নীলিমা - পর্ব ০৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৯!!

তন্ময়ের পার্সে ওদের বিয়ের ছবিটা দেখেই অপলকে ছবিটা দেখছে নীলিমা। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের ছবি। তন্ময় আর নীলিমা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ঠোঁটের কোণে খেলা করছে অকৃত্রিম একটা হাসি। বিয়ের ছবিটা দেখে বিয়ের দিনটার ঠিক এক সপ্তাহ আগের ঘটনাটাও যেন নীলিমার চোখের সামনে ফুটে উঠতে শুরু করেছে৷ মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। স্মৃতিতে এতোটাই জীবন্ত যে মনে হয় চাইলেই নীলিমা আজও সেখানে ফিরে যেতে পারবে।

মাথায় আর সারা শরীরের অসহ্য একটা ব্যথায় চোখ খুলে তাকায় নীলিমা। চারদিকে এক বার ভীত চোখে দেখে নেয় মেয়েটা। দেখে মনে হচ্ছে কোন একটা হসপিটালের মতো জায়গায় আছে ও। তবে ঠিক হসপিটালও না। রুমটা হসপিটালের ধাঁচে বানানো হলেও এটা কারো থাকার ঘর৷ বেশ সাজানো গোছানো একটা বেডরুম, তবে সব কিছুতেই একটা নার্সিং হোম টাইপের ভাব ফুটে আছে। এই যে বেড সিট, কাভার, দেয়ালে ঝোলা ভারি পর্দা সব কিছুতেই ধবধবে সাদা রঙ। কেমন তুষারের দেশ মনে হচ্ছে রুমটাকে ওর কাছে৷ কিন্তু জায়গাটা কোথায় সেটা ও জানে না৷ এমন কি সমস্ত শরীরের এই অসহ্য যন্ত্রণার কারণটা পর্যন্ত মনে করতে পারছে না বেচারি। তবু মাথা চেপে ধরে ভাবতে চেষ্টা করছে ও। কিছু তো মনে পড়বে কি হয়েছিল ওর।

হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হয়ে দরজা খুলে যেতেই নীলিমা একেবারে জড়োসড়ো হতে বিছানায় গুটিসুটি হয়ে মুখ লুকিয়ে নিলো। ধীর পায়ে মানুষটা ওর সামনে এসে দাঁড়ালে একটু সাহস করে ঘাড় বাঁকিয়ে একটু চোখ পিটপিট করে মানুষটার দিকে তাকালো৷ তখনই প্রথম দেখলো মানুষটাকে নীলিমা৷ আর দেখেই কয়েক সেকেন্ড অবাক বিস্ময়ে তার মুখের দিকেই তাকিয়ে রইলো। লোকটার চোখে, মুখে কিসের একটা উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। আর সেটা শুধু নীলিমার জন্য। সেই মায়া ভরা মুখটা দেখেই থমকে গিয়েছিল নীলিমা৷ মানুষটা কে সেটাও নীলিমা জানে না। তবু কেন জানি তাকে ভিষণ আপন কেউ মনে হচ্ছিল ওর৷ মনে হচ্ছিল নিজের কেউ লোকটা। নীলিমার এভাবে চুপ করে থাকায় মানুষটা যেন আরেকটু ভয় পেয়ে যায়। এগিয়ে এসে নীলিমার মুখটা তুলে ধরে গভীর আতঙ্কে।

-তুমি ঠিক আছো? শরীর খারাপ করছে? পানি খাবে একটু? কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে? কি কষ্ট হচ্ছে আমাকে বলো? নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে? নাকি------।

-আপনি কে?

-আমি! আমি--আমি তন্ময়। তুমি কেমন আছো এখন?

-ভালো---।

-কি কষ্ট হচ্ছে বলো? ডাক্তারকে খবর দিবো? 

-আমি এখানে কেন? আর এই জায়গাটা কোথায়?

-সেসব পরে হবে। বলো না? কষ্ট হচ্ছে তোমার কোনো?

-নাহ--। জাস্ট মাথাটা ভার হয়ে আছে--। আর শরীরটা একটু ব্যথা করছে---। আমি---। আমি এখানে কেন?

-তোমার একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল৷ আমি তোমাকে রাস্তায় পেয়ে বাসায় নিয়ে এলাম---। 

-এক্সিডেন্ট!

-হ্যাঁ---। এবার একটু কষ্ট করে তোমার বাবা মার নাম আর ঠিকানাটা বলো প্লিজ---। উনাদের খবর দেয়া প্রয়োজন---।

-বাবা মা!

-হ্যাঁ---। আর কি নাম তোমার?

-আমার? আমার নাম? আম--। আমার নাম--।

-এই? কি হয়েছে তোমার? 

-প্লিজ বলুন না আমার নাম কি? আমার মনে পড়ছে না কেন?

নীলিমা দু হাতে মাথাটা চেপে ধরে আর্তনাদ আর আকুল ভরা কণ্ঠে বলছে দেখে তন্ময়ের মধ্যেও একটা ব্যাকুলতা দেখা দিল৷ আরেকটু এগিয়ে গিয়ে নীলিমাকে নিজের সাথে হালকা করে জড়িয়ে নেয় সে৷ মনে হয় যন্ত্রণাটা নীলিমার নয়, তন্ময়েরই হচ্ছে। 

-ডক্টর! ডক্টর----।

ডাক্তার বাইরের রুমেই বসা ছিল। তন্ময়ের কন্ঠস্বর শুনে রুমে এলো৷ নীলিমাকে যতই প্রশ্ন করছে ততই মেয়েটা কিছু মনে করতে না পেরে আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে দেখে শেষমেশ ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে শান্ত করলেন ডাক্তার৷ তারপর তন্ময় আর ডাক্তার দুজনেই বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে৷ 

-কি হয়েছে ডক! ওর কি আসলেই--।

-হ্যাঁ মিস্টার তন্ময়। আমরা যেমনটা ভেবেছিলাম। উনার আসলেই মেমোরি লস হয়েছে---৷ 

-এখন কি করা যায় বলুন---।

-লাস্ট এক মাস ধরে তো চেষ্টা করছেন---। পুলিশ স্টেশন থেকেও তো কোন খবর পাওয়া গেল না--। আরেকটা চেষ্টা করা যায়--। নিউজপেপারে বিজ্ঞাপন দেয়া যেতে পারে--। কিন্তু তাতে---।

-হুম--। রিস্ক হয়ে যাবে মেয়েটার জন্য---। 

-সেটাই ভাবছি--। দেখলেনই তো-। উনি ড্রাগ এডিক্ট নন, অথচ এক্সিডেন্টের সময় ব্লাডে প্রচুর পরিমাণে ড্রাগ পাওয়া গেছে--। সুতরাং বুঝতেই পারছেন কেউ ইচ্ছে করেই মারার চেষ্টা করেছিল--৷ তারা যদি কোনভাবে জানতে পারে যে উনি বেঁচে আছে----।

-এখন তাহলে----!

-আপনার খুব সমস্যা হলে কয়েকটা দিন কোন আশ্রমে পাঠানোর ---।

-নো ডক--। আমি দেখছি কি করা যায়---।

এর পরের সাতটা দিন নীলিমার বিভীষিকার মতো কেটেছে। নিজের নামটাও মনে করতে পারে না। অথচ রাতের অন্ধকার ছাপিয়ে চোখের সামনে অনেক মানুষের চেহারা ঘুরে বেড়ায়৷ না তাদের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পারে মেয়েটা, না বুঝতে পারে কে তারা, আর কিইবা করছে। কখনো রাতে ভয়ে খাটের এক কোণে লুকিয়ে গুটিসুটি হয়ে কাঁদে নীলিমা৷ একদিন রাতে এসব সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যায় নীলিমা। চোখ খুলে নিজেকে বিছানায় শোয়া দেখে যতটা না অবাক হয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ অবাক হয় তন্ময়কে ওর বিছানার পাশে চেয়ার বসে থাকতে দেখে। নীলিমার হাতটা শক্ত করে ধরে বসে থাকতে থাকতেই বোধ হয় লোকটা ঘুমিয়ে গেছে। নীলিমা নড়ে উঠতেই তন্ময়েরও ঘুমটা ছুটে গেল। 

-ঘুম ভেঙ্গে গেছে তোমার? ঠিক আছো তুমি?

-আমার আর ঠিক থাকা---।

-এভাবে বলছো কেন? আর রাতে কি হয়েছিল? তোমাকে ওভাবে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে আমি--।

-কি ভেবেছিলেন! মরে গেছি??

-এই মেয়ে? কি বলো এসব? 

-কি আর হবে বলুন এভাবে বেঁচে থেকে? যার নিজের নামটা পর্যন্ত--।

-তুমি আমার নীলিমা হবে? যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোমাকে নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবো--। তোমার কি মনে আছে, কি নেই সেসব নিয়ে কখনো মাথা ঘামাতে হবে না। শুধু আমার হয়ে থাকবে তুমি--। হবে আমার নীলিমা?

-আপনি!

-দেখো নীলি---। তোমাকে সেদিন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে মনে হচ্ছিল আমার বুকের ভিতরটা কেউ ছুরির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে--। তোমার এই মায়াভরা মুখটা দেখে খুব আপন মনে হচ্ছিল--। এই অনুভূতিটা হারাতে চাই না। তোমাকে কখনো হারাতে চাই না--। তোমাকে হারাতে হলে হয়তো মরেই----।

তন্ময় কথাটা শেষ করতে পারলো না। নীলিমা আলতো করে তন্ময়ের ঠোঁটে হাত রেখে থামালো। তন্ময় নীলিমার দিকে তাকাতেই লজ্জা পেয়ে হাতটা নামিয়ে নিতে গেলেই তন্ময় নীলিমার হাতটা ধরে আলতো করে চুমো খেল। নীলিমাও একটু কেঁপে উঠে মুখ নামিয়ে হাসলো। তন্ময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো চুপ করে৷ 

-আমার যদি কখনো স্মৃতি ফিরে আসে--। আর তখন যদি----।

-তখন আমার ভালোবাসা দিয়ে আবার তোমাকে মনে করিয়ে দিবো সব---। নয়তো নতুন করে জয় করে নেব---। 

-----তবুও মনে না পড়লে---।

-তাহলে আবার নতুন করে ভালোবাসার আরেকটা গল্প রচনা করবো দুজনে---। শুধু তুমি পাশে থাকলে সবটা শূন্য থেকে শুরু করতেও পিছপা হবো না আমি---।

-আর আপনার পরিবার! তারা যদি--।

-তুমি ছাড়া তন্ময়ের আর কেউ নেই নীলি--। কেউ না---।

নীলিমা চমকে উঠে তন্ময়ের দিকে তাকালো। তন্ময় শান্ত চোখে নীলিমাকে দেখছে। 

-আমি--। আমি রাজি আপনার নীলিমা হতে----।

-থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ সো মাচ নীলি---। বিয়েটা যখন করতেই হবে-। তবে কালই হোক--। কি বলো?

নীলিমা লজ্জায় লাল হয়ে সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়তেই তন্ময় উঠে একটু ঝুঁকে নীলিমার কপালে চুমো খেল। পরের দিন বেশ অনুষ্ঠান করেই ওদের বিয়েটা হয়েছিল। তন্ময়ের কলিগ, তাদের কয়েকজনের পরিবার, নীলিমার ডাক্তার- সব মিলিয়ে বিশাল আয়োজন। আর পুরো আয়োজনটার মধ্যমণি ওরা দুজন। নীলিমা আর তন্ময়। বিয়ের কথাটা মনে পড়তেই নীলিমা তন্ময়ের মোবাইল থেকে ওদের বিয়ের ভিডিওটা ওপেন করলো। ভিডিওটা দেখা হয়নি পুরোটা৷ প্রতিবারই লোকটা দুষ্টুমি শুরু করে দেয় ভিডিও দেখার মাঝেই। কথাটা খেয়াল হতেই নীলিমা লাজুক হেসে তন্ময়ের কপালে চুমো খেল আলতো করে। ভিডিওর একটা জায়গা দেখতে দেখতে হঠাৎ করে থমকে গেল নীলিমা। দশ সেকেন্ড ব্যাকওয়ার্ড করে আবার দেখলো অংশটা। একবার, দুবার করে বেশ কয়েকবার অংশটুকু দেখলো নীলিমা। তবু নীলিমার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। বিয়ের সময় নামটা 'তন্ময়' না বলে কাজীসাহেব বারবার 'আবীর শাহরিয়ার আহমেদ' কেন বলছে সেটাই মাথায় ঢুকছে না নীলিমার। কে এই আবীর শাহরিয়ার আহমেদ!

১০!!

বিয়ের ভিডিওতে আবীর নামটা শুনে নীলিমা ব্যস্ত হাতে তন্ময়ের পার্সটা খুললো। সেখানে তন্ময়ের আইডিটা আগেই দেখেছে। আইডিটা হাতে নিতেই নীলিমার পৃথিবীটাই যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল। আইডিতে তন্ময়ের ছবির নিচেই নামটা ভেসে আছে স্পষ্ট অক্ষরে। 'আবীর আহমেদ'৷ নীলিমা এতোক্ষণ শুয়ে ছিল। এবারে চমকে উঠে বসে গেল নীলিমা। আর তাতেই তন্ময়ও একটু নড়ে উঠে নীলিমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো। নীলিমা কিছুক্ষণ থ হয়ে বসে ভাবার চেষ্টা করলো৷ যে মানুষটার সাথে ও একটা বছর ধরে সংসার করছে সেই মানুষটা নিজের পরিচয়টা ওর কাছে গোপন করেছে এতোদিন ধরে! কিন্তু কেন? 

নীলিমা এক মনে বসে ভাবার চেষ্টা করছে৷ এই ব্যাপারে তন্ময়ের সাথে সরাসরি কথা বলা উচিত! নাকি তন্ময়ের সবটা স্বীকার করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত! আচ্ছা তন্ময় ইচ্ছে করেই পার্স, মোবাইল দিয়েছে ওকে। তাহলে কি তন্ময় চাইছিল ব্যাপারটা নীলিমা জানুক! তাই যদি হয় তবে না বলে এতো দিন ধরে ওকে এই ধোঁয়াশায় রাখার কারণ কি হতে পারে! নাকি ব্যাপারটা আরো জটিল! কোন নিষিদ্ধ কাজের সাথে যুক্ত নয়তো লোকটা! আর ভাবতে পারলো না নীলিমা। দু হাতে মাথা চেপে ধরলো৷ আর ভাবতে পারছে না নীলিমা। একটু পরেই টের পেল তন্ময় নীলিমার পেটে মুখ গুঁজে লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। নীলিমা তন্ময়ের চুলে হাত ছুঁইয়ে দিলো।

-কি করছো তুমি?

-কথা বলো না নীলি। তোমার মিষ্টি ঘ্রাণটা নিতে দাও--। 

-একটা প্রশ্ন ছিল। 

-আইডিতে যে নামটা দেখছো আর বিয়ের সময় কাজী সাহেব যে নামে বিয়ে পড়িয়েছেন সেটাই আমার আসল নাম নীলি--।

-তাহলে---। তাহলে এতো লুকোচুরি কেন? নিজের নাম পরিচয় গোপন করার কি কোন কারণ ছিল তন্ময়? ওহ না সরি--। তন্ময় নাকি মিস্টার আবীর---? কোনটা বলবো আপনাকে?

আবীর উঠে বসে নীলিমার দিকে একবার তাকালো। মেয়েটা রেগে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে সে। এই রাগ সহজে যে নামবে না সেটাও আবীর বেশ টের পাচ্ছে। নীলিমা আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবীর নীলিমার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো। নীলিমা হাত পা ছুঁড়ে সরার চেষ্টা করেও সফল হলো না। আবীর হেসে এক হাতে নীলিমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে অন্য হাতে নীলিমার মুখটা তুলে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। 

-নীলি? আমার কথাটা শোনো একবার প্লিজ?

-কি শুনবো? হ্যাঁ কি শুনবো তোমার কথা? এখন সত্যি বলবে সেটার ই বা---।

-নীলি? আচ্ছা একটা বার শোনো বউ প্লিজ? তারপর যা বলবা তাই হবে---।

-বলো----। 

-আসলে আবীর শাহরিয়ার আহমেদ, এটাই আমার আসল নাম। তন্ময় ছদ্মনামটা একটা কেইস নিয়ে কাজ করার জন্যই ব্যবহার করতে হচ্ছে। একে তো সরকারি পক্ষের গোয়ান্দা, তার উপরে এই ড্রাগ মাফিয়াদের কেইসটা আরো বেশি রিস্কি। প্রথম দিকে সাধারণ ড্রাগ পাচারকারী চক্রের একটা নরমাল কেইস মনে হলেও দিন দিন আরো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে কেইসটা। আর তাই তোমাকেও পরিচয়টা জানানে হয়নি--। 

-আমাকেও জানানো যেত না?

-নীলি? রাগ করো না প্লিজ--। এর সাথে তোমার সেইফটিও জড়িত ছিল। তাই আমি-----।

-বলা শেষ তোমার?

-সরি---। 

-এবার বলো? আর কি কি লুকিয়েছ আমার কাছে? আনসার মি মিস্টার আবীর---।।

-মানে আসলে---। আসলে আমি যে শুধু গোয়েন্দার কাজটাই করছি সেটাও না---। আমার নিজের একটা বিজনেস ফার্ম আছে--। বিকেলের পরে সেখানেই---।

-বাহ!! অসাধারণ! তা আপনার ফেমেলিতে আর কে কে আছে?  ওয়াইফ? বেবি? ছেলে নাকি মেয়ে?

-নীলি! কি বলো এসব?

-বলো বলো? কে কে আছে?

-নীলি? আমার তো তুমি আছো-। আমার পুরো দুনিয়াটাই তো তুমি-। আর কাউকে লাগবে কেন?

-আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই মিস্টার আবীর----। আপনার ডায়লগ শোনার আর ইচ্ছে নেই--।

-নীলি? শোনো না?

নীলিমা আবীরের সামনে থেকে সরে সোজা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। একটু পরে আবীর এসে নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। ততক্ষণে নীলিমার চোখের বৃষ্টি ঝরা শুরু হয়েছে।

-নীলি? আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি জান। সরি--। আসলে আমাদের কাজটাই এমন--৷ আর এই কেইসটার সাথে প্রায় দুই বছর ধরে আছি--। কাছের দুজন বন্ধুকে হারাতে হয়েছে শুধু এই কেইসটার জন্য--। তাই তোমাকে এসবের সাথে জড়াতে বড্ড ভয় হয়েছিল বউটা--। সরি---। কিন্তু আমার সম্পর্কে সবটা জানার অধিকার তোমার আছে--। আমি জানি--। বাট---। 

-বাদ দাও--। যা হয়েছে হয়েছে--। এসব নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার---।

-তাহলে বলো মাফ করে দিয়েছ?

-হুম---।

-নীলি? লাঞ্চ অর্ডার করেছি--। পনেরো বিশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে--। 

-হুম---।

-আর রাগ করে থেকো না প্লিজ? লাঞ্চ করে একটু বের হবো--। 

-সকালে না বললে কোথাও যাবে না তুমি--?

-আমি তো একা যাবো না। তুমিও যাচ্ছো--।

-কোথায়!

-আমাদের অফিসে--। ভেবেছিলাম আজ যাবো না---। কিন্তু আমার সবটা তো তেমার জানা থাকা উচিত-। কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না---।

-আবীর! বাজে কথা বলবা তো--।

-কি আর হবে! 

-কি হবে মানে কি? তুমি এসব বলবা কেন?

-এতো এতো মিথ্যে বলছি--। তোমাকে ঠকাচ্ছি--। এসবের বোঝাটা আর বইতে হবে না তাহলে।

-তুমি--? অসভ্য ছেলে----!

নীলিমা আবীরের দিকে ঘুরে বুকে হাত আছড়ে রাগি চোখে তাকালো। আবীর নীলিমার রাগি মুখটা দেখে মুচকি হেসে নীলিমার কোমড় টেনে ধরে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো। 

-নীলুসোনা? রাগ করছো কেন গো?

-অসভ্য লোক একটা--। যাবো না আমি তোমার সাথে কোথাও--। তোমার যেখানে মন চায় যাও--।

-সত্যি যাবো?

-বাসার বাইরে এক পা রেখে দেখো, পা যদি না ভেঙ্গে দেই দেখবা তো-।

-ওলে বাবা রে! বউটা রেগে গেছে রে--। ও নীলু? নীলি?

-কি হয়েছে?

-ভালোবাসি তো।

-------------------------------

-ও নীলিমা? কি গো? ভালোবাসি তো?

নীলিমা একবার চোখ লাল করে আবীরকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শোনা গেল। বিরক্ত ভঙ্গিতে আবীরের কাছ থেকে সরে দরজা খুলতে গেল নীলিমা। আবীরও নীলিমার পিছন পিছন চললো বকবক করতে করতে। খাবার নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে আছে দেখে আবীর বিল মিটিয়ে দিলো। তারপর নীলিমাকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে চুপচাপ খাইয়ে দিলো আবীর৷ আবীর নিজে খাচ্ছে না দেখে নীলিমাও আবীরকে খাইয়ে দিলো৷ আর সাথে সাথেই আবীরের ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠলো। খেতে খেতে আবার নীলিমার সাথে দুষ্টুমিতে মাতলো আবীর। 

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আবীর একটা হালকা জামদানি শাড়ি পড়িয়ে দিলো নীলিমাকে৷ নীলিমা মুখ ভার করে আবীরের কাজকর্ম দেখছে। শাড়ি পড়ানো শেষ হতেই আবীর নীলিমার কাঁধে হাত ঝুলিয়ে নাকে নাক ঘষলো।

-রাগ করে থেকো না প্লিজ? আর কক্খনো কিচ্ছু লুকাবো না তোমার থেকে ঘুমপরীটা--।

-প্রমিস?

-প্রমিস প্রমিস প্রমিস। ১০০ টা প্রমিস--। 

-হুম---।

-নীলি? কিন্তু মিস তুলি কোথায়? সেই সকালে বেরিয়েছে এখনো আসার সময় হয় নি!!

-আমিও সেটাই ভাবছি-। কোন সমস্যা হলো কিনা---। 

-বাদ দাও--। চলো--। আজকে আপাতত আর সবার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেদের নিয়েই ভাবি--। কি বলো? চলে আসবে আমরা বাসায় ফিরতে ফিরতে---।

-হুম---।

নীলিমাকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে একটু অবাকই হলো আবীর। আজ গেইটে দারোয়ানকে দেখতে পেল না। লোকটা আবীরের একজন বিশ্বস্ত লোক। এভাবে গেইট খালি রেখে লোকটা কোথাও চলে যাওয়ার মানুষ নয়। তাহলে কি কোন সমস্যা হয়েছে! নাকি নিছকই ওর মনের ভুল। কথাটা ভাবতে ভাবতেই ঘাড়ের কাছে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা অনুভব করলো আবীর। কেউ যেন হঠাৎ ইনজেকশন পুশ করেছে এমন প্রচন্ড ব্যথাটা৷ চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগে আবীরের মনে হলো নীলিমাও ততক্ষণে ওর পাশেই মাটিতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন