১৫!!
-মামী প্লিজ স্টপ ইট। অন্য ফ্যামেলি থেকে আসা মেয়েটা তোমাদের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না, কাজ পারে না, সারাদিন শুয়ে বসে থাকে, এসব বলাটা বন্ধ করো প্লিজ। আর ট্রিপিক্যাল শাশুড়িদের মতো আচরণটা করো না মামী প্লিজ। নিজের মেয়ে আর বউয়ের মধ্যে এই যে পার্থক্যটা করছো সেটাই আজকালকার সংসারগুলোর ভাঙার মেইন কারণ। নইলে তুমিই বলো তো মামি? নীলা আসার আগে কি বাড়িতে কাজগুলো সময়মতো কমপ্লিট হয়নি? নাকি নীলা আসার আগে বা পরে এই একমাসের মধ্যে মুগ্ধা কখনো রান্নাঘরের ধারেকাছে ঘেঁষেছে? তাহলে মুগ্ধার বেলাতে কেন এই কথাগুলো বলো না কখনো? ও যে কলেজের নামে বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়, বাসায় থাকলেও সারাদিন হয় মোবাইল নিয়ে পড়ে আছে, নয়তো টিভিতে। কই কখনো ওর নামে তো কমপ্লেইন করতে শুনি না তোমাকে? তাহলে নীলা এসেছে আজ ত্রিশ দিনও হলো না এখনই তোমার মনে হচ্ছে এই মেয়ে সংসারের কোনো কাজ পারে না, ওকে দিয়ে সংসার হবে না এটসেকট্রা এটসেকট্রা? হোয়াই? যে কাজটা ও পারছে না শিখে নিবে, এ আর এমন কি? খন্দকারদের বাড়িতে নীলা নিজের হাতে এক গ্লাস পানি নিয়েও খেয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। তাহলে এটা কেন আশা করছ যে এই বাড়ির বউ হয়েছে বলেই বিয়ের পরেরদিনই ওকে রান্নাঘরের দায়িত্ব দিয়ে তুমি ছুটি নিবে?
দেখতে দেখতেই মাসখানেক কেটে গেছে। এই এক মাসে জিহান নীলার সম্পর্কের খুব বেশি উন্নতি না হলেও একটা অদৃশ্য বন্ধন ঠিকই তৈরি হয়েছে দুজনের মাঝে। জিহানের টেন্ডার নিয়ে সারাদিন অফিসের ধকল সেরে বাড়ি ফেরার পর নীলা ওর মুখটা দেখে কিছু না বললেও ঠিকই গরম ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফি রুমে রেখে দিয়ে যায়। রান্নাঘরের হাজার ব্যস্ততার ভিড়েও এই কাজটা করতে ভোলে না নীলা। আর জিহানও সারাদিনের কাজ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া নীলাকে আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারাতে সাহায্য করে। এটা যেন ওদের প্রতিদিনকার অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম নীলা রাগে সরে আসলেও এখন আর বাধা না দিয়ে চুপটি করে জিহানের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে। হয়তো ক্লান্তিতে, অথবা সময়ের সাথে সাথে আবেগ, রাগ, দুঃখ অনুভূতিগুলো কেমন ভোঁতা হয়ে এসেছে মেয়েটার। অবশ্য চৌধূরী ভিলার চার দেয়ালের মধ্যে নীলার দিনগুলো কি করে কাটছে সেটা হয়তো জিহানের কল্পনারও বাইরে।
আর পাঁচটা দিনের মতোই আজও সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হলো জিহানের বাড়িতে ফিরতে। আর বাড়িতে ফিরে রুমে যাওয়ার আগেই মামী অভিযোগের খাতা খুলে বসলেন নীলার নামে। মেয়েটা সাধারণ একটা রান্নাও পারে না, ঘরের কাজ তো দূর এতোদিনের তোলা ডিনার সেটের দুটো প্লেটও ভেঙে ফেলেছে ধুয়ে রাখতে বলায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মেয়েকে দিয়ে সংসারের একটা কাজও হয় না। সারাদিন মোবাইল, নাহয় ঘুম, ইত্যাদি ইত্যাদি। যে টেন্ডার নিয়ে এতোদিন ঘুম খাওয়া এক করে লেগে ছিল, সেটাই হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায় এমনিতেই জিহানের মাথা খারাপ অবস্থা। তার উপরে জিহানের মামী দিলারা জামানের কথাগুলো বলার ফাঁকে ড্রইংরুমের টিভি থেকে ফুল ভলিউমে হিন্দি পার্টি সং বাজার শব্দে নিজের ধৈর্য্যের বাঁধটা সত্যি সত্যিই ভেঙ্গে গেছে জিহানের। নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত রেখেই কথাগুলো বলে দোতলার দিকে পা বাড়াবে এমন সময় দিলারা জামানের কান্নার শব্দে থেমে গেল জিহান। দিলারা জামান রীতিমতো বিলাপ শুরু করেছেন বলা যায়।
-এজন্যই বলে রক্ত কথা বলে জিহান। এতোগুলো দিন ওকে নিজের ছেলের মতো করে আগলে রাখার এই প্রতিদান দিলি? আজ কথাগুলো আমি না বলে তোর মা বললেও কি এভাবে অপমান করতে পারতি তোর মাকে? না পারতি না। আমি তো তোর মা নই, মামী। সত্যিই তো, তোর বউকে কিছু বলার অধিকার আছে নাকি আমার? এজন্যই বলে বিয়ের পরে ছেলেরা আর নিজের থাকে না, বউয়ের কথায় উঠে আর বসে।
-মামী প্লিজ? কথাগুলো তুমি বলো বা আমার মাই বলুক, আনসারটা সেইমই হতো। কে বলছে সেটা ডিপেন্ড করে না, ডিপেন্ড করে কে সঠিক আর কে ভুল।
-হায় আল্লাহ! এই কথা শোনানোর জন্যই এতোদিন বাঁচিয়ে রেখেছিলে? এর চেয়ে আমি মরে গেলাম না কেন? আমাকে উঠিয়ে নাও আল্লাহ! উঠিয়ে নাও।
দিলারা জামান এবারে বুক চাপড়ে এমন মরা কান্না জুড়ে দিয়েছেন যে বাড়ির সব কজন কাজের লোক ছুটে চলে এসেছে। জিহান একবার কাজের লোকেদের দিকে তাকিয়ে চলে যাওয়ার ইশারা করতেই সবাই চলে গেল। জিহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিলারা জামানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে সাগর না বানালেও মোটামুটি সাইজের একটা কূয়ো বানিয়ে দিবেন এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই জিহানের। আর উনার এমন ওভার রিএকশনটা এই প্রথমবার নয়। তাই জিহান মোটেও বিব্রত হলো না।
-কথাগুলো নীলার ক্ষেত্রে না হয়ে মুগ্ধার ক্ষেত্রে বললেও আমার জবাবটা একই থাকতো মামী। তাই এসব কান্নাকাটি বন্ধ করো প্লিজ। তোমার ওকে কাজ শিখানোর তো মায়ের মতো করে শেখাও। শুধু নীলাকে কেন? আমি তো বলবো মুগ্ধা আর নীলা দুজনকেই হাতে ধরে রান্না, ঘরের টুকটাক কাজ শেখাও তুমি। ওরা না পারলে কাজ করার লোকের তো অভাব নেই বাড়িতে। তবু প্লিজ এসব উল্টোপাল্টা কথা বলো না। জাজ করতে হলে মেয়ে আর বউ দুজনকেই সমান পাল্লায় মাপো। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।
-সেটাই তো! তোর বউকে কিছু বলার অধিকার আছে নাকি আমাদের? তোর মা হলে তার সাধ হতো না ছেলের বউয়ের সেবা নেয়ার? ওকে নিজ হাতে সব শেখানোর? তোকে বলে লাভ কি? তুই তো এখন এসব বলবিই। বিয়ে করে আগে শুনতাম মেয়ে পর হয়ে যায়, আর এখন বিয়ে দিলে ছেলে পর হয়ে যায়। হায় আমার কপাল! থাক বাবা। তোর বউকে কোনো কাজ করতে হবে না। ওকে বলে দিস কিচ্ছু করতে হবে না। আমরা আশ্রিত হয়ে আছি তো। এসব কাজের লোকদের কাজগুলো আমিই সামলে নিবো। তবু তোরা সুখে থাক বাবা, সুখে থাক।
-মামী! আরে? কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ কথা? আমি-----।
জিহানের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দিলারা জামান চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে। জিহান কিছুটা বিরক্তি নিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে রুমের দিকেই পা বাড়ালো। রুমে নীলাকে গুটিশুটি হয়ে বিছানাা শুয়ে থাকতে দেখে কোনো শব্দ না করে নিজের সুটকেসটা কাবার্ডে ঢুকিয়ে রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ ধরে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই নীলাকে কফির মগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ম্লান হাসলো জিহান। নীলার হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে টাওয়ালটা নীলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নীলাকে টাওয়াল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিহান কফির মগে চুমুক বসালো।
-আরে বাবা স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন? চুলগুলো মুছে দাও না প্লিজ? মাথাটা প্রচন্ড প্রচন্ড ব্যথা করছে।
নীলা এগিয়ে এসে বিছানায় বসে জিহানের ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হাতে মুছিয়ে দিতে দিতেই জিহান লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে আবার কফিতে আরেকবার চুমুক দিলো।
-আপনি কি কিছু নিয়ে টেনশন করছেন?
-কই না তো! আমার আবার কিসের টেনশন! খাচ্ছি ধাচ্ছি অফিস যাচ্ছি। মাস্ত লাইফ। টেনশনের কি আছে?
-তাহলে কোনো কিছু নিয়ে কি ডিস্টার্বড? আপনার তো এমনি এমনি মাথা ধরে না। কি হয়েছে বললে আপনারই ভালো। না বলতে চাইলে আর কি করা!
-বলার বা না বলার মতো কিছুই ঘটে নি নীলপাখি। আসলে টেন্ডারটা নিয়ে একটু বেশিই জল্পনা কল্পনা করে ফেলেছিলাম, তাই আজ টেন্ডারের ফাইনাল ডে তে এসে বাদ পড়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
-বিকেলবেলা তো ভাবি এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। কই কিছু তো বললো না?
-হা হা হা। সরাসরি না জিজ্ঞেস করে খুঁচিয়ে জানতে চাইছ তোমার বাবার কোম্পানি টেন্ডারটা পেয়েছে কিনা? হা হা হা।
-আমি হাসার কি বললাম? আপনারা দুই কোম্পানি তো টেন্ডারটা নিয়ে রীতিমতো রক্তারক্তি বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। আপনাড কোম্পানি না পেলে তো বাবার আর ভাইয়ার টেন্ডারটা পাওয়ার কথা।
-আমরা কেউই পাই নি টেন্ডারটা। আনএক্সপেক্টেড ব্যাপার কি জানো? যত লো কস্টে ভালোভাবে কাজটা কমপ্লিট করা যায় সেই এমাউন্ট ডিক্লেয়ার করেছিল আমি। ইভেন তোমার ভাইয়াও সব প্রোডাক্টের কোয়ালিটি চেক কটে মিনিমাম এমাউন্ট বলেছে টেন্ডারে। বাট যে কোম্পানি টেন্ডার পেয়েছে ওরা জাস্ট আমাদের থেকে হাফ ওর মে বি ওয়ান পয়েন্ট কম বলেছে। এটাই বেশি গোলমেলে লাগছে আমার। কোনো ডিটেইলস দেয় নি ওনারের, না নাম না কিছু। অদ্ভুত!
-অদ্ভুতের কি হলো? ওরা যা পারবে তাই করে দেখিয়েছে আর কি। আপনাদের মতো সবার সামনে গলা না ফাটিয়ে কাজে করে দেখিয়েছে।
-ইউ ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড নীল। কিছু একটা তো ঘাপলা আছেই এই S S industry limited কোম্পানিটাতে। আমার গাট ফিলিংস বলছে বুঝলে। নইলে জাস্ট তিন চার বছর আগে হওয়া একটা কোম্পানি তোমার বাবা আর আমাদের এতো বছরের পুরোনো কোম্পানির সাথে টেক্কা দিতে আসে!
-নিজেদেরকে একটা কিছু ভাবেন যে তাই ওরাও আপনাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে। আমি এক্কেবারে খুশি হয়েছি। হুহ।
-আরে ধুর! তোমাকে কি বলছি তুমি ব্যাপারটা তো বুঝলেই না। এতো এক্স্যাক্ট এমাউন্ট বলা পসিবলই না যদিনা অফিসের কেউ টেন্ডারের এমাউন্টটা লিক না করে। বুঝলে কি না ব্যাপারটা? আমার কোম্পানি থেকে কেউ একজন খবর লিক করছিল, আমি সেটা জানি। এই টেন্ডারের সব ক'টা আমি নিজে করেছি। তাহলে? আর তোমার ভাইয়াও টেন্ডার নিজে রেডি করেছে এবছর। ব্যাপারটা কিছুই বুঝলাম না।
-আমার এতো বুঝার দরকারও নেই। আপনারা যেমন এই বাড়িতে কি হচ্ছে ওই বাড়িতে নিউজ টেলিকাস্টের মতো করে জেনে যান, এবারও সেইম হয়েছে। পার্থক্য শুধু এবার আপনাদের দু পক্ষের নিউজই অন্য কারো বাড়িতে টেলিকাস্ট হয়েছে।
-মানে এই মেয়েটা কোথায় একটু সমবেদনা যাবে তা না! উল্টো আমার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেয়ার মতো করে খোঁচা মারছে। বলছি এসব করা ছেড়ে দাও বুঝলে। এমনিতেই মাথা গরম।
-থ্রেট দেয়া হচ্ছে?
-নোপ। সর্তক করে দিচ্ছি আর কি।
-উফফ! আপনার মাথা ধরার গল্প শুনতে গিয়ে আমার মাথা ধরে গেছে। ডিনারের টাইম হয়ে গেছে। খেতে চলুন?
-তুমি যাও। মামীকে একটু হেল্প করো। আমি আসছি।
নীলা একটা রহস্য মাখা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেয়েটার এমন হুটহাট অদ্ভুত আচরণের মানেই আজকাল বুঝতে পারে না জিহান। এই যে হুটহাট একদম সহজ, সাবলীল কথাবার্তা, আবার হুটহাট এতো রেগে যায় মেয়েটা। বোঝা মুশকিল হয়ে যায় জিহানের কাছে। জিহান কাপের লাস্ট সিপটুকুতে চুমুক দিয়ে একটা টিশার্ট পড়ে নিয়ে রুমের দরজার দিকে পা বাড়াতেই জিহানের মোবাইলটা শব্দ করে বেজে উঠলো। জিহান কাবার্ডের উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে আননোন নাম্বার দেখে কলটা রিসিভ করতেই অপেরপ্রান্ত থেকে কারো হুড়মুড় করে বলা কথাগুলো শুনতে পেল জিহান।
-এই আপনি নীলাকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন মিস্টার জিহান? আসলে আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে। আসলে ভালোবেসে নয়, টর্চার করতেই মেয়েটাকে বিয়ে করার নাটকটা করেছেন আপনি। এই কাজটার জন্য আপনাকে কখনোই ক্ষমা করবো না আমি। কখনোই না।
১৬!!
-নিজেদের শত্রুতার জের ধরে এভাবে একটা মেয়ের জীবনটা নষ্ট করার পরও এমন শান্ত ভঙ্গিতে আপনি বসে আছেন যেন কিছু করেনইনি। বাহ জিহান সাহেব বাহ! এই ধোঁকাবাজি, শত্রুতা ভরা পৃথিবীতে দুজন মানুষকেই এসব নোংরা খেলায় নিজেদেরকে কলুষিত করেন নি ভাবতাম এতোদিন। আপনি আর আবরার। সেদিন আপনার ফার্মহাউজে নিজের পি.এ কে পাঠিয়েছে শুনে আবরারের উপরে বিশ্বাসটা নষ্ট হয়ে গেছে। আর আজ! আজ নিজের চোখে নীলাকে এই পরিস্থিতিতে না দেখলে জানতেও পারতাম না আপনিও নিজের জেদের বশেই মেয়েটার সাথে ভালোবাসার নাটক করেছেন। এই প্রথমবার আমার মনে হচ্ছে চার বছর আগে যখন নীলা আপনার কথা আমাকে বলেছিল, তখন মা হিসেবে নয়, ভাবি হিসেবে ওকে আপনার দিকে যাওয়া থেকে আটকানো উচিত ছিল। আমার নীলাকে বোঝানো উচিত ছিল প্রতিপক্ষ দুটো পরিবার কখনোই আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারে না। আমার বোঝা উচিত ছিল যে নিজেদের জেদ ধরে রাখতে আপনারা আরেকটা মানুষের জীবন নিয়েও খেলতে পিছপা হবেন না।
নিহারের একনাগাড়ে বলা কথাগুলোর একটা মানেও জিহান বুঝতে পারে নি। নিহার বাসায় এসেছিল কথাটা মাত্রই তো নীলা ওকে বলেছে। কোনো প্রবলেম হয়ে থাকলে সেটাও তো নীলার বলার কথা ছিল। কিছুই যদি না হয়ে থাকে নাহলে নিহার এখন এতো রিএক্টইবা করছে কেন? সবই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে জিহানের। একে তো সারাদিনের ক্লান্তি, টেনশন, আর এখন নিহারের এসব কথা! সব মিলিয়ে চোখে সর্ষফুল দেখার অবস্থা জিহানের। নিহারকে কি বলবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না ছেলেটা।
-চুপ করে কেন মিস্টার জিহান? আনসার মি ড্যাম ইট! আপনার পরিবারের কাছে প্রতিনিয়ত অপমানিত, অসম্মানিত করার জন্যই মেয়েটাকে নিয়ে গেছেন সেদিন জোর করে বিয়ে করে? এই ছিল আপনার ভালোবাসার নমুনা? আরে নীলার জায়গায় নিজের বোনকে একবার কল্পনা করে দেখুন তো? উনার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এমন আচরণ করলে আপনি সহ্য করতে পারতেন তো?
-ভাবি? আমি বুঝতে পারছি না আপনি এসব কি বলছেন। নীলা আমাকে আপনার আসার কথাটা বলেছে একটু আগেই। বাট কি হয়েছে আমাকে একটু বলবেন প্লিজ? কি হয়েছে? কে মিসবিহেভ করেছে নীলার সাথে?
-কি বুঝতে পারছেন না আপনি? আপনার পরিবারেট প্রত্যেকটা মেম্বার, লিটারেলি প্রত্যেকটা মোম্বার মেয়েটাকে ছোটো আর অসম্মান করতে উঠেপড়ে লেগেছে। বাহ! আর আপনি? এতোগুলো দিন পর নীলাকে দেখে আমার তো মনে হয় না আপনি একবারও ওর দিকে ভালো করে তাকিয়েও দেখেছেন বলে। বিয়ের পর থেকে নিজের ননদ নয়, সন্তানের মতো করে যাকে আদরে, স্নেহে, বন্ধুর মতো পাশে থেকেছি, তাকেই কিনা কথা শুনতে দেখে এসেছি আপনার বাড়িতে গিয়ে। আপনি বা আপনার ফ্যামেলি কি জানে না নীলা কখনো রান্নাঘরের ধারেকাছেও যায় নি? তাহলে আপনার মামি, মামাতো বোন ওকে 'রান্না পারে না' এই কথা শোনাতে? মেয়ে হয়েছে বলেই যে ঘরের সব কাজকর্ম মুখস্ত জানতে হবে, পারতে হবে এটা কোথায় লেখা আছে?
-মামি আর মুগ্ধা নীলাকে অপমান করছে?
-এটাকে শুধু অপমান করা বলে না মিস্টার জিহান। একটা মেয়ে বাপের বাড়ি থেকে সব তো শিখে আসে না। তাকে নিজেদের মতো শিখিয়ে নিতে জানলে তবেই সংসারটা পরিপূর্ণ থাকে। আর আপনার পরিবার শিখিয়ে নিবে কি? কথা শুনাতেই তো তাদের কারো নজর সরে না নীলার উপর থেকে। মেয়েটাকে না শিখিয়ে দিতে পারবে, শুধু কাজের ফরমান জারি হবে, আর ভুল হলেই তাদের লেকচার। বাহ! এটা সংসার নাকি জেলখানা বলতে পারেন মিস্টার জিহান? এসবের পিছনে আপনারও হাত আছে রাইট?
-ভাবি কিসব বলছেন? আমি আসলেই জানতাম না নীলা এসব ফেইস করছে এখানে এসে। ইভেন ও আমাকে কখনো বলে নি পর্যন্ত---।
-আপনার কি ধারণা নীলা আমাকে এসব বলেছে আর তাই আমি আপনাকে আপনার মামা মামি আর মামাতো বোনের বিরুদ্ধে উস্কাচ্ছি? এটাই বোঝাতে চাইছেন তো জিহান?
-আহহ! ভাবি আপনি রাগে কি বলছেন নিজেও জানেন না। আমি এসব কিচ্ছু মিন করি নি। আপনি লাস্ট কয়েকটা মাস ধরেই টেন্ডারের কাজটা নিয়ে বিজি। আপনি আবরার ভাইকে তো দেখছেন? টেন্ডারটা নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলাম যে আসলেই বাড়িতে এসব চলছে আমি ভুলেও টের পাই নি। আর নীলাও আমাকে এসবের ব্যাপারে কিচ্ছু বলে নি। আমি আসলেই সো সরি ভাবি। আপনার ননদকে ভালো রাখবো কথা দিয়েছিলাম, কথাটা রাখতে পারি নি।
-কথা রাখার জন্য যে মানসিকতাটা থাকা দরকার সেটা আপনার আছে? আর আপনি একটু আগে কি বললেন? নীলা আপনাকে বলে নি? আপনাকে কথাটা বললে কি হবে ও কি জানে না সেটা? নাকি আপনি জানেন না? আপনার সামনে আপনার যে মামা মামি ওর সাথে ভালো হয়ে চলার এক্টিং করে আপনি চলে যাওয়ার পরেই তারা কি করে রূপ বদলায় আপনি সেটা জানবেন কি করে? অথবা জানলেও তো চুপ করেই থাকবেন। হাজার হোক তারা আপনার বিপদের দিনে আপনার পাশে ছিল, আপনার পরিবার তারা। আর নীলা? ও কে? ও যদি ভুলেও কখনো আপনার পরিবারের নামে, বা আপনার বিপদের বন্ধুদের নামে কিছু বলেও তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে জানেন? ও আপনার পরিবারটা ভাঙতে চাইছে, আপনার প্রতিপক্ষের মেয়ে, বোন তাই মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মিলিয়ে নিয়েন আমার কথা।
-ভাবি ব্যাপারটা তেমন নয়। মামা মামীরও তো নীলাকে বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে। সবাই তো এতো সহজে আপনার ভালো দিকটা দেখবে এমন কোনো কথা নেই।
-একটা মেয়েকে প্রতিনিয়ত যদি চোখে আঙুল দিয়ে যদি এটা দেখিয়ে দেয়া হয় যে তুমি এটা পারো না, তুমি ওটা পারবে না, তোমার এসব কিচ্ছু হবে না, তাহলে মেয়েটার কন্ফিডেন্স লেভেল কোথায় নেমে গিয়ে দাঁড়ায় জানেন? মাটির সাথে মিশে যায় লিটারেলি। আর যদি পরিবার পাশে থাকে তাহলে সেই মেয়েটাই দুনিয়া জয় করতে পারে। বুঝলেন মিস্টার জিহান।
-জি ভাবি। এন্ড সো সরি। নীলা যেন এই বাড়িতে আর এসব ফেইস না করে সেটা আমি দেখবো প্রমিস।
-যে প্রমিসটা রাখতে পারবেন না সেটা দয়া করে বলতে যাবেন না। একমাস ধরে তো পাশে আছেন, এক বাড়িতে, এক ছাদের তলায়। তবু একবারও টের পেয়েছেন নীলার মধ্যে কতোটা পরিবর্তন এসেছে? ওর চোখে মুখে ফুটে ওঠা ক্লান্তিগুলো, কালচে হয়ে আসা সার্কেলগুলো হয়তো দামী মেকাপ দিয়ে ঢাকা যায়, কিন্তু যে বিষণ্ণতা বুকের মধ্যে চেপে রেখে তিলে তিলে মরছে মেয়েটা সেটাও কি আপনার চোখে পড়ে না? অবশ্য পড়বেই বা কেন?! তিলে তিলে শেষ করে দিতেই নো নিয়ে গেছেন আমার ছোট্ট নীলাকে? তাই না মিস্টার জিহান?
-ভাবি প্লিজ এভাবে বলবেন না।
-শুনুন মিস্টার জিহান। নীলার ভাবিমা হয়ে আপনাকে আপনাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি। আমার মেয়েটার যদি কিচ্ছু হয়, তাহলে আপনাকেও আমি ছেড়ে কথা বলবো না। নিহারের যতটা নম্র ভদ্র রূপ দেখেছেন, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি রূদ্র তান্ডব দেখবেন। আর আপনার মামা মামিকেও বলে দিবেন, এতো কষ্টই যখন হচ্ছে আমার মেয়েটার কাজে, ওর কোনো কাজই যখন তাদের মনমতো হচ্ছে না তাহলে আমাদের মেয়েকে আমাদের বাড়িতেই ফিরত দিয়ে দিন। আমাদের মেয়ে আমাদের চোখের মণি হয়েই চোখের সামনেই থাকুক, কষ্ট পাক, তবু কারো প্রতিদিনকার কথার থাপ্পড় তো খেতে হবে না ওর।
-ভাবি? হ্যালো? ভাবি?
নিহার যে জিহানের মুখের উপর দিয়েই কলটা কেটে দিয়েছে সেটা বুঝতে পেরে মোবাইলটা রেখে কিছু একটা চিন্তা করতে করতে ডাইনিং রুমের দিকেই পা বাড়ালো। নিচে ড্রইংরুমে আসতেই মামা, মামি, মুগ্ধা সবাইকে ডাইনিং টেবিলে বসা দেখে নিজেও চুপচাপ এসে চেয়ার টেনে বসলো। নীলা রান্নাঘর থেকে দুহাতে করে শেষ দুটো খাবারের বাটি এনে টেবিলে রেখে সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়া শুরু করেছে। জিহান চুপচাপ নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে নিতে শুরু করেছে এমন সময় পাশ থেকে বিড়বিড় করে মামীর কণ্ঠস্বরটা কানে এসে বাজায় হাত থেমে গেল জিহানের।
-রান্নাঘর থেকে খাবার টেবিলে আনতে আনতেই আধা ঘন্টা লাগিয়ে ফেলেছে। জগে পানি নেই, টেবিলে গ্লাসগুলো পর্যন্ত সোজা করে রাখার সময় হয়নি কারো। হাহ। দিলারা এসবে মাথা ঘামিও না। কাউকে কিছু বলে নিজে দোষী হবার দরকার নেই। কোনো দরকার নেই।
জিহান প্লেটে খাবার নেয়া বন্ধ করে হাত গুটিয়ে নিয়ে পানির জগটা নিয়ে উঠে ওয়াটার ফিল্টার থেকে জগটা পানিভর্তি করে টেবিলে রেখে নিজের চেয়ার টেনে বসে পড়লো। ততক্ষণে নীলা সবার প্লেটে খাবার সার্ভ করে দিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসে প্লেটে খাবার নিতে শুরু করেছে ধীর হাতে। মুগ্ধা মুখ তুলে নীলাকে একনজর দেখে হাতের ইশারায় একটা বাটি দেখিয়ে সেটা পাস করার জন্য বললো। বাটিটা দিলারা জামানের হাতের পাশে হলেও উনি মুগ্ধা যে বাটিটা নিতে চাইছে সেটা যেন উনি খেয়ালই করে নি এমন ভাব করে খাচ্ছে। নীলা নিজের প্লেটে ভাত নেয়া থামিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে দেখে জিহান নিজেই হাত বাড়িয়ে বাটিটা দিলারা জামানের দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে ধরলো এবারে।
-মামি? মুগ্ধাকে বাটিটা দাও তো?
-হুম।
-এখানে খাওয়ার টেবিলে এখন সবাই আছে। আমার কিছু বলার ছিল সেটা এখনই বলার বেস্ট টাইম বলে মনে হচ্ছে।
-কি বলবি জিহান? আমরা বাড়ি থেকে কবে চলে যাবো এটাই তো? ঠিক আছে। কাল সকালেই চলে যাবো। এই যে শুনছ? আমরা সোজা আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাবো। আর মুগ্ধা, তুই তোর ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলে দেখ কোনো হোস্টেলে সিটের ব্যবস্থা করতে পারিস কিনা। লাস্ট সেমিস্টারটা তো এখনও বাকি।
-মামি প্লিজ? পুরো কথাটা না শুনে নিজের মতো খেয়ালি ভাবনায় ডুব মেরো না। আমি একবারও তোমাদেরকে চলে যেতে বলি নি। বাট কিছু বলা আসলেই জরুরি মনে হচ্ছে তোমার এমন রিএক্টের পর। তুমি নিজেও তো বিয়ের পর একটা অন্য বাড়িতে এসেছিলে। তাদের চালচলন, রান্নাবান্না, আদব কায়দা সব কিছু কি একদিনেই রপ্ত করে ফেলেছিলে? না নিশ্চয়ই। তুমি মানো বা না মানো নতুন একটা জায়গায় এসে তাদের সাথে এডাপ্ট হতে কিছুটা হলেও সময় লাগে, তোমারও লেগেছিল, নীলারও লাগছে, মুগ্ধারও লাগবে। ইট'স ন্যাচারাল।
-তুই এখন কি বলতে চাস জিহান? তোর বউকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না এই তো? ঠিক আছে বউমা। তোমার কাল থেকে কোনো কাজ করা লাগবে না। নিজের রুম থেকে নিচে আসাই লাগবে না। তোমার খাবারটা তোমার রুমেই দিয়ে আসবো আমি বা মুগ্ধা। এবার চলবে জিহান?
-মামি প্লিজ? উফ! সব কথা এতো ইগোতে টেনে নিচ্ছ কেন বলো তো মামি? নীলা খন্দকারদের মেয়ে। ওদের সাথে আমাদের একটা বিজনেস কোলাপ্স চলছে, বাট তাই বলে ভুলটাকে ভুল বলতে তোমরাই আমাকে শিখিয়েছ। এটা ভুলে যাও কেন? মামা তুমিই বোঝাও তো মামিকে। বাচ্চাদের মতো জেদ করছে। আমার একটা কথাও শুনতে চাইছে না। অদ্ভুত!
এতোক্ষণে খাওয়া বন্ধ করে দিলারা জামানের দিকে মুখ তুলে তাকালেন জিহানের মামা, শওকত জামান, ওরফে জামান চৌধূরী। স্ত্রীর দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইলেন মিনিট খানেক। যেন গভীর ভাবনায় হারিয়ে গেছেন কোথাও।
-দিলারা ছেলেটাকে আগে বলতে দাও। আগে ওকে শেষ করতে দাও কথাটা। তারপর রিএক্ট করো তুমি। না বুঝেই রিএক্ট করে সিচুয়েশনটাকে আর কমপ্লিকেটেড করো না দিলারা। প্লিজ?
-ওকে। আমি কিচ্ছু বলবো না। আর একটা কথাও বলবো না। কাল থেকে তোমাদের যার যেমন ইচ্ছে হয় করো। কি করে রান্না হবে, কি রান্না হবে, কখন খাবে, কখন আসবে কিচ্ছু নিয়ে মাথা ঘামাবো না। নিজেদের মতো করেই যা পারো করে আমাকে একটা দিন দেখাও। তারপর তোমাদের সব লেকচার আমি শুনবো। ঠিক আছে?
দিলারা জামান রাগে গজগজ করতে করতে প্লেটের খাবারে পানি ঢেলে দিবে এমন সময় জিহান আবার বলা শুরু করলো। আর জিহানের কথাটা শুনে সবাই চোখ বড় বড় করে ওর দিকেই তাকিয়ে রইলো। জিহান ঠাট্টার মশকরা করার মতো ছেলেই নয়, যা বলে, যা করে সিরিয়াসলিই করে।
-আগামীকালের দিনের সব কাজ আমার উপরেই ছেড়ে দাও মামি। কিছু নিয়েই টেনশন করো না। রান্নার কাজ হোক বা ঘরের অন্য কাজ, আমি নীলাকে এসিস্ট করবো। যতটা হেল্প করার দরকার ততটাই করবো। আর নীলা কিভাবে বাকিটা নিজে সামলে নেয় সেটাই তুমি দেখো। কখনো হাল ছেড়ে দিয়ে নয়, পাশে থেকেও যে সহজে জটিল সমস্যার সমাধান করা যায় সেটাই কালকে দেখো। তারপর বলো নীলাকে দিয়ে সংসারটা হচ্ছে কি না।