আড়ালে আবডালে - পর্ব ২৪ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


পরেরদিন নিজাম ইসলাম, লিয়াকত শিকদার, নীলম, তরু আর নিহি তরুর কলেজে যায়। ভর্তির সব কার্যক্রম সম্পূর্ণ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। নিজাম ইসলাম আর নীলম আজই ঢাকায় ফিরে যাবে, তাই নিহি আজ ক্লাস করেনি। বাড়িতে আসার পর নিহির মনটা খারাপ হয়ে যায়। কান্না চলে আসে। নিজাম ইসলাম বুঝতে পারেন। এক হাতে নিহিকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

"মন খারাপ করিস না মা। তোর কলেজ ছুটি হলে আমি নয়তো নীলম এসে তোকে নিয়ে যাব। আর আমরাও মাঝে মাঝে আসব। তুই কিন্তু মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।"
নিহি এবার বাচ্চাদের মতোন কেঁদে ফেলে। নিজাম ইসলাম আর নীলমের চোখেও পানি চলে আসে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, নিহিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। পরে নিজেরাই মনকে ধাতস্থ করেন। আবেগকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। তারা নিহিকে বুঝিয়ে, শুনিয়ে রেখে সময় থাকতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। মামি নিহির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
"মন খারাপ করিস না মা। আমার ঘরে আয়।"
মামি সঙ্গে করে নিহিকে নিয়ে যায়। গল্পগুজব করে। মজার মজার কথা বলে নিহিকে হাসায়।

অপরপ্রান্তে সুখ নেই আমানের মনে। কালকের দিনটা ঘোরের মধ্যে কাটলেও রাতের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরের রেশ কমে এসেছে। নিহির শূন্যতা আমানকে আঁকড়ে ধরেছে। পুরো বাড়িটায় শূন্যতা বিরাজমান। নিহির রাগের ধমক এখন আর বাড়িতে প্রতিধ্বনি হয় না। নিহির খিলখিল করা হাসির শব্দও প্রতিধ্বনি হয় না। শুধু চোখ বন্ধ করলেই নিহির হাসিমাখা মুখটা ভেসে ওঠে। কেমন আছে নিহি? ভালো আছে তো? নিজের অস্থিরতায় নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে আমানের। শত চেষ্টা করেও অস্থিরতা কমাতে পারছে না।

অফিসে থাকতেও আজ ভালো লাগছে না। নিরবকে অফিসের বাকি কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমান বাড়িতে চলে যায়। টুকটুকি আর আবুল এখন আবার আগের ন্যায় শুধু রাতের রান্না করতে আসে। বাড়ি পুরো ফাঁকা। ঘরে ঢুকতেই দম বন্ধ হয়ে আসে। নিহির স্মৃতিরা জড়িয়ে ধরে আমানকে। এভাবে চলতে থাকলে আমান মানসিক রোগী হয়ে যাবে। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আমান। ফোনটা হাতে নিয়ে গ্যালারীতে যায়। নিহির ঘুমন্ত ছবি দেখে। চলে যাওয়ার আগেরদিন যে ঘুরতে গিয়েছিল তখন বেশকিছু ছবি তুলেছিল দুজনে। সেই ছবিও দেখে। নিঁখুতভাবে নিহির ছবি পর্যবেক্ষণ করে। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে কেন? চোখ দুটো এত স্বচ্ছ কেন? একদম কাচের ন্যায়! মাঝে মাঝে আমানের ইচ্ছে করে নিহিকে খেয়েই ফেলতে। আমান হাসে। নিহির ছবিটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখে। একটু প্রশান্তি লাগছে এখন।

আমান শোয়া থেকে উঠে বসে। মাকে ফোন করে। অনামিকা রহমান তখন কলেজে ছিলেন। আমানের কল দেখে তিনি ফোন রিসিভ করেন। আমান বলে,
"আসসালামু আলাইকুম মা।"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো আব্বু?"
"ভালো নেই মা!"
অনামিকা রহমান অস্থির হয়ে বলেন,
"ভালো নেই! কী হয়েছে আব্বু? শরীর ঠিক আছে?"
"শরীর ঠিক আছে। কিন্তু মন ভালো নেই। তুমি কি একটু বাসায় আসবে?"
"আমার আর একটা ক্লাস আছে। আমি ক্লাসটা শেষ করেই আসছি।"
"ঠিকাছে।"

ব্যবসার কাজে আমানের বাবা বেশিরভাগ সময়টাই বাহিরে থাকেন এটা সবাই জানেন। তাই দেশের অফিসের সব কাজকর্ম আমানকেই দেখতে হয়। অফিসের দূরত্ব বাড়ি থেকে অনেক দূরে হওয়ায় আমান আলাদা বাড়িতে থাকে। এবং সেই বাড়িওটা ওদের নিজের। মাধ্যমিক পর্যন্ত বাবা-মায়ের কাছে থেকেই স্কুলে পড়লেও উচ্চ-মাধ্যমিক শেষ করেছে হোস্টেলে। এরপর অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে কানাডাতে। পড়াশোনার পার্ট শেষ করেই আমান বাবার অফিসের কাজে হাত দিয়েছে। আমান স্বভাবে যতটা শান্তশিষ্ট আসলে তা নয়। তবে আমান শান্তিপ্রিয় লোক। সহজে রাগে না। তবে একবার রেগে গেলে খবর আছে। সবসময় নিজেও হাসিখুশি থাকে এবং অন্যদেরও হাসাতে পছন্দ করে। ছোট থেকেই আমান গানটা ভালো করে। তবে সিরিয়াসলি কখনো নেয়নি। সিরিয়াসলি নিলে নিঃসন্দেহে বড় গায়কও হতে পারত।

আমান ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে নিহি দু'বার ফোন করেছিল। ওয়াশরুমে ছিল বলে পানির শব্দে রিংটোনের শব্দ শুনতে পায়নি। আমান কল ব্যাক করে। অদ্ভুত বিষয়! আমানেরও বুক ধুকপুক করছে। নিহি ফোন রিসিভ করে সালাম দেয়। অজানা প্রশান্তিতে বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায় আমানের। হয়তো নিহির কণ্ঠ শুনেই! আমান নিহির সালামের উত্তর নিয়ে বলে,
"কেমন আছেন?"
"আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনি?"
"যেমন রেখেছেন।"
"কেমন রেখেছি?"
"শূন্যতায়।"
"পূর্ণতা কীভাবে পাবে?"
"আপনাকে পেলে।"
নিহি নিঃশব্দে হাসে। আমান বুঝতে পারে তবুও। নিজেও নিঃশব্দে মুচকি হাসে। আমান জিজ্ঞেস করে,
"তারপর?"
"তারপর কী?"
"কেমন যাচ্ছে দিনকাল?"
"আসলামই তো কাল।"
"তবুও। কেমন লাগছে ওখানে?"
"খুব ভালো। তবে বাড়ির কথা মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে।"
"স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।"
"অভ্যস্ত মনে হচ্ছে?"
"তাই-তো। বাবা-মাকে ছাড়াই তো থাকছি। আর এখন..."
"আর এখন?"
"আপনাকে ছাড়া!"

নিহি লজ্জা পায়। আমান সামনে নেই। তবুও মনে হচ্ছে আমান সামনেই আছে। নিহিকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে আমান বলে,
"মামার বাড়িতে কে কে আছে?"
"মামা-মামি, মামাতো ভাই আর বোন।"
"মামাতো ভাই বড় নাকি বোন?"
"ভাই।"
"বোন সিঙ্গেল?"
"মনে হয়। কেন?"
"রিলেশন করতাম। করিয়ে দিবেন?"
"খুব শখ?"
"বউ তার মামাতো বোনের সাথে প্রেম করিয়ে দিলে, শখ করা যেতেই পারে।"
"আমি কী বলেছি রিলেশন করিয়ে দেবো?"
"দেবেন না? হিংসে হয়?"
"মোটেও না। হিংসে কেন হবে?"
"থাক, জানি।"
"কী জানেন?"
"মেয়েরা স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না।"
"কচু জানেন।"
"তাই না?"
"হু, তাই! শুনুন, আমিও রিলেশন করব।"
"কার সাথে?"
"এখানে কি ছেলের অভাব আছে নাকি?"
আমান ধমক দিয়ে বলে,
"মেরে ফেলব একদম।"

নিহি এবার শব্দ করেই হাসে। আমান রাগ করলে নিহির ভালো লাগে। নিহি হাসছে আর আমান চুপ করে আছে। হাসতে হাসতেই নিহি বলে,
"রাগ করলেন?"
"না, খুশিতে নাচতেছি।"
"তাই নাকি? ভিডিও কল দেই? আমিও একটু দেখি।"
"দেন।"
"না, থাক।"
"দেন। আমি আপনাকে দেখব।"
"দেখা লাগবে না।"
"কেন?"
"এমনিই।"
কিছুক্ষণ নিরব থাকে দুজনই। নিরবতা কাটিয়ে আমান নিহিকে ডাকে।
"নিহু!"
আমানের মুখে 'নিহু' ডাক শুনলে বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে ওঠে নিহির। অজানা ভালো লাগায় খুশিতে মন ভরে যায়। এত মায়া, এত ভালোবাসা এই ডাকে! যা শুধু নিহি অনুভবই করতে পারে, প্রকাশ করতে নয়। সব অনুভূতি প্রকাশও করতে নেই। অপ্রকাশিত অনুভূতিটুকি নিজের করে থাক মনের ছোট্ট কুঠুরিতে।
নিহিকে চুপ থাকতে দেখে আমান আবার বলে,
"নিহু? আছেন?"
"হু।" ছোট করে উত্তর দেয় নিহি।
"আমার খুব কষ্ট হয় নিহু। ঘরে আসলে আমি শান্তি পাই না। আপনি ঠিকই বলেছিলেন। আপনি আড়ালে-আবডালে রয়ে গেছেন। সরাসরি আমি আপনাকে দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পারি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় আপনি আমার সামনে। মনে হয়, এইতো হাত বাড়ালেই আমার নিহুকে আমি ধরতে পারব।"

আমানের অগোচরে নিহি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। ঘরের বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মামির গলার শব্দও শুনতে পায়। 'মামি আসছে। রাখছি।' বলে ফোন রেখে দেয় নিহি। মামি ঘরে এসে বলে,
"কীরে একা একা কী করছিস?"
নিহি আমতা আমতা করে বলে,
"কিছু না মামি। ফোনে গেমস খেলছিলাম।"
"একা বোর লাগছে না?"
"না মামি।" হেসে বলে নিহি।
মামি বলেন,
"মিথ্যা বলবি না একদম। আয় আমি লিমনকে বলছি তোকে নিয়ে ঘুরে আসতে।"
"না, মামি। ঘরেই ঠিক আছি।"
"আয় তো তুই।"

মামি জোর করেই নিহিকে টেনে নিয়ে যান। মামির জোড়াজুড়িতে নিহি ঘুরতে যেতে রাজি হয়। তবে দূরে কোথাও নয়। একটু হাঁটাহাঁটি করার জন্য চা বাগানে যাবে। লিমন বাইকে উঠে বলে,
"নিহি দোয়া কর।"
"কেন? তুমি বাইক চালাতে পারো না? না পারলে নেমে যাই বাবা! আমার এত তাড়াতাড়ি মরার শখ নেই। জামাই বিধবা হয়ে যাবে।"
শেষের কথাটা বলে নিহি নিজেই বোকা বনে যায়। লিমনের অগোচরে জিভ কাটে। লিমন চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
"কী বললি? জামাই বিধবা হবে মানে?"
নিহি হাসার চেষ্টা করে বলে,
"মানে হবু জামাই আরকি!"
"বুঝলাম। কিন্তু ছেলেরা কীভাবে বিধবা হয়?"
নিহি এবার তাড়া দিয়ে বলে,
"তোমার এতকিছু বুঝতে হবে না। চলো তো!"

বাইক স্টার্ট দিয়ে লিমন বলে,
"দোয়া করতে বললাম কেন জিজ্ঞেস করলি না তো!"
"ওহ হ্যাঁ, তাইতো! কেন?"
"তোর সঙ্গে আমাকে গার্লফ্রেন্ড দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এজন্যই বলছি।"
"ওমা! কেন? আমি তো তোমার বোন হই।"
"ও তো আর জানে না।"
"জানিয়ে দেবে।"
"দিলেও! প্রচুর ত্যাঁদড়।"
"তোমার মতো?" জিজ্ঞেস করে হাসে নিহি।
লিমন রাগ দেখিয়ে বলে,
"আমার মতো? আমি ত্যাঁদড়? একদম ধাক্কা দিয়ে বাইক থেকে ফেলে দেবো।"
"জামাই মরে যাবে রে ভাই!"

আবারও একটা উদ্ভট কথা বলে নিহি নিজের ওপরই এবার রেগে যায়। লিমন বলে,
"এত জামাই জামাই করিস কেন? ফুপাকে বলব নাকি তোর বিয়ের কথা?"
"এই না! আমি তো মজা করে বলি।"

লিমন হাসে। জোর করে হাসে নিহিও।
____________________

নিহি নিয়মিত কলেজে যাওয়া শুরু করেছে। কলেজ থেকে এসে আবার প্রাইভেট পড়ছে। কোচিং করছে। মোট কথা, নিহির পুরোটা সময়ের বেশি সময়টাই যাচ্ছে পড়তে পড়তে। অবশ্য নিহি তো এখানে এসেছে পড়তেই। অবসর সময়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়। বাড়িতে সবার সঙ্গে প্রতিদিন কথা হয়। আমানের সঙ্গে একবার কি দু'বার কথা হয়। তবে সেটাও খুব কম। আমানের খুব ইচ্ছে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিহির সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। আমান জানে নিহির ব্যস্ততা। তাছাড়া আমান নিজেও চায় না, পড়া থেকে নিহির মনোযোগ অন্যদিকে যাক। নিহির অনুভূতি আমানের প্রতি যে পজিটিভ এটা বুঝেই আমান শান্ত। নিহি মন দিয়ে পড়ুক, ভালো রেজাল্ট করুক। তারপরই না বাবার মন জয় হবে। এরপর নিহিকে বউ সাজিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসবে। তখন আর চোখের আড়াল করবে না। বাকিটা জীবন সুখে কাটানোর জন্য এতটুকু সময়ে কষ্ট তো সহ্য করা যেতেই পারে। এছাড়া অফিসের কাজে আমানও নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। তবে নিহির মতো করে নয়।

লাঞ্চ সবসময় আমান নিরবের সঙ্গেই করে। ঐসময়ে নিরব জিজ্ঞেস করে,
"ম্যাম কেমন আছে স্যার?"
"ভালো আছে। তিনি তো পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত।"
নিরব মুচকি মুচকি হাসে। আমান খেতে খেতে প্রশ্ন করে,
"হাসো কেন?"
"না, স্যার। এমনি। ম্যামকে খুব মিস করেন তাই না?"
"মিস করাটা কি অস্বাভাবিক?"
"না, স্যার। একটা কথা বলব?"
"বলো।"
"চলুন সিলেটে যাই।"

আমান খাওয়া বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিরবের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে,
"কেন?"
"সিলেটে আমার খালার বাড়ি। ম্যামও তো সিলেটে থাকে। ম্যামের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।"
আমান হেসে বলে,
"না, নিরব! নিহুকে বিরক্ত করতে চাচ্ছি না।"

নিরবের মুখটা অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। হুট করে নিরবের মন খারাপের কারণ ধরতে পারে না আমান। আর যখন বুঝতে পারে তখন বলে,
"ওয়েট, ওয়েট! সিলেটে কার বাড়ি বললে? খালার বাড়ি?"
"জি স্যার।"
"যেই খালার মেয়েকে তুমি ভালোবাসো সেই খালার বাড়ি?"
নিরব এবার লজ্জা পায়। আমানের প্রশ্নে অপ্রতিভত হয়ে পড়ে। নিরব লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
"জি স্যার।"
আমান এবার শব্দ করে হাসতে হাসতে বলে,
"তাহলে এই হলো কাহিনী! আমার নাম আর তোমার কাম?"
"না, না স্যার। আপনার কথা ভেবেই বলেছি।"
আমান আগের ন্যায় হেসে বলে,
"আচ্ছা হয়েছে। শোনো, তোমার খুব ইচ্ছে হলে যেতে পারো। আমি ছুটি দিয়ে দিচ্ছি। তার সঙ্গে দেখা করে আসো।"
"না, স্যার একা যাব না।"
"ভেবে বলো।"
"ভেবেই বলেছি।"
"আচ্ছা। তবুও পরে যদি মত বদলাও আমায় জানিও। ছুটি দিয়ে দেবো।"
"মত পাল্টাব না স্যার।"

ক্যান্টিনে বসে আছে নিহি। বোতলের ওপর হাত রেখে মাথা ভর দিয়ে রেখেছে। দৃষ্টি জানালার বাইরে। এখান থেকে মেইন রাস্তা দেখা যায়। কাপল দেখা যাচ্ছে। নিহির আমানের কথা মনে পড়ে যায়। পড়াশোনা নিয়ে যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, আমানের কথা ঠিক মনে পড়ে। নিহি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সামনের চেয়ারে বসে তরু ফিসফিস করে ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছে। নিহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

পরক্ষণেই মনে হয় আমানকে তো একটা কল করা যায় এখন! যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগটা নিয়ে একদম পেছনের দিকে জানালার পাশে গিয়ে বসে। ক্যান্টিন এখন মোটামুটি ফাঁকা প্রায়। যারা আছে সবাই সামনে বসে আছে। কেউ খাচ্ছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে, কেউ ফোন চাপছে। আবার কেউ ওদের মতোই ফোনে কথা বলছে। নিহি আমানের নাম্বারে ডায়াল করে। আমান তখনও নিরবের সঙ্গে বসে খাচ্ছিল। নিহির নাম্বার দেখে কেটে দিয়ে ব্যাক করে। নিহির হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। আমান কথা বলছে অথচ নিহি নিশ্চুপ। এত বেশি কেন মিস করছে আমানকে তা নিহি জানে না! কথা হয় কিছুক্ষণ। ঘণ্টা পড়ে যায় এর মাঝেই। টিফিনের সময় শেষ। নিহি তখন বলে,
"একটা দামী জিনিস চাই।"
"বলুন কী চান?"
"অনেক দামী কিন্তু।"
"সমস্যা নেই।"
"দিতে পারবেন তো?"
"আপনি মুখ ফুঁটে একবার বলেই দেখুন।"
নিহি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
"আপনাকে চাই।"
আমান বুকে দিয়ে বলে,
"হায়ে! এ তুনে ক্যায়া কিয়া? ম্যায় তো মার জায়ুঙ্গি মেরি জান!"
নিহি শব্দ করে হেসে ফেলে। তরু ডাকছে। নিহি কিছু না বলেই খট করে কল কেটে দিয়ে ক্লাসে চলে যায়। আমান তখনও হাসছে। আমানের শেষ কথা শুনে নিরবও মুচকি মুচকি হাসছে।


সকাল আট'টা বাজে। তরু আর নিহি কলেজের সরু রাস্তায় হাঁটছে। চারপাশ কুয়াশায় ঢেকে আছে। দূর থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ক্লাস শুরু হবে নয়টায়। এক ঘণ্টা আগেই এসেছে। তার কারণ হচ্ছে তরুর বয়ফ্রেন্ড। এই সময়টা-ই শুধু দুজন দেখা করে। আর নিহি পাশে বসার মতো কোনো জায়গায় বসে পড়ে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। কলেজের বামদিকে রাস্তায় দুজনে হেঁটে চলে গেল। এখান থেকে কিছুটা দূরেই একটা পার্কের মতো জায়গা আছে। জগিং করতে আসে অনেকেই। বিশেষ করে বিকেলের দিকটায় সবাই সময় কাটাতে আসে। এখন শীত বলে কেউ সকালে আসে না। তরু আর ওর বয়ফ্রেন্ডকে আলাদা স্পেস দিয়ে নিহি অন্যদিকে যায়। আজ পড়তেও ইচ্ছে করছে না। শীতে শরীর কাঁপুনী দিয়ে উঠছে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে আমানকে একটা কল করবে। যখনই আমানের নাম্বারে কল করতে যাবে তখনই নিহির ডান হাতে টান লাগে। নিহি ভয় পায়। আৎকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ঠান্ডা দুটো হাত নিহিকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। নিহি চোখ মেলে তাকায়। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে যায়। দু'হাতে মুখ ঢাকে। চোখ দুটো স্থির সামনের মানুষটির দিকে। আমান! চোখে-মুখে দুষ্টুমির হাসি। হেসে বলে,
"সারপ্রাইজ!"
এতটাই অবাক হয়েছে যে নিহি কথাই বলতে পারছে না। সেই সঙ্গে খুশিতে চোখে পানি চিকচিক করছে। খুশিগুলো মুখে প্রকাশ করার দরকার নেই। আমান নিহির চোখ দেখেই বুঝে ফেলেছে। নিহি কোনরকমভাবে বলে,
"আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!"
নিহিকে অবাক করে দিয়ে আমান শীতল ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা নিহির কপাল ছুঁয়ে দেয়। আবেশে নিহির চোখ বন্ধ হয়ে যায়। আমান বলে,
"বিশ্বাস হয়েছে?"
"না।" নিহির উত্তর।
"তাহলে আবার দেবো?"
নিহি আমানের ঠোঁটের ওপর হাত রেখে বলে,
"নাহ্!"
আমান হাসে। তখনো নিহি আমানের বাহুবন্ধনে। নিহি জিজ্ঞেস করে,
"কীভাবে সম্ভব!"
"এভাবেই। আপনার ভাবির থেকে ঠিকানা নিয়েছি। তারপর কাল বিকেলেই সিলেটে রওনা দিয়েছি। এখানে উঠেছি নিরবের খালার বাসায়। কলেজের ঠিকানা নিয়ে আরো এক ঘণ্টা আগে থেকে এসেই অপেক্ষা করছি। আপনাকে এখানে আসতে দেখে আমি আর নিরবও চলে এসেছি।"

নিহি এবার চারপাশে চোখ বুলায়। আমান হেসে বলে,
"নিরব গাড়িতে এখন। আমাদের দেখছে না।"
নিহি লজ্জা পায়। চোখ দুটো নামিয়ে নিয়ে নিজেকে আমানের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। মনে মনে খুশিও হয়। ভাগ্যিস তরুর বয়ফ্রেন্ড আছে। এজন্যই তো এখানে আসা। কলেজের সামনে দেখা হলে তো এমন কিছু হতো না। এসব ভেবে নিজে নিজেই নিহি আরো বেশি লজ্জা পায়। গাল দুটো লাল হয়ে যায়। আমান হাসছে মুচকি মুচকি। আবারও একটানে নিহিকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলে,
"এখন এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? কাল না আমাকে চাইলেন? আমি বলেছিলাম, দেবো। এইতো দিলাম আপনার দামী জিনিস। আমাকে। আগলে রাখুন এবার!"
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন