নিহির চলে যাওয়া দেখছে আমান। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না কিছু বলতে পারছে আর না কিছু উপলব্ধি করতে পারছে। শুধু মনের মাঝে গেঁথে আছে নিহির ভালোবাসার পরশ। নিহি জানালার পাশে বসেছে। বাস ছাড়ার মুহুর্তে হাত নাড়িয়ে বাড়ির সবাই ও আমানকে টাটা দেয়। আমান যেন ঘোর থেকে বেরই হতে পারছে না। তিতির দৌঁড়ে আমানের কাছে যায়। আমানের হাত টেনে বলে,
"এই তুমি আমার পঁচা ছেলে। ফুপি টাটা দিচ্ছে। তুমি দিচ্ছ না কেন?"
আমানের হুশ ফিরে। বাস অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নিহি জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে। আমান এবার হাত নাড়িয়ে বিদায় দেয়। চোখের পলকে আস্তে আস্তে করে বাসটি দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। নিহি সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে। নিজাম ইসলামের দিকে তাকিয়ে দেখে পত্রিকা পড়ছেন। মানুষটা পারেও বটে! বাসেও পত্রিকা নিয়ে এসেছে। নিহি হাসে। বাবার ডান হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। একটার পর একটা বাড়ি-ঘর, দোকান, গাছপালাকে পেছনে ফেলে বাসটি এগিয়ে চলেছে। ছোটবেলার একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। ছোট থাকতে যখন বাসে করে কোথাও যেতাম, তখন আমি ভাবতাম গাছগুলোও বাসের সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে। তখন এত ভেবেও এটা বুঝতে পারতাম না যে, গাছ হাঁটে কীভাবে? গাছের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে তখন তো হাঁটে না, দৌঁড়ায় না। তাহলে শুধু বাসের সঙ্গেই দৌঁড়ায় কেন? ছোট মাথায় এই প্রশ্নের উত্তর কখনোই আসেনি। বিষয়টি মাথা থেকেও বের করতে পারতাম না। তখন একদিন আব্বুর কাছেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম। আব্বু পুরো বিষয়টি আমায় সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেও আমার বাচ্চা মন সেই ব্যাখা মানতে চায়নি।
"জানালাটা লাগিয়ে দে। বাতাস আসছে।"
নিজামের ইসলামের কথায় ছোটবেলার অতীত থেকে বের হয়ে আসে নিহি। তবে চোখে-মুখে এখনো হাসি বিদ্যমান। নিহি জানালা লাগায় না। বাতাস আসায় একটু শীতটা বেশিই লাগছে এটা সত্যি। তবে ভালো লাগছে। অতীতের স্মৃতিচারণ করায় বোধ হয় ভালোলাগা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাসের একসঙ্গে তিন সিট যে থাকে সেই সিটেই ওরা বসেছে। কিনারে বসেছে নীলম। সিটের সঙ্গে হেলান দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে। কী রকম বোরিং ভাই আর আব্বু ভাবা যায়? একজন পত্রিকায় মুখ গুঁজে বসে আছে আর অন্যজন কানে হেডফোন গুঁজে! নিহি পত্রিকা টেনে নিয়ে বলে,
"সারাক্ষণ এত কীসের পত্রিকা হু?"
নিজাম ইসলাম হকচকিয়ে যান। অনুরোধ করে বলেন,
"দে মা। সকালে পড়তে পারিনি। তাই নিয়ে এসেছি।"
"না। দেবো না।"
"আমার লক্ষী মা।" বাচ্চাদের মতো করে বলেন তিনি।
নিহি হেসে ফেলে। বাবার গালে চুমু দিয়ে পত্রিকা দিয়ে দেয়। বাবা নিহির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
"আমার পাগলী মেয়ে!"
নিহি এবার একটু উঁচু হয়ে নীলমের হেডফোন টান দিয়ে খুলে ফেলে। নীলম চোখ মেলে তাকায়। মেকি ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"কী হয়েছে?"
"কিছু না।"
"হেডফোন দে।"
"দেবো না।"
"সারাক্ষণ শুধু দুষ্টুমি না? দে বলছি।"
"না, না, না।"
"দেন না আপা।"
নিহি হেসে বলে,
"সুন্দর করে বলো।"
"আমার টিয়া,ময়না, তোতাপাখি, চড়ুইপাখি হেডফোন দিয়ে দেন।"
নিহি খিলখিল করে হেসে ফেলে। হেডফোন ফিরিয়ে দেয়। তারপর আগের ন্যায় সিটে হেলান দিয়ে বসে। আমানের কথা মনে পড়ছে। চুমু দেওয়ার পর আমানের মুখটা দেখার মতো ছিল। নিহি আপনমনেই হাসে। চোখ বন্ধ করে ফেলে। সকালে ঘুম হয়নি। তাই খুব সহজেই ঘুমেরা চোখে ধরা দিয়ে দেয়। নিহি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর নিজাম ইসলাম বাসের জানালা লাগিয়ে দেন। কিন্তু তবুও বাতাস আছে। তার কারণ হচ্ছে সামনের সিটে যারা বসেছে তারা জানালা খুলে রেখেছে। অন্যের স্বাধীনতায় তো আর বাঁধা হওয়া যায় না। তাই নীলম বলে,
"আব্বু তুমি একটু বের হও। নিহিকে মাঝখানে দেই।"
"হ্যাঁ, তাই কর। মেয়েটার শীত লাগছে।"
নীলম বের হওয়ার পর নিজাম ইসলাম বের হন। তারপর নীলম নিহিকে কোলে করে মাঝখানে বসায় আর নিজে জানালার কাছে বসে। নিজাম ইসলামকে বলে,
"তুমি আমার জায়গায় বসো।"
উত্তরে তিনি বলেন,
"তুই ওখানে বসলি কেন? তোর ঠান্ডা লাগবে তো।"
"সমস্যা নেই। আমার গায়ে মোটা জ্যাকেট আছে। তুমি ওখানে বসো।"
তিনি নীলমের জায়গায় বসেন। নীলমের উদ্দেশ্যে বলেন,
"নিহির শাল দিয়ে দিয়েছিল না তোর মা? বের কর তো।"
"করছি। তোমার মেয়ের তো ঢং। সুয়েটার পরে আবার শাল নিতে নাকি বিরক্ত লাকে।"
নিজাম ইসলাম হাসেন। নীলম ব্যাগ থেকে শাল বের করে নিহির গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দেয়। তারপর নিহির মাথা নিজের কাঁধে রেখে এক হাতে নিহিকে জড়িয়ে রাখে। এতক্ষণে নিহিও বোধ হয় আরাম পেলো। তাই গুটিসুটি হয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। নিহির হাত নীলমের হাতে ছোঁয়া লাগতেই নীলম চেঁচিয়ে বলে,
"বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে হাত।"
নিজাম ইসলাম বলেন,
"এ আর নতুন কী? ওর হাত দুটো তোর জ্যাকেটের পকেটে রাখ।"
নীলম তাই করল। কষ্ট হচ্ছে, আদরের বোনটাকে এভাবে আবার কবে কাছে পাবে কে জানে!
নিহির মা, ভাবি আর তিতিরকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমান অফিসে এসেছে। মনটা ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। অদ্ভুত না? নিহি চলে গেছে অথচ মনটা খুশিতে বাকবাকুম করছে। করবেই না বা কেন? নিহি যে আজ ভালোবাসার পরশ দিয়েছে! চেয়ারে বসে বসে দুলছে আর মিটিমিটি হাসছে। নিরব দশ মিনিট ধরে সামনের চেয়ারে বসে আছে আর আমানের কীর্তি দেখছে। ক্লায়েন্ট মিটিং নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে এসে আমানের এই অবস্থা দেখে নিরবের মাথা হ্যাং। যখনই কিছু বলতে যায় আমান থামিয়ে দিয়ে বলে, 'আহা! এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? কথা বলব। একটু বসো।'
নিরব স্যারের আদেশই পালন করছে। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে চুপ করে বসে থাকা যায় বলেন? ঐদিকে নিরবের আরো কাজ আছে। একবার চলে যেতে চেয়েছে। আমান যেতেও দেয়নি। পুতুলের মতোন সামনে বসিয়ে রেখেছে। নিরব এবার বলে,
"স্যার আমি থাকব নাকি চলে যাব?"
নিরবের কথা বলায় আমান বিরক্ত হলো। বিরক্তিকর চাহনীতে নিরবের দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। জিজ্ঞেস করল,
"তুমি না ইদানীং খুব বিরক্ত করছ! আমার থেকেও অফিসের কাজ নিয়ে তোমার বেশি মাথা ব্যথা। বলো কী বলবে?"
নিরবের মুখটা হা হয়ে যায়। কবে বিরক্ত করল নিরবের ঠিক মনে পড়ে না। আর এমন কী ভাবনা-চিন্তা তিনি করছেন যে সামান্য কথা বলায় এত বড় কথা! নিরবের ইগোতে লাগল। আমানকে জিজ্ঞেস করল,
"কাজের কথা পরে হবে স্যার। আগে আপনি বলুন আমি কবে আপনাকে বিরক্ত করেছি?"
"মাত্রই তো করলে।"
নিরবের মুখটা অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। এভাবে মুখের ওপর বলে দিল মাত্রই বিরক্ত করেছে? অভিমান নিয়ে নিরব বলে,
"স্যরি স্যার।"
আমান হেসে ফেলে। হেসে হেসে বলে,
"রাগ করলে নাকি? রাগ কোরো না। আজ আমি অনেক খুশি। খুশিতে পাগল পাগল লাগছে। তাই উল্টা-পাল্টা বলে ফেলেছি।"
নিরবের মন শান্ত হয়। শান্তি লাগে। জিজ্ঞেস করে,
"কারণ কী স্যার? ম্যাম কি সিলেটে যাবে না?"
"সকালেই চলে গেছে তো। ও'কে বাসে উঠিয়েই তো অফিসে এসেছি।"
নিরব এবার বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
"ম্যাম চলে গেছে তাও এত খুশি? কারণটা কী স্যার?"
আমান লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে,
"কিছু কষ্ট যেন কষ্ট নয়, সুখমিশ্রিত কষ্ট। এইরকম কষ্ট সারাজীবন পেতেও আমি রাজি।"
নিরব মাথা চুলকায়। আমানের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না। আমান ঘোর থেকে বের হয়। বলে,
"বাদ দাও এসব। এখন বলো কী যেন বলতে এসেছিলে?"
"জি স্যার, মিটিং এর বিষয়ে। নতুন ক্লায়েন্টদের সঙ্গে মিটিং এর সময়টা ফিক্সড করতে কথা বলতে এসেছি। কখন করবেন?"
"আজ বিকেলেই। মনটা ভালো আছে। খুব ভালোভাবেই সব হ্যান্ডেল করতে পারব।"
"ঠিকাছে স্যার।"
_______________________
সিলেট গিয়ে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে যায়। বাস স্ট্যান্ডে ওদেরকে নিতে এসেছে নিহির মামা লিয়াকত শিকদার এবং তার বড় ছেলে লিমন। নিহি বাস থেকে নেমে আগে মামাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
"কেমন আছেন মামা?"
"ভালো আছি আম্মা। তুমি ভালো আছো?"
"আলহামদুলিল্লাহ্।"
নিহি এবার লিমনকে জিজ্ঞেস করে,
"ভালো আছো ভাইয়া?"
"আমি খারাপ থাকি কবে বল?"
"তোমার বাঁকা উত্তর দেওয়ার স্বভাব আর গেল না, না?"
লিমন ওদের ব্যাগ হাতে নিয়ে হেসে হেসে বলে,
"ভালো আছিরে ময়না। বাড়িতে চল এখন।"
সবাই একসঙ্গে বাড়িতে যায়। নিহিকে দেখে মামি জড়িয়ে ধরেন। গালে হাত বুলিয়ে বলেন,
"মুখটা এমন শুকিয়ে গেছে কেন মা?"
পাশ থেকে মামার মেয়ে তরু বলে,
"মা নিহি জার্নি করে এসেছে। মুখ তো শুকনো লাগবেই।"
নিহি হেসে বলে,
"একদম। ফ্রেশ হয়ে খেলেই দেখবে তাজা হয়ে গেছি।"
"তাহলে তাড়াতাড়ি আগে ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি খাবার দিচ্ছি।"
লিমন তখন পিঞ্চ মেরে বলে,
"এত খাস তবুও তো মোটা হস না।"
নিহি চিৎকার করে বলে,
"মামী! কিছু বলবে?"
মামী তখন লিমনের কান মলে দিয়ে বলে,
"আমার মাকে নিয়ে খাওয়ার খোঁটা দিবি না।"
লিমন ব্যথা পেয়ে 'আহ্' শব্দ করে বলে,
"মা ছাড়ো।"
তারপর তরুর উদ্দেশ্যে বলে,
"দেখ, নিহি কিন্তু তোর ভাগ নিতে চলে এসেছে।"
তরু ভেংচি কেঁটে বলে,
"তুমি একদম প্যাঁচ লাগানোর চেষ্টা করবা না।"
তারপর নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
"আমার সঙ্গে চল। ফ্রেশ হবি।"
নিহি লিমনকে ভেংচি কেটে চলে যায়। নীলম হেসে লিমনের পিঠে চাপড় দিয়ে বলে,
"আহারে! বেচারা। পাত্তা পেলি না কোথাও।"
"ভাই মজা নিও না।" মন খারাপের অভিনয় করে বলে লিমন।
ওদের খুনসুটি দেখে সবাই হাসে। হ্যাঁ, সবাইকে যেমন হাসিখুশি দেখছেন ওরা তেমনই হাসিখুশি। এবং নিহির মামা-মামী, মামাতো ভাই-বোন সবাই ভাবনার চেয়েও বেশি ভালো। তরু নিহির ব্যাচমেট। এবং তরুর কলেজেই নিহিকে ভর্তি করানো হবে।
সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে এক সঙ্গে খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষ করে নিহি তরুর ঘরে যায়। এখন থেকে নিহি তরুর সঙ্গেই থাকবে। সাড়ে চারটার দিকে তরু প্রাইভেট পড়তে চলে যায়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নিহিকেও নিয়ম করে প্রাইভেট পড়তে হবে। তবে এখন তো মুক্তি! তরু চলে যাওয়ার নিহি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। মামার বাড়িতে আসার পর ভাইয়া বাড়িতে ফোন করে সবার পৌঁছানোর কথা বলে দিয়েছে। আমানকেও ফোন করে বলেছে। কিন্তু নিহির সঙ্গে আমানের কথা হয়নি। আমানকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছে। আমানের নাম্বারে কল দিতে গেলেও আবার ব্যাকে চলে আসে। বুকের হার্টবিট বেড়ে যায় ফোন দিতে গেলে। শেষমেশ আর ফোন দেওয়াই হয় না। নিহি উপমাকে কল করে। দু'বার রিং হওয়ার পর উপমা ফোন রিসিভ করে বলে,
"হ্যালো নিহি।"
"কী করছিস?"
"আমি তো প্রাইভেটে এখন। তুই কোথায় আছিস?"
"মামার বাসায় চলে এসেছি একটু আগে। আমি কি তোকে পরে ফোন করব?"
"না। অনামিকা ম্যামের পারমিশন নিয়েই রিসিভ করেছি।"
অনামিকা ম্যাম নিহির সাথে কথা বলতে চান। উপমা ফোনটা ম্যামের কাছে দেয়। ম্যাম জিজ্ঞেস করেন,
"কেমন আছো নিহি?"
নিহি সালাম দিয়ে বলে,
"ভালো আছি ম্যাম। আপনি?"
"আলহামদুলিল্লাহ্। ভালোমতো পৌঁছিয়েছ তো?"
"জি ম্যাম।"
নিহি আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তার সঙ্গে। বুক ধুকপুক করে। কারণ তিনি যে শুধু ম্যাম-ই নয়। নিহির শ্বাশুরীও। আচ্ছা যখন উনি জানতে পারবেন, নিহি উনার বড় ছেলের বউ তখন উনি কী করবেন? মেনে নিবেন নিহিকে? এখন যেমন ভালোবাসেন, তখনও কি সেরকমভাবে ভালোবাসবেন?
অনল ঘরে বসেই অনামিকা ম্যামের কথা শুনছিল। নিহির কথা না শুনলেও মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারছিল নিহি যে সিলেটে চলে গেছে। তার মানে আর কখনো নিহিকে দেখতে পারবে না। কেমন এক শূন্যতা বুকের ভেতর। কেমন যেন হাহাকার করছে। আচ্ছা অনল তো এটাই চেয়েছিল। নিহিকে কলেজ থেকে বের করতে চেয়েছিল। নিহি চলেও গেছে কলেজ ছেড়ে। সেই অনুযায়ী অনলের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু অনল খুশি হতে পারছে না। অস্থিরতায় শরীর কাঁপছে। তবে কি নিহির প্রতি ভালোবাসা...! অনল বসা থেকে উঠে ধারায়। নিজেই নিজের মনকে মানানোর চেষ্টা করে বলে, 'না, অসম্ভব। আমি কখনোই নিহিকে ভালোবাসিনি। নিহির প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা থাকতে পারে না। কখনোই না!'
অনলের ফোন বাজছে। ফোনের স্ক্রিনে ইরার নাম লেখা। সেদিন কলেজে ঐরকম ব্যবহার করার পর ইরা নিজেই স্যরি বলেছে। মাফ চেয়েছে। কিন্তু অনল কোনো রেসপন্স করেনি। আরো শাস্তি পেতে হবে ইরাকে। তবেই অনলের শান্তি। বেয়াদবি অনলের সহ্য হয় না। একদম না!
উপমা আর ম্যামের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে নিহি দীপ্তকে ফোন করে। দীপ্তর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পর ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে। ঘুম পাচ্ছে খুব। ঐদিকে আমানের সঙ্গেও কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ফোন করবে কী করবে না ভেবে সময় অতিবাহিত হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অবশেষে ফোন দিয়েই ফেলে। রিং হচ্ছে, কিন্তু রিসিভ করছে না। এইদিকে বুক ধুকধুকানি বেড়েই চলেছে। একটু, আরেকটু, আরো বেশি এভাবে হার্টবিট বেড়েই চলেছে। ঐদিকে এখনো ফোন রিসিভ করছে না।রিং হতে হতে কল কেটে যায়। নিহি আবার ফোন দেয়। ফোন নিরবের কাছে। আমান ক্লায়েন্টদের সঙ্গে মিটিং করছে। ফোন নিয়ে নিরব বাইরে বের হয়। ফোনের স্ক্রিনে লেখা, 'নিহু পাখি'। নিজের অজান্তেই মুচকি হাসে নিরব। ফোন রিসিভ করে নিরম সালাম দেয়। নিহি সালামের উত্তর নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"কে?"
নিরব হেসে বলে,
"আমি সবার কাছে নিরব ম্যাম। কিন্তু আপনার কাছে ক্যাবলাকান্ত।"
নিহি শব্দ করে হেসে ফেলে। জিজ্ঞেস করে,
"কেমন আছেন ক্যাবলাকান্ত?"
"আলহামদুলিল্লাহ্ ম্যাম। আপনি কেমন আছেন?"
"আমিও আলহামদুলিল্লাহ্। আপনার স্যার কোথায়?"
"স্যার তো মিটিং-এ। স্যারের কাছে ফোন দেবো?"
"মিটিং-এ আছে! না, থাক। তাহলে দরকার নেই। আপনার সঙ্গেই কথা বলি। আপনার স্যারের কী অবস্থা? মন খারাপ করে থাকে?"
"সত্যি বলব ম্যাম?"
"অবশ্যই।"
"স্যারের কী হয়েছে কে জানে! অফিসে আসার পর থেকেই দেখছি মিটিমিটি হাসে শুধু। আর কী যেন ভাবে। ভূতেও ধরতে পারে।"
নিহি হাসে। আমানের এত ভাবনা আর মিটিমিটি হাসার কারণও নিহির কাছে পরিষ্কার। নিহি বলে,
"বউয়ের ভূত ধরলে স্বামী এমনই করে। যাই হোক, এখন রাখছি ভাই। মিটিং শেষ হলে আপনার স্যারকে বলিয়েন, আমি ফোন করেছিলাম।"
"ঠিকাছে ম্যাম।"
"ভালো থাকবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।"
"আপনিও ভালো থাকবেন ম্যাম। আল্লাহ্ হাফেজ।"
নিহি ফোন রেখে শুয়ে পড়ে। আমান যে মন খারাপ করে থাকছে না সেটা শুনে এখন শান্তি লাগছে। আরামসে ঘুমও দেওয়া যাবে এখন। লেপ, কম্বল জড়িয়ে নিহি ঘুমিয়ে পড়ে।
মিটিং শেষ করে আমান নিজের ক্যাবিনে আসে। নিরব আসে মিনিট পাঁচেক পর। ফোনটা আমানের টেবিলের ওপর রেখে বলে,
"স্যার, ম্যাম ফোন করেছিল।"
আমান অবাক হয়ে বলে,
"কী? কে ফোন করেছিল?!
নিরব মুচকি হেসে বলে,
"আপনার নিহু পাখি।"
আমান কেঁশে বলে,
"এহেম! এহেম! ফোন করেছিল, আমায় দাওনি কেন?"
"ম্যাম বারণ করেছিল।"
"তোমার ম্যাম বললেই শুনতে হবে? বেতন কি আমি দেই নাকি তোমার ম্যাম? এখন থেকে মা আর নিহু ফোন দিলে আমি যত জরুরী মিটিং-য়েই থাকি না কেন, আমার কাছে ফোন দেবে।"
"ঠিকাছে স্যার।"
আমান কল লিস্ট চেক করে বলে,
"পাঁচ মিনিট তিন সেকেন্ড কথা বলেছ! ওহ গড! তুমি কল কেটে ব্যাক করোনি কেন? আমার বউয়ের টাকা খেয়েছ।"
নিরব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। আমান আবার বলে,
"নিহু কি চাকরী করে? বাবার টাকায় চলে। এখন থেকে ফোন করলে কেটে ব্যাক করবে।"
"জি স্যার।"!
"আচ্ছা নিরব..."
"জি স্যার?"
"আমি কি একবার ফোন দেবো?"
"দিন স্যার।"
"কী ভাববে ও? যদি কিছু মনে করে?"
"এখানে মনে করার কী আছে স্যার? আপনি ফোন করুন।"
"করব? আচ্ছা তোমার সঙ্গে এতক্ষণ কী কথা হলো?"
"সাক্ষাৎ বিনিময়, তারপর আপনার কথা জিজ্ঞেস করল। আপনার মন খারাপ থাকে নাকি জানতে চাইল।"
"তুমি কী বললে?"
"যা সত্যি তাই-ই। আপনি কী কী যেন ভাবেন আর মিটিমিটি হাসেন এটাই বলেছি।"
আমান এবার উত্তেজিত হয়ে বলে,
"নিহু কী বলল?"
"কিছু বলেনি স্যার। হেসেছে।"
"হেসেছে?"
"জি স্যার।"
আমান এবার চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসে। ভাবে, কিছু বলল না কেন! আর হাসলোই বা কেন!
নিরব জিজ্ঞেস করে,
"আমি কি যাব স্যার?"
"যাও।"
নিরব চলে যাওয়ার পর আমান আবারও ভাবনার গহীনে হারিয়ে যায়। নিহির কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতর ভালোবাসার উথালপাতাল জোয়ার আসে। বিশাল বিশাল ঢেউ বলে যায়, 'ভালোবাসি নিহু পাখি। ভীষণ ভালোবাসি।'
.
.
.
চলবে.................................