উপল নূড়ি - অন্তিম পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!!

সকালবেলা জীবনের ঘুম ভাঙলো মোবাইলের রিংটোন শুনে। স্ক্রিনে বাবার নাম দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করে মোবাইলটা নিজের কানের কাছে ধরলো জীবন। কথা বলা শেষ কলটা কেটে যেতে দু মিনিট থ হয়ে রইলো জীবন। কি হলো ব্যাপারটা কিছুই বুঝলো না। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠলো জীবনের৷ তানিশা একেবারে গুটিশুটি হয়ে জীবনের বুকের সাথে ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে। রাতে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেছে পাগলিটা। কিছুই খায়ও নি। তানিশা খায় নি কিছু-কথাটা মনে পড়তেই তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠলো জীবন। ফ্রেশ হয়ে এসে চলে গেল রান্নাঘরে।

তানিশার ঘুম ভাঙতেই পাশে জীবনকে না দেখে উঠে বসলো। জীবন ওকে না জাগিয়ে অফিসে চলে যাওয়ার মানুষ না৷ তাহলে গেল কোথায় লোকটা? কথাটা চিন্তা করে শোয়া থেকে উঠে আড়মোড় ভেঙে বিছানায় উঠে বসলো তানিশা। ধীর পায়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে বলে মাথায় বেশ কিছুক্ষণ পানি দিয়ে চুল ভিজিয়েছে। এখন টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে খেয়ালই করেনি জীবন রুমে বসে আছে। তানিশা একদম টাওয়ালে মাথা ঢেকে ভেজা চুল মুছছে দেখে জীবন উঠে এসে তানিশার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে তানিশার হাত থেকে টাওয়ালটা নিয়ে নিজেই মুছে দিতে শুরু করলো। তানিশাও একটু চমকে গিয়েছিল জীবনের স্পর্শে। কিন্তু বাধা দিলো না। 

তানিশার চুল মুছে দিয়ে জীবন টাওয়ালটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেললে তানিশা রাগী চোখে তাকালো। 

-এই? ভেজা টাওয়াল বিছানায় ফেলছ কেন? 

-মুখ ধুতে গিয়ে চুল ভেজালে কি করে ম্যাডাম?

-মাথাটা ঝিমঝিম করছিল--। তাই একটু মাথায় পানি দিয়েছি--। তুমি বসো আমি টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিয়ে আসছি--। দেখি ব্রেকফাস্টে কি বানানো যায়---।

-আরো সারদিনরাত না খেয়ে কাঁদো ফাজিল মেয়ে--। 

-হুহ---। 

তানিশা জীবনের কথায় মুখ বাঁকিয়ে ভেজা টাওয়ালটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মনটা আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কখনো শ্বশুর বাড়িতে ফেরা হবে কিনা ওর কে জানে!! একটু পরই টের পেল জীবন ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়েছে। তানিশা জীবনের গলা জড়িয়ে চুপ করে রইলো৷ এই পাগলটাকে কিছু বলাটাই বৃথা। সে তার নিজের মতোই পাগলামি করবে। জীবন তানিশাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে মুখের সামনে খাবার এগিয়ে দিলো। তানিশা এবার বেশ অবাক হলো।

-এই? এসব কি! আমি নাস্তা বানাতে আসছিলাম তো---।

-কথা না বলে চুপচাপ খাও--। 

-কখন করলে এতোসব?

-এতোসব কই দেখছো? ডিম পোচ করেছি, ব্রেড পেলাম,  টোস্ট করে নিলাম আর কফি--। এমন কি বলো?

-তবু------।

-তোমাকে না খেতে বললাম? এতো কথা বলো না তুমি!! হা করো তো?

সারাদিনটা তানিশা আর জীবনের কাটলো খুনসুটিতে৷ তানিশার সব কাজে আজ বাগড়া দিচ্ছে জীবন। তানিশা বিরক্ত হলেও সেটাকে পাত্তা দিচ্ছে না জীবন। শুক্রুবার আজ। সুতরাং অফিসে যাওয়ার প্যারা নেই। সুতরাং দিনটা নিজের মতো পাগলামি করে কাটানোই যায়। দুপুরে দুজনে একসাথে দুষ্টুমি করে রাঁধতে রাঁধতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই খেতেও দেরি হলো। খাওয়া শেষ করে রুমে এসে তানিশাকে জোর করে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে জীবন। এখন একটু ঘুমাতেই হবে। তানিশাও আর কি করবে! শেষমেশ ঘুমিয়ে গেল। 

সন্ধ্যার দিকে তানিশার ঘুম ভাঙতেই দেখলো জীবন আলমারি থেকে তানিশার একটা একটা করে শাড়ি বের করে দেখছে আর বিরক্ত হয়ে আবার রেখে দিচ্ছে। জীবনের এমন কাজে তানিশা পুরোই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। উঠে এসে জীবনের পাশে দাঁড়ালো। 

-এই? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? শাড়িগুলোর এ অবস্থা করছ কেন?

-ওহ! তুমি উঠে গেছ? তানু তুমি নিজেই সিলেক্ট করো কোনটা পড়বা শাড়ি--। আমার তো মাথা ঘুরছে--।

-কোনটা পড়ব মানে!

-আমরা একটু বাইরে যাবো--। তুমি মিষ্টি দেখে একটা শাড়ি পড়বা। আমি তোমার সাথে ম্যাচিং ম্যাচিং পাঞ্জাবি---।

-পাগল হয়েছ তুমি? আমি কোথাও যাবো না---।

-উফফফ। বেশি কথা বলো সবসময়। বাবাদের ওখানে যাবো--।

-নাহ। আমার আজ যেতে ইচ্ছে করছে না। অন্য কোনদিন দুপুরবেলা যাবো। এভাবে না বলে গেলে কেমন দেখাবে--। উহু---।

-উফফ। মেয়েটা!! এই রেডি হও তো--। তাড়াতাড়ি করো--। আমি এতো শত কিছু শুনছি না---। এই লাল শাড়িটা পড়ো---।

-আজব! আজই কেন যেতে হবে!! 

-আমি যেতে চাইছি তাই---।

-উফফফ--। ধ্যাত---।

তানিশা বিরক্ত হয়ে জীবনের হাতের শাড়িটা নিয়ে পড়ে রেডি হলো৷ জীবন তানিশার বিরক্ত মুখটা দেখে মিটিমিটি হাসছে। নিজেও রেডি হয়ে নিয়ে তানিশাকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলো হালকা সাজে। তানিশা ভ্রু কুঁচকে জীবনের দিকে তাকালো।

-এই কি ব্যাপার বলো তো? মায়ের বাসায় যাচ্ছি নাকি অন্য কোথাও? এতো সাজগোজ করার কি হলো?

-কিছু হয়নি। নিজেদের বাসায় একটু সাজগোজ করে গেলে তো আর সমস্যা নেই। তাই না ম্যাডাম?

তানিশা আর কিছু বলার আগেই জীবন পাঁজাকোলা করে তানিশাকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলো উপল নূড়ি থেকে৷ আস্তে করে বসিয়ে দিলো ড্রাইভারের পাশের সিটে। আর নিজে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বাইরের আবছা আলোয় রাস্তাটা চিনতে তানিশার কয়েক মিনিট লাগলো। যখন বুঝতে পারলো ওর বাবার বাড়ির রাস্তা এটা না তখন জীবনের দিকে তাকালো। লোকটা এখন মিটিমিটি হাসছে দেখে তানিশা আরো অবাক। অনেকবার জিজ্ঞেস করলেও কোথায় যাচ্ছে বললো না জীবন। শুধু কথা একটাই। গেলেই দেখতে পাবে। তানিশাও গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। 

গন্তব্যে পৌঁছানোর পর জীবন যখন গাড়ি থেকে নেমে তানিশার জন্য গাড়ির দরজা খুলে ধরলো তখন তানিশা বের হয়ে সামনে তাকিয়েই চমকে উঠলো। এতোক্ষণ রাগ করে মাথা নিচু করেই বসে ছিল। তাই খেয়াল করে নি কোথায় এসেছে, বা কোন পথে যাচ্ছে ওরা৷ এখন বাড়ির সামনে নেমে আর এতো আলোয় আলোয় বাড়িটা সাজানো দেখে পুরোই থমকে গেল তানিশা। বহুদিন পর শ্বশুর বাড়িতে এসেছে। বাড়িটা এতো সুন্দর করে লাইটিং করা কেন কে জানে? কোন কি অনুষ্ঠান আছে বাড়িতে? জীবনের কোন ভাই বা বোনও নেই যার বিয়ের জন্য বাড়ি এভাবে সাজানো হতে পারে। তাহলে?

তানিশা চমকে দাঁড়িয়ে আছে দেখে জীবন তানিশার চোখের সামনে তু্ড়ি বাজালো। তানিশা একবার বাড়ির দিকে আরেকবার জীবনের দিকে তাকাচ্ছে অবাক হয়ে।

-কি ম্যাডাম? সারপ্রাইজড?

-আমরা বাড়িতে!! বাড়িতে এসেছি! তুমি আমাকে আগে বলো নি কেন বাড়ি আসছি!! ইশ! এভাবে!!

-হা হা। বললে কি পার্লার থেকে সাজুগুজু করে আসতে??

-জীবন!?

-কি গো বউ? বলো?

-বাড়িতে কি কোন প্রোগ্রাম আছে? এতো লাইটিং কেন? 

-ওমা তুমি জানো না? দেখলে না কাল বাবা মা কেমন তাড়াহুড়ো করে ফিরে এলো--। বুঝতে পারো নি? 

-কি বুঝতে পারি নি?

-আরে বাড়িতে বিয়ে হবে আজ-।

-বিয়ে??! কার!?

-ওমা!! আর কার? আমি বাবা মায়ের একটা মাত্র ছেলে। আমারই বিয়ে। বউ নিয়ে আলাদা থাকি। কিন্তু বাবা মায়ের দেখাশোনা করার জন্যও তো একজন লাগে----।

-কি!!??

-হ্যাঁ সত্যি--। বাবা তো সকালেই কল করে রাজি করিয়েছে আমাকে। ভাবলাম আমি তো বাড়িতে থাকি না। অন্তত এখানে একটা বউ থাকলে মাঝেমাঝে যাওয়া আসা করা গেল--।

-অসভ্য ছেলে, আমার সাথে মশকারি করো তুমি?

-আরে বাবা! মশকারি করার কি হলো? তুমি হাজার হোক আমাকে এতোওওওও ভালোবাসো। আমিও এতোওওওও ভালোবেসে তোমাকে বিয়ে করলাম--। তোমার জানার একটা অধিকার আছে না? তাই তো বাবা বললো তোমাকে নিয়ে আসতে----।

-তুমি ভিষণ খারাপ। কি সব বলছ এগুলো?

-আরে!! কাঁদছ কেন? কি মুশকিল! চলো আমার নতুন বউ দেখতে যাবা--। অনেককক মিষ্টি দেখতে বউটা------।

-অসভ্য, বেহায়া, শয়তান, ফাজিল---। তুমি আমাকে নতুন বউ দেখাবা না? খুন করে ফেলবো বলে দিলাম----।।

-হায় রে! সত্যি কথার ভাত নেই--। নিষ্ঠুর দুনিয়া---।

-জীবন! তুই আমার মায়ের সাথে কি বলছিস? আমার মাকে কাঁদাচ্ছিস কেন??

কণ্ঠটা শুনে তানিশা সামনের দিকে তাকিয়ে একটা বড়সড় ধাক্কা খেল। একবার জীবনের দিকে, আরেকবার সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে তাকাচ্ছে। দুজনেই তানিশার দিকে তাকিয়ে হাসছে৷ আর তানিশা তাদের দুজনের হাসিমুখ দেখে তানিশা পুরোই বেকুব বনে গেল।

১০!!

জীবনের সাথে কথা বলতে বলতে কখন বাড়ির দরজার সামনে চলে এসেছে সেই হুঁশ নেই তানিশার। জীবনের বাবার বলা কথাটা শুনে আর উনার মুখের হাসি দেখে তানিশার সব ওলোট পালোট লাগছে। যে মানুষটার মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য ও এতোদিন মরিয়া হয়ে ছিল সেই মানুষটা আজ নিজে থেকে তানিশার মা বলে ডাকছে! ব্যাপারটা যে স্বপ্ন নয়, বাস্তব সেটা বুঝতেই বেশ কিছটা সময় লাগলো তানিশার। হা করে তবু শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে ছিল তানিশা।

জীবনের বাবা সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই তানিশা তাড়াহুড়ো করে শ্বশুরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। এই প্রথমবার উনি বিরক্ত না হয়ে তানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করলেন। তারপর জীবনের কান টেনে ধরলেন।

-আহ! বাবা! কি করছো? বউয়ের সামনে আমার প্রেস্টিজ পানচার করছ? এটা কোন কথা হলো?

-তোর বউ আমাকে সালাম করলো, তুই করলি না কেন? আমি তোর বাপ লাগি না ব্যাটা?

-আরে! বাবা! তুমি তো আমার বন্ধু--। বন্ধুকে কেউ সালাম করে! তাও আবার পায়ে হাত দিয়ে??

-কি বললি? হারামজাদা? আমার ডায়লগ আমারে চিপকাও! আজ তোমার হচ্ছে দাঁড়াও না??

-বাবা! প্লিজ কানটা ছাড়ো? এভাবে কান টেনে লম্বা করে দিলে কিন্তু ভবিষ্যতে আমার মেয়েগুলোর বিয়ে দিতে পারবো না--। তখন বসায়া বসায়া খাইয়ো ---। আমি জানি না--। 

-একটা মেয়ের মুখ দেখাতে পারলি না ব্যাটা--আবার বলিস মেয়েগুলো!

-আরে দেখবা দেখবা। এবার কানটা ছাড়ো---। 

-হুম ছাড়লাম এইবার--। কিন্তু তোর তো আবার বিয়ে করার শখ লাগসে না? দাঁড়া--। তোর আজকে ব্যবস্থা করতেসি---। কই গো জীবনের মা? দেখো তোমার জোড়া মানিক ফিরে এসেছে----।

জীবনকে বাবার সাথে কখনো এতো ফ্রি কথাবার্তা বলতে দেখেনি তানিশা। এখন উনাদের বাবা ছেলের কথাবার্তা শুনে বেচারি পুরোই থ হয়ে গেল। বাড়িতে কিসের অনুষ্ঠান, কেন এতো সাজ কিছুই বুঝতে পারছে না। তার উপরে এদের দুজনের রসিকতা। সবকিছুই গোলমেলে লাগছে তানিশার কাছে। জীবনের মা এলে সবাই মিলে বাড়িতে ঢুকে আরো অবাক হলো তানিশা। বড় হলরুমটায় ছোটোখাটো স্টেজের মতো করা হয়েছে। আর সামনে বেশ অনেকগুলো চেয়ার পাতা। তানিশাকে দেখেই সেখান থেকে কয়েকজন এসে তানিশাকে জড়িয়ে ধরলো। এতোক্ষণে তাদেরকে দেখে আরো একবার আকাশ থেকে পড়লো তানিশা। সামনে দাঁড়ানো তানিশার মা, বাবা, ভাইয়া, ভাবি। 

কিছু বুঝে উঠার আগেই ভাবি তানিশাকে আর জীবনের বাবা আর কয়েকজন মিলে জীবনকে দুটো আলাদা রুমে নিয়ে গেল। বেচারা জীবন বহু কথা বলে বাবাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে শুনে তানিশা হেসে ফেললো। কিন্তু জীবন ছাড়া পেল না। তানিশাও ভাবিকে বহুবার জিজ্ঞেস করলো কি হচ্ছে, সবাই এই বাড়িতে কেন। কিন্তু ভাবি সেসব পাত্তাও দিলো না, জবাবও দিলো না। ভাবি শুধু মিটিমিটি হেসে তানিশাকে টুকটুকে লাল একটা বেনারসি পড়িয়ে সাজিয়ে দিলো। 

সাজ কমপ্লিট হলে তানিশাকে নিয়ে বসানো হলো হলরুমের ছোট্ট স্টেজে। একটু পরে জীবনকেও এনে সবাই মিলে বসিয়ে দিলো তানিশার পাশে। একেবারে বরের সাজে। তানিশাকে নতুন বউয়ের বেশে দেখে জীবন হা হয়ে গেল। কিছু বলতে পারলো না। তানিশাও অবাক হয়ে সবকিছু দেখছে। জীবনের বাবা কোথা থেকে একজন কাজীও নিয়ে এসেছেন। বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে তানিশা আর জীবন উঠে এসে সবাইকে সালাম করলো। জীবনের বাবাকে সালাম করলে উনি দুজনকেই দোয়া করলেন। তারপর তানিশার মাথায় হাত রেখে চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন।

-বুড়ো বাপটা তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি মা। বাপটাকে মাফ করে দিস। 

-না বাবা! কি বলছেন?

-বলতে দে মা। আজ বলতে দে। জীবন পছন্দ করে তোকে বিয়ে করেছে বলে তোর উপরে এতোদিন রাগ ঝেড়েছি। তোর ছোট খাটো খুঁটি নাটি সব কাজেই তোর খুঁজেছি। কি করবো বল? বুকের ভিতরে একটা ভয় ছিল। আজকাল কতো পরিবারই তো দেখছি। বাইরে থেকে একটা মেয়ে এসে এতোদিনের সাজানো সংসারটা একেবারে নষ্ট করে দেয়। তাই তুই যে পরিবারটাকে এক করে চলতে চাস, তোর সে চাওয়াটা আমার চোখেই পড়ে নি৷ কথায় কথায় উঠতে বসতে অপমান করেছি। মনে হচ্ছিল আসলেই তুই আমার সংসারটাকে তছনছ করে দিচ্ছিস। আর সেদিন যখন শুনলাম তুই আলাদা বাড়ি কেনার কথা বলছিস---। রাগটা সামলাতে পারি নি রে মা---।

-সরি বাবা। আমি শুধু চেয়েছিলাম ছুটির দিনগুলোতে আমরা সবাই মিলে বাড়িটায় গিয়ে হাসি আনন্দ করবো। সমস্ত কাজের প্যারা ভুলে--। আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি--।

-না রে মা। আমি সরি। তোর বসের কথা শুনে এতো অবাক হয়েছি বলার মতো না। তুই শুধু আমাদের কথা ভেবে নিজের এতোদিনের চাকরিটা ছেড়ে দিতেও ভাবিস নি। এই যে আমি আসার সময়ও তুই কেঁদেকেটে হয়রান হচ্ছিলি--। কি করবো বল? আমার মাকে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে হতো যে---।

-বাবা!!

-হ্যাঁ মা। এতোদিনের এতো খারাপ ব্যবহারের জন্য সরি মা। আর তোর উপল নূড়িতে আমরা যাবো। প্রতি সপ্তাহেই যাবো। উপল নূড়ি হবে আমাদের হলিডে হাউজ---।

-থ্যাংক ইউ বাবা---।

তানিশা আর জীবন দুজনেই একসাথে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। তানিশার এতোদিনের পরিশ্রম আর জীবনের এতোদিনের ধৈর্য্য আজ সার্থক হয়েছে। বাবার মনে যে চাপা ক্ষোভটা ছিল সেটাও আজ ওরা জয় করে নিয়েছে নিজেদের চেষ্টা দিয়ে। কথায় আছে মন থেকে চাইলে সবই পাওয়া যায়। তাই হয়তো ওদের মনের জোরের কাছে বাবার এই অযাচিত ভয়টা হেরে গিয়ে জিত হয়েছে ভালোবাসার।

এক সপ্তাহ পর।
সপ্তাহ খানেকের শূন্যতার পর উপল নূড়িতে আজ প্রাণের উৎসবে মেতেছে সবাই। সারাদিন জীবন, তানিশা, বাবা, মা, তানিশাদের বাড়ির সবাই মিলে মিশে রান্না করেছে, খাওয়া দাওয়া করেছে আর হাসি ঠাট্টা তো আছেই। এসব করতে করতে রাতও গভীর হয়েছে অনেক। জীবন একবার ইশারায় তানিশাকে ডেকে রুমে এসে শুয়ে আছে। এদিকে মেয়েটার আসার নামও নেই। মেজাজ খারাপ করেই শুয়ে আছে জীবন। আজ আসুক। মজা দেখাবো। তানিশা রুমে এসেছে টের পেয়ে কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে রইলো। 

তানিশা পা টিপে টিপে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেখলো জীবন শুয়ে আছে। ভাবলো জীবন হয়তো ঘুমিয়ে গেছে রাগ করে। রাগ করবে নাই বা কেন? সেই কখন এসেছে লোকটা রুমে। আসার সময় ইশারায় তানিশাকেও আসতে বলেছে। কিন্তু সবাই এটা ওটা কথা বলছিলো, সেখান থেকে কি করে উঠে আসবে তানিশা! লোকটা একটু বুঝেও না। তানিশা আনমনে হেসে মশারি টাঙানোর জন্য বিছানার কাছে আসতেই জীবন হুট করে তানিশাকে টেনে নিয়ে বিছানায় উঠিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো যে তানিশা থতমত খেয়ে গেল। 

-এই? তুমি ঘুমাও নি?

----------------------

-শোনো না? এই? 

-ঘুমাও তানিশা--। রাত অনেক হয়েছে --।

-সরি তো? এই? সবার সামনে দিয়ে---।

-তানু? কাল সকালে অফিসে যেতে হবে--। এখন একটু ঘুমাও--। প্লিজ?

-শোনো না?? আমি কি বলছি---।

জীবন আর কিছু না বলে তানিশাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে বেড সাইট লাইট ওফ করে দিলো। তারপর আলতো করে তানিশাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো। তানিশা জীবনের বুকের উপরে থুঁতনি রেখে জীবনের মুখের দিকে তাকালো।

-এই? শোনো না গো? সরি---।

-ইটস ওকে ম্যাডাম---। ঘুমান এখন---। গুড নাইট।

তানিশার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। জীবনের বুক থেকে সরে উঠে বিছানা থেকে নামার জন্য পা বাড়াতেই জীবন তানিশার হাত ধরে একটানে নিজের বুকে ফেলে জড়িয়ে ধরলো। তানিশা গাল ফুলিয়ে আর কথা বললো না। ছোটার জন্য ছটফট করতে লাগলো। জীবনও তানিশার তানিশার অভিমানটা বুঝতে পেরে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরলো।

-পাগলি? এমন করছো কেন?

-ছাড়ো--।

-কই যাও?

-জানি না---। তুমি ঘুমাও---।

-একে তো এতো দেরি করে এসেছ। এখন আবার আমাকেই রাগ দেখিয়ে উঠে যাওয়া হচ্ছে? কাজটা কি ঠিক বলো?

-জানি না--। ছাড়ো। তোমার তো ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে। তুমি ঘুমাও। আমি নাহয়----।

-তানু? আমার রাগটা না ভাঙিয়ে নিজে রাগ দেখাচ্ছো! এটা কোন ধরনের লজিক বলো তো? 

-লজিকের কিছু নেই। আমি তো ইচ্ছে করে দেরি করি নি--। তবু যদি মানুষ এমন করে আমি কি করবো?

-কি করবা জানো না? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি বউটাকে মন ভরে আদর করবো বলে--। আর তিনি একে তো দেরি করে এসেছে--। এসেও চুপিচুপি আমাকে আদর করে রাগ না ভাঙিয়েই---।

-ভালো হয়েছে--। 

-এখন আবার বাচ্চাদের মতো রাগ দেখানো হচ্ছে না? তোমাকে আজ দাঁড়াও না----।

-হুহ--। কচু--। সরো। ঘুমাবো। সকালে অফিসে যাবো না? ঘুম ঠিক মতো না হলে তো অফিসে গিয়ে ঝিমাবো---।

-দুষ্টুটা--। আমার কথা দিয়ো আমাকেই খোঁটা দেয়া না?? দাঁড়াও--। ঘুম পাড়াচ্ছি তোমাকে--।

-এই? ভালো হবে না বলে দিলাম জীবন---।

জীবন আলতো করে তানিশাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে ঠোঁটে কামড় বসালো। তানিশাও রাগ অভিমান ভুলে জীবনের ভালোবাসায় গা এলিয়ে দিলো। উপল নূড়িও তার একাকীত্ব ভুলে ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে জেগে থাকলো। এভাবেই প্রতি ছুটির দিনগুলোতে উপল নূড়ি দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসার গল্পে নিজের শূন্যতা ভুলে যায়। আর অধীর হয়ে অপেক্ষা করে পরের ছুটির দিনের অপেক্ষায়। আর বাকিগুলোতে ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে বাড়ির গেইটে জ্বলজ্বল করে একটি নাম- "উপল নূড়ি।"



                               ***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন