূপকথা রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়ে। আরিশের বাসায় গিয়ে আরিশকে সারপ্রাইজ দিবে তাই।
এদিকে প্রিয়া ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেয় রূপকথার কাছে যাওয়ার জন্য। রাস্তায় জ্যামে আটকে আছে প্রিয়া।
- উফ! বিপদের যেন শেষ নেই আর। একেই তো দেড়ি হয়ে গেলো তার মধ্যে আবার জ্যামে আটকা পড়লাম। রূপ আবার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লো না তো!
ওকে বরং একটা ফোন দিয়ে দেখি।
রূপকথার নাম্বারে ডায়াল করে। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না রূপ।
- ধুর! আগেই রূপকে কল করা উচিত ছিল আমার। আল্লাহ্ জানে কি আছে কপালে।
ফোনের রিংটোনে তাড়াতাড়ি প্রিয়া ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে। নিশ্চয় রূপ ফোন দিয়েছে। কিন্তু পরক্ষণে দেখে আরিশ কল করেছে।
হায় আল্লাহ্! রূপ কি তবে এতক্ষণে আরিশকে প্রপোজ করে ফেলেছে?
- হ্যালো
- হ্যালো বাবুই
- হুম বলো
- স্যরি গো?
- স্যরি কেন?
- আমাকে ইমার্জেন্সি চিটাগাং যেতে হচ্ছে একজন রোগীর অপারেশনের জন্য। তাই বিকেলে যে দেখা করবো বলেছিলাম এটা আজ সম্ভব নয়।
- এতে স্যরি বলার কি আছে আরিশ? তুমি একজন ডক্টর। তোমার দায়িত্ব এটা।
- এজন্যই তোমায় আমার এত ভালো লাগে। কত বুঝো তুমি আমায়!
- আসবে কবে?
- ২/৩ দিন পরই।
- আচ্ছা সাবধানে যেও।
রাখি।
ফোনটা কেটে দিয়ে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে প্রিয়া। যাক এ যাত্রায় তাহলে বাঁচা গেল। আরিশ ফিরে আসার আগেই কোনো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
অনেক্ষণ হলো জ্যাম নেই এখন। রূপকথার বাসায় গিয়ে কি হবে । আরিশ নিশ্চয় রূপকেও বলে দিয়েছে সে দেখা করতে পারবে না। তবুও আরেকবার ফোন দিয়ে দেখি।
নাহ্ এবারও রিসিভড করছে না। বোধ হয় ফোন সাইলেন্ট করা।
- ড্রাইভার গাড়ি বাড়ির দিকে নাও।
বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে প্রিয়া মনে এক প্রকার শান্তি পাচ্ছে। অন্য সময় হলে খারাপ লাগতো, রাগ করতো আরিশের সাথে।
প্রিয়া সবেমাত্র বাড়িতে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। এর মধ্যেই ফোনটা বেজে ওঠে। রূপ ফোন দিয়েছে।
- হ্যালো রূপ বল
- হ্যালো, আমি রূপ নই।
- তাহলে কে আপনি? রূপকথার ফোন আপনার কাছে কেন?
- আপনি আমাকে চিনবেন না। এটা যার ফোন সে এক্সিডেন্ট করেছে।
- হোয়াট! কি বলছেন এসব?
- হ্যাঁ। তার কল লিষ্টে প্রথমে আপনার নাম্বার দেখলাম তাই আপনাকেই কল দিলাম। তাড়াতাড়ি সিনহা হাসপাতালে চলে আসুন
- হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি এখনি আসছি।
হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে পড়ে প্রিয়া। মনে হচ্ছে মাথার উপর আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে তার। হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে পড়ে, গাড়িও নেয়নি। পথে দেখা হয় আদিত্যের সাথে। আদিত্য গাড়ি থেকেই খেয়াল করলো প্রিয়া দৌড়ে দৌড়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। আদিত্য গাড়ি ঘোরায়। প্রিয়ার পেছন পেছন যাচ্ছে।
স্নেহার সাথে রূপকথা ও প্রিয়ার সম্পর্ক ঠিক হওয়ার পর প্রিয়ার সাথে আদিত্যর ভালো একটা ফ্রেন্ডশিপ হয়ে যায়।
এতক্ষণে গাড়ি দাঁড় করে প্রিয়ার সামনে। আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে এসে প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করে,
- কি হয়েছে? এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন?
প্রিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
- রূপ...রূপ!
- হ্যাঁ রূপ কি?
- রূপ এক্সিডেন্ট করেছে!!!
- কি বলছো? কিভাবে?
- জানিনা এতকিছু, আমাকে একজন ফোন দিয়ে জানালো। আমি এখন হাসপাতালেই যাচ্ছি।
- চলো আমিও যাবো
হাসপাতালে পৌঁছে রিসিপশনে খবর নিয়ে রূপকথার কেবিনের দিকে এগুলো। রূপকথাকে দেখে থমকে আছে প্রিয়া! নিথর হয়ে আছে পুরো দেহটা।
শাড়ি ব্লাউজ রক্তে ভিজে আছে পুরো। হাতে কাঁচের চুড়ি গুলো ভেঙ্গে আছে। ড্রেসিং করছে নার্সরা। ডক্টর এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
- রোগি কি হয় আপনাদের?
আদিত্য আর আমি একসাথেই উত্তর দিলাম,
- আমার বোন হয়
- আমার শালিকা হয়!
- ওহ আচ্ছা! রোগির আপনারা ছাড়া আর কেউ নেই? আই মিন বাবা মা?
- আছে, বাবা আছে। কিন্তু খবর দেওয়া হয়নি।
- কি বলছেন? এখনো খবর দেননি।
এবার আদিত্য বললো,
- আমরাই জেনেছি অন্যদের মাধ্যমে। আগে বলুন ওর কি হয়েছে?
- প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। মাথা আর পায়ের চোট'টা বেশি পেয়েছে। আর প্রচুর পরিমাণে ব্লিডিং হয়েছে।
- আপনারা ওর অপারেশন ইমার্জেন্সি শুরু করুন। টাকার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না।
রূপকথাকে অটিতে নিয়ে যায়। এদিকে প্রিয়া কান্না করতে করতে ফ্লোরে বসে পড়ে। আদিত্য প্রিয়াকে দেখে অবাক হয়ে যায়। রূপকথার কষ্ট যেন প্রিয়ার কষ্টকে দ্বিগুণ করে তুলছে। আদিত্য প্রিয়াকে দু'হাতে আঁকড়ে ধরে তোলে।
- প্লিজ প্রিয়া কান্না থামাও। এভাবে কাঁদছো কেন? রূপকথার কিচ্ছু হবে না
- সত্যি বলছেন তো আপনি? রূপের কিছু হবে না?
- হ্যাঁ। এবার তুমি কান্না থামাও তো। কান্না করতে করতে হেঁচকি উঠে গেছে একদম।
পাশাপাশি বসে আছে আদিত্য আর প্রিয়া।
- বলছিলাম কি রূপের আব্বুর নাম্বার তো আমার কাছে নেই, আপনি যদি ফোন দিয়ে জানাতেন একটু।
- আমার কাছেও তো নেই। ওয়েট স্নেহাকে ফোন করি।
- হ্যালো স্নেহা
- হুম ডিয়ার, কি খবর? এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়লো?
- স্নেহা বিপদ ঘটে গেছে
- মানে? কি হয়েছে?
- রূপকথা এক্সিডেন্ট করেছে। এখন ওর অপারেশন চলছে। তোমরা তাড়াতাড়ি চলে আসো।
- কিন্তু আদিত্য আমি তো এখনো গ্রামে আছি। নানুর অবস্থা ভালো নয়। আমি আজকে আসতে পারবোনা তবে কালকের মধ্যেই রওনা দিবো আমি। আব্বুকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছি আমি।
- আচ্ছা ঠিক আছে রাখছি এখন।
আদিত্য একসাইডে গিয়ে কথা বলছিল। নার্সের ডাকে সে পিছনে ঘুরে তাকায়।
- এক্সকিউজ মি, আপনি রূপকথার রিলেটিভ না?
- হ্যাঁ কি অবস্থা ওর?
- অপারেশন এখনো শেষ হয়নি কিন্তু ঐদিকে আপনার স্ত্রী কান্না করতে করতে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি আসুন।
১০২ নং কেবিনে আছে এখন!
আদিত্য এবার ঘাবড়ে যায়! আমার স্ত্রী মানে? আমি তো এখনো বিয়েই করিনি আর স্নেহাও তো এখানে নেই। তবে কি তারা প্রিয়াকে আমার ওয়াইফ ভেবে নিয়েছে!
অতসব না ভেবে আদিত্য ১০২ নং কেবিনে যায়। প্রিয়া শুয়ে আছে। কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। যেন আস্ত একটা মায়াবতী এই মেয়ে। অথচ একসময় এই মেয়েটাকেই সহ্য করতে পারতাম না। যেখানে এখন রূপের পাশে স্নেহার কাছে থাকার কথা সেখানে এখন প্রিয়া আছে। শুধু আছে বলছি কেন, চিন্তায় কান্না করতে করতে সেন্সলেস পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। একটা চেয়ার টেনে প্রিয়ার বেডে পাশে বসে। স্নেহার কথা খুব করে মনে পড়ছে আদিত্যের।
স্নেহার প্রপোজাল যখন আদিত্য এক্সেপ্ট না করে তখন সেই ছোট মেয়েটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নেয়। কি পাগলামিটাই না করেছিল। হুম স্নেহার পাগলামি বাধ্য করেছিল আদিত্যকে স্নেহাকে ভালোবাসতে। সেদিনও এমনভাবে স্নেহা শুয়ে ছিল।
আদিত্যকে একজন নার্স এসে জানায়, রূপকথার অপারেশন সাক্সেসফুল। তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে। এখন একটা কেবিনে শিফ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
- আলহামদুলিল্লাহ্ (আদিত্য)
আদিত্য স্নেহাকে ফোন দিয়ে খবরটা জানিয়ে দেয়। প্রিয়া এখনো ঘুমে। জাগাবে নাকি জাগাবে না দোটানায় পড়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে।
সব চিন্তা বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলো প্রিয়াকে ঘুম থেকে তুলে, খবরটা জানাবে!