আড়ালে আবডালে - পর্ব ১৬ - মুন্নি আক্তার প্রিয়া - ধারাবাহিক গল্প


গাড়ি থেকে কোলে করে এনে নিহিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে আমান। রাত প্রায় ১২টা পার হতে চলল। এমন সময় মিহি বা সৈকতকে বিরক্ত করা ঠিক হবে কী না তা নিয়ে বিচলিত আমান নিজেই। মনের সাথে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে সিদ্ধান্ত নেয়, কাল সকালেই ওদেরকে জানাবে। নিহির গায়ে ল্যাপ জড়িয়ে দিয়ে আমান অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

নিজাম ইসলাম আর হাসপাতালে যাননি। সরাসরি বাসায় চলে গেছেন। নিহিকে নিয়ে তিনি কোনো কথাই শুনেনি নীলমের থেকে। বাড়িতে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। নীলম দরজা ধাক্কিয়ে ডেকে বলে,
"আব্বু তুমি একটাবার আমার কথা শুনো। তিতিরের শরীরের অবস্থা ভালো নয় বলেই নিহি ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিল। আর তুমি তো জানোই এলাকার বখাটে ছেলেরা কেমন? নেশাখোর, গাঁজাখোর ছেলেরা টাকার জন্য কী না করতে পারে বলো? ওরাও নিহি আর ঐ ছেলেকে টোপ হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। এখানে নিহির কোনো দোষ নেই আব্বু।"

ওপাশ থেকে ফিরতি কোনো উত্তর আসে না। নীলম আবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলে,
"আব্বু কিছু তো বলো।"

এবারও ওপাশে নীরবতা। সম্ভবত সকালের আগে আর কিছু বলতেও পারবে না। কারণ তিনি ঘরে এসেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছেন। এত ট্রেস তিনি আর নিতে পারছেন না। একসময় নীলম নিজেই ধৈর্যহারা হয়ে ডাকাডাকি বন্ধ করে দেয়। হাসপাতালে তমাকে ফোন করে জানতে পারে ওর বাবার অবস্থা এখন মোটামুটি ভালো। নীলম বলে,
"তোমরা রেডি থাকো। আমি নিতে আসছি।"
"আজকে থাকি আমি হাসপাতালে?"
"বাড়িতে সমস্যা হয়েছে তমা। নয়তো আমি নিজেও আজ হাসপাতালে থাকতাম। মাকে এখনই কিছু বোলো না। বাড়িতে আসার পর সব বলব।"
তমা অস্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন করে,
"কেন? কী হয়েছে? নিহি, তিতির ওরা ঠিক আছে তো? তিতিরের কী জ্বর বেড়েছে আরো?"
"ফোনে সব বলা যাবে না। বাড়িতে আসো। তারপর বলব।"
"আচ্ছা, আসো তাহলে।"
"ঠিকাছে।"

নীলম ফোন কেটে দিয়ে হাসপাতালে চলে যায়।


সকালে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে আমানের ঘুম ভাঙে। কাল এমন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় ফজরের আজানের সময় টেরও পায়নি। নামাজও মিস গেল আজ। কিছুক্ষণ বিছানাতে থেকেই আলসেমি কাটায়। তারপর হাই তুলতে তুলতে নিহি যে রুমে আছে সেই রুমে উঁকি দেয়। নিহি বিছানায় নেই। আমান ভেতরে যায়। ওয়াশরুমে ধাক্কা দিয়ে দেখে ওয়াশরুমেও নেই। ব্যলকোনি, ছাদেও চেক করে। কোথাও নেই। হঠাৎ আবার কোথায় উধাও হয়ে গেল? এই মেয়ে দেখি টেনশনের গোডাউন। ফ্রেশ না হয়েই আমান মিহিদের ফ্ল্যাটে যায়। দরজায় নক করার পর দরজা খুলে দেয় মিহি। আমানকে দেখে বলে,
"ভেতরে আসো।"

আমান অবাক হয়। এত স্বাভাবিক ব্যবহার কেন? ওরা কি ধরেই নিয়েছিল আমি এখন আসব? মনে মনে কথা বলেই আমান ভেতরে যায়। এবং ভেতরে যাওয়ার পরই বুঝতে পারে এমন স্বাভাবিক ব্যবহারের কারণ। নিহি সোফার ওপর পা তুলে গুটিসুটি হয়ে বসে কাঁদছে। পাশেই সৈকত বসে আছে। কী রকম অদ্ভুত মেয়ে ভাবা যায়? আসার আগে অন্তত একবার বলে তো আসতে পারত! আমানকে দেখে সৈকত বলে,
"বসো আমান।"!

আমান ওদের সম্মুখের সোফায় বসে। মিহি কিচেনে চলে যায় নাস্তা আনতে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে সৈকত নিজেই বলে,
"কীভাবে কী হলো আমান?"
"আমি নিজেও বুঝলাম না ভাই। কী থেকে কী হয়ে গেল। এমন কোনো ঘটনার জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। ইভেন, আমি এখনো একটা ঘোরের মধ্যেই আছি।"
"আমাদেরও তো একই অবস্থা। বসো কিছুক্ষণ। আমার শ্বাশুরীকে ফোন করে বলেছি নিহি আমাদের কাছেই আছে। তারা আসছে এখন।"

আমান কিছু না বলে চুপ করে থাকে। মিহি নাস্তা নিয়ে আসে। আমান ফ্রেশ হয়নি বলে এখনো খায়নি। অন্যদিকে কাঁদতে কাঁদতেই নিহির অবস্থা খারাপ। জোর করেও খাওয়ানো যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মাঝেই সালেহা বেগম, নীলম, তমা আর তিতির আসে। সালেহা বেগমকে দেখে নিহি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
"মা তুমি আমায় ভুল বুঝো না। আমার কোনো দোষ নেই মা। তুমি আব্বুকে একটু বুঝাও প্লিজ।"

সালেহা বেগম নিজেও কেঁদে ফেলেন। নিহির পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন,
"শান্ত হ মা। আমরা আছি তো তোর সাথে। আমি তোকে গর্ভে ধরেছি। আমি জানি আমার মেয়ে কেমন।"
"আব্বু আমায় আবার ভুল বুঝেছে মা। বারবার আমি আব্বুর চোখে খারাপ হয়ে যাচ্ছি।"
"আচ্ছা আমরা সবাই তোর আব্বুকে বুঝিয়ে বলব। এখন তো তুই শান্ত হ মা।"

নিহির কান্না কমে না। বরং উল্টো কান্না বাড়ে। তিনি নিহিকে নিয়ে সোফায় বসেন। ছোট বাচ্চাদের মতো নিহি মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। নিহির অন্যপাশে বসেছে নীলম। বোনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে রেখেছে। সালেহা বেগম আমানকে বিস্তারিত সব জিজ্ঞেস করেন। আমান সবকিছুই খুলে বলে সালেহা বেগমকে। সব শুনে সালেহা বেগমও যেন মাঝ সমুদ্রে পড়ে গেলেন। কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। আড়ালে নিয়ে সালেহা বেগমকে আমানের সম্পর্কে সবকিছু বলে সৈকত। সৈকতের ভাষ্যমতে, আমান খুব নম্র-ভদ্র একটা ছেলে। জব করে। বিয়ে যখন হয়ে গেছে তখন তো আর কিছুই করার নেই। সালেহা বেগম আমানকে প্রশ্ন করেন,
"এভাবে যে বিয়েটা হয়ে গেল তাতে তোমার কিছু বলার নেই?"
"আমি কী বলব বুঝতে পারছি না।"
"তুমি কি নিহিকে মেনে নিয়েছ?"
"হঠাৎ এই প্রশ্নগুলো খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে আন্টি। তবে আপনারা এবং নিহি যদি চায় আমার সঙ্গে থাকতে তাহলে আমি সব ম্যানেজ করে নেব।"
"আর তোমার পরিবার?"
"সেটাও আমি ম্যানেজ করে নেব।"

সবার কথা বলার মাঝে তমা নিহিকে নিয়ে অন্য ঘরে যায়। ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে বলে,
"নিহি আজ সকালেও এই চিঠি এসেছে দেখো।"
"আজও? কী লেখা আছে?"
"হ্যাঁ। আমি পড়িনি। তাড়াতাড়ি ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছি।"

ড্রয়িংরুম থেকে নীলম ডাকছে। নিজাম ইসলাম ফোন করেছেন। এখনই সবাইকে বাড়িতে যেতে বলেছেন। ফোনে মিহি আর সৈকতের সঙ্গেও খুব রাগারাগি করেছেন। তিনি চান না কারো সঙ্গে নিহির কোনো সম্পর্ক থাকুক। নিহিকে অবশ্য এসব কিছু বলেনি কেউ। যাওয়ার আগে সালেহা বেগম বলেন,
"চিন্তা করিস না নিহি। সবই আল্লাহ্-র ইচ্ছা। আল্লাহ্-র ইশারা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না। আর সেখানে বিয়ে তো অনেক বড় একটা বিষয়। সব পরিস্থিতির জন্যই নিজেকে তৈরি রাখিস। আর কেউ তোর সঙ্গে না থাকলেও আমি তোর সঙ্গে আছি। কলেজে আরো কিছুদিন সময় দে। এর মাঝে আমি তোর বাবাকে বুঝাব। তারপর দুই পরিবার নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসব। নিজের খেয়াল রাখিস মা।"

নিহি শক্ত করে একবার মাকে জড়িয়ে ধরে। যাওয়ার আগে নিহির কপালে চুমু দিয়ে যান সালেহা বেগম। সবাই চলে যাওয়ার পরই নিহির কান্না আরো বেড়ে যায়। আমানও নিজের ফ্ল্যাটে চলে যায়। যাওয়ার আগে নিহিকে বলে, "আপনার যখন ইচ্ছে হবে আমার ফ্ল্যাটে চলে আসিয়েন। আমি অফিসে যাব কিছু সময়ের মধ্যেই। একটা চাবি দরজার নিচে রেখে যাব। হাত দিলেই পাবেন। আসি।"
নিহি উত্তরে 'হ্যাঁ', 'না' কিছুই বলেনি। পাশের রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। তখন মিহির রুম থেকে সৈকত আর মিহির কথোপকথন শুনতে পায় নিহি। সৈকত বলছে,
"তোমার বাবা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে না মিহি? তিনি না সম্পর্ক রাখলেন নিহির সাথে। সেটা তার ব্যাপার। আমরা নিহির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবি নাকি সেটা আমাদের ব্যাপার। তাহলে সে কীভাবে বলে, নিহির সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে সে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না?"
"রাগ থেকে বলে।" মলিন মুখে বলে মিহি।

আর কোনো কথা শুনতে ইচ্ছে হলো না নিহির। নিজের জন্য কারো মাঝে কোনো সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। মিহির ঘরে গিয়ে বলে,
"আপু আমি উনার বাসায় গেলাম।"
"কার বাসায়? আমানের?" মিহি প্রশ্ন করে।
নিহি মাথা নত করে উত্তর দেয়,
"হুম।"
সৈকত আর মিহি দুজনই দুজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। সৈকত হেসে বলে,
"আচ্ছা চলো। আমি রেখে আসি।"

আমানের ফ্ল্যাটে গিয়ে কলিংবেল বাজানোর পর আমান নিজেই দরজা খুলে দেয়। একবার নিহির দিকে তাকিয়ে আবার সৈকতের দিকে তাকায়। সৈকত হেসে হেসে বলে,
"আমার সুন্দরী শালীকাকে তোমার কাছে রেখে গেলাম। সেবার যেন কোনো ত্রুটি না হয়।"
"ভেতরে আসেন আপনিও।" বলে আমান।
"না ভাই। অফিসে যেতে হবে আমার। পরে আসব।"
"ঠিকাছে।" হেসে বলে আমান।

সৈকত চলে যাওয়ার পর নিহি গিয়ে আমানের রুমে বসে। আমান টাওয়াল নিয়ে গোসল করতে চলে যায়। ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে রাখা খামটা বের করে নিহি। চিঠিতে লেখা,

'এই এলোকেশী,
আমার মনটা ভীষণ খারাপ জানো? কেন এত মন খারাপ করছে বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে তুমি ভালো নেই। তোমার কষ্টেই আমার কষ্ট হচ্ছে।

এলোকেশী,
খুব কি কষ্টে আছো তুমি? তাহলে প্লিজ একটু হাসো। তোমার কষ্টে যে আমার বুকের মাঝে তোলপাড় হয় তা তুমি বোঝো না?'

চিঠিটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিহি। মন খারাপের বিজ্ঞাপনগুলোও যে আজ দেওয়া বারণ। এখন আর মন টানছে না জানতে কে সেই উড়োচিঠির মালিক। কী-ই বা হবে আর জানতে পেরে? থাকুক কিছু কথা আড়ালে আবডালে লুকিয়ে।

আমান টাওয়াল পরেই গোসলখানা থেকে বের হয়। নিহি আমানের দিকে একবার তাকিয়ে ব্যলকোনিতে চলে যায়। নিহির হঠাৎ করেই মনে পড়ে তার না গার্লফ্রেন্ড আছে? যখন জানতে পারবে উনার বিয়ের কথা তখন কত কষ্টই না হবে! নিজে তো দুঃখীই। এখন আবার অন্যদের দুঃখের কারণও হতে হচ্ছে। কারো পথের কাঁটা হয়ে থাকার তো কোনো মানেই হয় না।

নিহি ব্যলকোনি থেকেই বলে,
"হয়েছে আপনার রেডি হওয়া?"
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক ঠিক করতে আমান বলে,
"হ্যাঁ। আসুন।"
নিহি ভেতরে এসে মাথা নত করে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
"স্যরি।"
"স্যরি কেন?" ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে আমান।

"আমার জন্যই আপনাকে এত বড় বিপদে পড়তে হলো। তাছাড়া আপনার গার্লফ্রেন্ড যখন জানতে পারবে তখন খুব কষ্ট পাবে আমি জানি। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। কয়েকটা দিন শুধু আমায় সময় দিন। আমি আমার মামার কাছে চলে যাব। তারপর..."
"তারপর?"
"তারপর ডিভোর্স লেটারও পাঠিয়ে দেবো।"

বিছানার ওপর পড়ে থাকা নিহির ফোন বাজছে। নিহি এগিয়ে যেতে নিলেই আমান পেছন থেকে ডাকে।
"নিহু।"
নিহু! ছোট্ট নাম। ভালোবাসার ডাক মনে হচ্ছে। মানুষটা এভাবে কেন ডাকবে? নিহি পিছনে ফিরে তাকায়। আমান মৃদু হেসে বলে,
"আপনি থেকে যান, আমি রেখে দেবো।"
.
.
.
চলবে........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন