০৫!!
সকাল বেলা সারিকার ঘুম ভাঙল চুলে কারো আলতো স্পর্শে। চোখ না খুলেই স্পর্শটা চিনতে পারলো ও। মা এসেছে। কপালে টুপ করে এক ফোঁটা পানি পড়তেই অবাক হয়ে চোখ খুললো সারিকা। চোখ খুলেই দেখলো মা তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে নিচ্ছে। সারিকা উঠে বসে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
-মা? কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?
-তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছি না রে সারু?
- নাহ মা আসলে------।
- জানি রে বাবা---। কিন্তু কি করবো বল? আমরা তো তোর বাবা - মা--। যা করব তোর ভালোর জন্যই করব বল?
-কিন্তু মা? অয়নকে ছাড়া তো আমি কখনো ভালো থাকব না--সেটা কেন তোমরা বুঝতে পারছ না?
-তবু তো আমাদের সামনে থাকবি--। বেঁচে বর্তে থাকবি-। সুস্থ থাকবি---।
-কি বলছ এসব? তোমরা কেন ওর সাথে আমার বিয়েটা দিচ্ছ না মা? ওকে ছাড়া একদম মরে যাব আমি---। ওর মাও কত ভালো দেখেছ? কতো করে বললো তোমাদেরকে--। তোমরা তবু শুনছই না-----।
-কাঁদিস না সারু--। যা কপালে থাকবে তা হবেই---।
-তোমরা কি ভেবেছো? আমাকে না বলে টুপ করে ওই ফাজিল, গাধা, ভ্যাবলা ছেলে দেখিয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে? সেটা হবে না---। আমি বিয়ের আগেই মরে যাব। দেখবা তো-----।
-সারু কি বলছিস?
-তোমাদের জন্য অয়ন কাল আমাকে কত্তোগুলো বকা দিলো---। এ্যাঁ? আমি নাকি নেচে নেচে বিয়ে করছি----। ওকে সামনে পেলে---। না না ওকে না-- তোমাদের ওই হ্যাংলা ব্যাটাকে পেলে আমি ইচ্ছে মতো মার খাওয়াবো অয়নের হাতে--। বেয়াদ্দপ ব্যাটা--। ওই শয়তান লোকের জন্য উনি আমাকে ধমক দিয়েছে----।
-সারু?
--এ্যাঁ----এ্যাঁ---এ্যাঁ----।
-সারিকা? তোর বাবা চায় জিহানের সাথেই তোর বিয়েটা হোক--। আর ওর মায়েরও তোকে ভিষণ পছন্দ হয়েছে তোকে----।
-কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলব আমি শয়তান ব্যাটা আর শয়তানের মাটাকে--। ফাজিল -বজ্জাত মহিলা---। ছেলের বউ বানানোর শখ হয়েছে?
-সারু? আজকে জিহান তোকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যাবে দুপুরে--। লাঞ্চ করবে-একটু ঘোরাঘুরি করবে এদিক সেদিক---।
-খুন করে ফেলবো আমাকে নিতে এলে----। শয়তান বদ লোক---। অসহ্য----।
-সারিকা?
------------------------------
-তুই আমার মেয়ে হয়ে এতো গাধা কেন বুঝি না বাপু----।
-মানে!
-মানে গাধা নাকি তুই? গত একমাস ধরে তুই ঘরে বন্দি--। জিহানের সাথে হলেও বাসা থেকে বের হতে পারবি-। এই সোজা ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না তোর?
-ওই ফাজিল লোকের সাথে বের হয়ে কি ঘোড়ার ডিম করব! আর অয়ন এমনিতে যা খেপে আছে-ওকে বললে তো হয়েই গেল-----।
-সারু-----। আল্লাহ! এই মেয়েটাকে নিয়ে আমি কি করবো! অয়ন ছেলেটা তোকে সামলায় কি করে আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না!
-মা?
-এই মেয়ে? মোবাইল দে---।
-মোবাইল? না না---। আমি দিবো না----।
-সারু? মোবাইল দে----।
সারিকা মোবাইল মায়ের হাতে দিয়ে আবার কান্নাকাটি শুরু করলো। সারিকার মা মেয়ের কান্নাকাটিতে মন না দিয়ে সারিকার মোবাইল থেকে কাউকে কল করলো। কল কয়েকবার বাজার পর রিসিভ হলো।
-কি? বিয়ের দাওয়াত দিতে কল করেছ এখন?
-অয়ন?
-আন্টি? আন্টি আপনি? সারিকা কেমন আছে?
-ও তো কেঁদে কেটে সাগর করে ফেলছে বাবা--। তুমি এই গাধাটাকে সামলাও কেমন করে বাবা!
-জি? মানে!
-সারিকার কাছে শুনেছ হয়তো কালকে একটা সম্বন্ধ এসেছে--। ছেলে আর ছেলের মা দেখে গেছে--। ওদের পছন্দও হয়েছে সারিকাকে--। মেয়েটা আসলেই এতো কিছু জানত না বাবা---। ওর বাবা চাইছে সারিকার বিয়েটা ছেলেটার সাথে হোক---।
-------------------------------
-অয়ন-- আজকে জিহান সারিকাকে নিয়ে লাঞ্চ করতে যাবে--। হয়তো আজই তোমাদের শেষ দেখা করার সুযোগ আছে--। কি করবে তোমরা দেখ---।
-আন্টি?
-মেয়েটাকে আর কষ্ট পেতে দেখতে পারছি না-।
-প্লিজ? একটু আঙ্কেলকে রাজি করান না আন্টি? আমি সত্যিই নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করব ওকে সুখে রাখার--।
-ওর বাবার তোমার সাথে বিয়ে দিতে সমস্যা নেই অয়ন--। সারিকার জন্য তোমার চেয়ে ভালো ছেলে পাবে না সেটা উনিও জানে অয়ন---। কিন্তু আসলেই আমাদের কিছু করার নেই--।
-মানে! কিছু করার নেই মানে!
-সেটা জানি না বাবা---। তবে একটা কথা বলবো---। তোমরা যা ই কর না কেন--আমার দোয়া সবসময় তোমাদের সাথে থাকবে--।
-আন্টি?
-ভালো থেকো---। সারিকার সাথে কথা বলো।
-জি------।
সারিকার মা সারিকাকে মোবাইল দিয়ে চলে গেল। সারিকা হা করে এতোক্ষণ মায়ের কথা শুনছিল। মোবাইলটা কানে লাগিয়ে চুপ করে বসে রইলো। অভিমান গলা চেপে আছে৷ কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।
-সারু?
-------------------------------
-সারু সোনামনি? সরি তো বাবা? মাফ করে দাও প্লিজ? ওই? বাবুটা?
-কি সমস্যা?
-মাফ করে দাও না? প্লিজ?
-না---। করবো না---।
-তাহলে কিন্তু আজকে নিতে আসবো না----।
-কই নিবা? হুহ-----। আসিও না--।
-ওহ---। আমি তো আরো ভাবলাম তোমাকে টুক করে ধরে নিয়ে গিয়ে টুপ করে বিয়ে করে নিয়ে আসবো--।
-সত্যি!
-বাহ! তুমিই তো চাইছ না যে আমি আসি---।
-কি বললা!
এভাবেই মিষ্টি ঝগড়ায় সারিকা আর অয়নের সারাটা দিন কেটে গেল৷ দুপুরে সারিকা মহাখুশিতে সাজগোজ করে জিহানের সাথে লাঞ্চে গেল। অয়নও জিহানের সামনে থেকেই সারিকা নিয়ে সোজা চলে গেল তার এক বন্ধুর বাসায়। সেখানে বিয়ের সমস্ত আয়োজন করাই ছিল। পরিবারের সবার অনুপস্থিতিতেও সারিকা আর অয়নের বিয়েটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেল। এভাবে শুরু হলো ওদের একসাথে পথ চলা। দেখতে দেখতে এতোগুলো দিনও কেমন করে যেন কেটে গেল। দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতেই সারিকার চোখ দিয়ে টুপটুপ করে কান্নাগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়ছে। আগের সেই পাগলামিগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেছে সারিকার। খুঁজেই পাচ্ছে না৷ কখনো আগের সেই সুখ, খিলখিল হাসি, দুষ্টুমিগুলো কি আধো খুঁজে পাবে মেয়েটা!
০৬!!
অয়ন বিকেলে অফিসে কাজ করছিল এমন সময় মোবাইলটা সশব্দে বেজে উঠলো। স্ক্রিনের দিকে না তাকিয়েই কলটা রিসিভ করে কানে মোবাইল ধরে কাজ আর কথা দুটো একসাথে চালানোর চেষ্টা করলো।
-হ্যালো?
-------------------------------
-হ্যালো! কি আশ্চর্য! কে বলছেন?
-আম---! অয়ন সাহেব বলছেন?
-জি বলছি---। আপনি কে বলছেন?
-আমি আপনার ওয়াইফের সাইকিয়াট্রিস্ট---।
-ওহ! ইয়েস ডক--। বলুন?
-আম---। মিস্টার অয়ন--। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল--।
-জি--। বলুন ডক্টর?
-আপনার ওয়াইফ এখন কেমন আছে?
-এখন বেশ ভালো আছে--। বাট ও মাঝে মাঝেই এতো গম্ভীর হয়ে কি যেন ভাবে--। কিছু শেয়ারও করে না---।
-উনার কেসটা নিয়ে আমি ফার্দার স্টাডি করেছিলাম--। উনার বেশ কিছু কথা আমি এখনো বুঝতে পারছি না--। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে কল দিলাম---। ব্যাপারগুলো এখন জানাটা কতটা জরুরি সেটা নিশ্চয়ই জানেন--।
-জি ডক্টর---। বলুন কি জানতে চান?
-সারিকা প্রায়ই বিড়বিড় করে বলতেন আপনি নাকি উনার মেয়েটাকে মেরে ফেলেছেন--। আপনি নাকি বেবি চান নি--। ঠিক কি হয়েছিল বলুন তো?
-আমি জানি--। ও আমাকেও বহুবার এসব বলেছে--। অবশ্য এসব নিয়ে ওকে দোষও দিতে পারব না আমি--। বিয়ের তিনটা বছর পেরিয়ে গেলেও ও কনসিভ করে নি তখনো---। মা আর উনার এক বান্ধবী এসব নিয়ে কথা বলছিল একদিন---। আমি উনাদের থামানোর জন্য বলেছিলাম যে, আমি এখনই বেবি চাই না--। এখন বাচ্চার দায়িত্ব নেয়া পসিবল না---। সারিকা হয়তো সেটাই শুনে---। আমি তখনও জানতাম না যে সি ওয়াজ প্রেগন্যান্ট----।
-ও মাই গড!
-ওকেও বহুবার বলেছি কথাটা--। ও বিশ্বাস করে নি--। ওর ধারণা আমি বাচ্চাটা চাই নি--। আর এসব টেনশনের জন্যই সিঁড়ি থেকে স্লিপ করে----।
-একটা ব্যাপার আছে মিস্টার অয়ন--। আপনার ওয়াইফের মিসক্যারেজটা নরমাল ছিল না--।
-মানে! ও তো পড়ে গিয়ে----?
-এ্যাকচুয়েলি--। সারিকার ব্লাড রিপোর্ট আনিয়েছি আমি হসপিটাল থেকে। রিপোর্ট বলছে ওনার ব্লাডে হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল---। তাতে ঘুম না আসলেও হালকা মাথা ঘুরা বা ঝিমানি হবে এমন মাত্রায় ছিল ওষুধটা---।
-হোয়াট!
-এখন আপনিই ভালো বলতে পারবেন--যদিও দু বছর আগের কথা-। উনি কি কোন ঘুমের ওষুধ নিয়েছিলেন?
-আরে নাহ---। সারিকা বা আমি কেউই ঘুমের ওষুধ খাই না--। ইভেন তখনও খেতাম না--। আমার ঘুম না এলে আমি ওকে জাগিয়ে দিতাম-। দুজনে মিলে গল্প করে রাতটা কাটিয়ে দিতাম--। আর ও নিজেও একই কাজ করত--।
-তাহলে বলছেন ওষুধ উনি খান নি?
-নো ওয়ে---। ও একটা প্যারাসিটেমল খাওয়া নিয়েও কত তাল বাহানা করে---। ইভেন এখনও সেইম-। আর ও ঘুমের ওষুধ খাবে তাও আমাকে বলবে না! অসম্ভব।
-আপনি দেন নি তো কোনভাবে ওষুধটা?
--------ডক্টর? পাগল হলেন আপনি?
-নো মিস্টার অয়ন--। আমি জাস্ট বোঝার চেষ্টা করছি--। আপনার ওয়াইফের মিসক্যারেজটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিল নাকি মার্ডার!
-মার্ডার! খুন! কে করবে আমার সন্তানের খুন?
-জাস্ট রিল্যাক্স মিস্টার অয়ন। আপনি আপনার ওয়াইফকে নিয়ে কতোটা সেনসিটিভ সেটা লাস্ট দু বছর আমি নিজে দেখেছি---। নিজের চোখে না দেখলে হয়তো আমি নিজেও আপনাকে দোষী ভাবতাম---।
-------------------------------
-আরেকটা মজার তথ্য আপনাকে দেই--। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন হঠাৎ দু বছর পর কেন ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি---। আমি আপনার ওয়াইফের কেইসটা নিয়ে যতই কাজ করছি ততই কনফিউজড হয়ে যাচ্ছিলাম--। লাস্ট উনি যখন চেকাপে এলেন-তখনও কথা শুনে মনে হচ্ছিল উনি আপনাকে দোষী ভাবছেন--। বারবার আপনাকে খুনী বলছিল---।
-হোয়াট!
-দেখুন হতেই পারে উনার মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন--। তবুও আমার সিক্সথ সেন্স বলছে--। কেউ ইচ্ছাকৃত ব্যাপারগুলো উনার মাথায় ঢুকাচ্ছেন--।
-কি বলছেন?
-এই কয়েকদিনে কোন রকম কি ইন্সিডেন্ট ঘটে নি তেমন?
-আজকেই একটা ব্যাপার ঘটেছে বাট----।
-কি হয়েছিল?
-সারিকা খাওয়া নিয়ে বহু বায়না করে--। আর নিজে থেকে এমনিতেও খেতে চায় না---। দুপুরে বাসায় গিয়ে দেখি ঘুমিয়ে আছে--। আমিও ওর জন্য তাই রুমেই খাবার নিয়ে যাচ্ছিলাম---। বুঝলাম না হঠাৎ মনে হল লিকুইড কিছুতে পা পিছলে গেল--। আর প্লেট দুটোও পড়ে গেল--।
-হোয়াট!
-আমিও শকড হয়ে গেছি পুরো--।
-আপনাকে একটা রিকুয়েস্ট করবো--। আপনি একদম সিওর না হয়ে উনাকে কিছু খাওয়াবেন না প্লিজ--। আর প্রয়োজন ছাড়া যেন চলাফেরা না করে --। জানেনই তো এবার কিছু হলে উনাকে আর আমরা বাঁচাতে পারব না----।
-ইয়েস ডক্টর----।
-আর আপনি একটু সময় দিন উনাকে--। এই সময়টা এমনিতেই মেয়েদের মন মেজাজের ঠিক ঠিকানা থাকে না---। হাসি- কান্না- রাগ- অভিমান কখন কি চলে সেটা বুঝাই যায় না--। উনার এই ব্যাপারগুলোর সুযোগ নিয়ে যেন কেউ আপনাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি ক্রিয়েট না করতে পারে--।
-থ্যাংকস ডক্টর---।
-সময় করে চেকাপে নিয়ে আসবেন--। আমি আর কিছু জানলে আপনাকে জানাব---।
-ওকে বায়----।
অয়ন হাতের কাজটা শেষ করে বসের রুমের দিকে গেল। অফিসের সবাই ওকে যথেষ্ট সম্মান করে। আর বস তো অসম্ভব আদর স্নেহ করেন। তাই যে কোন রকম সুবিধা অয়ন পায়। এখন সে হাফ ডে ছুটি চাইলেও বস তাকে মানা করবে না। কেননা তিনিও জানেন অয়ন তার সমস্ত কাজগুলো সময়ের মধ্যেই শেষ করে বুঝিয়েও দিবে। আর অয়ন নিজের কাজে কতটা দায়িত্বশীল সেটা বস বেশ ভালোই জানেন। তাই যথেষ্ট স্নেহও করেন।
বসের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় ফিরলো অয়ন। চারদিকে সন্ধ্যার আলো আধারি খেলা করছে। আর সারিকা বিছানায় একেবারে সোজা হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। চোখের উপরে ডান হাতটা বাঁকা করে রেখে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা৷ অয়ন ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেস চেইঞ্জ করে সারিকার মাথার কাছে বসলো। আস্তে করে চোখের উপরে থাকা হাতটা সরিয়ে সারিকার মুখটা দেখছে অয়ন। গালের উপরে কান্নার পানিগুলো দাগ রেখে গেছে। এতো কাঁদে কেন মেয়েটা! অয়ন হালকা হাতে সারিকার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবছে৷ আর কোন রকম ভুল বোঝাবুঝি হতে দিবে না অয়ন। প্রয়োজনে সব ছেড়েছুড়ে সারাদিন সারিকার সামনেই বসে থাকবে।