সংসার - পর্ব ০৭ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


১৩!! 

দেখতে দেখতেই যেন দুটো দিন কেটে গেছে। এই দুটো দিনে অনুর উপর দিয়ে যে কি গেছে বেচারি নিজেও জানে না। বেচারি কাজ করবে কি, অরণ্যের থেকে পালাতে পালাতেই মেয়েটা কাহিল হয়ে গেছে। অরণ্যও নাছোড়বান্দা। অনুকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে আবার যদি ফ্লোরে ঘুমাতে দেখে ওকে তাহলে কি হবে সেটা অরণ্য নিজেও জানে না। অরণ্যের এই সাংঘাতিক রকমের হুমকির পর ফ্লোরে ঘুমানোর সাহস অনামিকা দেখাতে পারে নি। অবশ্য ভয়ের চেয়ে তাহিয়ার জোরাজুরিতেই আর রান্নাঘরের ফ্লোরে থাকা হয়নি অনুর। অরণ্য আবার ঘুমের মধ্যে রুমে নিয়ে যাবে এই ভয়েই এতো দিন পর তাহিয়ার রুমে গিয়েই লুকিয়েছে মেয়েটা। এতো সহজে এই লোকটাকে তো মাফ করবে না অনু। কিছুতেই না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে নিজের কাজ করছিল অনু। ভদ্রলোক অফিস থেকে আসার আগেই নিজের কাজগুলো গুছিয়ে নিয়ে পালাতে হবে কথাটা ভেবেই ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো মেয়েটার। অবশ্য বেশিক্ষণ অনামিকার হাসিটা স্থায়ী হলো না। কেমন এক্টা গা শিরশিরে অনুভূতি জাগছে মেয়েটার। এই অনুভূতিটা এর আগে কখনো হয়নি অনামিকার। গা ঘিনঘিন করা অনুভূতিটা ধীরে ধীরে আরো তীব্র হয়ে যেন জেঁকে ধরতে চাইছে অনুকে। কেন এমন লাগছে সেটা দেখার জন্যই চট করে পিছনে ফিরতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো মেয়েটার।

অন্যদিকে বাড়িতে কাজিনেরা এসেছে শুনেছে দুপুরের আগেই বাড়িতে ফিরে এসেছে অরণ্য। সব কাজিনরা মিলে হুট করে প্ল্যান করে সারপ্রাইজ দিতে বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছে অরণ্য কি আর অফিসে বসে বোরিং টাইম কাটাবে? বাড়িতে এসেই সবাইকে ড্রইংরুমে বসে আড্ডা দিতে দেখে অরণ্যও জয়েন করলো। এদের মধ্যে দু তিনজন কাজিন অরণ্যের বিয়ের সময় আসতে পারে নি। কেন আসতে পারে নি সেসব ব্যাখ্যা করতে করতে কয়েক শ বার সরি ফেলেছে অরণ্যকে বেচারা ছেলেগুলো। অরণ্য এক এক করে সবাইকেই জড়িয়ে ধরে নিজেও এসে সবার সাথে সোফায় এসে বসে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে ভ্রু কুঁচকালো।

-কি রে? গেট টুগেদার করছিস ভালো কথা। রিশাদ এবারেও মিসিং কেন? ওকে জানাস নি তোরা? আমার বিয়েতেও ওর অফিসে শিপমেন্ট চলছে বলে আসে নি, এবারও কি সেইম কেইস? নাকি তোরা ইচ্ছে করে বেচারাকে খবর দিস নি?

-আরে কি বলো ভাইয়া? রিশাদ ভাইয়া তো এসেছে। আন্টির সাথে দেখা করতে গেছে।

-ভাইয়ের চেয়ে আন্টি বেশি হয়ে গেল তাহলে? বাহ! ভালো তো।

-ব্রো! তুই কবে থেকে এমন সেন্টি খেতে শুরু করেছিস? আমাদের অনামিকা ম্যাডাম দেখছি রাফ এন্ড টাফ ভাইটাকে একদম বদলে দিয়েছে দেখছি। ব্যাপার কি ব্রো? হুম হুম? বলো বলো?

ড্রইংরুমের সামনে থেকে রিশাদের গলা শুনে অরণ্যও হেসে উঠে এসে রিশাদকে জড়িয়ে ধরলো। রিশাদও শক্ত করে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে পুরোনো দিনের বন্ধুত্বের স্মৃতিটা তাজা করে নিল। একটু পরে অরণ্য আর রিশাদ পাশাপাশি সোফায় এসে বসতেই তাহিয়া আর অনামিকা দুজনেই ট্রে তে করে নাস্তা নিয়ে এসে টি টেবিলের উপরে রেখে দাঁড়ালো। তাহিয়া রিশাদের মাথায় হালকা করে একটা গাট্টা দিয়ে ছুটে এসে অনামিকার পিছনে এসে লুকালো। রিশাদ মুখ ঘুরিয়ে তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি দিল।

-একবার তোকে ধরতে পারি রে তাহু, এতো বছরের সব মারামারির শোধ একসাথে তুলবো দেখিস। আমার সাথে লাগার মজা টের পাইয়ে দিবো দেখিস। খালি একবার ধরতে পারি।

-এহ! ধরতে পারবি? তুই? আমাকে? হি হি। তুই আর অরণ্য ভাইয়া কেউ জীবনে আমাকে ধরতে পেরেছিস যে মজা দেখবি বলছিস? উল্টো প্রত্যেকবার তোদের পিঠেই ঢুসঢাস মাইর লাগাই আমি। হি হি। হা হা।

-কথায় আছে চোরের দশদিন আর গৃর্হস্থের এক দিন। ওই একদিনই যথেষ্ট তাহুবেবি। তোর যত বাচ্চামি সব সোজা হয়ে যাবে একদিনে। ওয়েট কর। সপ্তাহ খানেক তো আছি এবারে। টের পাবি রিশাদ কি চিজ।

-আহা! কি চিজ মাইরি তোমরা! জানো ভাবি? রিশাদ ভাইয়া আর অরণ্য ভাইয়া একেবারে জানের জান প্রাণের প্রাণ বন্ধু ছোটোবেলা থেকে। ছোটোবেলায় আমরা একদিনে বড় আন্টিদের বাড়িতে চলে যেতাম, আরেক ঈদে রিশাদ ভাইয়া আর প্রভা চলে আসতো আমাদের বাড়িতে। কি মজা যে হতো। এখন বড় হয়ে সবাই নিজের নিজের কাজ নিয়ে এতো বিজি যে রিশাদ ভাইয়া তো তোমাদের বিয়েতে আসারই সময় পেল না। হাহ।

-ভাবির সামনে টিজ করছিস রে তাহু? নতুন জব, প্রথমবার শিপমেন্টের সব দায়িত্ব আমার উপরে ছিল। কোন মুখে ছুটি চাইতাম বল? তবু জাস্ট বিয়ের দিনটাতে ছুটি চেয়েছিলাম। সেটাও পাই নি। আর এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার আফসোসের সীমা নেই। আর তুই টিজ করছিস আমাকে? 

-আজীবন টিজ করবো। নিজের ভাইয়ের, নিজের বেস্টফ্রেন্ডের চেয়ে সামান্য একটা চাকরি বড় হয়ে গেল তোমার কাছে? ছি ছি ছি রিশাদ ভাইয়া? এই নাকি তোমরা জানের জান দোস্ত একজন আরেকজনের।

-আহা! ঘরে বসে খাও দাও আর ঘুমাও তো বোন তাই মজাতেই আছো। কি সুন্দর কথা তার! সামান্য একটা চাকরি! এদিকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে ঘরে বেকার যে বসে ছিলাম, রীতিমতো নিজেকে গুড ফর নাথিং মনে হতো। দিন দিন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম। আর তুই আছিস সামান্য একটা চাকরি নিয়ে----। অরণ্য? তাহুর বরকে বলিস তো ওর স্টাডি কমপ্লিট হলে জবের জন্য এপ্লাই করাতে। তখন টের পাবে মনা আজকালকার বাজারে জব কি সোনার হরিণের নাম।

-বাহ রে বাহ! একে তো নিজে ভাইয়ের বিয়েতে আসে নি এখন এসেও আমার জীবন তেজপাতা করার প্ল্যানিং শুরু করে দিয়েছে বজ্জাতটা। আমার কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে তোমাদের মতো ফাইলের মধ্যে ডুবে থাকবো? হুহ। এই ভাইয়া খবরদার জবের এপ্লাই টেপ্লাই করতে পারবো না আমি। জব করতে হলে বিয়েই করবো না ধুরো।

তাহিয়া আর রিশাদের টম এন্ড জেরি টাইপের ঝগড়া শুনে অরণ্য আর বাকি কাজিন সবাই হেসে ফেলছিল। অরণ্য স্ন্যাক্সসের প্লেটগুলো হাতে হাতে বাকিদের তুলে দিয়ে অনামিকার দিতে তাকাতেই একটু অবাক হলো। তাহিয়া অনামিকার পিছনে লুকিয়ে অনামিকার কাঁধ জড়িয়ে রিশাদের সাথে দুষ্টুমি করছে। তাই অনামিকার পাংশু মুখটা মেয়েটা খেয়াল করে নি। কিন্তু অনুর এমন রক্তশূন্য মুখটার দিকে চোখ পড়তেই অরণ্য চোখের ইশারায় অনুকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। অনামিকা হালকা করে মাথা নাড়িয়ে জানালো কিছু হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে স্ন্যাক্সস শেষ করতে করতেই লাঞ্চের টাইম হয়ে গেছে দেখে অনামিকা রান্নাঘরের দিকে যেতেই অরণ্যও ট্রে টা নিয়ে রান্নাঘরে এসে হাজির হয়েছে। অরণ্য ট্রে টা রান্নাঘরের কাউন্টারের উপরে রাখার সময় হালকা শব্দ হতেই অনামিকা রীতিমতো চমকে উঠে অরণ্যের দিকে তাকালো। অনামিকার এমন অদ্ভুত বিহেভে অরণ্য এবারে কিছুটা অবাকই হলো। অরণ্য একপা এগিয়ে এসে অনামিকার কপালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে দেখলো জ্বর আছে কিনা। 

-অনু? কি হয়েছে? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? রুমে গিয়ে রেস্ট করো তুমি। আমি, তাহিয়া মা এদিকটা সামলে নিতে পারবো। তুমি যাও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো?

-না না। আমি-আমি ঠিক আছি। আপনি-আপনি যান। কাজিন-কাজিনদের সাথে গিয়ে বসুন। আমি ফারহা, তাহিয়া সবাই মিলে এদিকটা সামলে নিব। 

-অনু? জ্বর তো নেই। বলবে তো কি হয়েছে? মুখটা কেমন শুকনো লাগছে? কি কষ্ট হচ্ছে বলবেও না মেয়েটা, রেস্ট করতে বলছি সেটাও শুনবে না। আমার কোনো কথাই তুমি শুনবে না এটাই পণ করেছ না তুমি? এক্ষুণি বলো আমাকে কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? নাকি অন্য কোনো প্রবলেম?

-আসলে--অরণ্য? আপনাকে একটা কথা--একটা কথা বলার ছিল-----।

-হ্যাঁ অনু। বলো না কি হয়েছে? 

অরণ্য অনুর দিকে আরেক পা এগিয়ে এসে অনু কি বলছে শোনার চেষ্টা করলো। মেয়েটার শুকনো মুখটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন তোলপাড় করছে অরণ্যের। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার কথাটা ভেবে আবার অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে কি হয়েছে বলার ইশারা করতেই রান্নাঘরের দরজার বাইরে কয়েক জনের ধাক্কাধাক্কি আর হাসাহাসির শব্দ শুনে অনামিকা আর অরণ্য দুজনেই পিছন ফিরে তাকিয়েই রিশাদ আর বাকি কাজিনদের দেখে অরণ্য একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালো সবার দিকে।

-ব্যাপার কি? তোরা এখানে কি করছিস? একজন পারলে আরেকজনের গায়ের উপরে উঠে যাচ্ছিস! কাহিনী কি তোদের?

-ব্রো দেখছি তোকে। দেখছি কিভাবে আমাদের লায়ন কিং অরণ্য বউয়ের পিছু পিছু ঘুরছে। ভাবিইই? কি জাদু করেছেন বলেন না প্লিজ? অরণ্যকে বশে আনতে পেরেছেন মানে যে কাউকেই বশে আনার ক্ষমতা আপনার আছে। আমাদেরকেও একটু শিখিয়ে দিন না প্লিজ? বসকে বশে আনতে সুবিধা হতো তাহলে। শালা বুড্ঢা বহুত জ্বালায়। 

-এটা কি ধরনের কথা রিশাদ? শি ইজ মাই ওয়াইফ। বশে আনার কথা আসছে কোথা থেকে? আর তোরা এভাবে উঁকিই বা মারছিস কেন? 

-ওপস। সরি সরি। উনার ওয়াইফকে কেউ কিছু বলবা না ওকে? দেখছিলাম তোমরা দিন দুপুরে রান্নাঘরে রোমান্স করছ কিনা কাজের নাম করে?

-রিশাদ? 

-এই পালা পালা। অরণ্য বাবু ক্ষেপেছে। হা হা। কিন্তু ভাবি। বশ করার মন্ত্র শিখাতে হবে কিন্তু----।

অরণ্য রিশাদের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাতেই বাকিরাও রান্নাঘর থেকে ছুটে পালালো। অরণ্য আবার মুখ ফিরিয়ে অনামিকার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মেয়েটা উল্টো দিকে ঘুরে নিজের কাজ করছে। অরণ্য ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটা হাসি ফুটিয়ে অনামিকাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজলো। মেয়েটা চমকে উঠতেই অরণ্য ছোট্ট করে একটা চুমো এঁকে দিল অনুর ঘাড়ে। অনু বেচারি হাতের প্লেটটা হাতে নিয়েই কেঁপে উঠলো আরেকবার। সেটা টের পেয়ে অরণ্য হেসে অনুর হাত থেকে প্লেটটা হালকা করে টেনে কাউন্টারের উপরে রেখে দিল।

-কি হলো ম্যাডাম? কিছু একটা বলতে চাইছিলেন তো আপনি? না বলেই উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন যে? বলুন কি বলতে চাইছিলেন?

-আমমমম। কিছু না। আপনি ডাইনিংরুমে যান না? তাহিয়া আর ফারহা এক্ষুণি চলে আসবে খাবার টেবিলে নেয়ার জন্য.....।

-হুম। আসলে আসুক। কি প্রবলেম? আমি তো যাচ্ছি না কোথাও। কে আসলো কে দেখলো আমার দেখার বিষয় না। আপনি বলুন কি বলতে চাইছিলেন?

-আমমমম। কিছু না। আপনার কাজিনরা আবার চলে আসবে।

-হুম আসবে। তো?

-যান না প্লিজ?

-নো ওয়ে ম্যাডাম। একবার নিজে বলতে চেয়েছিলেন, না শুনে তিনটা মাস বরবাদ করেছি। আবার একই ভুল করবো? মাথা খারাপ?

-আমি আপনাকে পরে বলবো প্রমিস। এখন কাজ করতে দিন প্লিজ?

-আমি কি আপনাকে কাজ করতে দিচ্ছি না নাকি? এতো বড় অপবাদটা দিতে পারলেন এই মাসুম বাচ্চাটার নামে? ছি ছি ছি অনু! তোমার কাছে এমনটা আশা করি নি।

-প্লিজ অরণ্য?

-আচ্ছা সরি। শরীর খারাপ লাগছে ম্যাডাম?

-নাহ। আমি ঠিক আছি। 

-কেমন ঠিক আছেন সেটা রাতে দেখে নিবো। আজকে কোথায় পালাবেন। হুম হুম। ওকে বাবা। তুমি কাজ করো। আমি যাই দেখি ডাইনিং টেবিলটা সেট করে আসি।

অনু কিছু বলছে না দেখে অরণ্য অনামিকার চুলে আলতো করে একটা চুমো খেয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে গেল। আর অনু ভাবনার জগতে হারাতে হারাতে ধীর হাতে কাজ করতে লাগলো। অরণ্যকে তো ওর অনেক কথা বলার আছে। অনেক অনেক কিছু। কিন্তু কথাগুলো অরণ্য কিভাবে নিবে সেটা ভেবেই অনুর ভয় হচ্ছে। ভিষণ ভয়। আরেকবার অরণ্যের রাগের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি আর অনামিকার একদমই নেই।

১৪!! 

-এই মেয়েটা গেল টা কোথায়? সারাদিন তো কাজই করে গেছে। এখন তো রুমে আসবে নাকি? বাড়ি ভর্তি মেহমান তবুও কিচেনেই থাকবে নাকি মেয়েটা? আজ তো তাহিয়ার রুমেও থাকতে পারবে না। সেখানে তো ফারহা আর প্রভা শুয়েছে আজকে। তাহলে?! এই মেয়েটাকে নিয়ে যে কি করি আমি! উফ! তাড়িতাড়ি এসো না বাবা? অনু?

নিজের মনেই কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুমটায় পায়চারি করছিল অরণ্য। রাতের খাবার টেবিলে ওরা সব কাজিনরা মিলে হৈ-হুল্লোড় করেই ডিনার করেছে। মা, তাহিয়া, ফারহা আর অনু সবার সাথে যোগ দেয় নি। তাই ডিনারের পর অনুর সাথে আর দেখাই হয়নি অরণ্যের। আরো বেশ রাত করেই সব কাজিনরা মিলে আড্ডা দিয়ে রুমে এসে অনুকে না দেখে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে অরণ্যের। মেয়েটা আজও রান্নাঘরে শুয়েছে? নাকি কিচেনে কাজ শেষ হয়নি সব চিন্তাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ছেলেটার। অন্যদিকে সারাদিনের হুটোপুটির পর এতো টায়ার্ড লাগছে যে রুমের দরজাটা খোলা রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে অরণ্য। অনুর কাজ শেষ হলে রুমে আসবে কিনা কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে ঘুম নামলো অরণ্যের। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে অরণ্য জানে না। মাঝরাতে ওর ঘুমটা ছুটে যাওয়ায় পাশে অনুকে না দেখে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো ছেলেটা। আজও রান্নাঘরের ফ্লোরে শুয়ে আছে দেখলে এই মাঝরাতেই মেয়েটার কপালে দুঃখ আছে কথাটা চিন্তা করে বিছানা ছেড়ে নামতেই বন্ধ দরজাটার দিকে চোখ পড়তেই থেমে গেল অরণ্য। ঘুমানোর আগে দরজাটা খোলাই রেখেছিল, স্পষ্ট মনে আছে অরণ্যের। তাহলে দরজাটা ভিতর থেকে লক করা কি করে? তাহলে কি অনু এসেছে? বিছানায় নেই, ওয়াশরুমে কি? ওয়াশরুমের দরজার কাছে গিয়েও বাইরে থেকে ওয়াশরুমের দরজাটা লক করা দেখে রীতিমতো চিন্তা হলো অরণ্যের। তাহলে কি বারান্দায় গেছে অনু? এতো রাতে বারান্দাতেই বা কি করছে মেয়েটা?

কৌতূহলী অরণ্য ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বারান্দার দরজায় হাত দিতেই টের পেল দরজাটা হালকা করে ভেজিয়ে দেয়া ছিল। রুমের ঘড়িটার দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখলো ঘড়িতে তিনটের কিছুটা বেশি বাজে। এতো রাতে বারান্দায় বসে আছে কেন মেয়েটা? দুপুর থেকেই খেয়াল করছিল অরণ্য অনুকে। মেয়েটা কিছু একটা নিয়ে ভিষণ আপসেট। কিছু একটা বলতে গিয়েও বারবার থেমে যাচ্ছে। কিন্তু কি সেটা? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বারান্দায় এসে অনুকে খুঁজে না পেয়ে বুকের ভিতরটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠলো অরণ্যের। একটা লকড রুম থেকে মেয়েটা কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? রুমেই নেই তো? নাকি দরজাটা আসলে লকড নয়? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রুমের দিকে পা বাড়াবে এমন সময় মেয়েটাকে খেয়াল করলো অরণ্য। দূরের ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় এতোক্ষণে দোলনায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা অনামিকার দিকে চোখ পড়লো অরণ্যের। মেয়েটাকে দোলনায় একদম ছোট বাচ্চাদের মতো পা ভাঁজ করে হাত জোড়ার উপরে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে হাসবে নাকি অবাক হবে নাকি রাগ করে মেয়েটাকে ডেকে তুলবে সেটাই ঠিক করতে পারলো না অরণ্য। অবশ্য ঘুমন্ত বাচ্চাদের মতো আদুরে মুখটা দেখে অরণ্য রাগ করতে পারলো না। অনুর দোলনার মুখোমুখি ফ্লোরে বসে ঘুমন্ত অনুর মুখটা কয়েক মিনিট দেখে আলতো করে অনুর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল অরণ্য। অনু একটু নড়ে উঠতেই অরণ্য তাড়াতাড়ি সরে আসতেই খেয়াল করলো অনু এই ছোট্ট ঝুল দোলনাতেও কত সহজে পাশ ফিরে উল্টোদিকে কাত হয়ে শুয়েছে। মেয়েটার এমন অদ্ভুত কাজে অরণ্য একটু শব্দ করে হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। কোনোমতে মুখে হাত দিয়ে হাসিটা চেপে অনুর চুলে হাত বুলিয়ে দিল অরণ্য।

-পাগলি একটা! এইটুকুন জায়গার মধ্যে আবার পাশ ফিরছে দেখো! সারাদিন কাজ করে কি খুব বেশি ক্লান্ত ম্যাডাম? এখানেই ঘুমাবেন? নাকি রুমে যাবেন আমার সাথে? 

আরো কিছুক্ষণ অনুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে আরেকবার ছোট্ট করে কপালে চুমো এঁকে দিল অরণ্য।

-আজ আর বিরক্ত করবো না ম্যাডামকে। আয়েশ করে ঘুমাচ্ছেন যখন এখানেই ঘুমান। রুমে না এসে বারান্দায় দোলনায় ঘুমানোর শাস্তিটা নাহয় কালের জন্যই তোলা থাক। এখন ক্লান্ত শরীরে ঘুমটা ভাঙ্গাতে কেন জানি ইচ্ছে করছে না। গুড নাইট ডিয়ার পাগলি বউটা। এতো ছোট্ট দোলনায় ঘুমাতে পারলে আপনার হাজবেন্ডের বুকে শুয়ে ঘমাতে অসুবিধা হবে না আশা করি। অবশ্য ঘুমের মধ্যে পড়ে কোমড় ভাঙ্গলে আমার দোষ নেই। রুমে না শুয়ে এখানে শোয়ার কিছু তো একটা শাস্তি পেতেই হবে ম্যাডাম।

কথাগুলো বলে হাসতে হাসতেই রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আবার ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল অরণ্য। ঘুমের মধ্যেও অনামিকার ঘুমন্ত মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠায় ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠলো অরণ্যের। অবশ্য সকালে ঘুম ভেঙ্গে অনামিকাকে না রুমে পেল অরণ্য আর না বারান্দায়। অরণ্যের ঘুম ভাঙ্গার আগেই যে মেয়েটা পালিয়েছে সেটা রুমের হালকা ভিড়িয়ে দেয়া দরজাটা দেখেই বুঝতে পারলো অরণ্য। ফ্রেশ হয়ে নিচে ডাইনিং রুমে এসে দেখলো সবাই গতকালের মতোই আড্ডা দিতে দিতে ব্রেকফাস্ট করছে। অনু আর তাইয়্যেবা জামান সবাইকে হাতে হাতে নাস্তা সার্ভ করছে। তাহিয়া, ফারহা আর প্রভাকে ডাইনিং টেবিলে দেখা গেল না। মেয়েগুলো বোধহয় এখনো ঘুমোচ্ছে। সবার দিকে একনজর তাকিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো একটা প্লেট নিয়ে। 

সবার ব্রেকফাস্ট করা শেষ হয়ে যেতেই সবাই যে যার মতো করে রেডি হতে চলে গেল। ছেলেরা সবাই মিলে আশেপাশের কয়েকটা জায়গায় ঘুরবে, সবাই মিলে বাইরে লাঞ্চ করবে, সারাদিন আর কি কি করা যায় এসব প্ল্যান করতে লেগে পড়েছে। অরণ্য দুপুরে সবার সাথে লাঞ্চের সময় মিট করবে এটা ফাইনাল হলো। অফিসে ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে, নইলে সে ও সবার সাথে জয়েন করতো। সবার প্ল্যান করা হয়ে গেলে সবাই যে যার মতো করে রেডি হতে চলে গেছে দেখে অরণ্যও রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালো। তাইয়্যেবা জামান আর অনামিকা দুজনেই হাতে হাতে প্লেট বাটি ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখছে দেখে অরণ্য হালকা করে গলা খেঁকারি দিল। তাইয়্যেবা জামান ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলেন।

-কি রে অরণ্য? কিছু বলবি নাকি? অফিসে যাবি না আজকে? 

-যাবো মা। কাউকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে আসলাম। বাড়ি ভর্তি কাজিনদের সামনে সিনক্রিয়েট না করলেই কি কারো চলছে না?

-সিনক্রিয়েট? কে সিনক্রিয়েট করছ? কার কথা বলছিস? আর তুই আজকাল এতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলছিস কেন? যা বলার ক্লিয়ারলি বল।

-ওকে। ক্লিয়ারলিই বলছি শোনো। আমাদের ঘরোয়া ঝামেলা বাকিদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার কি কোনো মানে আছে? অনামিকা ম্যাডাম আর আমার মধ্যে যে কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা চলছে এটা কি সবাইকে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে হবে?

-কি বলছিা তুই অরণ্য? আগা নেই মাথা নেই।

-আগা মাথা থাকবে না কেন? ম্যাডাম রুমে না থেকে এই রান্নাঘরের ফ্লোরে ঘুমাচ্ছে জানলে বাকি সব আত্মীয় স্বজনদের কান পর্যন্ত খবরটা পৌঁছাতে যে সময় লাগবে না এটা কি বুঝতে পারছ? সবাই কি ভাববে বলো তো মা?

-কি রে অনু? তুই কালও রান্নাঘরে শুয়েছিস? তোকে না বললাম রুমে যেতে?

অরণ্য আর তাইয়্যেবা জামানের কথাগুলো শুনতে শুনতে রীতিমতো ঘামছিল অনামিকা। শাশুড়ির প্রশ্ন শুনে কিছুটা থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করলো মেয়েটা এবারে।

-না মানে মা---। আসলে-----।

-ওকে জিজ্ঞেস করছ কেন মা? রুমে তো আমি ছিলাম। আমি জানি না ও রুমে এসেছিল কিনা? একবার ভাবো তো রাতে রান্নাঘরে শুয়েছে। কেউ হুট করে চলে আসতো যদি? কি ভাবতো সেটা নাহয় বাদ দিলাম। বাট একটা রিস্কও তো আছে নাকি? তাছাড়া ওরা সবাই তো ছেলে মানুষ নাকি? এটাও তো মাথায় রাখতে হবে নাকি? 

অরণ্যের কথাগুলো শুনে অনামিকার মুখটা শুকিয়ে গেল নিমিষেই। অরণ্যও নিজের কথাগুলো শেষ করে রুমের দিকে পা বাড়ালো। 

-আমি অফিসে যাচ্ছি মা। কাউকে বলে দিও আপাতত সবাই বাইরে যাচ্ছে। সন্ধ্যের আগে ফিরবে না। 

কথাগুলো শেষ করেই অরণ্য রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তাইয়্যেবা জামান হাতের শেষ প্লেটটা মুছে নিয়ে র‍্যাকে রেখে অনামিকার দিকে তাকালো। অনামিকাও ততক্ষণে নিজের হাতের কাজটা শেষ করে ফেলেছে।

-হয়েছে। এদিকে এখন আর কোনো কাজ নেই অনু। রুমে যা। কিছুক্ষণ রেস্ট করে নে। আমি পরে ডেকে নিবো তোকে।।

-মা? এখন? তাহিয়ারা তো ওঠে নি এখনো। একটু পরেই উঠে যাবে।

-সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না মা। আমি আসার আগেই রান্নাঘরে এসে কাজ শুরু করে দিয়েছ। দেখেছি আমি। সেই কোন সকালে উঠেছ। কত রাতে ঘুমিয়েছিলে খেয়াল আছে? তাহিয়ারা এতো তাড়াতাড়ি উঠবে না। আর উঠলেও আমি তো আছি। আর নইলে ওরা নিজেরাই নিয়ে খেতে পারবে। তুমি চুপচাপ রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট করো যাও।

-মা? এখনই যাবো?

-হ্যাঁ এখনই যাবে। অরণ্যের কি লাগবে দেখো গিয়ে। কিছু একটা বলতে এসেছিল ছেলেটা। আমাকে দেখে তো বলতে পারলো না। যাও দেখো রুমে অপেক্ষা করছে। কোনো কথা না। যাও?

তাইয়্যেবা জামানের রীতিমতো ধমক শুনে ধীর পায়ে রুমের দিকেই পা বাড়ালো অনামিকা। আজ যে কপালে কি আছে কে জানে! অরণ্য তো জানে না রাতে রুমেই ছিল অনামিকা। কথাটা ভাবতে ভাবতে হাত পা ঘামতে শুরু করেছে অনামিকার। অথচ বেচারি এটা জানে না অরণ্য ইচ্ছে করেই নাটকটা করেছে। দুজনের এই লুকোচুরি খেলা কোনদিকে মোড় নেয় দেখাই যাক না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন