সংসার - পর্ব ১৩ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


২৫!! 

-এই যে মেয়েটাকে দেখছ সামনে, ঠিক করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেও পারছে না, দেখছ তো ওকে? এতো দূর থেকে দাঁড়িয়ে তো ঠিক মতো দেখতে পাচ্ছ না তাই না মা? ওয়েট! এই ভাবি? এদিকে এসো। মায়ের সামনে এসে দাঁড়াও। এসো এসো? মাও দেখুক তুমি কেমন নাটক করে সবার মন ভুলিয়েছ। কই এসো এসো? মায়ের সামনে এসে দাঁড়াও তো ভাবি? এসো এসো?

প্রভা ওর মাকে নিয়ে অরণ্যের রুমের সামনে এসে দাঁড়ানোর প্রায় সাথেসাথেই রুমে দরজাটা খুলে অনামিকা বেরিয়ে এসেছিল। অরণ্য রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কিছুতেই ঘুম আসছিল না মেয়েটার। কোনোমতো সমস্ত শরীরের অসহ্য যন্ত্রণাটাকে সহ্য করে নিয়ে হাত মুখে ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসতেই বাইরো থেকে আবার চিৎকার চেঁচামেচির শব্দটা অনামিকার কানে এলো। রুমের বাইরে যাবে কি না সেটা কিছুক্ষণ ভেবেই দরজাটা খোলামাত্রই সামনে প্রভা আর রাগী চেহারার আরেকটা মানুষকে দেখে চমকে গেল অনামিকা। পিছন পিছন যে অরণ্য আর বাকিরাও আসছে সেটাও দেখে থতমত খেয়েই দাঁড়িয়ে গেল অনামিকা। প্রভাও মিনিট খানেক থমকে দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে এসে কথাগুলো বলতে বলতে অনামিকার একটা হাত টেনে ধরে মায়ের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল অনামিকাকে। অনামিকার হাতটা রিশাদের উল্টোদিকে করে চেপে ধরায় আগেই বেশ খানিকটা মচকে গিয়েছিল। রাতে ব্যথার ওষুধে ব্যথাটা কমলেও এবারে প্রভার শক্ত করে ধরায় অনামিকার মনে হলো হাতটা বুঝি ভেঙ্গেই গেছে। তবু মেয়েটা দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা হজম করার চেষ্টা করলো। প্রভার অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। মেয়েটা অনামিকার হাতটা চেপে ধরেই মায়ের সামনে নিজেও দাঁড়িয়ে আছে।

-এই বিধ্বস্ত চেহারার মেয়েকে দেখে তোমার কি মনে হয় মা? ও নিজে থেকে নাটক করছে সব? নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছে। ব্যথায় সেই দুপুর থেকেই জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল, সেটাও কি নাটক? এই যে ঘাড়ে দাঁতের স্পষ্ট তাজা দাগ বসে আছে, সেটাও কি সাজানো? সরি ভাইয়া, সরি ভাবি। আমি কালই দেখেছিলাম দাগটা। মাকে প্রমাণ না দিলে তো মা নিজের গুণধর সন্তানের কথাই বিশ্বাস করে বসে থাকবে----।

-প্রভা? এই মেয়ের সাথে খারাপ কিছু হয়েছে এটা বোঝাতে চাইছিস তো? বুঝলাম। কিন্তু তোদের কারো কাছে প্রমাণ আছে এই কাজ আমার রিশাদ করেছে? তোরা সবাই তো বলেছিলি লাঞ্চের জন্য বাইরে যাচ্ছিস। তাহলে এই মেয়ে যে রিশাদের নামে বানিয়ে বলছে না তার প্রমাণ কি?

-ভাবি মিথ্যে বলছে না, কারণ রিশাদ ভাইয়া কাল।রাতেও এই রুমে এসেছিল। ওর কাছে অরণ্য ভাইয়ার রুমের চাবি ছিল। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন ভাষায় কথা বলছিল ও। আর সেটাও ভাবির নাম ধরে।

-কি বলেছে বল? হয়তো--------।

প্রভার মা আরো কিছু বলার আগে এবারে অরণ্যও পাশ কাটিয়ে এসে অনামিকার পাশে এসে দাঁড়িয়ে হালকা করে অনামিকাকে জড়িয়ে ধরলো যাতে মেয়েটা ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পড়ে না যায়। অনামিকা এক নজর অরণ্যের দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকালো। প্রভারও মা ও এতোক্ষণ ধরে কটমট করে অনামিকাকেই দেখছে। যাতে সমস্ত দোষ অনামিকার, এটা উনি মেনেই নিয়েছেন।

-রিশাদরা বাইরে গিয়েছিল আন্টি। বাকি সবাই গিয়েছিল একসাথে। কিন্তু দুপুরে লাঞ্চ করতে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পর ওকে কেউ দেখেই নি কোন ফাঁকে সেখান থেকে চলে গেছে। তুমি অবশ্য বলতে পারো যে আর্জেন্ট কোনো কাজে গেছে হয়তো। হতে পারে। বাট ও আমাকে যা বলেছিল সেটার একটা কথাও সত্যি ছিল না। এখানে ওদের অফিসের কোনো ব্রাঞ্চ বা শাখা অফিস নেই। তাছাড়া পুলিশের লোকেরা এটা কনফার্ম করেছে যে সময় অনামিকার উপরে এ্যাটাকটা হয় তখন রিশাদের ফোনের লোকেশন এই এরিয়াতেই ছিল।

-কি!

-এখনই অবাক হয়ো না আন্টি। অফিসাররা আজকের মধ্যে সামনের ল্যাম্পপোস্টের সাথে লাগানো সিসিটিভি ফুটেজটার রেকর্ড চেক করে এটাও আইডেন্টিফাই করে ফেলবে রিশাদ ঠিক কয়টা বাজে এখানে বাড়িতে এসেছিল, কখন চোরের মতো বেরিয়ে গেছে। এন্ড নিজের সাফাইয়ে যতই নাটকীয় কাহিনীর অবতারণ করুক ও, কিছুতেই প্রমাণ করতে পারবে না যে ও কাল দুপুরে অন্য কোথাও ছিল। কেন বলো তো? কজ একজন মানুষ একই সময়ে দুই জায়গায় থাকতে পারে না। সব প্রুফই ওর বিরুদ্ধে। তবু যদি তোমার মনে হয় তোমার ছেলেকে ফাঁসানো হচ্ছে তাহলে সরি আন্টি। তোমাকে বোঝানোর মতো আর কোনো কিছু বলার নেই আমার।

-কিন্তু কিন্তু কিন্তু------।

প্রভার মা আর কিছু বলার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন উনার কাঁধে হাত রাখলেন। ভদ্রমহিলা কাঁপা স্বরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও মানুষটার দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।

-অনেক হয়েছে রিশাদের মা। ছেলের প্রতি এই অন্ধ বিশ্বাসের পরিণামটা দেখছ তো? মানছি সবাই নাহয় তোমার ছেলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তোমার নিজের মায়ের পেটের বোন, তার সন্তানেরা হিংসে থেকে করছে, এই মেয়েটা, ক মাস আগে নতুন বউ হয়ে এই বাড়িতে এসেছে, সেও নাহয় নিজের দোষ ঢাকতে এসব বলছে। কিন্তু তোমার মেয়ে? নিজের ভাইকে অপমান করে, এভাবে পুলিশের মার খাইয়ে কি প্রমাণ করবে ও বলো? রিশাদকে আর প্রভাকে তো কখনো আলাদা চোখে দেখ নি তুমি। না ছেলে বলে রিশাদকে বেশি যত্ন করেছ, আর না মেয়ে বলে।প্রভাকে কম দিয়েছ কোনোকিছু। তাহলে আজ যখন বিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে তাহলে কেন রিশাদের কথাটাই ধ্রুব সত্যি হিসেবেই মেনে নিচ্ছ? এতোগুলো মানুষের কি লাভ মিথ্যে বলে?

-কিন্তু আমাদের রিশাদ? ও এমন খারাপ কাজ করার ছেলেই না। 

-বাবা মা সবসময়ই ভাবে তার সন্তান একদম সোনার টুকরো, কোনো অন্যায় করতেই পারে না। আসলেই কি তাই রিশাদের মা? ওর এই অন্যায়ের দায় হয়তো আমাদেরও কিছুটা আছে। হয়তো সন্তানকে যে আদর্শে মানুষ করা দরকার তা করতে পারি নি। কি আর করবো বলো? এটাই আমাদের কপালে ছিল ভেবে নাহয় ফিরে যাই চলো? এক সন্তানের অন্যায়ের শাস্তি অন্য সন্তান যেন না পায় সেটাও তো দেখতে হবে আমাদেরকে বলো?

-কিন্তু রিশাদ? ও তো জেলে---- আমাদের অপেক্ষায় থাকবে ছেলেটা।

-থাকুক। অন্যায় করার পর যে অনুশোচনা করে তাকে ক্ষমা করা যায় রিশাদের মা। যে নিজের অন্যায়টাকেই ন্যায় বলে গলা উঁচিয়ে কথা বলার সাহস দেখায় তাকে ক্ষমা করার মানে হলো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া। সেটা তো আমি মরে গেলেও পারবো না। তাই কোনোদিন যদি রিশাদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে খাঁটি সোনা হয়ে ফিরতে পারে তবেই তাকে গ্রহণ করবো আমরা। এখন নাহয় নিজের কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করে মানুষ হোক।

-তাহলে রিশাদকে কি আমরা ছাড়াতে যাবো না? ছেলেটার কি অবস্থা দেখেছই তো-----।

-এই মেয়েটার দিকে একবার তাকাও রিশাদের মা। ওদের রুমের দিকে তাকাও। বিছানার পাশে পড়ে আছে পানি ভর্তি বালতি, বালিশে ভিজে দাগ পড়ে গেছে। একটা মেয়ে শুধু তোমার ছেলের বদনাম করবে বলে তো নিজের এই হাল করতে পারবে না তাই না? তুমি খেয়াল করেছিলে কিনা জানি না প্রভা ওর হাতটা ধরার সাথে সাথেই ব্যথায় মেয়েটার চোখে পানি চলে এসেছিল। সেটাও বলে নি একবারও মুখ ফুটে। ওর কথাগুলো নাহয় বিশ্বাস নাই করলে একবার মেয়েটার জায়গায় আমাদের প্রভাকে রেখে ভাবো তো? আজ আমাদের মেয়ের সাথে যদি এমনটা হতো তাহলে কি করতে তুমি? তোমার যদি এখনও নিজের ছেলের কথাতেই বিশ্বাস করে তাকে ছাড়িয়ে আনার ইচ্ছে থাকে তাহলে যেতে পারো, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরছি, এক্ষুণি। চল প্রভা?

রিশাদের বাবা কথাগুলো শেষ করেই প্রভাকে নিয়ে নিচের দিকে রওনা হলেন। তাইয়্যেবা জামান আর আরহান চৌধূরীও তাদেরকে আরো কয়েকটা দিন থেকে যেতে অনুরোধ করতে করতে নিচের দিকে চললো। বাকিরাও ধীরে ধীরে নিজেদের রুমে চলে গেছে। অরণ্য আর অনামিকার মুখোমুখি থ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেও ধীর পায়ে ড্রইংরুমে দিকে পা বাড়িয়েছেন রিশাদের মা। যাওয়ার সময় অনামিকার দিকে তাকিয়ে কয়েকটা কথাই বলেছেন ভদ্রমহিলা। কথাগুলো বলেই আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করেন নি উনি। অনামিকা আর অরণ্য দুজনেই থতমত খেয়ে নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একবার। কানে এখনো উনার কথাগুলোই বাজছে ওদের দুজনের।

-যদি সত্যিই আমার ছেলে তোমার সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করে তাহলে তার শাস্তি আমি নিজের হাতে ওকে দিবো। আর যদি ওকে বিনা কারণে ফাঁসানোর চেষ্টা কেউ করে তাহলে তার জীবন আমি তছনছ করে ছাড়বো। একজন মা তার সন্তানের অন্যায়ে যেমন শাসন করতে পারে, তেমনি তার সন্তানকে কিভাবে প্রোটেক্ট করার ক্ষমতা রাখে। একজন মা কতোটা কোমল, আর কতোটা কঠিন হতে পারে সেটাও আমি সবাইকে দেখিয়ে দিবো। শুধু আসল অপরাধী কে সেটা জানার অপেক্ষা।

২৬!! 

 দেখতে দেখতে আরো পাঁচটা দিন কেটে গেছে। পুরো বাড়িটায় আজ সাজো সাজো রব। কাজিনরা সবাই মিলে বাড়িটাকে ফুল দিয় সাজিয়েছে। সাথে হালকা লাইটিংয়েরও ব্যবস্থা আছে। কাজিনেরা টুকটাক কাজে অরণ্যকে হাতে হাতে হেল্প করে দিচ্ছে। অরণ্যের চোখ জোড়া না চাইতেও বারবার অনামিকার দিকেই চলে যাচ্ছে। মেয়েটা অল্প কয়দিনেই বেশ সুস্থ স্বাভাবিকই হয়ে গেছে বলা যায়। হাতে হালকা ব্যথা থাকলেও বাকি দাগগুলো, শরীরের যন্ত্রণা সবই প্রায় সেরে উঠেছে মেয়েটার। আর আজ স্নিগ্ধের বাবা মা আর বোন তাহিয়াকে দেখতে আসবে বলে অনামিকাও সবার সাথেই কাজে নেমে পড়েছে। মেয়েটা ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটিয়ে সবার সাথেই কাজ করছে দেখে অরণ্যের কাছেও শান্তি লাগছে। এই যে মেয়েটা ফারহার সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলতে বলতে ডাইনিং টেবিলটা গুছিয়ে রাখছে সেদিকেও কেন জানি বারবার চোখ চলে যাচ্ছে অরণ্যের। এমনটা কেন হয়? এই মেয়েটা আশেপাশে থাকলেই যেন মনে হয় অরণ্যের দুনিয়াটা থমকে গেছে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে পাশ থেকে কারো নিচু গলা খেঁকারির শব্দে ভ্রু কুঁচকে পাশে মানুষটার দিকে তাকালো অরণ্য। বজ্জাতগুলো বাগড়া দিতে চলে এসেছে এটা ভেবেই অরণ্যের ভ্রু জোড়া আরো খানিকটা বেঁকিয়ে গেল। এদিকে মূর্তিমানেরা দাঁত বের করে হাসছে অরণ্যের বিরক্তি ভাবটা দেখে।

-উহু উহু---। ভাইয়া, ভাবির দিকে এভাবে দূর থেকে তাকিয়ে না থেকে কাছে গিয়েও দেখতে পারো। আমরা মাইন্ড করবো না একটুও। বাট তার আগে ডেকোরেশনটা একটু চেক করে বলবে আর কিছু করা লাগবে কিনা? তারপর নাহয় তুমি ভাবিকে মন ভরে দেখো।

-তবে রে ফাজিলের দল! আমি আমার বউকে দেখছি তাতেও তোদের প্রবলেম? 

-না ভাইয়া। তোমার বউ, তুমি দেখবে, আমাদের তাতে প্রবলেম হবে কেন? আমরা তো শুধু বলছি ভাবিকে নাহয় দু মিনিট পরে দেখো? আগে চেক করো ডেকোরেশনটা ঠিক মতো হয়েছে কিনা। পরে তো আমাদেরকেই বকবা তুমি। 

-একটু বেশিই পাকামি করছিস না সিফাত? কাজ না করে আমার পিছনে লাগা হচ্ছে না? তোদের সবগুলোর আজ খবর নিচ্ছি আমি দাঁড়া।

-আহহহহ। অরণ্য ভাইয়া? লাগছে তো। ওহো ভাইয়া প্লিজ ছেড়ে দাও না কানটা? এভাবে কান টেনে লম্বা করলে শেষে ভাবির মতো সুন্দর দেখতে বউ পাবো কেমনে? নিজে তো সুন্দর একটা বউ জোগাড় করে নিয়েছ। এবার নিজের ভাইদের কথাটাও একবার ভাবো প্লিজ?

অরণ্য অনামিকাকে দেখার ফাঁকে সিফাত আর বাকিরাও দুষ্টুমি শুরু করেছে দেখে অরণ্যও সিফাতের কান টেনে ধরেছে। এই ছেলেগুলো এতো ফাজিল যে শাসন না করলে বাঁদরামি করতেই থাকবে। আর লেগ পুলিং তো আছেই।

-বাচ্চা ছেলে এখন বউ চায় না? চাচা চাচিকে বলে ব্যবস্থা করছি তোর বিয়ের দাঁড়া না। তারপর দেখবো আমরাও তুমি কি করো বাছাধন।

-আহ! অরণ্য ভাইয়া? ছাড়ো না? ব্যথা লাগছে তো। বাবাকে বলে লাভ কি? নির্ঘাত ঘোমড়ামুখী কাউকে ধরে এনে বলবে বিয়ে কর। না বাবা। আমি তো ভাবির মতো সুন্দর দেখে কাউকে বিয়ে করবো। উফ! কি সুন্দর হাসি ভাবির! একদম ক্রাশ খেয়েছি। ভাবির যে কেন একটা ছোটো বোন নেই। ধুর!

-ওরে বজ্জাত ছেলে! আমার বউয়ের উপরে ক্রাশ খাচ্ছিস! আবার আমার সামনে সেটা গলা উঁচিয়ে বলছিস? তোকে তো আজকে আমি সিয়াম-----।

-আরে  ভাইয়া? মারো কেন? ভাবি দেখছে তো? ছি ছি ছি! কি ভাবছে অনুভাবি! ধুর ভাইয়া! পুরো প্রেসটিজ পানচার করে দিলা তো?

-অসভ্য ছেলে! আমার বউয়ের দিকে নজর দেয়া নিষেধ। একেবারে খুন করে ফেলবো বলে দিলাম। 

-ছি ছি অরণ্য ভাই! আমি তোমার ছোটো ভাই হই! সেটাও ভুলে গেছ নাকি? আমি তো মজা করছিলাম তোমার সাথে। ভাবি তো আমার বড় বোনের মতো। ছি ছি! তুমি এতো খারাপ ভাবো নাকি আমাকে?

-জুনিয়র সিনিয়র, বড় ছোটো এসব কিছু আমার দেখার দরকার নেই। আমার বউয়ের দিকে তাকালেও চোখ খুলে নিবো। সেটা তুই হস, বা অনুর ওই সাহিল।

-হুম? কি? এই সাহিলটা আবার কে অরণ্য ভাইয়া? অবশ্য ভাবি যত কিউট দু একজন প্রণয়অভিলাষী থাকবে এটা কোনো ব্যাপারই না। তুমি এতো রাগ করো না ভাইয়া ওকে? আমি ভাবির উপরে ছোটো ভাইয়ের দৃষ্টিতে ক্রাশ খেয়েছি। আর তুমি ব্যাপারটা কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছ? এটা করতে পারলে ভাইয়া? ছি ছি ছি! এতো সুন্দর ভাবির কপালে কিনা শেষে এমন সন্দেহবাতিক জামাই! এটা একদমই ঠিক হলো না ভাবির সাথে। আই রিয়েলি ফিল সরি ফর হার। না না ভাইয়া। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে সাপোর্ট করতে পারলাম না। সরি। ভাবিও তো চলে গেছে, ধ্যাত।

-সিফাত! তোকে কিন্তু আজকে ছাড়বো না বলে দিলাম। আমার লেগপুল করার চেষ্টা করছিস? তোর সাহস বেড়েছে না খুব?

-এই এই এই অরণ্য ভাইয়া। গেস্টরা চলে এসেছে। ছাড়ো ছাড়ো। ডেকোরেশন তো দেখলেই না তুমি। আমার কি! পচা হলে তাহিয়া আপু ধরবে তোমাকে। এই সবাই পালা পালা গেস্টরা চলে এসেছে। 

    

অরণ্যের হাত ফসকে সিফাত পালানোর সাথে সাথে বাকিরাও ছুটছে দেখে অরণ্য পিছন ফিরতেই স্নিগ্ধের বাবা মায়ের সাথে স্নিগ্ধ আর শান্তাকেও আসতে দেখে নিজেই মেইন ডোরের দিকে এগিয়ে উনাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেল। ততক্ষণ অনামিকা আর ফারহাও পগার পার হয়েছে। স্নিগ্ধের বাবা মা ড্রইংরুমের সোফায় গিয়ে বসতেই তাইয়্যেবা জামান আর আরহান চৌধূরীও তাদের সাথে যোগ দিলেন। অনামিকা আর ফারহার সাথে হাতে হাতে নাস্তার ট্রে ভর্তি খাবারগুলো এগিয়ে দিয়ে হেল্প করছিল অরণ্যের কাজিনের। নাস্তা পর্ব শেষ হলে তাহিয়াকেও ড্রইংরুমে নিয়ে আসলো ফারহা আর অনামিকা মিলে। মেয়েটা কাঁপাকাঁপা হাতে চায়ের ট্রেটা টি-টেবিলের উপরে রেখে সবাইকে এক কাপ করে চা এগিয়ে দিয়ে একটা সোফায় গিয়ে বসে রীতিমতো দপদপ করে ঘামছে। আর কেউ ব্যাপারটা খেয়াল না করলেও অনামিকা তাহিয়ার অবস্থাটা বেশ ভালোই অনুভব করতে পারলো। অনামিকার বেলায় পরিস্থিতিটা কিছুটা আলাদা হলেও এই অনুভূতিটার সাথে অনামিকা বেশ ভালো করেই পরিচিত। তাহিয়ার বেলাতেও হয়তো পরিস্থিতিটা আলাদা। কিন্তু এই যে একটা নতুন বন্ধন তৈরি হওয়ার প্রথম পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মূহুর্তটা! হয়তো সব মেয়ের জীবনেই, যে কোনো পরিস্থিতিতেই অনুভূতিটা সম্পূর্ণ আলাদা, একটা নিরব শিহরণ জাগানো। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অনামিকা তাহিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে একটু নিচু গলায় কিছু একটা ফিসফস করে বলে হালকা হাসলো। 

-ভয় নেই গো আদরের ননদিনী। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। সবসময় তোমার ভালোয়, মন্দয়, হাসিতে, কান্নায়, বিপদে, আনন্দে, সবসময়।

অনামিকার কথাগুলোয় তাহিয়ার ঠোঁটের কোণে স্বস্তির একটা হাসির রেখা ফুটে উঠতেই অনামিকাও মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আর অনামিকার দিকে আরেকবার মুগ্ধ হয়ে তাকালো অরণ্য। 

-আমাদের তো গত সপ্তাহে আসার কথা ছিল। স্নিগ্ধের কাছে শুনলাম আমাদের বউমা অসুস্থ ছিল। তাই আজই আসলাম।

-আরে ভাইসাহেব, আপনারা যে ব্যাপারটা মেনে নিয়ে সময় বের করেছেন সেটার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

-আরে বেয়াইসাহেব, এবার থেকে বেয়াই ডাকার অভ্যেসটা করে ফেলুন। আজই কিন্তু আমরা এঙ্গেজমেন্টটা সেরে ফেলবো। বিয়ের ডেইটটাও ফিক্সজড করে তবেই বাড়ি ফিরবো। 

-হা হা হা। তাহলে সেটাই হোক। আপনাদের মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করে নিতে পারেন। পরে কিন্তু মেয়ে এটা পারে না, ওটা পারে না বললে চলবে না। মেয়ে আমাদের গ্লাসে পানি ঢেলেও খায়নি কখনো। মা বাবার যেমন আদরের তেমনি ভাই আর ভাবিরও আদরের ছোটো বোন আমাদের তাহিয়া। তাই বাড়ির কাজগুলো আপনাদেরকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিজেদের মতো করে গড়ে পিঠে নিতে হবে আপনাদেরকেই। এইটুকু কষ্ট করতে পারলে মেয়ে দিতে আমাদের আপত্তি নেই।

-আরে নিজেদের মেয়েকে আরেকজনের বাড়িতে পাঠানোর পর নিজেও কষ্টটা বুঝি ভালো করেই। এক মেয়েকে আরেকজনের ঘরে পাঠিয়ে এবার নাহয় ছেলের বউকে মেয়ে হিসেবে বাড়ি নিয়ে যাবো। এবার কি পাকা কথাটা শুরু করা যায় বেয়াই সাহেব?

-বেশ বেশ! আমরা কথা বার্তা শুরু করি। ছেলে মেয়েরা ততক্ষণ নিজেরা কিছুক্ষণ কথা বলে নিক? কি বলেন বেয়াই সাহেব?

-তা তো বটেই। বিয়ের ডেইটটা না হয় ওদের জন্য সারপ্রাইজই থাক? কি বলেন? হা হা হা। যাও যাও স্নিগ্ধ তাহিয়ার সাথে একটু কথা বলে নিজেদের মান অভিমানটা মিটিয়ে নাও। যাওয়ার সময় এই গুমড়ো মুখটা যেন না দেখতে হয়। হা হা। আমাদের চেয়ে এই ছেলেরই বিয়ে নিয়ে টেনশন বোধহয় দ্বিগুণ বেশি। হা হা হা। 

স্নিগ্ধের বাবার এমন কথায় বাকিরা শব্দ করেই হেসে ফেললো। স্নিগ্ধ একটু লজ্জা পেয়ে উশখুশ করছে দেখে অরণ্য আর কাজিনরা সবাই আরেকবার হো হো করে হাসতে শুরু করেছে। অরণ্য একবার চোখের ইশারায় অনামিকাকে তাহিয়াকে নিয়ে ভিতরে যাওয়ার ইঙ্গিত করতেই অনামিকা টুকটুকে লাল ভারি শাড়িতে জড়ানো তাহিয়াকে নিয়ে ধীর পায়ে ড্রইংরুম থেকে তাহিয়ার রুমের দিকেই পা বাড়ালো। হাসাহাসির ফাঁকে অরণ্যও এক ফাঁকে স্নিগ্ধকে নিয়ে এসে তাহিয়ার রুমে মোটামুটি ঠেলে দিয়ে হাসতে হাসতে রুমের দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিয়েছে। অনামিকা আগেই বেরিয়ে এসেছিল রুম থেকে। এবারে অরণ্য একবার অনামিকার দিকে তাকিয়ে একটু শব্দ করেই বললো কথাগুলো।

-আপাতত বিয়ের কথাবার্তা পাকা হতে হতে নিজেদের যত মান অভিমান মিটিয়ে নাও। আগামী মাসের আগে বিয়ের ডেইট যাতে না দেয়া হয় সেটা সামলানোর দায়িত্ব আমার। রুমের ভিতরে মারামারি না করে ভাব ভালোবাসা করে নাও। আর একই দিনে দ্বিতীয় বার বিয়ে করার জন্য যা যা প্ল্যানিং করার করে ফেলো। ঘন্টাখানেক আমরা কেউ বিরক্ত করতে আসবো না। ওকে বায়। এন্ড বেস্ট অফ লাক স্নিগ্ধ। যুদ্ধ জিতেই ফিরো, এই দোয়া রইলো ভাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন