মোবাইল পাগলী (পর্ব ০২)


০৩!!

হঠাৎ করে কে যেন পেছন থেকে কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠলো,
- সারাক্ষণ মোবাইলে এত কি?
পেছনে তাকিয়ে দেখি আব্বু!!
ফোন লুকাবো নাকি নিজে লুকাবো এই মুহুর্তে বুঝতে পারছি না। আমার কোনো উত্তর না পেয়ে আব্বু আবার বলা শুরু করলো,
- এই ফোন ফোন করেই তোর অর্ধেক জীবন পাড় হয়ে যাবে। বলি পড়াশোনা টা কি ঠিকমত করবি নাকি বিয়ে দিয়ে দিবো বলতো!
- বিয়ের পর যদি মোবাইল টিপতে দেয় তাহলে আমার বিয়ে করতে কোনো সমস্যা নেই (মনে মনে)
- কি হলো? চুপ করে আছিস কেন?
-কি বলবো?
- কিচ্ছু বলতে হবে না, তুই ফোন দে আমার কাছে।
- কেন আব্বু ফোন দিয়ে কি করবে?
- পিন্ডি চটকাবো! (রাগে)
- আরে আব্বু মোবাইল কি মানুষ নাকি হিহি
- আবার হাসে! ফোন দে।
আব্বু এক প্রকার জোর করেই ফোনটা নিয়ে গেল। আমার দম মনে হয় আটকে আসছে! আল্লাহ্ গো এখন আমার কি হবে গো! মা গো। কোথায় গেলে গো 
আমার চিৎকার চেঁচামেচিতে আম্মু ভয় পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে।
- কিরে মা, কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? (আম্মু)
- আব্বু.....আব্বু...... আব্বু আমার ফোন নিয়ে গেছে গো আম্মুউউ (কান্না করে)
- এজন্য কাঁদছিস? আমি ভাবলাম কি না কি হয়েছে! যা সর (রাগ করে আম্মুও চলে গেল)
এখন আমি কি করবো? আমার মোবাইল ছাড়া তো আমি থাকতে পারবো না। হু আকাশ! আকাশের কাছে যাই।

আকাশের রুমে গিয়ে দেখি আকাশ ঘুমুচ্ছে। বালিশের পাশেই ওর ফোন। ওর ফোনটা নিয়ে একটা চেয়ারে বসে ফোন টিপছিলাম এর মধ্যেই একটা আননোন নাম্বার থেকে কল আসলো!
- মেজাজটা তাহলে কেমন লাগে বলেন তো? ফোনটা রিসিভ করেই আমি ঝাড়ি দিয়ে বললাম,
- ঐ কে রে? অসময়ে ফোন দিয়ে জ্বালানি ছাড়া আর কোনো কাজ নাই নাকি? 
ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ আসলো না ফোনটা কেটে দিলো।
আকাশের ফোন নিয়েই আমি আমার রুমে চলে আসছি। আমার ফেসবুক আইডিতে লগিন দিয়ে নিউজফিড স্ক্রল করছিলাম তখন দেখি অশুভের ম্যাসেজ!
- এই মোবাইল পাগলী, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। (শুভ)
- কি সারপ্রাইজ?
- এখন না পরে বলবো!
- হু।
- হু কি?
- কিছুনা।
- মন খারাপ?
- অনেএএএএএএক!
- বাব্বাহ্! এত্ত মন খারাপ? কারণটা কি শুনি? হঠাৎ কি হলো মোবাইল পাগলীটার?
- আব্বু আমার ফোন নিয়ে গেছে (কান্নার ইমুজি)
- এটা তো ভালো খবর!
- এটা ভালো খবর? (রাগি ইমুজি)
- অবশ্যই। অন্তত পক্ষে আমার জন্য ভালো খবর।
- কিভাবে? (অবাক হয়ে)
- ঐটা পরেই বুঝবা। আচ্ছা এখন বলো তো তুমি ফোন ছাড়া ফেসবুকে আসলে কিভাবে?
- আকাশের ফোন দিয়ে।
- আকাশ বেচারাকে আর কত জ্বালাবে? (হাসির ইমুজি)
- আমি মোটেও ওকে জ্বালাই না হুহ!
- হাহাহা তাই?
- জ্বী তাই, এখন বাই।
- আচ্ছা যাও আল্লাহ্ হাফেজ।
- আল্লাহ্ হাফেজ।
ফেসবুক আইডি লগআউট দিয়ে ফোনটা আকাশের রুমে রাখতে যাবো তখনি সিঁড়িতে আকাশের সাথে দেখা।
- তুই আমার ফোন নিছিস? (আকাশ)
- হু
- না বলে ফোন নিছিস কেন চোর!
- ঐ একদম চোর বলবিনা, খুন করে ফেলবো। চুরি করলে কি আর দিয়ে আসতে যেতাম।
- বাব্বাহ্! রাগ দেখাচ্ছিস আজ? তাও আমাকে? (অবাক হয়ে)
- এতে এত অবাক হওয়ার কি আছে, আমার কি রাগ নাই নাকি!!
- তো রাগের কারণ কি?
- আব্বু ফোন নিয়ে গেছে।
- খুব ভালো। খুশির খবর। তুই আর অশুভ দুজনই তো এক, খুশি তো তোরা হবিই!
- অশুভ মানে?  শুভ? ওর সাথে তোর কথা হয়?
- হু
- কিভাবে?
- বলবো না।
চলে আসছিলাম, পেছন থেকে আকাশ ডেকেই যাচ্ছে,
- প্রিয়া দাঁড়া, দাঁড়া বলছি!!
আমি রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়েছি। আকাশ অনেকবার ডেকেছে খুলিনি। খুব খুশি না? কথাই বলবো না আর হু!

বিছানায় গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম। কিছুতেই ঘুম আসছে না। মোবাইল আমার বালিশের পাশে না থাকলে আমার যে ঘুম আসে না তা কি আব্বু জানে না! কেউ ভালো না। কেউ ভালোবাসে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি।
সন্ধ্যার আজানের সময় দরজায় আম্মুর নক পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
- প্রিয়া, এই প্রিয়া দরজা খুল। সন্ধ্যায় হয়ে গেছে। আজান দিবে একটুপর।
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই আম্মু রুমে ঢুকে বলে,
- তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। তোকে শাড়িটা পড়িয়ে দেই। তারপর আবার তোকে রেডি করাতে হবে।
- মানে? কেন? 
- কি কেন? 
- শাড়ি পড়বো কেন?
- তোকে আজ দেখতে আসবে।
- হোয়াট! এসব কি বলছো আম্মু???!!!

০৪!!

সন্ধ্যার সময় আমাকে রেডি করে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল আম্মু। ড্রয়িং রুম ভর্তিই প্রায় মানুষ। কি আশ্চর্যের বিষয় ভাবা যায়? এরা মেয়ে দেখতে আসছে নাকি চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী দেখতে আসছে কে জানে!
আমাকে একটা চেয়ারে বসানো হয়েছে। আড়চোখে ছেলেকে দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না যে ছেলে কোনটা। একটু আড়চোখে সামনে তাকাতেই দেখি, একটা টাকলুু ছেলে মানে মাথায় চুল কম আরকি! কেমন লাজুক লাজুক মুখ করে আর মিষ্টি মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। বজ্জাত, বুড়ো ভাম একটা!
তারা কিছু প্রশ্নট্রশ্ন করার পর আমাকে আমার রুমে নিয়ে আসলো মা। তার কিছুক্ষণ পরেই তারা কথাবার্তা বলে খাওয়াদাওয়া করে চলে গেল।
আম্মু রুমে আসলো।
-  আম্মু আমি এই বিয়ে করবো না।
- কেন করবিনা?
- ছেলেকে আমার পছন্দ হয়নি।
- তুই ছেলেকে দেখেছিস নাকি?
- হু লুকিয়ে দেখেছি। দেখো আম্মু ছেলে কোনো ফ্যাক্ট নয় মধ্যা কথা হলো যে আমি এখন বিয়েই করবো না। কয়েকদিন পর আমার ফাইনাল পরীক্ষা আর তোমরা এখন কি শুরু করলে? আমি কি এতই বেশি হয়ে গেছি তোমাদের কাছে?
- পাগলী! ছেলে-মেয়ে কি কখনো বাবা-মায়ের কাছে বেশি হয় নাকি। আর তোর পরীক্ষার আগে তো বিয়ে দিচ্ছি না। এই শুক্রবারে শুধু আংটি বদল করে রেখে দিবো। তারপর তোর পরীক্ষা যখন শেষ হবে তখন বিয়ে দিবো।
- এত তাড়াহুড়ো কেন আমার বিয়ের জন্য সেটাই তো বুঝতে পারছি না আম্মু।
- ছেলে ভালো, ছেলের ফ্যামিলি ভালো আর কি চাই। বিয়ের পর পড়াশোনাও করাবে।
- ঘেচু করাবে। তোমরা আমাকে বিয়ে দিচ্ছো নাকি বিক্রি করে দিচ্ছো আম্মু?
- প্রিয়া!! কথাবার্তা ঠিক করে  বল। আমরা তোর বাবা-মা। তোর খারাপ চাইবো না নিশ্চয়ই।
- হ্যাঁ আমার ভালোটা চাইতে গিয়ে কখন যে খারাপটা করে বসো তা তোমরা বুঝোই না।
- তোর কি কোনো পছন্দ আছে? কাউকে ভালোবাসিস?
- না।
- তাহলে তো আর কোনো সমস্যা দেখছি না। এই বিয়ে হবেই।

আম্মু রুম থেকে চলে গেলো। এইদিকে আমার রাগ যেন সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছে গিয়েছে। একই ফোনটা নিয়ে গেল, এখন আবার বিয়ে নিয়ে পড়েছে। ঐ টাকলু মটু বুড়ো ভামকে বিয়ে করবো আমি? অসম্ভব।
কিন্তু এই বিপদ থেকে আমাকে বাঁচাবেই বা কে! পেয়েছি। আকাশ! একমাত্র আকাশই পারবে। ওকেই বলবো বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে।যেই ভাবা সেই কাজ।
আকাশদের ফ্লাটে চলে গেলাম। কলিং বেল বাজাতেই আন্টি দরজা খুললো,
- আরে প্রিয়া! শাড়ি পড়েছিস যে( অবাক হয়ে)
- পরে বলছি আন্টি। আগে বলো আকাশ কই?
- আকাশ তো রুমে নেই?
- কি বলো? এই সময়ে কোথায় গেল?
- দেখলাম তো ফোনে কার সাথে কথা বলতে বলতে যেন ছাদে গেল। দেখ গিয়ে ছাদেই হয়তো আছে।
- আচ্ছা আমি তাহলে আসছি।
- আচ্ছা।

আন্টির কথামত ছাদে চলে গেলাম। ছাদে গিয়ে দেখি আকাশ এক কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে! কি অদ্ভুত বিষয়।আকাশ সিগারেট খাচ্ছে? যাক এটা নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে। আগে আমার সমস্যাটা সমাধান করি। পেছন থেকে আকাশের কাঁধে হাত রেখে শুধু বলেছিলাম,
- আকাশ জানিস....
পুরো কথাটা বলার আগেই মাত্র দুই সেকেন্ডের মত আমার মুখের দিকে তাকিয়েই আমার গালে একটা থাপ্পড় মারে। আমার অবাক হওয়ার মাত্রা যেন সীমা ছাড়িয়ে গেল।
- আকাশ!! তুই আমাকে মারলি?
- হ্যাঁ মারলাম। তোকে কি আমি কম ভালোবেসেছি? কোনো বেষ্টু কাউকে এতটা ভালোবাসে গুরুত্ব দেয়? যতটা আমি তোকে দিয়েছি? তোর জন্য শুধুমাত্র তোর জন্যই আমি মেঘলাকে এত ভালোবাসা সত্ত্বেও ইগনোর করেছি। ওকে ছাড়তে চেয়েছি। তবুও তোকে ছাড়তে চাইনি।আর সেই তুই আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিলি?
- মানে? এসব তুই কি বলছিস আকাশ? সম্পর্ক ভেঙ্গেছি মানে?
- বাহ্! বাহ্ এখন তো দেখি কিছুই জানিস না। সেদিন তুই বলার পর আমি মেঘলার সাথে দেখা করি। দুজনই দুজনকে ভালোবাসার কথা বলি। আর মেঘলা তোকে মেনেও নিয়েছিল। সেই তুই কি না আমার ফোন থেকে মেঘলাকে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিস? তোর সাথে নাকি আমার সম্পর্ক আছে? আমাদের বিয়ে হবে। আমাদের মাঝে যেন মেঘলা না আসে আরো যাচ্ছে তাই বলেছিস তুই মেঘলাকে। ছিঃ! আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে যে তুই আমার বেষ্টি!
- আকাশ তুই আম....
- চুপ! কোনো কথা বলবিনা তুই। আসলে সেদিন এটাই ছিল তোর উদ্দেশ্য যে আমার ফোন দিয়ে মেঘলার সাথে কথা বলে প্যাঁচ লাগাবি। আংকেল তোর ফোন নিয়ে গেছে এটা তো একটা বাহানা।
আর তুই যে আমাকে ভালোবাসিস? ভালোবাসার কোনো যোগ্যতা আছে তোর?  তুই ফোন ছাড়া আর কি বুঝিস? যে মেয়ে মোবাইলের জন্য এত পাগল সেই মেয়ে না ভালোবাসার যোগ্যতা রাখে  আর না বিয়ে, সংসারের! আর এখন থেকে তো এটাও ক্লিয়ার যে সে বেষ্টু হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না!
কথাগুলো এক নাগারেই বলে আকাশ চলে গেল। আমি ছলছল দৃষ্টিতে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি। ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। কি বলে গেল এসব আকাশ? এই কি সেই আকাশ যে আকাশকে আমি ছোট থেকে চিনি!!...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন