সংসার - পর্ব ১০ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৯!! 

-হেই সুইটহার্ট, লুক আ'ম ব্যাক। আজ নিজেকে ভিষণ লাকি মনে হচ্ছে ইউ নো? নইলে আজই তোমাকে পাওয়ার পাওয়ার সাধ জাগলো, আর দেখো পেয়েও যাচ্ছি। হাউ ইন্টারেস্টিং! ইজন্ট ইট? বাট একটা কথা বলতেই হয় তোমাকে ডিয়ার অনু ভাবি। আপনার হাজবেন্ড একদমই কাজেট না। লেখাপড়া বা বিজনেস এসবে অসামান্য জ্ঞান থাকলেও সংসার বিষয়ে জ্ঞান বুদ্ধি একেবারে শূন্যের কোটায়। নইলে এতো সুন্দরী একটা বউয়ের সাথে রাগ দেখিয়ে রাত বিরেতে কাজিনদের সাথে গিয়ে শোয়? এতো বড় গর্ধব দুনিয়াতে আর একটাও আছে বলুন তো দেখি! তাও আবার বাড়িতে এতোগুলো সমত্ত বয়স্ক কাজিন থাকার পরও বউকে একলা রুমে রেখে যাওয়ার সাহস হয় কি করে এই বেক্কলেট বলেন তো? এই লোকের কাছে আপনার সেইফটি কি আসলেই ম্যাটার করে? উমমমমম। মনে তো হয় না। এর চেয়ে আমার আশ্রয়েই আপনি নিরাপদে থাকবেন। অন্তত আপনার অরণ্যেট চেয়ে কোনো অংশে কম অখুশি রাখবো না এটা এশিওর করতে পারি। শুধু আপনার একটা সুযোগ দেয়ার অপেক্ষা। তাছাড়া ভাবিদের উপরে দেবরদের এমন টুকটাক অধিকার তো আছেই। কি বলেন মিসেস অরণ্য? ওপস সরি। অনামিকা নামটাই এনাফ আপনার জন্য। রাইট? 

রাত গভীর হওয়ার পর একজন সবার আড়ালে পা টিপে টিপে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে অন্ধকার হাঁতড়ে দোতলার করিডোরে এসে দাঁড়িয়েছে। একবার সন্তর্পণে করিডোরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পুরোটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে অরণ্য অনুর বেডরুমের দরজার লকটা খুলে ভিতরে ঢুকে হালকা হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে কথাগুলো বলছিল। রুমে মিটিমিটি জ্বলা ডিমলাইটের আবছা আলোয় বিছানার উপরে ধড়ফড় করে কারো উঠে বসা দেখে লোকটার ঠোঁটের কোণের হাসিটা আরো খানিকটা বিস্তৃত হলো। এক পা দু পা করে এগিয়ে আসতে আসতে প্রায় বিছানার কাছাকাছি এসেও কোনো রেসপন্স বা বাধা না পেয়ে এবারে লোকটার সাহস যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। 

-বাহ! দারুণ তো! দুপুরে তো বেশ ধড়ফড় করছিলেন, পালানোর চেষ্টা করছিলেন। এখন কি পালানোর এনার্জি নেই? নাকি নিজের নিয়তিটা মেনে নিয়েছেন মুখ বুজে? অবশ্য মেনে নেয়াটাই আপনার জন্য সুবিধার হবে। যত পালানোর চেষ্টা করবেন তত আপনারই কষ্ট হবে। আমাকে অযথাই তাহলে নিজের এনার্জি নষ্ট করতে হবে আপনাকে কন্ট্রোল করার জন্য বা বেঁধে ফেলার জন্য। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খুব একটা ভালো হবে না। এর চেয়ে দুজনে মিলে এন্জয় করলে সহজেই মিটে যাবে ব্যাপারটা। হেই? অনু? কিছু বলছ না কেন? রেগে আছো ভিষণ? দুপুরে এমন পিঞ্জিরাবন্ধ পাখির মতো ছটফট করছিলে যে গায়ে হাত তুলেই চুপ করাতে বাধ্য হয়েছিলাম। জ্বরও চলে এসেছিল শুনলাম? সরি গো। এক্সট্রেমলি সরি। আসলে রাগ উঠে গিয়েছিল। তুমি পালাই পালাই করতে করতে ফুলদানিটা ফেলে দিলে, আর ওই শালা অরণ্যও চলে এসেছিল। সব মিলিয়ে মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেছিল। ধ্যাত! আচ্ছা যাও! এখন আদর দিয়ে সবটা শোধ বোধ করে দিব কেমন? সরি তো অনামিকা? কিছু তো অন্তত বলো? 

অন্ধকারের বুক চিরে রিশাদ এগিয়ে এসে বিছানায় জড়সড় হয়ে বসে থাকা মেয়েটার পাশে এসে বসেছে এবারে। আবছা আলোয় মুখটা দেখা যাচ্ছে না বলে খানিকটা বিরক্তই হলো রিশাদ। এমন আবছা আলোয় মুখটা দেখতে না পেলে মুডই তো আসবে না। কথাটা ভেবে একবার উঠে গিয়ে রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে দিবে কিনা সেটা ভেবেও ভাবনাটা ক্যানসেল করে দিল রিশাদ। বাইরে থেকে রুমে আলো জ্বলছে টের পেলে কেউ যদি ডিস্টার্ব করতে আসে? কি দরকার বাবা কাবাবের মধ্যে হাড্ডি এনে! কথাগুলো ভেবে রিশাদ আরো খানিকটা গা ঘেঁষে এসে মেয়েটার হাত ধরার চেষ্টা করতেই কড়া হাতের শক্ত একটা থাপ্পড় এসে পড়লো রিশাদের গালে। রিশাদ রাগে লাল হয়ে আবার মেয়েটার হাত মচকে ধরার চেষ্টা করতেই মেয়েটা ধাক্কা দিয়ে রিশাদকে নিচে ফেলে দিয়ে নিজে প্রায় ছিটকে বিছানা থেকে ফ্লোরে পা রাখলো। রিশাদ সর্তক ছিল না বলে হুট করে ফ্লোরে পড়ে বেশ কিছুটা ব্যথাই পেল। ব্যথার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই সামনের মানুষটার রাগে, দুঃখে, কেঁপে ওঠা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে নিজের ব্যথার কথাটা ভুলে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। আর কন্ঠস্বরটা শুনেই একটা ঠান্ডা শীতল স্রোত রিশাদের শিড়দাঁড়া বেয়ে যেন নিচের দিকে নেমে গেল। কারণ, সামনে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে রিশাদকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল সে অনামিকা নয়। মানুষটা অন্য কেউ। 

-ছি ভাইয়া! তুই এতো খারাপ! এতে খারাপ যে ভাবির দিকে বাজে নজর দিতে একবারও বিবেকে বাঁধলো না তোর? তুই দুপুরেও ভাবির সাথে জবরদস্তি করেছিলি! ছি ছি ছি! তোকে আমার নিজের ভাই বলতে এখন গা ঘিন ঘিন করছে। ছিহ! ভাবি না মায়ের মতো! সেই ভাবির সম্বন্ধে এতো বিশ্রি কথা চিন্তায় আসার আগে মরে যাস নি কেন তুই? তাহলে অন্তত মনকে এটা বলে শান্তনা দিতে পারতাম যে আমার ভাই কখনো কারো কোনো ক্ষতি করে নি। ছিহ! তোর মতো ভাইয়ের বোন হওয়ায় এতো ঘৃণা লাগছে যে আমার নিজেরই এখন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। হে আল্লাহ! কেন এমন অমানুষকে আমার ভাই করে পাঠালে তুমি! যে কিনা অন্যের বোনের, অন্য একটা মেয়ের সম্মানের দিকে কুনজর দিয়েছে তাকেই আমার ভাই কেন করে পাঠালে! এর চেয়ে নাহয় আমার কোনো ভাই না থাকতো। আজ ওর কথা ওর নিজের মুখ থেকে না শুনলে তো আমি জীবনেও বিশ্বাস করতাম না যে আমার ভাই এমন কিছু করতে পারে! অরণ্য ভাইয়াও তো আমাদের ভাই! ওর বউয়ের সাথে এভাবে এতো------। আল্লাহ! এসব দেখার আর শোনার আগে আমি মরে গেলাম না কেন? এই তোকে ভাইয়া বলে ডাকতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার জানিস? অন্যের বোনের দিকে বাজে নজর দেয়ার আগে এটা একবারের জন্যও ভাবিস নি যে তোর নিজেরও একটা বোন আছে? তুই অন্য একটা মেয়ের সাথে যা করছিা তা তোর নিজের বোনের সাথেও হতে পারে! ছি ছি ছি! এতো পড়ালেখা, এতো ভালো জব, এতো পার্ফেক্ট একটা লাইফ! তবু তোর আচরণ যেন রাস্তার কুকুরের মতো! কেন রে? বাবা মা কি তোকে মানুষ করতে পারে নি?! নাকি অমানুষগুলোকে যতই পড়াও, যতই শেখাও ওরা জীবনে মানুষ হয় না?

-প্রভা? 

প্রভা, রিশাদের আদরের ছোটো বোন। শুধু রিশাদের নয়। বাকি সবকটা কাজিনেরই বড্ড আদরের ছোট্ট প্রভা। তাহিয়ার মতো দুরন্ত নয়, কিছুটা শান্ত, ধীরস্বভাবের মেয়ে বলেই সবার দু চোখের মনি। কখনো রাগ করে কারো সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলেছে এমন কথা কেউ বলতেই পারবে না। সেই শান্ত মেয়েটাই আজ চিৎকার করে কাঁদছে। রাত দুপুরে প্রভার কান্নার আওয়াজেই হোক, বা নিজেদের প্ল্যানের কারণেই হোক, অরণ্য আর বাকিরাও একে একে ছুটে এলো অরণ্য অনামিকার সাধের বেডরুমটায়। ছোটো খাটো একটা জটলা রুমের বাইরে থেকে ঘুমঘুম চোখে কি ঘটছে বোঝার চেষ্টা করছে দেখে অরণ্য নিজের চাবিটা দিয়ে দরজার লক খুলে রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। লাইটের ঝকঝকে আলোয় সবাই ফ্লোরে মূর্তির মতো বসে থাকা রিশাদকে দেখে যতটা না অবাক হলো, তার চেয়ে বেশি অবাক হলো সদা শান্ত প্রভাকে পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে দেখে। লাইট জ্বলে ওঠায় রিশাদ চমকে উঠে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেও প্রভা ছুটে এসে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কেঁদে ফেললো। ততক্ষণে বাকি কাজিনেরাও এসে অরণ্য আর প্রভাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সবার কৌতূহলী প্রশ্নগুলো রীতিমতো গুঞ্জন তুলছে বদ্ধ রুমটার চার দেয়ালের মাঝে। এতো শব্দের মাঝেও চোয়াল শক্ত করে ফ্লোরেই বসে আছে রিশাদ। এভাবে ধরা পড়তে হবে সে হয়তো স্বপ্নেও ব্যাপারটা কল্পনা করতে পারে নি। 

-তুমি ঠিকই বলেছিলে ভাইয়া। কে কেমন সেটা বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না কখনো। ভাবির অবস্থা দেখে কে ভাবির সাথে এমন অসভ্যতা করেছে সেটা বের করবো বলে রাজি না হলে জানতেও পারতাম না, আমার ভাই, আমার নিজের মায়ের পেটের ভাই, এতোটা অমানুষ। এতো খারাপ, এতো ------। আমি আর এসব নিতে পারছি না ভাইয়া। আমি----আমি---আমি কালই বাড়িতে চলে যাবো। একটু এরেঞ্জ করে দিবে ভাইয়া প্লিজ? আমি একাই চলে যাবো। আর এই অমানুষটা আর যেই হোক ওকে আর জীবনে নিজের ভাই ভাবতে পারবো না। ওকে কি করবে, পুলিশে দিবে, নাকি মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে, সেটা তোমরা ভালো জানো। ওর ব্যাপারে আমি কিচ্ছু জানতেও চাইবো না। 

প্রভা কথাগুলো কোনোমতে শেষ করে এক ছুটে বেরিয়ে গেল রুমটা থেকে। অরণ্যের কাজিনেরা একে অন্যের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। ওরা সবাই জানতো অরণ্য কিছু একটা খেলা খেলছে। অনামিকার সাথে রাগের ব্যাপারটা যে পুরোটাই এক্টিং সেটা ওদের জানা। তাই কেউই রাতে অরণ্য ওদের রুমে আসায় বাড়তি একটা প্রশ্নও করে নি। কিন্তু রিশাদ? ও এই রুমে কি করছে এতো রাতে? প্রভাই বা এমন কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল কেন? কিছুই কারো মাথায় ঢুকছে না। সবার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে অরণ্য এবারে একপা দুপা করে এগিয়ে এসে রিশাদের সামনে একটু ঝুঁকে রিশাদের শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁড় করালো। রিশাদ নিজের মনে হাজারটা কথা সাজানোর চেষ্টা করছিল। এর মাঝেই অরণ্যের এভাবে ওকে টেনে তোলায় চমকে অরণ্যের রক্তলাল চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো রিশাদ। ভাই বা বন্ধুর গান গেয়ে যে পার পাবে না এটা বেশ ভালোই বুঝে গেছে এতোক্ষণে রিশাদ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন কাহিনী তৈরি করার চেষ্টা করলো ওর কুটিল মস্তিষ্ক।

-কি ভেবেছিলি রিশাদ? তুই এতোটা কাছ থেকে অন্যায় করে যাবি আর আমি টের পাবো না? নাকি তোকে ভাই মানি এই আবদারে সব অন্যায় মাফ করে দিব? তাও আবার অনুর সাথে যা করেছিস, যা করতে চেয়েছিস তার পরও?

-আমি ভাবির সাথে ---ভাবির সাথে কি করলাম? কিসব আজেবাজে কথা বলছিস অরণ্য? 

-আজেবাজে কথা? কি করেছিস, কি করতে চেয়েছিলি, কেন করেছিলি সবটাই আমি জানি রিশাদ। তাই তোর এই ভালোমানুষির নাটকটা না আমার সামনে করিস না বুঝলি? অরণ্য নামের যে ছেলেটাকে এখন সামনে দেখছিস সে কোনটা সত্য, আর কোনটা মিথ্যে সেটার পার্থক্য করতে জানে। ছোটোবেলা থেকে তুই যে আমার প্রত্যেকটা কাজে হিংসে করতি, সেটাও বুঝতাম আমি। কিন্তু তোর সব কাজ, কথাগুলো ছেলেমানুষি বলে উড়িয়ে দিতাম সবসময়। সেটাই যে এতো বড় কালসাপ হয়ে আমার সংসারে আমার জীবনে এসে ছোবল মারার চেষ্টা করবে সেটা তো বুঝতে পারি নি। বুঝলে হয়তো তোর মতো কাপুরুষের সাহস হতো না আমার সামনে দাঁড়িয়ে এখনো নিজের সাফাই দেয়ার চেষ্টা করার। তাও আবার নিজের বোনের হাতে হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও। তাই না রিশাদ?

২০!! 

-তোর সাহস হয় কি করে রিশাদ অনামিকার দিকে চোখ তুলে তাকানোর? তুই কি ভেবেছিলি? আর দশটা মেয়ের মতে ওকেও ব্ল্যাকমেইল করবি আর ও আমাকে কিচ্ছু বলবে না? আমি চাইলে দুপুরেই যখন অনুকে ওই অবস্থা দেখেছিলাম তখনই তোকে রেস্টুরেন্টে সবার সামনে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এসে কুকুরের মতো মারতে পারতাম। কাজটা করি নি কেন বল তো? কজ তুই নতুন করে কাহিনী বানানোর জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিলি। আমি গাধার মতো কয়েকটা সেকেন্ডের জন্য তোকে বাড়িতেই ধরতে পারি নি।

অরণ্য রিশাদকে ফ্লোর থেকে কলার চেপে তুলে ধরে এলোপাথাড়ি চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি একসাথে দিতে দিতে কথাগুলো বলছিল। অরণ্য আর রিশাদের কাজিনরা কয়েক মূহুর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঘটনাটা কি ঘটছে সেটাই বেচারারা বুঝেই উঠতে পারে নি। রিশাদ আর অরণ্যের এতো কলিজার বন্ধুত্বে হঠাৎ কি এমন হলো যে অরণ্য পারলে খুন করে ফেলে রিশাদকে! সবাই মিলে কোনোমতে রিশাদকে অরণ্যের হাত থেকে কষ্টেসৃষ্টে টেনে হিঁচড়ে বের করে দাঁড় করাতেই অরণ্য আবার রিশাদের কলার চেপে ধরে কারো বাধা দেয়ার আগেই মারা শুরু করেছে। অরণ্যের কাজিনরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়ে একদল রিশাদকে অরণ্যের হাত থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে, আরেকজন অরণ্য যেন রিশাদকে ধরতে না পারে তারই ব্যর্থ চেষ্টা করছে। অরণ্যের চোখ জোড়া ততক্ষণে টকটকে লাল হয়ে গেছে। আর রিশাদ? প্রভার ধাক্কায় অসাবধানে পড়ে গিয়ে একটা পা আগেই মচকে গিয়েছিল ওর। এবারে অরণ্যের শক্তিশালী হাতের এলোপাথাড়ি আক্রমণে রীতিমতো নাক, দাঁত ফেটে রক্ত ঝরে পড়নের সাদামাটা টিশার্টটায় রক্তারক্তি ডিজাইন হয়ে গেছে। অবশ্য অরণ্যের রক্তলাল চোখ জোড়া দেখেও রিশাদ ভয়ে পেয়েছে বা নিজের কাজের জন্য তাকে একটুও বিচলিত দেখালো না। সে সবার আড়ালে অরণ্যের চোখে চোখ রেখে কুটিল একটা হাসি দিয়ে আবার আগের মতো নম্র ভদ্ররূপে কাজিনদের একেকজনের মুখের দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন কি ঘটছে সে নিজেও কিছু বুঝতে পারছে না। এদিকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে তাইয়্যেবা জামান আর আরহান চৌধূরী, তাহিয়া, ফারহা বাকিরাও চলে এসেছে রুমে। কি ঘটছে কেউই কিছু বুঝতে পারছে না। বিশেষ করে রিশাদের রক্তাক্ত হতভম্ব মুখ আর অরণ্যের টকটকে রক্ত লাল চোখ মুখ দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে।

-তুই আমাকে বলবি অরণ্য ঠিক কি হয়েছে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুই এমন করছিস কেন? আমি কি করলাম? তোর ওই অনুই আমাকে আসতে বলেছিল। আমি তো ভাবলাম হয়তো তোকে কিছু সারপ্রাইজ দিবে তাই আমার কাছে হেল্প বা সাজেশন চাইবে তাই-----।

-শাট আপ রিশাদ। অনু তোকে রুমে ডেকেছে না? কোথায় অনু? কখন ডাকলো? দুপুরের পর থেকে ওর জ্বর বলে রুমের বাইরেই তো বের হয় নি। বাবা মা, এমনকি তাহিয়াকেও বারণ করেছি বলে ওরা কেউ রুমে আসে নি। তাহলে অনু কখন ডাকলো তোকে? বল? মিথ্যে গল্প বানাতে গিয়ে যে মিথ্যের সাগরে আটকে যাচ্ছিস সেটা টের পাচ্ছিস তুই রিশাদ? 

অরণ্যের কথা আর রীতিমতো তেড়ে আসাতেও রিশাদ বিন্দুমাত্রও বিচলিত হলো না। একটা অতি অবাক হওয়া মুখ করে অরণ্যের দিকে তাকালো। 

-অরণ্য? কি বলছিস তুই এসব? আমি কেন মিথ্যে বলতে যাবো? দুপুরেই তো অফিস থেকে বেরিয়েই তোকে কল করলাম। আর এখন তুই বলছিস আমি ভাবির সাথে কিছু একটা করেছি! আজব! কি করেছি আমি বলবি প্লিজ? মাঝরাতে তুই আমাকে এমন চোরের মতো মারছিসই বা কেন?

রিশাদের কথাটা শেষ হয়েছে কি হয় নি এর মধ্যেই রিশাদের শক্ত হাতের আরেকটা থাপ্পড় রিশাদের গালে এসে পড়তেই রিশাদ প্রায় ছিটকে আরহান চৌধূরীর গায়ের উপরে পড়তেই আরহান রিশাদকে ধরে ফেললো। অরণ্য একপা সামনে এগিয়ে এসে আঙ্গুল তুলে রিশাদের চোখের দিকে কঠিন মুখে তাকালো।

-আর একটাও কথা বললে তোকে এখানেই খুন করে রেখে দিবো রিশাদ। কি ভাবিস কি তুই? যা ইচ্ছে করবি আর কেউ সেটা জানতেও পারবে না? জানতে চাইছিলি না কি করেছিস? তোর কাজের লিস্ট দিবো আমি? ওয়েট দিচ্ছি---। সবাই শোনো। তোমাদের আদরের রিশাদ, রিশাদ ভাইয়ার ক্যারেকটারের নতুন দৃশ্য তুলে ধরছি সবার সামনে। আজ থেকে এক বছর আগের ঘটনা। একটা কফিশপে একটা মেয়েকে দেখে রীতিমতে ক্রাশ খায় আমাদের রিশাদ সাহেব। মেয়েটাকে অন্য একটা ছেলের সাথে বসা দেখেও নিজের মনের কথা জানায়। মনের কথা বলাটা তো দোষের কিছু না, আমিও মানছি। বাট রিজেক্ট করে দেয়ার পরও, মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড পাশে থাকার পরও কন্টিনিউয়াসলি তাকে টন্ট করা, পিঞ্চ করা এসবও নাহয় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখলাম। বাট মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড বিল পে করতে গেলে তাকে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডের জন্য অফার করা এটা কি ক্ষমা করার মতো অপরাধ?

-অরণ্য? আজেবাজে কথা বলবি না একদম। আমি কাউকে------।

-জাস্ট শাট ইওর মাউথ। পৃথিবীর যে কেউ তোর নামে এমন অভিযোগ করলে আমি হয়তে সেটা মিথ্যে অপবাদ বলে উড়িয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু তুইও জানিস কাজটা তুই করেছিস। আর কফিশপের ম্যানেজার আজও তোর কথা মনে রেখেছে। প্রমাণ চাই তোর?

-সব মিথ্যে, সাজানো নাটক। অনামিকা তোকে এসব কাহিনী শুনিয়েছে না অরণ্য? আমি কথাটা কাউকে বলতে চাই নি। বাট নিজেকে সেইফ করতে কথাগুলো তো আমাকে বলতে হবেই। বছরখানেক আগে ককফিশপে তোর বউকেই আরেকটা ছেলের সাথে দেখেছিলাম। ওর এক্স ছিল ওই ছেলেটা। পাবলিক প্লেসেও যা করছিল তা আমি মুখেও আনতে পারবো না। আমাকে দেখেই তাই প্রথমদিন থেকেই তাই নার্ভাস হয়ে গেছে। ভেবেছে যদি সবাইকে ওর আসল চরিত্রটা বলে দিই। তাই এসব মিথ্যে------।

রিশাদ কথাটা শেষ করতেই অরণ্যের হঠাৎ একটা ঘুষি নাক বরাবর এসে পড়তেই আবার গলগল করে নাক দিয়ে রক্ত ঝড়তে লাগলো রিশাদের। রিশাদ নাকে হাত দিয়ে ব্যথায় এবারে কিছুটা কঁকিয়ে কিছুটা নিচু হয়ে ফ্লোরে বসে পড়ার চেষ্টা করতেই অরণ্য রিশাদকে আবার টেনে তুললো।

-কি ভাবিস কি তুই? তোর এসব উল্টোপাল্টা কথায় আমি অনুর কথাগুলো মিথ্যে বলে মনে করবো? আমি কি ক্রস চেক না করে তোকে ধরতে টোপ ফেলেছিলাম? ইয়েস মিস্টার রিশাদ। তুমি টোপ গিলেছ বলেই আমার কাজটাও সহজ হয়েছে। আর অনুর এক্স ওয়াই জেড, তাকে নিয়ে তোর মাথা ঘামাতে হবে না। অনু তো তোকে বলেছিল ওই সাহিল ছেলেটার কথা আমি জানি। তোর মে বি মনে হয়েছে অনুও তোর মতো মিথ্যে কথাই বলছে, রাইট? 

-ওই মেয়েটা তোকে ধোঁকা দিচ্ছে, তার তুইও ওর কথা মেনে আমাকেই ভুল বুঝছিস অরণ্য? মাত্র তিনটে মাস ওকে চিনিস তুই, আর আমি? তোর সাথে একসাথে খেলে হেসে বড় হয়েছি। তবু ওর কথা শুনে তুই আমাকে এভাবে কুকুরের মতো মারছিস? অথচ তুই আমাকে নিজের ভাই, নিজের বেস্টফ্রেন্ড মনে করতি এক সময়।

-নিজের বেস্টফ্রেন্ডের চরিত্র আমার থেকে ভালো কারো জানার কথা না। তোকে আমি ছোটোবেলা থেকে চিনি বললি না? কথাটা ঠিকই বলেছিস রিশাদ। তুই কি করতে পারিস, না পারিস আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আর তুই আমার বিষয়ে কতোটা জেলাস সেটা এতোগুলো বছর তোর সাথে চলে বেশ ভালোই জানি আমি। নতুন করে সেসব হিসেবের খাতা আমার খুলে দেখতে হবে না। বাট এবারের কাজটা কি করলি? তোর সাহস হয় কি করে অনুর দিকে বাজে নজর দেয়ার? রাগের মাথায় একদিন ওর গালে একটা চড় বসিয়ে সেই কাজের অনুশোচনা আমি আজকের দিনটা পর্যন্ত করছি। আর তুই কিনা------! তোর সাহস হয় কি করে অনুকে টাচ করার? ওর ঘাড়ের কাছে তোর দাঁতের--। এই ছোটো ভাই বোনের সামনে আমি কি বলতে পারি বল? ওকে ব্ল্যাকমেইল করে রেইপ করতে চেয়েছিলি? নাকি ভয় দেখিয়ে নিজের ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে পরকিয়া করতে চেয়েছিলি? কোনটা বলবো? 

অরণ্যের কথাগুলো বদ্ধ ঘরে রীতিমতো বিস্ফোরণের মতো সবার কানে গিয়ে লাগলো। অরণ্য রাগী এটা সবাই ভালো করেই জানে। তাই বলে অযথা ছেলেমানুষি কারণে যে রাগ করে না সেটাও কাজিনদের জানা কথা। কিন্তু রিশাদ! রিশাদের এমন কাজ মেনে নিতে কষ্টই হচ্ছে সবার। এমন কি তাহিয়ারও! গতকালও তো সবাই মিলে ওরা কত হাসি তামাশা করে আড্ডা দিয়েছে! আর আজ যা শুনছে তাতে কার কথা বিশ্বাস করবে, আর কার ভুল হয়েছে এটা ভাববে? 

-তোর অফিসের ব্রাঞ্চে ইম্পরট্যান্ট মিটিং ছিল বলেছিলি সবাইকে তাই না? তোর বসের নাম্বারটা দে। উনাকেই কল করে সবার সামনে ক্লিয়ার করে দিচ্ছি এখনি। নাম্বারটা দে তো রিশাদ?

সবার ভাবভঙ্গি দেখে এতোক্ষণে নিজের রাগটা কিছুটা সামলে নিয়েছে অরণ্য। সরাসরি প্রমাণ না দিলে বাকিদের মনে দোটানা থেকে যাবে আজীবনের মতো। অনুও হয়তো সবার সামনে অপরাধীর মতোই মুখ লুকিয়ে নিতে হবে। কিন্তু নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে বিনা অপরাধে এতোটা শাস্তি পেতে তো দিবে না অরণ্য। এবারে তো কিছুতেই নয়। এদিকে অরণ্যের হুট করে একের পর এক প্রশ্নবানে জর্জরিত দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে রিশাদ। রুমে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের মুখভঙ্গি বলে দিচ্ছে অরণ্যের পাল্লাটাই ভারি আজকের বিচার সভায়। আরো একবার হেরে যাচ্ছে টের পেয়ে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে রিশাদের। এতো রাগ যে চোখটা বারবার পাশের ওভারড্রবের উপরের ফ্লাওয়ারভাসটার দিকে চলে যাচ্ছে। হুট করেই একটা কান্ড করে বসলো রিশাদ। বিদ্যুৎ গতিতে ফুলদানিটা তুলে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মাথা বরাবার বসিয়ে দিল কাঁপা হাতেই। ধরা যেহেতু পড়েছেই ভদ্রতার মুখোশ টেনে আর কি দরকার! যুদ্ধটা নাহয় এবার সামনাসামনিই হোক। এসব নাটকে আর পোষাচ্ছে না এমনিতেও রিশাদের। এবার যুদ্ধ হোক মুখোমুখি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন