৩১!!
-ডিয়ার মিসেস চৌধূরী, এতো কিউটিপাইয়ের মতো শান্ত হয়ে একটা মানুষ ঘুমায় কি করে বলতে পারো? একদম পরীর মতো লাগছে তোমাকে এই লাল সবুজ আধো আলোয়। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে ডিম লাইটের আলোটা যত বাড়ছে, তার সাথেই পাল্লা দিয়েই যেন তোমার সৌন্দর্যটাও বেড়ে চলেছে। এই যে তোমার এলো খোলা চুল, গুটিশুটি হয়ে একদম আমার বুকে মিশে আছো। এতোটা কাছ থেকে দেখছি তোমায়। তবু যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না। সেদিন তোমার কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে ফ্রেন্ডদের সাথে পাগলামি করা উচ্ছল হাসিমাখা মুখটা দেখার পর থেকে এই একটাই প্রার্থনা করেছি জানো? প্রতিটা দিন প্রতিটি মূহুর্তে এই ভোরের অপেক্ষা করেছি, যেদিন চোখ মেলে তোমার ঘুম জড়ানো মুখটা দেখতে পাবো। কিন্তু সেই ভোরের দৃশ্যটা এতো মোহনীয় হবে কল্পনাও করতে পারি নি জানো?
ঘুমন্ত অনামিকার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে নিজের মনেই বকবক করে চলেছে অরণ্য। লাল সবুজ আবছা আলোটায় অনামিকার বাম হাতের অনামিকায় আংটিটা একটু পর পর ঝিলিক দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে গতকাল রাতের কথাটা মনে করিয়ে দিল অরণ্য। অনামিকা কাঁপা পায়ে এগিয়ে এসে হাতের মুঠো খুলতেই আংটিটা দেখে অরণ্যের ঠোঁটের কোণে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। এই আংটিটা অনুকে অরণ্য ওদের বাসরেই পড়িয়ে দিয়েছিল। এই তিনটে মাস আংটি অনামিকার কাছে থাকলেও কখনো পড়তে দেখে নি অরণ্য। অরণ্য অনামিকার হাতের মুঠো থেকে আংটিটা নিয়ে আগেরবারের মতো যত্ন করেই পড়িয়ে দিয়ে ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিল অনামিকার হাতে। এবারে অনামিকা কেঁপে উঠেছে ঠিকই, তবে হাতটা টেনে নেয় নি। অরণ্যও তাই বিনা দ্বিধায় অনুকে নিয়ে ভালোবাসার অন্য কোনো দুনিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে, কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই।
অনামিকাকে বুকে হালকা করে জড়িয়ে নিয়ে কথাগুলো ভেবে নিজের মনেই হাসছিল অরণ্য। এর ফাঁকেই অনামিকা নিজের এলোমেলো চুলগুলো বাম হাতে সরিয়ে দিয়ে মূহুর্তের মধ্যেই অরণ্যের মুখের দিকে তাকালো। অনামিকার এমন হুট করে উঠে বসে তাকানোর অবাক হলেও অরণ্য অনামিকার মুখটা দুহাতে তুলে ধরলো। অনামিকা অরণ্যের দিকে একটু ঝুঁকে আসতেই অরণ্য অনামিকার কপালে আদরের স্পর্শ বুলিয়ে দিল।
-আর কি কি লুকিয়েছ আমার কাছ থেকে বলো তো?
-কি লুকালাম আবার? কি বলো এসব অনু?
-তুমি আমাকে আমার কলেজের সামনে দেখেছ! আগে বলো নি কেন? কবে দেখেছ? কি করে দেখলে?
-আরে বাবা ওয়েট ওয়েট! তোমাকে আমি ফার্স্ট দেখেছি তোমার কলেজের সামনে। তোমরা চার পাঁচজন মিলে ফুচকা কম্পিটিশন করছিলে। এন্ড আমার কিউটিপাই আদুরে বউটা ঝালে লাল হয়ে গেলেও জিতেছিল।
-তার মানে তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চার পাঁচটা মেয়ের ফুচকা খাওয়া দেখছিলে! তাও একটা কলেজ স্ট্রিটের সামনে দাঁড়িয়ে! ছি ছি ছি! এভাবে আর কয়টা মেয়ের দিকে হা করে দেখো প্রতিদিন! ছি ছি ছি! ছি অরণ্য!
-আরে! কি মুশকিল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে যাবো কেন? গাড়িতে ছিলাম। অফিসে যাওয়ার পথে জ্যামে আটকে গেছি। হঠাৎ করে চোখ পড়েছিল তোমার দিকে।
-চোখ পড়েছিল বলেই কি হা করে দেখতে হবে? আমাকে দেখেছ মানে আমার বান্ধুবিদের দিকেও হা করে তাকিয়ে ছিলে। ওরা কেউ জিতলে ওদের মধ্যে একজনেই বিয়ে করতে রাইট?
-পাগলি একটা! হা করে তাকিয়ে থাকতে যাবো কেন? আর ম্যাডাম সেদিন আপনার দিকে চোখ আটকে গেছিল বলেই এক মাসের শর্ট নোটিশে আপনি আমার বউ হয়ে গেছেন। যদি মেয়ে দেখে টাইমপাস করারই হতো তাহলে এখন আমার লক্ষী বউ হয়ে আমার বুকে থাকতে?
অনামিকা আর কিছু না বলে গায়ে আলগোছে প্যাঁচানো শাড়িটা টেনে উল্টোদিকে ফিরে শোয়ার চেষ্টা করতেই অরণ্য অনুর কোমড় জড়িয়ে নিজের উপরেই তুলে নিয়ে অনামিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। অনামিকা চুপ করে আছে দেখে আলতো করে অনামিকার ঠোঁট জোড়া নিজের ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিল অরণ্য। অনামিকা একটু লজ্জা পেয়ে অরণ্যের বুকে মুখ লুকিয়ে চুপ করে রইলো আবার। অরণ্য এবারে আলতো করে অনামিকার চুলে বিলি কেটে দিতে শুরু করলো।
-কি ব্যাপার মিসেস চৌধূরী? রাগ করে আছেন কেন ম্যাডাম? তোমাকে কলেজের সামনে দেখেছি সেটা নিয়ে রাগ করেছ পাগলি? আসলে কি বলো তো? আল্লাহ কার সাথে কার জুটি লিখে রেখেছেন সেটা তো একমাত্র উনিই জানেন। নইলে এই অল্প সময়ের দেখায় তোমাকে সারাজীবনের জন্য চাইতাম? তুমি আমার ভাগ্যেই আছো বলেই তোমার এতো এতো মেকাপ সুন্দরী বান্ধুবিদের মধ্যেও তোমার কাজল কালো চোখের মায়ায় আটকে গেছি।
-এই খবরদার একদম! তুমি আমার সামনে আমার বান্ধবিদেরকে দেখেছ, ওরা কেমন দেখতে সেসব নিয়েও কমেন্ট করছ? আর কখনো কোনো মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকালেও না খুন করে ফেলবো বলে দিলাম।
-যা বাব্বা! আমি তার রূপের প্রশংসা করছি, তার মায়াভরা কাজল কালো চোখের গভীরতার ব্যাখ্যা করছি, আর সে কিনা খুন খারাবি করে ফেলছে! ব্যাপারটা কি ম্যাডাম? এতো জেলাস!
-তুই জেলাস বলো, আর যা ইচ্ছে বলো। তুমি শুধু আমাকে দেখবে, মুগ্ধ হয়ে দেখবে। অন্য কারো দিকে তাকালেও না- মেরে ফেলবো একদম।
-আমার বউটার কি জ্বর এসেছে নাকি গো? আমার অনুপাখিটা তো এমন করে কথা বলে না জ্বর আর ঘুমের ঘোরে ছাড়া! এই অনু? তুমি কি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলছ? নাকি জ্বর এসেছে বউটা? দেখি দেখি?
অরণ্য হাত বাড়িয়ে অনামিকার কপাল ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই অনামিকা ধুমধাম কয়েকটা কিল বসালো অরণ্যের বুকে। অরণ্য এবারে হেসে ফেললো অনামিকার পাগলামি দেখে। কোনোমতে অনুর হাত দুটো একসাথে আটকে ধরে অনামিকার নাকে নাক ঘষলো অরণ্য। অনামিকা অভিমানী গাল ফুলিয়ে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অরণ্য হেসে অনামিকাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
-আরে পাগলি, তখন তো তুমি ছিলে না। তাই এদিক ওদিকে তাকিয়ে আমার মনের রাণীকে খুঁজেছি। এবং খুঁজেছি বলেই তো তোমাকে পেয়েছি ও তাই না? এখন তো আর কাউকে খোঁজার প্রয়োজন নেই রে পাগলি। আমি বারবারই তো তোমার এই কাজল কালো চোখের গভীরতায় হারিয়ে যেতে চাই। যদিও বউ আজকাল আর কাজল তো দেয়ই না। কি করা যায় বলো তো?
-কাজল? আচ্ছা পড়বো কাল থেকে। কাজল লেপ্টে ভূতের মতো হয়ে গেলে তখন দেখবো কেমন গভীরতা মাপো কাজল কালো চোখের।
-শুনুন ম্যাডাম, আপনি রাগিনী বাঘিনী হলেও আমার, ভূতনি প্রেত্নী হলেও আমার। চোখে কাজলে লেপ্টে যাক, ঠোঁটে লিপস্টিক আদরের চুমোয় ছড়িয়ে যাক, তবু তুমি আমার। আমার অনু।
-অসভ্য লোক একটা! সরো?
-এই অনু? তোমার কলেজে ক্লাস চলছে না? কলেজে যাও না কেন? ফাইনাল ইয়ার না তোমার? এভাবে ফাঁকিবাজি করলে চলবে?
-উমমমম। ইয়ার ফাইনাল হয়েছিল তাই মাস খানেকের বেশি অফ ছিল। তারপর তো বিয়ে, এখানে চলে এলাম। আর যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি।
-এসব কিন্তু ঠিক না একদম অনু। অনার্সটা কমপ্লিট করো, এরপর কি করতে চাও সেটা নিয়ে ডিস্কাস করা যাবে। বাট সংসার করছ বলে পড়াটা মাঝপথে থামিয়ে দিবে সেটা তো একদমই হবে না।
-বিয়ের পরে কলেজে যাওয়া ব্যাপারটা কেমন কেমন না? সবাই হাসহাসি করবে। কি বিশ্রি ব্যাপার! ইইই!
-একদম না। আর বিয়ের পরে মেয়েদের কি পড়া বারণ? আমার তো নিজেরই অবাক লাগছে এতোদিন ব্যাপারটা খেয়াল করলাম না কি করে! আর বাবা মা ও কিছু বললো না তোমাকে?! কালই মায়ের সাথে কথা বলতে হবে।
-আরে! আমি এখন বোকার মতো কাজ ফেলে ব্যাগ, খাতা, কলম ঘাড়ে করে ক্লাস করতে যাবো! ছি! সবাই লেগপুল করবে কত! নো ওয়ে! উহুঁ।
কোনো একটা সিচুয়েশন কল্পনা করে অনামিকা জোরে জোরে মাথা নেড়ে 'না' জানাতেই অরণ্য দু হাতে অনামিকার মুখটা ধরে চোখে চোখ রাখলো।
-শোনো অনু? লাইফে কার কখন কি হয় সেটা এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। জীবন কখন কাকে কোন মোড়ে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় বলা মুশকিল। তাই সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে নিজেকে। বুঝলে মেয়ে? এখন সম্মানের সাথে বাঁচার জন্য কোনো একটা জব করতে একটা মেয়ের মিনিমাম গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করা জরুরি। তুমি ভবিষ্যতে কাজ করতে চাও কি না সেটা তোমার নিজের ব্যাপার। বাট নিজে কাজের যোগ্য হয়ে থাকাটাও কম জরুরি না। সো? নেক্সট উইক থেকে আপনি আবার কলেজে যাচ্ছেন। এন্ড ইটস ফাইনাল ম্যাডাম।
-সবাই অনেক লেগপুল করবে। আমি যাবো না।।
-লেগপুল করবে কেন? আর করলেও তুমি পাত্তা না দিলেই তো হলো। একবার দুবার হয়তো হাসাহাসি করবে, টিজ করবপ, বাট তুমি যখন রিএক্ট করবে না তখন দেখবে সবাই চুপ করে গেছে। কোথায় প্রতিবাদ করবে, কোথায় চুপ থাকবে সেটাও শিখতে হবে অনু। কারণ তোমার বিপদে কেউ সাহায্য করতে আসবে, সেটা ভেবে বসে থাকলে জীবনেও বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারবে না। নিজের সাহায্যটা নিজেকেই করতে হবে। আর তার জন্য লোকে কি বলবে, হাসবে, মজা নিবে এসব মাথা থেকে বিদায় করো। কজ লোকেরা ওই হাসাহাসি করা পর্যন্তই পাশে থাকবে, এক পা এগিয়ে এসে সাহায্য করার মানুষ আজকাল পাওয়াই যায় না। তাই নিজের জন্যই নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। বুঝলেন ম্যাডাম?
-হুম। জি জনাব বুঝলাম।
-আর কলেজে যাওয়ার জন্য কি কি লাগবে আমাকে লিস্ট করে দিও। আর তোমার মোবাইল?
-উমমমমম। মোবাইল তো----আমমম হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে গেছে।
-হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গেছে? নাকি আমার ধাক্কায়---? শিট! আমার খেয়ালই ছিল না একদমই। মোবাইলের সিম আছে?
-হুম।
-ওকে। আর কি কি লাগবে আমাকে কাল বলে দিও। আমি নিয়ে আসবো।
-হুম।
-এই অনু?
-হুম?
অরণ্যের ডাকে অনামিকা অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্যের ঠোঁটের কোণের বাঁকা হাসিটা দেখে অনামিকা থতমত খেয়ে সরে আসার চেষ্টা করলো। অরণ্যও দেরি না করে অনামিকাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে অনামিকার মুখের দিকে এগিয়ে এলো ধীরে ধীরে।
-আরে? সরো? তোমার সকালে অফিস আছে সে খেয়াল আছে জনাব? সকালে উঠতে হবে না?
-এন্ড ম্যাডামের পালাই পালাই আবার শুরু হয়ে গেল। এতো জ্ঞানের কথা বলে টায়ার্ড হয়ে গেলাম। একটু তো কিছু পাওনা হয়েছে নাকি? আর তুমি খালি ভাগাতে পারলে বাঁচছ? এসব ঠিক না মেয়ে বুঝলে? আমার পাওনা তো আমি আদায় করেই ছাড়বো ম্যাডাম। আর আপনার পালাই পালাই রোগেও একটা ব্যবস্থা করছি ওয়েট।
-আরে? অরণ্য?
অনামিকা নিজের কথাটা বলতে গিয়েও আটকে গেল। কথাটা শেষ করার আগেই অরণ্যের উষ্ণ ঠোঁটজোড়ার গভীর বাঁধনে বন্দী হয়ে গেছে অনামিকা। আর কোনো গভীর সুন্দর স্বপ্নের মতো হারিয়ে গেছে ভালোবাসার অন্য কোনো দুনিয়ায়। যেখানে রঙিন ভালোবাসারা অপেক্ষা করছিল ওদের ছোট্ট মিষ্টি সংসারটাকে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য।
৩২!!
-এই মেয়ে, তোমার সমস্যাটা কি? তোমার মোবাইলটা থাকে কোথায় হ্যাঁ? প্রয়োজনের সময় যদি কল করে না ই পাই তাহলে এই মোবাইল রাখার দরকারটা কি? জানো কতবার কল করেছি দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত? একবারও চেক করেছ কে কল করেছে বা কেন করেছে? কেউ কল করলে যে কল ব্যাক করতে হয় এই নূন্যতম কমনসেন্সটুকু নেই তোমার?
দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে। অনামিকা শাশুড়ির সাথে টুকটাক ঘরের কাজ সামলে কলেজে ছোটে। দুপুরে বাসায় ফিরে তাহিয়ার সাথে গল্পে মেতে ওঠে বা কখনো ননদে ভাবিতে মিলে টুকটাক রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে। যেসব এক্সপেরিমেন্টের সরাসরি প্রয়োগ করা হয় বাকি চারজন নিরীহ মানুষের উপরে, অরণ্য, আরহান চৌধূরী, তাইয়্যেবা জামান আর ফুলির মা। ঘরের বেশিরভাগ কাজকর্মই ফুলির মা সামলে নেন আগের মতোই। তাই অনামিকা নিজের পড়ার পাশাপাশি এসব উদ্ভট এক্সপেরিমেন্ট করার সময় পেয়ে যায়। দিনগুলো ভালোই কাটছিলে ওদের। অনুর সংসারে সব জায়গাতেই একটা সুখের হাওয়া বইছিল এতোদিন। আজ হঠাৎ বিকেলের দিকে অরণ্য বাসায় ফিরেই রীতিমতো চিৎকার চেঁচামেচির শুরু করেছে। ড্রইংরুমে যে বাবা, মা, তাহিয়া সবাই বসে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে সেদিকেও চোখ পড়ে নি অরণ্যের। বাকিরা কিছুটা অবাক হয়েই কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করলো। অনামিকাও অরণ্যের জন্য দরজা খুলে দিতেই এই হঠাৎ ধমকিধামকিতে চুপসে গেল। মোবাইলটা তো সাইলেন্ট করা! অনু জানবে কি করে অরণ্য কতবার কল করেছে?
-কি রে অরণ্য? এতো চিৎকার করছিস কেন? আমরা সবাই মিলে নিচে আড্ডা দিচ্ছিলাম এতোক্ষণ। মেয়েটার মোবাইলটা হয়তো রুমে রয়ে গেছে। এতো হাইপার হওয়ার কি হলো?
-হাইপার হবো না? আমি কখন থেকে কল করছি জানো? আজ অফিসের কাজ জলদী শেষ হয়ে গেছে আমার। ভাবলাম ওকে কলেজ থেকে পিক করে দুজনে আশেপাশে কোথাও কিছুক্ষণ ঘুরবো। এই মেয়েকে আমি নাহলেও ১২ টা থেকে কল করেই যাচ্ছি। না কল রিসিভ করেছে, আর না বাসায় ফিরে একবারও কলব্যাক করেছে। ওর ফ্রেন্ডকে কল দিলাম। ওরাও জানে না এই মেয়ে কখন চলে এসেছে। এসব কোনো কথা?
-আরে অনু তো আজকে তাড়াতাড়িই চলে এসেছে। আর তুইও কি রে অনু? এতোবার কল করেছে খেয়াল করিস নি? আর অরণ্য? এতো রেগে যাচ্ছিস কেন তুই? ক্লাসে মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছিল হয়তো। পরে আর খেয়াল ছিল না আর কি। বাসায় তো জানিস তোর বাবা আর তাহিয়ার কত প্ল্যান চলছে। কি শপিং করবে, কোথায় ম্যারেজহল বুক করবে, এসবের মাঝেই আমি নিজেও হিমশিম খেয়ে আশ্রমের কাজ দেখতে পারছি না। অনুকে আর কি দোষ দিবি?
-তোমরা এমন করেই ওকে বাঁচাও সবসময়। ওকে আরো আস্কারা দাও যাতে এসব পাগলামিগুলো করতেই থাকে। আর আমাকে বুঝাও শুধু রাগ করিস না, ভুল করে করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওকে কিচ্ছু বলো না। কোনদিন কোন ইমার্জেন্সিতে কল করতে করতে পাগল হয়ে গেলেও যখন কল রিসিভ না করে ভ্যানিশ হয়ে থাকবে তখন বুঝবে আমি কেন এতো রিএক্ট করছি।
-আরে অরণ্য? শোন তো আমার কথা?
-তাহু? সবার জন্য আইসক্রিম এনেছি। কোন পছন্দের চকবারও আছে। তোর পছন্দের চকলেট চিপসও আছে। ধর?
আইসক্রিমের প্যাকেটটা তাহিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়েই নিজের অফিস ব্যাগটা নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে রুমে চলে গেল। তাইয়্যেবা জামান থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনামিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসলেন।
-কি রে অনু? এতোক্ষণে একবারও মোবাইল চেক করিস নি? ছেলেটা কত রেগে গেছে দেখেছিস? অনেকবার কল করেছিল নিশ্চয়ই। যা দেখ রাগ ভাঙ্গাতে পারিস কি না। আর শোন? মুখ দেখে মনে হচ্ছে লাঞ্চও করেনি এখনো। খাবারটা উপরে নিয়ে যা।
-মোবাইলটা ব্যাগে সাইলেন্ট করে রেখেছি যে খেয়ালই ছিল না মা। হেল্প করুন না মা প্লিজ? এবার কি করবো বলুন না? অনেক রেগে আছে তো, ও মা?
-কিছু করতে হবে না। এখন লক্ষী মেয়ের মতো খাবারটা নিয়ে রুমে যা তো বাবা। দেখ কি লাগবে ওর।
-হুম। আচ্ছা।
তাইয়্যেবা জামান অনামিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে সোফার দিকে চলে যযেতেই তাহিয়া এসে অনামিকাকে টেনে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চললো।
-এই ভাবি? ভাইয়া বোধহয় তোমার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চেয়েছিল আলাদা করে। আর এদিকে তুমি মোবাইল কোন দুনিয়ায় রেখে এসে আমাদের সাথেই আড্ডা দিচ্ছ। দেখো রাগ ভাঙ্গাতে পারো কিনা। আর এই ভাবি? এগুলো কি করবো? আইসক্রিম, চকলেট, চিপস? সব তো আমাকে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল? তোমার জন্য আনলো নাকি আমার জন্য আনলো কিছুই তো বললো না!
-চকলেট আর চিপসগুলো তোমার জন্যেই এনেছে বাবুতা। আমার গুলো আমি উনার কাছ থেকে আদায় করে নিবো। হি হি। আইসক্রিমগুলো এখন না খেলে ফ্রিজে রেখে দাও। পরে খেও।
-ইশ! পরে কেন? আমি এখনই খাবো।
-দুষ্টু বুড়ি, খাও তাহলে। মা বাবাকেও দাও। আমি উনার খাবার নিয়ে যাই। নইলে আবার কি করবে কে জানে!
-ভাবি তোমার আইসক্রিম ফ্রিজে রাখছি তাহলে। আর চকলেট আর চিপসেট ভাগ তাহলে দিচ্ছি না তোমাকে। হি হি।
-তুমিই খাও বাবু। আমি যাই। দোয়া করিও ভাবির জন্য।
অনামিকা আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি একটা প্লেটে খাবার বেড়ে রুমে এলো। অরণ্য ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে। অনামিকা খাবারটা এগিয়ে দিতেই চুপচাপ প্লেটটা খালি করে হাত ধুতে উঠে গেল। অনামিকাও প্লেটটা রান্নাঘরে রেখে রুমে এসে দেখলো অরণ্য শুয়ে পড়েছে। অনামিকা কি বলবে ভেবে রুমে আর বারান্দায় পায়চারি করছে। অরণ্য একটু বিরক্ত ভাব নিয়েই অনামিকার এমন দিশেহারা পায়চারি দেখছে। একসময় বিরক্ত হয়ে অরণ্য নিজেই বিছানায় উঠে হেলান দিল বিছানায়। অনামিকা এবারে একটু সাহস করে গুটি গুটি পায়ে অরণ্যের পাশে বসে দাঁত দিয়ে আঙ্গুলের নখ কামড়ে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলো। অরণ্য আরো কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে শেষে বিরক্ত হয়ে অনামিকার হাতটা টেনে মুখ থেকে সরিয়ে নিল।
-কি প্রবলেম কি তোমার? স্কুলের বাচ্চাদের মতো নখ কাটছো কেন দাঁত দিয়ে? কখনো রুমে পায়চারি করছো? কখনো বসে আছো থ মেরে? কাহিনী কি তোমার? কিছু বলবে?
-আমমমম। আসলে অরণ্য আমার খেয়াল ছিল না মোবাইলটা যে সাইলেন্ট করা। আমি সত্যি অনেক সরি।
-সরি না বলে কতবার কল আর টেক্সট করেছি সেটাই চেক করো। তারপর সরি বলতে এসো। আর মা বললো তাড়াতাড়ি ব্যাক করেছ আজকে। ক্লাস ছিল না? তোমার ফ্রেন্ডরা তোমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। ব্যাপার কি?
-আসলে ক্লাস বেশি ছিল না আজকে। ১২ টার দিকে ক্লাস শেষ। ওরা সবাই মিলে শপিংয়ে যাবে বলছিল। তাই আমি চলে এসেছি আজকে একাই। ওদের সাথে অযথা শপিংমলে ঘুরার চেয়ে বাসায় মা বাবা আর তাহিয়ার সাথে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছি সেটাই বেশি মজার ছিল।
অনামিকা কথাগুলো বলতে বলতে উঠে নিজের পার্স থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ২৮ টা মিসডকল আর ৪ টা টেক্সট মেসেজ দেখে থতমত খেয়ে অরণ্যের দিকে তাকালো। অরণ্য একটু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আবার হেলান দিল বিছানার সাথে। অনামিকা মেসেজে ক্লিক করতেই মোবাইলের স্ক্রিনে কয়েকটা ছোটো ছোটো মেসেজ ভেসে উঠলো।
"Onu tomar class sesh hole cl back koro. Tmr clg er gate theke pick korbo tmk. Baire lunch kore bashay firbo."
"Kothay hareye gele onu? Kotokkhn theke wait korchi....class sesh hoi ni akhno? Ami shoping mall a achi. Akta blue clr er shari vishon pochondo hoyeche. Niye nibo tmr jnno? Aj rate porbe, r ami obak hoye dekhbo. "
"Onu where are you? plz cl to receive koro. "
"Onu tumi ki bashay cole ashcho? Naki Tmra frnd ra mile kothaw gecho? Miss you pagli. Love you. "
অনু এবারে মোবাইলটা পাশে ফেলে অরণ্যের বুকে মুখ ডুবিয়ে কেঁদে ফেললো। অরণ্য চোখ বুজে অপেক্ষা করছিল অনামিকার টেক্সটগুলো পড়ে ওর কাছে ধরা দেয়ার। এবারে অনামিকা বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করায় অরণ্য অনামিকাকে নিজের সাথেই জড়িয়ে নিয়ে চুল আঙ্গুল ডুবিয়ে দিয়ে মুখটা তুলে ধরলো।
-আরে অনু? পাগলি মেয়ে কাঁদছ কেন এভাবে?
-আমি কি খারাপ! তুমি কতবার কল করেছ, মেসেজ করেছ আমি একবারও চেক করি নি। আর তুমি আমার অপেক্ষায় এতোক্ষণ না খেয়ে---। আমি সত্যিই খুব খুব খুব খারাপ।
-আরে পাগলি থামো থামো? এরকম আর করো না বুঝলে? আমি সত্যিই ভিষণ টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই রাগ করে ওভাবে রিএক্ট করে ফেলেছি। সরি হ্যাঁ প্লিজ?
-তুমি সরি কেন বলছ? আমি সরি। আর কখনো এমন হবে না প্রমিস। কিন্তু তুমি বাসার ল্যান্ডলাইনে কল করলে না কেন একবারও? তাহলে তো এতোক্ষণ বাইরে না খেয়ে থাকতে হতো না।
-তুমি বাসায় এসেছ কিনা সেটা তো জানি না। তাই কল করি নি। বাসায় না আসলে তো বাবা মা ও টেনশনে পড়ে যেত কল করলে তাই না?
-বাসায় না এসে আর কোথায় যাবো বলো? আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে?
-আ'ম সরি অনু। বাট আর কখনো এমন করবা না প্লিজ। কল করে না পেলে আমার কত টেনশন হয় জানো?
-সরি। এই আমার চকলেট কই? এবার বলো না রাগ করে আমার জন্য চকলেট আনো নি। তাহলে কিন্তু কথা বলবো না একদম।
-রাগ করে আনবো না এটা বলতে পারলে? ব্যাগে আছে। তোমার চকলেট, চিপস, শাড়ি সব। পরে দেখে নিও। এখন রেস্ট করতে দাও। সন্ধ্যের পরে বের হবো। এখন ঘুমাও।
-শাড়ি? শাড়ি দেখবো। নীল শাড়ির কথা বললে যে মেসেজে ওটা নিয়ে নিয়েছ? আমি দেখবো দেখবো দেখবো।
-দেখতে মানা করেছি না আমি? পড়ার সময় তো দেখতেই পাবে। এখন ডিস্টার্ব না করে ঘুমাতে দাও। আর শাড়ি চয়েজ না হলে আমার কিছু করার নেই। ওই শাড়িটা পড়েই আজকে বের হতে হবে। এটাই আজকের শাস্তি আপনার ম্যাডাম।
-এই না না না। আমি এখনই দেখবো। ছাড়ো না?
-অনু? তোমাকে তো আমি-------।
অরণ্য আর কথাটা শেষ করলো না। দুজনে খুনশুটিতে মেতে উঠলো। ছোটো ছোটো রাগ, অভিমানগুলো এভাবেই ওদের সংসারে ভালোবাসাটা আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে তুলতে শুরু করেছে। আর অন্যদিকে অনামিকার সাইলেন্ট করা মোবাইলে কেউ একজন লাগাতার কল করেই যাচ্ছে। একটা কল কেটে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার নতুন করে আরেকটা নাম্বার ভেসে উঠছে মোবাইলের বোবা স্ক্রিনে। খুনশুটির তালে সেটা অরণ্য বা অনামিকা কারোই নজরে পড়লো না।