ভোরের রোদ - পর্ব ০৪ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


০৭!! 

-তার মানে রোদ তুই বলতে চাইছিস মেয়েটা তোর কাছে ছুটে এসেছিল আর তুই একবারের জন্যও দরজাটা খুলিস নি? উল্টো এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলি?

রোদ মুখটা কাচুমাচু করে মাথা নেড়ে সায় দিতেই ওর সামনে বসে থাকা মানুষটা হঠাৎই হা হা করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ার দশা লোকটার। রোদ এবারে ভ্রু কুঁচকে বন্ধুর এমন অট্টহাসির পিছনের তাচ্ছিল্যটা বোঝার চেষ্টা করলো। সামনে বসা লোকটা কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক করে রোদের সামনে বসলো। অনেক চেষ্টা করেও দু তিন মিনিটের বেশি হাসি চাপতে পারলো না বেচারা। আবার হাসতে হাসতেই বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো ছেলেটা। রোদ এবারে চোয়াল শক্ত করে বন্ধুর মুখের দিকে তাকালো। ছেলেটা এমনভাবে হাসছে যে মনে হচ্ছে রোদ ওকে হাস্যকর কোনো কথা শুনিয়েছে। এতো হাসির কি হলো সেটা ভেবেই রাগে চোখ জোড়া লাল হতে শুরু করেছে রোদের।

-মেঘ? তুই থামবি? এমনভাবে হাসছিস যেন আমি তোকে কোনো জোকস শুনিয়েছি? তোকে আমি নিজের সমস্যার কথা শেয়ার করতে এলাম আর তুই কিনা? ধুস শালার! তোর বাসায় আসাই আমার ভুল হইসে। গেলাম আমি---।

রোদ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বিছানা ছেড়ে উঠে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করেছে দেখে মেঘও তাড়াহুড়ো করে উঠে রোদকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো। রোদ রাগে লাল হয়ে চুপচাপ বসে রয়েছে দেখে মেঘও এবার রোদের পাশে বসলো।

-এটাই হলো তোর সবচেয়ে বড় সমস্যা রোদ। কিছু হয়েছে কি হয়নি ওমনি তোর মাথা গরম হয়ে যায়, রেগে বেরিয়ে যাস বাসা থেকে। 

-আমি মোটেও রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে আসি নি।

-ওহ আচ্ছা? তাই নাকি? তা আজকের কথাই ধরি তাহলে। সকালে তো ভিষণ খুশি ছিলি। ভোরকে দেখবি এতোদিন পর। আমি দু মিনিট মেয়েটার দিকে তাকিয়েছি সেটাই তুই নিতে পারিস নি। ধমক দিয়ে ওকে রুমে পাঠালি। মেয়েটা নাস্তাটুকুও শেষ করে নি তখনো। তারপর তো পিছন পিছন ওর রুমেও গেলি। তা কি করলি? 

-মেঘ?

-লেট মি গেস। এবার কয়টা মেরেছিস? একটা? উম! নাকি আরো বেশি?

-মেঘ!

-পরে নিশ্চয়ই তোর নিজের কাছেই খারাপ লেগেছে। তাই না রোদ? কিন্তু ততক্ষণে ভোরকে তো তোর রাগটা সহ্য করতে হয়েছে। তুই আমার ব্যাপারে সবটা জানিস রোদ, আর আমিও বলতে গেলে তোর লাইফের প্রায় প্রত্যেকটা ঘটনা জানি, তোর আর ভোরের গল্পটাও জানি। তবু তুই রাগটা সামলাতে পারলি না। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কি করতি তাহলে ভাবতে পারছিস? আজ বাদে কাল তো ভোর কলেজে উঠবে। নতুন বন্ধু বান্ধব হবে এটাই স্বাভাবিক। তখন কি হবে ভাবতে পারছিস রোদ? এভাবে হুটহাট রাগ সামলাতে না পারলে তোদের মধ্যে যে একটা দূরত্ব তৈরি হবে সেটা ভাবতে পারছিস? এখনও ছোটো মানুষ বলে তোর শাসনগুলোকে ভালোবেসে মাথা পেতে নিচ্ছে। কিন্তু যত দিন যাবে ও সবটা বুঝতে শিখবে রোদ। এটাও বুঝবে তুই ওকে কেমন করে বন্দী করে রাখতে চাইছিস। সেটা যদি ভোর না মানে তখন? তখন কি করবি তুই? আবার হাত তুলবি ওর গায়ে?

-মেঘ! কি যা তা বলছিস তুই এসব? 

-শোন রোদ। এই রাগের কারণেই সমস্ত বন্ধুদের হারিয়েছিস। তোর জীবনে বন্ধু বলতে একমাত্র আমিই আছি। আজীবন তোর পাশে থাকব কথা দিচ্ছি। শুধু একবার তুই নিজে ভেবে দেখ ব্যাপারটা। যে রাগ তোর থেকে প্রিয় মানুষগুলোকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, সেই রাগটা যদি তোর ভালোবাসাকেও কেড়ে নেয়! বাঁচতে পারবি তুই তোর ভোরকে ছাড়া?

-মেঘ! ভোরকে ছাড়া আমি মরে যাবো। এসব বলিস না ভাই প্লিজ।

-শোন রোদ। তুই আসছিস দেখেই সকালে আমি ভোরের দিকে তাকিয়েছিলাম, ইচ্ছে করেই তোর সামনে ভোরের প্রশংসা করেছিলাম আমি। তুই কি করিস দেখার জন্য। 

-সরি মেঘ।

-আমাকে সরি বলছিস কেন? আমাকে মোটামুটি রকমের ঘাড় ধাক্কা দিয়েছিস বলে? নাকি বাসা থেকে কাজ আছে বলে বেরিয়ে আমাকে রেখেই বাসায় গিয়ে ডুব দিলি বলে? অবশ্য কেন করেছিস কাজগুলো জানি। আর জানি বলেই রাগ করি নি আমি। কিন্তু ভালোবাসায় কেয়ার থাকা ভালো হলেও এতোটা প্রজেসিভ হলে তো ঝামেলা রোদ। এই সামান্য কথাটা কবে বুঝবি তুই?

-সরি মেঘ! ভোরের দিকে কেউ তাকালেও আমার মাথা ঠিক থাকে না। আমি--আমি ওকে হারাতে চাই না বিশ্বাস কর।

-কয়দিন রোদ? কয়দিন এভাবে রাগ দেখিয়ে ধরে রাখতে পারবি বল? এভাবে চললে একদিন ভোরও তোকে ছেড়ে চলে যাবে। মিলিয়ে নিস তুই আমার কথাটা।

-নাহ! আমার ভোর কোথাও যাবে না আমাকে ছেড়ে। কোথাও না। না ও যাবে। আর না ওকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো। 

রোদ এবারে কেমন একটা ভয় পেয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াতেই মেঘ আবার রোদকে আটকালো। রোদ কাতর চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে মেঘের একটা হাত চেপে ধরলো।

-মেঘ তুই আমাকে বল আমি কি করবো? আমি ভোরকে ছেড়ে এতোদূরে কিছুতেই যেতে পারবো না। এর চেয়ে আমি ভোরকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবো। হ্যাঁ। আমি ভোরকে নিয়ে পালিয়ে যাবো। প্রয়োজন হলে কুলিগিরি করবো, কাঠ কাটবো----।

-রোদ! তুই পাগল হয়ে গেছিস? 

-হ্যাঁ হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। কেউ আমাকে আমার ভোরের থেকে আলাদা করতে পারবে না। কেউ না। বাবাও না। তুইও না। আমি আজই চলে যাবো।

-রোদ! শান্ত হয়ে বস তুই আগে। এবার বল। আঙ্কেল তোকে কেন ভোরের থেকে আলাদা করবে বল? তোর বাসার সবাই জানে তুই ভোরকে ঠিক কতোটা ভালোবাসিস। তাই না? 

-আমি জানি না এতো কিছু। বাবা চায় না আমি ভোরের পাশে থাকি। নইলে বল ভোরের পরীক্ষা নেক্সট মান্থে। বাবা কি করে পারলো আমাকে এভাবে শাস্তি দিতে?

-কি করেছে আঙ্কেল? আরে বোকা! আড়াই বছরেরই তে ব্যাপার। তুই আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটি থেকে এম বি এ কমপ্লিট করবি, সেখানে ব্যবসা সামলাবি। এদিকে ভোরও ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে দিবে। তারপর তো আর বাধা দিবে না কেউ। এখন তো চাইলেও তুই ভোরকে বিয়ে করতে পারবি না।

-তুই বুঝতে পারছিস না। আমি জানি বাবা চায় না আমি ভোরকে বিয়ে করি। বাবা কিছুতেই ভোরকে আমার হাতে তুলে দিবে না। আমি জানি।

-রোদ! কিসব বলছিস?

-জানিস বাবা কি বলেছে? বলেছে আমি নাকি ভোরের পড়ায় ডিস্টার্ব করছি। আমি থাকলে ভোর নাকি পড়া কন্টিনিউই করতে পারবে না। এটা কোনো কথা বল?

-কথাটা ভুলও তো না। এর আগেও কম করে হলেও আট দশটা প্রাইভেট টিউটর বদলেছিস তুই। আর স্কুল, কোচিং এসব কথা নাই বা বলি।

-আমি ওকে সবসময় সেইফ রাখতে চাই মেঘ। তোরা বুঝতে পারিস না সেটা?

-ওকে। বুঝলাম। এবার তাসমিদ সাহেব যিনি লাস্ট ভোরকে পড়াচ্ছিল তাকে ভাগালি কেন? বল শুনি।

-ওই লোকের সাহস হয় কি করে আমার ভোরের গায়ে হাত তোলার? জানিস ওই লোকটা ভোরকে স্টিলের স্কেল দিয়ে--।

-উনি ভোরের টিচার রোদ।

-টিচার হোক আর যাই হোক। লোকটা ভালো না। এর আগেও আমি কয়েকবার লক্ষ্য করেছি লোকটা ইচ্ছে করেই ভোরকে-----।

-রোদ? আমিও আঙ্কেলের সাথে একমত। তোর আসলেই কিছুদিন ভোরের থেকে দূরে থাকা উচিত। 

-তোরা সবাই আমার শত্রু। সবাই। তুইও। তোদের কাউকে চাই না আমি। আমি আমার ভোরকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবো। যেখানে কেউ আমাদেরকে খুঁজে পাবে না।

-রোদ? তুই আমার কথাটা শোন? ভোরের উপরে রাগ করে চলে এলি আমার বাসায়। কেন এতো রাগ করলি বল তো?

-বাবার সাথে আমার একটা ডিল হয়েছে মেঘ। 

-ডিল? কিসের?

-কয়েকদিন আগে বাবা আমাকে কিছু পেপার ধরিয়ে দিয়ে বললো আমাকে নেদারল্যান্ডে চলে যেতে হবে। যেন আমার কারণে ভোরের বা ভোরের পড়ালেখার কোনো ক্ষতি না হয়। যদি এই আড়াই বছর আমি ভোরের থেকে দূরে থাকি তাহলেই বাবা ভোরকে আমার হাতে তুলে দিবে। নইলে কখনো আমি ভোরকে পাবো না। 

-কি বলিস!

-বাবার শর্তের আরেকটা অপশনও ছিল। বিদেশে না গেলে আমি পুরো একটা বছর ভোরের সামনেও আসতে পারবো না। দেশে থাকলেও ভোরের জীবনে থাকতে পারবো না। আমি প্রথমে ভাবলাম এই ভালো। দেশে থেকে দূর থেকে হলেও অন্তত ভোরকে চোখের দেখাটা তো দেখতে পাবো। কিন্তু-----।

-কিন্তু কি? একটু নিজেকে সামলে থাকবি। একটা বছরেরই তো ব্যাপার।

-শুধু একটা বছরের ব্যাপার না মেঘ। বাবা বলে দিয়েছে এই এক বছরের মধ্যে আমি ভুলেও যদি ভোরের সাথে কোনো যোগাযোগ করি বা ভোরের সামনেও আসি তাহলে বাবা ভোরকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিবে। আর তাও পাঁচ বছরের জন্য। 

-হোয়াট!

-ভোরের উপরে রাগ কেন জানতে চাইছিলি না? বাবা বলে দিয়েছে আমাকে এসবের কিছুই করতে হবে না যদি ভোর না চায় আমি যাই। মানে ওকে নিজের মুখে বাবাকে বলতে হবে ও চায় না আমি আমস্টারডামে যাই। আর এই মেয়ে কি করলো? তা একটা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না জানিস?

-এটা কিন্তু তোর বাড়াবাড়ি রোদ। ছোট একটা মেয়ে। ও জানতোই না তুই চলে যাবি। হঠাৎ কথাটা শুনে তাই--------।

-কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে এখন মেঘ। কিন্তু কি করে যাবো আমি বল তো? ওকে একা এসবের মধ্যে ফেলে? তার উপরে ওর সামনের মাসে পরীক্ষা মেঘ। এখন পর্যন্ত এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেদিন আমি ভোরের সাথে-----।

-মাথা ঠান্ডা কর রোদ। ভোরের উপরে রাগ করে কি শান্তি পাচ্ছিস বল? না তো। এর চেয়ে ওর সাথেই ঠান্ডা মাথায় কথাগুলো শেয়ার কর। আর আমার মতামত যদি চাস তাহলে বলবো তুই যা। দু-আড়াই বছর বেশি কিছু না। আর দূরে থাকলে ভালোবাসাটা আরো গভীরভাবে অনুভব করতে পারবি। যেমনটা আমি অনুভব করছি।

-আমি যাই মেঘ। পরে কথা বলবো।

-রোদ?

রোদ আর কিছু না বলে মেঘের বাসা থেকে বেরিয়ে ভোরদের বাসার দিকে রওনা হলো। আসলেই ভোরকে এভাবে কথাগুলো বলে শান্তি লাগছে না রোদের। মেয়েটা তো আসলেই এসবের কিছুই জানতো না। তাহলে ওর উপরে রাগ দেখিয়ে লাভ কি? এর চেয়ে অন্য কোনো প্ল্যান করতে হবে রোদের। যাতে রোদেরও আমস্টারডামে যাওয়া না লাগে, আর ভোরও নিজের মনের কথা সবাইকে বলার সাহস পায়। কিন্তু কি প্ল্যান করবে!

এদিকে রোদের কথাগুলো শুনে বিছানায় পড়ে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ভোর নিজেও জানে না। ঘুম ভাঙতেই টের পেল সন্ধ্যা হয়েছে বেশ অনেকক্ষণ আগেই। ভোর একটু অবাকই হলো। ভোর এতোক্ষণ ঘুমাচ্ছে আর রোদ ওকে একবারও জাগাতে আসে নি? নাকি এসে চলে গেছে? শেষমেশ সাহস করে রোদের রুমে উঁকি দিয়ে খালি রুমটা দেখে একটু মন খারাপ হয়ে গেল ভোরের। নিচে এসে মা আর বড়মাকে রান্নাঘরে কাজ করতে দেখে সেখানেও একটু ঘুরঘুর করলো মেয়েটা। সেখানেও ভোরকে না পেয়ে আবার নিজের রুমেই ফিরে এলো ভোর। রোদ রাগ করে চলে গেছে ভাবতেই কান্না পেল ভোরের। কি করে রোদের রাগ ভাঙাবে আর কি করে তার যাওয়া আটকাবে সেটা ভাবতেই চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো ভোরের। চোখের কোণে জমা অশ্রুবিন্দুগুলোর শুধু ঝড়ার অপেক্ষা এবার।

০৮!! 

-রোদ ভাইয়া! যেও না প্লিজ? প্লিজ যেও না---।

গলা দিয়ে অস্ফুটস্বরে গোঙ্গানি বের হতেই ভোর ধড়ফড় করে উঠে বসে চোখ মেলে তাকালো। নিজেকে পড়ার টেবিলে আবিষ্কার করতেই বুঝতে পারলো এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো। স্বপ্নটা মনে পড়তেই হাত পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসতে চাইছে ভোরের। এটা কেমন স্বপ্ন ছিল! কোনো এক অচেনা শহরের গলি দিয়ে রোদ হেঁটে যাচ্ছে। ভোরের ঠিক সামনেই রোদ। অথচ ভোর হাজার ছুটেও রোদের নাগাল পাচ্ছে না। আর না ভোরের গলা ফাটানো চিৎকার রোদের কানে পৌঁছাচ্ছে। প্রতি সেকেন্ডেই যেন রোদ ভোরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এতোটা দূরে যে সেখানে ভোরের কোনো অস্তিত্বই নেই। এতোক্ষণে ভোর টের পেল ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নামার পরও বেশ অনেকক্ষণ ভোর ড্রইংরুমে ঘুরঘুর করেছে। না রোদ এসেছে, না মা বা বড়আম্মু কেউ কিছু বলেছে। শেষে বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে এসেই পায়চারি করেছে ভোর। একসময় ক্লান্ত হয়ে টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত কত হলো কে জানে!

-ভোর? দরজা খোল? এই ভোর? ঘুমিয়ে গেছিস? এই ভোরপাখি?

হঠাৎ দরজায় টোকা আর নিচুকণ্ঠে কারো ডাক শুনে ভোর পড়ি কি মরি করে ছুটে এসে দরজা খুলে দিলো। রুমের সামনে রোদকে দেখে আর কান্না আটকাতে পারলো না মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতেই রোদের বুকে এসে পড়লো। রোদও তাড়াহুড়ো করে এক হাত দিয়ে ভোরকে হালকা করে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। 

-আরে? পাগলিটা কাঁদছিস কেন এভাবে? এই ভোর? তাকা না আমার দিকে? ভোর?

-তুমি--তুমি কোথায় চলে গেছিলে রোদ ভাইয়া? আমার উপরে রাগ হলে বকো, মারো। কিন্তু প্লিজ এভাবে----।

-ভোর? শান্ত হ না বাবা। আর এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদিস না প্লিজ। তোর বড় আব্বু এসে দেখলে বলবে আমি তোকে খুন করতে এসেছি। 

-কিসব বলছ? 

-এখন সর তো। রুমে আসতে দে। আর এই মেয়ে? তোর সাহস তো কম না আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিস! 

-সরি।

-তোর সরির হিসেব পরে হবে। রুমে আসতে দিবি নাকি চলে যাবো?

-না না না। এসো না? একি তোমার হাতে কিসের প্লেট?

ভোর ফোঁপাতে ফোঁপাতে রোদের কাছ থেকে সরে এসে একটু অবাকই হলো। রোদের হাতে একটা প্লেট দেখে। রোদ ভোরের কৌতূহলী দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে রুমে এসে বিছানায় বসে রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। ভোরও গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে রোদের পাশে এসে বসেছে। এবারে রোদ প্লেটের ভাত মাখিয়ে এক লোকমা ভোরের মুখের সামনে ধরতেই ভোর থতমত খেয়ে রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। 

-কি হলো হা কর? আমাকে দেখার জন্য সারাটা রাত পড়ে আছে। এখন আপাতত খেয়ে নে পেট ভরে। একটু পরে শাস্তি ভোগ করতে এনার্জি লাগবে তো।

-কি?

-খেতে বলছি না তোকে? তোকে না বলেছিলাম না রাতে না খেয়ে কখনো ঘুমাবি না? আমার কথা কি শুনবি না বলে পণ করেছিস ভোর?

-না মানে--আমি তো পড়ছিলাম------।

-পড়ছিলি? নাকি ঘুমাচ্ছিলি? গাধা মনে হয় আমাকে তোর?

-সরি---। ঘুম এসে গেছিল---।

-হুম সে তো আসবেই। আমি বাসায় নেই ওমনি তোমার ফাঁকিবাজি শুরু না? 

রোদ ভোরকে খাইয়ে দিতে দিতে ভোরের কান্নায় সিক্ত মুখটা দেখছে। ভোর ভয়ের চোটে কোনোমতে রোদের দেয়া খাবারটুকু গিলে ফেলছে। সেটাও রোদের চোখ এড়ালো না। 

-আর এই ভোর? আজ দরজা বন্ধ করলি কেন? তুই জানতি না আমি আসবো যে? সকালেই তো বলেছিলাম আজ থাকবো। তবু----। তার মানে আমি কি ধরে নিবো তুই চাস না আমি তোর রুমে আসি?

-আমি কি করলাম? তুমিই তো সকালে বললে রাতে রুমের দরজা যেন খোলা না থাকে। আমি কি করবো? 

রোদ আর কিছু না বলে চুপচাপ ভোরকে খাইয়ে দিয়ে ভোরের মুখ মুছিয়ে দিলো। তারপর প্লেটটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ভোর রোদের শার্টটা খামচে ধরে আটকালো। রোদ একটু হেসে ভোরের দিকে ফিরলো।

-কি রে? কি হলো?

-তুমি কোথায় যাচ্ছ? যেও না প্লিজ?

-আরে পাগলি মেয়ে। আমি প্লেটটা কিচেনে রেখে আসতে যাচ্ছি। একটু পরে আবার আসবো তো--।

-না তুমি যাবা না একদম। প্লেট আমাকে দাও। আমি রেখে আসি। না রেখে আসা লাগবে না। এখানেই থাক। সকালে রেখে আসলেও হবে----।

-এটা কেমন কথা ভোর? একটা এঁটো প্লেট সারারাত তোর রুমে থাকবে? ছি ছি! দিন দিন কেমন খবিশ হয়ে যাচ্ছিস তুই? 

-আমি এতো কিছু জানি না। তুমি যাবা না কোথাও।

-আমি না গেলে আমার সামনে চেইঞ্জ করতে পারবি? লজ্জা করবে না তোর?

-কি? চেইঞ্জ করবো কেন?

-আমি বলেছি তাই। চুপচাপ আমার রুমে চলে যা। বিছানার উপরে একটা প্যাকেট রাখা আছে তোর জন্য। গুনে গুনে বিশ মিনিট সময় পাবি। বিশ মিনিট পর ঠিক যে অবস্থায় থাকবি সেই অবস্থাতেই তোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বো মনে রাখিস। এখন কোন রুমে চেইঞ্জ করবি সেটা তোর ব্যাপার। 

-বেরিয়ে পড়বা মানে? কোথায় যাবো আমরা?

-অতিরিক্ত প্রশ্ন না করে আমার রুমে যা। আমি ড্রইংরুমে আছি। 

-উম। আচ্ছা। 

রোদ প্লেট নিয়ে বের হয়ে যেতেই ভোরও পা টিপে টিপে রোদের রুমের দিকে এগোলো। রোদের কথামতো একটা শপিংব্যাগও পেয়ে গেল বিছানার উপরেই। আর ব্যাগটা খুলেই ভোর হা করেই তাকিয়ে রইলো কয়েক মিনিট। প্যাকেটে একটা লাল জর্জেটের শাড়ি, সাথে ব্লাউজ, পেটিকোট, চুড়ি, কাজল, টিপ এসব রাখা। একটা একটা করে জিনিস হাতে ধরে দেখছে ভোর। অন্যরকম একটা ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছে ভোরের। অনুভূতিটা কেমন সেটা হয়তো ভোর নিজেও জানে না। একটা একটা করে জিনিস বের করা শেষ হলে ছোট্ট একটা চিরকুটও পেল ভোর। আর চিরকুটের ছোট্ট দুটো লাইন দেখেই ভোরের এতোক্ষণের ঘোরটা কাটলো। বিশ মিনিট সময় দিয়েছে রোদ সেটা তো ভুলেই গেছিল ও। আরেকবার চিরকুটটা পড়ে হেসে ফেললো ভোর। রোদ কি করে ভোরের মনের কথাগুলোও টের পেয়ে যায় কে জানে! ভোর এসব ভাবতে ভাবতে মিটিমিটি হাসতে হাসতে শাড়ি পড়ায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো। শাড়ি পড়ার ফাঁকেই বারবার ভোরের চোখ চলে যাচ্ছে রোদের চিরকুটটার দিকে। গোটা গোটা অক্ষরে দুটো মাত্র লাইন লেখা। অথচ এই দুটো লাইনেই যেন রোদ ভোরের একটু আগের ঘোর লাগা বাস্তবতাটুকুকে আগে থেকেই জেনে সতর্ক করে দিয়েছে। যেন ভোরকে ওর রোদের চেয়ে বেশি কেউ চিনে না, কেউ না। ভোর নিজের মনেই বিড়বিড় করে লাইন দুটো পড়লো।

"এভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে চটপট রেডি হয়ে নে ভোর। আমি এসে রেডি করিয়ে দিতে হলে কিন্তু আজকে তোর রক্ষে নেই বলে দিলাম।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন